আমার দেশের চালচিত্র
সত্যের আলােয় আমাদের বিবেকের বন্ধ্যাত্ব ঘুচবে কবে?
মুহাম্মাদ ফারূক হুসাইন খান
===================================================================
মানুষ, মানবতার সেবা এবং জনকল্যাণের নামে এই সভ্য যুগে এ দেশে অনুষ্ঠিত হল আরও একটি বর্বরতা। নির্মম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এ বর্বরতাকে চরম রূপ দেয়া হলাে। হানাহানি, ঘৃণা, দলাদলি, প্রতিহিংসাকে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে আবারও উস্কে দেয়া হল। সংঘটিত হলো জনগণের অর্থ সম্পদ অপচয়ের আর একটা বহ্নুৎসব। এই বহ্নুৎসবে নাম নির্বাচন।
দেশের প্রধান চারটি নগরীর লক্ষ লক্ষ মানুষের ‘মহা সেবক’ নির্বাচন হল সম্প্রতি। মেয়র ও কমিশনার পদাবলীর পরিচয়ে নির্বাচিতরা নগরীর বাসিন্দাদের দুঃখ কষ্ট লাঘব এবং তাদের সার্বিক কল্যাণ সাধনে নিয়ােজিত হবেন। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ ব্যয় করে সেবক নির্বাচন করার এটাই একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু সার্বিক নির্বাচনচিত্র এর উল্টো কথা বলে।
‘মানুষের সেবা করা’ কথাটা যত সহজে উচ্চারণ করা যায় কাজটি ততাে সহজ নয়। এ কাজে নিযুক্ত সেবক লােকটির মানুষের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা, দরদ থাকা একান্ত জরুরী। মানুষের দুঃখ-কষ্টে তার মন কেঁদে ওঠবে, মানুষের অসহায় অবস্থা দেখা মাত্রই তার সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে নিস্বার্থভাবে অসহায় মানুষটির অসহায়ত্ব মােচন করবে। এজন্য চাই উদার মন, নিস্বার্থ মনােবৃত্তি। এছাড়া যেখানে লক্ষ লক্ষ লােকের দুঃখ-কষ্ট, অসহায়ত্ব, দারিদ্র, বঞ্চনা নিয়ে কারবার, তা মােচন করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিটিকে সর্বদা দায়িত্ব সচেতন, আন্তরিক ও সহানুভূতিশীল হতে হয়। আরামকে হারাম করে, রাত নেই, সকাল নেই, বিকেল নেই অসহায় দরিদ্র মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে হয়, শুনতে হয় তাদের আর্জি-আকুতি। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, বিচারের বেলায় যাতে বে-ইনসাফ, শ্রেণীভেদ না হয় সেদিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে হয়।
এক কথায় ব্যক্তিটিকে হতে হয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, প্রশাসনিক জ্ঞানে জ্ঞানী, নির্লোভ, নিঃস্বার্থপর ও জনগণের অধিকার আদায়ে অত্যন্ত সচেতন। এতসব মানবিক গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিই কেবল এহেন দুরুহ দায়িত্ব পালন করতে পারে। যেহেতু এ দায়িত্ব পালনে পদে পদে ইনসাফ ও সততার নিক্তিতে ওজন করে জনগণের অধিকার আদায় করতে হয় তাই এ দায়িত্ব হয় দুরুহ, জটিল ও কঠিন। একজন মানুষ সে যতই নিজেকে মহামানব মনে করুক বা সে গুণ অর্জন করুক কখনােই এমন দায়িত্বভার সহজে গ্রহণ করবে না। সমাজের সকলে মিলে যদি যােগ্য মনে করে কাউকে এ দায়িত্ব অর্পণ করে তবেই সে এ দায়িত্বভার গ্রহণ করবে। যদি স্বেচ্ছায় এ দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য সমাজের যে কাউকে আহ্বান করা হয় তবে এ গুরু দায়িত্ব পালনে নিজেকে অযােগ্য এবং অন্য কোন ব্যক্তি তার চেয়ে ও যােগ্য মনে করে সবাই নিচুপ থাকবে। এটাই স্বাভাবিক, এটাই মানবতার ধর্ম।
