অনুসন্ধানী প্রতিবেদন:
এনজিওরা কোথায় কি করছে?
আবদুল্লাহ আল ফারুক
========================================================
এনজিও'র উৎপত্তিঃ মানবতার ধর্ম ইসলামে সর্ব প্রথম সেবামূলক এনজিও'র ধ্যান-ধারণা ফুটে ওঠে এবং বিকশিত হয়। ইসলামী আদর্শ অনুযায়ী মানুষ অপর দুস্থ গরীব ও অসুস্থ মানুষকে সাধ্যমত অর্থ, ঔষধ, বস্ত্র এবং সেবা- শুশ্রুষা করবে। জনগণের চিকি ৎসার সুযোগ সৃষ্টি করবে, দরিদ্রদের অর্থ সংকট দূর করার জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করবে, নিরক্ষর লােকদের শিক্ষিত করে তােলার জন্য স্কুল- কলেজ প্রতিষ্ঠা করণ প্রভৃতিতে আত্মনিয়ােগ করবে। এটা মানুষের অন্যতম নৈতিক দায়িত্বও বটে। এজন্য ইসলাম প্রচারক ও ইসলামের নিষ্ঠাবান অনুসারী মুসলমানগণ যুগে যুগে মানবতার সেবার নজীরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। কালক্রমে ইসলামের এই মানব সেবার মিশনে আকৃষ্ট হয়ে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও সমাজ সেবার জন্য ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। এরা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে মানতার সেবায় নিবেদিত থাকত বলে এদেরকে বেসরকারী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বলা হতাে।
আধুনিক যুগের ব্যাপক ভিত্তিক সেবামূলক এনজিও সংগঠন প্রতিষ্ঠার ধ্যান-ধারণার উদ্ভাবক হলেন বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামার, (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী)। তিনি বিশ্ব ব্যাঙ্কে কর্মরত থাকা অবস্থায় তার এবং তার সমমনাদের প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় তাদের ফরমূলা অনুযায়ী অসংখ্য এনজিও প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশে সমাজ কল্যাণমূলক কাজে ব্যাপক ভূমিকা রাখার সুযােগ লাভ করে। আসলে এরা মানব সেবার কথা বলে এনজিও পদ্ধতির উদ্ভাবন এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুললেও এর পেছনে রয়েছে একটা কপট উদ্দেশ্য। মানুষকে সূক্ষ্ম কায়দায় শােষণ ও তাদের ধনসম্পদ লুটপাট করে নেয়ার জন্যই হাতিয়ার হিসেবে মানবতার সেবাব্রতী এনজিও নামক লুটেরা সংগঠন প্রতিষ্ঠার ধ্যান-ধারণার জন্ম দেয়। এনজিওঁর গােড়ার কথা আমরা জানি, বর্তমান পৃথিবীর উন্নত দেশ বলে দাবীদার বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী পতুর্গাল, বেলজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ডেনমার্ক প্রভৃতি সকল দেশেরই অতীতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কলােনী বা উপনিবেশ ছিল । এসব উপনিবেশ থেকে তারা অর্থ সম্পদ, খনিজ পদার্থ, বনজ সম্পদ, মূল্যবান সামগ্রী প্রভৃতি লুটপাট করে জাহাজ বােঝাই করে নিজ নিজ দেশে জমা করত। পাশ্চাত্যের লােকজন মানব সভ্যতার শুরু থেকেই ভােগবাদী, এবং বিলাসী জীবন যাত্রায় অভ্যস্থ।
মধ্য যুগে যান্ত্রিক উন্নতি এবং শিল্প বিপুরে ফলে পাশ্চাত্যের লােকজনের বিলাসিতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে তাদের জীবন যাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। ফলে তাদের আরও অধিক ধন সম্পদ উপার্জনের প্রয়ােজন দেখা দেয় ! সহজে এবং অতি দ্রুত ধনী হওয়ার জন্য সমাজপতিরা সংঘবদ্ধ হয়ে কোম্পানী গঠন করে এবং সরকারের অনুমতি ও প্রত্যক্ষ সাহায্য লাভ করে তারা ব্যবসার উদ্দেশ্যে জাহাজ নিয়ে বহির্বিশ্বে বেড় হয়ে পড়ে। এসব কোম্পানী নিজস্ব বাহিনী বা সরকারী সৈন্যদের সাহায্যে বিশ্বের বিভিন্ন দুর্বল ভূ-খণ্ড বা দেশ দখল করে সেখানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। বাণিজ্যের নামে তারা উক্ত এলাকায় শােষণ, লুণ্ঠন চালিয়ে অধিকৃত কলােনীতে অর্থনৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে ফেলে। এভাবে পাশ্চাত্য শতাব্দীর পর শতাব্দী বাণিজ্যের নামে বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ কায়েম করে লুটপাট চালিয়ে যেতে থাকে এবং এই তৎপরতা ব্যাপক আকার ধারণ করলে