যে সকল কারণে কারো
রক্তপাত হালাল হয়ে যায়
—শাইখ হারেস বিন গাযী নাযারী রহ.
(তাওহীদ ও কিতাল দরস সিরিজ থেকে)
আব্দুল্লাহ সিরাজী অনূদিত
********************************************
(চতুর্থ দরস)
(যেসকল কারণে মুসলমানের রক্তপাত বৈধ হয়ে যায়)
السلام عليكم ورحمة الله وبركاته
الحمد لله رب العالمين، اللهم صلّ على محمد وعلى آل محمد كما صليت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم، وبارك على محمد وعلى آل محمد كما باركت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم في العالمين إنك حميد مجيد. أما بعد
গত দরসে আলোচনা ছিল, এমন কাফেরের ব্যাপারে যার রক্তপাত ঘটানো বৈধ নয়৷ কাফের মূলত মুবাহুদ দম (তথা যার রক্তপাত ঘটানো বৈধ) কিন্তু কিছু অবস্থা এমন আছে, যখন তার রক্ত ও সম্পদ সংরক্ষিত হয়ে যায়৷ তো যেসকল অবস্থায় কাফেরের রক্ত ও সম্পদ নিরাপদ ও সংরক্ষিত হয়ে যায় তা হল যখন সে যিম্মী হয়, কিংবা নিরাপত্তাপ্রাপ্ত বা চুক্তিবদ্ধ কাফের হয়৷
আজকের আলোচনা হল মুসলমানের ব্যাপারে, যার রক্ত মূলত সুরক্ষিত, যা ঝরানো বৈধ নয়৷ কিন্তু কিছু অবস্থায় বিধান এর ব্যতিক্রম হয়৷ একজন মুসলমান যে কালেমার সাক্ষ্য দিয়ে ইসলামে প্রবেশ করে, তার রক্ত পবিত্র, সুরক্ষিত৷ কিন্তু কিছু অবস্থা এমন আছে যখন এই মুসলমানের রক্ত ঝরানো ওয়াজিব হয়ে যায়৷ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যেমন জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. এর সূত্রে হাদীসে আছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা. কে বলতে শুনেছি: "আমি লোকজনের সাথে লড়াই করার নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছি যতক্ষণ না তারা এ কথার সাক্ষ্য দেয়, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই), অতএব তারা যদি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ স্বীকার করে নেয় তবে তারা আমার হাত থেকে তাদের রক্ত ও সম্পদ সুরক্ষিত করে নিল, কিন্তু কালেমার অধিকার ব্যতীত৷ আর তাদের প্রকৃত হিসাব নিকাশ আল্লাহর দায়িত্বে এবং নবী সা. জানিয়ে দিয়েছেন, যেসকল অবস্থায় কোন মুসলিমের রক্ত প্রবাহিত করা হালাল হয়ে যায় তা হল, এক. বিবাহিত ব্যক্তি যিনা করলে, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে এবং দ্বীন ইসলাম ত্যাগ করলে, মুসলমানদের দল ত্যাগ করলে৷
আজকের আলোচনা হল বিবাহিত যিনাকারী এবং অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যাকারী মুসলিম সম্পর্কে৷ এখানে আরো কিছু অবস্থাও আছে, যার আলোচনা ইনশাআল্লাহ পরে আসছে৷ যেমন, বিদ্রোহকারী দল, শরীয়ত পরিত্যাগকারী দল এবং যুদ্ধরত দল ইত্যাদি৷ কিন্তু আজকের আলোচনা শুধু ওই সকল শ্রেনী সম্পর্কে যাদেরকে রাসূল সা. উল্লেখিত এই এক হাদীসে একত্রিত করেছেন৷
এই সকল শ্রেণী যাদের রক্ত প্রবাহিত করা বৈধ তন্মধ্যে প্রথম হল, বিবাহিত যিনাকারী৷ আর বিবাহিত যিনাকারী ব্যক্তির দণ্ডের বিষয়টি সুবিদিত৷ অর্থাৎ তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হবে৷ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে পাথর নিক্ষেপ করা হবে৷
