JustPaste.it

বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি
রফিকুল ইসলাম

======================


      “কাণ্ডারী, তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর, -
      বাঙ্গালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর”।


     পলাশীর যুদ্ধের কথা কে না জানে। এই যুদ্ধ বাঙ্গালী জাতির জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ও শোকাবহ ঘটনা। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধে বিহার এবং উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। ফলে বাংলার শাসনভার ইংরেজদের হাতে ন্যাস্ত হয় এবং প্রায় দু'শো বৎসরের জন্য আমরা আমাদের স্বাধীনতা হারাই । কিন্তু বাংলার এত সৈন্য সামন্ত থাকা সত্বেও নবাব পরাজিত হলেন কেন? তার অন্যতম কারণ. নবাবের কিছু ঘনিষ্ঠ সহচর ও আত্মীয় ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করে নবাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতায় লিপ্ত হয়। আর এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলে বাংলার মাটিতে নেমে আসে ইংরেজদের কালো শাসন। কিন্তু এসব বিশ্বাসঘাতকদের ইতিহাস ক্ষমা করেনি, ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার সাথে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তি কঠোর ও নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়। আমরা সংক্ষেপে এখন এ নিয়ে আলোচনা করছি।
     ১। মীর জাফরঃ সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কারীদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তি। সে নবাব হওয়ার লোভে ইংরেজদের সাথে হাত মিলায় এবং পলাশীর যুদ্ধে নীরব ভূমিকা পালন করে। সে ইংরেজদের পুরো সহযোগিতা প্রদান করে এবং যাবতীয় গোপন খবরাখবর ক্লাইভের নিকট প্রেরণ করে নবাবকে পরাজয়ে বাধ্য করে। সিরাজের পরাজয়ের পর মীর জাফর নিজে নবাব হন। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস।  দুরারোগ্য কুষ্ট রোগে আক্রান্ত হয় এই কলংকিত ব্যাক্তি। তার সর্বাঙ্গে পচন শুরু হয়, অত্যন্ত করুণ ও ন্যক্কারজনক ভাবে মীর জাফরের শেষ জীবন কাটতে থাকে এবং একাকী ও ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে তার শোচনীয় মৃত্যু ঘটে। মীর জাফরের এ গাদ্দারীর কারণে আজও তার সমাধিতে পর্যটকরা ঘৃণা ও ক্ষোভে থু থু নিক্ষেপ করে । 
      মীরনঃ সনে ছিল মীর জাফরের অন্যতম পুত্র। সে অত্যন্ত লোভী, নির্দয় ও দুশ্চরিত্রের ছিল। মীরন সিরাজকে হত্যার নির্দেশ দেয় এবং নবাবের মা ভাই সহ অন্যান্য সতের ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিন্তু অমানুষ মিরণের জন্য অপেক্ষা করছিল নির্মম শাস্তি। ইংরেজরা নির্মমভাবে মীরনকে হত্যা করে প্রচার করে. বজ্রপাতে মীরনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর _নরপিশাচ. ইংরেজ ভক্ত মীরনের চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। 
      ৩। মোহাম্মদী বেগঃ নবাব পরিবারের লালিত পালিত মোহাম্মদী বেগ বিশ্বাসঘাতকতার এক বড় দৃষ্টান্ত, অত্যন্ত অসহায় অবস্থা থেকে তাকে তুলে এনে ছিলেন নবাবের পিতা। অথচ এই মোহাম্মদী বেগই নবাবের গলায় ছুরি চালিয়ে তাকে হত্যা করে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছিল সে। ইংরেজরা এই অকৃতজ্ঞ পাষণ্ডের শরীরের অর্ধেক মাটিতে পুতে কুকুর দিয়ে খাইয়েছিল।
       ৪। জগৎশেঠঃ সে সময়ের প্রচুর অর্থ ও ধন সম্পদের মালিক ছিল জগৎ শেঠ। সে ইংরেজদের একান্ত ভাবে সহযোগিতা করে ছিল। নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্র কারীদের মধ্যে সে ছিল অন্যতম প্রধান - ব্যক্তি। সে ইংরেজদের লক্ষলক্ষ টাকা অর্থ সাহায্য দেয়। কিন্তু ইতিহাস তাকে ক্ষমা করেনি। মীর কাসিমের রাজত্ব কালে অর্থলোভী স্বার্থপর জগৎ শেঠকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।
