আল্লাহর সাহায্য আমি স্বচক্ষে দেখেছি
কামান্ডার আমজাদ বেলাল
==================================================
আমি বিশেষ প্রোগ্রামের শ্রীনগর থেকে বাসে ইসলামাবাদ যাচ্ছিলাম। সাড়ে বারোটায় বাস শ্রীনগর থেকে ছেড়ে। ছাড়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ি। পৌনে একটায় আমার ঘুম ভাঙ্গলে দেখলাম। বাস একটি ভারতীয় সৈন্যদের চেক পোষ্টে দাঁড়ানো। দুই তিন জন সৈন্য যাত্রীদের বলছে, "নিচে নেমে এসো।" চোখ খুলে আমিও উঠে দাঁড়ালাম। পিছনের এক সৈনিককে উদ্দেশ্য করে আগের জন ইশারা করে বলছে। "এর উপর সন্দেহ হচ্ছে খেয়াল রেখো।" সে তার পরবর্তী সৈনিককে বল্লো "একে দুষ্কৃতিকারী বলে মনে হয়।" গেটের সৈনিকটি আমাকে নিচে নিয়ে আসে। সেখানে আরো তিনজন সিপাহী দাঁড়ানো ছিল। তাদের একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করে "কোথা থেকে এসেছো?" বললাম শ্রীনগর থেকে। কি কাজ করো 'মসজিদে ইমামতী কর। নামাজ পড়াই।' ইমামতী আবার কি জিনিস? আমার ভয় হতে লাগলো, কেননা সাধারণ ভারতীয় সৈন্যরা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানে না। সামান্য সন্দেহের বশীভূত হয়ে আমাকে বন্দী করতে পারে। আমি এদের চেয়ে বরং অফিসারের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছা করলাম। তারা মোটামুটি শিক্ষিত হয় ও তাদেরকে দলিল-প্রমাণ দিয়ে বুঝানো যায়। একজন সৈন্য কে বললাম "তোমাদের অফিসার কোথায়?" তার কাছে আমাকে নিয়ে চলো। তার কাছে সব বলবো। সৈন্যটি আমাকে কিছু দূরে বসা কর্ণলের কাছে নিয়ে আসে।
কর্ণেল জিজ্ঞাসা করলো "কোথা থেকে এসেছো?" " শ্রীনগর" "কোথায় যাবে?" "অনডনগর" "কি কাজ করো?" "ইমামতী" "ইমামতী কি জিনিস?" "নামাজ পড়াই" "আচ্ছা আল্লাহ, আল্লাহ কারো।"
পিছনে দাঁড়িয়ে এক ক্যাপ্টেন গভীর ভাবে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছিল। আমার পা কাপছে কিনা, কন্ঠে জড়তা আসে কিনা। কিংবা প্রশ্ন বানে জর্জরিত হয়ে আমার চেহারা ফ্যাকাশে হচ্ছে কিনা তা লক্ষ্য করছে। আমি তার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে স্বাভাবিক ভাবে জওয়াব দিয়ে যাচ্ছিলাম। এবার কর্নেল বল্ল, তোমার রাইফেল কোথায়? তোমাকে ভদ্র মানুষ বলে মনে হয়। অস্ত্র জমা দিলেই ছেড়ে দিবো। আমি বললাম "স্যার কি যে বলেন! আমি অস্ত্র কোথায় পাব? সে এবার ধমক দিয়ে বল্লো, আর ন্যাকামি করতে হবে না। জলদী বলো, তোমার অস্ত্র কোথায়? আমি বললাম স্যার আপনারা ভারত থেকে এসে আমাদের দুষ্কৃতিকারী বলেন; অপরদিকে মুজাহিদরা আমাদের বলে ইন্ডিয়ান এজেন্ট। কিছুদিন পূর্বে মুজাহিদরা ইন্ডিয়ান এজেন্ট বলে কয়েকজন আলেমকে হত্যা করে তাদের লাশ চৌরাস্তায় মাথায় ঝুলিয়ে রেখেছিল। আপনিই বলুন এটা আমাদের দেশ এদেশ ছেড়ে আমরা কোথায় যাব? কর্ণেল বল্ল, তুমি কথায় বড় পাঁকা।
