JustPaste.it

 

আমার দেশের চালচিত্র

মুহাম্মাদ ফারূক হুসাইন খান

======================================================

 

        দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে আমাদের জীবনে এসেছিল আরও একটি ঈদ পর্ব-ঈদুল ফিতর। প্রতিটি বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়ে আনন্দের প্লাবন বইয়ে দিয়ে অবশেষে সেও চুপি চুপি কালের গর্ভে মুখ লুকাল। দীর্ঘ এক মাস যাবৎ যাবতীয় লোভ, লালসা, ভোগ ও পাপকার্য থেকে আমাদের মুক্ত রাখার ও কঠোর সাধনার মাস রম্যান। সামর্থ ও সাধ্য অনুযায়ী নিজের সর্বস্ব অপরের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে ত্যাগের আনন্দ গ্রহণের মাস রমজান। মোটকথা এ মাস ভোগের নয় ত্যাগের। আর এই কঠোর ত্যাগ ও সংযমের মাধ্যমে মনকে পরিশুদ্ধ করার পর পুনঃরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার দিনটিকে বলে ঈদুল ফিতর অর্থাৎ (রোযা) ভাঙ্গার উৎসর। এদিন মুসলমানদের আনন্দের দিন। কিন্তু এ আনন্দের পরিসীমা কতখানি হবে তা’ রাসূল ﷺ এবং সাহাবাগণ নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করে আমাদের জন্য নির্দেশনা রেখে গেছেন। সাহাবীগণ এবং রাসূল ﷺ পুরো রমযানে খুব কম খাওয়া-দাওয়া করতেন। এজন্য তখন বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বছরের অন্যান্য সময় অপেক্ষা কম থাকত। ঈদের দিন রাসূল ﷺ মিষ্টি খেতেন এবং অন্যকে খাওয়াতেন। সাহাবীগণ এ সময় গাছ থেকে নতুন কাটা খেজুর, কিছু মিষ্টি এবং হালুয়া খেয়ে ঈদ পালন করতেন। ঈদের দিনে রাসূল ﷺ এবং তাঁর সাহাবীগণও তাঁদের নিজস্ব জামা-কাপড়ের মধ্যে সবচেয়ে ভাল এবং সুন্দর জামা কাপড় পরে ঈদের জামাতে উপস্থিত হতেন। তাঁরা রমযান মাসের অধিকাংশ সময় টাকা নিয়ে মসজিদে অভাবগ্রস্থদের অপেক্ষায় বসে থাকতেন এবং ভাল কাজে কে কত বেশী নিজের সম্পদ ব্যয় করতে পারে তার একটা প্রতিযোগিতা লেগে থাকত তাদের মধ্যে। মোটকথা, এটাই হল রমযান ও ঈদ উৎযাপন করার রাসূল ﷺ -এর আদর্শ। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমাদের সমাজে ঈদের সেই উত্তম আদর্শের ছিটেফোটাও অবশিষ্ট আছে কি?

 

        জোর গলায় বলা যায়, মোটে নেই। এখনকার রমযান-ঈদ ত্যাগের পরিবর্তে ভোগের উৎসবে পরিণত হয়েছে। কোরবানীর ঈদের উদ্দেশ্য হল মানুষের পশু প্রবৃত্তিকে কোরবাণী করা। অথচ আমরা কে কত বেশী মূল্যের পশু কোরবানী করতে পারি সে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠি ঈদুল আযহার দিনে। রমযানে কম খাওয়াতো দূরের কথা বেলা দ্বিপ্রহরের পর পরই গৃহের কত্রীদের ডজন ডজন আইটেমের ইফতারী তৈরীতে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। রমযান মাসে আমাদের ভোজন বিলাস এত চরমে ওঠে যে, বাজারে দ্রব্যসমূহ অগ্নিমূল্যে বিক্রি হয়। রমযানে খাওয়ার পরিমাণ কম হওয়ার কারণে শরীরের সকল রোগ দূর হওয়ার কথা থাকলেও অতি ভোজনের ঠ্যালায় আমাদের দেহে নতুন নতুন রোগের সৃষ্টি হয়। ডাক্তারের ঔষধের পুরো ডিসপেনসারী গিলে খেলেও সে রোগ সারতে চায় না। ঈদের দিনে তো কথাই নেই-মাশাআল্লাহ। এ দিন কোর্মা-পোলাও, রোষ্ট, রেজালা, কালিয়া, কোপ্তা, বিরানী, খিচুরী, জর্দা, ফিরনি হাজার রকমের সেমাই হালুয়া খেয়ে পেটের যন্ত্রণায় মরণ এসে সামনে দাড়ায়।

