মরণজয়ী মুজাহিদ - ১৯
মল্লিক আহমাদ সারওয়ার
একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে। মুজাহিদ হেড কোয়ার্টারে জমায়েত হচ্ছে সকল মুজাহিদ। চীফ কমান্ডারের অফিসে সভা বসেছে। সকল মুজাহিদ কমাণ্ডারগণ নিজ নিজ সেক্টরের অবস্থা তুলে ধরছেন চীফ কমান্ডারের কাছে। সেক্টর কমান্ডারগণ জানাচ্ছে, শত্রুপক্ষের তুলনায় আমাদের বেশী ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি না, এ অবস্থায় কি ভাবে আমরা শত্রুপক্ষের মোকাবেলা করব।
যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলো। চীফ কমাণ্ডার সব শুনে বললেন, সমস্যা সংকুল সেক্টরে আলীকে পাঠানো যেতে পারে। আলী যদিও তরুণ তবে সে বুদ্ধিমান তীক্ষ্ণ মেধা খাটিয়ে সে নতুন কোন সমাধান বের করতে পারবে। কিন্তু তোমাদের সবাইকে নির্দ্বিধায় তার কমান্ড মেনে চলতে হবে। তোমরা তার সহযোগিতা না করলে যতো ভালো কৌশল সে অবলম্বন করুক সফল হবে না। তরুণ বলে তার নির্দেশের যথাযথ গুরুত্ব না দিলে সে কিছুই করতে পারবে না। যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে আসা সকল কমাণ্ডার ও সহযোদ্ধারা চীফ কমান্ডারকে আশ্বাস দিলেন, আলী সম্পর্কে তাদের কোন আপত্তি নেই, তারা আলীর সকল নির্দেশ মেনে চলবে।
আলোচনা সভা শেষ হলে, চীফ কমাণ্ডার আলীকে তার অফিসে ডেকেপাঠালেন। তিনি অন্যান্য সেক্টর কমাণ্ডারদের সাথে আলীকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং আলীকে তার নতুন দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত করালেন। কতোক্ষণ ভেবে আলী বিনীত ভাবে চীফ কমাণ্ডারকে বল্লো, মুখোমুখী যুদ্ধ ক্ষেত্রের বর্তমান পরিস্থিতি ও গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই, অভিজ্ঞ কমাণ্ডারগণ থাকাবস্থায় আমি কি তাদের চেয়ে বেশী ভালো করতে পারবো?
চীফ কমাণ্ডার বললেন, আমি ভেবে চিন্তেই তোমাকে নির্ধারণ করেছি। তুমি ফিল্ডে যেয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তার পর পরিকল্পনা তৈরী করবে। আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করবেন।
দ্বিতীয় দিন চীফ কমাণ্ডারের সাথে আলীর দেখা হলে চীফ কমান্ডার বললেন, তুমি অপারেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকো, পরন্তু জুমআর পরই তোমাদের রওয়ানা হতে হবে।
আলী বললো, আপনি যদি আব্দুর রহমান, দরবেশখান, ফারুখ খান, ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহকে আমার সাথে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিতেন, তাহলে এদের সাহচর্যে আমার মনোবল বৃদ্ধি হতো। চীফ কমান্ডার মুচকি হেসে প্রস্তাবিত ব্যক্তিদেরকে আলী সাথে করে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
শুক্রবার জুমআর নামাজের সময় প্রায় হয়ে গেছে। আলী সব প্রস্তুতি সেরে চীফ কমাণ্ডারের অপেক্ষায় দাড়ালো। যুদ্ধের প্রয়োজনীয় অস্ত্র-শস্ত্র ও খাদ্য-পানীয় দুটি খচ্চরের পিঠে বোঝাই করে দফতরের সামনে বেঁধে রাখা হলো। আলী গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো। তার চেহারা বিমূর্ষ। চীফ কমাণ্ডার এসে আলীকে চিন্তামগ্ন দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আলী! তোমাকে এতো বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন?