তা বেসরকারী ভাবে পরিচালনার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে চলে যায়। এর ফল স্বরূপ উপনিবেশ দখল এবং তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। উপনিবেশ দখলের এই প্রতিযােগিতা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ সংঘটনে ভয়ঙ্কর ইন্ধন যােগায়। বিশ্ব যুদ্ধ শেষে পাশ্চাত্যের কোটি কোটি লােকের প্রাণহানী, সম্পদ ধ্বংস, অর্থনীতির দেউলিয়াত্ব,যুদ্ধ পরবর্তী অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও প্রতিক্রিয়ায় পাশ্চাত্যের যুদ্ধ করার খায়েশ স্তিমিত হয়। পূণরায় যাতে যুদ্ধের বিভীষিকা মােকাবিলা করতে না হয় সে জন্য তারা তৎপর হয়ে ওঠে। তাই যুদ্ধ বাধার অন্যতম কারণ, উপনিবেশ দখলের প্রতিযােগিতা থেকে তারা হাত গুটিয়ে নেয়। দখলকৃত অধিকাংশ উপনিবেশকে তারা স্বাধীনতা প্রদান করে সটকে পড়ে।
এভাবেই অবসান ঘটে পাশ্চাত্যের বাণিজ্যের নামে লুটপাট প্রক্রিয়ার কালাে অধ্যায়। যুদ্ধে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হলে ও পাশ্চাত্যের লুটপাটের সঞ্চিত অর্থ সম্পদ শেষ হয়ে যায়নি। অবশিষ্ট সেই সম্পদ খাটিয়েই আজ তারা বিশ্বের উন্নত দেশ বলে । লুটের মাল বেশী দিন স্থায়ী হয় না । পাশ্চাত্যেরও সে দশায় পেয়েছে। তাদের ভােগ- বিলাস বেড়েছে, বেড়েছে জীবন যাত্রার ব্যয় । কিন্তু তার সাথে পাল্লা দিয়ে আয় উপার্জন বাড়ছে না। দেশে দেশে বাড়ছে বেকারত্ব, বাজেট ঘাটতি । পাশ্চাত্যের লােকেরা স্পষ্টতই উপলব্ধি করতে পারছে যে, তাদের বিলাসিতার দিন ফুরিয়ে আসছে। তাই অনাগত বিপদকে ঠেকানাের জন্য তাদের দ্রুত এবং সহজে ধনী হওয়ার প্রয়ােজনীয়তা এবং প্রবণতা পুনরায় দেখা দিয়েছে। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? উপনিবেশিক কায়দায় জাহাজ ভর্তি বন্দুক আর সৈন্য পাঠিয়ে দেশ দখল করার দিন ফুরিয়ে গেছে। কোন দেশের শাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে দেশটাকে চেটে-পুটে যাওয়ার বেলায় ভয়ঙ্কর ঝুকি। অতীতের ন্যায় এভাবে চাটাচাটি করতে গেলে, ঠ্যাঙ্গানী খাওয়া বা জিহ্বা কাটা যাওয়ার সম্ভবনাও ষােল আনা থাকে। পাশ্চাত্য গর্তে যখন অনাগত সমস্যাকে ঠেকানোর পন্থা নিয়ে এভাবে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছিল, ঠিক তখনই সমস্যার মােক্ষম সমাধান নিয়ে উদয় হন বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রধান “রবার্ট মকানমারা”।
মধ্য যুগে ভাস্কোডা গামা, কলম্বাস প্রমুখ নাবিক যেমন বিশ্বের বিভিন্ন জলপথ আবিস্কার করে পাশ্চাত্যের লুটপাট করার পথ খােলাসা করে বরণীয় হয়ে আছেন, তেমনি রবার্ট ম্যাকানমার সাহেবও আধুনিক পাশ্চাত্যের সমস্যার সমাধানের পথ উন্মুক্ত করে দিয়ে আগামী প্রজন্মের কাছে বরণীয় হবেন নিশ্চয়। পাশ্চাত্য প্রত্যক্ষ আগ্রাসন বা রাষ্ট্রের পথ পরিহার করলেও তাদের দস্যু মনােবৃত্তির কোন পরিবর্তন ঘটেনি । পাশ্চাত্যের প্রতিনিধি ম্যাকানমার সাহেব তাই পাশ্চাত্যের আগ্রাসনের ভাষা এবং পদ্ধতিকে পরির্বতন করেছেন মাত্র। আগে পাশ্চাত্যের লােকজন বেকারী ভাবে কোম্পানী গঠন করে বহির্বিশ্বে বাণিজ্য করতে বেড় হয়ে দস্যুবৃত্তি চালাত। এখন পাশ্চাত্যের ভাগ্যান্বেষীরা তার ফর্মুলা অনুযায়ী সেবা করার নামে এনজিও সংগঠন গঠন করে বিভিন্ন দেশে লুটপাট করতে বেড়িয়ে পড়ছে। আগে লুটপাটের জন্য ব্যবহার হত বাণিজ্য' নামক শব্দ। এখন ব্যবহৃত হচ্ছে আরও মধুর আকর্ষণীয় এবং আধুনিক শব্দ সমাজ সেবা। আগে এসব সাম্রাজ্যবাদীরা শক্তি প্রয়ােগ করে ভূ-খন্ড দখল করে সেখানের অর্থ-সম্পদ লুটে নিত, বর্তমানে কৌশলে সেবা করার নাম করে কোন দেশের জণগণের অর্থ-সম্পদ লুটে নিয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়ে তুলছে। পাশ্চাত্য তাদের অর্থ-সাম্রাজ্যবাদ সফল করার জুন এনজিও' কে ব্যবহার করছে হাতিয়ার হিসেবে।
বাংলাদেশে এনজিওদের আগমনের পটভূমিঃ