কড়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বল, এমন ভালো ব্যক্তি আছে কি যে তোমার জামানত দিতে পারে? তখন আমি কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম বল্লাম। এইরকম বিপদে কাজে লাগবে বলে তাদের নাম-ঠিকানা পূর্বেই মুখস্ত করে রেখেছিলাম। এর মধ্যে এমন কিছু ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন যারা সরকারের নিকট বিশ্বস্ত। জিহাদের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। কর্ণেল বল্ল এরাও তো দুষ্কৃতিকারীদের সহযোগী। আমি বললাম, কি যে বলেন স্যার, এরা দ্বীনদার লোক। ধর্মের কাজ করেন। না এদের দুষ্কৃতিকারীদের সাথে কোন যোগাযোগ আছে আর না আমিও কোন দুষ্কৃতিকারী। পয়তাল্লিশ মিনিট পর্যন্ত এভাবে কথাবার্তা চলতে থাকে বাসের সবার তল্লাশী শেষ হয়েছে তারা অধীর অপেক্ষা ও আশঙ্কায় আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা জানত আমি কাশ্মীরি নই। হয়ত পাকিস্তানী অথবা আফগানী হব। আমার সরল কথায় কর্ণেল মোটামুটি আশ্বস্ত হয়েছে।
কিন্তু দেহ তল্লাশী তখনও বাকী। আমার গায়ে কাশ্মীরি আলখেল্লা জড়ানো। হাতদুটো আলখেল্লার পকেটের মধ্যে রেখে মৃদু নাড়াচ্ছি ও তার সাথে সাথে দৃঢ়ভাবে কর্ণেলের কথার জবাব দিচ্ছি। যে ক্যাপ্টেন আমার সামনে ছিলো তার দৃষ্টি হাতের উপর পরতেই কর্নেলকে বলল, "স্যার নিশ্চয়ই এর পকেটে গ্রেনেট আছে। এখন ধরা পড়ার সময় নিজেও মরবে এবং আমাদেরও মারবে। তাকে দুই কদম পিছিয়ে যেয়ে দাড়াতে বলুন।" কর্নেল আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো এবং জোরে কমান্ড দিল। বলল দুই কদম পিছে হটে হাত উপরে তোল। মনে মনে বললাম, এবার আর গ্রেফতারী থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। মনে মনে আল্লাহর কাছে মদ চাইলাম। আমার বিশ্বাস ছিল যে আল্লাহর দ্বীনের হেফাজতের জন্য এসেছি, এর থেকেও বড় বিপদে তিনি সাহায্য করেছেন। নিশ্চয় এবারও তিনি আমার থেকে বিমুখ হবেন না।
তিনি যেভাবেই হোক আমাকে হেফাজত করবেনই। দুই কদম পিছনে সরে হাত উপরে তুললাম হাতে ছড়া তছবীহ ছিল। যা এবার আমার জন্য আবে-হায়াৎ হয়ে জীবন রক্ষকের ভূমিকা পালন করে। তাছবীহ দেখতেই কর্নেল মোমের মতো গলে যায়। সে এবার বিনয়ের সুরে বলে ওঃ ভগবান আমাকে ক্ষমা করো, আমরা এক বেগুনাহা আদমীকে খামাখা কষ্ট দিচ্ছি। সে গর্জে ওঠে বলে "কে এই শরীফ ব্যক্তিকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে? যাও একে বাসের মধ্যে সসম্মানে বসিয়ে দিয়ে আসো। আমার সাথে বামে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামের কাশ্মীরের আমীর বসা ছিলেন। আমাকে এভাবে ফিরে আসতে দেখে তার খুশির অন্ত ছিল না। তিনি মনে মনে আল্লাহর শুকর আদায় করলেন।