আলী বললেন, ভাবছি, আপনি যে দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন, তা কি যথাযথথাভাবে আদায় করতে পারবো? কমাণ্ডার বললেন, হ্যা! চিন্তা করা ভালো তবে যে কোন সমস্যা সমানে এলে বিমূর্ষ হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। "তোমরা আল্লাহর দ্বীনের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যে ময়দানে যাচ্ছো। আল্লাহ অবশ্যই তোমাদেরকে অতীতের যোদ্ধাদের মতো সাহায্য করবেন।” অতপর আলী ও সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে চীফ কমাণ্ডার বললেন, “আপনারা গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে বেরুচ্ছেন। আপনাদের সফলতা নির্ভর করবে আপনাদের ঐক্য, সমঝোতা ও নিষ্ঠার উপর। কোন বিষয়ে মতানৈক্য হলে কমাণ্ডারের ফয়সালা দৃঢ় ভাবে পালন করতে হবে। আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আল্লাহর পথে জিহাদরত কোন মুজাহিদ শত কফিন দূরাবস্থাতেও ধৈর্য হারা হবে না, ঘাবড়ে যাবে না, চরম নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতেও আল্লাহর সাহায্যের উপর ভরসা রেখে কাজ করে যেতে হবে। সব সময় আল্লাহর সাহায্যের জন্য বেশী বেশী দু'আ করবেন। তিনি সকল সম্যার সমাধান দাতা, শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।”
চীফ কমাণ্ডারের দিক নির্দেশনার পর সকল মুজাহিদ সাথীরা দুআ করলেন। চীফ কমাণ্ডার সকল বিদায়া মুজাহিদদের সাথে বিদায়ী কোলাকুলি করলেন। 'আল্লাহু আকবার' “নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারীব” শ্লোগান দিতে দিতে দশ সদস্যের মুজাহিদ কাফেলা এগিয়ে চললো!
মারকাজ থেকে রওয়ানা হয়ে আসার তিন দিন পর মুজাহিদ কাফেলাটি একদিন সকাল নটায় তাবু গুটিয়ে এগুচ্ছিল। মুজাহিদ কাফেলাটি একটি পাহাড় অতিক্রম করে সংকীর্ণ একটি নালা পেরিয়ে একটি মাঠের দিকে যাচ্ছিলো। এমন সময় আলী পাশের পাহাড়ে দেখতে পেলেন, মুজাহিদ সদৃশ একটি লোককে ঘিরে রেখেছে কিছু মানুষ। আলী তৎক্ষণাৎ কাফেলা থামিয়ে নিজেই এগিয়ে গেলেন দাড়ানো লোকগুলোর জটলার দিকে। জানতে পারলেন, এসব মানুষ মুজাহিদদের সমর্থক ও সাহার্যকারী। আলী আরো জানতে পারলেন, এক বৃদ্ধ পাহাড় খনন করতে চায়। কিন্তু অন্যেরা তাকে পাহাড় খনন থেকে বিরত রাখতে চায়। বৃদ্ধ তাদের কথা না মেনে কোদাল দিয়ে পাহাড় খোড়া শুরু করলে এ নিয়ে সবাই বৃদ্ধকে তামাশা করছে। আলী অপেক্ষমান ব্যক্তিদের বল্লো, ভাইয়েরা এখানে কি ঘটেছে? আপনারা কেন এই বৃদ্ধকে নিয়ে ঠাট্টা করছেন? অপেক্ষমান লোকদের একজন বললো, এই বুড়ো পাগল হয়ে গেছে। সে বলে তার স্ত্রী-সন্তান এই পাহাড়ে চাপা পড়েছে। আমরা তাকে খুব বুঝিয়েছি, তোমার স্ত্রী, সন্তান, পাহাড়ে চাপা পড়লেও তারা আর বেঁচে নেই। কাজেই পাহাড় খুড়ে তোমার কি লাভ হবে? কিন্তু বুড়ো আমাদের কথা শোনে না।
আলী বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা! তুমি কেন পাহাড় খুড়তে শুরু করেছে। তোমার স্ত্রী সন্তানরা এখানে চাপা পড়লেও তো তারা আর বেঁচে নেই। এছাড়া একাকী তোমার পক্ষে পাহাড় খনন করাও তো সম্ভব।
বৃদ্ধ বললো, বেটা! এরা জ্যান্ত না মৃত কথা সেটা নয়। আমি এদের এখান থেকে নিয়ে নিজের কবরস্থানে দাফন করতে চাই কিন্তু এরা আমাকে সাহায্যের পরিবর্তে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করছে।
আলী বললো, বাবা! তুমি সব ঘটনা খুলে বলো, কি করে তোমার স্ত্রী সন্তানরা এই পাহাড়ে চাপা পড়লো?