 

        রাসূল ﷺ ঈদের দিন যে ভালো জামা কাপড় পরতেন সে সুন্নতের চরম বিকৃতি ঘটেছে আমাদের পোশাক বিলাসে। পাঁচ / ছয় হাজার টাকার বেতনের অফিসার আমলা লাখ টাকা খরচ করে ঈদের বজার করতে যান হংকং, সিঙ্গাপুর, বোম্বে। নইলে তাদের নাকি পেজটিজ নষ্ট হয়। তারা অবৈধ টাকা খরচ করার একটা রাস্তা বানিয়ে নিয়েছেন আর কি।

 

        আমাদের দেশের অভিজাত অনভিজাত মার্কেট বা ফুটপাতের দোকান গুলির অবস্থা ঈদ মওসুমে খুবই অস্বস্তিকর রূপ ধারণ করে। আমাদের সোনামনিদের হিরিক পড়ে যায় নতুন নতুন ফ্যাশন খোঁজার। ছেলেরা শার্টের বোতাম খুলে উদোম বুক প্রদর্শন করে নিজেদের বাহাদুরী প্রকাশ করে আর ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আমলা অফিসার পত্নী ও তাদের আদুরে কন্যারা উদোম মাথা, আধা খোলা বুক আর খোলা পেট প্রদর্শন করে নিজেরা তৃপ্ত হন অন্যের কামুক চক্ষুকেও তৃপ্তি দেন। ঈদের মার্কেটে এরাই একটা প্রথম শ্রেণীব পণ্যে পরিণত হয়। ঈদের বাজার প্রমাণ করে, আমাদের সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তি যতই আর্থিক, উন্নতি করতে থাকে ততই তাদের পত্নী ও কন্যাদের চেহাৱা-সৌন্দর্য একটা সস্তা পণ্যে পরিণত হয়। বছরের অন্যান্য সময়ের কথা না হয় বাদ দিলাম। পবিত্র রমযান মাসে এবং ঈদের দিনেও সুন্নতের বিকৃতি ঘটিয়ে, ফরজ ইবাদত পর্দাকে ড্যাম কেয়ার করে, ব্লাউজ, কামিজের কাটিংয়ে ইংরেজী ‘ভী’ অক্ষরের সার্থক রূপায়ন ঘটিয়ে প্রজাপতির মত পর-পুরুষের সামনে নিজেদের সৌন্দর্যের ডালা মেলে না ধরতে পারলে তারা তৃপ্তি পান না। ঈদের দিন উগ্র মেকাপ চর্চিত, ঝলমলে পোষাকে আর বিদেশী পারফিউমের প্লাস্টার লাগানো রেখা, শ্রীদেবী, এলিজাবেথ টেইলার আর সোফিয়া লরেনদের ভীর জমে নগরীর অলিতে-গলিতে। বিবেকবান মানুষের তখন হয় মরণ দশা। সামনের দিনগুলোতে রাস্তায় বেরুতে হলে তাদের চোখে ঠুলি পরতে হবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় হয়ত তাদের ঈদের দিন স্বগৃহে বন্দী থাকতে হবে নতুবা রাজপথে বেরুতে হবে বোরকা পরে।

 

        কিন্তু এ অধঃপতনের জন্য দায়ী কে? এর জন্য দায়ী আমরাই। আমরা মদীনার ইসলাম এবং রাসূল ﷺ -এর আদর্শ থেকে সরে এসেছি বহু যোজন দূরে। আমরা আকরে ধরে আছি বাগদাদী, মোঘলাই, তুর্কী, দামেস্কী মুসলিম নামধারী বিলাসী রাজা-বাদশাহদের কর্মকাণ্ড জীবনাচারকে। ওই সব রাজ বংশের অধিকাংশ বাদশাই ইসলামের অনুশাসনে ইচ্ছেমত বিকৃতি ঘটিয়ে ইসলামী উৎসবগুলোকে ভোজন-বিলাসী কৃত্রিম অনুষ্ঠানে পরিণত করেছিল। মদ-আর বাঈজীর নাচ, নুপুরের ঝংকার আর তবলার তালে সারাক্ষণ ডুবে থাকতো বলে ওদের মস্তিষ্ক ছিল এক একটা মস্ত বড় শয়তানের আড্ডা।

