সত্য প্রকাশে সরব কন্ঠ ওমর আব্দুর রহমানের অপরাধ কী?
========================================================================
সম্প্রতি আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে World Trade Centre “বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে” বােমাবাজির অভিযােগে গত ৪ঠা মার্চ চারজন মুসলমান অভিযুক্ত করা হয়েছে। অথচ বােমা বহন করেছে এমন গাড়ী কেউ দেখেছে এমন সাক্ষ্য প্রমাণ মিলেনি, ঘটনাস্থলের কোন আলামত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নেয় ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়নি কোন বিশেষজ্ঞ।
ব্যস্ত এলাকায় স্পষ্ট দিবালােকে মধ্যাহ্নে সংঘটিত ঘটনার আগে অথবা পরে কোন মুসলমানের কোন তৎপরতা কোন সাক্ষীর চোখে পড়েনি। শুধু মাত্র ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামতের উপর নির্ভর করে এটুকু প্রমাণ হয় যে, বােমাবাজির একটা ঘটনা সেখানে ঘটেছিল। কিন্তু তারা এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত এটা প্রমাণের জন্য যে সব আলামত বিধি সম্মত, নির্ভরযােগ্য, তা উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। চারজন মুসলমানের পক্ষে একজন তার নির্দোষ হওয়ার পক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ উপস্থাপন করেন কিন্তু বস্তুতঃ তার পক্ষের আইনজীবি নিজ মক্কেলের বিষয়বস্তু ভুল উপস্থাপন করেছেন, যে বিষয়ে মক্কেল অভিযােগ করেছিলেন, কিন্তু তার অভিযােগের প্রেক্ষিতে উকিল তার বিভ্রান্ত বক্তব্য প্রত্যাহার করেন নি, কারণ ওই উকিল ভীষণ মুসলিম বিদ্বেষী।
শুধুমাত্র ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামতের উপর নির্ভর করেই অভিযুক্ত মুসলিমদের যাবৎজীবন কারাদন্ডের আদেশ আদালতের সম্ভাব্য রায় বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। এই বিতর্কিত মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক জনমত গড়ে তােলা হয়েছে, এ ব্যাপারে পত্র-পত্রিকার ভূমিকাই সব চেয়ে বেশী। সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় ও তিলকে তাল বানান মার্কা শিহরণমূলক প্রতিবেদন পত্র পত্রিকাগুলাে নিয়মিত প্রকাশ করতে থাকে। সংঘটিত বোমাবাজির উপর রঙ চড়িয়ে এমনভাবে প্রতিবেদনগুলােকে উপস্থাপন করা হয় যাতে মন স্বদেশিকতার উম্মাদনা, আবেগ আর অন্ধত্বে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং সুস্থ স্বাভাবিক বিবেকগুলাের উপর এর বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিচারকমন্ডলীও মানুষ তারাও মানবিক দুর্বলতার উর্ধ্বে নয়। অন্যদের মতাে তাদেরও উগ্র প্রচারণায় আচ্ছন্ন হওয়া স্বাভাবিক। এ কারণে বিচারের রায় সুষ্ঠু হবে না বলে বিবেকবান মানুষ আশঙ্কা করছেন। অভিযুক্ত মুসলমানদের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু ও ইনসাফপূর্ণ বিচারের জন্য অন্যত্র মামলাটি স্থানান্তরের আবেদন জানান হয়। কিন্তু আদালত তাদের এই আবেদন নাকচ করে দেয়।
অথচ তারা যে বােমাবাজির সাথে জড়িত এর কোন প্রমাণ নেই। কোন সাক্ষী নেই। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পেশ করার মত কোন আলামত নেই। অভিযােগের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য শুধুমাত্র এটুকু বলা হচ্ছে যে, তাদের মন-মগজে রয়েছে আমেরিকা বিরােধী চেতনা Ati American belief, এই Anti American belief টা কি?
