নির্বাচিত নিবন্ধ
বু’আলী শাদলী
তালিবান সংবাদ ও আমাদের রক্তের বন্ধন
কিউ, জামান লস্কর
আজ থেকে পনের বছর আগে বু’আলী শাদলী আমাকে বেওকুফ বলেছিলো। শাদলীর কথা কখনো ভুলিনি, যতদিন বেঁচে থাকবো মনে থাকবে, শাদলীকেও মনে থাকবে।
জিদ্দার নতুন বিমানবন্দরে তখন কাজকর্ম শুরু হয়েছে মাত্র। জিদ্দাকে বলা হতো পৃথিবীর বৃহত্তম বিমানবন্দর। এলাকার বিশালতার জন্যই সম্ভবতঃ এ রকম বলা হতো। নানা কারণে বৈশিষ্ট্যময় ছিলো বিমানবন্দরটি। দু’ভাগে বিভক্ত বিশাল হজ্জ টার্মিনাল নির্মাণ করেছিলেন আমাদের এ দেশেরই এক প্রতিভাবান সন্তান। পনের বছর হয়ে গেলো, এখনো দ্বিতীয় অংশটি ব্যবহার করার দরকার হয়নি। বহু দূর প্রান্তে রয়েছে সুদৃশ্য রয়েল টার্মিনাল, আরেক প্রান্তে সাউদিয়ার নিজস্ব সাউথ টার্মিনাল। মাঝখানে বহির্দেশীয় আন্তর্জাতিক টার্মিনাল। সবেমাত্র উড়োজাহাজ উঠানামা করছে; অনেক অফিসে প্রয়োজনীয় আসবাপত্র এখনো পৌঁছেনি, কিছু কিছু ব্যবস্থা সাময়িকভাবে চলছে। মসজিদ তখন শুধুমাত্র সাউথ টার্মিনালেই নির্মিত হয়েছে'।
সপ্তাহের সাতদিনই কাজ করতে হয়। তাই শুক্রবার সকালে অফিসে গিয়েই ভাবছি, জুমার নামাজের কী ব্যবস্থা আছে জানতে হবে। আমার সব সমস্যার সামাধান দিচ্ছে শাদলী। অতএব তাকেই এখন প্রয়োজন। শাদলীদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ইতিমধ্যে বেশ ঘনিষ্ট হয়ে উঠেছে। আমরা বাংলাদেশ থেকে আর ওরা তিউনিস থেকে এসেছে। কর্মস্থল এক, থাকতে দেয়া হয়েছে একই বাড়ীতে। শাদলীর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তার কারণ, শাদলী বেশ ভালো ইংরেজী বলতে পারে। তিউনিস বিমানের এই চৌকস কর্মকর্তাটি পৃথিবীর বুহুস্থানে যাতায়াত করেছে। তার সাথে কথা বলে আমিও বেশ স্বাচ্ছন্দ অনুভব করছি। আরবী না বলতে পারার বিপদ থেকে অন্ততঃ রেহাই পাওয়া যাচ্ছে। শাদলীর সাথে দেখা হওয়া মাত্রই বললামঃ দোস্ত, আজ শুক্রবার, জুমার নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সে বললোঃ কোনো চিন্তা নেই। যেখানেই থাকো আজানের সময় হলে অফিসে চলে এসো। আমি অপেক্ষা করবো। একসাথে নামাজ পড়তে যাবো।
যথা সময়ে শাদলীকে অফিসে পাওয়া গেলো। সে আমাকে নিয়ে টার্মাক অঞ্চলে নেমে গেলো। যেখানে ডিউটি কারগুলি পার্কিং করা ছিলো, একটি গাড়িতে আমাকে নিয়ে এপ্রোন ট্রাক ধরে গাড়ী চালাতে শুরু করলো। গাড়ী সাউথ টার্মিনালের দিকে চললো, বুঝলাম সাউদিয়ার জামে মসজিদে জুমা পড়তে হবে।
এয়ার ফিল্ডের ভিতর দিয়ে একে-বেঁকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। শাদলী তার স্বভাবসুলভ গল্প জুড়ে দিলো। প্রথমেই এক অভাবিত প্রশ্নঃ ‘দোস্ত, জুমার নামাজ কি নিয়মিত পড়ে থাকো?’