 

        এবারের ঈদ উপলক্ষে জনৈক সরকারী মন্ত্রী ঢাক-ঢােল-কাশা পিটিয়ে রাজপথে যে জমকালো উৎসব মিছিলের আয়োজন করেছিলেন তার উৎপত্তি ঘটেছিল ঐ শয়তানদের প্রভাবিত মস্তৃক থেকেই। আমরা হরেক রকমের খাদ্য ও পোষাকের। সমারোহ ঘটিয়ে যে ঈদ উৎসব উদ্যাপন করি তাও আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি ওদের নিকট থেকেই।

 

        সুতরাং আমাদের সমাজে ভোজন–বিলাস, লজ্জা-শরম ও পর্দাকে উপেক্ষা করে ঈদ উৎত্যাপন করার যে রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে তাকে চিরতরে মুছে ফেলতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে ঈদের ত্যাগের আদর্শ। সমাজে ইনসাফ ভিত্তিক আইন ইসলামকে পুননারুজ্জীবিত করতে হবে। নেই কি কোন সাম্য ও ইনসাফের সৈনিক যিনি বাধার হিমালয়কেও টপকে এ দায়িত্ব পালনকরতে পারবেন দৃঢ় চিত্তে?

 

        শকুনের ন্যায় এক পাল মানুষ শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কার্যোপলক্ষে প্রায়ই এফডিসির পাশ থেকে আশা যাওয়া করতে হয়। সকাল-বিকেল, রাত্র-দুপুর সর্বদাই দেখি বখাটে টাইপের বস্তির বাসিন্দা, কিছু রিকশাওয়ালা এবং তাদের সাথে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের দু’একটি কিশোর যুবকও শ্যেন দৃষ্টিতে এফডিসির বিশাল লোহার গেটের প্রতি তাকিয়ে আছে। কখন খুলবে এই গেট, কখন কোন নায়ক নায়িকা বেরিয়ে আসবে-তাদের এক নজর দেখে চোখ জুড়াবে সেজন্য তাদের এই প্রতীক্ষা।

 

        হ্যাঁ আমাদের সিনেমার রঙীন জগতের ধরার বুকের তারকা তথা নায়ক-নায়িকা, নর্তক-নর্তকী, গায়ক গায়িকাদের কথাই বলছি। যারা মাটির মানুষ হয়েও এক শ্রেণীর নির্বোধ মানুষের মনে দেবতার আসন গড়েছেন। ঐ শ্রেণীর মানুষ এদের এক নজর দেখলে তাদের মনে শান্তির ধারা অঝাের ধারায় ঝরতে থাকে। স্কুলে পড়ার অবসরে, খেলার মাঠে, আড্ডায় এদের নিয়ে জমজমাট রসালো গল্পের অবতারণা ঘটে। পর্ণো পত্রিকাওয়ালারা এদের বাহারী ছবি ছাপিয়ে হাতিয়ে নেয় প্রচুর মুনাফা। তথাকথিত আধুনিক ও প্রগতির সন্তানদের কাছে এরা হয়ে ওঠেন প্রিয় ব্যক্তিত্ব।

 

        আধুনিক এই সবাক সিনেমা আবিস্কারের কীর্তির দাবীদার ওয়ারনার নামক এক মার্কিন ইহুদী বিজ্ঞানী। ১৯২৭ সালে তিনি তার এই মহান (!) সৃষ্টিকে উপহার দিয়ে পৃথিবীর ভোগ বিলাসী মানুষদের চিত্ত বিনোদনের জগতে এক অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটান। ভোগ লিপ্সু মানুষদের শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাওয়া চিত্তে এ অনুপম আনন্দ রসের যোগান দিয়ে তিনি তাদের সকলের রাজকীয় শ্রদ্ধার পাত্র হন।

 