এটি একটি ইজমায়ী মাসআলা তথা সর্বসম্মতক্রমে ঐক্যমত্যপূর্ণ বিধান যে, বিবাহিত যিনাকারী ব্যক্তিকে মৃত্যু পর্যন্ত পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হবে৷ ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেন, " বিবাহিত ব্যক্তির যিনা-ব্যভিচার এ তো এমন এক বিষয় যার দণ্ডের ব্যাপারে মুসলমানগণ একমত যে, তার শাস্তি হল- মৃত্যু পর্যন্ত প্রস্তরাঘাত৷ এই কথাটি তিনি "জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন৷
তবে "রজম" (প্রস্তরাঘাতে হত্যা) নিশ্চিত হওয়ার জন্য কিছু শর্তাদি আছে যা অবশ্যই পাওয়া যেতে হবে৷ চারটি শর্ত৷ বিবাহিত হওয়া ছাড়াও আরো চারটি শর্ত৷ উলামায়ে কেরাম এই চারটির ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন৷ এই চারটি শর্ত ঠিকমতো না পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রে অপরাধী ব্যক্তিকে রজম করা হবেনা, বরং চাবুকের আঘাত করা হবে৷
সেই চারটি শর্ত হল : বালেগ (প্রাপ্ত বয়স্ক) হওয়া, সুস্থবিবেক সম্পন্ন হওয়া, দাসদাসী না হওয়া, বিশুদ্ধ বিবাহের মাধ্যমে সহবাস সম্পন্ন হওয়া৷
হানাফী এবং মালেকী ফকীহগণ স্ত্রীর ক্ষেত্রে ইসলামের শর্ত বৃদ্ধি করেছেন৷ অর্থাৎ স্ত্রীকে মুসলিমা হতে হবে৷ আহলে কিতাব হলে চলবেনা৷ শুধু হানাফীগণ শেষে আরেকটি শর্ত যোগ করেছেন, তা হল- উপরোল্লিখিত সবগুলি শর্ত স্ত্রীর জন্য শর্তারোপ করেছেন৷ অর্থাৎ কোন পুরুষ পরিপূর্ণ অর্থে বিবাহিত হওয়ার জন্য শর্ত হল, তার স্ত্রী সুস্থবিবেকসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্কা, স্বাধীনা এবং মুসলিমা হতে হবে৷ সুতরাং যখন এই শর্তগুলো একসাথে পাওয়া যাবে এবং যিনা সংঘটিত হবে তখনই কেবল আমৃত্যু প্রস্তরাঘাতের দণ্ড ওয়াজিব হবে৷
দ্বিতীয় প্রকার হল, প্রাণের বদলায় প্রাণ৷ কিসাসের বিধান৷ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন, "কিসাসের মাঝে আছে তোমাদের জন্য প্রাণ হে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়, যাতে তোমরা খোদাভীরুতা অবলম্বন করতে পারো৷"
আল্লাহ তা'আলা বলেন, "পবিত্র মাসের বদলায় পবিত্র মাস৷ যার পবিত্রতা অলংঘনীয় তার অবমাননা কিসাসের অন্তর্ভূক্ত৷ কাজেই যেকেউ তোমাদের আক্রমণ করবে তোমরাও তাকে অনুরূপ আক্রমণ করবে৷ এবং তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করো৷ আর জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন৷
কিসাস
"কিসাস" এর আভিধানিক অর্থ:
কিসাস শব্দটি "কাসসুন" মূলধাতু থেকে গঠিত৷ যার অর্থ হল, পদরেখা অনুসন্ধান করা৷ ফিকহে ইসলামীর পরিভাষায় কিসাসের বেশ ক'টি সংজ্ঞা রয়েছে৷ তন্মধ্যে একটি হল, কিসাস হচ্ছে শরীয়ত নির্ধারিত এক দণ্ডবিধি৷ যা স্বয়ং শরীয়ত (কুরআন ও সুন্নাহ) নির্ধারণ করে দিয়েছে৷