সত্তরের দশকে বাংলাদেশে এনজিও'দের আগমন ঘটে। ৭০-এর জলােচ্ছাস এবং ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এদেশের উন্নয়নের কথা বলে এনজিওদের অবাধ আগমন ঘটে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশে দেখা দেয় অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার চরম সংকট। ঠিক সেই সময় দেখা গেল প্রায় প্রতিদিন প্লেন ভর্তি ত্রাণ-সামগ্রী আসছে ক্ষুধার্ত জনগণের জন্য। আর এরই সাথে “ক্ষুধা থেকে মুক্তি ও আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠন" এর শ্লোগান নিয়ে এনজিও ওয়ালারা আগমন করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও কিছু কিছু এনজিও শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ বিতরনের কাজ করে। আশির দশকে এনজিওদের তৎপরতা বাড়তে থাকে। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর তাদের তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পায়। মধ্য-আশির দশক পর্যন্ত এনজিও গুলাের ছিল শিশু ও কৈশাের কাল । এখন তাদের পূর্ণ যৌবন কাল চলছে।
সারাদেশে এখন এনজিও'র কর্মকাও ছড়িয়ে পড়েছে। এমন কোন থানা নেই যেখানে এনজিওর উপস্থিতি ঘটেনি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, প্রতি থানায় গড়ে ৪টি এনজিও কাজ করছে। বর্তমানে বিদেশী সাহায্য প্রত্যাশী রেজিষ্ট্রেশনভুক্ত এনজিওর সংখ্যা ৬৩৫। এছাড়া নামে বেনামে আরাে ১৬ হাজার সংস্থা এনজিও'র হয়ে কাজ করছে। এত ক্ষুদ্র দেশে এত বিপুল সংখ্যক এনজিওর তৎপরতা বিস্ময়ের ব্যাপারই বটে। দারিদ্র বিমােচন তৎপরতাই বটে! এনজিও গােষ্ঠীর উৎপত্তি ঘটেছে তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র মােচনের তথাকথিত দরদী চেতনা থেকে। তারা সংগঠন তৈরী করে এদেশের সর্বত্র ছুটাছুটি করছে এদেশ থেকে অভাব অনটন দূর করার জন্য। বাংলাদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা থেকে দারিদ্র শব্দটি উৎখাত করার জন্য। সংস্থার কর্মীরা তাই নিস্বার্থভাবে স্বেচ্ছাসেবকের ন্যায় দরিদ্র জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এ বক্তব্য বিভিন্ন এনজিও সংস্থার বাকপটু হোতাদের । কিন্তু একি! এ কেমন দারিদ্র বিমােচন কর্মসূচী ! এ কেমন জনসেবা?
“ঘটনা নরসিংদীর শিবপুরে- ব্র্যাকের ব্র্যাক থেকে ঋণ নেয়ার পর নিয়মিত কিস্তি পরিশােধ করতে না পারায় সংস্থা থেকে চাপ আসতে থাকে। ঋণ বিতরণকারী কর্মীটি নিয়মিত চাপ দিতেই থাকে বাড়ি গিয়ে। পুলিশের ভয় দেখানাে হয় ; আর বাড়ি ভেঙ্গে দেয়ার ভয় দেখানাে হয়। কাজ হয় না। ঋণ গ্রহীতা ভয়ে পালিয়ে থাকে। স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়া হয়। স্ত্রীও স্বামীর সঙ্গে পালিয়ে থাকে। অর্ধাহার, অনাহারের সঙ্গে নেমে আসে এক দুঃসহ অধ্যায়ের। ব্র্যাক কর্মীটি পড়ে বিপদে। খুঁজে পায় না স্বামী-স্ত্রী কাউকে। ধরার কৌশল ব্যবহার করা হলাে। বেছে নেয়া হলাে, শব-ই বরাত। নিশ্চিত এই দিন স্বামী-স্ত্রী বাড়িতে থাকবে। দু'জন পুলিশ নিয়ে রাতে রওয়ানা দিলেন কর্মীটি। বাড়িতে পাওয়া গেল স্ত্রীকে। পুলিশী নির্যাতন চলল কিছুক্ষণ। যদিও এই খেলাপীর ব্যাপারে স্ত্রীটি জড়িত নয়।
নামাজ থেকে ধরে আনা হলাে স্বামীকে। বাধা হলাে খুটির সাথে। স্বীকারােক্তিমূলক নির্যাতন চালানাে হলাে, জোর করে আদায় করা হলো তারিখ-কবে দিবে সে টাকা। বসের নির্দেশ ছিল যা পাবে তাই নিয়ে আসবে । কর্মীটি তাই করলাে- দেড় কেজি চাল এবং স্ত্রীটির প্রায় নতুন একটি শাড়ি নিয়ে কেন্দ্রে রওয়ানা দিলো তারা। বিবেকের তাড়নায় কর্মীটি ব্র্যাকের চাকরি পরের দিন ছেড়ে দিয়ে চলে আসে। এই বক্তব্য চাকরী ছাড়া কর্মীটির নিজের। তার আর একটি অভিজ্ঞতার কথা বললেন। এটি তার এক সহকর্মীর ক্ষেত্রে ঘটেছে অন্য আর এক গ্রামে। এক বিধবাকে ঋণ দেয়া হয় ৩ হাজার টাকা। প্রথম কয়েক কিস্তি মােটামুটি ভালােভাবেই শােধ করে। তারপর শুরু হয় অনিয়ম । চাপের মুখে পড়ে দু'টো ছাগল ছিল, বিক্রি করে কিছু কিস্তি শোধ করে কিছু নিজের জন্য খরচ করে। তারপর আবার চাপ। ভয়ে বাড়ির একটা আম গাছ বিক্রি করে। এতে ও শােধ দিতে পারে না কিস্তি। কর্মীটির চাপ বাড়তে থাকে। বিধবা ভয়ে পালিয়ে