সত্যের সন্ধানে
ইসাবেলা
মূলঃ মাওলানা আব্দুশ শরর লখনবী
অনুবাদঃ মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক
========================================================================
একটি মনােরম উদ্যান
স্পেনের কর্ডোভা নগরীর সুবিখ্যাত উদ্যানটি ছিল আপন শ্যামলিমায় নয়নাভিরাম ও রূপ-মাধুর্যে তুলনাহীন। সকাল-সন্ধ্যায় ভ্রমণবিলাসীদের ভীড় এখানে লেগেই থাকত। এই উদ্যানের এক পার্শ্বে উপবিষ্ট দু’টি মুসলিম যুবক ধর্মীয় আলােচনায় লিপ্ত। মহাক্লান্ত দিনমনী আপন সফরের সামান গুটিয়ে ম্লানমুখে সন্ধ্যার আঁচলে গা’ঢাকতে চলেছে। পাখীদের কলকাকলী প্রাকৃতিক সুর ঝঙ্কারে ক্লান্ত-পথিকদের অন্তরে এক স্নিগ্ধ শান্তিধারা প্রবাহিত করছে। ঠিক এমনি এক গােধুলি লগ্নে স্পেনের 'ইসাবেলা' নামে পরিচিতা জনৈকা খৃস্টান নন্দিনী তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহচরী সহ উদ্যানের এক মনােমুগ্ধকর স্থানে উপবেশন পূর্বক তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভােগ করছিল। ইসাবেলা তৎকালীন প্রধান খৃস্টান ধর্মযাজক বা পত্নীর অষ্টাদশ বর্ষিয়া কন্যা। স্রষ্টাপ্রদত্ত অসাধারণ রূপ ও অঙ্গ সৌষ্ঠবে সে যেন বেহেশতী হুর। মনে হয় কোন সুবিখ্যাত আমীর অথবা অত্যধিক জনপ্রিয় নেতার হৃদয়ের চাওয়া পাওয়া পূরণার্থে তার জন্ম হয়েছে। কিন্তু ইসাবেলার পিতা তাকে কুমারী মরিয়মের পবিত্র রূহের প্রতিমা স্বরূপ দুনিয়ায় রাখতে ইচ্ছুক। তাই কোন পুরুষের সাথে কন্যার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে তিনি রাজি নন। পাদ্রী সাহেব তার আন্তরিক বাসনা পূরণার্থে প্রিয় কন্যা সৌন্দর্যের রাণী ইসাবেলাকে শুরু থেকেই ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছেন। কাজেই ইসাবেলা ধর্মীয় আলােচনায় বিশেষ উৎসাহের সাথে অংশ গ্রহণে আগ্রহী। সে সময় ধর্মীয় শিক্ষা ও আলােচনাই ছিল শিক্ষা ও সভ্যতার প্রধান মাপকাঠি।
উদ্যানের এক কোনে গােলাপ পুষ্পের কেয়ারী সমূহের মাঝে উপবিষ্ট মুসলিম যুবকদ্বয়ের বাহ্যিক আকৃতি ও বেশভূষায় মনে হচ্ছে তারাও কোন ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত। একটি ধর্মীয় প্রশ্ন নিয়ে তারা আলােচনা করছিলাে। যুবকদ্বয়ের একজনের নাম ওমর লাহমী। অপর জনের আম মাআ’য।
মাআ’যের প্রশ্ন : খৃস্টীয় মতবাদে তাদের খােদা যীশুর প্রেরীত রসূল পলের লিখিত এক পত্রে তিনি লিখেছেন, “শরীয়ত একটি অভিশাপ। আর যীশু আগমন করে এই অভিশাপ থেকে খস্টীয়গণকে মুক্ত করেছেন।” পলের এই বাক্যটির তাৎপর্য কি?
