JustPaste.it

আমার দেশের চালচিত্র

 

আজকের নারী চেতনার উন্মেষ এবং সেকালের ইতিহাস

ফারূক হোসাইন খান

=====================================================================

 

        যে কোন জাতির উন্নতি অগ্রগতিতে নারী সমাজ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, যদিও আমরা অনেকেই তা স্বীকার করত চাই না। আমরা মনে করি, পুরুষরাই সর্বক্ষেত্রে জাতির কর্ণধার হয়ে জাতিকে পরিচালনা করে, দুর্যোগ মুহর্তে সাহসী, এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করে এবং জাতির সােনালী ইতিহাস রচনায় এগিয়ে আসে। সুতরাং এ কৃতিত্বের দাবিদার পুরুষরাই, নারীরা নন। তারা বলে, পৃথিবীর ইতিহাসে নারী সমাজ কোন জাতির অগ্রগতি, উন্নয়নে দু'একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোন উল্লেখযােগ্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারেনি। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির উত্থান পতনের ইতিহাসের সাথে কেবলই জড়িয়ে আছে অসংখ্য বীর পুরুষের নাম। সে তুলনায় নারীদের কিঞ্চিৎ অবদান ম্লান হয়ে যায় বইকি।

 

        আসলে আমাদের সমাজে নারীদের কোন ভূমিকাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না । তাদের কোন প্রশংসনীয় কাজকে সহজে গ্রহণ করার মানসিকতা অনেকের মাঝেই অনুপস্থিত। যে পুরুষ বিশ্ব কাঁপানাে ইতিহাস সৃষ্টি করে সে জন্ম নেয় এক নারীর গর্ভেই। ছেলে বেলার অসহায় দিনগুলো তার মায়ের কোলেই কাটে। এই মহান শিক্ষা সদনেই তার মায়ের নিকট সে লাভ করে ভবিষ্যত জাতির সেরা, জাতির নেতৃত্ব প্রদানের বিপ্লবী প্রেরণা, শিক্ষা, সাহস। মায়ের স্তন্য তার শরীরের পরতে পরতে রােপন করে বিপ্লবের বীজ। ছোট একটি বালককে চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধি, সাহসে যোগ্যতর করে গড়ে তুলে তাকে জাতির কর্ণধারে পরিণত করে যে সে তার মা, একজন শ্রদ্ধেয় নারী। যার সযত্ন লালন, পালন, স্নেহ ভালবাসা, শিক্ষা ও প্রেরণার কারণে জাতি লাভ করে একজন মহান নেতা, কীর্তিমান পুরুষ। সে পুরুষের সকল কীর্তি, সম্মান তাে সে নারীরই প্রাপ্য। আবিস্কার নয়, আবিস্কারকাকে সম্মান দেখানােই তাে জগতের নিয়ম, এটাই বাস্তুব।

 

        মা-ই প্রথম সন্তানকে শেখান কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, কে জালিম আর কে মজলুম। মাতৃগৃহের পাঠশালা থেকে-ই সন্তান লাভ করে জুলুম, অসত্য ও সকল শোষণের বিরুদ্ধে জিহাদ করার শিক্ষা ও প্রেরণা। জাতির ক্রান্তি লগ্নে বীর মাতা তার প্রিয় ধন যুবক ছেলেকে আঁচলে বেধে না রেখে জাতির স্বার্থে, জাতির সেবায় উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠিত হন না। পাহাড়সম বিপদকে উপেক্ষা করেও তার সন্তানকে সামনে এগিয়ে যেতে উদ্ভুদ্ধ করেন। জাতির বীর মাতাগণ এভাবে যখনই তাদের সন্তানরা জাতি, স্বাধীনতা ও আর্দশের জন্য কোরবানী দিতে প্রস্তুত হন সে জাতির ইতিহাস লেখা হয় সােনালী হরফে। পৃথিবীর কোন শক্তিই সে জাতির ইতিহাসে কালিমা লেপন করতে সক্ষম হয় না।

 

