মরণজয়ী মুজাহিদ
মল্লিক আহমাদ সারওয়ার
=====================================================================
সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে নূর মুহাম্মাদ এদিক ওদিক তাকায় । তারপর বলল,এতক্ষনে তো তাদের চলে আসার কথা । এ স্থানটিই নির্বাচন করা হয়েছিল । আলী জিজ্ঞেস করল যে,এখানে কাদের আসার কথা? উত্তরে নূর মুহাম্মাদ বলল,আপনাদের সাহায্যে এক গ্রুপ মুজাহিদের আসার কথা ছিল । তার কথা শেষ হতেই অদূরে পাখির কণ্ঠের মত নির্দিষ্ট সংকেত শুনা যায় । প্রতি উত্তরে নূর মুহাম্মাদ ও অনুরুপ আওয়াজ দিলে সেখানে দশজন মুজাহিদের উদয় হল । হায়দার মারকাজের ইনচার্জ হানীফ খানও এদের মধ্যে ছিলেন ।
নূর মুহাম্মাদ বলল,অতি তাড়াতাড়ি আমাদের এ স্থান ত্যাগ করতে হবে । তখন আলী বলে উঠল যে,না আঃ করীমের হত্যাকারীকে তুলে না নিয়ে এখান থেকে যাবো না । আঃ করিমের মৃত্যুতে মেজর ফাইয়্যাজও দারুণ ব্যথিত ছিলেন । তিনিও আলীর কথার সমর্থন জানালেন । শেষে এটাই সিদ্ধান্ত হল যে হত্যার প্রতিশোধ নিতেই হবে ।
আলী,নূর মুহাম্মদ ও অপর চার মুজাহিদ গাড়ীতে উঠল । আরো দুজন মুজাহিদ বন্দী সিপাহিদের ইউনিফর্ম পরে নিল,রুশদের হাতে কোথাও আটকা না পড়তে হয় যাতে । রাত বারোটা । আঃ করীমের বাড়ীর সামনে এসে আলীর গাড়ী থামল । গাড়ী হতে নেমে সে আঃ করীমের দরজায় কড়া নাড়লে দরজা খুলে দিল,আলী ঘরে প্রবেশ করল । অপর দিকে নূর মুহাম্মদ আর দুজন মুজাহিদ ঢুকল আঃ করীমের হত্যাকারী ইয়াসীনের ঘরে ।
আলী সংক্ষেপে সব কথা আঃ করীমের মাকে খুলে বলে যথা সম্ভব তাড়াতাড়ি তাকে প্রস্তুত হতে বলল । কোন দামী জিনিস সাথে নিতে চাইলে সেটাও সাথে নিতে বললো,কারন কিছুক্ষণের মধ্যে রুশীরা এ ঘর ঘেরাও করে ফেলবে ।
আঃ করীমের আম্মা বললেন, আমার আঃ করীম কোথায়?
আলী বলল,আঃ করীম সম্পর্কে পরে বলব ।
আম্মা!আপনি জলদি করুন । মোটেও দেরী করবেন না ।
বিস্ময়,বিমূঢ় হয়ে আঃ করীমের মা দাঁড়িয়ে রইলেন । কিছুই তার বুঝে আসছিলো না ।
বললেন,বেটা, আমার কিছুই বুঝে আসছেনা । তুমি যা বলো তাই মেনে নিচ্ছি । আমার আঃ করীমও এ কথা বলত যে,রুশীরা বড় নিষ্ঠুর । আর আমার ঘরে কোন দামী জিনিস তো নেই । আমার সম্পদই ছিলো ওই এক আঃ করীম । সে তো এখন ঘরে নেই । ওহ!একটা জিনিস রয়েছে । কুরআন শরীফটা নিতে হবে । এ ঘরে আর ফিরে আসি কিনা তার তো ঠিক নেই । রুশীরা ঘরে আসলে যাতে কুরআন শরীফের কোন বেহুরমতী করতে না পারে সে জন্য কুরআন শরীফখানা নিতেই হবে । আঃ করীম আমাকে বলেছে,রুশীরা বহু মসজিদ ভেঙে ফেলেছে এবং কুরআন শরীফ জ্বালিয়ে দিয়েছে ।
এর মধ্যে নূর মুহাম্মদ এসে বলল, জলদী কর ভাই, না হলে আমরা সবাই ধরা পড়ে যাব ।
সবাইকে নিয়ে বাধা বিঘ্ন ছাড়াই গাড়ী পূর্বের স্থানে ফিরে আসল ।
