JustPaste.it

দেশে দেশে ইসলাম


থাই মুসলমানদের সেকাল ও একাল
ইবনে হাতেম


                  থাইল্যান্ড, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহের সম্মিলিত জোট আসিয়ানের এক সদস্য দেশ। ১৯৯০ সলের আদম শুমারী অনুযায়ী এর লোকসংখ্যা প্রায় ৫,৪৯,৮০,০০০। সরকারী ও পশ্চিমা প্রচার মাধমের রিপোর্ট অনুযায়ী মুসলমানরা ৪ শতাংশ। কিন্তু থাই মুসলমানদের দাবি, থাইল্যান্ডে তারা মূল জনসংখ্যার ১০ শতাংশ তথা পঞ্চাশ লাখ। এই হিসেবে থাইল্যান্ডে থাই বৌদ্ধদের পরেই মুসলমানদের অবস্থান।
                 থাইল্যান্ডে মাত্র কয়েকটি অঞ্চলে মুসলিম বসতি রয়েছে। তন্মধ্যে রাজধানী ব্যাংকক, মধ্য অঞ্চল, উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মুসলমানদের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পটভূমিও ভিন্ন ভিন্ন। উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ মুসলমান চীনা বংশোদ্ভূত। চীনে কম্যুনিষ্ট অভ্যুত্থানের পর তারা হিজরত করে থাইল্যান্ডে এসে বসতি স্থাপন করে। উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের মুসলমানদের কেউ বাংলাদেশী কেউ পাকিস্তানী আবার কেউ হিন্দুস্তানী। জীবিকার তাকিদে সে দেশে তারা ধীরে ধীরে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে। তাদের অধিকাংশের-ই পেশা হলো ব্যবসা। রাজধানী ব্যাংককের মুসলমানরা দক্ষিণ থাইল্যান্ডের-ই লোক।
                 থাইল্যান্ডে বিপুল সংখ্যক মসজিদ রয়েছে। রাজধানী ব্যাংককে রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় মসজিদ। ‘ইসলামী পরিষদ’ এর ব্যবস্থাপনায় সম্প্রতি থাই ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মূল আরবী কুরআনও ছাপা হয়েছে বিপুল সংখ্যক। থাইল্যান্ড থেকে দু’টি ইসলামী পত্রিকাও বের হয়। একটির নাম ‘জিহাদ’ অপরটির নাম ‘রাবেতা’। প্রতিবছর ৫০০০ মুসলমান হজ্জ করে থাকে।
                   শিক্ষা-দীক্ষায় থাইল্যান্ডের মুসলমানরা অনেক অগ্রসর। প্রায় ৭০ শতাংশ মুসলিম যুবক দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন মাদ্রাসায়, এবং কিছু সংখ্যক নিজ পরিবারের অভিজ্ঞজনদের নিকট থেকে ইসলামী শিক্ষা অর্জন করে থাকে। থাইল্যান্ডে প্রায় ৪০০ মাদ্রাসা আছে, যার শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২২০০। তবে উত্তরাঞ্চলে শিক্ষার হার তুলনামূলক কম। সরকার দেশের ঠিক মাঝামাঝি এলাকায় একটি ইসলামী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা অর্জনকারী ছাত্রের সংখ্যা ২০০ এর বেশী নয়।
               মোট জনসংখ্যার হারে থাইল্যান্ডে মুসলমানরা সংখ্যালঘু। পাতানীতে মুসলমানরা-ই সংখ্যাগরিষ্ঠ। পাতানীতে তারা সংখ্যায় ৮০ শতাংশেরও বেশী।
              ১৭৮৬ সাল পর্যন্ত পাতানী একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা রাখত। কিন্তু থাইল্যান্ডের রাজা সিয়াম ১৭৮৬ সালে এক সেনা অভ্যুত্থান ঘটালে মুসলমানরা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এর আগে ১৬০৮ সাল থেকে পাতানীতে আরো বেশ কয়েকবার সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটনের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতি বার-ই তাদের অভ্যু্ত্থান ব্যর্থ হয়ে যায়। এ ভাবে ১৯১২ সাল পর্যন্ত পাতানী মুসলমানরা থাই সেনাদের মোকাবিলায় লড়তে থাকে। কিন্তু ১৯১২ সালে এসে তারা অনেকটা স্তিমীত হয়ে পড়ে।
               ১৯০৬ সালে পাতানীকে একটি স্বতন্ত্র প্রজাতন্ত্রের রূপ দেওয়া হয় এবং থাই রাজা পাতানীকে তিনটি অংশে বিভক্ত করেন। তিনটি অংশের জন্য যে তিনজন গভর্নর নিয়োগ করা হয় তারা ছিল সকলেই থাই বংশদ্ভুদ তারা পাতানী মুসলমানদের উপর নানা রকম কর আরোপ করে তাদের জীবন যাত্রা অচল করে দেয়ার চেষ্টা চালায়।
                 ১৯৩২ সালের ২১ জুনে থাইল্যান্ডে সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ১৯৩৩ সালে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। এই সংবিধানে থাইল্যান্ডবাসীর জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু আকীদা বিশ্বাস এবং সাম্য ও স্বাধীনতার কথা বলা হয়। কিন্তু তাতে মুসলমানদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কারণ, এই নতুন সংবিধান কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠদের স্বার্থই সংরক্ষিত হয়েছে। সাম্যের আশ্বাস কেবল শ্লোগানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।
