JustPaste.it

পদে পদে আল্লাহর নুসরাত
জম্মু-কাশ্মির ফ্রন্টে কমাণ্ডার শামশীর খানের
ঈমান-দীপ্ত দাস্তান

=========================================


(পূর্ব প্রকাশের পর)
      পথেই রাত হয়ে যায়। আমার ভীষণ .ঘুম পায়। ঘুমের ঘোরে চলতে গিয়ে একবার হোচট্‌ খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। এক মুজাহিদ আমার হাত ধরে ফেলে। পরে আমি তার হাত ধরেই চলতে থাকি। এ সময়ে আমার এক অদ্ভুদ অভিজ্ঞতা হয়। এ মুজাহিদের হাত ধরে চলতে চলতে পুরদস্তুর ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু পথ চলতে কোন ব্যাঘাত হলনা। এভাবে ঘন্টাক্ষানিকের মত ঘুমিয়ে নিলাম। এর পর থেকে এটা আমার অভ্যাস হয়ে যায় যে, হাটতে হাটতে ঘুম ধরলে এক সঙ্গীর হাত ধরে নিতাম। একই সঙ্গে ঘুমাতাম এবং পথ চলতাম!
     ভোর তিনটায় আমরা ইসলামাবাদের (অনন্তনাগ) প্রথম গ্রাম পরওয়ানীতে পৌঁছি। গ্রামবাসী আমাদের আসার সংবাদ পেয়ে দলে দলে বেরিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। আহসান ডারে স্থানীয় মুজাহিদদের সাথে পরামর্শ শেষ করে আমরা আবার সামনে অগ্রসর হলাম ।
      রাতের প্রহরীঃ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আমরা 'কুগর গ্যান্টরাস' নামক এক গ্রামে পৌঁছলাম। রাতটা এখানেই কাটে। এ রাতে আমি পাহারা দেয়ার জন্যে জিদ্‌ ধরলাম। ইতিপূর্বে কাশ্মিরী মুজাহিদরা আমাদেরকে পাহারায় নিয়োগ করতনা। বলতো, তোমরা মেহমান, আর মেহমানের হেফাজত করা এবং তাদের আরামে রাখা আমাদের কর্তব্য। এবারও তারা সে কথাই তুল্লো। আমি বল্লাম, এখানে এসেছি দু'মাস হল। এখন আমি আর মেহমান নই। দ্বিতীয় কথা, আমি তো জিহাদ করতে এসেছি। তাই আপনাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব কষ্টের সমভাগী হতে চাই। কারও জন্য কোনরূপ বিশেষ আচরণ আমার পছন্দ নয়। যাক্‌ সেরাতে আমি কাশ্মিরী মুজাহিদ শওকত ভাইর সাথে পাহারা দেয়ার  সুযোগ পেলাম। তার সাথে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো আমার।
     জিহাদের পথে পাহারা দেয়ার সুসংবাদ সম্পর্কিত বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছেঃ “এক সকাল কিংবা এক সন্ধ্যা সীমান্ত পাহারা দেয়া দুনিয়া ও তদস্থিত সব কিছুর চেয়ে উত্তম-মূল্যবান”। এতে এক অপুলক আনন্দ রয়েছে নিশ্চই। সাইয়্যেদুল কাওনাইন মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমরা অধমদের জন্যে কতসব সৌভাগ্যের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। নিকষ রাতের নীরবতায় ঘুম তাড়িয়ে, শক্রর অপেক্ষা করে পাহারা দিয়েও রাতে এক নিদারুন আনন্দ পেলাম। দু'টো বাজে আমরা