কিন্তু সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দেখা গেল এর বিপরীত চিত্র। সরকার মেয়র ও কমিশনার পদাবলীর মাধ্যমে নিজ নিজ এলাকার জগণের ‘সেবা’ কর্মের দায়িত্ব পালনের জন্য সেবকের আহ্বান করেছেন। দেখা গেল সেবকের অভাব নেই। একটি “সেবক পদের” জন্য কয়েক ডজন প্রার্থী। অর্থাৎ তারা প্রত্যেকেই এলাকার সর্বশ্রেষ্ঠ মানব দরদী এবং মানবতার সেবা করার যােগ্য প্রার্থীর দাবীদার। পােষ্টারে, মাইকিংয়ে, দেয়াল লিখনে, শ্লোগানে, পত্রিকা বিজ্ঞাপনে, মিছিলে, ভােট ভিক্ষা করার অভিযানে সব স্থানেই প্রত্যেক প্রার্থীর একটাই দাবী, “আমিই একমাত্র এলাকার কীর্তি সন্তান, বিশিষ্ট সমাজ সেবক, এলাকার জনগণের আত্মার আত্মা, নয়ন মনি। অতএব আমাকেই ভােট দিয়ে জয়ী করুন। আপনাদের সেবা করার মহান সুযােগ আমারই প্রাপ্য।” বাংলা ভাষার বিশেষণ বিশেষজ্ঞে পরিণত হন প্রার্থীরা, নিজ গুণ কীর্তনে এসময় সবাই পরিণত হন সু-সাহিত্যিকে।
আমিই ভালাে মানুষ এ দাবী করে এবং এর সপক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে এভাবেই এ সমাজের, জনগণের সেবক নির্বাচিত হচ্ছে। আমি ভালাে মানুষ, এলাকার জনগণ আমাকে আত্মার মহান-আত্মা জ্ঞান করে, আমি এলাকার কীর্তি সন্তান, আমার জীবনটা মানব সেবার মহৎ কর্মে কাটিয়ে দিয়েছি, নিজের সম্পর্কে এ ধরনের দাবী নিশ্চয়ই কোন ভালাে মানুষ করে না। কোন ভালো (মানুষই লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় করে নিজের গুণকীর্তন করার জন্য লােক ভাড়া করে মাইকিং করাবে না, পােষ্টারিং করে তাদের গুণাবলীর ফিরিস্তি জনসমক্ষে জাহির করবে না। সে যে সৎ ও যােগ্য প্রার্থী তা প্রমাণের জন্য মিছিল, মিটিংয়ের প্রয়ােজন হয় না।
এক মানুষ অন্য মানুষের সেবা করবে, তার দুঃখ কষ্টে সহানুভূতি জানাবে, সাহায্য করবে এটা তার নৈতিক দায়িত্ব, মানবতার দাবী। এ দায়িত্ব পালন করবে সম্পূর্ণ নিস্বার্থভাবে। যে মানুষ মানবতাকে সম্মান করে সে এর জন্য কোন প্রচারের আশা করে না, আশা করে না কোন বিনিময় প্রাপ্তির। মানুষ তার প্রতিভাকে কাজে লাগাবে মানবের কল্যাণে, সমাজ সেবায় আত্মনিয়ােগ করবে এই একই মনােবৃত্তি নিয়ে মানবতা, নৈতিকতার এধর্ম যে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে সেই প্রকৃত মানুষ। তার এই আত্মত্যাগের জন্য সে অর্জন করবে মানুষের অকুণ্ঠ ভালােবাসা। সমাজ তার কার্যাবলী পর্যালােচনা করে তাকে কীর্তিমান, মহামানব বলে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হবে। কাজের মাধ্যমেই এটা অর্জিত হবে। নিজেই নিজের গুণাবলীর প্রচার-প্রোপাগাণ্ডা করার কোন প্রয়ােজন হবে না। তা ছাড়া যে ব্যক্তি সমাজের সেবক, কীর্তিমান, জনদরদী, সকলের নয়নমনি বলে সমাজে স্বীকৃতি পেয়েছে তার আবার নিজের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে তা প্রচার করার প্রয়ােজন কি? একি ভণ্ডামী নয়?