বাস চলা শুরু করলে সকল যাত্রী আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে থাকে। কে এই লোক? এতক্ষণ কর্ণেলের সাথে কথাবার্তা বল্ল, কর্নেল তাকে গালিও দিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিপাহীরা এসে সসম্মানে বসিয়ে দিয়ে গেল। দেহ তল্লাশী ও করল না। নিশ্চয়ই কোনো সরকারী এজেন্ট হবে। প্রথমে বুঝতে না পেরে কর্নেল গালী গালাজ করেছে। পরে পরিচয় পাওয়ায় ছেড়ে দিয়েছে। হয়তো কোনো গোপন সংযোগ আছে। বাসের সকলে আমাকে ভারতীয় গুপ্তচর মনে করে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগল। কে আমি? কোথা থেকে এসেছি? কর্নেলের সাথে এতক্ষণ কি কথা হয়েছে? ইত্যাদি। আমি যতটা সম্ভব তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে, আমি কোন গুপ্তচর নই।
আমাকে তারা মুজাহিদ বলে সন্দেহ করছিল। অনেক ওজর আপত্তি করে গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হয়েছি। তারা কিছুতেই তা বিশ্বাস করতে পারছিল না। এর বেশী বাসে বলাও সম্ভব নয়। কেননা এখানে কোন ভারতীয় গুপ্তচর থাকতে পারে। নামার সাথে সাথে তারা আমাকে ধরে ফেলবে। অপরদিকে আশ্বস্ত না করতে পারলে ইসলামাবাদ যাওয়া ও নিরাপদ নয়। তারা কোন মুজাহিদ গ্রুপের কাছে ভারতীয় চল বলে আমাদেরকে ধরিয়ে দিতে পারে । কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম দেখলাম, প্রতিটি যাত্রীই আমার ব্যাপারে নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। অগত্যা নিজের আসন ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়ালাম। হাত দুটি দুই পকেটে ঢুকিয়ে গ্রেনেট দুটি বের করে এনে তাদেরকে দেখিয়ে বললাম, এ দুটি ছিল আমার পকেটে।
যদি কর্ণেলের সামনে আমার দেহ তল্লাশী হতো তবে বাঁচার উপায় ছিল না। এবার সবার ভুল ভাঙ্গলো। তারা নিজ নিজ মন্তব্যের জন্যে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে লাগল। শুধু আমার ব্যাপারে তারা আশ্বস্ত হলো না, বরং তারা ভাবতে লাগলো, যে ব্যক্তি দুটি গ্রেনেট পকেটে রেখে এভাবে পঁয়তাল্লিশ মিনিট কর্ণেলের সামনে জেরা করতে পারে সে কত উঁচু স্তরের মুজাহিদ। বাস থেকে নামার সাথে সাথে তারা আমাকে সাথে নিয়ে নিরাপদ এলাকায় পৌঁছে দেয়। যাই হোক, তাদের ভালোবাসা ব।ভোলার মতন নয়। এক ঘরে নিয়ে বাসের যাত্রীরা গরম পানি দিয়ে আমার পা ধুইয়ে দেয়। আমি এক নওযোয়ান আর আমার পিতার বয়সী হয়ে পা ধোয়াতে থাকায় লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কোনো ক্রমেই এদেরকে বিরত রাখতে পারেনি। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনারা কবে আসতেছেন? আমি জানালাম আমাদের কামান্ডার শীঘ্রই এসে পৌঁছবেন। তিনি আসলেই নিয়মিত লড়াই শুরু হবে। সকলে তাদের নাম-ঠিকানা আমার ডায়েরিতে লিখে দেয়। যখন ভাক আসবে আমরা হাজির হয় আপনাদের কমান্ডে জিহাদ করবো বলে ওয়াদা করে গেল।