উভয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ি। চারটার দিকে অন্য সাথীদেরকে জাগিয়ে তুলি। জামাতের সাথে ফজর নামাজ আদায় করে আমরা নাস্তা করছিলাম। এ সময়ে বাইরে শোরগোল শুনা গেল। বাইরে গিয়ে দেখতে পেলাম, গ্রামের বহু মেয়ে পুরুষ আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে। জিজ্ঞেস করলে তারা বল্লো, “এখান থেকে জ্বলদি বেরিয়ে যান ... এক্ষুনি সংবাদ পৌঁছেছে যে, সৈন্যরা এ গ্রাম ঘেরাও করতে অগ্রসর হচ্ছে। এভাবে একাধিকবার আমি সাধারণ জনতার জিহাদী জযবা অবলোকন করেছি? ভাবতে আনন্দ লাগে, কাশ্মিরের প্রতি ইঞ্চি মাটি মুজাহিদদের নখ দর্পনে। দ্বিতীয়ত প্রতিটি কাশ্মিরী জনগণ আপন মুজাহিদ ভাইদের হেফাজত এবং তাদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরীর দায়িত্ব পালনে কত যত্বশীল। সৈন্যরা কয়েক মাইল দুরে থাকতেই জনসাধারণ মুজাহিদদের সে সংবাদ পৌঁছে দেয়। এক ব্যক্তি তার গ্রামের পাশ দিয়ে সৈন্যদের 'কুগর গ্যান্টারস' গ্রামের দিকে আসতে দেখে সে দৌড়ে আমাদের নিকট আসে। তাই সৈন্যরা আসার পূর্বেই আমরা তাদের সংবাদ, পেয়ে যাই। আমরা সবাই তখনই হাতে অস্ত্র তুলে নিলাম। গ্রামবাসিকে বল্লাম, সবাই নিজ নিজ ঘরে চলে যান। বাধা না দিয়ে সৈন্যদেরকে এদিকে আসতে দিন। আমরা বুঝতে পারছিলাম, আর্মিরা এখনো গ্রামে এসে পৌঁছেনি, না হয় পাহারারত মুজাহিদরা আমাদের সংবাদ দিত।
       সৈন্যদের সাথে লুকোচুরিঃ ক্ষনিক পরই পাহারারত এক মুজহিদ ভারতীয় সৈন্যদের আগমন সংবাদ সত্যায়ন করে। তাকে গ্রামের সব মুজাহিদকে একত্রিত করার দায়িত্ব দিয়ে আমরা গ্রাম থেকে বেরিয়ে গেলাম। ভারতীয় সৈন্যরা পজিশন নিয়ে আমাদের বের হওয়ার পথ আটকে রেখেছে। মুখোমুখি হতেই উভয় পক্ষ থেকে প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। শক্র পক্ষ প্রচুর সৈন্য সহ পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলো, আর গেরিলা যুদ্ধের নীতি হল, শক্রপক্ষ আক্রমনের প্রস্তুতি নিয়ে আসলে তার সাথে সরাসরি মুকাবিলায় অবতীর্ন না হওয়া। নিয়ম হল, তখন নিরবে লুকিয়ে থাকা এবং সুযোগমত শক্রপক্ষের অসতর্ক মুহুর্তে তাদের কুপোকাত করা। তাই আমরা সৈন্যদের বেষ্টনী থেকে বের হয়ে বাইরে নিরাপদ স্থানে কেটে পরার. সীদ্ধান্ত নিলাম; এদিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী তিন জন মুজাহিদ সৈন্যদের উপর বিরামহীন ভাবে ফায়ার করতে থাকে। ভারতীয় সৈন্যরা তাদের মুকাবিলায় ব্যস্ত হলে এই সুযোগে আমরা বেষ্টনী থেকে বের হতে থাকি। কিন্তু তারা আমাদেরকে. দেখেও পজিশন ছেড়ে আমাদের পথ রুদ্ধ করার সাহস করলনা। গোলা-বৃষ্টির মাঝে মুজাহিদরা বেষ্টনী ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। বেশ দূরত্বে এসে আমরা পিছন থেকে সৈন্যদের উপর ফায়ার শুরু করলাম। এসুযোগে কোরিং গ্রুপের ওই তিন মুজাহিদও বেষ্টনী ভেঙ্গে আমাদের সাথে যোগ দেয়।