মানুষের সহানুভূতি লাভের জন্য সমাজের ভন্ড, প্রতারক, চরিত্রহীন ও ক্ষমতা লােভীদের পক্ষেই কেবল আত্মপ্রচারের প্রয়ােজন হয়, ভালাে মানুষের নয়। যেহেতু দায়িত্বপূর্ণ পদে যােগ্য ও ভালাে মানুষকে সবাই আশা করে তাই ক্ষমতালােভীরাই নিজেদের ভালাে মানুষের লেবাছ পরিয়ে হাস্যকর উপায়ে সৎ ও যােগ্য প্রার্থী দাবী করে। জনসেবা এদের উদ্দেশ্য নয়, এদের উদ্দেশ্য থাকে ক্ষমতা লাভ ও পদের সেবা। দরিদ্র, পীড়িত, অসহায় মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা লাঘব, তাদের কল্যাণ সাধনই যদি এই স্বঘােষিত জনগণের সেবকদের মহৎ উদ্দেশ্য হতাে তবে তারা হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে ‘পদ’ লাভের জন্য মাইকিং, পােস্টারিং, দেয়াল লিখন, জনসভা, মিছিল প্রচারণা ও কর্মী ভাড়ার সয়লাভ বইয়ে দিতাে না। বরং যাদের সেবা করার উদ্দেশ্য এই অর্থ তাদের সেবায়ই ব্যয় করতাে। দরিদ্র মানুষের অন্ন সংস্থানে, ঋণগ্রস্তের ঋণ শােধে, দুস্থ লােকের চিকিৎসায় ব্যয় করতাে। মানুষের সেবা করার যদি উদ্দেশ্য থাকে তবে তার জন্য বেতনভােগী কোন পদের প্রয়ােজন নেই। প্রয়ােজন নেই সে পদ লাভের জন্য প্রতিযােগিতা ও বিপুল অর্থ ব্যয়ের। সমাজের যার যে স্থানে অবস্থান সে সে স্থানে থেকেই মানুষের সেবা করতে পারে। গ্রামের বা মহল্লার রাস্তা-ঘাট নির্মান, স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা, দরিদ্রের সেবার জন্য বিশেষ কোন পদ জরুরী নয়, প্রয়ােজন সত্যিকারের সেবার মনােবৃত্তি।
সেবকের পদ লাভের জন্য সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের প্রাণান্তকর প্রতিযােগিতা, অর্থ অপচয়ের বহ্নোৎসব ঘটিয়ে এটাই প্রমাণ করে যে জনসেবা নয় পদ লাভই তথাকথিত জনদরদীদের একমাত্র টার্গেট। নির্বাচনের পূর্বে এক হিসেবে জানা গেছে শুধু ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে একমাত্র দেয়াল লিখনেই প্রার্থীদের খরচ হয়েছে এক কোটি টাকা। পুনরায় এই দেয়াল লিখন মুছতে সিটি কর্পোরেশনের ব্যয় হবে তিন কোটি টাকা যা ট্যাক্স আকারে জনগণের পকেট থেকেই নেয়া হবে। অভাগা জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য এতকিছু, অথচ সেই অভাগী জনগনের পকেটের ৩ কোটি টাকা হাওয়া, কাজের কাজ কিচ্ছুটি নয়। এছাড়া নির্বাচন পরিচালনার জন্য আনুষঙ্গিক ব্যয়, ব্যালট পেপার ছাপানাে, বহন, বাক্সবন্দী করণের ব্যয়তাে রয়েছে যা জনগণকেই বহন করতে হবে। এভাবে জনগণের দুঃখ কষ্টের লাঘবকারী নির্বাচন করতে গিয়েই গুণতে হচ্ছে চড়া মাশুল। সুন্দর রাস্তায় চলার আশায়, বিজলী, গ্যাস, পানির সুষ্ঠু সরবরাহ পাওয়ার আশায়। প্রতিনিধি নির্বাচন করতে গিয়ে বাড়তি ট্যাক্স আকারে এ নির্বাচন ব্যয় তাদেরই বহন করতে হচ্ছে। ফলে দেখা যায় দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, ট্যাক্স বেড়েছে, বেড়েছে সংসারিক ব্যয়। এ যেন এক কৌটা আলতা কিনতে পরিধানের জামা কাপড় বিক্রি করার অবস্থা। জনগণের দুর্ভোগ, দুর্দশা এখানেই শেষ নয়। নির্বাচনের নামে ৪ টি মহানগরীতে পুরাে একমাস যেন যুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করছিল। একদলের প্রার্থী কিভাবে অন্য দলের প্রার্থীকে পরাজিত করবে দলীয় সমর্থকরা সে চিন্তা এবং উপায় উদ্ভাবনে বিভাের ছিল।
