আল্লাহর সাহায্য আমি স্বচক্ষে দেখেছি
কমান্ডার আমজাদ বেলাল
==================================================
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর আমীর এসময় কাশ্মীরের বাইরে ভারতের অন্যত্র সফরে ছিলেন। আজমল তার সফর সঙ্গী। ফোনে তারা আমার পৌছার খবর পেয়ে সফর সংক্ষিপ্ত করে শ্রীনগর ফিরে আসে। আমরা এক গোপন মিটিংয়ে কেন্দ্র থেকে দেওয়া প্রোগ্রাম নিয়ে পরামর্শে বসি। তাতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, এখানে একটি পরিপূর্ণ, ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হবে। সেখানে সকল সাথী একত্রিত হওয়ার পর পরবর্তি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।
হরকাতের আফগানিস্তানের ট্রেনিং ক্যাম্পে অনেক কাশীরী মুজাহিদ ট্রেনিং নিয়ে কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তারা ইতিমধ্যে বহু সফল অভিযানে অংশ নিয়েছে। তবে বিশেষ কারণে তারা তাদের সংগঠনের নাম প্রকাশ করা থেকে বিরত রয়েছে।
এবার নতুন সেন্টারে পুরাতন সাথীদের সাথে সাথে নতুন সাথীদের আফগান ক্যাম্পের নিয়ম অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একই নিয়ম ও পদ্ধতিতে টেনিং চলছে। কখনো দৌড় ঝাপ, কখনো অস্ত্রের ট্রেনিং যুদ্ধের মহড়া এর পর কুরআন ও ইমান আকীদা বিষয়ক দরস। সাথে সাথে পাহারাদারী ও মরিচা খেদাইও করানো হচ্ছে। ভোর রাতে সেজদায় পড়ে হৃদয়ের সমস্ত আকুতি দিয়ে আল্লাহর কাছে কান্না কাটি করা একটা নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। আমরা পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে সর্ব প্রথম ট্রেনিং সেন্টারের হেফাজতের ব্যবস্থা গ্রহণ করি এবং এক ডাকে সব মুজাহিদ কমাণ্ডারের কাছে জমা হই। চতুর্দিকে দূর পর্যন্ত মরিচা খেদাই করা হয়। ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার পথের দুই ধারে ওয়ারলেসসহ কড়া পাহারা বসান হয়েছে। অল্প দিনের মধ্যেই ট্রেনিংয়ের কাজ পুরো দমে শুরু হয়। দেখতে দেখতে সকল পুরাতন সাথী সেন্টারে পৌছে যায়। আমাদের ট্রেনিংয়ের ধরণ দেখে অন্যান্য মুজাহিদ গ্রুপ দলে দলে তাদের সাথীদের আমাদের কাছে পাঠাতে শুরু করে। মুজাহিদদের অধিকাংশ গ্রুপ থেকে আমাদের মারকাজের প্রশিক্ষণ ও শৃঙ্খলার জন্য ভূয়সী প্রশংসা পত্র আসতে থাকে। মূলত আমরাই (হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী) সর্ব প্রথম কাশ্মীরে পরিপূর্ণ ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই।
ট্রেনিংয়ের প্রোগ্রাম গতিশীলভাবে এগিয়ে চলছিল। এমন সময় পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে ক্রেক ডাউন হয়। এবার এই ক্রেক ডাইনে অংশ নেয় কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ। তারা গ্রামের এক ছেলেকে ধরে মার পিট করলে সে তাদেরকে বলে দেয় যে, আমাদের এখানে কিছু আফগান মুজাহিদ ঘোরা ফেরা করছে। তার কথামত একজন গুপ্তচরসহ রিজার্ভ পুলিশের সদস্যরা