     এবার সৈন্যদের সাথে লুকোচুরি শুরু হয়। সৈন্যরা আমাদের পিছু ধাওয়া করে আর আমরা লুকিয়ে তাদের উপর ফায়ার করতে থাকি! মুজাহিদরা ক্ষনিক এ ক্ষেত থেকে অন্য ক্ষেতে সৈন্যদের উপর গুলি চালায়, আর চলে যায় এই টিলা হতে ওই টিলায়। এ এলাকা ছিল আমাদের সাথীদের নখদর্পনে। সৈন্যরা খুব সতর্ক হয়ে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। আমরাও খুব চৌকস হয়ে তাদের উপর ফায়ার করতে করতে অগ্রসর হচ্ছিলাম৷ আমাদের ধাওয়া করার ব্যপারে সৈন্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে সম্ভবত। তাই খুব দৃঢ় পদে চার ঘন্টা যাবৎ সৈন্যরা আমাদের পিছু নেয়। এ সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন সৈন্য আমাদের গুলিতে নিহত হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর শোকর, আমাদের কোন সাথীর গায়ে একটু আচড়ও লাগেনি। তিনি আমাদেরকে তার আপন মদদের ছায়ায় আশ্রয় দেন। আমরা স্বল্প সংখ্যক হওয়া সত্বেও শেষ পর্যন্ত সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায়।
    জন্মুর পথেঃ ইসলামাবাদের মিশন শেষে আহসান ভাইসহ আমাদের এ কাফেলা জন্মুর 'আধম পুর' শহরের দিকে অগ্রসর হয়। জন্মুর মুজাহিদদের সুসংগঠিত করার কাজ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। তাদেরকে আরও বেগবান ও শক্তিশালী করার জন্যে ওখানকার মুজাহিদদের সাথে সাক্ষাত করা খুবই জরুরী। পথ অত্যন্ত দুর্গম । বহু জঙ্গল, বরফ ঢাকা দীর্ঘ পথ আর নদী পেরোতে হবে। উপরন্তু ইন্ডিয়ান চর ও হিন্দুদের খপপরে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। চলতে চলতে আমরা এক পাহাড়ী রাখালের বস্তীতে পৌছলাম। তারা আমাদের 'লিপ্টন চায়ের আমন্ত্রণ করে। আমরা তাদের দাওয়াত সানন্দে গ্রহণ করলাম। কাশ্মীরে লিপ্টন চা বলতে সাধারণ মিষ্টি চা বুঝায়। আরেকটা হল 'নুন চা'। চা পান করায় শরীর সতেজ হল। আবার দ্রুত পথ চলতে লাগলাম। একটু পর পথে এক প্রবল স্রোতস্বিনী নদী বাধ সাধলো। নদীর পানি হীম শীতল। আর তা এত খরস্রোতা যে পার হওয়া ভারী মুশকিল। কিনতু খোদার পথের অকুতোভয় মুজাহিদদের সামনে এ বাধা অতিতুচ্ছ বইকি। স্রোতের ধাক্কায় বিচ্ছিন্ন হয়ে ভেসে যাওয়ার ভয়ে সবাই একে অন্যের হাত ধরে নদীতে নেমে পড়লাম। পানি এতো ঠান্ডা যে তাতে নামতেই মনে হল, কে যেন হাটুপর্যস্ত পা কেটে দিয়েছে। আরো সামনে গিয়ে বুঝলাম, নদী খুব গভীর । পানি গলা পর্যন্ত ঠেকেছে। প্রচন্ড স্রোত আমাদের পা উপড়ে দিচ্ছিলো