জীবন পাথেয়
ঈমানের খোশবু এবং হালাল খাদ্যের বরকত
হাকীমুল ইসলাম মাওঃ কারী মুহাঃ তাইয়্যেব (রহঃ)
=====================================================================
প্রত্যেক ব্যক্তিকে যে কোন কাজ করার আগে গভীর ভাবে ভাবতে হবে, আমি যে কাজ করতে যাচ্ছি তাতে 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ'র শিক্ষা ও দাবী প্রতিফলিত হচ্ছে কি-না। যদি না হয়ে থাকে তবে এই কাজ ভ্রান্ত, নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ কাজের মধ্যে এক প্রকার হলো শরীয়ত যাকে প্রকাশ্য ও স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ ঘােষণা করেছে। এমন গর্হিত কাজকে যদি বৈধ করার চিন্তা করা হয় তবে ঐ ব্যক্তির কর্মের দ্বারাই প্রমাণিত হবে যে, সে ঈমানতো আগেই খুইয়ে ফেলেছে সেই সাথে সে ইত্তেবায়ে রাসূল (সাঃ)-কেও ধুলিস্যাত করে দিয়েছে।
যেমন পাক পাকস্থলি হলাে মানব দেহের শক্তি সঞ্চয়ের উৎস ! পাকস্থলি যদি নষ্ট হয়ে যায়, পচন ধরে তাহলে পচা পাকস্থলির প্রতিক্রিয়া সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। পাকস্থলি ঠিক থাকলে মানব দেহের অন্যান্য অঙ্গ পতঙ্গও সুস্থ থাকে। এমনভাবে প্রত্যেক মুসলমানের হৃদয়ে ঈমানের খােশবু জন্ম নেয়। আর সেই খোশবু সারা অঙ্গে প্রবাহিত হয়। মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি হলে ফেরেশতা এসে তার অঙ্গে প্রত্যঙ্গে ঈমানের গন্ধ পরখ করে। যদি হাত পায়ে ঈমানের গন্ধ পায় তবে সহজেই আন্দাজ করতে পারে যে, তার মধ্যে ঈমান আছে।
আফগান রাজার একটি অনুকরণীয় ঘটনাঃ
এ মুহর্তে আমার আফগান রাজার একটি অনুসরণীয় ঘটনা মনে পড়ছে। ঘটনাটি অতি সাধাৰণ হলেও বিজ্ঞজনের জন্য এতে একটি শিক্ষনীয় বিষয় আছে। আফগানিস্তানের আমীর আব্দুর রহামানের পিতা আমানুল্লাহ খানের দাদা রাজা দোস্ত মুহাম্মদ খান ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ন শাসক। তাঁর কথা এখনাে কিংবদন্তীর মতাে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে শুনা যায়। একদিন তিনি অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে অন্দর মহলে প্রবেশ করলেন। বেগম তার মলিন চেহারা দেখে জিঞ্জেস করলেন, আজ আপনাকে এতাে চিন্তাক্লিষ্ট দেখাচ্ছে কেন! বললেন, আজ একটি ভীষণ দুর্ঘটনার খবর পেলাম, এজন্য চিন্তায় পড়ে গেছি। ঘটনাটি হলাে, আফগানিস্তানে বহিশত্রু আক্রমণ করেছে। আমি শত্রুর মােকাবিলা করার জন্যে শাহজাদাকে সৈন্য নিয়ে পাঠিয়ে ছিলাম। আজ সীমান্ত থেকে খবর এলো, শাহজাদা শত্রু বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে আসছে এবং দুশমন তার পিছু ধাওয়া করছে। এখন দু'টি বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। প্রথমতঃ আমি রাজ্য ছাড়া হলাম, রাজ্য অন্যের হাতে চলে গেল। দ্বিতীয়তঃ শাহজাদা পরাজিত হয়ে ভীরু কাপুরুষের পরিচয় দিলো। এই দুঃখ আমাকে মৃত্যু পর্যন্ত যন্ত্রণা দিবে।
বেগম বলেন, আপনার সব খবরই অবাস্তব ও মিথ্যা। আমার ছেলে শহিদ হতে পারে কিন্তু পরাজিত হয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পিঠ প্রদর্শন করতে পারে না। এ সব খবর মিথ্যা, গুজব। বাদশা বললেন, সরকারী গোয়েন্দারাও এই খবর দিয়েছে। বেগম বললেন, এরা আপনাকে ভুল তথ্য দিয়েছে। তিনি বললেন, শাহী দফতরের তথ্য বিভাগও এ সংবাদ দিয়েছে। বেগম আবার তা নাকচ করে নিয়ে বললেন, ওরাও অসত্য সংবাদ পরিবেশন করেছে। বাদশা বললেন, আচ্ছা মুসিবত তো! মুরগীর সুপ পাকানাে ছাড়া যে অন্য খবর রাখেনা তাকে কার শক্তি আছে, এই সব কথা বুঝাবে। সে তো গােয়েন্দা রিপাের্ট, সরকারী ভাষ্য সবই মিথ্যা বানিয়ে দিল।