        কিন্তু জাতির মাতাগণের, স্তুন্য যখন এই সম্মোহনী শক্তির ঘাটতি দেখা দেয়, মায়ের চিন্তা-চেতনায় যখন সংকীর্ণতা ও আত্মকেন্দ্রীকতা দানা বাধে, মা যখন তার সন্তানদের যােগ্য শিক্ষাদানে ব্যর্থ হন, তখনই জাতির ভাগ্যে লেখা হয় বিপর্যয় ও অধঃপতনের ইতিহাস। জাতিকে মাথা উঁচু করে দাড়াতে হলে চাই শক্ত মেরূদন্ড, অফুরন্ত শক্তি, অদম্য মনােবল। এসবের উৎস হলাে দেশের যুব সমাজ। এ যুব সমাজ যদি হয় ভীরু, আত্মত্যাগের শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত, মহৎ কিছু করার মানসিকতা যদি তার মধ্যে অনুপস্থিত থাকে, বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে যদি জাতির ইতিহাস লেখার সাহস না থাকে, তবে সে জাতি তার পদদলনে লাঞ্চিত হয়ে, মজলুম হয়ে, হাহাকার করে বুক চাপরাতে থাকবে এটাই বাস্তব, এটাই ইতিহাসে।

 

        মামা বাংলা ভাষাভাষি জনগোষ্ঠী যদি আমাদের এই ক্রান্তিলগ্ন উপস্থিত হওয়ার কারণ অনুসন্ধান কন্তে চাই তবে আমাদের শক্তি, সাহস ও প্রেরণার সুতিকাগার মাতৃগণের দুর্বলতাকে যদি অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করি তবে বােধ হয় ভুল হবে না। কোন জাতি যদি দুর্বল, অসহায় হয়ে পড়ে তবে তার প্রাণশক্তি ফিরিয়ে আনতে পরে একমাত্র মাতৃগণই। মা তার সন্তানদের চেতনার দুয়ারে আঘাত হেনে তাকে জাগ্রত করবে, তার কানে স্বাধীনতা ও আদর্শ রক্ষার জন্য নয়া বিপ্লবের মন্ত্র ফুঁকে দেবেন। জাতি যখন ঘুমিয়ে থাকবে তখন পুর নারী মা-বোনরাই জাতির নওজোয়ানদের ঝাঁকুনী দিয়ে জাগ্রত করে তুলবে। বিপ্লবের মন্ত্রে উদ্ভুদ্ধ করবে। তাদের আদেশ করবে জুলুমের হাত গুড়িয়ে দিতে, দৃপ্ত পদক্ষেপে শহীদী কাফেলায় সামিল হতে। কিন্তু হয়, আমরা বুঝি সত্যিই দুর্ভাগা। আমাদের চেতনার সেই আগ্নেয়গিরি বুঝি নিভে গেছে । জাতির শক্তির প্রাণকেন্দ্র আজ শূণ্য, সে নিজেই দায়িত্ব সম্পর্কে অচেতন, আমাদের মা-বােনেরা তাদের উত্তর সুরীদের ইতিহাস, শিক্ষা ভুলে যেতে বসেছে।

 

        জাতি আজ কুশিক্ষা, অপ-সংস্কৃতি, অশ্লীলতা, পাপাচারের সয়লাবে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সন্ত্রাসী, মাস্তান, চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিবাজদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে সমাজ ও প্রসাশন। নিরক্ষরতা, দারিদ্র ও বিদেশী চক্রান্তের ফলে ঈমান, ইসলাম ও দেশের স্বাধীনতা আজ হুমকির সম্মুখীন। আমাদের মুহাম্মদী পরিবারের একটা বৃহৎ অংশ নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়ে ধুকে ধুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই দেশ ও জাতিকে সকল অরাজকতা ও জুলুমের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য আজ একান্ত প্রয়োজন সিংহ হৃদয়ের অধিকারী বীর সৈনিদের। আমাদের মাতাগণ সেসব বীর পুরুষদের জন্ম দিতে যেন আজ একেবারে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। বিলাস ব্যঞ্জন, বৈষয়িক উন্নতি প্রভৃতির দিকে সন্তানদের চিন্তা-চেতনাকে ধাবিত করে আদর্শ দেশপ্রেমিকের সেবা থেকে জাতিকে বঞ্চিত করছেন।