বারবার। তবুও অসীম সাহস নিয়ে কাফেলা সামনে এগিয়ে চল্লো। সবাই শক্ত হাতে একে অন্যকে ধরে রেখেছে। তবুও মনে হয় এখনই সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। আল্লাহ আল্লাহ করে কোনভাবে পার হলাম। ঠান্ডায় সকলের শরীর অবশ হয়ে গেছে। অপর পাড়ে গিয়ে অর্ধ বেহুশ অবস্থায় সবাই শুয়ে পড়ে। অনেক্ষন বিশ্রাম নেয়ার পর আমরা আবার অগ্রসর হতে থাকি।
      এদিকে আহসান ভাই বিশেষ কারণে জম্মুর প্রোগ্রাম পিছিয়ে দিলেন। আমরা কাশ্মীরের সর্বোচ্চ পাহাড় চূড়া 'কুল হিন্দের' পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। এর উচ্চতা প্রায় পনের হাজার ফিট।
      এবার আমাদের গন্তব্য 'বুডগাম শহর"। দুগর্ম, কঠিন পথ পেরিয়ে আমরা যখন গন্তব্যে পৌছি তখন রাত হয়ে গেছে। খানা খেয়ে তারাতাড়ি শুয়ে পড়ি। এরপর ভোরেই এক গোপন স্থানে পৌছলাম। সেখানে মুজাহিদদের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছিলো ।
      সামরিক উপদেষ্টা পরিষদঃ এতদিন আমরা অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম শুধু। নিজেদের অবস্থান আর দুশমনের ঘাটির খবর নেয়া, রাস্তাঘাট আর মৌসুমের হাল-হাকীকত জানা হচ্ছিল এতদিন। আলহামদুলিল্লাহ-এ ক'মাসে কাশ্মীরের প্রত্যন্ত অঞ্চল, প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব, মুজাহিদ এবং কমান্ডারদের সাথে পরিচয় পর্ব পূর্ণরূপে সম্পন্ন হয়।
       এই মিটিংয়ে বিশিষ্ট কমান্ডারগণ উপস্থিত হন। 'সামরিক উপদেষ্টা পরিষদ' গঠন সহ আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমাকে উক্ত পরিষদের নায়েবে- উপদেষ্টার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পাদনের যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু আমীরের প্রতি ভালবাসা ও তার আনুগত্যের সামনে নিজের মতামত ব্যক্ত করা থেকে বিরত রইলাম। এই পরিষদের ,দায়িত্ব হল গোটা কাশ্মীরের মুজাহিদদের সাথে মজবুত যোগাযোগ স্থাপন, তাদের আরো তৎপর করে তোলা, আক্রমণ রচনার সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের সমস্যা সমূহের সমাধান করা।
     আমি এই দায়িত্বের বোঝামুক্ত হওয়ার জন্যে হাজারো চেষ্টা করলাম। কারণ কাশ্মীরে আমার চেয়ে উন্নত প্রশিক্ষন প্রাপ্ত এবং সমর অভিজ্ঞ অসংখ্য মুজাহিদ রয়েছেন। তবে এরা বহির্দেশ থেকে আগত প্রতিটি মুজাহিদ কে নিজেদের চেয়ে বেশী সমর অভিজ্ঞ ভাবেন। অথচ আফগান জিহাদে দেড় বছর কাটানো ছাড়া আর কোন অভিজ্ঞতা আমার নেই। বড় কোন আক্রমনে অংশ নেয়ার সুযোগও আমার হয়নি। বাস্তবেই আমি অযোগ্য । পাথেয় শুধু আল্লাহর মদদ, আর শক্তি হলো .... জিহাদের আবেগ-আর শাহাদাতের তামান্না!
