ইনসাফের আদালতে...
গণতন্ত্রঃনবী আদর্শের মুকাবিলায় ফেরাউনী শাসনবব্যবস্থার আরেক নাম
হাসসান খান
==================================================
মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে কাছে অতি পরিচিত একটি নাম “ফেরাউন”। তবে প্রতিটি মুসলমান এ নামটিকে অত্যন্ত ঘৃণাভরে স্মরণ করে থাকে। তারা ফেরাউনকে খােদাদ্রোহী, জালিমের প্রতীক মনে করে। মূলতঃ ফেরাউন বলতে কাউকে নির্দিষ্ট করে বুঝায় না। মিশরের প্রাচীন আমালিক বংশের সম্রাটদের উপাধী ছিল এই ফেরাউন! যিনি যখন সম্রাট হতেন সে-ই এই উপাধি ধারণ করতেন। মুসলমানদের কাছে ফেরাউন এত পরিচিত হওয়ার কারণ এই বংশের ২০তম শাসক "মিনফাতাহ”। ইনি হযরত মুসা (আঃ)- এর সময়কালের মিশরের সম্রাট ছিলেন এবং হযরত মুসা (আঃ) একে তাওহীদের পথে দাওয়াত দিলে সে দম্ভভরে নিজেকে খােদা বলে দাবী করে এবং সমগ্র মিসরবাসীকে তাকে খােদা বলে স্বীকার করতে নির্দেশ দেয়। অবশেষে আল্লাহর গযবে এই জালিম। নীল নদ পার হতে গিয়ে ডুবে মারা যায়। ফেরাউনের এ অপ্রাসঙ্গিক ইতিহাস বর্ণনা করার একটাই উদ্দেশ্য যে, মিসরের ২০তম ফেরাউনের নীল নদে ডুবে মরার সাথে সাথেই যে দুনিয়া থেকে সকল ফেরাউনের অস্থিত্ব মুছে যায়নি, তা বলা স্বঘােষিত না হলেও অঘােষিত বহু ফেরাউন যুগে যুগে মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে, নিজেদেরকে মানুষের প্রভুরূপে প্রতিপন্ন করেছে।
সভ্যতার এই চরম যুগেও অঘােষিত ফেরাউনের সংখ্যা কম নয়। এক আল্লাহ-তে বিশ্বাস স্থাপন কারী, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়কারী, রােযা পালনকারী মুসলমানদের শাসক রূপেও অধিষ্ঠিত রয়েছে বহু ফেরাউন। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই আমরা মুসলমান দাবীদাররা অসংকোচে মেনে নিচ্ছে এসব ফেরাউনের আদেশ, নিষেধ ও আইন-কানুন। ফেরাউন নিজের ধন-সম্পদ, ঐশ্বৰ্য্য-প্রতিপত্তি, মূল্যবান সিংহাসন, রাজমুকুট, সােনা-রূপা ও দামী পাথরের বিশাল সংগ্রহ প্রদর্শন করে এগুলােকে ক্ষমতা ও ইজ্জতের মাপকাঠিরূপে বর্ণনা করে নিজের কওমের লােকজনের নিকট নিজেকে খােদা বলে দাবী করেছিল। মিশরের লােকজনের নিকটও ধর্মীয় ও পার্থিব ইজ্জতের মাপকাঠি ছিল এসবই। ফলে তারা একবাক্যে ফেরাউনকে খােদা বলে স্বীকার করে নিল। এভাবে ফেরাউন মিশরীয়দের তাদেরকে দাস বানিয়ে রাখে। কিন্তু আধুনিক যুগের অঘােষিত ফেরাউনদের নেই তেমন কোন ক্ষমতার দাপট, ব্যক্তিগত সম্পদ, জৌলুসময় রাজ সিংহাসন বা মহল। তারা শূন্য হাতে আমাদের ধােকা দিয়ে আমাদেরই সম্পদ অপচয় করে, আমাদের ওপর তাদের শাসন চাপিয়ে দিচ্ছে আর আমরা সেকালের মিশরীদের চেয়েও বুদ্ধিহীনতার পরিচয় দিয়ে তাদের দাসত্ব মেনে নিচ্ছি। ফেরাউন মিশরীদের ধােকা দিয়েছিল ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে, অন্যদিকে অঘােষিত ফেরাউনরা আমাদের ধােকা দিচ্ছে সভ্যতা, আধুনিকতা ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে। বিশ্বব্যাপী চলছে এই নব্য ফেরাউনী জাহিলিয়াতের সয়লাব। জগদ্ধল পাথরের মত মানুষের ওপর চেপে বসছে এই ফিতনা। এই ফিতনার নাম গণতন্ত্র।