এ রকম প্রশ্ন ব্যক্তিত্বে আঘাত করে। তবু কিছু মনে না করে জবাব দিলামঃ ‘হ্যাঁ, তা তো পড়ি’।
এবার দ্বিতীয় প্রশ্নঃ ‘তোমাদের দেশে জুমার খুতবা পড়া হয়?’
এবার আর সহ্য করা যায় না। বেশ রাগান্বিত হয়েই বললামঃ ‘কী বলতে চাও তুমিঃ জুমার নামাজ খুতবা ছাড়া হয় নাকি? খুতবা তো জুমার অংশ।’ শাদলী নির্বিকার। এবার আরো কঠিন একটি প্রশ্ন করে বসলোঃ ‘আচ্ছা, তুমি কি এখানে এসেই নিয়মিত নামাজ পড়ছো, নাকি আগেও পড়তে?’
আমার মেজাজ খুব বিগড়ে গেলো। একজন বয়ঙ্ক মানুষকে এ রকম প্রশ্ন করা ঔদ্ধত্যের শামিল। চোখ রাঙিয়ে বললামঃ ‘তোমার সন্দেহ হয় নাকি? দেখো, আমরা তোমাদের মতোই একটি মুসলিম দেশের অধিবাসী। শিশু বয়সেই আমাদেরকে নামায-কালাম শিখানো হয়। আমরা তোমাদের চেয়ে আমল-আকিদায় কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই।’
শাদলী তারপরও নির্বিকার। আপন মনে গাড়ী চালাচ্ছে, সামনের দিকে তাকিয়ে।
আবার প্রশ্নঃ ‘তুমি কি কুরআন পড়ে থাকো?’
তাজ্জব ব্যাপার এ সব কী বলছে? আমার আত্মমর্যাদাবোধ যেন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। অনেকটা তিরস্কারের ভংগিতেই জবাব দিলামঃ ‘তোমার কথায় মনে হচ্ছে, কুরআন আমাদের জন্য নাজিল হয়নি!’ ওকে একটা সমুচিত জবাব দেবার ইচ্ছা মনে খুব তাগিদ দিচ্ছিলো। বললামঃ ‘আমার সম্বন্ধে তোমার ধারণাটা যথোচিৎ নয় বলেই মনে হচ্ছে। আমাদেরকে তোমরা খুব কমই জানো। ঘনবসতির হিসাবে আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম জাতি। আল্লাহ পাকের কালাম আমাদের মাথার মুকুট, চোখের মনি। আমার জীবনের প্রথম পাঠই ছিলো কুরআনুল করীমের হরফ। খুব ছোটকালেই কুরআন শিখেছি। সেই অবধি আজতক কখনো কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন হইনি। অহংকার করে বলছিনা, পরিবারে এমনজনও আছে, যাদের প্রতিদিনের নিয়মিত অভ্যাস কুরআন পাঠ। সারা জীবনে কে কতবার কালামে পাককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছে হিসাব করা যাবেনা। মুখস্থ না করেও শুধু পড়তে পড়তে যতখানি মুখস্থ হয়ে গেছে তা শুনলে তুমি হয়তো এই রকম প্রশ্ন করতে উৎসাহী হতে না।
আমার আত্মপ্রশংসা সম্ভবতঃ বেশ উঁচুমাত্রায় চলে যাচ্ছিলো। আত্মসম্মানবোধ, রাগ, প্রতিউত্তর ও শ্লাঘা আমাকে অনেকটা বেসামাল করে তুলেছিলো। আওয়াজও বোধ করি বেশ জোর পেয়ে যাচ্ছিলো।
কঠিন ব্রেক কষে গাড়ী মাঝপথে থেমে গেলো। তীব্র চাহনি নিক্ষেপ করে শাদলী আমার দিকে তাকালো এবং অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বললোঃ ‘বন্ধু! তুমি একটি আস্ত বেওকুফ।’
তারপর ধীরে ধীরে নির্মম কথাগুলো বলে যেতে থাকলোঃ ‘তুমি বললে, জুমার খুতবা নিয়মিত শুনে থাকো, অথচ খুতবা হয় আরবীতে; নামাজ পড়ছো যথারীতি, সেই নামাজের ভাষাও আরবী; কুরআন পড়ছো সারাজীবন, এই কুরআনও আরবী; অথচ আমি যখন তোমার সাথে আরবীতে কথা বলি, তখন তুমি হয়ে যাও বোবা; এমনভাবে তাকাও যেন বধির; হয়ে যাও পাথর, স্থবির৷ বন্ধু, তুমি বেওকুফ যদি না হও তবে কী?’