বৃদ্ধ কতোক্ষণ চোখ বন্ধ করে কি যেন চিন্তা করলো। তার পর বললো, বেটা! আমার কাহিনীও অন্যান্য আফগান মজলুমদের চেয়ে ভিন্ন নয়। এখান থেকে দু'মাইল উত্তরে পাহাড়ের বিপরীত দিকের গ্রামেই আমার বাড়ী। আজ থেকে তিন বছর আগে খুব সুখেই ছিলাম আমরা। আমাদের গ্রামটি ছিল আংগুর, আখরোট, ছেব ইত্যাদি ফলের সব চেয়ে উর্বর ভূমি। সারা গ্রামের মানুষ সুখ সাচ্ছন্দেই ছিল। এমতাবস্থায় রুশ বাহিনী আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালালো। কিন্তু তারপরও কয়েক বছর আমরা ছিলাম সম্পূর্ণ নিরাপদ। আশে পাশের কয়েক গ্রামের লোক রুশ হানাদার বাহিনীর জুলুম অত্যাচারের কাহিনী শুনে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলো। তারা আমাদেরকেও বললো রুশ হানাদার বাহিনীর কোন ঠিক ঠিকানা নেই কবে কোন গ্রামের উপর হামলা করে বসে। কিন্তু আমাদের মন চাচ্ছিলনা, এতো সুন্দর বাগান, চারণভূমি, নিজের সাজানো ঘর-দুয়ার ফেলে বিদেশে চলে যাবো।
বৃদ্ধ কতক্ষন নীরব থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বললো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই ঘটলো। হঠাৎ একদিন আধা ডজন বোমারু বিমান গ্রামটির উপর বৃষ্টির মতো বোমা বর্ষণ করলো। পুরো গ্রামটি পরিণত হলো মৃত পূরীতে। সাজানো সুন্দর বাগান, গোছানো ঘরবাড়ী সব বিনাশ হলো। যারা বেঁচে ছিলো, বোমারু বিমান চলে যাওয়ার পর তারা গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। আমার এক ছেলে ও পুত্রবধু নিহত হলো। ছোট দুই পুত্র ও স্ত্রীকে নিয়ে আমি এখানে চলে এলাম। এই পাহাড়ে ছোট একটা গর্ত ছিল। আমি তাদের এখানে বসিয়ে গ্রামে চলে এলাম আহতদের সেবা এবং নিহতদের দাফন করার জন্য। গ্রামের জায়গায় জায়গায় তখনও আগুন জ্বলতে ছিলো। আমি অন্যদের সাথে নিয়ে আহত ও মৃতদের ধ্বংসাবশেষের নীচে থেকে উদ্ধার করতে ছিলাম। ধ্বংসাবশেষ থেকে নিহত ও আহতদের উদ্ধার করে নিহতদের দাফন কাফন শেষ না করতে আবারো রুশ বিমানের বোম্বিং শুরু হয়ে গেলো। আমরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পাহাড়ের দিকে দৌড়াতে শুরু করলাম। যে যেদিকে পারলো দৌড়ে প্রাণ বাচাতে চেষ্টা করলো। ঘরবাড়ী শস্য ক্ষেত বোমার আঘাত থেকে কোন কিছুই রক্ষা পেলনা। আমি পড়ি মরি করে প্রায় পাহাড়ের কাছাকাছি পৌছে গিয়ে ছিলাম, হঠাৎ করে আমার পাশেই বিস্ফোরিত হলো একটি বোমা। দূরে ছিটকে পড়লাম। এরপরে কি হলো, কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানিনা। আমার যখন হুশ ফিরে এলো, দেখলাম আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি পাড়ার পরিচিত আরো কয়েকজন আহতাবস্থায় পড়ে আছে। স্ত্রী, পুত্রদের কথা মনে পড়লো আমার। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করলাম, তারা কিছুই বলতে পারলোনা। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলে জানালো, তোমাকে যে সৈনিক হাসপাতালে নিয়ে এসেছে, কাল সে আসবে, তুমি ওকে জিজ্ঞেস করো। দ্বিতীয় দিন রুশ সৈনিক এলে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম। সে বললো সেখানে তুমি আহত হয়ে পড়েছিলে সেখানে আমি কোন শিশু বা মহিলা দেখিনি। ওর কথা শুনে আমি শুকনো ঠোট জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে বললাম, আল্লাহর শুকুর, জালেমদের হাত থেকে আমার স্ত্রী পুত্ররা বেঁচে গেছে। আমার ধারণা ছিল, বোম্বিং থেকে রেহাই পেয়ে ওরা পাকিস্তান চলে গেছে।
দুমাস হাসপাতালে পড়ে থাকার পর কিছুটা সুস্থ হলাম। জালেম রুশ সরকারী বাহিনী আমাদের জেল খানায় চালান করলো। জেলখানায় স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্য চললো অত্যাচার। যে অত্যাচার জুলুমের কথা স্মরণ হলে আমার গায়ের পশম দাড়িয়ে যায়। অবর্ণনীয় অত্যাচার করে আমাদের জিজ্ঞেস করা হত, বলো মুজাহিদদের সাথে তোমার কি সম্পর্ক। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আমার সামনেই ক'জন শহীদ হয়ে গিয়েছিল। এভাবে প্রত্যেক কয়েদীর উপরই চলতো হায়েনাদের আক্রমন। বৃদ্ধ আলীকে নিজের হাত দেখিয়ে বললো, বেটা! এই দেখো, জালেমরা আমার নখের নীচ দিয়ে গরম সূই ঢুকিয়ে সব গুলো আঙ্গুল নষ্ট করে দিয়েছে। ওরা কয়েদীদের শরীরের গোশত কেটে তাতে লবণ মরিচের গুড়ো দিতো। দেখো, এখনও আমার শরীরের গর্ত গুলো ভরাট হয়নি। অসহ্য যন্ত্রণায় যখন আসামীরা তরপাতে থাকতো তখন ওরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো। কয়েকমাস কয়েদ খানায় আমাকে এভাবে শাস্তি দিয়েছিল।
গ্রেফতারীর আড়াই বছর পরে একদিন কয়েদখানার রুশ অফিসার আমাকে ডেকে পাঠালো। মুখোমুখী হলে আমাকে এই বলে প্রস্তাব দিলো যে, পাকিস্তানে বোমিং করতে রাজী হলে ওরা আমাকে ছেড়ে দিবে। আমি মুখের উপর না বলে দিলাম। আবার আমাকে নিক্ষেপ করলো কারাগারে। জেলখানায় আমার সাথীরা আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলো, এই শর্ত মেনে হলেও আমি যেনো মুক্ত হয়ে যাই। কিন্তু আমি তাতে কিছুতেই রাজী হচ্ছিলাম না। যারা আমাদের অসহায় স্ত্রী পুত্র ও দেশের মানুষের দুর্দিনে ঠাই দিয়েছে, তাদের নিরাপরাধ শিশু-পুত্র-কন্যাদের উপর আমি বোমা নিক্ষেপ করতে পারবো না। পারবো না অকৃতজ্ঞের মতো নিষ্পাপ শিশুদের খুনে হাত রাঙ্গাতে। এভাবে আরো তিন মাস কেটে গেলো। হঠাৎ একদিন জানিনা কি কারণে আমাকে ছেড়ে দিলো। হয়তো এমনও হতে পারে যে, আমি বুড়ো হয়ে গেছি, ওদের বিরুদ্ধে আমার পক্ষে আর তেমন কিছু করা সম্ভব না। তা ছাড়া অকারণে ওদের চাল ডাল খাইয়ে আমাকে কেন পালবে। এজন্যেই হয়তো মুক্তি পেয়েছি।
মুক্তি পাওয়ার পরে আমি সোজা পাকিস্তান গিয়ে উঠি। সেখানে দীর্ঘ দু'মাস পর্যন্ত আমার স্ত্রী পুত্রদের খোঁজা খোজি করে কোন হদিস পাইনি। অনেক প্রতিবেশী পরিচিতদের দেখা হয়েছে কিন্তু তারা কেউ আমার স্ত্রী-পুত্রদের পাকিস্তান যেতে দেখেনি বলে জানিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমি আবার আফগানিস্তানের পথে পা বাড়ালাম। এখানে পৌছে দেখি, পাহাড়ে আগে যে গর্তটি ছিল সেটি এখন নেই। প্রথম প্রথম আমার সন্দেহ হচ্ছিল হয়তো পাহাড়টি আমি ভুলে গেছি। কিন্তু আমার স্মৃতি শক্তি এতে দুর্বল হয়নি যে, আমার গ্রামের পাশে অবস্থিত পাহাড়টি আমি চিনব না। যদিও এটির পূর্ব আকৃতি বোমার আঘাতে হানাদার বাহিনী বিগড়ে দিয়েছে। বোমার আঘাতে গর্ত মুছে গেছে এবং উপর দিকটায় ঝোপ ঝাড় সৃষ্টি হয়েছে।