এক প্রার্থী অন্য প্রাথার চরিত্র হননে সভা-সমাবেশে সমালােচনার বান ছুড়েছে। বিপক্ষ দলের প্রার্থী ও কম যান না। তিনিও পাল্টা বান ছুড়ে দিয়েছেন। এই ছােড়াছুড়ির ফলশ্রুতিতে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা, হিংসা, হিংস্রতা ছড়িয়ে পড়েছে। পরিণতিতে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, হাতাহাতি, নির্বাচনী ক্যাম্পে অগ্নি সংযোগ, লুটতরাজ চলেছে অবাধে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, যে মানুষদের সেবা করার জন্য প্রার্থীরা ভােট যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল পরাজিত হয়ে লালবাগের জনৈক প্রার্থী প্রতিহিংসা পুরণে ব্রাশ ফায়ার করে পাখির মত সেই ৬ জন মানুষকে গুলী করে হত্যা করে। এছাড়া এই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে আরও ২১ জনকে জমের সাথে লড়াই করতে হয়েছে হাসপাতালে। খুলনায়ও জনৈক পরাজিত প্রার্থী প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ার অপরাধে মসজিদের ইমাম মাওঃ শাখাওয়াত হােসাইনসহ এলাকাবাসীর ওপর হামলা চালায়। ব্যাপক লুটতরাজ, ভাংচুর, গুলী বর্ষন করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। মানব সেবাই বটে! স্বঘােষিত জনগণের সেবকরা যে ভাল মানুষের খােলস ধারণ করে কুৎসিত চরিত্রকে আড়াল করে নির্বাচনী পরীক্ষায় পাশ করতে চায় এটা তার একটা জ্বলন্ত প্রমাণ।
তথাকথিত বহু দলীয় গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে এভাবে সমাজে ক্ষমতালােভী, কুৎসিত চরিত্রের লােকেরা অর্থের দাপটে ক্ষমতায় পূর্ণবাসিত হচ্ছে। কেননা এ নির্বাচন পদ্ধতিতে জনগণের প্রার্থীর চরিত্র, সেবার মনােবৃত্তি, দায়িত্ব পালনের যােগ্যতা যাচাই করে ভােট দেয়ার কোন উপায় নেই। এখানে দল মনােনয়ন দিচ্ছে। নৈতিকতা, যােগ্যতা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। এলাকায় তার দাপট, দলের প্রতি অনুগত্যের পরিমাণ, টাকার ভাণ্ডারই মনােনয়নের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। ফলে প্রার্থী যতই অযােগ্য হােক। দলীয় সমর্থনের জন্য তাকেই ভােট দিতে হচ্ছে। এ কারণেই স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ প্রশাসনেও দেখা যায়। কালাে টাকার মালিক, স্মাগলার, কুখ্যাত খুনী, ত্রাস সৃষ্টিকারী মাস্তান-চাঁদাবাজের আনাগোনা। এদের কারণেই দেশ আজ ঘুষখাের, মাস্তান, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ, খুনী, চোরাকারবারী মূনাফাখোর ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের হাতে জিম্মি ইউনিয়ন থেকে শুরু সকল প্রশাসনিক সেক্টরে নির্বাচিত প্রার্থীর অবস্থান, অথচ দূর্নীতি আজ জাতির এক নম্বর সমস্যা এ অবস্থার জন্য দায়ী বহুদলীয় তথাকথিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতি শাসন ব্যবস্থায় ভালাে লােক নির্বাচনে যে অক্ষম তার প্রমাণ, জাপান, ইটালী, ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে দূর্নীতি যৌন কেলেঙ্কারীর অভিযােগে ঘন ঘন সরকার পতনের ঘটনা।
