ইরশাদে রাসুল সা.
হাদীসের আলোকে হজ্ব ও ওমরাহ
আরিফ বিল্লাহ ডা আব্দুল হাই
হজ্জ কার উপর ফরযঃ হযরত আলীর (রাঃ) বর্ণনা; রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ “যার কাছে হজ্জের সফর করার জন্যে প্রয়োজনীয় পাথেয় আছে এবং বায়তুল্লাহ্ পর্যন্ত পৌছাতে পারে এমন যানবাহনেরও ব্যবস্থা আছে, সে যদি হজ্জ না করে তবে তার ইহুদী হয়ে মৃত্যু বরণ করা ও খৃস্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করার মধ্যে কোন তফাৎ নেই। কারণ আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেনঃ আল্লাহর জন্যে বায়তুল্লাহর হজ্জ ফরয তাদের উপর, যারা সে পর্যন্ত যাওয়ার সামর্থ্য রাখে।-(তিরমিযী, মা'আরেফ)
ওমরার স্বরূপঃ হজ্জের মতই একটি এবাদত হল ওমরা। এটা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। এর স্বরূপ হজ্জেরই কতক প্রেমিকসুলভ ক্রিয়াকর্ম। তাই একে হজ্জে আসগর (ছোট হজ্জ) বলা হয়। - (হায়াতুল মুসলিমীন)
হজ্ব ও ওমরার বরকতঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রাঃ) বর্ণনা; রসুলে আকরাম (সাঃ) বলেনঃ “হজ্ব ও ওমরা এক সাথে কর। উভয় এবাদত দরিদ্র ও গোনাহকে এমনভাবে দূর করে, যেমন কর্মকার ও স্বর্ণকারের গরম পানিপূর্ণ পাত্র লোহা ও সোনারূপার আবর্জনা দূর করে দেয় আর হজে মবরুর তথা মকবুল হজ্বের প্রতিদান ও ছওয়াব তো জান্নাতই।” -(তিরমিযী, নাসায়ী, মা'আরেফ)
নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেনঃ “হজ্ব ও ওমরার জন্যে গমনকারী ব্যক্তি আল্লাহ্ তা'আলার বিশেষ মেহমান। সে দোয়া করলে আল্লাহ কবুল করেন, ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করেন।” -(তিবরানী, মা'আরেফ)
নবী করীম (সাঃ) আরও বলেনঃ “আল্লাহ্ তা'আলা প্রত্যহ তার হাজী বান্দাদের জন্যে ১২০ টি রহমত নাযিল করেন। তন্মধ্যে ৬০টি রহমত তাদের জন্যে যারা বায়তুল্লাহর তওয়াফ করে, ৪০টি তাদের জন্যে যারা সেখানে নামায পড়ে এবং ২০টি তাদের জন্যে যারা কেবল কা'বাকে দেখতে থাকে।”-(বায়হাকী)
অন্য এক হাদীসে আরও বলা হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি ৫০ বার বায়তুল্লাহর তওয়াফ করে নেয়, সে গোনাহ থেকে এমন পাক হয়ে যায়, যেন আজই ভূমিষ্ঠ হয়েছে।”-(তিরমিযী)
আরাফাতে উপস্থিতিই হজ্বঃ হযরত আবদুর রহমান ইবনে ইয়ামর দোয়ালী বর্ণনা করেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, “হজ্ব হচ্ছে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা! (অর্থাৎ এটাই হজ্বের বিশেষ ও প্রধান রোকন।) যে হাজী মুযদালেফার রাত্রিতে (অর্থাৎ ৯ ও ১০ই যিলহজ্বের মধ্য রাত্রিতে) সোবহে সাদেকের পূর্বে আরাফাতে পৌছে যায়, সে হজ্ব পেয়ে যায় এবং তার হজ হয়ে যায়। ১০ই যিল হজ্বের পরে মিনায় অবস্থানের তিন দিনের মধ্যে যদি কেউ শুধু দু'দিন কংকর নিক্ষেপ করে সেখান থেকে চলে যায়, তবে তারও কোন গোনাহ নেই।"-(তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজা, দারেমী)
আরাফাতের মর্তবাঃ এক দীর্ঘ রেওয়ায়েতে হযরত জাবের (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ রাসুলে করীম (সাঃ) বলেনঃ আরাফার দিনে যখন হাজীগণ আরাফাতের ময়দানে একত্রিত হয়, তখন আল্লাহ তা'আলা ফেরেশতাদেরকে গর্ব করে বলেনঃ আমার বান্দাদেরকে দেখ, দুর-দুরান্তর থেকে তারা আমার কাছে এসেছে। তাদের কেশ বিক্ষিপ্ত এবং দেহ ধুলি ধূসরিত, তারা রৌদ্রের মধ্যে চলাফেরা করছে। তোমরা সাক্ষী থাক, আমি তাদেরকে ক্ষমা করলাম।"-(বায়হাকী, ইবনে-খুযায়মা, হায়াতুল-মুসলিমীন)
