যাকাত সম্পর্কিত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও তার সংশোধন
মাওলানা আশরাফ আলী থানুভী রহ.
====================================================================
দৈহিক ইবাদাত সমুহের মধ্যে নামায যেমন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেমনি আর্থিক ইবাদতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলাে যাকাত। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন জায়গায় “নামাজ কায়েম কর” এর পাশাপাশি “যাকাত প্রদান কর” উল্লেখ থাকাতে একে নামাযের সমপর্যায়ের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একারণে এই গুরুত্বপূর্ণ এবাদতের মধ্যে ত্রুটি- বিচ্যুতি সম্পর্কে অবগতি লাভ করা একান্ত জরুরী। নিম্নে সংক্ষেপে কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হলােঃ
১। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলাে, অনেক ধনী-মালেকে নেছাব যাকাত প্রদান করে না। বিষয়টার গুরুত্ব সম্পর্কে তারা চিন্তা করে না। এ ত্রুটি সংশােধনের পদ্ধতি হলাে, যাকাত ফরয ইবাদত এবং একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আমল হওয়ার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে যে সব আলােচনা রয়েছে এবং যাকাত প্রদান না করার পরিণামে যেসব ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে তা গভীরভাবে মনােযােগ সহকারে নিজে পাঠ করা বা অন্যের মুখ থেকে শ্রবণ করা এবং যাকাত প্রদানে অনিহার মূল কারন কৃপণতা দূর করার চেষ্টা করা। কৃপণতা দূর করার অর্থ হলাে, সম্পদের মােহ কমানাে। সম্পদের মােহ কমানাের সব চেয়ে বড় ব্যবস্থা হলাে, মৃত্যুকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করা ও স্মরণে রাখা।
আর যদি যাকাত প্রদান করাকে ফরয বলে স্বীকার না করাই এর মূল কারণ হয় তাহলে অভিজ্ঞ আলিমদের সাথে আলাপ করে এরূপ বিশ্বাস সমূলে দূর করা চাই। নতুবা ফরয অস্বীকারকারী হিসাবে সে কাফির বলে গণ্য হবে।
২। আরেকটি ত্রুটি হলাে, অনেকে যাকাত দেয় ঠিক, কিন্তু হিসাব করে দেয় না। বরং নিজের ইচ্ছানুযায়ী অনুমান করে যাকাত দেয়। বস্তুত এইরূপ দেয়া আর না দেয়া প্রায় সমান কথা। কারণ যেমন ধরুন, এক হাজার টাকার যাকাত আসে পচিশ টাকা-এমতাবস্থায় দশ টাকা যাকাত আদায় করলে মাত্র চার শত টাকার যাকাত আদায় হলাে, ছয়শত টাকার যাকাত অনাদায়ী রয়ে গেল। সুতরাং এটা হলাে সেই ব্যক্তির মত যার কাছে আছেই মাত্র ছয়শত টাকা আর সে যাকাত মােটেই আদায় করল না। অর্থাৎ এই ব্যক্তি এবং ওই ব্যক্তি যে ছয়শত টাকার যাকাত মােটেই আদায় করল না সমান অপরাধে অপরাধী।
কোন ধরনের সম্পদের যাকাত দিতে হয়?
৩। একটি ত্রুটি হলাে, অনেকে কিছু সম্পদের যাকাত দেয় আর কিছু সম্পদের যাকাত দেয় না। এর প্রধান কারণ হলাে তাদের অজ্ঞতা। কোন্ কোন্ সম্পদে যাকাত হয় তারা তা জানে না। এ বিষয়ে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলােকপাত করা হলােঃ