ওমর শাহমীঃ (উচ্চহাস্যে) এ কথার তাৎপর্য আপনি আমার নিকট বুঝতে চান? অথচ স্বয়ং পাদ্রী সাহেবগণই এ কথা ....।”
অদূরে উপবিষ্ট ইসাবেলা চমকে উঠল এবং তার এক উচ্চশিক্ষিতা সহচরীকে বললো, দেখ, এই মুসলমানেরা আমাদের ধর্মের সমালােচনা করছে। একটু নিরব থেকে শুন তারা কি বলে।
সহচরীঃ এই মুসলমানেরা এদেশে আসা অবধি আমাদের ধর্মের জন্য একটি বিপদরূপে দেখা দিয়েছে।
ইসাবেলাঃ তুমিতাে নিজের কথাই আরম্ভ করে দিলে। একটু নিরব থেকে এদের কথা শুন। দেখ, এরা কি বলে।
মা’আযঃ এটা আপনি কি বললেন? স্বয়ং পাদ্রীগণও এ কথা বুঝতে অক্ষম। তবে কি তারা না বুঝেই খৃস্ট ধর্মের অনুসরণ করছে? ওমর লাহমীঃ জী হ্যা। কোন একজন বড় পাদ্রীকে এই প্রশ্নটি করে দেখুন, তবেই বুঝতে পারবেন, সে কি উত্তর দেয়। যা হােক এটাতাে পরের কথা; এখন বলুন, পলের এই বাক্যে আপনার কি অভিযােগ?
মাআ'যঃ আমার কোন অভিযােগ নেই, আমি শুধু তার এই কথার তাৎপর্য বুঝতে চাই। আর যেহেতু আপনার খৃস্টানগণের সাথে আলাপ- আলােচনার সুযােগ হয় এবং তাদের পুস্তকাদিও আপনি যথেষ্ট পাঠ করেছেন, তাই কথাটি পরিষ্কারভাবে বুঝবার জন্য আমি আপনার নিকট জিজ্ঞেস করলাম। আমি জানতে চাচ্ছি, যখন শরীয়ত একটি অভিশাপ, আর হযরত ঈসা (আঃ) এই অভিশাপ থেকে খৃস্টীয়দের মুক্তি দেয়ার জন্যই আগমন করেছিলেন; তবে তাে চুরি, ব্যাভিচার ও পিতামাতার অবাধ্যতা ইত্যাদি অবৈধ হওয়ার করা নয়। অথচ কোন খৃস্টানই এ সব অপকর্মকে বৈধ বলে না।
ওমর লাহমীঃ শরীয়াত অভিশাপ হওয়ার সাথে চুরি এবং ব্যাভিচারের সম্পর্ক কি? আপনার কথার উদ্দেশ্য আমি বুঝতে পারলাম না।
মাআ'যঃ আমার বলার উদ্দেশ্য হলাে, হযরত মুসা (আঃ)-এর উপর অবতীর্ণ তাওরাত হলাে একটি শরীয়ত বা উম্মতের জন্য পার্থিব জীবন-যাপনের বিধান। এই গ্রন্থে নির্দেশ আছে, চুরি করাে না, ব্যভিচার করে না, প্রতিবেশীকে দুঃখ দিও না, নর হত্যা করাে না, পিতামাতার অবাধ্যচারণ করাে না ইত্যাদি। এখন কথা এই যে, মূলতঃ শরীয়তই যদি অভিশাপ হয় তবে শরীয়তের উপর তারাও চলছে, যা পলের বাক্যানুযায়ী জাজ্বল্যমান অভিশাপ। ফল কথা, যে সকল খৃস্টান চুরি, ব্যাভিচার ইত্যাদি অপকর্ম থেকে নিজেকে বিরত রাখছে তারা সকলেই অভিশপ্ত, কেননা শরীয়াত অভিশাপ হওয়া সত্ত্বেও তারা তার অনুসরণ করছে।
ওমর লাহমীঃ ছুবহানাল্লাহ! আপনি এমন এক প্রশ্ন আমার নিকট করছেন যা আমি নিজেই খৃস্টানদের নিকট উত্থাপন করে থাকি।
মাআ'যঃ তা হলে খৃষ্টানদের তরফ থেকে আপনি এই প্রশ্নের কি উত্তর পেয়েছেন?