আমাদের ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হয়। তাদেরকে আমাদের ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হতে দেখে আমাদের পাহারাদার সাথী ওয়ারলেসের মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ আমাদের নিকট সে খবর পৌছে দেয়। এ খবর শুনে ক্যাম্পের মুজাহিদরা খুশীতে আটখানা। বহুদিন ধরে তারা এমনই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। গলা জড়িয়ে একে অন্যকে তারা মোবারকবাদ জানিয়ে বলে, ওদেরকে এমনই শিক্ষা দেওয়া হবে যে, কাশ্মীর জবরদস্তি দখলে রাখায় কত মজা তা আজ বুঝিয়ে দিতে হবে। একটি লড়াইয়ের জন্য সকল প্রস্তুতিসহ সবাই অপেক্ষা করছে। শিকার নিজে এসে ধরা দিচ্ছে বলে ব্যস্তভাবে সবাই মরিচা সামলানসহ প্রতিরোধ শক্তি মযবুত করতে থাকে। স্থির হল, তাদেরকে ক্যাম্পের মধ্যে ঢোকার পর ঘেরাও করে সব খতম করা হবে। কাউকে জিন্দা ফিরতে দেওয়া হবে না।
এদিকে গ্রাম থেকে এক মাইল অগ্রসর হওয়ার পর ভাড়াটে গুপ্তচর তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে, আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? তারা বলল, এখানকার অফিগানী ক্যাম্পে আমরা হামলা করব। এ কথা শুনে সে বিস্ময়ের সাথে বলল, “সে কি করে সম্ভব! আপনারা সংখ্যায় এত কম আর আফগানীরা সংখ্যায় অনেক। উপরন্তু তাদের রয়েছে উন্নত প্রশিক্ষণ। তারা মারকাজে সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র তাক করে রেখেছে। আমার মনে হয়, সেখানে গেলে কেউ জিন্দা ফিরে আসতে পারবে না। রিজার্ভ পুলিশের এই গ্রুপ কাশ্মীরে এই নতুন এসেছে। তারা কিছু একটা করে নিজেদের বাহাদুরী জাহির করতে চায়। তারা বলল, কোন চিন্তা করো না, আমাদের সাথেও দেড় হাজার বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিপাহী আছে। তাছাড়া আফগানীরা অন্যদেশ থেকে এসেছে। মানসিকভাবে তারা বহু দুর্বল। এখানে তারা আত্মা বল নিয়ে পড়ার সাহস পাবে কই? রিজার্ভ পুলিশ আরো অগ্রসর হলে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্যরা তা জানতে পেরে গাড়ি নিয়ে সরাসরি তাদের সামনে এসে রাস্তা রুখে দাঁড়ায়। তারা বলে, ক্রেক ডাউন শেষ হয়েছে এখন ভালোয় ভালোয় ফিরে যান। তবুও তারা অগ্রসর হতে চাইলে সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্যরা বলে এই ক্যাম্পে হামলা করতে হলে পাঁচ সাত হাজার সৈন্যসহ আরও বহু আধুনিক অস্ত্রের দরকার।
অগত্যা তারা ফিরে গেল। যাওয়ার পথে গ্রামবাসীদের বলে গেল, তোমরা আফগানীদেরকে অস্ত্র সমর্পণ করতে বল, অন্যথায় তাদের বাঁচার দ্বিতীয় কোন পথ নেই। একথা আমরা জানতে পেরে জবাবে বলা হল, আমরা দশদিন পর্যন্ত তোমাদের অপেক্ষায় থাকব। আমরা মারকাজ থেকে দশ মাইল পর্যন্ত বাইরে এসে তোমাদের সাথে লড়াই করব। তোমরা যত সৈন্য ও মারণাস্ত্র নিয়ে আসতে পার আস। এই পয়গাম দুশমনদের এত ভীত করে দিয়েছিল যে, দশ দিন পর্যন্ত তারা এদিকে পা-ই বাড়ায় নি। এদিকে আর একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে যায়। ক্রেক ডাউন তুলে সৈন্যরা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। তখন পাঁচজন সশস্ত্র মুজাহিদ ওই রাস্তা দিয়ে ক্যাম্পের দিকে আসছিল। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে তারা রাস্তার পাশে লুকিয়ে থাকে। গাড়ি চলে যাওয়ার পর রাস্তার উপর উঠে হরকাতুল জিহাদের নির্ভিক মুজাহিদরা সামনে আগাতে থাকে। “সামনে চল” এই রণ সংগীত তারা কোরাস গলায় গাইতে গাইতে রাস্তার ওপর দিয়ে চলতে থাকে।
ওই গাড়ির পিছনে আর একটি গাড়িতে একশ চল্লিশজন সিপাহীর একটি পদাতিক দল ধেয়ে আসছিল। পাঁচজন মুজাহিদকে দেখে তারা রাস্তার দুপাশে লুকিয়ে যায়। তাদের অতিক্রম করে পিছনে ফেলে আসার পর একজন মুজাহিদ পেশাব করতে বসার পূর্বে পিছনে তাকিয়ে দেখে, সৈন্যরা রাস্তার নিচে নেমে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সাথীদের ডাক দিয়ে এখবর দিলে এক জন মুজাহিল অপেক্ষা না করে তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে সাথে সাথে চার পাঁচ জন সৈন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তারা হতাহতদেরকে তুলে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।
আমরা পরে গ্রামবাসীদেরকে জিজ্ঞাসা করেছি, আমাদের মাত্র পাঁচজন মুজাহিদকে দেখে তারা ভয়ে পালালো কেন? গ্রামবাসীদেরকে তারা বলেছে, তাদের জন্য পাঁচজন মুজাহিদের সাথে লড়াই করা কোন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তাদের ভয় হচ্ছিল, ফায়ারের আওয়াজ শুনে পার্শ্ববর্তী মুজাহিদ ক্যাম্প থেকে মুজাহিদরা সাড়াশী আক্রমণ করলে তখন তারা কেউই যে জীবিত ফিরে আসতে পারবে না! দ্বিতীয়ত তাদের অন্যসব গাড়ি আগে চলে গিয়েছিল। যুদ্ধে নাকি তাদের পরাজয় ছিল নিশ্চিত। তাই বৃহৎ কোন ক্ষয়-ক্ষতি ও বিপর্যয়ের মুকাবিলায় তুলনামুলক অল্প ক্ষতি বরণকে তারা মেনে নিয়েছি। পালিয়ে জীবন বাঁচাতে পারাটাও কোন ছোট বিজয় কি? উপরন্তু মযবুত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পরীক্ষিত চৌকস আফগান মুজাহিদদের সাথে লড়াই করার হিম্মত তাদের হয় না।
ভারতীয় সেনাদের আহ্বান মতে বিশ দিন পর্যন্ত আমরা তাদের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। তাদের পক্ষ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে এমনকি তাদের এদিকে আসার কোন লক্ষণ না দেখে কৌশলগত কারণে আমরা আমাদের ট্রেনিং সেন্টারটি স্থানান্তরিত করি।
আল্লাহর উপর তায়াক্কুল করে আমি পূর্ণ আস্থার সাথে বলতে পারি, যদি সেদিন ভারতীয় রিজার্ভ পুলিশ আমাদের উপর হামলা করত তবে তারা একজনও জিন্দা ফিরে যেতে পারতো না।
নতুন যায়গায় ট্রেনিং সেন্টার স্থাপনের সাথে সাথে চারিদিক থেকে বিভিন্ন সংগঠনের মুজাহিদরা ট্রেনিং নিতে এখানে অসতে শুরু করে। এখানে বিভিন্ন ট্রেনিংয়ের সাথে সাথে দ্বীনি তালিমেরও ব্যবস্থা করা হয়। অন্যান্য সংগঠনের মুজাহিদরা আমাদের নিয়ম পদ্ধতি ও ক্যাম্পের দ্বীনি পরিবেশ দেখে অগ্রহের সাথে আমাদের সংগঠনে যোগ দিতে এগিয়ে আসে। আমরা সব সংগঠনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে তাদেরকে নিজ নিজ দলে থেকে কাজ করার পরামর্শ দেই।