 

        আজকে আমাদের মাতাগণ ও সেকালের মাতাগণের সন্তানের প্রতি তাদের স্নেহ, লালন-পালন প্রক্রিয়া ও সন্তানের চিন্তা-চেতনার বিকাশের জন্য তাদের ভূমিকার মধ্যে যে আকাশ পাতাল পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে তা দেখে আমাদের আশ্চর্যান্বিত হতে হয়। একালে মাত্রাগণ যখন তার সন্তানকে কাঠের বা মাটির খেলনা দেয় খেলতে, এ সময় সে কালের মাত্রাগণ সন্তানদের তীর তলোয়ার চালানাে শেথানের জন্য সামরিক স্কুলে পাঠাতেন। তাদের উদ্দেশ্য থাকত তার সন্তান বড় হয়ে দেশের জন্যে ইসলামের জন্যে একজন আদর্শ সৈনিক হিসেবে সংগ্রাম করে শাহাদাৎ বরণ করে দেশের ও ইসলামের মর্যাদা বৃন্ধি করবে। আখেরাতে মা-বাবার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে। আর এ যুগের মায়েৱা সন্তানকে বানান “বার্ধ্যক্যের খুটি"। বৃদ্ধ বয়সে সন্তান ভাল-রোজগার করে তাদের আরাম-আয়েশের নিশ্চয়তা প্রদান করবে এ জন্য সন্তানকে ছেলেবেলা থেকেই ভালাে স্কুলে ভর্তি করে দেন যাতে ভালাে রেজাল্ট করে, সন্তান ভালাে একটা চাকুরী পায়, ব্যবসা করতে পারে, স্কলারর্সীপ নিয়ে বিদেশে লেখাপড়া করতে যেতে পারে অথবা একজন উকিল, ব্যারিষ্টার, জজ, ডাক্তার অথবা সরকারী আমলা হয়ে বাবা-মার সম্মান, নিজের সম্মান, সম্পদের ভাণ্ডার বৃদ্ধি করতে পারে। একই সাথে অভিজাত পরিবারে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করে নিজেদের আভিজাত্য আরও খানিকটা জৌলুসময় করে তুলবে। তাদের কাছে সন্তান হল বৈষয়িক উন্নতি ও তথাকথিত সামাজিক সম্মান বৃদ্ধির হাতিয়ার মাত্র। সন্তান যে পরকালের মুক্তির জন্যও গ্যারান্টি হতে পারে এ চিন্তা চেতনা তাদের নেই। ছেলে এখন আমাদের উপার্জন করে খাওয়ালে এর মধ্যে আবার পরাকালের কি দখল আছে? ইসলামের সেবা বা দেশের সেবার কথা বললে তাে কথাই নেই, “মা-বাবার খেদমত করা ফরজ"-মুফতি না হলে ও অভিজ্ঞ মুফতিগণের ন্যায় ফতোয়া দিতে কসুর করেন না। এ শ্রেনীর মা-বাবারা তারা সর্বদা সতর্ক থাকেন ছেলে আবার কোনাে আন্দোলন-ফান্দোলনে জড়িয়ে পরলাে কিনা। আন্দোলন সত্য পথের, জুলুমের বিরুদ্ধে হলেও তারা সন্তানকে এতে যােগদান করতে নিতে নারাজ। কেননা এতে কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তাদের ভবিষ্যত জীবন -চাকা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

 