পরের দিন রাজ দরবারে খবর এলো, শাহজাদা শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় বেশে রাজধানীতে ফিরে আসছে। সে বিজয়ের জংকা বাজিয়ে ঘরে ফিরছে এবং শত্রু বাহিনীকে তাড়িয়ে বহু দূর পর্যন্ত পালাতে বাধ্য করেছে। খবর শুনে বাদশা অত্যন্ত প্রফুল্য মনে আন্দর মহলে প্রবেশ করলে তাঁর উজ্জ্বল চেহারা দেখে বেগম জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যপার, আপনাকে খুব খুশী খুশী লাগছে? বাদশা বললেন, বেগম! তোমার কথাই সত্যে পরিণত হয়েছে।
ঘটনার অন্তরালেঃ
বেগম এ সংবাদ শুনে কৃতজ্ঞচিত্তে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আমার কথা সত্য পরিণত করেছেন। বাদশা জিজ্ঞেস করলেন, বেগম! কি করে তুমি এত দৃঢ়তার সাথে বললে যে, কোন অবস্থাতেই শাহজাদা পরাজিত হয়ে পালিয়ে আসতে পারেনা? তোমার কাছে কি কেন গায়েবী সংবাদ এসেছিল? বেগম বললেন, আমি মহিলা, তদুপরি একজন বিলাসী রাণী। এলহাম বা গায়েবী সংবাদের সাথে কি আমার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে? তাহলে তুমি এতো নিশ্চিত করে সব সংবাদ নাকচ করে নিলে কোন শক্তিতে; বস্তুতঃ তোমার কথাই তাে বাস্তবে সঠিক হলাে? বলাে এর পশ্চাতে কি রহস্য রয়েছে? বেগম বললেন, এটি একটি গােপনীয় বিষয়। আমি তা প্রকাশ করতে চাইনা। বাদশা বললেন, স্বামীর চেয়ে আপন জন আর কে আছে যে, স্ত্রী তাঁর সাথেও কোন বিষয় গােপন রাখতে পারে? আমি তােমার কাছে এটা জানার জন্য বার বার আবদার করতে থাকবাে, যতােক্ষন না তুমি আমাকে এই রহস্যের ভেদ না জানাবে। অবশেষে বেগম তার রহস্যময় ঘটনা বলতে শুরু করলেন। বলেলেন, আমি এ পর্যন্ত কাউকে এ বিষয়টি জানতে দেইনি। কিন্তু আজ আপনাকে জানাচ্ছি।
শাহজাদা আমার গর্ভে আসার পরই আমি আলাহর কাছে শপথ করেছিলাম, আমি সরকারী ভাতার একটি পয়সাও নিজের বেলায় খরচ করবনা। সে দিন থেকে আপনার প্রাপ্ত ভাতা থেকে আমি একটি কপর্দকও খরচ করিনি। নিজে টুপি সেলাই করে বিক্রি করিয়ে তদ্বারা খরচ চালিয়েছি। এ ভাবে শাহজাদা পেটে থাকা কালিন নয় মাস পর্যন্ত আমি অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্টার সাথে জীবন যাপন করেছি। ভূমিষ্ট হওয়ার পর শিশুকে দুধ পান করিয়েছি। এসময় ও আমার উপার্জিত পয়সায় আমি আহার করেছি এবং শাহজাদাকে দুধ পান করানাের সময় হলে আগে আমি অযু করে দু'রাকাত নফল নামায পড়েছি, অতঃপর দুধ পান করিয়েছি। আধ্যাত্মিক, বাহ্যিক সর্ব প্রকারের পবিত্রতা অর্জনের মধ্য দিয়ে হালাল ও সন্দেহ মুক্ত খাবার আমি তাকে খাইয়েছি। এধরণের উত্তম আহার ও পবিত্রতার মধ্যে বেড়ে উঠা সন্তান কখনাে কাপুরুষ, চরিত্রহীন ও ভীতু হতে পারে না। এ বিশ্বাস আমার ছিল।
ভীরু-কাপুরুষতা একটি ঘৃণ্য চরিত্র। ইসলামে বিশ্বাসী মানুষ এই চরিত্রের অধিকারী হতে পারে না। আমার উদরের সন্তান কখনাে এমন হবে না। এই আত্মবিশ্বাস আমার ছিল। তাই আল্লাহর দয়ার উপর ভরসা করে আমি দৃঢ়ভাবে আপনার সংবাদ নাকচ করে ছিলাম।
হালাল খাদ্যের অপরিহার্য সুফল ও সচ্চরিত্র বানঃ
হালাল খাদ্য গ্রহণকারীনী পূত-পবিত্র মায়ের কখনই চরিত্রহীন সন্তান জন্ম নিতে পারে না। চরিত্রবান সন্তানের কাজ কর্ম, চালচলনও সমাজ বিরােধী, নৈতিকতা পরিপন্থী হতে পারেনা। উল্লেখিত ঘটনা থেকে বুঝা যায়, শাহী মহলে লালিত পালিত হলেও পূত পবিত্রা মায়ের সন্তান ভীতু ও কাপুরুষ হতে পারে না। পবিত্ৰাত্মা মা তাই নির্ধিদায় বলতে পেরেছিলেন, আমার সন্তান শহীদ হতে পারে কিন্তু ভীতু কাপুরুষের ন্যায় রণাঙ্গন থেকে পৃষ্ট প্রদর্শন করে পালাতে পারে না। শাহী মহলে থাকার পরও যদি একজন মা, হালাল রিযিক ও পবিত্রতম জীবন যাপন করতে পারে তবে আমরা কেন তা পারব না।
═──────────────═