JustPaste.it

গোঁড়ামী, সহনশীলতা ও ইসলাম

খুরশিদ আহমাদ

=====================================================================

 

        পৃথিবীর ধর্ম-সমূহের ইতিহাস পর্যালােচনা থেকে এটা প্রমাণ হয় যে, ধর্মের বিরুদ্ধে যে অসহনশীলতার অভিযােগ আনা হয়, ইসলাম তেমন অসহনশীল কোন দিনই ছিল না। অধিকন্তু মানবতার মুক্তি ও সার্বিক উন্নতি বিধানে ইসলাম একটি বিরাট শক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। ইসলাম জ্ঞান ও শিক্ষার আলাে প্রজ্জ্বলিত করেছে, “বিজ্ঞান ও কারিগরী জ্ঞানের প্রতি পরম অনুপ্রেরণা দান করেছে এবং মানুষের সামনে স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায়বিচারের সত্যিকার আদর্শ তুলে ধরেছে। এটা মানুষকে সহিষ্ণুতা, সাম্য ও ভালবাসার মহিমা শিক্ষা দিয়েছে। ইসলামের নবী অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য দেবতা সম্পর্কে খারাপ উক্তি না করার জন্য মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআন এবং হাদীস মানুষকে প্রকৃত সহনশীলতার আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছে। ইসলামের ইতিহাস এই সহনশীলতার বিপুল সাক্ষ্য বহন করছে।'

 

        এই বিরাট বিষয়ে বিস্তৃত ও বিষদ। আলােচনা এখানে সম্ভব নয়। আমরা মাত্র ইসলামের শিক্ষা ও ইতিহাসের কিছু জ্বলন্ত সাক্ষ্যের উপস্থাপন করছি। এখানে আমরা অমুসলিম ঐতিহাসিকদের অভিমত উদ্ধৃত করছি। এসব ঐতিহাসিকের অনেকেই ইসলামের বিরুদ্ধে বিরূপ মনােভাব ও শত্রুতা পােষণের জন্য সুপরিচিত। শত্রুতা পােষণ সত্ত্বেও তারা ইসলামের স্বপক্ষে - যে সব বক্তব্য রাখতে বাধ্য হয়েছেন, নিশ্চয় তা অতীব বিশ্বস্ত এবং প্রণিধানযােগ্য।

 

        ইসলাম একটি ধর্মমাত্র নয়, এটা কতকগুলাে আচার-আচরণের সমষ্টিমাত্রও নয় অথবা নয় এ কোন অবাস্তব নৈতিক দর্শন। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য এতে রয়েছে সঠিক দিক নির্দেশনা। ইহা সর্বব্যাপী এক পদ্ধতি, এক সমাজ-ব্যবস্থা, এক রাষ্ট্রদর্শন, এক অর্থনৈতিক আদর্শ-এক কথায় সম্পূর্ণ এক জীবন-পদ্ধতি । সুতরাং আকাশচারী কোন দার্শনিকের উপস্থাপিত সংঘাত-সংক্ষুব্ধ মানব জীবনের সাথে সম্পর্ক বিবর্জিত মােহনীয় কোন নৈতিক শিক্ষার সমষ্টি ইসলাম নয়। ইসলামের নৈতিক শিক্ষা জীবনের বাস্তবতার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। নৈতিক মূল্যবােধকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করার মত পূণ্য ও ন্যায়াদর্শ মণ্ডিত সুষম শক্তি এর রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যই হল ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরােধ।  আল-কুরআন ঘােষণা করছেঃ

 

        “যদি আমরা, তাদেরকে (মুসলমানদের) কোন ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠা দান করি (অর্থাৎ ক্ষমতায় অভিষিক্ত করি)তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরােধ করে- সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে।” [২২:৪১]

 