        এ যুগের মায়েরা ছেলেবেলায় সন্তানকে পুলিশ, বিড়াল, সাপ, বিচ্ছুর ভয় দেখিয়ে ঘুম পান বলে সন্তান ছেলেবেলা থেকেই ভীরু চরিত্র নিয়ে গড়ে ওঠে। তাই আজীবন মায়ের আঁচলকে মনে কর নিরাপত্তার মজবুত দূর্গরূপে। স্কুলে যেতে তাদের ভৃত্যের পিঠে চড়তে অভ্যস্থ করানাে হয় বলে তারা সারাটি জীবন পরনির্ভরশীল মানসিকতা সম্পন্ন হয়ে থাকে। অথচ সে যুগের মায়েরা সন্তানকে হাটি হাটি পা পা বয়স থেকেই ঘোড়ায় চড়তে উদ্বুদ্ধ করতেন। ছেলেকে দুরন্ত ঘােড়াকে বশ কর মাইলকে মাইল পথ পাড়ি দিতে দেখে অনন্দ ভোগ করতেন, গর্বে বুক ভরে যেত তাদের। সন্তানকে তারা ইসলামের বীর সন্তানদের যুদ্ধের কাহিনী শুনিয়ে ঘুম পাড়াত বলে সন্তান ছেলে বেলা থেকেই সকল মিথ্যা ও জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজেকে নিয়ােজিত করা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করে নিত।

 

        যে যুগের আরব মায়েরা যেদিকেই জুলুমের কথা শুনতেন সন্তানকে সে ময়দানেই ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করতেন। ছেলের ১৪ বৎসর বয়স পূর্ণ হলেই তাকে জিহাদে যেতে তাগিদ দিতেন আরব মায়েরা। এমনকি হাজার হাজার মাইল দূরে ছেলের সাথে বৃদ্ধ মা-বােন ও সঙ্গী হতেন রণাঙ্গনে তার মনােবল ও সাহস অটুট রাখার জন্য। ঘোরতর লড়াইয়ের মধ্যে যদি কখনাে মুসলিম সেনাদের পা নড়ে যেত বা পশ্চাৎ অপসারণ করে জীবন বাঁচানাের চেষ্টা করত তবে পেছন থেকে তাদের মা-বােনেরা তাবুর খুটি উৎপাটন করে হুংকার ছেড়ে তেড়ে যেতেন, “খবরদার! তােমাদের দ্বারা যদি ইসলাম কলঙ্কিত হয় তবে তােমাদের মস্তকও নিরাপদ থাকবে না। পেছনে হটে গেলে আমরা হাতের কাকন খুলে তােমাদের পরিয়ে দিয়ে কাপুরুষ বলে আখ্যায়িত করব।" ইসলামের বীর সৈনিকদের এমনি করে সেকালের মা-বোনেরা মরণ পন যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন অথবা শাহাদাৎ বরণ করতে উহসাহিত করতেন। পেছনে হটলেই মা-বােনেরা মুখে ঘৃণার থু থু দেবেন এ ভয়ে মুসলিম সেনারা ভুলেও পেছনে হটার চিন্তা করতেন না।

 