এ এমন একটি মােহনীয় শব্দ, সূক্ষ্ম প্রতারণার হাতিয়ার যার স্বরূপ উপলব্ধি করা সহজ নয়। এ জন্যই বিশ্বব্যাপী মানুষ কঠিন বিভ্রান্তি, কঠিন প্রতারণার ফাঁদে আটকা পড়ে আছে। আর গণতন্ত্র এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে তার সাফল্যের চূড়ান্ত শীর্ষে। গণতন্ত্রের ভেল্কিবাজী অনেকে যেমন উপলব্ধি না করতে পারার দরুন একে সর্বোত্তম শাসন ব্যবস্থা বলে মেনে নিচ্ছে, তেমনি অনেক বিভ্রান্ত মুসলমানও বিজ্ঞ দার্শনিকের ন্যায় বলে ফেলেন যে, রাসূল (সাঃ)-ই গণতন্ত্রের বুনিয়াদ রচনা করেছেন। এ গণতন্ত্র ইসলাম সম্মত। মূলতঃ যারা পাশ্চাত্যের জড়বাদী শিক্ষায় শিক্ষিত এবং পাশ্চাত্য ভাবধারার সংক্রামনের শিকার, সেসব মুসলমানের পক্ষেই কেবল এ উক্তি করা সম্ভব। গণতন্ত্র ইসলাম সম্মত এ ফতােয়া দেয়ার সময় তারা যদি ইসলামী রাষ্ট্র দর্শন এবং ইসলামের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি সম্পর্কে লেখা দু'একখানা কিতাবের পাতায় একটু নজর বুলিয়ে নিতেন তবে এ উক্তি করার দুঃসাহস হতাে না। অবশ্যই তাদের উপলব্ধি হতােঃ
(১) শুধুমাত্র রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থার রাজনৈতিক মতবাদ হলাে গণতন্ত্র। পক্ষান্তরে রাসূল (সাঃ) তাঁর প্রতিষ্ঠিত মদীনা রাষ্ট্রে যা’ কায়েম করেছিলেন তার নাম হল ইসলাম। ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন-যাপনের পূর্ণ প্রক্রিয়ার নামই হল ইসলাম। এর এক একটা ইসলামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ এবং প্রতিটি অন্যটির সাথে সম্পর্কযুক্ত। রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থাই পূর্ণ ইসলাম নয় বরং এটা ইসলামের একটা ক্ষুদ্রতম অংশ। এজন্যেই ইসলাম রাষ্ট্রীয় নীতিকে আলাদা কোন মতবাদ তথা গণতন্ত্র নামে অভিহিত করার প্রয়ােজন বােধ করেনি। তাছাড়া ইসলামের মূল ভিত্তি আল কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, “তােমাদের আমি আমার খলিফা হিসেবে সৃষ্টি করেছি, তােমরা আমার জমীনে আমার দ্বীন ইসলামকে কায়েম করবে, ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবে এই উদ্দেশ্যেই।” আল মতবাদ কায়েমের নির্দেশ এবং তথাকথিত গণতন্ত্র বা Democracy- এর সমার্থক কোন শব্দও নেই।
(২) রাসূল (সাঃ)-এর রাষ্ট্রের সংবিধান ছিল আল কুরআন, যার মূল উৎস আল্লাহর কুরআন। কুরআনের আলােকেই সকল রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণীত হয়েছিল। পক্ষান্তরে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণীত হয় মানব রচিত আইন ও বিধানের সমাহারে!