এ হাদীসটি হযরত ইবনে আবী হাতেম হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকেও বর্ণনা করেছেন ।-(রূহুল-মা'আনী, বয়ানুল কোরআন)
আরাফাতের দোয়াঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-এর বর্ণনা; রসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এরশাদ করেনঃ আরাফার দিনে আমার মূল থেকে এবং পূর্ববর্তী নবীগণের মূল থেকে যে সর্বোত্তম দোয়া ও সর্বোত্তম কলেমা উচ্চারিত হয়েছে, তা এইঃ-
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
অর্থাৎ, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই। রাজতু তাঁরই এবং প্রশংসা তাঁরই। তিনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান।-(তিরমিযী, মা'আরেফ)
اللهم اجعل في قلبي نورا، وفى صدرى نورا، وفي سمعي نورا، وفي بصري نورا، اللَّهُمّ اشرح لي صدري ويسر لي أمري، اللَّهُمّ إني أعوذ بك من شرِّ ما يلج في الليل، وشَرِّ ما يلجُ في النهار، وشرِّ ما تهبُّ به الرياحُ، وشرِّ بوائق الدهر.
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমার অন্তরে, আমার বক্ষে আমার শ্রবণে এবং আমার দৃষ্টিতে নূর সৃষ্টি করুন।
হে আল্লাহ! আমার বক্ষ উন্মোচন করুন এবং আমার কাজ সহজ করুন। আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই মনের কুমন্ত্রণা থেকে, কাজের বিশৃঙ্খলা থেকে এবং কবরের আযাব থেকে। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই রাত্রিতে প্রবেশকারীর অনিষ্ট থেকে, দিনে প্রবেশকারীর অনিষ্ট থেকে, বায়ু যাকে বয়ে নিয়ে চলে, তার অনিষ্ট থেকে এবং কালের বিপদাপদের অনিষ্ট থেকে।
দোয়া করার সময়ঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বুক পর্যন্ত হাত তুলে রেখেছিলেন। দোয়ার হাত প্রসারিত করার সময় তিনি বললেনঃ “আরাফার দিনের দোয়া সকল দোয়া অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।” –(যাদুল মাআদ)
মীকাতঃ (এহরাম বাঁধার স্থান): হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যুল-হুলায়ফাকে মদীনাবাসীদের জন্যে, জাহ ফাকে সিরিয়াবাসীদের জন্যে, কারনুল-মানাযেলকে নজদবাসীদের জন্যে এবং ইয়ালামলামকে ইয়ামনীদের জন্যে মীকাত সাব্যস্ত করছেন। সুতরাং এ স্থান চতুষ্টয় স্বয়ং এসব স্থানের অধিবাসীদের জন্যে মীকাত এবং তাদের জন্যেও যারা অন্যান্য এলাকা থেকে এসব স্থান হয়ে হজু অথবা ওমরার জন্য আগমন করে। যারা এসব স্থানের অধিবাসী (এবং এসব স্থান থেকে শুরু করে মক্কার মধ্যবর্তী স্থানের অধিবাসী), তারা তাদের গৃহ থেকেই এহরাম বাঁধবে। এ নিয়ম অনুযায়ীই খাছ মক্কার অধিবাসীরা মক্কা থেকেই এহরাম বাঁধবে!-(বুখারী, মুসলিম, মা' আরেফ)
এহরামের পোষাকঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলঃ যে হজ্বের এহরাম বাঁধে, সে কি কি কাপড় পরিধান করতে পারে? তিনি বললেনঃ “এহরাম অবস্থায় কোর্তা-জামা পরোনা, মাথায় পাগড়ী বেঁধোনা, সেলওয়ার পাজামা পরিধান করোনা, পায়ে মোজা পরিধান করোনা। তবে কারও কাছে চপল অথবা জুতা থাকলে সে পায়ের হেফাযতের জন্যে মোজা গিটের নীচে কেটে জুতার মত বানিয়ে পরতে পারে।”