        নৈতিক সমস্যা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিকোণ দার্শনিক দৃষ্টিকোণের অনুরূপ নয়। ইসলাম মানুষের জীবন-পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন আনতে চায়, নৈতিক শিক্ষার আলােকে তার জীবনকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে চায় এবং চায় মানুষের মূল্যবােধের প্রতিষ্ঠা করতে। সুতরাং ইসলাম একদিকে এক জীবন-দর্শন, অন্যদিকে জীবনের এক নিখুঁত কর্ম - পরিকল্পনা। এ নয় কোন নির্জীব নৈতিক - দর্শন। এটা প্রাণবন্ত ও গতিশীল জীবনাদর্শ, একটি সমাজ ব্যবস্থা এবং, একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্র-পদ্ধতি। ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম রাষ্ট্রশক্তির ব্যবহার করে। সহনশীলতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা এর একটি মৌলিক অঙ্গ। ইসলামের মুলনীতি সমূহের নিম্নলিখিত আলােচনা থেকে ইসলামী সহনশীলতার রূপ সম্পর্কে একটি পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করা যাবে।

 

 ইসলামঃ সাম্যের ধর্ম 

        ইসলামী জীবনাদর্শের মূল কথা হলো তৌহিদ- আল্লাহর একত্বের প্রতি বিশ্বাস । ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর হল এই তৌহিদ। এর উপরই গড়ে উঠেছে ইসলামী জীবন- পদ্ধতির সবিশাল ইমারত। তৌহিদের অর্থ হলঃ সমগ্র বিশ্ব-চরাচরের একজন প্রভু আছেন। তিনি সর্বত্র বিরাজমান এবং সমগ্র । বিশ্বলােক ও মানবজাতির সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা। তিনি সারা জগতের স্রষ্টা ও প্রভু এবং তিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী-সর্বশক্তিমান।তৌহিদ শাস্ত্রীয় কোন এক ধারণামাত্র নয়। এক গতিশীল বিশ্বাস, এক বিপ্লবী মতবাদ, এক ঐতিহাসিক শক্তি এবং ভাগ্য-সম্মিলনী ।

 

        ইসলাম বলে যে, সমস্ত মানুষ এক আল্লাহর তৈরী, তারা সকলেই পরস্পর সমান । বর্ণ, শ্রেণী, বংশ ও আঞ্চলিকতার পার্থক্য বিদঘুটে এক বিভ্রম মাত্র এবং এ বিভ্রমপূর্ণ পার্থক্যের উপর ভিত্তিশীল আর্শগুলাে পৃথিবীর সর্বনাশা আপদ। সমগ্র মানব সমাজ আল্লাহর এক পরিবার এবং কোন বিভেদের স্বীকৃতিই এখানে চলতে পারে না। মানুষ এক-হােক তারা বুর্জোয়া কিংবা সর্বহারা, সাদা কিংবা কালাে, আর্য কিংবা অনার্য অথবা প্রাচ্য কিংবা প্রতীচ্য। ইসলাম মানুষের ঐক্য ও সাম্যের এক বিপ্লবী মতবাদ পেশ করে। মানুষকে তার অর্থ, শক্তি, গােষ্ঠী, সম্প্রদায় অথবা অঞ্চলের জন্য সম্মান নয়, মানুষকে সম্মান করতে হবে মানুষ হিসেবেই। আল্লাহ বলেনঃ

 

        “আমি আদমের সন্তানদের (মানুষকে) সম্মানিত করেছি।”

 

আল্লাহ আল-কুরআনে আরও বলেনঃ

 

        “হে মানুষ, আমি তােমাদের নারী ও পুরুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছি এবং বংশ ও পরিবারের মাধ্যমে তােমাদের পরিচয় দিয়েছি যাতে করে তােমরা একে অপরকে চিনতে পার। নিশ্চয় তােমাদের মধ্যে সে-ই আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম যে অধিক ধর্মপরায়ণ ও আল্লাহর কাছে সৎ কর্মশীল। আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং সব কিছুর সঙ্গে পরিচিত।”

 

