|| আরব্য রজনীর নতুন অধ্যায় ||
|| নির্বাসনের চিরকুট ||
( ধবংস ও হিজরত )
৯/১১ এর পরপরই উসামা বিন লাদেন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে তার বার্তা প্রচার করতে শুরু করে, একইসাথে বন্দিত্ব থেকে বাঁচতে এক গোপন স্থান থেকে আরেক গোপন স্থানে অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকেন। ৭ই অক্টোবর ২০০১ এ অ্যামেরকার আফগানিস্তান আক্রমনের আগে থেকেই আল-কায়েদার এই পর্বের কৌশলের বাস্তবায়ন শুরু করে। এই সময় পাকিস্তানে থাকা বিন লাদেনের প্রতিনিধি দলগুলো নিজেদের আগের নেটওয়ার্কগুলো ব্যবহার করে নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে থাকে। আল-কায়েদার মুজাহিদদের পরিবারের সদস্যদের স্থানান্তরের জন্য তারা পাকিস্তানে বিভিন্ন বাড়ি ভাড়া করে।
আবু যুবায়দা নামের একজন ফিলিস্তিনিকে ১লক্ষ ডলারসহ লাহোরে পাঠানো হয় লস্কর-এ-তাইয়্যেবার(LeT) প্রধান, হাফিয মুহাম্মাদ সাঈদের সাথে দেখা করার জন্য। যাতে করে মহিলা ও শিশুদের জন্য বৈধ পাসপোর্ট ও তাদের অন্তর্বতীকালীন অবস্থানের জন্য ব্যাবস্থা করা হয়। সাঈদকে এই স্পর্শকাতর কাজের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল কারণ সে ছিল উসামা বিন লাদেন এবং আল-কায়েদা নেতৃত্বের পুরোনো আস্থাভাজন।
১৯৮৮ তে বিন লাদেনের অন্যতম ডেপুটি, সৌদী নাগরিক আবু আব্দুর রহমান সারিহী আফগানিস্তানের কুনাড় উপত্যকায় একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পাকিস্তানের বাজাউর এজেন্সি (একটি প্রাদেশিকভাবে শাসিত গোত্রীয় অঞ্চল) থেকে লোক রিক্রুট করা। সারিহী ছিল জাকিউর রহমান লাখভীর বেয়াই, যিনি এখন লস্কর-এ-তইয়্যেবার (LeT) কমান্ডার-ইন-চীফ এবং ২৬ নভেম্বর, ২০০৮ এ মুম্বাই হামলার প্রধান সন্দেহভাজন (আমেরিকার ট্রেজারী এবং সিকিউরিটি কাউন্সিল তাকে LeT র অপারেশনের প্রধান বলে দাবী করে)।
ট্রেইনিং ক্যাম্পের জন্য টাকা দিয়েছিল বিল লাদেন এবং সংস্থাটি কুনাড় উপত্যকা ও বাজাউর এজেন্সিতে বেশ প্রসার লাভ করেছিল। এর জন্য শত শত সালাফী ঘরানার পাকিস্তানী যুবক তাদের আফগান ভাইদের সাথে মিলিত হয়ে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে সংগঠনটিতে যোগ দেয়। সংক্ষেপে ১৯৮৯ সালেই বিন লাদেন তার বৈশ্বিক প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য ভাষা ও সুর নির্ধারণ করেছিল।
১৯৯০ এ ইরাক কুয়েতে আক্রমণ চালায়। বিন লাদেন সৌদি আরবকে প্রস্তাব দেয়, অ্যামেরিকার কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার পরিবর্তে তার অধীনস্ত স্বেচ্ছাসেবীদের কাজে লাগানোর জন্য। এসময় বিন লাদেন তার নিয়ন্ত্রণে থাকা যোদ্ধাদের সংখ্যা ও সামর্থ্যের বিবরণ সৌদিদের পাঠায়। এ বিবরণীতে কুনাড় উপত্যকায় সারিহীর সেট-আপ অন্তর্ভূক্ত ছিল। সে দিনগুলোতে কুনাড় উপত্যকায় লস্কর-এ-তইয়্যেবা জন্ম হয়েছিল, সারিহীর সেট-আপের একটি শাখা হিসাবে, যার ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপিত হয়েছিল বিন লাদেনের হাতে। এর কিছুদিন পরই আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটে এবং তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের আগেই কুয়েতে ও সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষকতায় এ উপত্যকায় সালাফী ভাবাদর্শে বিশ্বাসী একটি ইসলামিক ইমারত গঠন করা হয়েছিল।