তিনি আরও বললেনঃ “এহরাম অবস্থায় এমন কোন কাপড় পরোনা, যাতে জাফরান অথবা ওয়ারস লেগেছে।”-(বুখারী, মুসলিম, মা'আরেফ)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-এর রেওয়ায়েতে আছে যে, “রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মহিলাদেরকে এহরাম অবস্থায় দস্তানা পরিধান করতে, মুখমন্ডলে নেকাব পরতে এবং জাফরান লাগা কাপড় ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। এ ছাড়া অন্য যে কোন রঙীন কাপড় তারা পরিধান করতে পারে। তারা অলংকার, সেলওয়ার কামীজ এবং মোজাও পরিধান করতে পারে।-(আবু দাউদ, মা'আরেফ)।
এহরামে পুরুষ কেবল দু'টি চাদর ব্যবহার করবে-একটি লুঙ্গিরূপে বেঁধে নিবে ও অপরটির দ্বারা শরীর আবৃত রাখবে মাথা ও পা খোলা থাকবে এমন জুতা পরবে, যাতে পায়ের উপরিভাগ খোলা থাকে। মহিলারা মুখমন্ডল খোলা রাখবে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, বেগানা পুরুষের সামনেও মুখমন্ডল সম্পূর্ণ খোলা রাখবে। বরং তাদের সামনে চাদর অথবা অন্য কোন কিছু দ্বারা মুখ আড়াল করে নিবে।
আবু দাউদের রেওয়ায়েতে হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ আমরা মহিলারা রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে এহরাম অবস্থায় ছিলাম। এহরামের কারণে আমরা মুখমন্ডলের ঘোমটা ব্যবহার করতাম না। পুরুষেরা যখন আমাদের সামনে দিয়ে যেত, তখন আমরা মাথার উপর থেকে চাদর ঝুলিয়ে দিতাম এবং পর্দা করতাম। পুরুষরা চলে গেলে আমরা মুখমন্ডল খুলে নিতাম।-(মাআরেফ)
এহরামের পূর্বে গোসলঃ হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রাঃ) বলেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) কে দেখেছি তিনি কাপড় খুললেন এবং এহরাম বাঁধার জন্যে গোসল করলেন।-(তিরমিযী, মসনদে-দারেমী) এ হাদীসের ভিত্তিতে এহরামের পূর্বে গোসল করা সুন্নত বলা হয়েছে। (মা'আরেফ)।
এহরামের পূর্বে সুগন্ধিঃ সহীহ হাদীসে প্রমাণিত আছে যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) এহরামের পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। সে মতে তাঁর মাথার চুলে এবং দাড়িতেও সুগন্ধির চিহ্ন পরিদৃষ্ট হত। এক রেওয়ায়েতে আছে, রসুলুল্লাহ্ (সাঃ) এহরাম বাধার আগে সর্বোত্তম সুগন্ধি ব্যবহার করতেন, যা তখন পাওয়া যেত।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আমি রসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে এহরামের পূর্বে ও এহরাম খোলার পরে সুগন্ধি মেখে দিতাম, যার মধ্যে মেশকের মিশ্রণ থাকত। আমি যেন এহরাম অবস্থায় তাঁর মস্তকে সুগন্ধির সৌরভ দেখতে পাচ্ছি।-(বুখারী, মুসলিম, মেশকাত)
কিন্তু এহরাম বেঁধে নেওয়ার পর সুগন্ধি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। ইমাম আবু ইউসুফ প্রণীত জাওয়ামেউল ফিকাহ গ্রন্থে আছে, এহরামের পূর্বে যে সুগন্ধি লাগানো হয়, এহরাম অবস্থায় তার ঘ্রাণ লওয়া নাজায়েয নয় ।-(যাদুল মা'আদ)
তালবিয়াঃ ( লাব্বায়িকা বলা): খাল্লাদ ইবনে সায়েব তাবেয়ীর পিতা সায়েব ইবনে খাল্লাদ আনসারীর (রাঃ) বর্ণনা; রসুলে করীম (সাঃ) বলেনঃ “আমার কাছে জিবরাঈল এসে আল্লাহ তা'আলার এই আদেশ পৌঁছালেন যে, আমি যেন আমার সঙ্গীদেরকে উচ্চৈঃস্বরে লাব্বায়িকা বলার আদেশ করি।”-(মুয়াত্তা মালেক, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজা, মা'আরেফ)
তালবিয়া নিম্নরূপঃ