        সে কালের আরব মায়েরা ছেলে বয়স্ক হলেই জিহাদে না পাঠালে প্রতিবেশীদের নিকট উপহাসের ও তিরষ্কারের পাত্র হতেন। স্বামী রণাঙ্গন ছেড়ে বাড়ীতে অবস্থান করতে সাহস পেতেন না স্ত্রীর তিরস্কারের ভয়ে। একজন মা তার আদরের ছেলেকে, স্ত্রী তার স্বামীকে নিজ হাতে রণসাজে সাজিয়ে নিয়ে হাসিমুখে বিদায় জানাতেন। তারা খোদার রাহে জীবনের সর্বোত্তম ধন, অবলম্বন কামনা-বাসনাকে এভাবে উতসর্গ করতেন। স্নেহের পুত্র, প্রিয় স্বামীর বিরহ তাদের বুক জর্জরিত করতো বটে কিন্তু সবকিছুর চেয়ে দায়িত্ব পালন, দেশ ও ইসলামের মর্যাদা রক্ষাকে তারা অগ্রাধিকার দিতেন বলেই মুখে তার কোন প্রতিক্রিয়া যাহির হাতে দিতেন না। ছেলে বা স্বামী শাহাদাৎ, বৱণ করলে সে নাৱীর ন্যায় মহল্লায় আর কেউ বেশী খুশী হতেন না। প্রতিবেশীরা এই ভাগ্যবান মহিলাকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠত। সমাজে তার মর্যাদা বহুগুণে বেড়ে যেত। ছেলে বা স্বামীর জিহাদের ময়দানে যত বেশী বীরত্ব প্রকাশ পেত এবং শাহাদাৎ লাভ করার সৌভাগ্য লাভ করত তার মা, স্ত্রী এবং বংশের মান, মর্যাদা সেই মাপকাঠিতে নির্ণয় করা হতো। এ জন্যে আরবের যে কবিলা লােক সংখ্যায় বেশী হতো এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ভালাে থাকতো তারা সমর বিদ্যা শেখার জন্যে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নিযুক্ত করতেন এবং সম্মান ও প্রতিপত্তি অর্জনে দেশের শ্রেষ্ঠ বীর পুরুষ সৃষ্টি করতে হতাে, দেশের স্বাধীনতা ও ইসলামের মান মর্যাদা রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে তাদের থাকতে হতো প্রথম কাতারে। মােট কথা সম্মান, প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য সেকালে একমাত্র মাপকাঠি ছিল দক্ষ স্তীরন্দাজ, দ্রুতগামী ঘোড় সওয়ার ও নিপূন অসি চালক হওয়ার। আর এর পেছনে সিংহভাগ অবদান থাকত সিংহী হৃদয়ের মা-বােনের উৎসাহ, প্রেরণা, শিক্ষা ও মহৎ চিন্তা-চেতনা।

 

        ইসলামের সােনালী যুগে মুসলিম, মা-বােনেরা সন্তান-স্বামীর হাত-পায়ে শেকল হতে চাননি।বলেই রচিত হয়েছিল সােনালী ইতিহাস। ক্ষুদ্র আরব ভূ-খন্ড থেকে মুজাহিন বাহিনী ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়া ছেড়ে আফ্রিকা ও ইউরোপে।  মা তার যুবক ছেলেকে বৃদ্ধ বয়সে ভর করে চলার জনাে লাঠি না নিয়ে তলােয়ার হাতে তুলে দিয়ে হাজার হাজার মাইল দুরে ইসলামকে বুলন্দ করতে পাঠাতেন বলেই অল্প দিনের মধ্যে বিশ্বের অনাচে কানাচে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। মরু আরবের বেদুইন সুদূর স্পেনে ইসলামের ঝাণ্ডা উড়ায়। সে যুগের মা-বােনের সন্তান-স্বামীকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করতে পেরেছিলেন বলেই আরবের সন্তান শাহজালাল (রাহঃ) বাংলার বুকে ইসলামের আলাে জ্বেলেছিলেন। সুদূর সুমাত্রা দ্বীপে পৌছে গিয়েছিল ইসলামের শ্বাশত বানী। ইসলামের জন্য তাদের অফুরন্তু দদদ ও ভালােবাসার কারণেই ইতিহাসে লেখা হয়েছে খালিদ, তারিক, কাশিম, কুতাইবা, মুসা নুসাইরী, সালাউদ্দিন আইউবী প্রমূখ বীর কেশীর বীরত্ব গাঁথা।

 