(৩) রাসূল (সাঃ) - এর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র বা যে কোন ইসলামী রাষ্ট্রেরই হােক প্রশাসনের প্রতিটি সদস্যকে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতে হবে। অর্থাৎ‘ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ’ -চূড়ান্ত হুকুম দেওয়ার মালিক, সার্বভৌমত্বের অধিকার কারােই নেই। এ অধিকার একমাত্র আল্লাহর জন্য সংরক্ষিত। পক্ষান্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণকে বলা হয় সকল সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। বর্তমানে প্রচলিত গণতন্ত্রের জন্ম প্রাচীন গ্রীসে। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বের গ্রীসে ডেমােক্রেসি, সিনেট, এসেম্বলীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু মধ্য যুগে রাজতন্ত্রের ব্যাপক পত্তন হওয়ার সাথে সাথে এর বিলুপ্তি ঘটে। এ সময় রাজা-বাদশাহ ও সামন্তদের সাথে সাথে জায়গীরদার ও চার্চের প্রধান হিসেবে পােপ ও পাদ্রীরা শাসন ও শােষনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করত। পাদ্রীরা রাজার শাসন কার্যেও প্রভাব রাখতে শাসন সংক্রান্ত আইন-কানুন পাদ্রীরা প্রণয়ন করত এবং রাজারা সেই অনুয়ায়ী শাসন করত। এ সময় পাদ্রীরা ধর্মের নামে ব্যাপক স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে।
রাজারাও শাসন ও জুলুম চালিয়ে বিলাসিতায় দিন কাটাত। ফলে জনগণ বাধ্য হয়ে রাজার জুলুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে পােপ ও পাদ্রীরা রাজার পক্ষে এগিয়ে এসে ফতােয়া জারী করত যে, “যে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সে ঈশ্বর এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।” এখানেই শেষ নয়। পোপ ও পাদ্রীরা জনগণকে এ বলে অন্ধ ও বিভ্রান্ত করে রাখত যে, ধর্মীয় প্রধান ব্যক্তিত্ব পােপ ও পাদ্রীরা ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তারা সাধারণ মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করার অপরিহার্য ও একমাত্র মাধ্যম। সাধারণত মানুষের পাপ মােচন করার জন্য আল্লাহর নিকট থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত বলে দাবী করত। স্বভাবতই খৃষ্ট সমাজ এদেরকে ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রতীভূ মনে করত। কিন্তু এই ধর্মীয় নেতারা যখন ধর্মের নামে জুলুম নির্যাতন ও বিজ্ঞান বিরােধী ভূমিকা নিল তখন জনগণের মন থেকে ধর্মের প্রভাব খুব দ্রুত মুছে যেতে লাগল। তারা মনে করতে লাগল, যে ধর্ম শােষন ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাকে শাসন ব্যবস্থায় রাখলে মানুষ শুধু শােষিতই হবে।
তারা ঈশ্বরকে জুলুমের প্রতীক, বিজ্ঞান ও প্রগতির শত্রু বলে ভাবতে শুরু করে। একসময় পাদ্রী ও পােপদের জাহেলি ত ৎপরতার কারণে অধিকাংশ খৃষ্টান বুদ্ধিজীবী আল্লাহর অস্তিত্বই অস্বীকার করে বসে। রাজতন্ত্র ও পাদ্রীতন্ত্রের বিরােধীতা করার জন্য তারা হাজার হাজার বছরের প্রাচীন গণতন্ত্র, সিনেট, এসেম্বলীকে পুনরুজ্জীবিত করল এবং এর সাথে জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক এ মােহময় কথাটি জুড়ে দিল। এই জাহেলিয়াত এবং একটি মিথ্যা কারণে সৃষ্ট অন্য একটি মিথ্যা ওপর হল আধুনিক গনতন্ত্রের ভিত্তি। আধুনিক এ গণতন্ত্রের দ্বিতীয় জন্ম বেশী দিন আগে হয়নি। মাত্র ষোড়শ শতকের শেষ দিকে। কিন্তু আমরা একে ইসলাম সম্মত বা মহোত্তম শাসন ব্যবস্থা বলে বিশ্বাস করি কিভাবে? পাশ্চাত্যের যে দার্শনিকেরা এই গণতন্ত্রের থিউরী দিয়েছেন তারা কি মুসলমান ছিলেন? তারা কি ইসলামী দর্শনে প্রভাবিত হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যুগােপযােগী করে তােলার জন্য এ থিউরী বানিয়েছেন? অথবা তারা কি মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে এ থিউরী আবিষ্কারে ব্রত হয়েছেন যাতে ইসলাম ও তথাকথিত নয়া গণতান্ত্রিক থিউরীর মধ্যে কোন সংঘর্ষ না বাধে? যে খৃষ্টান জগত মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করার জন্য শত শত বছর ধরে আমাদের। বিরুদ্ধে ক্রুসেড চালিয়েছে তারাই আবার আমাদের ধর্ম-দর্শনকে রাষ্ট্রনীতি হিসেবে। গ্রহণ করবে বা মুসলমানদের গ্রহণযোগ্য। অথবা ইসলামের সাথে মিলে যায় এমন কোন মতবাদ উদ্ভাবন করবে এমনটা কি আমরা পাশ্চাত্যের কাছে আশা করতে পারি? যার ভিত্তিই হল জাহেলিয়াত, বিদ্বেষ ও হিংসা? প্রত্যেক মুসলমানকেই মনে রাখতে হবে, প্রচলিত গণতন্ত্রের পূনর্জন্মের হাজার বছর আগে রাসূল (সাঃ) ইসলামী রাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করেছিলেন।