মহররম মাসের দশ তারিখে আমি সোপুর গিয়েছিলাম। সেখানে একজন সাথী আমাকে নিকটবর্তী গ্রামের এক মুজাহিদের সাথে সাক্ষাৎ করতে অনুরোধ জানায়। সেই গ্রামে যেয়ে এক মাদ্রাসায় উঠে মাদ্রাসার ছাত্রের সাহায্যে তার খবর নিলাম। সে আমাকে তার ঘরে এসে সাক্ষাৎ করতে অনুরোধ জানায়। এই মুজাহিদ মাত্র দশ দিন পূর্বে জম্মু জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। ঘরের দরজায় কড়া নাড়তেই তের, চৌদ্দ বছরের এক যুবতী দরজা খুলে দেয়। আমি মুজাহিদ সাথীর কথা জিজ্ঞাসা করতেই মেয়েটি কান্না শুরু করে। দরজার দু'পাশে দু' হাত রেখে আমার রাস্তা বন্ধ করে কাঁদতে থাকে। আমি বারবার তার কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করে কোন উত্তর না পেয়ে ফিরে আসার জন্য রাস্তায় বের হই। এবার সে পিছন থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দ্দূতে আমাকে ডাকতে থাকে। কাছে আসলে সে জিজ্ঞাসা করে, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? তার সাথে কেন দেখা করতে চান? তাকে বললাম আমি শ্রীনগর থেকে এসেছি। তার সাথে বিশেষ কথা আছে। এবার সে আমার উর্দ্দূ ভাষা ও কথার ভঙ্গিতে আন্দাজ করে, নিশ্চয়ই আমি কোন মুজাহিদ হব এবং আমি দূর থেকে এসেছি। ফলে সে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে একটি কামরার দিকে হাত দ্বারা ইশারা করে।
এই কামরার মধ্যে সেই মহান মুজাহিদ বসে আছেন। আমাকে দেখে দাড়িয়ে মুছাফা করলেন। অতঃপর আমার আগমনের কারণ জানতে চান। আমি তাকে আমার সংগঠনের পরিচয় সহ কাশ্মীরে আগমনের কারণ ব্যাখ্যা করি। তার সাথে জিহাদ ও দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে অনেক আলোচনা হয়। এরপর তাকে আমি আমাদের সংগঠনে যোগ দেওয়ার জন্য আহবান জানায়। এর জবাবে তিনি বলেন "দেখো আমজাদ" আমার অনেক সমস্যা। অতঃপতত তোমাদের সাথে যোগ দিতে পারছিনা। গ্রামের যে মাদ্রাসাটি দেখেছো সেটি আমার এক বন্ধু চালাতেন। জিহাদেও তিনি শরিক হতেন। আমার ছাড়া পাওয়া আর দুই মাস পূর্বে ভারতীয় সৈন্যরা তার দুই পা কেটে দিয়েছে। জেল থেকে বের হওয়ার পর সে আমাকে মাদ্রাসা চালাবার জিম্মাদারী ন্যস্ত করেছে। এই মাদ্রাসা থেকে এ পর্যন্ত অনেক হাফেজ ফারেগ হয়েছে। অনেকে এখনও পড়ছে। অতএব দ্বীনের স্বার্থে আমাকে এই মাদ্রাসা চালাতে হচ্ছে।
আর দ্বিতীয় কারণ যদি শোনার ধৈর্য রাখো তবে বলবো। আমি আগ্রহ প্রকাশ করলে সে বলা শুরু করে এবং সাথে সাথে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তিনি কেন কাঁদছেন আমি বুঝতে পারছিলাম না। জেলে নির্যাতন, সাথীর হস্ত পা কর্তনের খবর কিংবা ইন্টারোগেশন সেন্টারে চরম নির্যাতনের মুখে দিনের-পর-দিন অবস্থানে শব্দ কাশ্মীরিদের কাছে নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। এতে একজন অকুতভয় মুজাহিদের ঘাবড়ে যাওয়ার কথা নয়। উপরন্তু তিনি একজন আলেম এবং কাশ্মীরে জিহাদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি অবগত। তা সত্ত্বেও মাদ্রাসায় চাকরি করার অজুহাতে কিভাবে জিহাদ পরিত্যাগ করতে পারেন। বিষয়টা আমাকে ভাবিয়ে তুলল।
তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে শুরু করেন, আমজাদ ভাই! গত বছর আমাকে একসাথীর সাথে একত্রে গ্রেফতার করে বারামুলার এক ইন্টারোগেশন সেন্টারে নিয়ে যায়। একদিন ও একরাত চরম নির্যাতনের পর আমাকে এক কর্ণেলের সামনে হাজীর করা হয়। কর্ণেল আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে তোমাদেরকে তো দেখতে ভালো মানুষ বলে মনে হয়। একটা শর্ত পূরণ করলেই তোমাদেরকে ছেড়ে দিবো। আমি বললাম "স্যার কি সে শর্তটি। কর্নেল মৃদু হেসে বল্ল তোমার একটি মেয়েকে এক রাতের জন্য আমার খেদমতে পাঠিয়ে দিবে। তার জানোয়ারের মত চেহারার দিকে তাকিয়ে আর ধৈর্য ধরতে পারলাম না। দেহের সমস্ত শক্তি দ্বারা সহজেই তার গালে একটা চড় কষে দিলাম। জানোয়ারটা ঘুরে পড়ে গেল। উঠে বির বির করতে লাগল "দেখাচ্ছি তোমাকে মজা, বুঝবে এবার কোন ভিমরুলের বাসায় ঢিল ছোড়ছো।
বলতে না বলতে সাত-আটজন সিপাহী আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। রাইফেলের বাঁটের আঘাত, কিল-ঘুষি আর বুটে লাথিতে আমার দেহ থেঁতলে যায়। এ সময় জীপের স্টাট নেয়ার শব্দ শুনতে পাই। এক ঘণ্টার মধ্যে ওরা আমার বড় মেয়েকে ধরে এনে হাজির করে। ওরা আমাকে একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখে। এরপর চোখের সামনে যা ঘটেছে একজন পিতার পক্ষে মেয়ে সম্পর্কে তা বলা সম্ভব নয়। আমি চীৎকার করে অনুনয়-বিনয় করতে থাকি। কিন্তু কিছুতেই পশুদের মনে দয়ার উদ্রেক হলো না। এখানেই শেষ নয়? এরপর ওরা আমার মেঝো মেয়েকে নিয়ে আসে। তার সাথে ও সেই একই আচরণ করে। এই কিয়ামত সমান অবস্থা দেখে আমার হৃদক্রিয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। চোখ দিয়ে আগুন ঝলসাতে থাকে। মনে হচ্ছিল, আমি এখনই মরে যাব। এরপর ওরা আমার দুই নাবালক হাফেজ মেয়েকেও হাজির করে। এবার আর স্থির থাকা সম্ভব হচ্ছিল না চিৎকার দিয়ে উঠে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যায়। তখন আমার বড় মেয়েকে ওরা বেয়নেট মেরে শহীদ করে। বাকীদের গাড়িতে করে গ্রামে ফেরত পাঠায়।
জালেম সৈন্যরা আমার ঘর জ্বালিয়ে দেয়। আর আমাকে জম্মুর হেরা নগর জেলে পাঠিয়ে দেয়। আমার মেঝো মেয়েটি ছিল বিবাহিতা। সে দুই সন্তানের মা। এই ঘটনার পর সন্তান রেখে তার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়। এই শোকে আমার স্ত্রী পাগল হয়ে গেছে। মেয়েরা এক বছর ধরে এই পোড়া ঘরে জীবন মরণের সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এক বছর পর্যন্ত তারা ঘর থেকে বের হয়নি। আর হবেই বা কিভাবে? বাপ বন্দী মা পাগল, আর ইজ্জত লুণ্ঠিত। বলো আমজাদ ভাই, বলো! আমরা কোথায় যাবো? কি করবো?