থাকে ক'দিন । একদিন ধরা পড়ে যান। কর্মীটি রাগে মহিলার চুলের মুঠি ধরে রাস্তায় ফেলে গলার ওপর পা তুলে দিয়ে বলতে থাকে, বল কবে দিবি টাকা। টাকা না দিলে মেরেই ফেলব। মাত্র ৪শ' টাকার জন্য এই বর্বর অত্যাচার! মহিলা ঘরের টিন বিক্রি করে ব্র্যাকের দরিদ্র বিমােচন কর্মসূচীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। কর্মীটি হিসেব করে দেখলেন যে, এই মহিলার কাছ থেকে তিন হাজার টাকার ঋণের পরিবর্তে দেড় বছরের মধ্যে সুদে আসলে সাড়ে ৪৫ শ' টাকা আদায় করা হয়েছে।" সাপ্তাহিক খবরের কাগজ, ২১শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩।
এনজিও আগ্রাসন থেকে নারীর ইজ্জত ও নিরাপদ নয়ঃ
এনজিও গােষ্ঠী শুধু আমাদের ধন সম্পদ লুটপাট করেই সন্তুষ্ট নয়। তারা আমাদের মান-সম্মান, ধর্ম-কর্ম, ঈমান-আকীদা, স্বাধীনতা, জাতীয় স্বাতন্ত্র্য, গৌরবময় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবকিছুই লুটে নিতে চায়। তারা একটা পরিকল্পিত ছক অনুযায়ী সর্ব ক্ষেত্রে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এ আগ্রাসন থেকে আমাদের সতী সাধ্বী নারী সমাজের ইজ্জত আব্রুও নিরাপদ নয়। ক্ষুধা-দারিদ্র ও অশিক্ষার সুযােগে আমাদের নারী সমাজের মূল্যবান ইজ্জতটুকুও লুট করে নিতে উদ্যত হয়েছে এই পাষণ্ডর দল । অধিকাংশ এনজিও “সমিতি" করার নামে গ্রামে গ্রামে লেডিস ক্লাব ও মহিলা সমিতির মাধ্যমে মহিলাদের একস্থানে জমায়েত করে পারিবারিক বন্ধন ও বিবাহ বন্ধনের বিরুদ্ধে উস্কানী মূলক শিক্ষা দিচ্ছে । গ্রামের মহিলাদের প্রতিই এদের নজর বেশী ।
কোন পরিবারের স্বামী বা শিক্ষিত ছেলে বেকার কি সকার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। পরিবারের গৃহবধু বা শিক্ষিত মেয়েটিকেই এরা বেছে নেয় চাকুরী বা ঋণ গ্রহণের জন্য। ঋণ গ্রহণ করতে হলে তাদের সমিতি করতে হয়, নির্দিষ্ট দিনে সমিতির মিটিংয়ে নিয়মিত হাজিরা দিতে হয় । আবার চাকুরী প্রাপ্ত মেয়েটিকে শহরে এনজিওর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে হাজির হতে হয়। তাদের বাধ্যতামূলক বাই সাইকেল, মােটর-সাইকেল চালানাে শিখতে হয়। কেননা তাদের গ্রামে গ্রামে গিয়ে ইউরাে-মার্কিন সাজে বাইসাইকেল, মােটর সাইকেলে চড়ে গ্রামের মহিলাদের বােঝাতে হবে যে, তারা পারিবারিক,বৈবাহিক বন্ধনের কারণে, শােষিত, বঞ্চিত হচ্ছে, ধর্মীয় বিধানের নাম করে পুরুষরা তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। কোন কোন এনজিও পুরুষ কর্মীকে সাইকেল এবং মহিলা কর্মীকে মােটর সাইকেল বরাদ্দ দিয়ে পুরুষদের ওপর মহিলাদের প্রাধান্য দেয় । এসব ট্রেনিং প্রাপ্ত মহিলারাই গ্রামের লাজুক মহিলাদের কাছে গিয়ে উন্নয়নের প্রলােভন দেখিয়ে তাদের সমিতি করার জন্য ঘরের বাহিরে নিয়ে আসে। সমিতির নামে জমায়েত মহিলাদের মুখে এরা ধরিয়ে দিচ্ছে, “স্বামীর কথা মানব না, পর্দা করে চলবাে না” মার্কা শ্লোগান ।
এভাবে এনজিওরা এদেশের সংস্কৃতিতে হাতুড়ি মেরে চলছে। অহরহ আমাদের সামাজিক বন্ধনে ফাটল ধরিয়ে দেয়ার জন্য তারা সহজ সরল মহিলাদের মনে পুরুষ বিদ্বেষ এবং হিংসা, ঘৃণার বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। গত বছর এই এনজিওদের লালিত একটি নারী আন্দোলনী সংস্থা সংসদ ভবনের সামনে অশ্লিল ঢংয়ে নর্দন কুর্দন করে তসলিমা নাসরিনের নারী মুক্তির আহ্বানের ছন্দে ছন্দে শ্লোগান তুলেছিল, “কিসের বর, কিসের ঘর?” কোন কোন এনজিও প্রাইভেট সেক্রেটারী, টাইপিষ্ট স্টেনােগ্রাফার পদে শুধুমাত্র সুন্দরী মহিলা, অবিবাহিতা, মহিলার দরখাস্তের আহ্বান জানায়।এসব মহিলাদের পাশ্চাত্যের স্টাইলে পােষাক পরে বসদের মনােরঞ্জনে বাধ্য করা হয় বলে অভিযােগ শােনা যায় । চাকুরী করার জন্য সুন্দরী অবিবাহিতা হওয়ার শর্ত জুড়ে দেয়া নিশ্চয় কোন সৎউদ্দেশ্য নয়। বেকারত্বের কারণে এসব অসহায় মহিলারা বসদের এ অন্যায় আবদার মেনে নেয়। এক সময় এটা গা সওয়া হয়ে যায়। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামে একটি এনজিওর বস কর্তৃক জনৈকা সুন্দরী তরুণী নির্যাতিত হওয়ার খবর পত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল। এসব এনজিওতে প্রয়ােজনে কর্মকর্তাদের সঙ্গদান, মনােরঞ্জন মহিলা কর্মীদের বাড়তি আয় ও যােগ্যতা নিরুপনের অন্যতম মাপকাঠি বলে জানা গেছে। এনজিওরা সেবা করতে এসেছে এবং সেই সেবা-কাজ তদারক করার জন্য কর্মী নিয়ােগ করছে। কিন্তু এই সেবা কাজ বা কাজ তদারকের সাথে সুন্দরী অবিবাহিতা মহিলার কি সম্পর্ক? এটাই একটা মহাবিস্ময়ের ব্যাপার! এনজিওদের এ নিন্দিত অপরাধ সম্পর্কে দৈনিক ইনকিলাবে (২০শে সেপ্টেম্বর, '৯৩} এক নিবন্ধের শেষে মন্তব্য করা হয়েছেঃ “এ সকল এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলাে আমাদের পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক ঐতিহ্য বিনষ্ট করার নেশায় গ্রামের সরলমনা মহিলাদেরকে যথেচ্ছা ব্যবহার করছে।
কিছু কিছু এনজিও গ্রামের মহিলা সমাজের উন্নয়নের জন্য নিজেদের মহিলা কর্মীদেরকে গ্রামে পাঠাচ্ছে। তাদের মহিলা-কমীরা মটর সাইকেল বাইসাইকেলে চেপে গ্রামের লাজুক প্রকৃতির মহিলাদেরকে উন্নয়নের প্রলােভন দেখিয়ে লেডিস ক্লাব, নাইট ক্লাব, মহিলা সমিতি ইত্যাদি বিভিন্ন সংগঠন করছে। মহিলাদের জন্য বিভিন্ন নামে ঋণদান প্রকল্প নিচ্ছে। যে সব মহিলাকে তারা ঋণ দিচ্ছে; তাদের অনেকেই, পরবর্তীতে স্বামীর বিরুদ্ধে বেপরােয়া হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। মহিলাদেরকে নিয়ে তাদের কার্যকলাপ সামাজিক ঐতিহ্যিক কাঠামাে যেমন- পরিবার, বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করার উস্কানি দেয়া হচ্ছে। তাদের বাছাই করা ২০/২৫ জন মহিলাকে একজন যুবক ছেলের নেতৃত্বে ডাটা কালেকশনের নামে পাঠানাে হয় গ্রামে গ্রামে। যত্রতত্র রাত্রি যাপন ও ক্যাম্প স্থাপন করে এলাকার পরিবেশ এরা ভারী করে তুলে। তাদের কার্যকলাপে সামাজিক কোন রীতিনীতির বালাই নেই, এসবের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করে না। এদের দেখাদেখি সমাজের স্বল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত মেয়েরা পর্দাপ্রথা, ধর্মীয় রীতি-নীতিকে তাদের উন্নতির পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে ভাবতে শিখে।
সপ্তগ্রাম নারী স্বনির্ভর পরিষদ তাদের প্রকল্প এলাকায় মহিলাদেরকে জ্ঞান দান করছে যে, “পর্দাপ্রথা নারী উন্নতিকে শতকরা ৮১% ভাগ পিছিয়ে দেয়।” ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাসের মূলে এভাবেই তারা আঘাত হানছে। সম্প্রতি ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ থানার জনৈক ব্যক্তি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) তার এলাকার একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা উল্লেখ করে একটি চিঠি লিখেছেন। ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে। এলাকার এক ব্যক্তির স্ত্রী ব্র্যাক সংস্থার নিকট থেকে কিছু টাকা ঋণ নেয়। কিছুদিন পর ঐ টাকা ফেরত দেয়ার জন্য সংস্থার পক্ষ থেকে চাপ আসে। গরীব মহিলা বহু চেষ্টার পরও টাকা শােধ করতে ব্যর্থ হয়। তারপর স্বামীর কাছে জানালে স্বামীও দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। কেননা, ঐ মহিলা ঐ অফিসে আসা-যাওয়ার ফলে অবৈধভাবে গর্ভবর্তী হয়ে পড়েছে। তাই স্বামী তাকে দেখতে পারত না। সে গােপন সূত্রে জানতে পারে যে, অফিসের একটি নিরিবিলি কক্ষে সংস্থার কর্মকর্তারা তার স্ত্রীর ন্যায় বহু মহিলার সাথে প্রায়ই অবৈধ লালসা নিবারণে লিপ্ত হয়। এই ঘটনার পর স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেয়। স্বামীর নিকট থেকে তালাক পাওয়া এবং সমাজের কাছে এ অবৈধ কর্মের জন্য কলঙ্কিত হয়েও মহিলাটি ব্র্যাকের ঋণের দায় থেকে মুক্তি পায়নি। ব্র্যাকের কর্মী ঋণ পরিশােধের জন্য তাকে উত্তরােত্তর চাপ দিতে থাকে। অনুপায় হয়ে অবশেষে মহিলা একদিন গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করে ব্লকের ঋণের দায় এবং গ্লানি থেকে নিষ্কৃতির পথ খোজে। এর নাম কি স্বনিৰ্ভৱতা ও জনসেবা?