প্রথমতঃ স্বর্ণ রৌপ্য। হউক তা মুদ্রা আকারে অথবা অলংকার রূপে কিংবা তা স্বর্ণের মুণ্ড আকারে রক্ষিত থাকুক। আর তা নিজের কাছে থাকুক বা অন্যের কাছে থাকুক। অবশ্য অন্যের নিকট থাকলে তা হস্তগত করা এবং তদ্বারা উপকৃত হওয়া সম্ভব বলে বিবেচিত হতে হবে। সােনা-চাদী যদি ঋণরূপে অন্যের হাতে থাকে তাহলে মালীক এতটুকু সুবিধা পাবে যে, সে অন্যান্য সম্পদের সাথে এর যাকাত আদায় করতে পারবে অথবা অন্যান্য সম্পদের যাকাত পৃথক আদায় করে দিবে এবং ঋণের অংশ যখন যতটুকু উসুল হবে ততটুকুর যাকাত আদায় করতে থাকবে। কিন্তু সম্পূর্ণ সম্পদ উসুল হওয়ার পর যাকাত দিলে ঋণে থাকা অতীতের সবগুলাে বছরের সমগ্র টাকার যাকাত আদায় করতে হবে। যেমন ঋণ প্রদানের দু'বছর পর যদি একশত টাকা আদায় হয়, তাহলে বছরে আড়াই টাকা হারে দুই বছরের পাঁচ টাকা যাকাত আদায় করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ ব্যবসার মাল। অর্থাৎ সেসব জিনিস বিক্রয় করার নিয়তে ক্রয় করা হয়। এ ব্যাপারে স্থাবর অস্থাবরের মধ্যে কোন ব্যবধান নেই। যেমনঃ অনেকে সুযােগ মত ঘরবাড়ী বা জায়গা জমি ক্রয় করে পরে লাভজনক মূল্য তা বিক্রয় করে। এটাকে ব্যবসার মাল বলে গণ্য করা হবে। ফলে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে।
পক্ষান্তরে যে জিনিস ক্রয় করার সময় বিক্রয়ের নিয়ত থাকেনা- এ পর্যায়ে পরে বিক্রি করার নিয়ত করলেও তা ব্যবসার মাল বলে গণ্য হবে না এবং তার যাকাতও ওয়াজিব হবে না। অনুরূপভাবে ব্যবসার নিয়তে ক্রয় করার পরে বছর পূর্তির আগেই যদি নিয়ত পবির্তন হয়ে যায়, তাহলে সেই মাল ও ব্যবসার মাল বলে গণ্য হবেনা! তাতেও যাকাত ওয়াজিব হবে না। তদ্রপ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মালের মালিক হওয়ার সময় কিংবা উৎপন্ন ফসল ঘরে তােলার সময় তা ব্যবসা বা লাভবান হওয়ার নিয়ত থাকলেও তা ব্যবসার মাল বলে গণ্য হবে না এবং তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না।
তৃতীয়তঃ গবাদি পশু যা প্রজনন বা পশু উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়, যেমনঃ অনেকে বকরী, গাভী, মহিষ বা ঘােড়া পুষে থাকে। এগুলাের আহকাম ও শর্তাবলী বিস্তর ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। ফেকাহ শাস্ত্রের বিভিন্ন কিতাবে এর বিধান দেখে নেয়া যেতে পারে।
চতুর্থতঃ উশরী জমির উৎপন্ন ফসল। যে জমির মালিক এখন মুসলমান এবং ইতিপূর্বে তা কোন কাফিরের মালিকানায় ছিল বলে প্রমাণ নেই- একে উশরী জমি বলা হয়। এই উশরী জমিতে কিছু উৎপন্ন হবে তার যাকাত দিতে হবে। এই যাকাতকে উশর বলা হয়। যদি বৃষ্টির পানি দ্বারা সেচ করে চাষ করা হয় তাহলে দশ ভাগের একভাগ আর খাল বা কুপের পানি দ্বারা সেচ করা হলে ওই জমির উৎপাদিত ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত হিসেবে দিতে হবে।
যাকাতের হিসাবে ভুল করা
৪। আর একটি ত্রুটি হলাে এই যে, অনেকে হিসাব করেই যাকাত আদায় করে বটে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সেই হিসাবে ভুল হয়ে থাকে। যেমনঃ কোন ব্যক্তি ব্যবসার জন্য পাইকারী মূল্যে কিছু কিতাব ক্রয় করল। কিংবা নিজস্ব প্রেসে কোন বই ছাপালাে। তার ক্রয় কিংবা মুদ্রন বাবদ ব্যয় হলাে এক হাজার টাকা। কিন্তু বাজারে তার বিক্রয় মূল্য দুই হাজার টাকা। এমতাবস্থায় তাকে দুই হাজার টাকারই যাকাত প্রদান করতে হবে। কিন্তু অনেকে এক্ষেত্রে ভুল করে, বিক্রয়মূল্য না ধরে ক্রয় মূল্য বা ছাপা খরচ হিসাবে মাত্র একহাজার টাকার যাকাত প্রদান করে থাকে। এক্ষেত্রে দুই হাজার টাকায় পঞ্চাশ টাকা যাকাত না দিয়ে খােদ কিতাবের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ দিয়ে দিলেও যাকাত আদায় হবে। যেমনঃ চল্লিশটি হেদায়া থেকে একটি হেদায়া বা সমমূল্যের অন্য কোন কিতাব দিয়ে দিলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
যাকাতের হিসাবে ভুল করার আরেকটি দৃষ্টান্তঃ