কিসাসকে ওয়াজিবকারী ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের মাধ্যমে এই কিসাস সম্পন্ন হয়৷ এই হল কিসাসের প্রথম অবস্থা৷ পক্ষান্তরে কিসাসকে আবশ্যককারী খুন ব্যতীত অন্যান্য আক্রমণমূলক অপরাধের বেলায় আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে কৃত অপরাধের মাত্রাভেদে অপরাধীর শাস্তি নির্ণিত হবে৷ অর্থাৎ প্রাণহত্যার বদলায় মৃত্যুদণ্ড৷ আর এর নীচের স্তরের আঘাতের বদলায় অনুরূপ আঘাত৷ যেমনটি আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন, "যার পবিত্রতা অলংঘনীয় তার অবমাননা কিসাসের অন্তর্ভূক্ত৷ কাজেই যেকেউ তোমাদের আক্রমণ করবে তোমরাও তাকে অনুরূপ আক্রমণ করবে৷"
কিসাসের শর্তসমূহ:
প্রথম শর্তঃ
হত্যাকারী ব্যক্তি মুকাল্লাফ (যার উপর শরীয়তের বিধানাবলী প্রযোজ্য এমন) হতে হবে৷ অর্থাৎ সে প্রাপ্ত বয়স্ক এবং বুদ্ধি-বিবেচনাবোধসম্পন্ন হতে হবে৷ অতএব যদি খুনী প্রাপ্তবয়স্ক অথবা বুদ্ধি-বিবেচনাবোধসম্পন্ন না হয় তবে কোন কিসাস নেই৷ সুতরাং পাগল ব্যক্তি এই বিধানের অন্তর্ভূক্ত নয়৷ পক্ষান্তরে নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি, যে নেশা গ্রহণ করে তারপর হত্যাকাণ্ড ঘটায়, যে সেই মুহূর্তে বিবেকশূন্য থাকে সে কি এই বিধানের অন্তর্ভূক্ত হবে? খুনির ব্যাপারে কি এরকম কোন শর্ত আছে যে, সে মাতাল বা নেশাগ্রস্ত হতে পারবেনা? অর্থাৎ কোন মানুষ যখন কাউকে খুন করতে চায় তখন সে নেশা গ্রহণ করে তারপর খুন করে, যাতে করে সে এর মাধ্যমে খুনের শাস্তি থেকে পার পেয়ে যেতে পারে; কিন্তু এরকম ব্যক্তি কি আসলেই মুক্তি পাবে? এর উত্তর হল, না৷ ফুকাহায়ে কেরামগণ নেশাখোর ব্যক্তির উপর দায় চাপার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন, যখন সে কিসাসকে আবশ্যককারী কোন অপরাধে লিপ্ত হয়৷ এবং জুমহুর উলামা তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী এবং হাম্বলী ফকীহগণের মতও এটাই৷
তাহলে প্রথম শর্ত হল, খুনী ব্যক্তি শরীয়তের মুকাল্লাফ তথা প্রাপ্ত বয়স্ক এবং সুস্থ বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া৷ আর নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি এ শর্তের ব্যতিক্রম নয়৷
দ্বিতীয় শর্তঃ
খুনী ব্যক্তি নিহতের পিতা হতে পারবেনা৷ পিতা যখন আপন সন্তানকে খুন করে, তাকে কি এর বদলায় হত্যা করা হবে? না, এর বদলায় তাকে হত্যা করা হবেনা৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ ফুকাহায়ে কেরাম তথা হানাফী, শাফেয়ী ও হাম্বলী ফকীহগণ এ মতই পোষণ করেছেন৷
তৃতীয় শর্তঃ
হত্যাকারী ইচ্ছাকৃত হত্যা করতে হবে৷ অর্থাৎ অন্যকারো চাপের মুখে বা বাধ্য হয়ে নয়৷ কিন্তু চাপের মুখে বা বাধ্য হয়ে বলতে বুঝায় উপায়ান্তরহীন অবস্থা৷ উদাহরণস্বরূপ, কাউকে আরেকজনের উপর ফেলে দিয়ে হত্যা করা৷ যে অবস্থায় তার ভূমিকা থাকে কোন যন্ত্রের মতো৷ তাকে আরেকজনের উপর ধাক্কা দিয়ে ফেলা হয়, যার ফলে অপর ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে৷ এখন কি এই ব্যক্তিকে -যে বাস্তবেই নিরুপায় রকমের বাধ্য ছিল- তাকে কি এর বদলায় হত্যা করা হবে? আসলে তো -আল্লাহই ভাল জানেন- এই অবস্থাকে বাস্তবিক অর্থে বাধ্য করাও বলা যায়না৷ বরং একে বলতে হয় কোন মানুষকে যন্ত্রের মতো ব্যবহার করা৷ কিন্তু যেক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে এই বলে হুমকি দেয়া হয় যে, তুমি যদি তাকে খুন না কর তাহলে তোমাকে হত্যা করা হবে- এক্ষেত্রে এই ধরনের বাধ্যকরণ অগ্রহণযোগ্য৷ কেন এই বাধ্যকরণ অগ্রহণযোগ্য? কেননা হত্যাকারীর জান নিহত ব্যক্তির প্রাণের চেয়ে বেশী দামি ও গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ যেহেতু এখানে উদ্দেশ্য হল, উপায়ান্তরহীন বাধ্যকরণ৷ অর্থাৎ যেখানে একজন মানুষ পরিপূর্ণ যন্ত্রে পরিণত হবে৷ পক্ষান্তরে তার সামনে যখন এখতিয়ার থাকে যে, তুমি যদি অমুককে হত্যা না কর তাহলে আমরা তোমাকে এই এই করব; এ ধরনের চাপ প্রয়োগ মূলত বাধ্যকরণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়৷
চতুর্থ শর্ত:
নিহত ব্যক্তি খুনী ব্যক্তির সমকক্ষ হতে হবে৷ আর এই সমকক্ষতা চারটি বিবেচনায় হয়৷ যদিও এই চার বিবেচ্য বিষয়ে কিছুটা মতপার্থক্য আছে৷ তথাপি আমরা চারোটি বিষয় উল্লেখ করে এর মধ্যে থেকে অগ্রাধিকারযোগ্য বিষয়টিও উল্লেখ করবো৷
প্রথম বিবেচ্যঃ
ধর্মের ক্ষেত্রে সমকক্ষতা: সুতরাং কোন মুসলিমকে কোন কাফিরের বদলায় হত্যা করা যাবেনা৷ কারণ মুসলিম এবং কাফির ধর্মের ক্ষেত্রে সমকক্ষ নয়৷ অতএব কোন মুসলিমকে কোন যিম্মী বা নিরাপত্তাপ্রাপ্ত কাফিরের বদলায় হত্যা করা যাবেনা৷ যেহেতু হারবী কাফিরের মৌলিকভাবেই কোন দিয়্যত (রক্তপণ) এবং কিসাস নেই৷ বরং তাকে হত্যা করা মুস্তাহাব কিংবা ওয়াজিব অথবা মুবাহ (বৈধ)৷ এটিই জুমহুর শাফেয়ী, হাম্বলী এবং কতিপয় মালেকী ও যাহেরী ফকীহদের মত৷
দলীল:
হযরত আবু জুহাইফা সূত্রে বর্ণিত মারফূ' হাদীস৷ তিনি বলেন, আমি আলী রা. কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কাছে কি এমন কিছু আছে যা কুরআনে নেই? তখন তিনি বললেন, ঐ সত্বার কসম! যিনি দানা বিদীর্ণ করেন এবং প্রাণী সৃষ্টি করেন- আমার কাছে কুরআনে যা আছে এর বাইরে কিছুই নেই৷ আর আছে ওই বুঝশক্তি যা কোন ব্যক্তিকে আল্লাহর কিতাব কুরআনের ব্যাপারে দান করা হয় এবং এই পুস্তিকায় যা আছে তাই৷ আমি বললাম, কী আছে পুস্তিকায়? তিনি বললেন, দিয়্যত (রক্তপণ), বন্দীমুক্তি বিষয়ক বিধানাবলী এবং এই নীতি- মুসলিম ব্যক্তিকে কোন কাফেরের বদলায় হত্যা করা হবেনা৷
অতএব, কোন মুসলিমকে কোন কাফেরের বদলায় হত্যা করা যাবেনা৷ কিন্তু এ ব্যাপারে হানাফী ফকীহগণ কী বলেন? ইমাম আবু হানীফা রহ. একটি যঈফ হাদীস দিয়ে প্রমাণ পেশ করে বলেন, যিম্মী কাফেরের বদলায় মুসলিমকে হত্যা করা হবে৷ ইমাম মালিক রহ. বলেন, মুসলিমকে কাফেরের বদলায় হত্যা করা যাবেনা৷ তবে কেবলমাত্র একটি অবস্থায় তা করা যাবে৷ তা হল, যদি সে তাকে "গীলা" করে হত্যা করে৷
"গীলা" মানে কী? ইবনে রুশদ রহ. এ ব্যাপারে 'বিদায়াতুল মুজতাহিদ' কিতাবে লিখেন, গীলা হত্যা হল- (কোন যিম্মী অথবা নিরাপত্তাপ্রাপ্ত কাফেরকে) কাত করে শুইয়ে যবাই করে হত্যা করে তার ধন-সম্পদ লুটে নেয়া৷ ইমাম মালেক রহ. এর মাযহাব হল, এক্ষেত্রে ওই হত্যাকারী মুসলিমকে এই যিম্মী কাফেরের বদলায় হত্যা করা হবে৷ তবে এটা খুবসম্ভব তা'যীর ইত্যাদি হবে৷ আল্লাহই ভাল জানেন৷ কিন্তু অনুসরণের জন্য সহীহ হাদীসই এক্ষেত্রে অগ্রাধিকারযোগ্য৷ সহীহ হাদীসে আছে, কোন মুসলিমকে কাফেরের বদলায় হত্যা করা হবেনা৷