        এ যুগের মা ও বােনেরা তাদের পূর্ব ঐতিহ্য ভুলে যাওয়ায় আমরা বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হয়েও বেঁচে থাকার জন্য পরের সাহায্যের মুখাপেক্ষি হতে হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশে স্বজাতি মুসলমানদের ওপর চরম নির্যাতন, নিপীড়ন চললেও আমরা তার প্রতিকারে কোন ভূমিকা নিতে সক্ষম নই। বিশ্বের আনাচে কানাচে মুসলমানরা মজলুম হলেও আমরা জালিমের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদের আওয়াজ তুলতেও সমর্থ নই। দেখা যায়, যদি কোন ইসলাম প্রেমী নওজোয়ান স্ব উদ্যোগে, দায়িত্ববােধের কারণে মজলুম মুসলমানদের পাশে দাড়াতে বিশ্বের কোন জিহাদী রণাঙ্গনে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় তবে সর্ব প্রথম তার সামনে বাধার লৌহ প্রাচীর তুলে দেয় তারই মা-বাবা। তাদের আশঙ্কা, ছেলে যুদ্ধে গিয়ে মরে গেলে তাদের খাওয়াবে পরাবে কে। ভাবখানা এমন, মানুষ যুদ্ধে গেলেই কেবল মরে যায় আর আঁচলের তলে লুকিয়ে রাখলে কখনাে মরণ সেখানে উপস্থিত হতে পারে না। এ যুগের মা-বােনেরা তাদের ছেলে, স্বামীদের একমাত্র নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য জুলুম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে বাধা দেন। ছেলেকে একমাত্র আর্থিক উন্নতিই মান-সম্মান, প্রতিপত্তির চাবিকাঠি এরকম একটা ধারণা দিয়ে অন্ধের মতো অর্থের পেছনে দৌড়াতে উদ্বুদ্ধ করেন। তাদের ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য সমস্ত জীবনের শিক্ষা, মেধা ও কর্ম শক্তি নিয়োজিত করতে শিক্ষা দেন। এ সমস্ত পরিবারের মা-বাবা ও সন্তান এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার সম্পর্কের গভীরতা ও স্নেহ-ভালবাসায় মাপকাঠি নির্ধারিত হয় ছেলে-স্বামীর অর্থ উপার্জনের পরিমানের উপর। আর্দশহীনা এ সমস্ত নারী স্বামীর অর্থ উপার্জনের সামর্থ যা থাকনা কেন তাদের বিলাস ব্যসনের জন্য কালার টিভি, ভিসিয়ার, ফ্রিজ, দামী আসবাপত্র, বিদেশী কসমেটিকস্ ও ফ্যাশন সামগ্রী সংগ্রহ করার জন্যে প্রয়োজনে বৈবাহিক সম্পর্কের দোহাই দিতে কশুর করেন না, ছেলে বয়স্ক হলে তাকেও কষ্ট করে লালন-পালন করে বড় করে তোলার অযুহাত দিয়ে তাদের আয়েশী জীবন যাপনের জন্য প্রয়ােজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতে মানসিকভাবে উৎপীড়ন করে থাকেন। তাদের দৃষ্টিত বৈবাহিক সম্পর্ক এবং সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করার একটাই মাত্র উদ্দেশ্য, তাদের বিলাসিতার চাহিদা পূরণ করা। এর বাইরে সন্তান এবং স্বামীর আর কোন কিছু করার নেই। তাই দেখা যায়, স্বামী আর্থিক অনটনের জন্যে ভিসিয়ার, টিভি বা পছন্দের শাড়ী কিনে দিতে পারেনি বলে স্ত্রী দাম্পত্য জীবনের ইতি টানছেন অথবা অভিমানে আত্মহত্যা করছেন। কোন কোন স্বামী বেচারা দাম্পত্য কলহ থেকে বাচার জনাে স্বীর আব্দার পূরণে সততাকে বিসর্জন দিয়ে বিকল্প ধান্ধার প্রতি ঝুকে পড়ছেন।

 

        এই হীন মানসিকতা সম্পন্ন সমাজ মানুষের মর্যাদা পরিমাপ করে তাৱ গাড়ী, বাড়ী, ব্যাংক ব্যালেন্সের নিক্তিতে। যে যতখানি বৈষয়িক উন্নতি ঘটাতে পারবেন, পরিবারের মা, বােন-স্ত্রী এবং সমাজের অন্যান্যদের পক্ষ থেকে ততখানি স্নেহ ভালবাসা, সম্মান প্রতিপত্তি লাভ করবেন। আমাদের সমাজের মানুষের এই লোভ, অর্থ লিপসা, ব্যক্তি কেন্দ্রীক চিন্তা-চেনার জন্যে দেশ ও ইসলামের সেবার জন্যে তাদের দায়িত্ব পালন করে না, অন্যকেও পাগলামী ও অর্থহীন বলে এ কাজ থেকে বিরত রাখে। পারিবারিক অংগনের এই চেতনাহীন শিক্ষার মাধ্যমে যে নাগরিক শ্রেণী গড়ে উঠেছে তাদের দ্বারা সমাজ, রাষ্ট্র বা ইসলামের অপকার  বৈ কোন উপকার হয় না। এরা সারাটি জীবন দেশের সম্পদ অযথা এক স্থানে পুঞ্জিভূত রেখে নিজেকে ভােগ-বিলাস, অপব্যয়, অপচয়ে মত্ত হয়, দেশকে দ্রুত অর্থনৈতিক ভাবে দেউলিয়ায় পরিণত করে।