এ পদ্ধতি জনগণের সেবক নির্বাচন করতে গিয়ে পক্ষান্তরে জনগণকে শােষণ করছে, তাদের দুর্ভোগ দুর্দশার মাত্রা আরও বৃদ্ধি করছে। দেশের দরিদ্র ও অভাগা জনগণের মুল্যবান অর্থ সম্পদের অপচয় না করে যদি প্রতিটি শহর, বন্দর, গ্রামে গঞ্জে চাহিদা ও প্রয়ােজন অনুযায়ী স্থানীয় লােকদের মধ্যেকার। বিচক্ষণ ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করা হতাে এবং এই কমিশনের ওপর এলাকার পরিবেশ পরিস্থিতির সম্পর্কে অভিজ্ঞ এবং যােগ্য প্রার্থী নির্বাচনের দায়িত্ব দেয়া হতাে তবে কি স্বঘােষিত সমাজ ও মানব সেবকের অপেক্ষা যােগ্য ও সৎ প্রার্থী নির্বাচিত হতাে না? অবশ্যই হতাে। এক এলাকায় পাশাপাশি অবস্থান করে একজন স্থানীয় ব্যক্তি প্রতিবেশীকে যতখানি গভীরভাবে চিনবেন, এলাকা সম্পর্কে সম্পর্কহীন ব্যক্তির পক্ষে ততােখানি চেনা কখনােই সম্ভব নয়। এছাড়া দেশের জনগণের প্রতিনিধি দাবীদার কয়েকজন এমপি যখন দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে পারছে সেই একই পদ্ধতিতে একটি ক্ষুদ্র এলাকার কমিশনার / মেম্বার প্রমুখ দায়িত্বশীলদের কেন নির্বাচিত করা যাবে না? এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বিপুল অর্থ অপচয়ের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব। সম্ভব দলাদলির রাজনীতির মাধ্যমে সমাজে হিংসা, বিদ্বেষ ছড়ানাের পথ রূদ্ধ করা।
সমাজে ও রাষ্ট্রে বহুদলীয় রাজনীতির ভয়ঙ্কর কুফল প্রত্যক্ষ করেও যারা এর স্বপক্ষে ওকালতি করে একে আধুনিক যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি দাবী করে হয় তারা মুখ অথবা ভণ্ড প্রতারক। এ ‘তন্ত্রের’ কুফল উপলব্ধি করেও যারা একে প্রতিষ্ঠার জন্য গলদঘর্ম তারা মানবতার মিত্র নয়, শত্রু। বহুদলীয় গণতন্ত্রে ব্যক্তির চরিত্র, যােগ্যতা, প্রশাসনিক জ্ঞান, ইনসাফ যাচাই করার কোন সুযােগ নেই। দলে যার প্রভাব বেশী সেই ক্ষমতায় আসতে পারে তার চরিত্র যেরূপই হােকনা কেন। পূর্বেই বলা হয়েছে, দলীয় প্রার্থী মনােনয়নে মানুষের “মনুষত্ব” বিচার করা হয় না, বিচার্য হয় তার আনুগত্য, প্রভাবের পরিমাণ ও টাকার অঙ্ক। তাছাড়া ভালাে মানুষ কখনাে নিজেকে ভালাে মানুষ বলে প্রচার করে ভােট ভিক্ষা করে না। ফলে টাউট, বাটপার, ভণ্ড-প্রতারকরাই ভালাে মানুষ বলে প্রচার করে নির্বাচিত হয়। দলটি পরিণত হয় দেশের ক্ষমতালােভী, স্বার্থপর, ভণ্ড-প্রতারকদের ব্যাটেলিয়নে। এভাবে দেশের সার্বিক ক্ষমতার দণ্ড চলে যায় ‘মনুষত্বহীন’ মানুষদের কব্জায়। ক্ষমতায় গিয়ে এরা স্বমূর্তীতে আত্মপ্রকাশ করে। আমাদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে যে নীতিহীনতার প্লাবন তা থেকে মুক্তি পেতে হলে সর্ব প্রথম বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে এই জাহেলিয়াতের কবল থেকে মুক্তি অর্জন করতে হবে। আমরা মুসলমান, আমাদের যােগ্য, সৎ, জ্ঞানী জনকল্যাণকামী নেতা নির্বাচন করার একটা সুষ্ঠু বিধান রয়েছে। এতে প্রচার প্রােপাগাণ্ডা, মিছিল, মিটিং করে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের কোন সুযােগ নেই।