অভিযুক্তরা নিউজার্সি মসজিদে যাতায়াত করত সালাত আদায়ের লক্ষ্যে। মসজিদের ইমাম ছিলেন ওমর আব্দুর রহমান, তাকেও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে এই মামলার সাথে সম্পৃক্ত করে। শেখ ওমর আব্দুর রহমান ইসলামী চিন্তা চেতনা, ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে মসজিদে নিয়মিত বক্তৃতা দিতেন। তাঁর বক্তব্যে স্বাভাবিকভাবে মুসলিম বিশ্বের বর্তমান করুণ পরিস্থিতি উপস্থাপিত হতাে। ইসলামী মূল্যবােধের নিরিখে মুসলিম বিশ্বের বুকে চেপে থাকা স্বৈরাচারী শাসকদের স্বরূপ উৎঘাটন করে বিশ্লেষণধর্মী আলােচনা করতেন। তার দেশ মিশরের গণধিকৃত প্রেসিডেন্ট হােসনী মােবারক, যে দেশ বিদেশে আমেরিকার বরকন্দাজ হিসাবে চিহ্নিত, তিনি তার অপকর্মের সমালােচনা করতেন! শেখ, ওমর এটা করতেন তার ইসলামী দায়িত্ব বােধ থেকে।
যে চারজন মুসলমানকে লৌহ যবনিকার অন্তরালে আটকে রাখা হয়েছে তারা মসজিদমুখী ঈমানদার, তাদের অপরাধ একটিই যে, তারা তাদের দেশের স্বৈরাচারদের বিরূদ্ধে সােচ্চার। তারা চায় তাদের দেশের জনগণের ইচ্ছা ও চিন্তা চেতনার সাথে সম্পৃক্ত শাসন ব্যবস্থা, কোন বরকন্দাজ নয়, কোন বিজাতীয় দালাল পরিচালিত শাসন কাঠামাে নয়, কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই মুসলমানদের, যারা জর্জ ওয়াশিংটন আর আব্রাহাম লিংকন এর মার্কিন মুলুককে মনে করেছে স্বাধীনতার পীঠস্থান, গনতান্ত্রিক চেতনা সমৃদ্ধ ভূখন্ড। আমেরিকার বিশ্বব্যাপী অপকর্মের পরও ভেবেছে আমেরিকা তার নিজের বুকে স্বাধীনতা মানবাধিকার সমুন্নত রাখবে। তারা মনে করেছে, এদেশ এ মাটিতে সীমাহীন বাক স্বাধীনতা রয়েছে, আলােচনা সমালােচনার ক্ষেত্রে এদেশ অবারিত, কিন্তু বিশ্বব্যাপী প্রচারিত আমেরিকার ভাবমূর্তির সাথে তার কর্মকান্ডের সামঞ্জস্য রয়েছে কি? ইহুদী অর্থ দ্বারা লালিত, তাদের পৃষ্ঠপােষকতায় প্রতিষ্ঠিত মার্কিন মুলুকে কতটুকু স্বাধীনতা রয়েছে? যে আমেরিকার মুসলমানদের ঠেঙ্গানোর জন্য এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার আওয়াজকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল সমূহে বিশেষ করে মিশরে গণ আন্দোলনকে নিশেষ করার জন্য যুগের পর যুগ বরকন্দাজ লালন করছে, অর্থ ও অস্ত্র যােগান দিচ্ছে মুসলমানদের রক্তাক্ত করার জন্য, সেই সরকারের সমালােচনা ও তার বিরুদ্ধবাদীতা আমেরিকার মাটিতে ইহুদী মদদপুষ্ঠ সরকার ও তার আমলারা বরদাস্ত করবে কেন?