নারী ও শিশু পাচারে এনজিওঃ এতদিন আমরা জানতাম, এই পশুসুলভ তৎপরতা চালাত এদেশেরই কোন আদম ব্যাপারী চক্র। তারা অর্থের লােভে এই নিকৃষ্টতর কর্মটি করত। কিন্তু এনজিও গােষ্ঠিও ইদানিং এই তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েছে। বােধহয় এ লাইনে অল্প পুঁজিতে বিরাট লাভের সম্ভাবনা দেখেই। এই উন্নয়ন তৎপরতায় এনজিও গোষ্ঠিও ঝাপিয়ে পড়েছে। নারী ও শিশু পাচারে এনজিওদের জড়িত থাকার ব্যাপারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যেমনঃ
“বাংলাদেশ থেকে এনজিও'র মাধ্যমে নারী ও শিশুদের বিদেশে পাচার করার অভিযােগ পাওয়া গেছে। কিছুদিন আগে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বেশকিছু সুন্দরী তরুণীকে বিয়ে দেয়ার নামে একটি ইউরােপীয় দেশে পাচার করা হয়েছে বলে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এদেশের শিশুদের দত্তক হিসেবে বিদেশে নিয়ে তাদের নানা ধরনের নােংরা ও অশ্লীল পেশায় নিয়ােজিত হতে বাধ্য করা হয়।” (সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান,১২ই ডিসেম্বর, ১৯৯১)
“টেরিডাস হােমস” এবং ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন" এর বিরুদ্ধে যথাক্রমে শিশু ও নারী পাচারের অভিযােগ রয়েছে। সুইস সংস্থা টেরিডাস হােমস তাদের বিভিন্ন শিশু সদন থেকে গােপনে বিদেশে দত্তক গ্রহণের নামে শিশু পাচার করছে। কোন বৈধ অনুমােদন ছাড়াই এ সংস্থাটি ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ১২৯ জন বাংলাদেশী অনাথ শিশু বাইরে নিয়ে গেছে। "ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন" বিয়ের নাম করে কয়েকটি মেয়ে বিদেশে নিয়ে গিয়েছে। ধর্মান্তরিতকরণের অভিযােগও তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি এনজিও কর্তৃক নারী। নির্যাতনের খবরও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মহিলা কর্মীদের দ্বারা নাকি অসামাজিক কাজকর্ম ও করানাে হচ্ছে। বিভিন্ন অফিসে প্রভাব খাটানাের জন্যও উপহার সামগ্রীর ন্যায় মহিলা কর্মীদের ব্যবহার করা হচ্ছে।” (মাসিক আর-রশিদ, জুলাই-আগস্ট '৯৩)
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এনজিওর অপচ্ছায়া, সেবা না আগ্রাসন?:
বাংলাদেশে ক্ষুধা, দারিদ্র, অশিক্ষার সুযােগে ইউরােপ, আমেরিকা অষ্ট্রেলিয়া থেকে ইহুদী, খৃস্টানরা সাহায্য ও উন্নয়নের নামে এসে এদেশের মুসলমানদের মন থেকে ঈমান, আকীদা, চরিত্র, নৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবােধ, ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি সবকিছু কেড়ে নিতে উদ্যত হয়েছে। এরা এদেশের মানুষের মন থেকে ইসলামী চেতনাকে মুছে ফেলে একটি খৃস্টান উপনিবেশ কায়েমের স্বপ্ন দেখছে। এ উদ্দেশ্যে তারা এদেশের মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে উদাসীন করার জন্য সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে মগজ ধােলাইয়ের অপারেশন শুরু করেছে। এনজিও কর্মকর্তারা তাদের অধিনস্থ কর্মচারী এবং উপকারভােগীদের নিকট ইসলামী আইন ও বিধানকে উপহাস করে তুলে ধরছে, ইসলাম ধর্মীয় বিশ্বাসকে কুটিল ও বিভ্রান্তকর রূপে তুলে ধরছে। তারা ইসলামকে চিহ্নিত করছে প্রগতি, বিজ্ঞান, উন্নয়ন ও মানবাধিকারের শত্রুরূপে।
গ্রামের সরল ও অশিক্ষিত মানুষদের তারা বােঝায়, ইউরােপ- আমেরিকার সমাজ ব্যবস্থা ও সংস্কৃতিই একমাত্র উন্নততর এবং যুগােপযােগী। আমরা সেই সমাজ, ব্যবস্থা, সেই সংস্কৃতির ধারক বাহক বলেই পৃথিবীর উন্নত জাতি। পক্ষান্তরে তোমরা সেকেলে ধর্মমত এখনও আকড়ে ধরে আছাে বলে এত অনুন্নত, গরীব। তােমাদের ধর্ম বিজ্ঞান ও প্রগতি বিরােধী বলেই তােমাদের এই দশা। অশিক্ষিত, অপশিক্ষায় শিক্ষিত গরীবদের তারা এই ধারনা দিতে চেষ্টা করে যে, আমরা উন্নত সমাজ, সংস্কৃতির মানুষ বলেই তােমাদের দেশে তােমাদের সেবা করতে এসেছি। তােমরাও ইসলামী আচার-আচরণ ছেড়ে-ছুড়ে আমাদের অনুকরণ,অনুসরণ করলে আমাদের ন্যায় জীবনে উন্নতি করতে পারবে। এভাবে তারা মানুষের মনে ইসলামের প্রতি একটা সন্দেহ, সংশয়ের বীজ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। গ্রামের অসহায় অশিক্ষিত মানুষ জানে না যে, তাদের এই অসহায়, অনুন্নত অবস্থার জন্য ইসলাম দায়ী নয়, দায়ী এই প্রতারক, ভণ্ডদের ডাকাত,বাপ-দাদারা।