আমাদের এই দেশ থেকে কোথাও বাইরে নিয়ে যাও। এখানে থাকা আমাদের আর মানায় না। ভাই, যদি তুমি আর এক বছর পূর্বে আসতে তবে হয়তো আমাদের ইজ্জত বাছতো। আমজাদ তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছো। আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমাদের চীৎকার কি দুনিয়ার মুসলমানদের কানে পৌঁছে না? কেন তারা আমাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না? আমরা কি মুসলমান নয়? এক মুসলমান বোনের ইজ্জত রাখতে মোহাম্মদ বিন কাসেম সুদূর বাগদাদ থেকে ছুটে এসেছিলেন। তোমরা তো অনেক কাছে। এত কাছে থেকেও যদি তোমরা তোমাদের কাশ্মীরী বোনদের করুন কান্নার ক্ষ্মীণ আওয়াজও শুনতে পাও না ঝিলাম নদী বেয়ে যে হাজার হাজার মা বোনের লাশ তোমাদের চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেছে তা দেখাও কি তোমাদের ঈমান স্ফুলিংয়ের মতো জ্বলে উঠে না?
যদি এত কিছুর পরও তোমাদের চেতনা না আসে তবে মনে রেখো, আমরা মরতেই থাকবো। দ্বীনের হেফাজতের জন্য সর্ব প্রকারের কোরবানী দিয়ে যাব। তবুও এক কাশ্মীরি জেন্দা থাকতে কাফিরের আনুগত্য স্বীকার করব না। তাতে দুনিয়ার মুসলিম আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসুক আর না আসুক। তুমি দুনিয়ার মুসলমানের কাছে আমাদের পায়গাম পৌঁছে দিও। শুধু এক ভাই নয়, হাজার ভাই হাজার বোন তাদের পথ পানে চেয়ে আছে। দয়া করে জলদী আস, আর ধৈর্য বাঁধ মানছে না।তার এই হৃদয়বিদারক জীবন-কাহিনী শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। অসুস্থ হয়ে বিছানার উপর ছটফট করছিলাম। সতের দিন পর সেই মুজাহিদের এক মেয়ে একখানা কাগজে আমার নিকট লিখে পাঠায়, আমজাদ! এক ভাইয়ের কাহিনী শুনেই নির্জিবের মত বিছানায় পড়ে গেলে। এখানের হাজারো ভাই বোনের জিন্দেগী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। শুয়ে থাকার সময় নেই। উঠ তোমাকে শত শত বোনের ইজ্জতের হেফাজত করতে হবে। এই চিঠি পড়ে আমার শরীরের জ্বর-তাপ ঠান্ডা হয়ে যায়। তখনই মেয়ের পিতাকে সঙ্গে নিয়ে জিহাদের জন্য শ্রীনগর চলে আসলাম।
পাঠকদের কাছে আমার নিবেদন, কারো ইজ্জত হানির কাহিনী বর্ণনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং আপনাদের ভাবতে বলছি, যদি এই রূপ অবস্থার শিকার আপনারা হন তখন কি করবেন? সেই সময় কি করনীয় হবে আপনাদের? একটু ভেবে দেখুন। আজ কাশ্মীরী ভাই-বোনদের বেলায় যা ঘটছে আমাদের সাথে তেমন হবেনা এর কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? তার প্রতিকারের জন্য আমরা কি প্রস্তুত নিচ্ছি? আল্লাহ আমাদের সহায় হোন নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াবার তৌফিক দান করুন। [চলবে...]
অনুবাদকঃ মনজুর হাসান
*****