                 নয়া বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার করা। তাই বিপ্লবের পর মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো থাই সংস্কৃতির জগদ্দল পাথর। পাতানী মুসলমানদের জন্য ইসলামী পোষাক ব্যবহার এবং মালাবী ভাষায় কথা বলা নিষিদ্ধ করা হয়। মুসলমানদেরকে বৌদ্ধদের মূর্তির সামনে মাথা নত করতে এবং মুসলিম মহিলাদেরকে পর্দা ত্যাগ করে সংক্ষিপ্ত বসনে সাজ-সজ্জা করে ঘর থেকে বের হতে বাধ্য করা হয়। সর্বোপরি আলিমদেরকে ইসলামী পোষাক পরতে নিষেধ করে দেয়া হয়।
                এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে মুসলমানরা ‘ইসলাম বাস্তবায়ন পরিষদ’ নামে একটি ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৪৪ সালের ১৪ জানুয়ারী হাজী আবদুল কাদের এ আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ঠিক এ বছর ই সরকার সংগঠনটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে মুসলমানরা বিচ্ছিন্নভাবে থাই সরকারের মোকাবিলায় অবতীর্ণ হয়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এই বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম চলতে থাকে।
                 ১৯৬৩ সালে ‘পাতানী বিপ্লব পরিষদে’র ভিত্তি স্থাপন করা হয়। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে একটি ছাত্র সংগঠন। ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইনকিলাবী ওয়াতন পার্টি’ নামে আরো একটি সংগঠন। ১৯৭০ সালে এই তিনটি সংগঠন একত্রিত হয়ে ‘পাতানী ঐক্য পরিষদ’ নামে কাজ শুরু করে। এ ভাবে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুসলমানরা জেল, জুলুম ও নানা রকম নির্যাতন ভোগ করতে থাকে। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৬ হাজার মুসলমান কারাবরণ করে। তন্মধ্যে ১৬,৮৪৭ জনকে বিনা বিচারে সঙ্গে সঙ্গে সাজা প্রদান করা হয়। গায়ে পেট্রোল ঢেলে জীবন্ত পুড়ে মারা হয়েছে অনেক মুসলমানকে। তা ছাড়া মুসলিম মহিলাদের অপহরণ ও শ্লীলতাহানী ঘটান ছিল থাই সেনা বাহিনীর নিত্যদিনের কাজ।
                  থাই-বৌদ্ধ সরকার মুসলমানদেরকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখার জন্য নানা রকম চেষ্টা চালিয়েও সফল হতে পারেনি। এতসব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের শিক্ষার আলো এতটুকু ক্ষীণ হতে দেয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও দ্বীনি শিক্ষা এবং আধুনিক শিক্ষা পাশাপাশি চলছে। বলা বাহুল্য যে, পাতানী মুসলমানদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট রয়েছে।
                  (১) বংশ ও গোত্রগতভাবে পাতানী মুসলমানদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। ভাষা তাদের এক, সামাজিক আচার-আচরণও অভিন্ন, পাতানী মুসলমানরা সকলেই মালাবী ভাষায় কথা বলে, মালাবী বংশ থেকেই তাদের উদ্ভব। সারা পৃথিবীতে মালাবী বংশোদ্ভুত লোকের সংখ্যা ১০ কোটি । চীন, ভারত, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে তাদের বাস।
               (২) মুসলমানরা পাতানীর আসল বাসিন্দা। তাদের ইসলামী ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য রয়েছে। তাদের জাতীয়তা সায়ামী জাতীয়তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৌদ্ধমত আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাদের জিহাদের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।
                (৩) পাতানী মুসলমানদের স্বতন্ত্র জীবন পদ্ধতি রয়েছে। জীবন সংগামে তারা শর্তহীনভাবে একে অপরের সহযোগিতা করে থাকে। সামাজিক জীবনে অমুসলিমদের সাথে তাদের উঠা বসা লেনদেন হয় না বল্লেই চলে।
                (৪) পাতানী এবং দক্ষিণ প্রজাতন্ত্রগুলোতে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু বৌদ্ধ সরকার তাদেরকে সংখ্যালঘু বলে প্রচার করে বেড়ায়। আর মুসলমানদের নির্মূল করার জন্য বৌদ্ধরা সদা অপতৎপরতায় লিপ্ত থাকে।
                (৫) ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার কারণে পাতানী মুসলমানরা কখনো নেতৃত্বহীনতার শিকার হয়নি এবং প্রতিপক্ষের কাছে কখনোই মাথানত করনি। বরাবরই তারা অত্যন্ত সুশৃংখলভাবে থাই প্রশাসনের জুলুমও অন্যায় সিদ্ধান্তের মোকাবিলা করে এসেছে। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাছে কখনো তারা অস্ত্র সমর্পণ করেনি।
তথ্য সূত্রঃ
            ১। সাপ্তাহিক এশিয়া।
            ২। অর্ধসাপ্তাহিক দাওয়াত, দিল্লী।
            ৩। বেদার ডাইজেস্ট, লাহোর।