দু'একজায়গায় গাড়ী থামানো হয়েছিলো বটে তবে নূর মুহাম্মদ নিজের কার্ড দেখালে পুলিশ রাস্তা ছেড়ে দেয় । বন্দী সিপাহী দু'জন মুজাহিদের সাথে মিলে জিহাদ করার শপথ নিলে তাদের ক্ষমা করে দিয়ে মুজাহিদরা তাদের সাথে নিয়ে নিলো । হঠাৎ গাড়িটা এক জায়গায় থামিয়ে মুজাহিদরা তাতে আগুন ধরিয়ে দিল । কারণ সামনে পায়ে হাটা পথ ।
সবাই হায়দার মারকাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছে । ইয়াসীনের চোখ ও হাত বেঁধে দেয়া হয়েছে ।
আলী আঃ করীমের মাকে হাঁটতে সাহায্যে করছিলেন । তিনি বার কয়েক জিজ্ঞেসও করেন যে,আঃ করীম কোথায়? আর ইয়াসীন কে কেন বন্দী করা হয়েছে? আলী বলল,আম্মা! মারকাজে পৌঁছে সব বলব ।
চলতে চলতে নূর মুহাম্মদ আলী ও মেজর ফাইয়্যাজকে বলল, আলীর সাথে প্রথম সাক্ষাতেই বুঝতে পারি যে, সে বিশেষ কোন প্রোগ্রাম নিয়ে এসেছে । বিশেষ করে সে যখন বলল,বহুদিন পাহাড় পর্বতে ঘুরেছি এখন শহরে আছি । এ উত্তরে স্পষ্ট বুঝা যায়, মুজাহিদরা পাহাড়ে পর্বতে ঘুরে বেড়ায়,তারা শহরে আসে বিশেষ কাজে কিন্তু আমি ইন্টেলিজেন্সের লোক হওয়ায় সে আমাকে স্পষ্টভাবে কিছু বলেনি । তার উপর আমি দৃষ্টি রাখি,কিন্তু সে মারাত্মক ভুল করে বসে, ছাউনী থেকে সোজা সে আঃ করীমের ঘরে যায় । আর সে ঘরের উপর ইন্টেলিজেন্সের লোকেরা সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখছিলো । কর্ণেল মুসা তার পিছে লোক লাগিয়ে দেয় । ঘটনাচক্রে ইয়াসীনও ঐ সময় ঘরে ছিল, তাই সহজেই ও বন্দী হয়,আমিও আর কিছু করতে পারি নি । আজকে গাড়ির ড্রাইভার নেই তাই আমাকে ডিউটি দেয়া হয় যে,রাত ৯ টায় গাড়ীতে করে বন্দীদের কে মৃত্যু কূপে নিতে হবে । দুপুর ২ টায় আমাকে একথা জানানো হলে আমার স্থির বিশ্বাস হল যে,মৃত্যু কূপের যাত্রী বন্দীদের মধ্যে নিশ্চয়ই আলীও রয়েছে ।
আমার পরিচিত লোকদের মধ্যে হাবীবুল্লাহর সাথে মুজাহিদদের যোগাযোগ আছে,আমি জলদি তার কাছে গেলাম এবং সবকিছু খুলে বললাম ।
তখন সিদ্ধান্ত হল যে,আমি বন্দীদের গাড়ি এখানে নিয়ে আসব,আর যদি আমি এতে ব্যর্থ হই তাহলে অন্য মুজাহিদরা মৃত্যু কূপের উপর আক্রমণ করবে । মৃত্যু কূপের নকশা তাকে দিয়ে দিলাম,তবে আল্লাহপাক আমাদের সাহায্যে করেছেন । আমরা সফল হয়েছি ।
এদিকে এরা সবাই ধীর পায়ে মারকাজের দিকে চলছে । ওদিকে মৃত্যু কূপের মূল ফটকে ওই রুশী অফিসার অপেক্ষা করতে করতে ক্রোধে উন্মত্ত প্রায় । সে বিরবির করে বলছিল,বারোটা পর্যন্তও বন্দীরা আসলোনা । বন্দীরা গেল কোথায়? কখনো রক্তপায়ী কুকুরের খাঁচার কাছে যায়, কখনো বিষাক্ত সাপের দিকে চেয়ে থাকে, আবার কখনো আশাহত চোখে তেলের কড়াইয়ের দিকে তাকায় । অতি ক্রোধে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে । রাগের বশে এক আফগানী সৈন্যের উপর থাপ্পড় মারতে উদ্যত হলে সৈন্যেটি একপাশে সরে দাঁড়ায় আর অফিসারটি ধড়াম করে ফুটন্ত তেলের কড়াই এর মধ্যে পড়ে এক মিনিটের মধ্যে রোষ্ট হয়ে গেলো ।