 মানবতার সম্মান, মানুষের সাম্য-নীতি এবং মানুষে মানুষে গােত্র, বর্ণ ও অঞ্চলভিত্তিক পার্থক্যের সফল বিলােপ সাধন ইসলামের মৌল শিক্ষার অঙ্গ। প্রখ্যাত হিন্দু চিন্তানায়ক স্যার সি, পি, রাম স্বামী অয়ার (Sir C.P Ramaswamy. Ayer} ইসলাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেনঃ “ইসলাম কিসের দাবী করে? আজকের পৃথিবীর সত্যিকারভাবে সক্রিয় একমাত্র গণতান্ত্রিক ধর্ম ব্যবস্থা হিসেবে। আমি ইসলামকে শ্রদ্ধা করি। শুধু আমি নই, প্রতিটি চিন্তাশীল ব্যক্তি এ সত্যের স্বীকৃতি দিবেন। আমি হিন্দু, হিন্দু ধর্মের প্রতি আমার আস্থা সুদৃঢ়, তবু এ সত্য - উদাত্ত কণ্ঠে ঘােষণা করার সাহস আমার আছে। আমার নিজের ধর্ম এক মানব সমাজের বাস্তব প্রতিষ্ঠায় সফলকাম হয় নাই। ঈশ্বরের সার্বভৌম ক্ষমতার অধীনে সমগ্র মানব সমাজ এক ও অভিন্ন-এই প্রয়ােজনীয় ধারণার বাস্তব প্রতিষ্ঠা করতে ইসলাম ছাড়া জগতের আর কোন ধর্ম সমর্থ হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার বয়েরস’ (Boers}, শ্বেতাংগ অষ্ট্রেলিয়া, অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহের সমস্যা, অথবা এমনকি ইংল্যাণ্ডের সমাজ জীবনের আভ্যন্তরীণ কূট-কোন্দল প্রভৃতির মত কোন সমস্যা একমাত্র ইসলামেই দৃষ্টিগােচর হয় না।” (Eastern Times, 22nd December, 1944)

 

        আর্নল্ড টোয়েনব ও তাঁর Civilizaton on Trial গ্রন্থে অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন এবং আজকের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার ক্ষেত্রে ইসলামের কার্যকারিতার ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ “আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার প্রধান বিষয়গুলাের সাথে জগা-খিচুড়ী চিন্তার - (ধর্ম - জাতি-নীতি নিরপেক্ষ ) মনুষ্য-জীবনের সম্মিলন দু'টি বিপদ এনে উপস্থিত করেছে-একটি হল উৎকট বর্ণ সচেতনতা, অপরটি হল মদ। এগুলাের প্রত্যেকটির মােকাবিলায় ইসলামের শক্তি এমন খেদমত দান করতে পারে যাকে গ্রহণ করলে আমরা উন্নত, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবােধের সৃষ্টি করতে পারি । মুসলমানদের মধ্যে থেকে বর্ণবাদ-মানসিকতার বিলােপ সাধন ইসলামের একটি মহৎ অবদান। আজকের সমসাময়িক পৃথিবীতে ইসলামের এই মহান নীতির ব্যাপক - প্রচার অতীব জরুরী হয়ে দাড়িয়েছে।

 

        আজকের যা অবস্থা তাতে বর্ণবাদী অসহনশীলতার প্রচারকদের রূপ ক্রমশই ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করছে। তাদের এ বর্ণবাদী মানসিকতা যদি চলতে থাকে, তাহলে তা এমনকি ব্যাপক ধ্বংসের কারণ হয়ে দাড়াতে পারে। বর্ণবাদ-বিরােধী শক্তি যদিও আজ বর্ণবাদীদের সাথে তাদের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে, তবু ও বর্ণ সচেতনতা-বিরােধী শক্তিশালী মানসিকতার উত্থান ঘটিয়ে বর্ণবাদী শক্তির উপর বিজয় লাভ করা যেতে পারে। ইসলামের বর্ণবাদ বিরােধী শক্তির সময়ােপযােগী ব্যবহার দ্বারাই বর্ণবাদের বিলােপ ঘটিয়ে সহিষ্ণুতা ও শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব (Civilizaton on Trial-by Arnold Toynbee, P. 205-20}

 

 মানব জীবনে পবিত্রতা

         ইসলাম শুধু মানুষের একত্ব ও সাম্যের কথাই বলে না, মানুষের রক্তের পবিত্রতার প্রতিও অপরিসীম গুরুত্ব আরােপ করে। মানুষের জীবনকে পবিত্র বলে ঘােষণা করা হয়েছে এবং ন্যায্য কোন কারণ ছাড়া মানুষের রক্তপাত করা যাবে না। আল-কুরআন ঘােষণা করছেঃ