এর ফলে সকল সংগঠনের কাছে আমরা পরম শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হই। একবার আমাদের সেন্টারের দিকে ইন্ডিয়ান সৈন্যরা চুপে চুপে অগ্রসর হতে থাকলে “আল ওমরের” মুজাহিদরা তাদের দেখতে পায়। সৈন্যদের গতি দেখে তারা বুঝতে পারে, আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের খবর না দিয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথিমধ্যে তারা সৈন্যদের গতিরোধ করে। এ লড়াইয়ে ‘আল ওমর' গ্রুপের চারজন মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন। চারজন মুজাহিদের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমাদের ক্যাম্প রক্ষা পায়।
ট্রেনিংয়ের কাজ চলছিল। এক ব্যাজ শেষ হতেই নতুন ব্যাজ শুর হয়। এভাবে বহু মুজাহিদ ক্যাম্পে জমা হয়। তাদের আন্তরিক দাবী হলো আক্রমণ শুরু করা হোক। আমরা, শুরার বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিলাম এখন থেকে নিয়মিত আক্রমণ চালানো হবে। তবে আক্রমণের ধরণ এমন হতে হবে, যাতে আমাদের প্রভাব তাদের প্রতি আরও বৃদ্ধি পায়। দুশমনের হৃদয় থেকে আমাদের প্রভাব এতটুকু কমে না যায়। এসময় ভারতীয় সরকারের পক্ষ থেকে অপারেশন টাইগারে শরীক সৈন্যদের প্রতি কেন্দ্রের নির্দেশ ছিল, যে মহল্লা থেকে তোমাদের প্রতি গুলি ছোড়া হবে সে মহল্লা পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিবে। আমরাও ঠিক করলাম, কোন গ্রাম বা মহল্লা থেকে ওদের প্রতি আক্রমণ করব না। বরং খোলা ময়দানে আমরা ওদের মোকাবেলায় অবতীর্ণ হব।
ছুরাহ পুলিশ স্টেশনের উপর আক্রমণঃ
----------------------------------------------------------------
শ্রীনগরে ছুরাহ ইনষ্টিটিউট নামক একটি বড় হাসপাতাল রয়েছে। তার সম্মুখে রাস্তার অপর পাশেই এক বিরাট পুলিশ স্টেশন। পুলিশ স্টেশনে কাশ্মীরি পুলিশের একটি ক্যাম্প আছে। তাদের পাশেই ইণ্ডিয়ান সৈন্যরা এক শক্তিশালী পোষ্ট স্থাপন করেছে। পোষ্ট দেড়শত ফৌজ থাকে।
এই পোষ্ট আক্রমণের প্রোগ্রাম অনুযায়ী আমরা দিনে সমগ্র এলাকা পরিদর্শন করে পজিশনের স্থান নির্বাচন করি।
পোষ্টের পশ্চিম পার্শে ছুরাহ ইনিষ্টিটিউট। পোষ্টের মাত্র দুটি গেট। একটি ইনিষ্টিটিউটের গেটের সোজাসুজি মেইন রোডের অপরপাশে। অপরটি তার উত্তর পার্শ্বে। একটি গেট কাশ্মীরী পুলিশ ও অপরটি ইণ্ডিয়ান আর্মিরা ব্যবহার করে।
পোষ্টের উত্তরে এলাহীবাগ মহল্লা ও আনছার ঝিল। এখান থেকে উত্তর দিকের সড়কটি সামনে গিয়ে দুভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে। এর একটির নাম নওসাহারা রোড যা আলমগিরী হয়ে ডাউন টাউনের দিকে চলে গেছে। এই মোড়ের আলমগিরীতে ইণ্ডিয়ান সৈন্যদের একটি শক্তিশালী পোষ্ট রয়েছে। অপর শাখার নাম আলীজান রোড। যা গড়াই মহল্লার পাশ দিয়ে চলে গেছে।