পাহাড়ের বিকৃতি ও পরিবর্তন দেখে আমি প্রথমে ভেবে ছিলাম, ওরা এখানেই নিহত হয়েছে। আর পাহাড় খুড়ে কি হবে এখানেই থাক। কিন্তু আমার সন্দেহ হলো, যদি ওরা এখানে থেকে চলে গিয়ে থাকে, তাহলে এখনও বেঁচে আছে এবং আমার অপেক্ষা করছে, কিন্তু আমার সন্ধান পাচ্ছে না। এসব সন্দেহ দূর করার জন্য শেষ পর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি পাহাড় খুড়ে দেখব। যদি পাই তবে তো নিশ্চিত হলাম, না হয় ওদের খুজে বের করব। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এসব লোক আমাকে সাহায্যের পরিবর্তে ঠাট্টা বিদ্রুপ করছে। বেটা! তুমিই বলো এখন আমি কি করবো? গর্ত খুড়ে ওদের না পেলে আমি খুঁজে ফিরব, না হয় এই ভেবে শান্ত হব যে, ওরা মরে গেছে। বৃদ্ধের হৃদয় বিদারক কাহিনী শুনে ওখানে দাড়ানো অনেকের চোখ ছলছল করছিলো। আলী বললো, বাবা! আপনার কাহিনী শুনে আমরা দুঃখিত। আফগানিস্তানের অধিকাংশ পিতার জীবনেই ঘটছে এমন দুঃখ। কেউ সন্তান হারিয়েছে, কেউ হারিয়েছে মা, বাপ। ঠিক আছে, গর্ত খুড়তে আমরা আপনাকে সাহায্য করব।
এরপর আলী ও সাথী মুজাহিদরা গর্তের মুখ স্থানটুকু থেকে মাটি সরাতে লেগে গেলো। তাদের দেখা দেখি স্থানীয়দের কেউ কেউ শরীক হলো।
সকাল দশটা থেকে মাটি সরাতে শুরু করে ছিলো আর দুপুর একটা পর্যন্ত মাটি সরালো, কিন্তু তখন পর্যন্ত কোন মৃত মানুষের আলামত চোখে পড়লো না। সাথী মুজাহিদরা জোহরের নামায ও আহারের বিরতি দিল। নামায সেরে তারা গতকালের অবশিষ্ট শুকনো রুটি খেয়ে আবার মাটি খুড়তে লেগে গেল। আলী বিরামহীন ভাবে মাটি সরাতেই ছিলো। আসরের নামাযের সময় হয় হয় অবস্থা। এমন সময় বুড়ো চিৎকার দিয়ে বললো, এই তোমরা থামো থামো পেয়েছি, পেয়েছি!! বৃদ্ধার আওয়াজ শুনে সবাই তার দিকে অগ্রসর হলো। বৃদ্ধা দেখালো এই দেখো আমার মেয়ে গুলজানের হাত। সবাই গভীর ভাবে খেয়াল করে বুঝতে পারলো, ঠিকই একটি ছোট্ট হাতের আঙ্গুল দেখা যায়।
এরপর আলীর নির্দেশে সকলেই সতর্কতার সাতে অল্প অল্প করে মাটির সরাতে লাগলো। অল্পক্ষণ পরেই প্রকাশ হয়ে গেলো পুরো ঘটনা।
দেখা গেল এক বৃদ্ধা, একটি ছেলে ও মেয়ের লাশ উপুর হয়ে পরে আছে। তখনও এদের কাপড় সম্পূর্ণ অক্ষত, অক্ষত তাদের লাশ। এদের অবস্থা এমন ছিলো যে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, বৃদ্ধা মহিলা গর্তের বাইরের কাউকে দেখে ভারী কাপড়ের পর্দা দিয়ে নিজের চেহারা ডেকে ফেলেছিল, তার কাছেই ছেলে ও মেয়েটির দিকে তার দৃষ্টি ও হাত প্রসারিত। ছেলের মাথায় টুপি এবং মেয়েটির মাথার চুল গ্রাম্য আফগানী স্টাইলে