ওমর লাহমীঃ আমি বহুবার এই প্রশ্ন পাদ্রীদের নিকট করেছি, কিন্তু তারা এর কি উত্তর দিবে? কিছুক্ষণ আবােল তাবােল বকে সকলে তাড়াতাড়ি সরে পড়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এমন সময় দূর থেকে মাগরিবের আযানের মধুর সুরলহরী ভেসে আসে? যুবকদ্বয় নিকটস্থ এক হাউয়ে ওযু করে নামাযে দাঁড়িয়ে গেলাে। ইসাবেলা এই আকর্ষণীয় আলােচনাটি একান্ত একাগ্রতার সাথে শুনছিল। আর যেহেতু যীশুর এলাহিয়্যাত অর্থাৎ খােদায়িত্বের বিষয়ে গবেষণা করার কিছু সুযােগ তার ঘটেছে তাই যুবকদ্বয়ের অভিযােগের গুরুত্ব সে গভীরভাবে উপলব্ধি করছে। সে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন, যেন মুসলিম যুবকদ্বয়কে তাদের অভিযােগের যথােপযুক্ত উত্তর দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু সে তার চিন্তা- ভাবনার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেও কোনই উত্তর খুঁজে পেল না। অতঃপর এই চিন্তানিমগ্নাবস্থায়ই সে সহচরীগণ সহ এই বলে উঠে দাঁড়াল যে, এই অভিযােগের উত্তর পিতাজীর নিকট থেকে অবশ্যই জানতে হবে!
ইসাবেলা আপন সহচরীগণকে এক চৌরাস্তায় ছেড়ে কর্ডোভা নগরীর পূর্বপ্রান্তের তােরণটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করল।
একটি জিজ্ঞাসা
পরমা সুন্দরী যুবতী ইসাবেলা কর্ডোভা নগরীর পূর্বদ্বারাভ্যন্তরে প্রবেশ মাত্রই সােজা কছরে শুহাদা নামক বিরাট রাজপ্রাসাদ মুখী সড়কটির ওপর পা রাখল। সে যুগের ইসলামী সরকার সমগ্র স্পেনকে সাজসজ্জায় ও বিলাস ব্যবস্থায় এক নব বধুর রূপ দান করেছিলেন। নগরীর রাজপথগুলােকে সুপ্রশস্ত ও সুসজ্জিত করা হয়েছিল। সন্ধ্যার প্রারম্ভেই সুদর্শন ঝুলন্ত বেলােয়াড়ি ঝাড়ফানুস হতে এমন উজ্জ্বল আলােকচ্ছটা বের হত যে, (ঐতিহাসিক ডাঃ ডায়ারের বর্ণনা মতে) ঐ আলাের সাহায্যে পথচারিরা বিশ মাইল পর্যন্ত অনায়াসে ভ্রমণ করতে পারত। কছরে শুহাদার মসৃণ সরল রাজপথে বেলােয়াড়ী ঝাড়ফানুসের আলােকে ইসাবেলা চিন্তিত ও অবনত মস্তকে তার বাসভবনের দিকে চলছে। আজ তার চালচলনে অসাধারণ গাম্ভীর্য পরিস্ফুটিত। তার অভ্যাস ছিল প্রত্যহ সান্ধ্য ভ্রমণের পর ঘরে ফিরবার পথে সে তার দু একজন সহচরীর সাথে অবশ্যই সাক্ষাৎ করত। কিন্তু আজ সে এক গভীর চিন্তায় বিভাের। আধা ঘন্টা পথ চলার পর সে তার প্রাসাদ-সম বাসভবনে পৌঁছল। পরিচারিকা ইসাবেলার অপেক্ষায় ছিল।