        মূলতঃ সিনেমা আবিষ্কারের পেছনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সকল মানব জাতির নৈতিক চরিত্রকে ধ্বংস করা। বিংশ শতাব্দীতে ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে ইহুদীরা কখনো পৃথিবীর কোথাও রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল না। পৃথিবীর জনসংখ্যার তুলনায় ইহুদীদের সংখ্যা খুব নগণ্য থাকায় তা সম্ভবপরও ছিল না। সংখ্যায় নগণ্য হলেও ইহুদীরা ছিল সকল সম্প্রদায়ের মানুযের ঘোর দুশমন। ধূর্তামী, যড়যন্ত্র ও গণ্ডগোল পাকানোতে এই সম্প্রদায় সম্রাট হওয়ায় সর্বপ্রথম হযরত মুহাম্মদ ﷺ কতৃক মদীনা রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কৃত হয়। পরে ১২৯০ সালে ইংল্যাণ্ড থেকে, ১৩০৬ ও ১৩৯৪ সালে — দুই পর্যায়ে ফ্রান্স থেকে, ১৩৭০ সালে বেলজিয়াম থেকে, ১৩৮০ সালে চেকোস্লাভিকিয়া থেকে, ১৪৪৪ সালে হল্যাণ্ড থেকে, ১৫৪০ সালে ইতালী থেকে, ১৫১০ সালে রাশিয়া থেকে, ১৫৫১ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হিটলার কর্তৃক জার্মানী থেকে এই একই কারণে এদের বহিষ্কার করা হয়। সারা বিশ্ব থেকে এভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর অষ্ট্রিয় ইহুদী সাংবাদিক থিওডাের হাজেল আন্তর্জাতিক ইহুদী সংস্থা গঠন করেন। তার উদ্যোগে ১৯০৫ সালে সুইজারল্যাণ্ডে আন্তর্জাতিক ইহুদী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে বিশ্বে ইহুদীদের কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য যে প্রস্তাব সমূহ গৃহীত হয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল, “সর্বত্র আমাদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বিশ্বব্যাপী মানুষের নৈতিক চরিত্রে ভাঙ্গণ ও বিপর্যয় সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে।”

 

        এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য ইহুদী পণ্ডিতরা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে নাইট ক্লাব, বার, প্রমোদ তরী, সিনেমা, ভিসিয়ার, ব্লুফ্লিম, বিমান বালা, বিউটি পার্লার, কলগার্ল, মডেলিং আরও হরেক রকমের উদ্দ্যম চিত্তবিনোদনের উপায় উপকরণ, প্রক্রিয়া। বিশ্বের প্রতিটি দেশের মত আমাদের দেশেও বৃটিশ শাসক এবং পরবর্তিতে তাদের তকমা আটা শাসকদের সুবাদে এবং চিত্ত হরণকারী বিচিত্র উপায় উপকরণ সুড় সুড় করে ঢুকে পড়ে। এক সময় সিনেমা হয়ে ওঠে বাংলার তথাকথিত ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতি, অবিচ্ছেদ্য অংশ। নায়ক-নায়িকারা বুক ফুলিয়ে জোড় গলায় দাবী করতে থাকেন, ‘সিনেমা সুস্থ বিবেকবান সমাজ গঠনের হাতিয়ার।’ আর যেহেতু তারাই এই মহৎ কর্মটির আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন সেহেতু তারাই মহান (!)

 

        ইতরামী আর বাদরামী যাদের আজীবনের সাধনা এক পর্যায়ে তারা সমাজ সংস্কারের মহৎ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। লজ্জা নামক মানবীয় গুণটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে রূপালী জগতের সোনালী মানব মানবীরা মেতে ওঠে রোমান্টিক চিত্তহরণকারী বিচিত্র কর্মকাণ্ডে। এই জগতের বাবা মেয়েকে, ভাই বোনকে, স্বামী স্ত্রীকে পরপুরুষের সাথে অভিনয়নের নামে জড়াজড়ি, ঢলাঢলি, কোলাকুলি করার সুযোগ করে দেন। এসব দৃশ্য দেখে তাদেরকে আরো এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দেন, চমৎকার অভিনয় হচ্ছে বলে নিজেরা আনন্দে বাক-বাকুম করতে থাকেন। দর্শকদের কাতারে বসে অদূরের দুলারীর শরীর নাচানো বাহারী নৃত্য দেখে তারাও হাততালি দিয়ে বাহবা জানাতে কসুর করেন না।

 