আমি অনুভব করছিলাম, আমার সমস্ত অন্তর বাহির যেন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড এক বেদনা বুঝি অনুভব করছিলাম হৃদপিন্ডের কোনো এক প্রান্তে। কখন জানি চোখের পাতা নীরবে নিন্মমুখী হলো। শাদলী বুঝি অনুভব করতে পারছিলো পরাজিত চোখের অবনত দৃষ্টিকে, তাই আস্তে করে হাত রাখলো আমার হাতে। মনে হলো আমার অন্তরের তপ্তবেদনা দু’চোখের ভুরুগুলোকে ভিজিয়ে দিয়েছে নিদারুণ অভিমানে।
হায়রে দুর্ভাগা জীবন! মানবজীবনের এমন ব্যর্থতার কী কৈফিয়ত থাকতে পারে? আল্লাহপাকের একখানি মাত্র কিতাব, তাকে ছুঁতে পারি, তাকে দেখতে পারি অথচ তার কথা বুঝতে পারিনা। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম করে জন্মিয়েছেন চোখ দিয়েছেন তাই দেখতে পেরেছি, কান দিয়েছেন তাই শুনতে পেরেছি; অন্তর দিয়েছেন কিন্তু সেই অন্তর দিয়ে তার কথাগুলি না বুঝেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছি। আল্লাহ তায়ালা প্রতিদিন নতুন করে বান্দার সাথে কথা বলছেন না। একবারই সব বুঝিয়ে বলে দিয়েছেন এবং তার নবী (সাঃ) সেই কথাগুলি লিপিবদ্ধ করে আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। দয়াময়ের সেই দয়ার্দ্র কথাগুলি না বুঝে নির্বোধের জীবন যাপন করছি। জ্ঞান-বুদ্ধির কোনো পথই আমাদের অজানা থাকে না। কঠিন অংকশাস্ত্র পর্যন্ত আমাদের আয়ত্ব হয়ে যায়। পাটিগণিত, বীজগণিত প্রাথমিক জীবনের পাঠযসূচীতেই স্থান পেয়ে যায়। জীববিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, ভূবিদ্যা, সমাজবিদ্যা, জোতির্বিদ্যা, রসায়ন শাস্ত্র, ইতিহাস শাস্ত্র,অংকন শাস্ত্র, নির্মাণ শাস্ত্র, কলা শাস্ত্র, ইত্যাদি কিছুই তো আমাদের আয়ত্বের বাইরে নেই। বিচিত্র বিচিত্র নীতির অনুসরণ করে চলেছি মহানন্দে। পৌরনীতি, রাজনীতি এসব তো দুর্বোধ্য নয় মোটেই। এমনকি দুর্নীতিও বুঝি সুযোগ-সুবিধা মতো। বুঝি না শুধু আমার মালিকের কথা, আমার প্রভূর কথা, আমার প্রিয়তম মাবুদের কথা। বুঝিনা সেই কথার অর্থ, যা আমার ইহজীবনের জীবন-বিধান; সেই কথার অর্থ বুঝিনা, যেকথা আমার পরকালের বার্তা বহন করে এনেছে। শাদলীর কথায় তর্ক করতে পারতাম, কিন্তু বিবেক তা করতে দেয়নি। সে তো ভালবেসেই আমাকে নির্বোধ বলেছে। এতো বিবেক-বুদ্ধির দাবী যে, আমি আমার প্রভুর কথার প্রতিটি অক্ষর স্পষ্ট করে শুনবো, পড়বো ও বুঝবো এবং তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। দয়াময় কুরআনুল করীমকে মানুষের জ্ঞানবুদ্ধির আওতাধীন করে নাজিল করেছেন, এক আশ্চর্য সহজ ভাষায় লিপিবদ্ধ করিয়েছেন। জগতে শিক্ষিতের দাবীদার হয়ে মূর্খ ও অজ্ঞতার পরিচয় দিলে শাদলীর মতো বন্ধু তিরস্কার করে বেওকুফ বলবে এটাই তো স্বাভাবিক।