 

        “হত্যা ও ফাসাদ সৃষ্টির কারণ ছাড়া যে একজন মানুষকে হত্যা করে, সে যেন গােটা মানব সমাজকেই হত্যা করে এবং এমতাবস্থায় যে একজন মানুষের প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন গােটা মানব জাতিরই প্রাণ রক্ষা করে।” (৫ঃ ৩২)

 

        মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য আলােচনা প্রসঙ্গে অন্য এক জায়গায় আল-কুরআন বলেছেঃ

 

        “আল্লাহর সাথে যে অন্য কিছু শরীক করে না, ন্যায্য কারণ ছাড়া আল্লাহ্ পবিত্র করেছেন এমন কোন জীবকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না-এবং যারা এসব করে, তাদের অবশ্যই শাস্তি ভােগ করতে হবে।" (২৫ : ৬৮)

        এ ধরনের ঘােষণা কুরআন শরীফে আরও কয়েক জায়গায় করা হয়েছে। রসূল (সঃ) বলেছেনঃ

 

        “পাপরাশির মধ্যে সবচেয়ে বড় পাপ হল শিরক, তারপর আসে মানুষকে হত্যার অপরাধ, এরপর পিতা-মাতার - প্রতি অবাধ্যতা এবং এর পর আসে মিথ্যা কথা বলার পাপ”।

 

        অন্য এক ঘটনায় মহানবী (সঃ) বলেছেনঃ

 

        “একজন মুসলমান তার ধর্ম প্রচার করে যায় (এবং থামে যখন) সে ন্যায্য কারণ ছাড়া মানব-হত্যার মত অবস্থার মুখােমুখি এসে দাঁড়ায়।”  ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায্য কারণ কি,তা কুরআন শরীফের ৫ঃ ৩২ উদ্ধৃতি থেকে পরিস্কার হয়ে যায় । ইসলাম এইভাবে মানুষের জীবনকে পবিত্র করেছে  এবং হত্যা ও পৃথিবীতে ফেতনা আর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপরাধ ছাড়া মানুষের রক্তপাত সম্পূর্ণ হারাম করে দিয়েছে। কোন মানুষ যখন মানব রক্তের পবিত্রতা বিনষ্ট করে, তখন নিজেই সে তাকে হত্যার ন্যায্য কারণ সৃষ্টি করে। হত্যা করা ও ফেৎনা সৃষ্টি- এই দুই অপরাধেই শুধু ইসলামে হত্যার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

 

 

সুবিচার ও আইনের শাসন

         ইসলাম তার অনুসারীদেরকে ফলাফলের দিকে দৃষ্টিপাত না করে সুবিচারের সাথে সমস্যার সমাধান করতে নির্দেশ দেয়। আইনের চোখে সকলেই সমান এবং বিচার পরিচালনায় কোন পার্থক্য ও পক্ষপাতিত্বের কোনরূপ প্রশ্রয়ই দেয়া চলবে না। আইনের শাসন এবং সুবিচার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবকিছুর উপরে। আইন এবং সুবিচারের ক্ষেত্রে ইসলাম এমনকি মুসলমান ও অমুসলমানের মধ্যেও কোন পার্থক্য করে না। আল-কুরআনের ভাষায়ঃ

 

        “যখন, তুমি মানুষের মধ্যে বিচার করতে বস, তখন সুবিচার কর।" (৪: - ৫৮) - “আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচারণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও সীমালংঘন।” (১৬: ৯০)

 

        “আমরা, আমাদের রসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শন দিয়ে পাঠিয়েছি এবং তাদেরকে দিয়েছি পবিত্র গ্রন্থ ও ন্যায়দণ্ড যাতে করে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।” (৫৭ঃ ২৫)

 

        কুরআন শরীফে আরও বলা হয়েছেঃ

 