        রোমান্টিক মানব মানবীরাও ভদ্র প্রগতিবাদী পিতা, ভাই, স্বামীর এই উদারতা, অকৃত্রিম প্রেরণার মূল্য দিতে ভূল করেন না। লাইম লাইটে উঠে আসার জন্য বিচিত্র এবং শিহরণমূলক নানান রোমান্টিক ঘটনা ঘটানোর একটা প্রতিযোগিতা তাদের মধ্যে লেগেই থাকে। কে কতখানি বিউটি কুইন সাজতে পারে, প্রেম নিবেদনে কে বেশী পারঙগম, কে দেহ প্রদর্শনী করতে বেশী উদার এসব যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় এই মহান (!) সাংস্কৃতিক অঙ্গণে কে বেশী প্রতিভাবান ও কুশলী সাংস্কৃতিক কর্মী। জাতীয় সংস্কৃতিতে তার এই অসামান্য অবদানের জন্য তার কোচরে একের পর এক রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক পুরস্কার আসতে থাকে। ওনারা চলনে বলনে স্বপনে নিজেদের সংস্কৃতির জনক জননী কল্পনা করে আত্মতৃপ্তি লাভের চেষ্টা করেন। স্টুডিও পাড়া, পার্টিতে, আডডায়, মনের মত সাংবাদিক পেলে পুচ্ছ নাড়তে নাড়তে মনের এ কথাগুলোই ঢেলে দেন।

 

        সুস্থ বিবেকবান মানুষকে অশ্লীলতা, নগ্নতা, বেহায়াপনা ও পশুত্বের দিকে প্রতিনিয়ত আহবান করা যাদের মহান ব্রত সেই শয়তানের দোসররা চলনে-বলনে যতই সাধু সাজার অপচেষ্টা চালাক ওরা কখনই মানবতার বন্ধু নয়। শয়তান সর্বদা বহুরূপী, সে সর্বদাই নিজেকে সাধু বলে জাহির করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে। সিনেমার রূপালী জগতের নট-নটীরাও শয়তানের চেয়ে কোন অংশে কম নয় বরং ওদের কার্যকলাপ দেখে শয়তানও লজ্জায় মুখ লুকায়। এই জগতে নৈতিকতা বা মানবীয় কোন গুণাবলীর বালাই নেই। সংস্কৃতি সেবার নামে যে সমস্ত দৃশ্যের ওরা অবতারণা করে মনে হয় যেন ওরা অতিমানব। অথবা মানবীয় সকল রীতি-নীতি, সীমা-পরিসীমার জঞ্জাল (!) থেকে ওনারা মুক্ত। প্রকৃতি ওনাদের অবাধে জড়াজড়ি, ঢলাঢলি করার মহা সনদ দিয়ে দিয়েছে। জগতে ওনাদের আবির্ভাব, ওনাদের মিশনই হল মানুষের চিত্তহরণ করা, নব-নব সুখে তাদের মন হৃদয়কে ভরিয়ে দেয়া।

 

        যুগের হাওয়া, আধুনিকতা, প্রগতি, নারী স্বাধীনতা ও সভ্যতার নামে অশ্লিলতা, নগ্নতা ও চরিত্রহীনতার জোয়ারে নিজেদের ভাসিয়ে দেয়া পাশ্চাত্যের ধর্মকে বিকৃতিকারী ইহুদী খৃষ্টান নর-নারীর জাত আসলাত। ওই সমাজের পুরুষেরা কন্যা-বোন-স্ত্রীকে নাচিয়ে অন্যকে তাদের ফর্সা উরু, নিতম্ব ও শরীরের লোভনীয় অংশ দেখিয়ে ও নিজেরা দেখে সুখ পায়। নিজেদের শরীরে লম্বা প্যান্ট, ঢােলা সার্ট চাপালেও রমনীকূলকে মিনিস্কাট, বিকিনি, আটো সাঁটো সংক্ষিপ্ত পোশাক পরিয়ে রাস্তায়, ক্লাবে, বারে, থিয়েটারে, সিনেমায় যত্রতত্র ছেড়ে দিয়ে নিজেরা চিত্তকে শতল করে অন্যের চিত্তেও শান্তি বিলায়। নারীকে চিত্তবিনোদনের জন্য যত প্রকারে পারা যায় পণ্য সামগ্রীর মত ভোগ করাই ওদের সংস্কৃতি। যৌনতা ও নারী দেহের পূজো করা ওদের প্রগতি নারীকে পরিবারের বাঁধন থেকে বেড় করে যতখানি সম্ভব সংক্ষিপ্ত বসনে অফিসে, আদালতে, বাসে-ট্রেনে, শহরে-নগরে সর্বত্র নিজেদের চাওয়া পাওয়ার চৌহদ্দিতে হাজির রাখাকে ওদের ভাষায় নারী স্বাধীনতা বলে। ওই সমাজের সিনেমা ও টেলিভিশন এসব নগ্নতা, অশ্লিলতাকে প্রগতি আর নারী স্বাধীনতার মোহরাঙ্কিত করে প্রচার করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। তাই দেখা যায়, ম্যাডােনার ব্যবহৃত পোশাক নিলামে ওঠে, তিনি কনসার্টে রিতিমত বস্ত্রের জঞ্জাল মুক্ত হতে পারেন বলে তার এত বিশ্বখ্যাতি। হলিউড, বোম্বের নায়িকারাতো রীতিমত প্রতিযোগিতায় মেতে থাকে “কে কত সংক্ষিপ্ত বসনে নিজেকে উপস্থাপন করে অধিক দর্শক প্রিয় হতে পারে। পত্রিকায় ফলাও করে সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়, দর্শকদের রুচির প্রয়োজনে নিজেদের আরো খোলামেলা হয়ে ক্যামেরার সামনে দাড়াতে তাদের কোন আপত্তি নেই।”