 

        জাতির চেতনার দুর্গে এহেন অধঃপতন জাতি হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে আমরা অবহেলার পাত্র, অপাংক্তেয় বলে বিবেচিত। দশ কোটি মুসলমানের এই দেশে কিন্তু ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে সার্বিক জিহাদ চালানাের মানসিকতার অধিকারী ১০০০ মুজাহিদও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। অথচ বিশ্বে অব্যাহতভাবে যে হারে মুসলিম নিধন চলছে, ইসলামের ওপর আঘাত হানা হচ্ছে তাতে ইসলামী আদর্শের দাবী অনুযায়ী কমপক্ষে দশ লক্ষ মুজাহিদ এদেশ থেকে বিশ্বের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়াই ছিল মুসলিম দেশের সত্যিকার পরিচয়ের বাহক কিন্তু বঙ্গ সন্তানের তাদের মা-বোনের নিকট থেকে সে চেতনা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইসলামের পক্ষে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করার প্রেরণা পায়নি, মৃত্যুকে ভয় করার শিক্ষাই পেয়েছে বলে আমাদের এমন দৈন্যতা, এমন দুর্বলতা আমাদের চরিত্রে।

 

        আমাদের জাতিকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এই সর্ব প্রথম আমাদের নারী সমাজকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে আমাদের বিপ্লবী জাতীয় চেতনা ও তাদের মনের সকল সংকীর্ণতা, আত্মকেন্দ্রীক চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলে ইসলামের অগ্রগতির জন্য সর্বস্ব উৎসর্গ করার মহান ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদের বলতে হবে, জাতির জন্য, ইসলামের জন্য যে মায়ের সন্তান কুরবানী হয় সে মরে না, সে বেঁচে থাকে জাতির প্রতিটি মানুষের অন্তরে, সে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত বলে গণ্য হয়, তাঁর শহীদী খুনের ন্যায় পবিত্র পৃথিবীতে আর কোন জিনিস নেই। প্রতিটি মা-বােনকে বলতে হবে, যে জাতির মা-বােনেরা তার আদৱেৱ ছেলেকে, প্রিয়তম স্বামীকে জাতির কল্যাণে, আজার্দী রক্ষায় আল্লাহর পথে উৎসর্গ করতে সংকোচ বােধ করে সে জাতির ভাগ্য লেখা হয় কলংকের কালি দিয়ে। যে জাতির মায়েরা সন্তানকে, বোনেরা স্বামীকে সত্যের পথে লড়াইয়ে বুক পেতে বুলেট গ্রহণ করতে উদ্ভুদ্ধ করতে পারে না, সে জাতি আজাদী বর্বর, রক্তপিপসু জ্বালিমের দ্বারা পদদলিত হয়, বৃদ্ধ পিতা হয় মজলুম, মা-বোনেরা তাদের পবিত্র ইজ্জতকে নিরাপদ রাখতে পারে না। এটাই ইতিহাস।

 

        সুতরাং আমাদের জাতির অগ্রগতির জন্য চাই সর্বপ্রথম নারী জাতির চেতনার দুয়ারে আঘাত হানা। তাদের ভ্রান্ত জীবন দর্শনকে পাল্টে দিয়ে জাতির প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। কোথায় সেই নকীবের কাফেলা, যার ডঙ্কা ধ্বনি বাজিয়ে আমাদের মাতৃজাতিকে গাফেলি ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবেন।

 

═──────────────═