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ، وَالنِّعْمَةَ، لَكَ وَالْمُلْكَ، لاَ شَرِيكَ لَكَ
অর্থাৎ আমি হাযির আছি হে আল্লাহ, আমি হাযির আছি। আপনার কোন শরীক নেই, আমি হাযির আছি। নিশ্চয় সকল প্রশংসা এবং নেয়ামত আপনারই এবং সমগ্র বিশ্ব-জাহান আপনার। আপনার কোন শরীক নেই।"
রাসুলে করীম (সাঃ) তালবিয়াতে এ বাক্যগুলোই পাঠ করতেন এবং এর সাথে অন্য কোন শব্দ মিলাতেন না (বুখারী, মুসলিম)
তালবিয়া পরবর্তী দোয়াঃ আম্মারা ইবনে খুযায়মা ইবনে সাবেত আনসারী তাঁর পিতার কাছ থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তালবিয়া পাঠ করে যখন এহরাম অবস্থায় প্রবেশ করতেন, তখন আল্লাহ্ তা'আলার কাছে তাঁর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের জন্যে দোয়া করতেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রার্থনা করতেন।-(রেওয়ায়েতে ইমাম শাফেয়ী, মা'আরেফ)
তওয়াফে যিকর ও দোয়াঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েব (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি রসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে তাওয়াফ করার সময় রোকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যস্থলে এই দোয়া পাঠ করতে শুনেছিঃ
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ.
হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন; রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ “রোকনে-ইয়ামানীতে সত্তরজন ফেরেশতা নিয়োজিত আছে।
তারা সেই ব্যক্তির দোয়ায় আমীন বলে, যে নিম্নোক্ত দোয়া করেঃ
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْعَافِيَةَ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ.
অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করি ইহকালে ও পরকালে । হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদেরকে ইহকালেও কল্যাণ দান করুন এবং পরকালেও কল্যাণ দান করুন। আমাদেরকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা করুন ।
চুম্বনঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, বিদায় হজ্বে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) উটের উপর সওয়ার হয়ে বায়তুল্লাহ শরীফ তওয়াফ করেছেন। তাঁর হাতে একটি বাকা ছড়ি ছিল। এর মাধ্যমেই তিনি হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করতেন।-(বুখারী, মুসলিম)
আবেস ইবনে রবিয়া তাবেয়ী বর্ণনা করেন, আমি হযরত ওমর ফারুক (রাঃ)-কে দেখেছি, তিনি হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করতেন এবং বলতেনঃ আমি বিশ্বাস করি, তুমি একখন্ড পাথর বৈ নও। (তোমার মধ্যে কোন খোদায়ী নেই তুমি কারও লাভ-লোকসান করতে পার না আমি যদি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম তবে কখনও তোমাকে চুম্বন করতাম না ।-(বুখারী, মুসলিম)
মূলতাযামঃ আবু দাউদে আছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) স্বীয় বুক ও মূলমন্ডল দ্বারা মূলতাযামকে জড়িয়ে ধরলেন এবং উভয় হাত প্রসারিত করে মূলতাযামের উপর রেখে দিলেন। এরপর তিনি বললেনঃ আমি রসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে এরূপ করতে দেখেছি ।(মা'আরেফ)