সে তাকে দর্শনমাত্রই অবনত মস্তকে সালাম করল। অতঃপর আজ অপেক্ষাকৃত বিলম্বে ঘরে পৌঁছার কারণ জিজ্ঞেস করলে ইসাবেলা একটি মামুলি উত্তরদানে তাকে বিদায় করল। অতঃপর আপন প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে সোফায় বসে একখানা ধর্মীয় পুস্তকে মনোনিবেশ করল। পরিচারিকা টেবিলে খাবার পরিবেশন করে ইসাবেলাকে খাদ্য গ্রহণে আহ্বান করে। কিন্তু সে তার চিন্তায় এতই বিভাের যে, পরিচারিকার কোন কথায়ই ভ্রুক্ষেপ না করে পুস্তকেই নিমগ্ন থাকে। যে পুস্তকে সে গবেষণায় রত ছিল তা ছিল বাইবেল। তাতে সে পলের লিখিত সেই পত্র খানা গভীর মননিবেশে পাঠ করছিল-যাতে শরীয়তকে অভিশাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সে পুনঃ পুনঃ পত্রখানা পাঠ করছিল, কিন্তু তার তাৎপর্য বুঝতে মােটেই সক্ষম হচ্ছিলাে না। যতই সে তা নিয়ে গবেষণা করছিল ততই সে অভিযােগটি তার হৃদয়ে মযবুত হয়ে শিকড় গাড়ছিল, যা সে উদ্যানের এককোণে উপবিষ্ট মুসলমান যুবক দুটির আলােচনার মধ্যে শ্রবণ করেছিল। অবশেষে তার মস্তিষ্ক যখন আর চিন্তা করতে অক্ষমতা প্রকাশ করে অথচ পলের পত্রসমস্যার কোনই সমাধান খুঁজে পেল না, তখন সে এই কথা বলে বাইবেল রেখে দিল যে, পিতাজী ব্যতীত এই হেয়ালীর সমাধান অসম্ভব। তিনি অনায়াসেই এর সমাধান দিতে পারবেন।
ইসাবেলা মনে মনে বলতে লাগল, এত চিন্তার কি প্রয়ােজন? এটা কি এমনই প্রশ্ন, যার কোন সমাধান নেই? আমি এটা বুঝতে পারিনি বলে আমার দৃষ্টিতে এটা একটি বিরাট প্রশ্ন, কিন্তু পিতাজীর নিকট এটা কোন প্রশ্নই নয়। কেননা আজ সমগ্র স্পেনে ইলমে এলাহিয়্যাতে (যীশুর খােদায়িত্বের দর্শনে) তার চেয়ে বড় জ্ঞানী আর কেউ নেই। এই ভেবে সে খাওয়ার টেবিলে খেতে বসল। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে পুনরায় বাইবেল পাঠে মনোনিবেশ করল। কিছুক্ষণ পর বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমিয়ে গেলাে।
পরদিন রােববার প্রত্যুষে ঘুম থেকে উঠেই সে গির্জায় যাত্রা করল। গির্জার অনুষ্ঠানাদি সমাপনান্তে গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর স্পেনের সর্ববৃহৎ গির্জার প্রধান পাদ্রী ইসাবেলার পিতাজী প্রিয় কন্যাকে নিকটে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ - বেটি! আজ তুমি এলাহিয়্যাত কলেজে বাইবেলের কোন্ পাঠ অধ্যয়ন করেছ? যেহেতু আজকাল তুমি বাইবেলের সুক্ষ্মভেদ বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করছ, কাজেই এ সম্বন্ধীয় যে বাক্য তােমার বােধগম্য হবে না তা আমার নিকট জিজ্ঞাসা করে বুঝে নিবে।
ইসাবেলাঃ (পিতার হস্ত চুম্বন করে) পিতা! আজ আমি বাইবেল ইউহান্না ৩য় অধ্যায় ২১ নং পদ অধ্যয়ন করেছি, যদি অনুমতি হয় তবে একটি প্রশ্ন করতে চাই, কেননা এখনও আমি তা বুঝিতে সক্ষম হইনি।
পাদ্রীঃ বিনাদ্বিধায় প্রশ্ন কর বেটি! এখনই আমি তােমাকে তা বুঝিয়ে দিচ্ছি।
ইসাবেলাঃ প্রশ্নটি হলাে, ওল্ড টেষ্টামেন্টে হযরত মুসার মাধ্যমে যে বারটি নির্দেশ প্রেরিত হয়েছে তা শরীয়ত সম্পকিত নয় কি?