বেণী পাকানো উভয়েই তার মার দিকে হাত বাড়িয়ে রেখেছে। মনে হয় মৃত্যুর সময় এরা সবাই একে অন্যের সাহায্যে হাত প্রসারিত করে দিয়েছিলো, আর এ অবস্থায়ই শীতল মৃত্যু এদের অভিনন্দন জানায়। মা, মেয়ে ও ছেলের মৃত্যু দৃশ্যটি এমন ছিলো যে, মনে হচ্ছিল টিলিভিশনে কোন এ্যাকশন দেখানো হচ্ছিল এমতাবস্থায় স্থির হয়ে গেল চিত্র। কাছে থেকে অবলোকনকারীরাও ভাবতে পারেনি যে ওরা মরে গেছে। দেখে মনে হচ্ছিল, হয়তো এখনি হেসে উঠবে মা মহিলাটি। তিন তিন বছর পরও তাদের লাশগুলো মোটেও বিকৃত হয়নি। না তাদের কাপড় গুলো নষ্ট হয়েছে না তাদের শরীর পচন বা কীটে খেয়েছে। এই দৃশ্য যেমন ছিল ঈমানদীপ্ত ঠিক তেমনই ছিল রুশ বাহিনীর নির্মম জুলুমের জ্বলন্ত সাক্ষী। সে হত্যাযজ্ঞ দেখে যে কোন পাষাণের চোখেও অশ্রু ঝরবে। বৃদ্ধ ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলো। উপস্থিত ব্যক্তিদের চোখেও নেমে এলো অশ্রু বন্যা। কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধের কান্না থামলে তিনি তার কন্যার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, একদিন জুমআর নামাযের পূর্বে ইমাম সাহেব জিহাদের উপর উজ্জীবনীমূলক বক্তৃতায় বললেন, রুশহানাদাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা প্রত্যেক আফগানী নাগরিকের উপর ফরয। আমার এই মেয়েও ইমাম সাহেবের বক্তৃতা শুনেছিল। রাতে সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা! জিহাদ কি? আমি বললাম, বেটী! দ্বীনের মর্যাদা বৃদ্ধি ও নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষায় যুদ্ধ করার নামই জিহাদ। মেয়েটি আমার গলা ধরে আদুরে স্বরে বললো, বাবা! ইমাম সাহেবতো বলেছেন, কাফেররা আমাদের পাশের মসজিদ ধ্বংস করছে, মানুষ মারছে তারপরও তুমি ওদের সাথে যুদ্ধ করতে যাচ্ছো না কেন? আমি তাকে সান্তনা দিতে বললাম, বেটী! যাবে, অবশ্যই যাবো!
বাবা! আমাকেও কিন্তু সাথে নিয়ে যেয়ো। মেয়েটি বললো, বাবা! যদি আমি কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হই, তাহলে আল্লাহ খুশী হয়ে আমাকে বেহেশত দিয়ে দিবে তাই না? এই বলে বৃদ্ধ লোকটি আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
বৃদ্ধের কথা শুনে আলীরও তার বোন সায়েমার কথা স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো। সেও দূরে গিয়ে হাটুতে মাথা লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো। তার মনে পড়লো বাড়ী থেকে আসার সময় আলী মাকে বলেছিলো, আমি বোন সায়েমার রক্তের প্রতিটি ফোটার প্রতিশোধ নিব। কিন্তু রুশ জালেমরা এখানে অগণিত নারী, শিশু হত্যা করে যে রক্তবন্যা বইয়ে দিয়েছে, সকল রুশ হানাদার বাহিনীকে হত্যা করলেও এর প্রতিশোধ হবে না। আলী মনে মনে আবার প্রতিজ্ঞা করলো, আমি শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত রুশ জালেমদের বিরুদ্ধে লড়ে যাবো।