প্রস্তর নিক্ষেপঃ হযরত জাবের (রাঃ) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ (সাঃ) ১০ই যিলহজ্ব তারিখে জামরা আকাবায় চাশতের সময় প্রস্তর নিক্ষেপ করেন। এরপর তশরীকের দিনগুলোতে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার পর প্রস্তর নিক্ষেপ করেন ।-(বুখারী, মা'আরেফ)
সালেম ইবনে আবদুল্লাহ তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-এর নিয়ম এই বর্ণনা করেন যে, তিনি প্রথমবারে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করতেন এবং প্রত্যেক বারে আল্লাহু আকবার বলতেন এরপর সামনে নীচু ভূমিতে নেমে কেবলামূলী হয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত দোয়া করতেন। এরপর এমনিভাবে আল্লাহু আকবার বলে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করতেন। অতঃপর বামদিকে নীচু ভূমিতে নেমে কেবলামুখী হয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত হাত তুলে দোয়া করতেন। এরপর শেষ বার বাতনে ওয়াদী থেকে আল্লাহু আকবার বলে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করতেন। এ সময় তিনি সেখানে না দাড়িয়ে ফিরে আসতেন। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এমনি করতে দেখেছি।-(বুখারী, মা'আরেফ)
মাথা মুণ্ডনকারীদের জন্যে দোয়াঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বর্ণনা করেন, রসূলে করীম (সাঃ) বিদায়হজ্জে বললেনঃ “আল্লাহ তা'আলার রহমত বর্ষিত হোক তাদের প্রতি, যারা এখানে মাথা মুণ্ডন করেছে! এক ব্যক্তি আরজ করল ইয়া রসূলল্লাহ (সাঃ) যারা চুল কাটিয়েছে তাদের জন্যও এ দোয়া করে দিন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবার বললেনঃ আল্লাহ তা'আলার রহমত বর্ষিত হোক মাথা মুণ্ডনকারীদের উপর। লোকটি আবার দোয়া করতে বললে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) তৃতীয়বার বললেনঃ যারা চুল কাটিয়েছে তাদের। প্রতিও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। (বুখারী, মুসলিম, মা'আরেফ)
কোরবানীর দিনঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে কুর্ত (রাঃ)-এর বর্ননা, রসূলে আকরাম (সাঃ) বলেনঃ আল্লাহ তা'আলার কাছে সর্বাধিক মাহাত্ম্যপূর্ণ দিন হচ্ছে কোরবানীর দিন-১০ই যিলহজ। অতঃপর ইয়াওমুল কার-১১ই যিলহজ্জের মর্তবা। তাই যথাসম্ভব ১০ই যিলহজ তারিখে কোরবানী করে নেওয়া উচিত। কোন কারণে এটা সম্ভব না হলে ১১ই যিলহজ্ব তারিখে করা অবশ্যই উচিত। তবে ১২ই তারিখে ও কোরবানী করা যায় ।-(আবু দাউদ)
নবী করীম (সাঃ)-এর কোরবানীর দৃশ্যঃ উপরোক্ত হাদীসের রাবী আবদুল্লাহ ইবনে কুর্ত (রাঃ) তাঁর একটি অভূতপূর্ব চাক্ষুষ ঘটনা বর্ণনা করেন যে, একবার পাঁচ-ছয়টি উট কোরবানীর জন্যে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে আনা হলে। প্রত্যেকটি উট তাঁর নিকট আসার চেষ্টা করছিল, যাতে তিনি প্রথম তাকেই যবেহ করেন।-(আবু দাউদ, মা'আরেফ)
তওয়াফে যিয়ারতঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ) তওয়াফে যিয়ারতকে ১২ই যিলহজ্জের সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত বিলম্বিত করার অনুমতি দিয়েছেন -(তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজা)