অক্টোবর ৭, ২০০১ এ আমেরিকা ও তার মিত্ররা আফগানিস্তান আক্রমণ করে। টানা দুই মাসব্যাপী এক-পাক্ষিক যুদ্ধ চলে, এসময় আল-কায়েদা এবং তালেবানের সম্পূর্ণ নেতৃত্বই পিছু হটে পাকিস্তানে চলে আসে। তবে অ্যামেরিকার আশা অনুযায়ী তা যুদ্ধের সমাপ্তি ছিল না বরং এটি ছিল নতুন এক বৈশ্বিক সংঘাতের সূচনা।
৯/১১ এর আক্রমন পশ্চিমা বিশ্ব ও তার স্বার্থের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জিহাদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এর উৎস ছিল মুসলিমদের সেই দলটি যারা আফগানিস্তানের মিলিটারী ক্যাম্পে দুই দশক আগে মিলিত হয়েছিল। সবার আগে এসেছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের মিশরীয় যুবকেরা এবং পরবর্তীতে তাদের সাথে যোগ দেয় আরব বিশ্বের বিভিন্ন সরকার বিরোধী আন্ডারগ্রাউন্ড ইসলামী সেলগুলোর সদস্যরা। এটাই ছিল আন্দোলনের সেই নিউক্লিয়াস যা আফগানিস্তানে কমিউনিজমকে পরাজিত করা মাধ্যমে বিশাল সোভিয়েত সম্রাজ্যের পতনে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
কিন্তু শক্তিশালী অ্যামেরিকান যুদ্ধযন্ত্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের সম্মিলিত শক্তির মোকাবেলা করা ছিল একটি ভিন্ন বিষয়। অ্যামেরিকা এবং তার মিত্রদের ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ ছিল মারাত্মক, অধিকাংশ যোদ্ধাই এতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। দুই মাসের যুদ্ধে অ্যামেরিকার পক্ষে হতাহতের সংখ্যা ছিল মাত্র বারো, যেখানে অ্যামেরিকান বিমান হামলায় হাজারো আল-কায়দা সেনা এবং নিরীহ বেসামরিক জনগন নিহত হয়েছিল। ২০০১ এর ডিসেম্বরে দু’মাস মেয়াদী এ যুদ্ধের সমাপ্তির পর ধারনা করা হয় কমপক্ষে ৩০০০ আল-কায়েদা যোদ্ধা এই যুদ্ধে নিহত হয়েছে। আরো বহু লোক গ্রেফতার হয়।
যখন জীবিতরা পাকিস্তানের উপজাতী প্রধান এলাকা বাজাউর, মোহমান্দ, উত্তর এবং দক্ষিন ওয়াজিরিস্তানে (হিন্দুকুশের নিকটবর্তী এই পাহাড়ী এলাকাটি বিশ্বের অন্যতম অবসবাসযোগ্য এলাকা এবং যা শক্তিশালী প্রাকৃতিক দুর্গরূপে কাজ করে) পৌছে, ততোদিনে তাদের সংখ্যা কমে মাত্র কয়েক হাজারে এসে ঠেকেছে। আমেরিকান আগ্রাসনের পর ঠিক কতো সংখ্যক বিদেশী যোদ্ধা আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যায় তার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকলেও গড়-পড়তা অনুমান যে, সর্বসাকুল্যে প্রায় ১০০০০ উজবেক, চেচেন, উইঘুর, চাইনীজ এবং আরব যোদ্ধা পাকিস্তানে এসে পৌছে। এদের মধ্যে সত্যিকারের আল-কায়েদা সদস্য ছিল ২০০০ এরও কম।
যেখানে অবশিষ্ট আফগান প্রতিরোধ যোদ্ধারা এমন করুন অবস্থায় ছিল সেখানে এমন মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে অ্যামেরিকান সম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ করার কোন অবস্থাই আল-কায়েদার ছিল না। কিন্তু বাস্তবে আল-কায়েদার ক্ষতির পরিমান যতটা আশা করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক কম ছিল, কারন নেতৃস্থানীয় আল-কায়েদা সদস্যরা আগ্রাসন চলাকালে যুদ্ধ করেনি বললেই চলে। শুধু ব্যাতিক্রম ছিল তোরাবোরার অবরোধের মতো পরিস্থিতি যেখানে আল-কায়েদার সদস্যরা আটকা পড়েছিল এবং যুদ্ধ ছাড়া তাদের অন্য কোন বিকল্প ছিল না। শুরু থেকেই আল-কায়েদার কৌশল ছিল — যখন আমেরিকান সেনাবাহিনী সমগ্র আফগানে ছড়িয়ে পড়বে — সেই পরবর্তী ধাপের লড়াইয়ে জন্য শক্তি ও সম্পদ সঞ্চয় করা। আর পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকা থেকেই আল-কায়েদা তার শত্রুর শক্তি নিঃশেষ করার যুদ্ধ শুরু করে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)