আল্লাহপাক দেখিয়ে দিলেন,ফেরাউন বা নমরুদের মত তার সাথে যে-ই চ্যালেঞ্জ করবে তার পরিণাম হবে এমনই ভয়াবহ । মাঝ পথে নূর মুহাম্মদ দূর বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে বলল যে,এক্ষুনি আমার পরিবারবর্গকে পাকিস্তান না পাঠালে আমার ফেরার হওয়ার অপরাধে তাদেরকে গ্রেফতার করা হবে । হানীফ খান, মেজর ফাইয়্যাজ ও আলী,নূর মুহাম্মদ কে শুকরিয়া জানিয়ে তাকে বিদায় দেয় ।
রাতে ৪টা নাগাদ সবাই হায়দার মারকাজ পৌঁছে । ইয়াসীনকে পাহারারত মুজাহিদদের হাতে দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে । ভোরে উঠে নাস্তার পর আঃ করীমের আম্মাকে তার ছেলের শাহাদাতের সংবাদ জানানো হয় ।
এ সংবাদ শুনে তিনি যেন নিথর হয়ে গেলেন, কান্নাকাটিও করলেন না বা কোন প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করলেন না । এরপর ইয়াসীনকে সেখানে আনা হলো,আলী ও মেজর ফাইয়্যাজ জোর আবেদন ছিল তাকে যেন জীবন্ত পুড়ে ফেলা হয় । কারন তার ষড়যন্ত্রে বন্দী হওয়া ক'জন মুজাহিদকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে ।
মেজর ফাইয়্যাজ মুজাহিদদের সামনে আঃ করীমের শাহাদাতের হৃদয়বিদারক কাহিনী বললে সবাই তার সাথে ঐক্যমত পোষণ করে যে,এ ষড়যন্ত্রের হোতা ইয়াসীন কে পুড়িয়ে মারা হোক ।
ইয়াসীনকে জীবন্ত পুড়ে মারবার জন্য তৈল ও লাকড়ী আনা হল । মৃত্যুর দৃশ্য কল্পনা করে ইয়াসীন বারবার শিউরে উঠছে । সে মেজর ফাইয়্যাজ, হানীফ খান ও আলীর পা ধরে ক্ষমা চাইতে থাকে । কিন্তু সবাই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে লোকটা অসম্ভবরকম নিষ্ঠুর । ঈমান তো বিক্রি করেছেই সাথে সাথে আত্নমর্যাদাবোধ টুকুও সে রুশীদের হাতে বিক্রি করে দিয়েছে । আর কত মুজাহিদকে যে সে বন্দী করিয়েছে, কত নিরিহ মানুষ তার সহায়তায় বর্বরতার যাতাকলে শহীদ হয়েছে তার খবর কে রেখেছে । এমন ব্যক্তির উপর দয়া করা আত্মঘাতি কর্ম ছাড়া আর কি ।
ইয়াসীন আঃ করীমের আম্মার পা ধরে হিচকি মেরে কাঁদতে লাগলে তিনি মেজর ফাইয়্যাজ কে বললেন,আপনারা একে ক্ষমা করে দিন ।
তার কথায় মেজর ফাইয়্যাজ অত্যন্ত আশ্চর্য হলেন, এ কেমন মহিলা, যার কারনে তার আদরের সন্তান রুশীদের হাতে বন্দী হয়ে জীবন্ত দগ্ধ হল,সে তাকে ক্ষমা করে দিতে বলছে । আঃ করীমের আম্মাকে তিনি বললেন,আম্মা, আপনি হয়ত জানেন না যে,কি নির্মম ভাবে আঃ করীমকে ওরা শহীদ করেছে ।
আমি তা ভালো করেই জানি । আঃ করীম ছিল এক মুজাহিদ, ইসলামের খাতিরেই সে নিজের জান আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দিয়েছে । আর এ ইসলাম আমাদের নিকট পৌঁছেছে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে । বলো তো, মক্কাবাসীরা নবী (সাঃ) -এর সাথে কীরুপ নির্মম আচরণ করল? তা সত্ত্বেও কি নবীজি (সাঃ) তাদের ক্ষমা করে দেন নি? আমাকে যদি 'মা' ডেকে থাক তাহলে তাকে ছেড়ে দাও । আর মনে রেখ এ আগুন হতে জাহান্নামের আগুন বেশী উত্তপ্ত । তোমরা সে শাস্তি তাকে দিতে পারবে না যা আল্লাহপাক তাকে দিবেন ।