ইসলামের অভূদয়ের একমাত্র কারণই হল মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়া, সকল মানুষ রচিত আইনকে বাতিল করে বিশ্ব মানুষকে এক আল্লাহর আইনের শাসনের আওতায় এনে সকল জুলুম, অত্যাচার থেকে মুক্তি দেয়া। তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সমাজের ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রভু সেজে বসা মানুষের আধিপত্য খর্ব করা। এজন্য ইসলাম কোন রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করে না। কেননা এরা নিজেরা আইন প্রণয়ন করে মর্জি মাফিক মানুষকে শাসন করত। কিন্তু ইসলামী দর্শন হল-এই বিশ্বের সবকিছুর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ। মানুষ তার সৃষ্টির একটা ক্ষুদ্রতম অংশ মাত্র। বিশ্বের সবকিছুই আল্লাহর দেয়া বিধান মাফিক পরিচালিত হয়, তারই আদেশে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ঘুরছে, গাছ ফল দিচ্ছে, মেঘ বৃষ্টি বর্ষণ করছে। কারাে কোন অধিকার বা ক্ষমতা নেই এই বিধান লংঘন করার। এজন্যই মেঘ বৃষ্টিই বর্ষন করে মধু বর্ষন করে না। গাছ ফলই দেয় অন্য কিছু ফলায় না। সৃষ্টির একটা অংশ হয়ে মানুষও নিশ্চয় আল্লাহর দেয়া আইন বিধান অনুযায়ী চলবে। তা ছাড়া স্বাভাবিক ভাবেও বুঝা যায় যে, একজন গৃহকর্তা যখন পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পােষণের সংস্থান করেন, সে নিশ্চয়ই তাঁর অধিনস্থদের তার ইচ্ছা, মতানুসারে পরিচালিত করতে চাইবেন। তদুপ মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লার দাস, আল্লাহই মানুষের রিজিক, ধন-দৌলত, আয়ু ও জীবন যাপনের সকল উপাদান সংস্থান করে থাকেন, সুতরাং কেন মানুষ একমাত্র তাঁরই বিধান অনুযায়ী চলবে না? মানুষের নিজেকে সৃষ্টি করতে যেমন নিজের কোন হাত নেই তদুপরি তার জীবনকে নিজের ইচ্ছেমত পরিচালনা করারও কোন অধিকার নেই।
সকল মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাঁর দৃষ্টিতে সমান। কিন্তু একজন মানুষ আর একজনকে শাসন করবে, আদেশ দেবে, শাস্তি দেবে এ অধিকার তাকে কে দিয়েছে? সে যে মানুষদের শাসন করবে, আদেশ মানতে বাধ্য করবে তাদেরকে কি সে সৃষ্টি করেছে, তাদের রিজিক ও জীবন যাপনের যাবতীয় উপাদান সংস্থানের জন্য কি তার কোন ক্ষমতা আছে? মানুষ যাতে সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করে এবং হানাহানি ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না করে এজন্যই আল্লাহ সকল মানুষের জন্য একটা জীবন বিধান হিসেবে ইসলামকে নির্ধারণ করেছেন, তার হুকুমের বিরােধিতাকারী এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের শাস্তি নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব মানুষকে তার প্রতিনিধি ঘােষণা করে মানুষেরই ওপর ন্যস্ত করেছেন। এ দায়িত্ব যে কোন মানুষ পালন করতে পারে তবে তার পূর্ব শর্ত হল তাকে হুকুমদাতা, বিচারক ও শাস্তিদাতার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ এবং তিনি তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে তা বাস্তবায়ন করছেন একথা । স্বীকার করতে হবে এবং হুকুম দেয়ার প্রাপ্ত। ক্ষমতা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত পরিসীমায় প্রয়ােগ করতে হবে। যুগে যুগে নবী রাসূলগণ এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন এবং নবী আগমন বন্ধ হওয়ার পর এ দায়িত্ব আমাদের ওপর বর্তেছে। নবী, রাসূলগণের অনুপস্থিতিতে আমাদের যাতে কোন অসুবিধার সৃষ্টি না হয় সে জন্য মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান সম্বলিত কিতাব "আল কোরআন” অবিকৃত রাখার দায়িত্ব খােদ আল্লাহ তা'আলা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু গণতন্ত্র নামক মতবাদ ইসলামের এ দর্শনের বিরােধী এবং সাংঘর্ষিক। রাসুল (সাঃ) জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নেতা। নির্বাচন করতে বলেছেন, গণতন্ত্রে জনমতের ভিত্তিতে নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া রয়েছে এবং এটা ইসলামী দর্শনের সাথে কোন কোন ক্ষেত্রে মিলে বলেই গণতন্ত্র ও ইসলামকে এক কাতারে দাড় করাবার কোন অবকাশ নেই।