     আধুনিক বিশ্বের অভিজ্ঞ সমর কুশলীরা শুনে বিন্মিত হবেন যে, কাশ্মীর জিহাদে বিগ্রেডিয়ার আর মেজর জেনারেলদের মাঝে মাত্র বিশ বছর বয়সের তরুণরাও রয়েছে।
      পরদিনই আমি কাজ শুরু করেদিলাম। এখন অন্য কোথাও যাওয়ার বদলে 'বডগাম এলাকায়" ট্রেনীংয়ের কাজ শুরু করতে হবে। এখানে এ সব তরুণদের ট্রেনিং দেয়া হবে যাদের জন্যে সীমান্ত পেরিয়ে ট্রেনিং-এর জন্য আফগানিস্তানে যাওয়া দুস্কর। অত্যন্ত সতর্ক হয়ে পা রাখতে হবে। কারণ স্থানে স্থানে সৈন্যদের ক্যাম্প রয়েছে+ তাদের চোখ এড়িয়ে ট্রেনিং চালাতে হবে।
     তিনদিনের মধ্যেই পঞ্চাশজন তরুণ. একত্র হল। ট্রেনিং সেন্টারের জন্যে ঘন জঙ্গলের ভিতর এক প্রশস্থ মাঠ তৈরী করা হলো। সব সাজ-সরঞ্জামের ব্যবস্থা করার পর সবাই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে যায়। সব সাথী একত্রিত হওয়ার পর তাদের উদ্দেশ্যে প্রাথমিক কিছু আলোচনা করতে গিয়ে তাদেরকে এই ট্রেনীংয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত করালাম। কারো আবেগের কমতি নেই। সবাই বীরত্ব ও হিম্মতে প্রদীপ্ত। শহীদী তামান্নায় সবাই উদ্দীপ্ত। থাকার জন্যে একটা অস্থায়ী ঘর নির্মান করা হল। এ ঘরের খোঁজ পাওয়া সৈন্যদের জন্যে অত্যন্ত দুস্কর।

     ট্রেনীং, শুরু হল। খুব ভোরে উঠে ঠান্ডা পানিতে ওযু করা। এরপর জামাতের সাথে ফজর নামাজ আদায়ের পর 'দরসে কুরআন।' তার পরে ব্যায়ামের কসরত। এরপর শুরু হত সামরিক প্রশীক্ষণ। যোহর পর্যন্ত তা চলত! দিনের বেলা সম্মিলিত ভাবে বিভিন্ন ইসলামী কিতাবাদীও পাঠ করে শুনান হত।
     ট্রেনীংয়ের পরীক্ষাঃ পনের দিনেই ট্রেনীং সমাপ্ত করা হয়। বাহ্যত এতটুকু সময় খুবই অল্প। কিনতু ট্রেনীংয়ের ফলাফল সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম। তথাপি সম্মুখ সমরে ট্রেনীংপ্রাপ্ত তরুণদের পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এর জন্যে আমাদের বেশী দূর যেতে হলনা। সৌভাগ্যবশত এই জঙ্গলের অদুরেই একটা সড়ক রয়েছে যা সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছেছে। সীমান্তের সেনা ঘাটির রসদ এ রাস্তা দিয়ে আনা নেয়া হয়। আমরা ওই রসদ গাড়ীতে হামলার সীদ্ধান্ত নিলাম।
      আক্রমণের পূর্বে আমি একদল মুজাহিদ নিয়ে সড়ক পর্যবেক্ষণ করতে গেলাম। সড়কটা কাচা এবং সংকীর্ণ। ছোট ছোট পাহাড় ও টিলার মাঝ দিয়ে তা একে বেঁকে এগিয়ে জঙ্গলে পড়েছে। জঙ্গলের পর বহুদূর পর্যস্ত সমতলভুমি। -সমতলভূমি পেরুলেই সীমান্ত রেখা। আক্রমনের জন্যে আমরা আমাদের সুবিধামত একটা স্থান নির্বাচন করলাম। পর্যবেক্ষন শেষে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। রাতে পুনরায় পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে চলে গেলাম। সড়কের এক জায়গায় গর্ত খুদে তাতে নিজেদের তৈরী মাইন ফিট করলাম। এরপর মাইনের সাথে তার জয়েন্ট করে তারের দ্বিতীয় মাথা নিয়ে রাখলাম জঙ্গলের দু’শ মিটার ভেতরে। এটা একশনের প্রথম পর্ব। কোন গাড়ী মাইন অতিক্রম করার সময় তারে বেটারী সংযোগ করে বিস্ফোরণ ঘটানো হবে মাত্র। মাইন পুতে রাস্তা পূর্বের ন্যয় সমান করে দেয়া হল। এখানে কোন বিপদ আছে তা সন্দেহ করার কোন নিশানা রাখা হলো না। এরূপ ভাববারও কোন অবকাশ ছিলো না।