অভিযুক্ত চার জন মুসলিমকে কারাগারে নিক্ষেপ ও প্রহসনমূলক বিচারের সম্ভাব্য পরিণতি সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের এই কথা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, তােমরা তােমাদের দেশের স্বৈরাচারী সরকার ও দুর্নীতি পরায়ণ প্রশাসনের সমালােচনা করবে না, যদি সেই সরকার আমেরিকার একান্ত বাধ্যানুগত গোলাম ও বরকন্দাজ হয়। গ্রেট বৃটেন ও আমেরিকার গৃহপালিত ইসরাঈলের মাস্তানী কর্মকান্ডের সমালােচনা থেকে বিরত থাকবে, তা না হলে তােমাকে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদীর কলঙ্ক লেপন করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে। সি এন এন, ও বি, বি, সি'র সার্বক্ষনিক, সম্প্রচারে কম্পমান ইথারের মধ্য দিয়ে তােমাদের আর্তনাদ দুনিয়ার মানুষের কানে পৌঁছাবে না। তােমাদের সাথে যাদের আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে তারাও এর ফাকে পড়ে তােমাদেরকে ধিক্কার দিবে। তােমাদের বিরুদ্ধে প্রচারণায় সম্মােহিত হয়ে মিথ্যাচারকে সত্যের প্রলেপ দিয়ে বিশ্ব জনতাকে গ্রাস করার সমস্ত মাল-মসল্লা রয়েছে আমেরিকার হাতে।
আমেরিকা সবই পারে, সবই সম্ভব। আমেরিকা হাজার হাজার টন বােম বর্ষণ করতে পারে- নির্বিচারে। যদি সেটা মুসলিম অধ্যুষিত জনপদ হয় তবে তাে আর কথাই নেই। লক্ষ কোটি মুসলমানের আর্তনাদ আমেরিকাকে একটুও বিচলিত করবে না। ব্যক্তি শুধু নয়, রাষ্ট্রকেও সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে পৃথিবী থেকে ধ্বংস করে দিতে পারে যদি সেটা মুসলিম রাষ্ট্র হয় এবং আমেরিকার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সহযােগী না হয়। ৪৭ বছর ধরে ফিলিস্তিনীদের রক্তাক্ত লাশের উপর নৃত্য করছে ইসরাইল আর তবলায় চাটি মেরে তাল দিচ্ছে আমেরিকা। যুগের পর যুগ কাশ্মীর জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্খা ভারতীয় বন্দুক আর বেয়নেটের খোচায় লুষ্ঠিত হচ্ছে আর পঞ্চাশ দশক থেকে আগ্রাসী ভারতকে অস্ত্রের যােগান দিয়ে আসছে এই আমেরিকা। বসনিয়ার মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে, নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার স্থপতি আমেরিকার কোন মাথা ব্যথা নাই। জাতিসংঘ তারই ইঙ্গিতে রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে বসনিয়ার মাটিকে বিরান ভূমিতে পরিণত করার নিরব অনুমতি দিয়েছে নব্য চেঙ্গিস-সার্বদের। এত কুয়াশা, এত মেঘ, এত মিথ্যাচার, এত রক্তের ছড়াছড়ি-এরই মধ্যে মুসলমানদের চেতনা সমৃদ্ধ হচ্ছে। এটা হবেই, নিপীড়িত গণ মানুষের চেতনা ক্ষুরধার হবেই। জুলুম নিষ্পেষণের মধ্যে দানা বাধবে প্রতিরােধ শক্তি, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ইতিহাসের গতি ধারা এগিয়ে চলবে। নিপীড়িত জনপদগুলােতে ইসলামের অনিরুদ্ধ গতি দুর্বার হয়ে উঠবে প্রাকৃতিক নিয়মে। গণতন্ত্রের ভেলকিবাজির আবরণ থেকে সত্যকে বের করাই আমাদের লক্ষ্য।
আজ সময় এসেছে আত্ম উপলব্ধির, আত্ম সচেতনতা ও ইসলামী ভাতৃত্ববােধ সমুন্নত করার। নিউইয়র্কের একজন মুসলমানের ওপর জুলুমের যে যন্ত্রণা সেটাকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে আমাদের প্রত্যেককে। সােচ্চার হতে হবে জুলমের বিরুদ্ধে। বিশ্বব্যাপী একই আওয়াজ, একই চেতনা, একই উপলব্ধির ঝড় তুলতে হবে। সন্ত্রাসের সপক্ষে আমরা নই। সন্ত্রাসের লেবেল দিয়ে, মৌলবাদের তিলক পড়িয়ে, প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে সচেতন মুসলমানদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে এমন আচরণকে বিবেক মেনে নিবে না।
(আমেরিকার মুসলমানদের পক্ষ থেকে প্রকাশিত একটি লিফলেট ও নিউ ট্রেন্ট পত্রিকার সৌজন্যে)
═──────────────═