এই রকম তিরষ্কার ও অপমান জীবনে এটাই প্রথম নয়। পিতাকে হারিয়ে যেদিন শাব্দিক অর্থে এতীম হলাম, সেইদিনও আমার কপালে আরেক তিরষ্কার নসীব হয়েছিলো। হাসান নামে এক মিশরী বন্ধু তখন বাংলাদেশে সফরে এসেছিলো। আল্লাহর পথের এই পথিক পথ চলতে চলতে একদিন বন্ধু হয়ে গিয়েছিলো। বন্ধুর দুঃসংবাদ শুনে ছুটে এলো। জানাজার জন্য কফিন ধরে সেও মসজিদের দিকে চললো। জামাত শেষে জানাজার জন্য যথারীতি কফিন মসজিদের চত্বরে আনা হলো এবং আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে দেয়া হলো। হাসান তখনো কিছু বুঝে উঠতে পারেনি, কিন্তু যখনি সে দেখলো, আমি সামনের কাতারে সমবেত মুসল্লিদের সাথে ইমামের পিছনে দাঁড়িয়েছি, তখনি সে তড়িৎ ছুটে এলো আমার কাছে এবং প্রায় টানাটানি শুরু করলো আমাকে সামনে ইমামের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি যতই বলি, জানাজা পড়াবেন ইমাম সাহেব, ততই সে অস্থির ও উত্তেজিত হয়ে আমাকে বলে, তুমি কেনো পড়াবে না? আরবী ভাষী হাসানের কথা সবাই বুঝতে না পারার কারণে সে যাত্রা রক্ষা পেলাম, ইমাম সাহেবই জানাজা পড়ালেন। অভিমানী হাসান জানাজা আদায় করে আমাকে কিছু না বলেই অদৃশ্য হয়ে গেলো।
হাসান আমার উপর অভিযান করেছিলো। তিরষ্কার করেছিলো। আমি চুপ করেই ছিলাম। আমি জানি, হাসানের দেশেও ইমাম ও আলেম বুজর্গরা জানাজার নামাজে ইমামতি করে থাকেন। তবে পিতামাতারা যোগ্য সন্তানও রেখে যান জানাজার নামাজ থেকে শুরু করে পরবর্তী কালে তাদের রুহের প্রতি সদকায়ে জারিয়ার পূণ্যসমূহ পাঠানোর জন্য। হাসান এমনটাই আশা করেছিলো আমার কাছ থেকে। কিন্তু সমাজের নিয়মনীতি অথবা আমার পলাতক মন আমাকে সাহস যোগাতে পারেনি পিতার শেষকৃত্যে যোগ্য সন্তানের ভূমিকা পালন করতে।
আমি আমার বাবার জানাজা পড়ালে অনেকেই সন্তুষ্ট হতো। কিন্তু আমরা দ্বীন থেকে পলাতক হয়ে দ্বীনদারী করি। দ্বীনের পথ একদিকে আমরা আরেকদিকে। আল্লাহপাক সর্বশ্রেষ্ঠ, অনাদি অনন্ত, মহা-মহীয়ান, পরম পরওয়ারদিগার, নুর-আলা-নূর। তার নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আখেরী নবী, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, যিনি নবীদেরও নবী। দয়াময়ের কিতাব পবিত্র কুরআনুল করীম মানুষের জন্য একমাত্র জীবন বিধান। আল্লাহর দ্বীন ইসলাম, তাঁরই মনোনীত দ্বীন। কার সে পূণ্যের ফল জানি না, দয়াময়ের এই অসীম দয়া কেনো হলো জানি না, কী কারণে এই মেহেরবানী হলো