 

        পাশ্চাত্যের ভ্রষ্ট সমাজের এই সমস্ত নীতিহীন কর্মকাণ্ড এই মুসলিম দেশটিতেও অবাধে চলছে। রূপ-সৌন্দর্য, ভাড়ামী পূর্ণ হাসি, মিষ্টি কণ্ঠস্বর ও যৌবন নাকি এই জগতে খ্যাতির শীর্ষে ওঠার মুলধন। সে যত এগুলিতে পারদর্শী হবে সে ততই দ্রুত সাফল্যের চূড়ায় চড়ে পা দোলাতে পারবে। ধর্মীয় বিধি-নিষেধ, লজ্জা নৈতিকতা এদের কাছে পঁচা পান্তা ভাত। ধর্মীয় বিধি বিধানের সীমাকে ওরা অহরহ ভেঙ্গে ফেলে সমাজকে উপহার দিচ্ছে, লজ্জাহীনতা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, নিত্য নতুন ফ্যাশন, বিলাস দ্রব্যের আহরণ, পারকিয়া প্রেম, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীর মহা পবিত্র ও স্বর্গীয় প্রেমের (?) নামে অবৈধ সম্পর্ক গড়ার সবক এবং কলাকৌশল।

 

        ইসলাম নারীদের বেআব্রু হয়ে চলা ফেরা করতে নিষেধ করেছে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে। কিন্তু রুপালী জগতের নটীরা তা উপেক্ষা করে বেআব্রু কেন বিবস্ত্র হতেও কুণ্ঠিত হয় না। ইসলাম নারীদের মর্যাদা রক্ষার এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নির্দিষ্ট ১৪ জন পুরুষ ব্যক্তি ব্যতীত অন্যান্য পুরুষের নিকট থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু ওনারা চিত্ত বিনোদনের বাজারে যেভাবে পণ্যের মত ব্যবহৃত হন, নিজের সুন্দর দেহ বল্লরী সৌন্দর্যকে বিক্রি করে গাড়ী, বাড়ী, টাকার পিছনে হন্যে হয়ে ছোটেন এবং অন্যকে তাদের পথ অনুসরণ করার উৎসাহ দেন তাতে মনে হয় যেন এই পৃথিবীতে যত নীতি-নিয়ম, নৈতিকতা, ধর্মীয় বিধান আছে সেগুলোকে দুমরে-মুছরে একাকার করে দেয়ার জন্যই ওনাদের জন্ম হয়েছে। ধর্মের বিরুদ্ধে, নৈতিকতার বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করাই ওনাদের জীবনের সাধনা। ধর্মের কথা শুনলে ওরা হাসে-দাঁত বের করে হাসে। পারলে মুখের ওপর বলে দেয়, “ওসব নীতি আদর্শের ফাঁকা বুলিতে সমাজ-দেশ চলে না, ওতে ভাত জোটে না, ওপথে অর্থ নেই, যশ নেই, খ্যাতি নেই, সম্মান নেই।”

 