ছুরাহ ক্যাম্পের দক্ষিণ পাশেই বিদ্যুত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। এই ক্যাম্পের পূর্বে দিক বাদে বাকী তিন দিক উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। তিন দিকের দেয়ালে কোন দরজা নেই।
প্রতি দিন নিয়মিত রাত সাড়ে দশটায় ভিসনাগ মন্দির থেকে একটা জীপ ও সাজোয়া গাড়ি খাবার নিয়ে ক্যাম্পে ঢোকে। আমরা প্রথমে এই গাড়ি দুটির ওপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করি। তার পর পরিস্থিতি বুঝে ক্যাম্পে হামলা করা হবে।
আঠারোজন সাথীকে বাছাই করা হল। গাড়ি ভিসনাগ মন্দির থেকে বের হয়ে গানাই মহল্লার পাশের ছোট রাস্তায় উঠে মেইন রোডে আসে। আমরা ছোট রাস্তার মুখে মাইন স্থাপন করে সাথীদের পার্শবর্তি মোর্চায় অপেক্ষা করতে বলি। রাস্তার এক পাশে মোর্চায় রকেট লাঞ্চার ও অপর পাশে ক্লাসিনকভ ও এল এম জি নিয়ে সাথীরা অপেক্ষা করতে থাকে।
যদি গাড়ি মাইনে ধ্বংস না হয় কিংবা সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে রকেট লাঞ্চার থেকে তার উপর রকেট নিক্ষেপ করা হবে। যদি কোন সৈন্য নেমে পালাবার চেষ্টা করে, তাকে ক্লাসিনকভের ব্রাশ মেরে ঝাঝরা করে দেয়া হবে। আমরা মোর্চায় বসে শিকারের জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছি। রাত বারোটায়ও গাড়ির কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। অগত্যা সাথীদের ডেকে জমা করে মাইন তুলে সরাসরি পোষ্টের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। ক্যাম্পে রকেট দাগার জন্য সুবিধাজনক স্থান মাত্র দু'টি। আমরা প্রথমে দক্ষিণ দিক যেয়ে বিদ্যুত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের পাশদিয়ে হামলা করার চেষ্টা করি। কিন্তু সমস্যা হল, যদি গোলা নিশানা ভ্রষ্ট হয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোন খামের সাথে আটকে যায় তবে সমগ্র শহরের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ রচনায় এই অসুবিধা দেখা দেয়ায় আমরা ঘুরে মেইন রোডে এসে দেওয়াল থেকে মাত্র আট মিটার দূরে দাঁড়িয়ে রকেট নিক্ষেপ করার প্রস্তুতি নেই। ইতিপূর্বে ছুরাহ পোষ্টে মুজাহিদরা অনেকবার হামলা করেছে। এ পর্যন্ত প্রায় দেড়শতাধিক রকেটও এর ওপর বর্ষিত হয়েছে। কিন্তু এই হামলাগুলি হয়েছে অনেক দূর থেকে যার ফলে রকেট হামলায় পোষ্টের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। রকেট নিক্ষেপ করার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। বাকী সাথীরা তিন ভাগে ভাগ হয়ে ক্লাসিনকভ ও এল এম জি নিয়ে একশত মিটার দূরে পজিশন নিয়ে বসে যায়।