আলী নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে বৃদ্ধকেও শান্ত করলো এবং তিনটি লাশ নিয়ে বৃদ্ধের পারিবারিক কবরে দাফন করে এখানেই তাঁবু গেরে রাত কাটিয়ে দিলো। সকাল বেলার নাশতা সেরে আলী রওয়ানা হওয়ার তৈরী করছিলো, বৃদ্ধ এসে বললো, আমিও তোমাদের সাথে যাবো আর কিছু করতে না পারি তোমাদের খানা পাকানোর সহযোগিতা তো করতে পারবো। আলী বৃদ্ধকেও সাথে নিয়ে নিলো।
মুজাহিদ কাফেলাটি রওয়ানা হয়ে তখনও দু'ঘন্টার পথ অতিক্রম করেননি, শত্রু বাহিনীর চারটি হেলিকপ্টার এসে বোমা নিক্ষেপ করতে লাগলো। দ্রুত আলী সাথীদের পাহাড়ে চড়ে নিরাপদ স্থানে পজিশন নেয়ার নির্দেশ দিলো।
আর খচ্চর দু'টিকে গাছের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখলো। হেলিকপ্টারে আঘাত করার মতো কোন অস্ত্র আলীর বাহিনীর সাথে ছিল না। তাই কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন না হয়ে ইচ্ছে মতো বোমা নিক্ষেপ করে হেলিকপ্টার চলে গেলো, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে চলে এলো জঙ্গি বিমান। জঙ্গি বিমানের বোম্বিং ছিল খুবই ভয়াবহ। আলী ও সাথীদের সমূহ ক্ষতি হওয়ার আশংকা ছিল। গাছের সাথে আটকে রাখা খচ্ছর দু'টি দড়ি ছিঁড়ে পাশের পাহাড়ের কাছে চলে গিয়েছিল। রুশ বাহিনী খচ্চরকে কেন্দ্র করে অগণিত বোমা নিক্ষেপ করে চলে গেলো। উভয় খচ্চর বোমা হামলায় মারা গেল।
বোমারু বিমান আকাশে চক্কর দেয়া অবস্থায়ই ট্যাংক সজ্জিত সাজোয়া যান এসে উপস্থিত। আলী তাড়াতাড়ি মুজাহিদদের পাহাড়ের চূড়াই আরোহন করার নির্দেশ দিলো। পাহাড়ের চূড়া ঝোপ ঝাড় গাছ গাছালির আড়ালে সকল মুজাহিদ একত্রিত হলো। খচ্চর মারা পরায় খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় সামগ্রী তাদের বয়ে নিয়ে পাহাড়ে চড়তে হয়েছিল। সব মুজাহিদকে একত্রিত করে আলী পরামর্শ করলো, উদ্ভূত সমস্যায় কি করা যায়।
বৃদ্ধ মুজাহিদ বললো, গতকাল আমরা যখন গর্ত খুড়তে ছিলাম তখন সেখানে হয়তো কোন চর ছিলো। সে রুশ বাহিনীকে আপনাদের উপস্থিতির খবর দিয়েছে। অন্যথায় এদিকে পাঁচ-দশ গ্রামে কোন মুজাহিদ ক্যাম্প বা সেনা ছাউনী নেই।
আলী বললো, যদিও আমাদের হাতে মোকাবেলা করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ অস্ত্র নেই, তবু যেগুলোই আছে তা দিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত মোকাবেলা করে যাবো। দু'জন দু'জন করে গ্রুপ তৈরী করে আলী তাদের কয়েকটি জায়গায় বসিয়ে দিলো। মুজাহিদরা রুশ বোমা হামলায় যেসব গর্ত হয়েছিল এসবের মধ্যে নিজেরা পজেশন নিয়ে লুকিয়ে পড়লো।
শত্রু বাহিনীর সাজোয়া যান তখন পাহাড়ের নীচে এসে পৌঁছে গেছে। ওরা কোন নিশানা ঠিক না করে পাহাড়ের দিকে এলোপাথাড়ি ফায়ার করতে লাগলো। দীর্ঘ সময় গোলা নিক্ষেপের পর গাড়ী থেকে নেমে উপরের দিকে উঠতে লাগলো। বিরাট এক শক্তিশালী বাহিনীর মোকাবেলায়, মাত্র কয়েকজন প্রায় অস্ত্রহীন মুজাহিদের যুদ্ধ ও জীবন দেয়া নেয়ার খেলা জমে উঠলো। যে খেলা খুবই লোম হর্ষক ও আশ্চর্যজনক।
ভাষান্তরঃ শহীদুল ইসলাম