      আমাদের হিসাব মত পর দিনই রসদ যাওয়ার  কথা। তাই রাতেই সব প্রস্তুতি সমাপ্ত" হল। মুজাহিদদেরকে কয়েক গ্রুপে ভাগ করা হলঃ (১) একশন পার্টি-যারা শত্রুর উপর সরাসরি আক্রমণ করবে। (২) কোরিং পার্টি-এদের দায়িত্ব হল একশন পার্টিকে সহজে পিছু হটার পথ করে দেয়া। (৩) সিগন্যাল পার্টি। এদের কাজ শত্রুর গতিবিধি ও আগমনের সংবাদ দেয়া। বাকী দুই গ্রুপের নাম হলো- রোড ব্লক গ্রুপ। এদের কাজ একশন পয়েন্ট (হামলা কেন্দ্র)-এর দুদিকে সর্তক দৃষ্টি রাখা। মুজাহিদদের হাতে আক্রান্ত শত্রুকে কোনরূপ সাহায্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত রাখা। “রোড ব্লক গ্রুপ' একশন পয়েন্টের দু'দিকে এক কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান নেয়।
       ভোরে ফজরের নামাযের পর সবাই অনুনয়-বিনয় করে আল্লাহ পাকের নিকট মদদ ও নুসরত কামনা করলাম। এর পর আমি একশন গ্রুপের ২৬ জন মুজাহিদ নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌছলাম। অন্যান্য গ্রুপও স্ব স্ব স্থানে পৌঁছে গেল। সিগন্যাল পার্টি এমন সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল যে, তারা এবং একশন পার্টি উভয়ে পরস্পরকে স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলো। আমরা  অধীর হয়ে সিগন্যাল পার্টির দিকে তাকিয়ে রইলাম। বেশীক্ষন অপেক্ষার প্রহর গুনতে হলনা । সিগন্যাল পার্টি রসদ গাড়ী আসার সংকেত দিল।  সর্তক হলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই গাড়ীর বহর দৃষ্টি গোচর হল। গাড়ির বহর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। রসদ বহরের প্রথম গাড়ীটা আস্তে মাইনের উপর উঠে এসেছে। এক-দুই-তিন-তার বেটারীর সংযোগ-অমনি প্রচন্ড বিস্ফোরণ। গাড়ীটা সৈন্য সহ শুন্যে উঠে গেলো। মহা বিপদ দেখে পিছনের গাড়ীগুলো থেমে যায়। তাদের সম্বিৎ পাওয়ার পূর্বেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ জন মুজাহিদের ২৬ টা ক্লাশিন কভ একসাথে গর্জে উঠল। তবে'কয়েক সেকেন্ড পর আমরা ফায়ার বন্ধ করে দিলাম। যাতে সৈন্যরা মনে করে, মুজাহিদরা পালিয়ে গেছে। ফায়ারিং বন্ধ হতেই সৈনারা গাড়ী থেকে রেরিয়ে আড়াল নেয়ার জন্যে দৌড় দেয়। আমরা তাদের এ ভুল পদক্ষেপেরই অপেক্ষায় ছিলাম। মুজাহিদদের ক্লাশিনকভ গুলো আবার গর্জে উঠল। সাথে সাথে কিছু সৈন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আনুমানিক আড়াই মিনিট পর আমরা ফায়ার বন্ধ করলাম, তারা এর পর কি পদক্ষেপ নেয় তা দেখার জন্যে। তারা কোন প্রতিরোধই করল না। বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা একে অন্যকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়া শুরু করে। আহতরা 'হায় রাম .... হায় মাতা বলে চীৎকার জুড়ে দেয়। তাদের মত এরূপ আর্তচীৎকার বর্তমান কাশ্মীরের নিত্য দিনের দৃশ্য। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভিরু সেনাদল হল হিন্দুরা। একথা সত্য যে, যারা ভিরু তারা কুটিলমনা হয়ে থাকে। নিরন্তর জনতার উপর হামলার সময় এরা নেকড়ের চেয়েও হিংস্র হতে পারে।
      প্রোগ্রাম ছিল তিন মিনিটের ভিতর এ্যাকশন শেষ করে পিছনে সরে আসা। তিন মিনিট শেষ হতেই কোরিং গ্রুপ ফায়ার শুরু করে; আমরা পিছু হটে আসি। আমরা পিছু না হটে আক্রমণ অব্যাহত রাখলে সব কটি সৈন্য নিহত হত, এ ছাড়া আমাদের হাতে প্রচুর গনীমতও আসত। কিন্তু-এ সব করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা অপারেশন শেষ করে নির্দিষ্ট এক স্থানে পৌঁছে গেলাম।
      'আমাদের পৌঁছার পর পরই বাকী সব গ্রুপও পৌঁছে গেল। আল্লাহর রহমতে আমাদের একটি সাথীও আহত হয়নি। ........ আমি নিশ্চিত হলাম, এ তরুণ মুজাহিদরা যে কোন যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে ঝাপিয়ে পড়তে পারবে -সে সাহস এদের আছে।
      আমার ধারনা ছিল, এই এ্যাকশনের পর এ এলাকায় সৈন্যদের ধরপাকড় বৃদ্ধি পাবে। তাই পূর্বেই এ স্থান ত্যাগ করার সীদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো ।ঐ দিনই আমাদের অস্থায়ী ট্রেনীং সেন্টার এর অস্তিত্ব মিটিয়ে দেয়া হল।
       বডগামের ট্রেনীং সমাপ্ত হওয়ার পর আমার পরবর্তী মনযিল ছিল ইসলামাবাদ। ভবিষ্যতে মুজাহিদদেরকে একশন প্ল্যান দেয়ার দায়িত্বও আমার। স্থানে স্থানে মুজাহিদদের সাথে সাক্ষাৎ করা এবং বিভিন্ন স্থানে তাদের প্ল্যান দেয়ার জন্যে আবার ঝটিকা সফর শুরু হল। কিন্তু সবখানেই ' আমি এই বেদনা ভরা কষ্ঠ শুনতে পেলামঃ
      “আমাদের অভাবটা জন সংখ্যার নয় বরং অস্ত্রের অভাব।” পরিস্থিতি এমন যে, অনেক মুজাহিদের' নিকট ক্লাশিনকভও নেই । কারো ক্লাশিনকভ আছে কিন্তু গুলি নেই। কারুর মুখে একথা শুনা যায় নি, “আমরা ক্ষুধার্ত, আমরা বস্ত্রহীন।” অথচ থাকা খাওয়ার সমস্যাও তাদের প্রকট কিন্তু সেদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ কম। তাদের সমস্যা একটিই-ক্লাশিনকভ ...... আর গুলি। আমি তাদের সান্তনা দিয়ে বল্লাম, 'বন্ধুরা! আল্লাহর উপর ভরসা দৃঢ় কর। ... তারই আশ্রয়ে এই জিহাদের সূচনা ও অগ্রযাত্রা এবং সফলতা। আমাদের সমস্যার সমাধান করবেন তিনিই। সৈন্যদের থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ওই অস্ত্র দিয়ে তাদেরকেই আবার কুপকাত করতে হবে। আল্লাহর রহমতে এ পদক্ষেপ ও পরামর্শ খুবই সফল হয়। 
(ক্রমশ| অনুবাদঃ আসাদ মাহমুদ