আঃকরীমের আম্মার কথায় ইয়াসীনকে ছেড়ে দেয়া হল । হানীফ খান দু'জন মুজাহিদকে বলল,তার চোখ বেঁধে মারকাজ থেকে দূরে রেখে এস । যাওয়ার সময় আলী তাকে বলে দিল, ভবিষ্যতে কোন মুজাহিদকে যদি বন্দী করাও তাহলে এ গরম তেলে তুমি কাবাব ভাজা হবে নিশ্চিত । আলী ও মেজর ফাইয়্যাজ মারকাজে এসেছেন আজ পাঁচদিন হয়েছে । যোহর নামাজ পড়ে তারা মসজিদ হতে বের হয়েছেন কেবল,এমন সময় দেখতে পেলেন যে,স্ত্রী পুত্রসহ ইয়াসীন মারকাজে উপস্থিত । সে এসেই হানীফ খানকে বলল,মুজাহিদদের সাথে আমি যে অন্যায় আচরণ করেছি সে অপরাধবোধ আমার বিবেককে দংশন করে চলছে । এখান থেকে যাওয়ার পর বিবেকের দংশন আমায় অতিষ্ঠ করে তুলে । তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে,বাকি জীবন জিহাদেই কাটাবো, আল্লাহপাক হয়ত এ উসিলায় আমাকে ক্ষমা করবেন ।
এরপর সে আঃকরীমের আম্মার পা ধরে বিনয়ের সাথে বলতে থাকে, আম্মা!আপনার আঃ করীমকে তো আর ফিরিয়ে আনতে পারবো না,আর সে শূন্যতা কোনভাবেই পূরণ হবে না, তবে যে পথে তিনি কোরবান হয়েছেন আমি সে পথে নিজের সব বিলিয়ে দিবো । আপনি আমায় ক্ষমা করুন । আমার বাল বাচ্চা আপনার সাথেই পাকিস্তান যাবে এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওরা আপনার খেদমত করবে । খোদার দিকে চেয়ে আমার বিবি-বাচ্চা ও আমাকে মাফ করে দিন । লোভের বশে অন্যায় করে ফেলেছি । আম্মা!আমার ঘর বিক্রি করে দিয়েছি,আর কখনো সেখানে যাব না ।
আপনি যেখানে থাকবেন আমার বিবি বাচ্চারাও সেখানে থাকবে । ইয়াসীন এক তোড়া টাকা আঃ করীমের মায়ের হাতে বলল,বাড়ি বিক্রি করে এ টাকা পেয়েছি,এখানে । আগের টাকাও রয়েছে ।
এখন টাকাগুলো আপনার । আপনি যা ইচ্ছা তা করুন । মনে চাইলে নিজের হাতে রাখুন অথবা মুজাহিদদের দিয়ে দিন । আপনি খুশি মতে ব্যয় করুন ।
আঃ করীমের আম্মার সাথে কথাগুলো বলতে বলতে ইয়াসীনের চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছিল ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু । তার বিবি বাচ্চারা আঃ করীমের আম্মার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে । আঃ করীমের মা একজন নিতান্ত দয়াবান মহিলা, তিনি ইয়াসীনের বাচ্চাকে টেনে কোলে বসিয়ে টাকাগুলো হানীফ খানের হাতে তুলে দিলেন । অর্ধেক টাকা হানীফ খান মুজাহিদদের জন্য রেখে বাকীটা আঃ করীমের মাকে দিয়ে বলল,পাকিস্তান যেয়ে টাকাগুলা আপনার এবং এ বাচ্চাদের দরকার হবে । ছয়দিন পর আলী ও মেজর ফাইয়্যাজ, আঃ করীমের মা ইয়াসীনের বিবি বাচ্চা ও আরো পাঁচজন মুজাহিদ পাকিস্তানের পথে রওয়ানা দিল । ইয়াসীন হায়দার মারকাজেই থেকে যায় ।
অনুবাদঃ আবু উসামা
═──────────────═