এ পদ্ধতিতে সন্ত্রাস সৃষ্টি, জাতিকে দলে দলে বিভক্ত করা, ঈর্ষা, বিদ্বেষ ছড়িয়ে জনগণকে হানাহানিতে লিপ্ত করার কোন অবকাশ নেই। বহুদলীয় ঐ গণতন্ত্র ইসলামের গ্রহণযােগ্য কোন মতবাদ নয়। নেতা নির্বাচনে ইসলামী পন্থা হল-যে এলাকার জন্য নেতা নির্বাচনের প্রয়ােজন সেই এলাকার বিজ্ঞ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও ন্যায়নীতি সচেতন ব্যক্তিগণের সমন্বয়ে, একটা গ্রুপ বা কমিশন থাকবে। এই কমিশন এলাকার সকলের মধ্যে যে বেশী জ্ঞানী, উদার, ন্যায়পরায়ন, ইনসাফকারী তাকে এ দায়িত্বে নির্বাচিত করবে এবং তার অন্যান্য সহকর্মীরাও এই যােগ্যতার মানদণ্ড অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে নির্বাচিত হবেন। নেতা বা নেতার সহকারীরা সৎ ও ন্যায়পরায়ন হবেন বলে। তারা একে অন্যের মতামতের প্রতি যেমন শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও আস্থা পােষণ করবেন, তেমনি জাতীয় ও জনস্বার্থের খাতিরে একে অপরের ভুল-ত্রুটি শুধরে দেবেন যে দায়িত্ব পালনের জন্য আধুনিক যুগে বিরােধী দলের জন্ম দেয়া হচ্ছে।
তারা একে অপরের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা পােষণ করবেন বলে নিজেদের ভুল-ক্রটি উদার চিত্তে মেনে নেবেন এবং সংশোধন করবেন। এটাই সর্বাধুনিক, সর্বকালের জন্য প্রযােজ্য, সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র পরিচালক নির্বাচন পদ্ধতি। কেননা দেশের সকল মানুষই জ্ঞানী এবং রাজনীতি সচেতন নয় যে তারা উত্তম ব্যক্তিকে নেতা নিযুক্ত করতে সক্ষম। যদি তাই হতাে তাহলে তাদের নেতা এবং প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়ােজন হতাে না। সবাই জ্ঞানী বলে একে অপরের অধিকার, দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকতাে, স্বাভাবিকভাবেই আইন শৃঙ্খলা বজায় থাকতাে, সকল মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করতাে। এ অবস্থা যখন মানব সমাজে অকল্পনীয় তবে যারা জ্ঞানী এবং রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি দেশের নেতা প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মী নিয়ােগ তাদের হাতে ছেড়ে দেয়াই উত্তম নয় কি? জেলেকে দিয়ে যদি উকিলের বা ইঞ্জিনিয়ারের কাজ পাওয়া বা করানাে না যায় তবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যারা নেতা নির্বাচন ও রাজনীতি-সম্পর্কে অনভিজ্ঞ তাদের দিয়ে নেতা নির্বাচন করানাে কি চরম মূর্খতা নয়?
অতএব, আমাদের জাতীয় জীবনে এই যে জাহেলিয়াত চেপে বসেছে, যা আমাদের ঐক্য, সংহতিতে পুণঃ পুণঃ আঘাত হেনে চলছে তাকে উৎখাত করে মানবতা ও মুক্তির এ মতাবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রয়ােজনে ধন-মাল এমনকি প্রাণও কোরবান করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। গর্জে উঠুক সেই সর্বস্বত্যাগী মর্দে মুজাহিদের কাফেলা।
═──────────────═