জানিনা, তবু এটাই সত্য যে, আমরা এই দ্বীনকে পেয়েছি এবং মুসলিম হয়েছি। কেউ চেয়ে পায় কেউ না চাইতেই পায়। কেউ সর্বস্বের বিনিময়ে পায় কেউ জন্মগ্রহণ করেই পায়। না চাইতে পাওয়া সম্পদ অমূল্য সম্পদ। এতবড় সম্পদ পেয়েও মিসকীনের মতো হাশর হবে এর চেয়ে দুঃখময় কথা আর কী হতে পারে। সে জন্যই এই নিয়ামতের দাবী হলো কুরবানী। এই সম্পদের বিনিময় হলো ন্যূনতম পক্ষে নিজের জীবন। যারা এই কুরবানী দেয়, জীবন দেয় তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক কী?
আসমানে বিদ্যুত চমকালে একজন আসার আলো দেখে, আরেকজনের অন্তর ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে উঠে। তালেবান আফগানিস্তানে বিদ্যুতের মতো চমকে উঠেছে; অনেকে সেই আলোতে পথ খুঁজছে, আবার আরেকদল মেষ শাবকের মতো ত্রাহি ত্রাহি রব তুলেছে। মুরগীর অসংখ্য বাচ্চার মতো দিগ্বিদিক ছুটে সবাইকে পেরেশান করছে।
বিংশ শতাব্দীর এই অন্ধকার পৃথিবীতে আফগানিস্তানের দ্বীনের আলো অনেকের চোখকে ঝলসে দিয়েছে, দিশেহারা করে তুলেছে। আবার অনেক মুমিন অন্তরকে দিয়েছে সান্ত্বনা। মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশ চুক্তি করে জোটবদ্ধ হয়েছে তালেবানের সম্ভাব্য হুমকি থেকে বাঁচার জন্য। ভোদকাওয়ালারা আপাততঃ চেসনীয়া নিয়েই বিপদে আছে; তালেবানযে একদিন দুনিয়াতেই ওদের কিয়ামত ঘটাবে, সেটা উপলব্ধি করার ফুরসতই এখনো পাচ্ছেনা। সুদূর এই বাংলাদেশের কাপালিকেরাও খুঁজে বেড়াচ্ছে, কোনো তালেবান এখানে এসে গেলো কিনা! আশ্চর্য! আল্লাহর দ্বীনের আলো যখন চমকে উঠে, তখন পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত সকল তাগুতের অন্তর কাঁপতে শুরু করে। অন্তরে দ্বীনের আলো আর অন্তরে শিখার আলো একজনকে মুমিন করে আরেকজনকে মুশরিক করে। হাজার মাইল দূরের দ্বীনের আলো সহ্য করতে পারেনা, কিন্তু অতি নিকটের শিখার আলোয় রাখীবন্ধন করে; আত্মার আত্মীয় পিতৃপুরুষের কোন পূণ্যের ফসল? প্রতিদিনই ছোটখাট তালিবান সংবাদ দুনিয়ার মানুষকে মানবতার স্বর্ণশিখরে আরেকবার আরোহন করার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করছে। আন্তর্জাতিক নারীবাদী সংগঠনগুলো অপবাদের ছল ছুতো খুঁজে মরছে আর তালিবান সরকার মেয়েদের সম্ভ্রম বজায় রাখতে নির্দেশ দিচ্ছে যে, অনুকূল পরিবেশ প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত চাকুরীজীবি মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে যাবেন না, তাদেরকে কর্মচ্যুৎও করা যাবেনা; অধিকন্তু সরকার তাদের নিজগৃহে বেতন পৌঁছে দেবেন বলে