এটি হল প্রথম বিবেচ্য বিষয়৷ ধর্মের ক্ষেত্রে সমকক্ষ হওয়া৷
দ্বিতীয় বিবেচ্যঃ
স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সমকক্ষতা, অতএব গোলামের বিনিময়ে স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যা করা যাবেনা৷ চাই নিহত ব্যক্তি তার নিজের গোলাম হোক বা অন্যের৷ এ অভিমতই ব্যক্ত করেছেন শাফেয়ী এবং হাম্বলী ফকীহগণ৷ কিন্তু মালেক রহ. এক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করেছেন৷ তিনি বলেন, এ প্রকারের হত্যা যদি "গীলা" করে হয়ে থাকে তবে গোলামের বিনিময়ে স্বাধীন হত্যাকারীকে হত্যা করা হবে৷ যেমনটা তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও বলেছেন৷
তৃতীয় বিবেচ্যঃ
লিঙ্গের ক্ষেত্রে সমকক্ষতা, কোন পুরুষকে কি কোন নারীর বদলায় হত্যা করা যাবে? হ্যাঁ, পুরুষকে নারীর বদলায় হত্যা করা যাবে৷ এ অভিমতই ব্যক্ত করেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হাম্বলী ফকীহগণ৷ এবং এ মতটিই অগ্রাধিকারযোগ্য৷
চতুর্থ বিবেচ্যঃ
সংখ্যায় সমকক্ষতা, অর্থাৎ একাধিক ব্যক্তি যেমন দুই, তিন অথবা পাঁচ কিংবা দশজন লোক যদি এক ব্যক্তিকে হত্যার জন্য একমত হয়, কিংবা তারা সকলে এক ব্যক্তির হত্যায় শরীক হয় তাহলে কি ওই এক ব্যক্তির বদলায় এদের সকলকে হত্যা করা হবে? হ্যাঁ, তাদের সকলকেই তার বদলায় হত্যা করা হবে৷ এ মতই পোষণ করেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ ফুকাহায়ে কেরাম তথা হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী এবং হাম্বলী ফুকাহায়ে কেরাম৷ এ মতের উপরই সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমের ইজমা (ঐক্যমত্য) প্রতিষ্ঠা হয়েছে৷ যেমনটি ঘটেছিল ওমর ইবনে খাত্তাব রা. এর যামানায়৷ সেটি প্রায় অনেকটা ইজমায়ী (ঐক্যমত্যপূর্ণ) মাসআলার রূপ নিয়েছিল৷ আল্লাহই ভাল জানেন৷
কিসাস উসূল করার পদ্ধতি, কীভাবে কিসাস কার্যকর করা হবে?
এখানে দু'টি অভিমত আছে
প্রথম অভিমতটি হানাফীদেরঃ
তারা বলেন, তরবারী ছাড়া কোন কিসাস নেই৷ সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি কাউকে হত্যা করে, -হত্যার ধরন যেমনই হোক- এর শাস্তি হল তরবারী দ্বারা খুনীর গর্দান উড়িয়ে দেয়া হবে৷
দ্বিতীয় অভিমত হলঃ
না, প্রত্যেক খুনীকে একইভাবে হত্যা করা হবেনা৷ বরং প্রত্যেক খুনীকে সে যেভাবে হত্যা করেছে তাকেও সেভাবেই হত্যা করা হবে৷ যদি সে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে তাহলে আমরাও তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করবো৷ আর যদি সে পানিতে ডুবিয়ে খুন করে তাহলে আমরাও তাকে পানিতে ডুবিয়েই হত্যা করবো৷ অর্থাৎ সে যেভাবে হত্যা করবে সেইভাবেই তাকে হত্যা করা হবে৷