সওয়ারীর উপর তওয়াফঃ হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি (বিদায়হজ্বে) রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে আরয করলামঃ আমি অসুস্থ, (অতএব তওয়াফ কিরূপে করব?) তিনি বললেনঃ তুমি সওয়ার হয়ে তওয়াফ কর। সে মতে আমি সওয়ার হয়ে মানুষের পেছনে পেছনে থেকে তওয়াফ করলাম রসুলুল্লাহ (সাঃ) তখন বায়তুল্লাহর একপার্শ্বে দাড়িয়ে নামায পড়ছিলেন এবং তাতে সুরা তুর তেলাওয়াত করছিলেন । (বুখারী, মুসলিম)
মহিলাদের শরীয়তসম্মত ওযরঃ হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ আমরা (বিদায় হজ্বে) রসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে মদীনা থেকে রওয়ানা হই। আমাদের মুখে কেবল হজ্বেরই আলোচনা ছিল। অবশেষে যখন আমরা মক্কার মাত্র এক মনযিল দূরে অবস্থিত মারেফ নামক স্থানে পেীছলাম, তখন আমার সেই দিনগুলো শুরু হয়ে গেল, যা মহিলাদের প্রতি মাসে শুরু হয়ে থাকে। আমি কাঁদতে লাগলাম।
রসুলুল্লাহ (সাঃ) তাবুতে এসে বললেন, সম্ভবতঃ তোমার মাসিক শুরু হয়ে গেছে। আমি বললামঃ হাঁ। তিনি বললেনঃ এতে কান্নার কি আছে। এটা তো আল্লাহ্ তা'আলা আদমের কন্যাদের জন্যে অপরিহার্য করে দিয়েছেন। (অর্থাৎ, সকলেরই এমন হয়।) হাজীদের যেসব ক্রিয়াকর্ম করতে হয়, তুমি সেগুলো সব করে যাও তবে এই ওযর থেকে পাক-ছাফ না হওয়া পর্যন্ত বায়তুল্লাহর তওয়াফ করো না।-(বুখারী, মুসলিম, মা’আরেফ)
বিদায়ী তাওয়াফঃ হযরত হারেস সকফীর (রাঃ) বর্ণনা; রসুলে করীম (সাঃ) বলেনঃ যে ব্যক্তি হজ্ব অথবা ওমরা করে, তার শেষ উপস্থিতি যেন বায়তুল্লাহয় হয় এবং শেষ কর্ম যেন তাওয়াফ হয়।-(মসনদে-আহমদ)
রওযা পাকের যিয়ারতঃ হজ্বের পরে অথবা হজ্বের পূর্বে মদীনা মুনাওয়ারায় উপস্থিত হয়ে রাসুলে মকবুল (সাঃ)-এর রওযা পাক ও মসজিদে নববীর যিয়ারতের সৌভাগ্য অর্জন করা উচিত। এসম্পর্কে রাসূলে মকবুল (সাঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি আর্থিক সঙ্গতি সত্ত্বেও আমার যিয়ারত করে না, সে আমার সাথে অসৌজন্য মূলক কাজ করে।” “যে আমার কবর যিয়ারত করে, তার শাফা'আত করা আমার উপর ওয়াজিব হয়ে যায়।”
“যে ওফাতের পরে আমার যিয়ারত করে, সে যেন জীবদ্দশায় আমার সাথে দেখা করল অর্থাৎ, দেখা করার বরকত লাভ করলো। (মারাকিউল-ফালাহ, বায়হাকী, তিবরানী)
তিনি আরও বলেনঃ “যে ব্যক্তি আমার মসজিদে নামায পড়বে, সে পঞ্চাশ হাজার নামাযের সাওয়াব পাবে।” -(আহমদ, ইবনে হাব্বান)।
হাজীর দোয়াঃ হাদীসে আছে, হাজীর সাথে সাক্ষাৎ হলে তাঁকে সালাম কর, মুসাফাহা কর এবং তোমার জন্যে মাগফেরাতের দোয়া করতে অনুরোধ কর। এটা তার গৃহে প্রবেশ করার পূর্বেই করবে। কেননা, হাজীর গোনাহ মাফ করা হয়েছে। (কাজেই সে আল্লাহর দরবারে মকবুল) বিশেষভাবে আশা করা যায় যে, তার দোয়া কবুল হবে। তার গৃহে পৌঁছার পূর্বে তাকে দিয়ে ইহকাল ও পরকালের যে দোয়া ইচ্ছা করিয়ে নেবে। (বেহেশতী-যেওর)
রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হজ্ব ও ওমরার সংখ্যাঃ রেওয়ায়েত অনুযায়ী রাসুলে আকরাম (সাঃ) হিজরতের পূর্বে দু'বার হজ্ব করেছেন। কেউ তিন বার হজ্বের কথাও বলেন। তাঁর ওমরার সংখ্যা চার বলে বর্ণিত আছে।-(বুখারী, মাদারেজ)
বিদায় হজ্বে সর্বশেষ ঘোষণাঃ নবী করীম (সাঃ) হিজরতের পর (দশম হিজরীতে) যে হজু করেন, একে হুজ্জাতুলবিদা ও হুজ্জাতুল ইসলাম বলা হয়। এতে তিনি মুসলমানদেরকে বিধি-বিধান ও মাসায়েল শিক্ষা দেন এবং বলেন, সম্ভবতঃ আগামী বছর তোমরা আমাকে পাবে না। অতঃপর তিনি সকলকে পরকালের সফরের ভিত্তিতে বিদায় জানান এবং খোতবা দেন।
(মাদারেজ)
অনুবাদঃ মুহাম্মাদ আব্দুল আজীজ