জানিয়েছেন। এমন অবিশ্বাস্য কথা শুনে নারী অধিকার সংরক্ষণকারীরা খুব নারাজ হলেন কী? চিত্রাংকন, চিত্র প্রদর্শন, মহান নেতাদের ছবি সংরক্ষণ ও অর্ঘ নিবেদন ইত্যাদির উপর তালেবান সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। মন্দীরা, মংগলপ্রদীপ ও অগ্নিশিখার পূজারীরা এইসব বিধিনিষেধের অর্থ বুঝেনা। মোহরাংকিত অন্তর চিত্রাংকনে বিভোর হবে এটাই তো কপালের লিখন হওয়া উচিত। সিজদাহকারীর কপাল এমন মসিলিপ্ত নয়। আল্লাহর জমীনে আল্লাহর আইনকে প্রতিষ্ঠা করার সৌভাগ্য সব জাতির হয়না। এজন্য চাই চরম ত্যাগ, কঠিন সংগ্রাম, রক্তাক্ত পথ পরিক্রমা। আফগানরা আজ যা পেতে যাচ্ছে, তা সেই রক্তের ফসল। প্রচুর রক্তপাতে জমীন আবাদ হয়েছে, এখন দ্বীনের ফুল ফুটছে, ফসল হবে, জগৎবাসী অনেক অবিশ্বাস্য বিষয় প্রত্যক্ষ করবে। অপরদিকে ইসলাম ও তালিবানের শত্রুরা হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরবে।
এটা কোনো বিস্ময়ের কথা নয় যে, বাংলাদেশের দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের তালেবানরা জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর পথে অন্য কোনো দেশের তালেবানের পাশে গিয়ে দাড়াবে। আল্লাহর বান্দাহ আল্লাহর পথের পথিক হয়ে স্থান থেকে স্থানান্তরে ছুটে যাবে। কিন্তু এতেও কোনো বিস্ময় নেই যে, এইসব পথে দুশমনরা মরণ ফাঁদ বিছিয়ে রাখবে-৬১০ খৃষ্টাব্দের পর মক্কায় যেমনটি হয়েছিলো। হিজরতের পর মদীনায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আজ বিংশ শতাব্দীর ঘটনা প্রবাহ একই ইতিহাস রচনা করে চলেছে। কুরআন, হাদীস ও কিতাব পড়ে তালেবান হয়ে যাচ্ছে, এদের ঠেকাও! মক্কায় মুশরিকদের মতো এদের উপর অত্যাচারে খড়গ চালাও অথবা মদীনার মুনাফেকদের মতো এদের শত্রুকে আহ্বান কর! অন্ততঃ কিছু একটা কর!! আমাদের সোনার সন্তানরা শহীদ হয়ে যাচ্ছে! আল্লাহর হুকুম পালন করতে গিয়ে এরা আমাদের অমুসলিম ভাইদের উপর অস্ত্রধারণ করেছে! বিশ্বাস নেই, এখনি নিশ্চিহ্ন করে না দিলে কোনোদিন হয়তো আমাদের উৎসের প্রবাহে এরা চড়াও হবে। একই ধারায় বিলীন হয়ে যে স্রোত আমরা বহমান করছি, তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে এইসব তালেবানের দল।