৫। ঘসেটিবেগমঃ নবাবের খালা হওয়া সত্ত্বেও ঘসেটি বেগম সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। দুশ্চরিত্রা ঘসেটি রেগম রাজবল্লভের কুপরামর্শে ইংরেজদের সহযোগিতা প্রদান করে। নবাবের নিকটাত্মীয় বিশ্রী স্বভাবের এই ষড়মন্ত্রকারীনীকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা কর! হয়!
      ৬। রাজবল্লভঃ বিক্রমপুরের কোটিপতি রাজা রাজ বল্লভ পলাশী ষড়যন্ত্রের এক অন্যতম মূল নায়ক : নবাবের বিরদ্ধে সে সকলকে কুমন্ত্রণা প্রদান করতো । কিন্তু রাজ বল্লভ ইতিহাসের শাস্তি থেকে রক্ষা পায়নি। নতুন করে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মীর জাফর রাজ বল্লভকে গলায় বালুর বস্তা বেঁধে গঙ্গায় নিক্ষেপ করে। সাথে সাথে তার পুত্র উর্মিদ রায়কেও হত্যা করা হয়, এভাবেই গঙ্গার জলে সমাধি ঘটে বিশ্বাসঘাতক পিতা পুত্রের।
       ৭। রায়দুর্লভঃ সিরাজউদ্দৌলার অন্যতম প্রধান সেনাপতি রায় দুর্লভ নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে ইতিহাসে কলংকিত হয়ে আছে। ইংরেজদের সে গোপনে সাহায্য করতো। পলাশীর যুদ্ধে রায়দুর্লভ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। পরবর্তিকালে বিশ্বাসঘাতক রায় দুর্লভকে কারাগারে নিক্ষেপ করে "অত্যন্ত নির্যাতন সহকারে করুণ অবস্থায় তাকে মৃত্যুর মুখে নিক্ষেপ করে।
      ৮। ইয়ার লতিফঃ নবাবের আরেকজন সেনাপতি ইয়ার লতিফ পলাশীর যুদ্ধে নবাবকে কোন প্রকার সাহায্য না করে দর্শকের মত দাঁড়িয়ে থাকে। পরবর্তি সময় ইংরেজরা.তাকে হত্যা করে তার লাশ লুকিয়ে ফেলে শেষ পর্যন্ত তার ঘৃণ্য লাশের কোন খবরই পাওয়া যায়নি ?
      ৯। ফকির দানাশাঃ পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অসহায় নবাব সিরাজুদ্দৌলা প্রাণ রক্ষার জন্য দানাশা নামে এক ফকিরের আস্তানায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু ফকির দানাশা নবাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে শক্রদের কাছে নবাবের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দেয়। ফলে নবার ধরা পড়েন। কিন্তু আল্লাহর কি ইচ্ছা, বিশ্বাসঘাতক ফকির দানাশা রেহাই পায়নি উপযুক্ত শাস্তি থেকে। কালসাপের বিষাক্ত ছোবলে এই নির্দয়, লোভী ফকিরের জীবন লিলা সাঙ্গ হয়।
       ১০। লর্ডক্লাইভঃ নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ইংরেজদের শিরোমণি ছিল এই লর্ড ক্লাইভ। সাম্রাজ্যরাদী.এই বেনিয়া বৃটেনের টেম্‌স্‌ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক.লিখেন, ক্লাইভ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে সে ইচ্ছে করে নিজ গলায় ছুরি চালিয়ে ছিল। ইতিহাস ক্লাইভকেও ক্ষমা করেনি, বরং তাকেও উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়েছে।
      এছাড়াও উমি চাঁদ, দুর্লভ রায় প্রমুখ ইতিহাসের কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা পায়নি, অত্যন্ত দরিদ্র ও কপর্দকহীন অবস্থায় এদের মৃত্যু ঘটে। প্রকৃত অর্থেই বিশ্বাসঘাতকতার ফল খুব কঠিন ও ভয়ংকর হয়। যে সব বিশ্বাসঘাতক ষড়যন্ত্রকারী নিজেদের হীন স্বার্থ রক্ষার খাতিরে ইংরেজদের কাছে বাংলার স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছিল, পরবর্তিকালে নির্মম ও করুণ পরিণতি তাদের জন্য নির্ধারিত ছিল। সমস্ত বাঙ্গালী জাতির অভিশাপ, ঘৃণা ও ধিক্কারে এসব বিশ্বাসঘাতকদের আত্মা আজও অভিশপ্ত। তাদের করুণ মৃত্যুই প্রমাণ করে দেয়, যারা দেশের ও জাতির সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে, কেউ তাদের ক্ষমা করে না।