ওদের বাপ-দাদারা এদেশে এসে আমাদের সব ধন-সম্পদ লুট করে নিয়ে গিয়েছিল বলেই আজ আমাদের এই অবস্থা। গ্রামের মানুষ যদি এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারতাে, তাহলে বােধহয় এনজিওদের এসব অপপ্রচারের পর তারা কিলিয়ে ওদের ভুত ছাড়িয়ে দিত। মুসলমানদের ভালো-মন্দ, ন্যায়- অন্যায়ের দর্পন হল ইসলাম। মুসলমানের মন থেকে দর্শন স্বরূপ এই ইসলামকে যদি মুছে ফেলা যায় তাহলে সে সত্যিকার অর্থে আর মানুষ হিসেবে মানবিক কর্তব্য পালন করতে পারবে না। তাকে যেমন খুশি তেমন ব্যাবহার করা যাবে। সে অন্যায় পথে চালিত হলেও উপলব্ধি করতে পারবে না। অন্যায় বুঝতে পারলেও অন্যায়ের বিরােধীতা করার মানসিক শক্তি তার মধ্যে অবশিষ্ট থাকবে না। এনজিও ওয়ালারা একথা জানে বলেই তাদের টার্গেট পূরণে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অস্ত্র ব্যবহার করছে। মুসলমানদের ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনাবােধকে কেড়ে নিচ্ছে। প্রগতি ও বিজ্ঞানের কথা বলে তাদের ধর্মহীন পথে জীবন যাপনের প্রলােভন দেখাচ্ছে। শােনা যায় এদেশের যে মুরতাদ লেখিকা ইসলাম ও পুরুষের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক কলমবাজী করে সমাজ জীবনে অস্থিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে তাতে মদদ যােগাচ্ছে এই এনজিওরা। সম্প্রতি এই লেখিকা সাম্প্রদায়িক উস্কানীতে ভরপুর একখানা উপন্যাস লিখে বিজেপির মুসলিম নিধনের জন্য দাঙ্গা সংঘটনে মশলা যুগিয়ে ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আর এই টাকা হাতানাের ব্যাপারে মধ্যস্থতা করছে বামপন্থী এক জাদরেল লােকের এনজিও সংস্থা।
এই সংস্থা উক্ত মহিলার ঘন ঘন ভারত সফরের খরচাদিও যােগাত বলে শােনা যায়। এছাড়াও সংস্থাটি এদেশে অপসংস্কৃতির সয়লাব বইয়ে দেয়ার জন্য মাঝে মাঝে ভারত থেকে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ধারক বাহক শিল্পী, সাহিত্যিক, নৃত্য শিল্পী, সিনেমার নায়ক-নায়িকা, যন্ত্রশিল্পীদের এশে আমদানী করাতে স্পন্সরের ভূমিকা পালন করে বলে ও অভিযােগ রয়েছে। এসব কীর্তিমানদের এদেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে আমদানী করার কথা বলা হলেও মূলত এরা এদেশে ব্রাহ্মণ্য মূর্তি সংস্কৃতির প্রচারকের ভূমিকা পালন করে। এই সংস্থার পক্ষ থেকে কোন দিন অন্য কোন দেশ থেকে এদেশে কোন মুসলমান ব্যক্তিত্বকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য এনেছে বলে শােনা যায়নি। সম্প্রতি দেশে সিনেমার ফিল্ম নির্মাণে অশ্লিলতার চুড়ান্ত বহিপ্রকাশ ঘটিয়েছিল যে, ছবি “অবুঝ দুটি মন' সেই ছবিটি নির্মাণে আর্থিক সহযােগিতা করেছিল একটি এনজিও । আরও অভিযােগ শােনা যায় যে, ছবিটির কাহিনীও এই সংস্থাটি সরবরাহ করে। ছবিতে কৌশলে খৃস্টধর্ম প্রচার করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন মহলে গুঞ্জনও শােনা গেছে। এই ছবিতে নায়ক নায়িকা দুই ধর্মের অনুসারী এবং তাদের তথাকথিত অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক পরিণতিতে বিবাহ হওয়ার ফলে দুটি ধর্মের মধ্যে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তাই দেখানাে হয়েছে, অথচ এ ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতি এদেশে অকল্পনীয়। এছাড়া ছবিতে এত অশ্লীলতার ছড়াছড়ি যা ইতিপূর্বে কোন ছবি নির্মাণকারী চিত্রায়িত করার দুঃসাহস দেখায়নি। অবুজ মনের নায়ক-নায়িকা যা খুশি তাই করেছে এমন একটা ভাব দেখানাে হয়েছে আলােচ্য ছবিটিতে।
এনজিওদের সাংস্কৃতিক তৎপরতার আরও কিছু নমুনাঃ