        “হে বিশ্বাসীগণ, সুবিচার প্রতিষ্ঠায় তােমরা কঠোরতা অবলম্বন কর, আল্লাহ স্বাক্ষী স্বরূপ, এমনকি এটা যদি তােমার নিজের বা তোমার পিতার কিংবা তােমার আত্মীয়-স্বজনেরও বিরুদ্ধে যায় এবং সুবিচারের ক্ষেত্রে ধনী ও গরীবের মধ্যেও কোন পার্থক্য করবে না, আল্লাহ উভয়েরই যােগ্যতর অভিভাবক। প্রবৃত্তির অনুসরণ করাে না, ন্যায়ের পথ পরিত্যাগ করােনা বা বিচ্যুত হয়ােনা এবং যদি সুবিচারকে বিকৃত কর কিংবা সুবিচার প্রদর্শনে অস্বীকৃতি জানাও, তাহলে মনে রেখ তুমি যা কিছু করছ আল্লাহ সব কিছুই দেখছেন।” (৪ ১৩৫) 

 

        এটাই ইসলামের শিক্ষা। এই শিক্ষা - ইসলামের অনুসারীদেরকে সকল অবস্থায় পক্ষপাতহীন সুবিচার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে। কুরআন শরীফ বলছে যে, এমনকি শত্রুর সাথে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তুমি ন্যায়ের অনুসরণ কর।

 

        “হে বিশ্বাসীগণ সাম্য ও সুবিচারের ক্ষেত্রে তােমরা অবিচল নিষ্ঠা প্রদর্শন কর। কোনাে সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা যেন তােমাদের সুবিচার থেকে বিপথগামী করতে না পারে। সুবিচারের সাথে কাজ কর, তা পরহেজগারীর নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় কর। জেনে রাখ, তুমি যা কিছু কর, আল্লাহ সবই জানেন।” (৫ঃ ৮)

 

        আর মুসলমানরা এই আদর্শকে বাস্তবে রূপদান করেছিলেন, ইসলামের ইতিহাস, এর বহু দৃষ্টান্তে ভরপুর।

 

        রসূলুল্লাহ (সঃ) এক চুরির মামলায় কোরাইশ গােত্রের বিরাট প্রভাবশালী এক মহিলার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে তাকে যথােপযুক্ত শাস্তি প্রদান করেছিলেন। মক্কার কয়েকজন উচ্চ সম্মানিত ব্যক্তি রায় পুনর্বিবেচনার জন্য তাকে অনুরোধ করলে তিনি ঘােষণা করেছিলেনঃ

 

        “আমি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতিমা ও যদি এ অপরাধ সংগঠন করত তাহলে সেও শাস্তি থেকে বিন্দুমাত্র রেহাই পেতনা।

 

        খলীফা হযরত উমর (রাঃ)-এর সময়ের ঘটনা। বকর বিন ওযাইল গােত্রের একজন লােক হিরার একজন অমুসলিমকে হত্যা করেছিল। নিহত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের হাতে হত্যাকারীকে দিয়ে দেবার জন্য খলীফা উমর (রাঃ) নির্দেশ দিলেন এবং তা করা হল। নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকাররা হত্যাকারীকে হত্যা করে।' (Islamic Law and Constittion - by Maudoodi, P. 179.)

 

        তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রাঃ)-এর শাসনকালে খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর এক পুত্র হুমুজান নামক এক ব্যক্তিকে হত্যা করলে খলীফা হযরত উসমান (রাঃ)-এর নির্দেশে তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

 

        চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রাঃ)-এর শাসন কাল। একজন অমুসলিম জিম্মিকে হত্যার জন্য একজন মুসলমান অভিযুক্ত হয়। অপরাধ প্রমাণিত হবার পর হযরত আলী (রাঃ) হত্যাকারীকে প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। নিহত লােকটির ভাই এসে হযরত আলী (রাঃ)-কে বলে যে, সে হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিয়েছে কোন রক্তের দাবী সে আর করে না। কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) তার মুখের একটু কথায় সন্তুষ্ট হলেন না। কিন্তু নিহত ব্যক্তির ভাই এ ব্যাপারে জেদ করতে থাকে এবং হলফ করে বলে যে, সে ন্যায্য রক্ত-পণ লাভ করেছে। তখনই শুধু হযরত আলী (রাঃ) অভিযুক্তকে ছেড়ে দেবার নির্দেশ দেন এবং তিনি এ প্রসঙ্গে ঘােষণা করেনঃ

 