পাদ্রীঃ হ্যা, এর সম্পূর্ণই শরীয়ত সম্পর্কিত।
ইসাবেলাঃ খােদাওন্দ প্রেরিত পল তাঁর এক পত্রে লিখেছেন, শরীয়ত একটি অভিশাপ।
পাদ্রীঃ অবশ্যই শরীয়ত একটি অভিশাপ। আর এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই তাে যীশু দুনিয়ায় আগমন করেছেন এবং আমাদের শরীয়তের উৎপীড়ন হতে মুক্তি দিয়ে গিয়েছেন।
ইসাবেলাঃ বেশ, বুঝতে পারলাম যে, শরীয়ত একটি অভিশাপ, এমন অভিশাপ যা হতে মুক্তি দেওয়ার জন্য আমাদের খােদাওন্দকে ক্রুশ বিদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করতে হয়েছে; সুতরাং এ কথার অর্থ হলাে শরীয়তের অনুসরণ করাও অভিশাপ।
পাদ্রীঃ সম্পূর্ণ অভিশাপ। এখন শরীয়তের স্থলে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর উপর ঈমান স্থাপনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের মুক্তি। কেননা শরীয়তের প্রয়ােজন ঐ সময় পর্যন্তই ছিল, যতক্ষণ আমাদের খােদাও ক্রুশবিদ্ধ হন নি।
ইসাবেলাঃ তবে কি আমাদের জন্য চুরি করাও বৈধ?
পাদ্রীঃ এই প্রশ্নের সাথে চুরির কি সম্পর্ক? দেখ বেটী! একটু চিন্তা ভাবনা করে প্রশ্ন করাে। অপর কেউ যদি শুনতে পায় তবে তােমাকে বােকা সাব্যস্ত করবে।
ইসাবেলাঃ ক্ষমা করুন, সম্ভবত আমি আমার উদ্দেশ্য পূর্ণরূপে ব্যক্ত করতে পারিনি। আমার উদ্দেশ্য হলাে, ঐসব নির্দেশ যাকে আপনি এইমাত্র শরীয়তের গন্ডিভুক্ত করলেন তার একটি হল, চুরি করাে না, দ্বিতীয়টি হল প্রতিবেশীকে দুঃখ দিও না, তৃতীয়টি হল পিতামাতার সাথে অবাধ্যচারণ করাে না-এইসব নির্দেশ শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত এবং শরীয়ত খােদাওন্দ প্রেরিত পলের বর্ণনা মতে অভিশাপ। সুতরাং ঐ নির্দেশাবলির অনুসরণ করা অর্থাৎ চুরি না করা, ব্যভিচার করা ইত্যাদিও অভিশাপরূপে গণ্য হল। আর এর পরিস্কার অর্থ দাঁড়ায় যে, চুরি না করা, পিতামাতাকে দুঃখ না দেওয়াও অভিশাপ।
পাদ্রীঃ বেটি, তুমি কি আমার সাথে বিতর্ক আরম্ভ করেছাে? এখনও তুমি শরীয়তের শ্রেণী বিভাগ বুঝিতে সক্ষম হওনি। কিন্তু সে যাই হােক, প্রথমে বলতাে এই ঘৃণিত অভিযােগটি তুমি কার নিকট শুনেছাে? কোন শয়তান তােমার অন্তরে এমন জঘন্য খেয়াল ঢুকিয়েছে?