“গণসাহায্য সংস্থা” নামক একটি এনজিও সম্প্রতি বাঙালী সংস্কৃতি উৎসব সংগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ব্র্যাকের জনাব ফজলে হােসেন আবেদও ছিলেন বাঙালী ‘সাংস্কৃতিক উৎসব’ সংগঠনের অন্যতম। বাঙালী সাংস্কৃতিক উৎসবের মঞ্চ থেকে মঙ্গল প্রদীপ আর জলপিড়ির সাংস্কৃতিক আদর্শ ও মহিমাই প্রচার করা হয়েছে।”
[দৈনিক ইনকিলাব ৩১শে জুলাই, ৯২)
এনজিরও সর্বশেষ শিকার হলাে এদেশের সাংস্কৃতিক কর্মীরা। এদের অনেকেই এখন মাথা বিক্রি করে দিয়েছে। প্রথমে বুঝতে পারেনি তারা বিক্রি হচ্ছে। এই কেনা বেচার দায়িত্ব প্রধানত বাঙালী সংস্কৃতির নামে গণসাহায্য সংস্থা করে থাকে। অভিযােগ রয়েছে এবার বাঙালী সাংস্কৃতিক উৎসবের জন্য সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় নেতাদের মােটা অংকের টাকা দিয়েছে। এজন্য প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য অনেক ভাবে এই উৎসবের পেছনে খরচ করার কথা জানা যায়। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলাে এখন এনজিওর খপ্পরে পড়ছে। প্রথমে অর্থ জোগান দিচ্ছে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে জালে ফেলছে। নির্ভরশীল করে ফেলছে। কয়েক বছর পর এই পরিস্থিতি আর থাকবে না। এনজিওর কথা মত চলতে হবে; কাজ করতে হবে, তাদের ন্যায়-অন্যায়কে শিল্পে রূপ দিতে হবে। গ্রামের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে হবে। শুরু হবে সাংস্কৃতিক বন্ধাত্ব-অবক্ষয়। {সাপ্তাহিক খবরের কাগজ,২১শে সেপ্টেম্বর, '৯৩}
চিকিৎসার নামে আমাদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করছে এনজিওরাঃ
এদেশ গরীব। তাই অর্থের অভাবে অনেকে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারে না। তাছাড়া অজ্ঞতা, কুশিক্ষার কারণে এদেশে রােগ-ব্যাধির শিকার হন এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক। এই কারণে আমাদের চিকিৎসা সুবিধা দেয়ার জন্য এনজিওরা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, গ্রামে গ্রামে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করছে। মহৎ উদ্যোগ বটে। কিন্তু সর্বত্র যখন ঘাপলাবাজি চলছে এখানে কি তা নেই? মহত্ত্ব টিকে আছে তাে, নাকি এখানেও সরিষার ভূত ঢুকে পড়েছে? দেখা যাক- রণজিৎ দাস, সাপ্তাহিক খবরের কাগজে (২১শে সেপ্টেম্বর '৯৩ সংখ্যা) কি বলতে চেয়েছেনঃ
“কোটি কোটি টাকা খরচ করে এনজিওগুলাে কি সুফল রাষ্ট্রের হাতে এনে দিয়েছে এ ক্ষেত্রে দাতাদের যে বাঙালিকে গিনিপিগ বানানাের কাজ তা তারা বেশ ভালভাবে করছে । এরা এখন যে কোন ধরনের যে কোনাে ওষুধ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হলে দাতারা তা এনজিওগুলাের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে বাজারে ছাড়ে । দাতারা যে সাহায্য দেয় তা তাদের আসল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই করে। এই নিয়ে দাতাদের পরস্পর বিরােধী স্বার্থ দেখা দিলে এনজিওগুলাে একদল আর একদলের বিরুদ্ধে যায়। বাস্তবে একদল ডাক্তার ছােট খাটো এনজিওর নাম নিয়ে বিদেশী কিছু অর্থ গ্রহণ করে এবং তাদের কথামত ওষুধের পরীক্ষা চালানাে হয় তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে। এসব মারাত্মক ঘটনা আমাদের লােক চক্ষুর অন্তরালে ঘটে যাচ্ছে। বিশেষ বিশেষ চিকিৎসার নাম করে অনেক কটি দেশি বিদেশী এনজিও গ্রামাঞ্চলে কাজ করছে। এদের কাজ নিয়ে এখন পর্যন্ত গবেষণা হয়নি। ওষুধ ও চিকিৎসা বিষয়ক এনজিওগুলাের কাজ কর্ম নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়ােজন।” ...' (অসমাপ্ত)
(এনজিওদের অপতৎপরতার সামান্য কিছু তথ্য তুলে ধরা হলাে। আগামী সংখ্যায় আরাে কিছু তথ্য তুলে ধরা হবে ইনশাল্লাহ। কলেবরের সংক্ষিপ্ততার দরুন সবকথা বলতে না পারায় ধৈর্য্যের সাথে আরও একমাস আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে। প্রতিদিন এনজিও সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছি, চিঠি আসছে। এ সবই আপনাদের জানাবাে, জানানাে দরকার বলে মনি করি। -লেখক ।)
*****