        “আমাদের জিম্মি (ইসলামী রাষ্ট্রে আশ্রিত অমুসলমান প্রজা) যে, তার রক্ত আমাদের রক্তের মতই পবিত্র এবং তার অর্থ-সম্পত্তি আমাদের অর্থ-সম্পত্তির মতই।” (Islamic Law and Constitutin--by Maudoodi, P.179) ।

 

        পরবর্তীকালেও, যখন ইসলামী সমাজের অধপতন ঘটেছিল, তখনও ইসলামী সুবিচারের অতুলনীয় দৃষ্টান্তের অভাব দৃষ্ট হয় না। একজন হিন্দু প্রজা সুলতান মাহমুদের বিরুদ্ধে, কাজীর আদালতে মামলা দায়ের করেন। রাজ্যের একচ্ছত্র মালিক সুলতান মাহমুদ একজন প্রজার অভিযােগের জওয়াব দানের জন্য কাজির সামনে আদালতে হাজির হন। {Travels of Ibne Batuta)।

        শেরশাহ সুরী একজন ব্যবসায়ীর সাথে অসদাচরণ করার জন্য তাঁর ছেলেকে কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন (M. Zakaullah, Tarekh-i Hind, Vol. INI, P. 341) আওরঙ্গজেব - আলমগীর এক জন অমুসলিম মহিলার অবমাননা করার অপরাধে তাঁর প্রধানমন্ত্রী আসাদখানের পুত্র মির্জা তাফাখুরকে কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। আলমগীর লিখেছেনঃ “মানুষ স্রষ্টার আমানত, নির্যাতনের হাত . থেকে এদের রক্ষা করা আমার কর্তব্য”।

(Anecdotes of Aurangzeb-by Sarkar, Pp, 109-11. See also Journal of Pakistan Historical Society, Vol- No. 1. Article on Tolerance in Islam')

 

        মুসলমানদের সুবিচার বােধের কারণেই অমুসলিমরা তাদের ধর্মের শাসকদের চেয়ে অমুসলিম শাসকের অধীনে বাস করতে অধিকতর পছন্দ করত ।

 

        1.s. Arnold of Preaching of slam গ্রন্থে লিখেছেনঃ . যখন মুসলিম সৈন্য জর্দান উপত্যকায় পৌছে এবং মুসলিম সেনাপতি আবু ওবায়দা ফিবলে তাঁর শিবির স্থাপন করেন, দেশের খ্রীস্টান জনসাধারন আরবদের লিখেনঃ “হে মুসলমমানগণ, বাইজান্টাইনদের চেয়ে আমরা আপনাদের পছন্দ করি। তারা আমাদের স্বধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের সহায়-সম্পদ হরণ করেছে এবং আমাদের করেছে গৃহহারা। আর আপনারা এনেছেন আমাদের জন্য নিশ্চিত নিরাপত্তার আশ্বাস এবং আমাদের ওপর আপনাদের শাসন তাদের চেয়ে অনেক ভালাে।'

 

        এমিসা নগরীর অধিবাসীরা তাদের নগরীর দরজা হেরাক্লিয়াসের খ্রীস্টান সেনাবাহিনীর মুখের সামনে বন্ধ করে দিয়েছিল এবং মুসলমানদের জানিয়েছিল যে, এমিসা নগরীর অধিবাসীরা গ্রীকদের অবিচার ও অত্যাচারের চাইতে মুসলমানদের শাসন ও সুবিচারকে অধিকতর পছন্দ করে। (The - Preaching of Islam-by T.W.Arnold, P. 55)

 

        ইসলামে কোন জোর-জবরদস্তি নেইঃ  ইসলাম একটি প্রচারকামী ধর্ম। আর মুসলমানদের দায়িত্ব হল, এ ধর্মের বাণী মানুষের কানে পৌছে দেয়া এবং আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দেয়া এই জীবন-বিধানকে প্রতিষ্ঠা করা। এ দায়িত্বের রয়েছে দু'টি দিকঃ  এক,সকল - প্রকার অন্যায় অবিচারের প্রতিরােধ; দুই, সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ।

 