কিন্তু ইতিহাসের অসংখ্য পুণরাবৃত্ত ইতিহাসের পাতায়ই লিখা আছে। মক্কা বিজয়ের দিন মক্কাবাসী টু-শব্দটি করতে পারেনি। মদীনার মুনাফিকরাও কোনোদিন অস্ত্র হাতে নেবার সাহস করেনি। মুজাহিদের বহু প্রতিপক্ষ আছে, তাই বলে সবাই নয়। মদীনার মুনাফিকরা মুজাহিদ-সাহাবীদের বিজয় দেখে হাতের আংগুল কামড়াতো। সেই হিংসা সেই যন্ত্রণা আজো আমরা বহু আদম সন্তানের চোখে-মুখে, আচার-আচরণে, লিখায়-রচনায় দেখতে পাই! বিদেশের মাটিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমার জন্মভূমির উপর হামলাকারীকে দুধ-কলায় পুষতে পারি। সংঘাত আর সন্ত্রাসে যারা রক্ত ঝরায় পথে ঘাটে, তাদের আশ্রয় স্বদেশের মাটি। কিন্তু আল্লাহর দ্বীনের পতাকা হাতে নিয়ে কোনো মুজাহিদ পথে নামলে কিয়ামতের বিপদ দেখে গলা ফাটিয়ে যে চিৎকার করবে, সেও তার নামের আগে ‘মুহাম্মদ’ লিখে। কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে প্রতিদিন রক্তাক্ত করছে যারা, তারা শুক্রবারের জুমার নামাজে খুতবা শুনে গভীর আবেগে। শিখার আলো যাদের চোখ ঝলসে দিয়েছে, তারা দ্বীনের আলো দেখতে পায়না। আগুনের শিখা দুর্ভাগা কপালকে পুড়িয়ে দিয়েছে। কিয়ামতের অনিবার্য অনির্বান চিরন্তন অগ্নিশিখা দুনিয়া থেকেই বুকে ধারণ করে নিয়ে যাবে এই যদি বিধিলিপি হয় তাহলে তা খন্ডানো যাবেনা।
ইসলাম আল্লাহর মনোনীত দ্বীন। এই দ্বীনের সাথে সংঘাত আল্লাহর সাথে সংঘাত। এমন দুঃসাহসের পরিণতি প্রতিটি মুসলমানের জেনে রাখা উচিৎ। যারা জানেননা, তাদের জানিয়ে দেয়া উচিৎ। প্রতিটি মুসলমানের সাথে আমাদের রক্তের বন্ধন। এই বন্ধনকে ছিন্ন করছে যারা আমরা শুধু তাদেরই শত্রু।
দেশের তিন চতুর্থাংশ জুড়ে কেন্দ্রীয় প্রশাসন কায়েম করে তালিবান সরকার আজো কোনো রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেলো না। ইউরোপ আমেরিকা আফগানিস্তানকে স্বীকার করে নিতে পারেনি, আমরা কেমন করে তা পারি? দুনিয়াতে আমরা যাদের অনুসরণ করে চলেছি, আখিরাতেও কি তাদেরই অনুসরণ করবো? জাতিসংঘ কোনো মুসলিম দেশকে অবরোধ করলে আমরাও করি। আল্লাহ বলেন, দ্বীনের আলোকে ওরা ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহর দুশমনরা যা চায় আমরাও কি তা-ই চাই? আল্লাহপাকের জীবন ব্যবস্থা আমাদের স্বীকৃতির অপেক্ষায় থাকবে? যে জীবন ব্যবস্থা নিজেদের জন্য গ্রহণযোগ্য করে নিতে পারলাম না, সেই বিধান অন্যে গ্রহণ করলে তাকে অন্ততঃ স্বীকৃতিটাও দিতে পারিনা। এমন মুসলিম নাম ধারণকারীদেরকে আল্লাহ তায়ালা স্বীকৃতি দেবেন এই আশা আত্মপ্রবঞ্চনা বৈ আর কিছু নয়। শিরক ও কুফরে নিমজ্জিত জাতি সীমা লংঘনের চূড়ান্ত করে চলেছে। উপযুক্ত শাস্তির জন্য কোনো শর্ত পূরণ করতে বাকি রাখেনি। এখন শুধু মুজাহিদের আযান শুনে মরণজয়ী মুমিন জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ পথ ধরবে অথবা ধ্বংস আর লানতকে নসীব করে অবিলম্বে আল্লাহর জমীন ত্যাগ করবে।