অতএব বুঝা গেল, কিসাস কার্যকরের দুই পদ্ধতির যেকোন পদ্ধতি এখতিয়ারাধীন৷ খুনী যেভাবে খুন করেছে সেভাবেই তাকে হত্যা করা হবে কিংবা চাইলে তরবারি দিয়ে তার শিরোচ্ছেদ করা হবে৷ এটি শাফেয়ীদের মত এবং হাম্বলীদের থেকে বর্ণিত দু'টি মতের একটি মত এর অনুরূপ, তাছাড়া মালেকীদের মতও এরকম৷ তবে মালেকীরা এখানে একটি ব্যাপার আলাদা করে উল্লেখ করেন৷ তা হল, যদি খুনী হারাম উপায়ে কাউকে খুন করে, যেমন, খুনের ইচ্ছায় কেউ কাউকে এমন অতিরিক্ত মদ পান করালো যে, সে মারা গেল; এমতাবস্থায় আমরাও কি এই খুনিকে ধরে এনে সে মরা পর্যন্ত তাকে মদ পান করাতে থাকবো? উত্তর হল, না৷ কেন? যেহেতু এটা একটা হারাম পদ্ধতি৷ সুতরাং পদ্ধতি যখন হারাম হয় সেক্ষেত্রে খুনীকে হুবহু তার পদ্ধতিতে হত্যা করা হবেনা৷
এখন কথা হল, অপরাধীকে হুবহু তার হত্যার পদ্ধতিতে হত্যা করার দলিল কী? এর দলিল হল, মহান আল্লাহর বাণী- (আয়াতের অর্থ) "যদি তোমরা শাস্তি দাও তবে ঠিক ততখানি শাস্তি দেবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে৷"
আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণিত আছে, এক বালিকাকে দেখা গেল যে, তার মাথা দুই পাথরের মাঝে থেতলে দেয়া হয়েছে৷ লোকজন তাকে জিজ্ঞেস করল, কে তোমার এমন দশা করেছে? অমুক, অমুক? এভাবে এক পর্যায়ে তারা এক ইহুদীর নাম নিলে সে মাথা ঝাঁকিয়ে তাদের কথায় সায় দিল৷ তারপর ইহুদী লোকটিকে ধরা হলে সে অপরাধের কথা স্বীকার করল৷ তখন নবী করীম সা. নির্দেশ দিলেন, তার মাথাও যেন পাথর দিয়ে এভাবে থেতলে দেয়া হয়৷ হাদীসটি সহীহ মুসলিমে আছে৷ অর্থাৎ অপরাধীর সঙ্গে তদ্রুপ আচরণ করা হবে যেমনটি সে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে করেছে৷
কিসাস কি মাফ হতে পারে? হ্যাঁ, কিসাস মাফ হতে পারে৷
কিসাস কখন মাফ হয়?
কিসাস নিম্নোক্ত অবস্থাগুলির কোন অবস্থায় মাফ হয়ে যায়:
প্রথম অবস্থাঃ
কিসাসের পাত্র হাতছাড়া হয়ে যাওয়া৷ যেমন, অপরাধীকে গ্রেফতার করার আগেই, কিংবা তাকে আদালতে উঠানোর আগে, অথবা কিসাস কার্যকর করার আগেই সে মারা গেল৷
এভাবে পাত্র হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কারণে কিসাস মাফ হয়ে যায়৷ কিন্তু তখন তার বিষয়টি আল্লাহ তা'য়ালার হাতে ন্যস্ত হয়ে যায়৷
দ্বিতীয় অবস্থাঃ
ক্ষমা করে দেয়া৷ অর্থাৎ আক্রান্ত আহত ব্যক্তি কিংবা নিহতের পরিবার অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়া, উদারতা প্রদর্শন করা, তার অধিকার ছেড়ে দেয়া৷
তৃতীয় অবস্থাঃ
আপোষ করা৷ অপরাধী এবং আক্রান্ত ব্যক্তি পরস্পরে আপোষ করে নেয়া৷
ক্ষমা করা এবং আপোষ করে নেয়ার মাঝে পার্থক্য কী?
ক্ষমা করা এবং আপোষ করে নেয়ার মাঝে পার্থক্য হল, ক্ষমা করা হল বিনিময়হীন, পক্ষান্তরে আপোষ করাটা কখনো বৈষয়িক বিনিময় ইত্যাদির মাধ্যমে হয়ে থাকে৷ তো এই তিনটি বিষয় কিসাসকে অকার্যকর করে দেয়৷ এক. কিসাসের পাত্র হাতছাড়া হয়ে যাওয়া৷ দুই. ক্ষমা করে দেয়া৷ তিন. আপোষ করে নেয়া৷ এই হল মৃত্যুদণ্ডকে ওয়াজিব করে এমন অপরাধে জড়িত মুসলিমের সংক্ষিপ্ত বিধানাবলী৷
আমরা আল্লাহ তা'য়ালার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের তার আনুগত্যের তওফিক দান করেন এবং তার অবাধ্যতার কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে রাখেন৷ নিশ্চয়ই তিনি সর্বশক্তিমান৷ আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু৷