        ইসলামের আদর্শ বলে, ধর্ম প্রচারে কোন জবরদস্তি - থাকবে না এবং অন্য ধর্মের মানুষকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা যাবে না। কিন্তু শত্রুতা-সংঘর্ষের অবসান ঘটানাের জন্য শক্তির ব্যবহার করা যাবে-করতে হবে। কারণ, আক্রমণ, সীমালংঘন ও ষড়যন্ত্রসাধন - অসহনশীলতা ও নির্যাতন-নিপীড়নের উৎস। ইসলাম নিপীড়নকারী ও অসহনশীলদের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শনের অনুমতি দেয়না।

 

        এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ

 

        “হত্যা ও ফাছাদ সৃষ্টির কারণ ছাড়া যে একজন মানুষকে হত্যা করে, সে যেন গােটা মানব সমাজকেই হত্যা করে।”

 

        “তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, যতদিন না অশান্তি ও বিপর্যয় চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হয়। যদি তারা বিরত হয়, তাহলে নিপীড়নকারী ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে আর কোন শত্রুতা রেখনা।”(২ঃ ১৯৩)।  “যারা তােমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আসে, আল্লাহর পথে তােমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, কিন্তু শত্রুতা আরম্ভ করাে না (এবং আল্লাহ কর্তৃক - নির্দিষ্ট সীমা লংঘন করোনা) মনে রেখ আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন।”

 

         ইসলাম প্রচারে বল প্রয়ােগের হুকুম দিয়ে আল্লাহ তা'আলা সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ

 

         “ধর্মে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। সত্য পথকে অন্যায়ের পথ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে দেয়া হয়েছে। যে তাগুতকে অস্বীকার করবে ও আল্লাহকে বিশ্বাস করবে, সে এমন এক মজবুত হাতল ধরবে যা কখনও ভাংবে না। আল্লাহ সককিছুই শোনেন এবং জানেন। (২:২৫৬)

 

        এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা আরাে বলেনঃ

 

        “বিজ্ঞতা ও সদুপদেশের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাক; এবং উৎকৃষ্ট ও মহোত্তম উপায়ে তাদের সাথে বাক্যালাপ কর।" (১৬:১২৫)।

 

        “তারা (অবিশ্বাসীরা) যাদের পূজা করে, তাদের সম্পর্কে কটুক্তি করাে না যদিও তারা অজ্ঞতাবশত অন্যায়ভাবে আল্লাহর সম্বন্ধে কটুক্তি করে।”

 

        "ইতিহাসের সাক্ষ্য, মুসলমানরা শুধু ইসলামের এই মহান আদর্শের কথা প্রচারই করেনি, বাস্তবে রূপদানও করেছিল। জেরুজালেম অধিকারের পর খলীফা হযরত উমর (রাঃ) খৃস্টানদের পবিত্র স্থানগুলাে ঘুরে ঘুরে দেখেন, কিন্তু তিনি কত সতর্ক ও সজাগ ছিলেন, আর্নল্ড-এর ভাষায় তা আবার পাঠ করুনঃ

 

        “খ্রীস্টানদের প্রধান পুরােহিত সমবিব্যবহারে হযরত উমর (রাঃ) পবিত্র স্থানগুলাে পরিদর্শন করেন। যখন তারা একটি গির্জা (Church of the Resurrection) পরিদর্শন করছিলেন, তখন সালাতের নির্দিষ্ট সময় এসে যায়। পুরােহিত ঐ স্থানে গির্জাতেই সালাত আদায়ের জন্য অনুরােধ করলেন। কিন্তু হযরত উমর (রাঃ), গম্ভীরভাবে সে অনুরােধ প্রত্যাখ্যান করলেন এবং বললেনঃ আমি যদি আজ এখানে সালাত আদায় করি, তাহলে পরবর্তীকালে মুসলমানরা একে তাদের এবাদতের স্থান বলে দাবী করতে পারে। (T.W. Arnold, Preaching of slam, P. 5-7)

 

        ইসলাম এই দৃষ্টিভঙ্গিরই অনুসরণ করে আসছে। কিন্তু আমাদের বন্ধুরা আমাদেরকে বনের হিংস্র পশু হিসাবে চিত্রিত করতেও দ্বিধা করেন না। কিন্তু তারা কি ইতিহাসের এ জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত মুছে ফেলতে পারেন? পারেন কি তারা ধূলা নিক্ষেপ করে সত্যের অতন্দ্র দৃষ্টিকে ঢেকে ফেলতে? তারা অভিযােগের বন্যা রটাতে পারেন, কিন্তু রাজহংসীর ডানার পানির মত ঝরে পড়বে সঙ্গে সঙ্গেই।