সাবই মিলে আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করে অবশেষে একটি রকেট পোষ্টের দিকে ছুড়ে দিলাম। ক্যাম্পের একটি জানালা দিয়ে মৃদু আলো দেখা যাচ্ছিল। এই কামরায় একজন অফিসার ঘুমাত। আমার ব্লকেটটি সোজা জানালায় আঘাত হানে। প্রচণ্ড আওয়াজে রকেটটি বিস্ফোরিত হয়। সাথে সাথে ঐ কামরা থেকে ধুয়ার কুণ্ডলী বের হতে দেখা গেল। রকেটের ছোট ছোট টুকরা অন্যান্য কক্ষে ছড়িয়ে পড়ায় আরও কয়েকটি কক্ষে আগুন লেগে যায়। যদিও রকেটের সামান্য একটি গোলা মাত্র ভিতরে আঘাত হেনে ছিল। কিন্তু আল্লাহর রহমতে তাতে ক্যাম্পের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। রকেট ফায়ারের পর পাঁচ মিনিট পর্যন্ত চারিদিক ছিল নিরব নিস্তব্ধ। এর পর ওই দিকে আরও একটি রকেট ছুড়ে দিলাম। এবারের রকেটটি ছাদে আঘাত হানে এবং ছাদ উড়িয়ে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় রকেটটি বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে অন্যান্য সাথীরা তাদের ক্লাসিনকভ ও এল এম জি দ্বারা অবিরামভাবে গুলি চালায়।
আমাদের ফায়ারের শব্দ শুনে ইনিষ্টিটিউট ও অন্যান্য পোষ্টের সৈন্যরা ফায়ার করতে থাকে। আমরা তাদের রেঞ্জের বাইরে থাকায় আমাদের কেউ হতাহত হয়নি। কিন্তু ছুরার পোষ্ট থেকে কেউ একটি গোলাও নিক্ষেপ করল না। আমাদের আক্রমণের ফলে তারা ভীষণভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা পাল্টা আক্রমণের সাহস সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলে। এর পর আমরা একটি মাইন মেইন রোডে স্থাপন করে পাশের মরিচায় অপেক্ষা করতে থাকি। ধারণা করেছিলাম, আক্রমণের পর দুরূহ ক্যাম্পের দিকে চারিদিক থেকে গাড়ী আসতে থাকবে। কিন্তু আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পরও এদিকে কোন গাড়ী আসতে না দেখে মাইন তুলে নিয়ে যাই। এই হামলায় কতজন দুশমন হতাহত হয়েছে তা আমরা সঠিক ভাবে জানতে পারিনি।
কাশ্মীরের নিয়ম হল কোন গ্রুপের হামলা করার পর তার বিবরণ নিজ নামে পত্রিকা অফিসে ফোন করে জানিয়ে দেয়া। আমরা হামলার পর কোন পত্রিকা অফিসে খবর দেই নি। উপরন্তু আমরা এলাকা বাসীকে বলে এসেছি তারা যেন আমাদের সংগঠনের নাম প্রকাশ না করে। আমরা আমাদের তৎপরতার সস্তা প্রচার চাই না। আমরা আমাদের উদ্দেশ্য কর্মদ্বারা সফল করে দেখাতে চাই। সংবাদিকরা আক্রমণকারীদের সনাক্ত করতে না পেরে নিজেরাই মহল্লায় এসে খোঁজ নিতে শুরু করে। পরদিন আসসফা, আফতার, শ্রীনগর টাইম্স ও চটান প্রভৃতি পত্রিকায় হেড লাইনে আমাদের হামলার খবর প্রকাশিত হয়। এসব পত্রিকার হেড লাইনে লিখিত হয় “হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী”-এর আক্রমণে ছুরাহ পুলিশ স্টেশন সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত।” অন্য পত্রিকায় শিরোনাম করা হয় “হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী ও সৈন্যদের মধ্যে শ্রীনগরে এক দীর্ঘ লড়াই” ইত্যাদি ইত্যাদি। পরদিন ইণ্ডিয়ান সৈন্যরা পার্শ্ববর্তী মহল্লায় হানা দিয়ে বেশ কয়েকজন নিরীহ লোককে গ্রেফতার করে। মহল্লার মধ্য থেকে হামলা না করে মেইন রোড থেকে আক্রমণ করায় তাদেরকে সামান্য জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়। (চলবে)
(আল-ইরশাদের সৌজন্যে)
অনুবাদঃ মনজুর হাসান
*****