        এদের নিয়ে আমাদেরও তত মাথা ব্যথা নেই। ওরা নাচছে আরও নাচুক, প্রকৃতি প্রদত্ত দেহখানা ষােল আনাই প্রদর্শন করে। আরও বাহবা কুড়াক ওরা ওদের কিছিমের লোকদের “খেমটা” নাচের তালে তালে আরও দিওয়ানা করুক, ছাগল-পাগল বানিযে ছারুক তাতেও আমাদের কিছু আসে, যায় না। ওদের মা-বোন-স্ত্রীদের ইজ্জতের না হয় কোন মূল্য নেই, বরং তাদের ইজ্জত বিকিয়ে, পরের মনোরঞ্জন করে তারা মূল্যবান বাড়ী-গাড়ি করে তৃপ্তি পায়। পরপুরুষের সাথে যেমন খুশি তেমন সম্পর্ক রাখলেও তাদের কিছু আসে যায় না। কিন্তু এই সর্বনাশা ও ধ্বংসাত্মক অভিশাপটা গোটা জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়ার অধিকার ওরা কোথায় পেল? জনসমক্ষে পাগল ছাগলের বেশ ধারণ করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার এত আয়োজন কেন? ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর এত আঘাত কেন? এরকি কোন প্রতিকার নেই?

 

        রুখতে হবে এই শয়তানী, গুড়িয়ে দিতে হবে শয়তানদের আড্ডা খানা। সমাজকে মুক্ত করতে হবে এইসব শয়তানদের বদ আছর থেকে। ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে হাসি ঠাট্টাকারীদের রুখতেই হবে। ওদের অশুভ তৎপরতায় বিভ্রান্ত মানুষদের জানিয়ে দিতে হবে যে, সিনেমা আর হিরো হিরোইনদের অশ্লীলতা সুস্থ সমাজ গঠনের হাতিয়ার নয়। মানবতা, শালীনতা, নৈতিকতা ও বিলাসীতা মুক্ত জীবন যাপন ও অন্যকে সে পথ অনুসরণ করার আহবান এবং এ জাতীয় তৎপরতাই হতে পারে সুস্থ সমাজ গঠনের হাতিয়ার। প্রকৃতি প্রদত্ত রুপশ্রী এবং দেহকে পুঁজি করে কোন ব্যবসা করা ও জীবিকা নির্বাহ করার পাথেয় করে নেয়া বৈধ তো নয়ই মানবিক দৃষ্টিতেও চরম ঘৃণিত কারবার। ইসলামের ফয়সালা তো আরো কঠিন। এ সত্যটুকু বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী এবং বিভ্রান্তের শিকার উভয় শ্রেণীর মানুষের কাছে পৌছে দিতে হবে। কে আছো ভাই সত্যের সাধক, সত্যের ঝাণ্ডাধারী! বিভ্রান্ত মানুষের কাছে সত্যের আলো কে পৌছিয়ে দিবে, কে সবদিকে জ্বালাবে সত্যের মশাল?

 

 

প্রশ্নোত্তর (৩৪ পৃঃ পর)

------------------------------------------------------------

 

        বেশী বলা হয়েছে জিহাদর কথা। সে সব আয়াতের অধিকাংস স্থানে জিহাদ দ্বারা নফসের জিহাদকে বুঝান হয়নি। বুঝান হয়েছে ইসলাম বিরোধীদের মুকাবিলায় অস্ত্রহাতে সরাসরি ময়দানে অবতীর্ণ হওয়ার কথা। কুরআন ও হাদীসেরর পরিভাষায় জিহাদ বলতে কাফিরদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধের করার কথাই বুঝায়। এছাড়া অন্য কিছুকে অন্ততঃ কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় জিহাদ বলা হয় না। তাই আকবর ও আসগারের প্রশ্নই উঠে না। জিহাদ বলতে বহু বিষয়কে যদি বুঝত তাহলে তুলনা করার অবকাশ ছিল যে, কোনটি ছোট এবং কোনটি বড়। জিহাদ বলতে যেহেতু উপরোক্ত একটি বিষয় ছাড়া দ্বিতীয় কিছু বুঝায় না সেহেতু কোনটি ছোট এবং কোনটি বড় তা তুলনা করার অবকাশ কই? তবে শাব্দিক ভাবে যুদ্ধ ছাড়াও সংগ্রাম, সাধনা অর্থেও জিহাদ ব্যবহৃত হয়। তাই যেহেতু নফসের সাথে সংগ্রাম করে দ্বীনের পথে চলতে হয়, আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে হয় তাই শাব্দিক অর্থে একেও জেহাদ বলা যায় এবং বলা হয়ও! তবেতা কখনও জিহাদে আকবর নয়।