 

        ইসলামের অপূর্ব সহনশীল চরিত্রের প্রশংসা করতে গিয়ে অমুসলিম ঐতিহাসিকরা সাক্ষ্য দিচ্ছেনঃ “মুহাম্মদ (সঃ) তার খ্রীস্টান প্রজাদের জীবন, তাদের ব্যবসায় স্বাধীনতা, তাদের সহায় সম্পদ এবং তাদের ধর্মীয় আচার আচরণের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা প্রদান করেন।" (The History of the Decline and Fal of the Roman Empire, P 269-70)|

 

        ‘ডঃ রবার্ট’ ব্রিফল্ট লিখেনঃ , - “পূর্বাঞ্চলীয় (প্রাচ্যের ইসলামী দুনিয়া) ধর্মরাষ্ট্র (ইসলামী সরকার) বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে নিপীড়ন ও সন্ত্রাসমূলক রূপ পরিগ্রহ করেনি। বর্বরতার অন্ধকার, চিন্তার শৃঙ্খলিত দশা, বুদ্ধিবৃত্তিকে - বিদ্রোহের বিরুদ্ধে কোন চিরন্তনী সংগ্রাম-প্রবণতা, আমরা দেখিনা। অথচ এগুলােই ছিল ইউরােপের গ্রীস ও রােমান সভ্যতার অতি পরিচিত বৈশিষ্ট্য।” (Robert Briffault: The Making of umanity, P. 113)

 

        ঐতিহাসিক উইলিয়াম মূর' এর ভাষায়ঃ “বিজিতদের প্রতি ইসলামের উদারতা এবং ইহার সুবিচার ও সংহতির নীতি, রােমকদের অসহিষ্ণুতা ও নিপীড়নের সম্পূর্ণ বিপরীত এক দৃষ্টান্ত। ... সম্রাট হেরাক্লিয়াসের অধীনে যেমন ছিল,তার চেয়ে অনেকে বেশী নাগরিক ও জাতীয় স্বাধীনতা সিরিয়ার খ্রীস্টানরা . আরব বিজেতাদের অধীনে ভােগ করেছে এবং এজন্যই তারা তাদের পূর্বের জীবনে ফিরে যেতে চাইতাে না।” (Muir: The Caliphate its Rise, Decline and Fall, P, 128)

 

        “স্যার টমাস আর্নল্ড ও ঠিক এমন কথাই বলেছেন। তিনি লিখেনঃ “আরবৎশাসনের প্রথম শতকে বিভিন্ন খ্রীস্টান সম্প্রদায় যে সহনশীলতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ভােগ করেছে, বাইজান্টাইন শাসনাধীনে বহু পুরুষ ধরে তা তাদের অজানা ছিল।”

 

        ঐতিহাসিকদের এ ধরনের সংখ্যাহীন সাক্ষ্য উপস্থাপন করা যায়। সত্যনিষ্ঠ প্রতিটি ঐতিহাসিক এটা স্বীকার করেন যে, প্রতিটি ধর্ম অসহনশীলতার জন্ম দেয়, এ কথা ঠিক নয়। আর নিশ্চিতভাবে, ইসলামের বিরুদ্ধে এমন অভিযােগ আসতেই পারে না।

 

        সুতরাং ‘ধর্ম অসহনশীলতার জন্ম দেয়' এই তত্ত্বটি মিথ্যার তৈরী এক মিথ্যার ডিপাে এবং ইসলামের প্রতি এ ধরনের অভিযােগের বৃষ্টি বর্ষণ করা চরম বােকামী ও অজ্ঞতার পরিচায়ক। অভিযােগটি ধােপে টিকেনি, টিকবেও না। অনুসন্ধিৎসুদের চোখে এটা লুটিয়ে পড়বে ধূলায়। কারণ, মিথ্যা অভিযােগের কাদায় তৈরী পা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?

 

*****