ইসাবেলা পিতার এই রূপ প্রশ্নে উদ্যানাভ্যন্তরে ওমর লাহমী ও মাআ'যের মধ্যে অনুষ্ঠিত কথােপকথনের সম্পূর্ণ ঘটনা তার পিতাকে বলে।
পাদ্রীঃ বেটি, তুমি জান যে, এই হতভাগা মুসলমানরা সাংঘাতিক কাফের এবং আমাদের পবিত্র ধর্মের চিরশত্রু। মনে রাখবে, শয়তানী খেয়াল সমূহের অপক্রিয়াই পবিত্র ধর্মগ্রন্থাবলির উপর অভিযােগে উৎসাহ যােগায়। বেটি, এখনই তওবা কর, আর ভবিষ্যতে মুসলমানদের কোন কথায় কর্ণপাত করবে না। তারা নিজেরাই ধর্মদ্রোহী এবং বিধর্মী, সত্য ধর্মের বদনাম করাই ওদের ধর্ম। বেটি ইসাবেলা! তুমি কি তাদের সম্বন্ধে কিছু জাননা? ওদের ধর্মে মানুষের রক্তপাত ঘটান সম্মান ও ছওয়াবের কাজ। দেখ, আমাদের দেশ স্পেনে তারা জিহাদের নামে কতশত নিস্পাপ মানুষকে হত্যা করেছে। আর এখন জানতে পারলাম, মুসলমানদের নিকট হতে তুমি এই অভিযােগ শুনেছাে। যদি স্বয়ং তােমার অন্তর হতে এই অভিযােগের উৎপত্তি হত তবে আমি অবশ্যই তা খন্ডন করতাম। কিন্তু ঐ কাফেরদের কত কথার উত্তর দেওয়া সম্ভব?
পিতার কথায় ইসাবেলার খুব অনুশােচনা হল। সে মনে মনে বলতে থাকে, আমি অনর্থক মুসলমানদের কথা উল্লেখ করলাম; যদি এমন না করতাম তবে আজ পিতাজির নিকট থেকে এ গুরুতর সমস্যার সমাধান নিশ্চয়ই পেয়ে যেতাম। যা হােক কোন চিন্তা নেই। আমি এ ব্যাপারে আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মহােদয়ের নিকট থেকে এর জবাব জেনে নিতে পারব। কলেজে অধ্যাপনার সময় যেমন আমি আমার অবােধগম্য প্রশ্নাদি পেশ করে তার নিকট থেকে বুঝে নেই, তেমনি এই বিদ্ঘুটে প্রশ্নটিও তার সম্মুখে উত্থাপন করলে সরল সমাধান পাব।
পরদিনই ইসাবেলা উক্ত অভিযােগটি তার অধ্যাপকের নিকট উত্থাপন করল, কিন্তু তিনিও এর কোন যুক্তিযুক্ত সমাধান দিয়ে তাকে তুষ্ট করতে পারলেন না। এ যাবত বেচারী ইসাবেলা ধারণা করছিল, তার জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য সমস্যাটি তার নিকট জটিল রূপে দেখা দিয়েছে, নতুবা ধর্মীয় নেতৃবর্গের পক্ষে এর সমাধান দেয়া সহজ বটে। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারল যে, এ প্রশ্নটি নিশ্চয়ই কোন সাধারণ প্রশ্ন নয়। অতএব তার হৃদয়ে একটি সন্দেহের বীজ অঙ্কুরিত হল এবং ক্রমশই তা শক্তিশালী হতে লাগল। (চলবে)
═──────────────═