বন মানুষ ও মানুষের আকার আকৃতির মধ্য কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও বন মানুষ কখনাে মানুষ নয়। মূলত গনতন্ত্র হলাে রাজা-বাদশা তন্ত্রের এক নয়া রূপ। পূর্বে রাজা-বাদশাহরা নিজে আইন করে মানুষ শাসন করতে আর গণতন্ত্রে কয়েকজন মানুষ সম্মিলিত ভাবে আইন পাশ করে মানুষকে শাসন করছে। পূর্বে একজনে আদেশ করতাে আর এখন একটি গােষ্ঠী আদেশ করছে। পূর্বে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা, আদেশ দেয়ার, শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা ছিল রাজা-বাদশাহর হাতে এখন তা জনগণের নাম করে প্রকারান্তরে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী অথবা পার্লামেন্টের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। রাজা ন্যায় হােক অন্যায় হােক যে কোন আদেশ করতাে। প্রজারা তা মানতে বাধ্য ছিল। বর্তমানেও পার্লামেন্ট ন্যায় হােক অন্যায় হােক, ইসলামের পক্ষে হােক বিপক্ষে হােক অথবা গণস্বার্থের বিরােধী কোন আইন পাশ করলেও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক জনগণের তা’ রদ করার কোন ক্ষমতা নেই, বরং তা মেনে নিতে তারা বাধ্য। গণতন্ত্র মানুষকে এই শাসন করার আইন প্রণয়ন ও আদেশ করার অধিকার দিয়ে শাসন করার, শাস্তি দেয়ার, আইন প্রণয়ণ করার সার্বভৌম ক্ষমতা যে আল্লাহর তা” চ্যালেঞ্জ ও সরাসরি অস্বীকার করছে। মানুষকে খােদার সমান ক্ষমতা অর্পন করে মানুষকে মানুষের খােদ বানানাে হয়েছে। ফেরাউন সরাসরি নিজেকে খােদা বলে দাবী করেছিল পক্ষান্তরে গণতন্ত্র রাষ্ট্র- প্রভুদের প্রত্যক্ষভাবে খােদার ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করে তাদের বানাচ্ছে স্বার্থক ফেরাউন। আমরা কলেমা-তাওহীদে বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে আল্লাহ এক, সর্বশক্তিমান, তিনিই পালনকর্তা, তিনিই আইন দাতা, তিনিই রিজিক দাতা, স্বীকার করে নিচ্ছি। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, ফরজ রােজা আদায় করে তাঁকে প্রভু এবং আমরা। তাঁর দাস বলে মেনে নিচ্ছি। আবার আমরা গণতন্ত্রকে মহােত্তম শাসন ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিয়ে নিজেদের সকল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবী করছি।
এ সবকি সরাসরি আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ করার সমান অপরাধ নয়? ফেরাউন কি এই এক ই দাবী করেনি? সকল ক্ষমতার উৎস যদি জনগণই হবে তবে এখনও ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ে মানুষের যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তা এই গণতন্ত্রীরা ঠেকাচ্ছে না কেন? মানুষ দারিদ্রে, রােগে ভুগে মারা যায়, শীতে কষ্ট ভােগ করে, তা তারা প্রতিরােধ করতে পারছে না কেন? কেন। মৃত্যুকে থামিয়ে দেয় না, সূর্যকে পশ্চিমে অস্ত যেতে বাঁধা দিয়ে রাত্রের অন্ধকারকে দূর করে না? কেন ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের সেবক হিসেবে তাঁদের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জিম্মা নিচ্ছে না? আল্লাহ আমাদের এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতা থেকে সতর্ক থাকার জন্যই ঘােষণা করেছেন, “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল যখন কোন বিষয়ে আদেশ করেন, চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেন, তখন কোন মুমিন পুরুষ স্ত্রীর জন্য তাদের ব্যাপার সংক্রান্ত এই হকুম বা ফয়সালা মেনে নেওয়া বা না নেওয়ার কোন ইখতিয়ারই থাকতে পারে না। যদি কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অমান্য করে তাহলে সে সুস্পষ্ট গুমরাহীর মধ্যে পড়ে গেল।” [সূরা আহযাব; ৩৬ আয়াত]
সুতরাং আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল আমাদের একটি সুন্দর, ভারসাম্য পরিপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় বিধান দেয়ার পরও আমরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে বিজাতীয় দার্শনিকদের প্রণীত মতবাদ অনুসরণ করে আল্লাহর ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে কি সেই সুস্পষ্ট গােমরাহীর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি না?
*****