অধিকাংশ যাকাত প্রদানকারীর অভ্যাস হলাে অধিক সওয়াবের আশায় তারা রমযান মাসে যাকাত আদায় করে। অতঃপর রমযানের পর হতে নতুনভাবে হিসাব করে। এতে কখনাে এমন হয় যে, নেসাবের মালিক হওয়ার তারিখ থেকে যে বছরটি শুরু হলাে রমযানের তিন চার মাস পূর্বেই তা শেষ হয়ে যায়। ফলে রমযান থেকে হিসাব করার কারণে এই তিন চার মাস অনাদায়ী থেকে যায়। আবার অনেক সময় এমন হয় যে, নেসাবের বছর সমাপ্ত হয় রমযানের তিন চার মাস পরে। তখন রমযান মাসে যাকাত আদায় করে অগ্রিম দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যায় বলে মনে করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ভুল হয় যে, রমযানে যাকাত দেয়ার সময় শুধু সেই সম্পদেরই যাকাত আদায় করে যা তখন মালিকানায় থাকে। অথচ এই সম্ভাবনাও তাে উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, বছর পূর্তির বাকী তিন চার মাসের মধ্যে নেসাব আরাে বেড়ে যাবে এবং প্রকৃত পক্ষে যাকাত সেই বর্ধিত অংশসহ ওয়াজিব হবে। এমতাবস্থায় রমযান মাসেই যাকাত দিয়ে দিলে পরবর্তীতে বর্ধিত অংশের যাকাত অনাদায়ী থেকে যায়।
এভাবে যাকাতের হিসাবে গরমিল হয়ে যায়। যেমন ধরুন, কারাে নেসাবের বছর পূর্ণ হওয়ার ছিল রজব মাসে আর তখন তার কাছে ছিল এক হাজার টাকা- যার যাকাত আসে পঁচিশ টাকা। কিন্তু রমযানের অপেক্ষায় রজব মাসে সে যাকাত দিল না এবং রমযান মাসে কমে তা আট শত টাকায় চলে আসলাে। এখন যদি সে রমজান মাসে হিসাব করে নেসাব অনুযায়ী বিশ টাকা আদায় করে তাহলে আরাে পাঁচ টাকা তার যিম্মায় থেকে যায়। তদ্রুপ কারাে বছর শেষ হওয়া ছিল যিলহজ্জ মাসে। রমযান মাসে তার কাছে ছিল আটশত টাকা, আর জিলহজ্জ মাসে হলাে এক হাজার টাকা, তাহলে রমযান মাসে অগ্রিম যাকাত আদায় করলে এক্ষেত্রেও হুবহু পূর্বের ন্যায় গরমিল হয়ে যাবে। আর এভাবে আদায় করলে প্রতি বছর তার হিসাবে একটা গরমিল হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে।
মনে করুন, ঘটনাক্রমে কারাে পাঁচ বছর পর্যন্ত এ ধরনের গরমিল হতে থাকলাে যে, বছর শেষে থাকে হাজার টাকা রমযানে তা হ্রাস পেয়ে হয় আটশত টাকা। এভাবে আটশত টাকার হিসাবে বিশ টাকা করে যাকাত দেয়া হলে প্রতিবছর পাঁচ টাকা করে পাঁচ বছরে পঁচিশ টাকা তার যিম্মায় অনাদায়ী রয়ে গেল। এমতাবস্থায় ব্যাপারটি এমন হলো, যেন সে পাঁচ বছরের মধ্যে চার বছরের যাকাত দিল আর এক বছরের দিল না। তাই লক্ষ রাখতে হবে, যাকাত রমযান মাসে আদায় করলেও বছর শেষ হওয়ার সময় নেসাব কি পরিমাণ ছিল অবশ্যই তা হিসাব করে দেখবে এবং তাতে কত টাকা যাকাত আসে তা স্মরণ রাখবে। অতঃপর বছর রমযানের পূর্বে শেষ হলে রমযান মাসে তদনুযায়ী যাকাত আদায় করবে। আর বছর রমযানের পরে শেষ হলে রমযানে কত টাকা দেয়া হলাে, তার হিসাব রাখবে। অতঃপর বছর শেষ হওয়ার পর হিসাব করে যে পরিমান যাকাত আসে পূর্বের দেয়া যাকাতের অংক এর সাথে মিলিয়ে হিসাব করে পরিশােধ করবে। যদি হিসাবে আরাে কিছু অনাদায়ী থেকে যায় তাে তা আদায় করে দিবে। আর যা দেয়া হয়েছে যদি তা ওয়াজিবের তুলনায় বেশী হয়ে থাকে তাহলে তা পরবর্তী বছরের যাকাতের সাথে যােগ করে নিবে।
যাকাত উপযুক্ত খাতে না দেয়া
৫। যাকাত আদায়ের ব্যাপারে আরেকটি ত্রুটি হলাে, অনেক লােক যাকাতের অর্থ বা সম্পদ উপযুক্ত শরয়ী খাতে ব্যয় করে না।
যেমন অনেকে যাকাতের অর্থ তাদের নিজেদের পীর সাহেবকে দান করে-যিনি ধনী- মালেকে নেসাব। অনেকে আবার যাকাতের অর্থ বেতন বাবদ মসজিদের ইমাম মুয়াযযিনকে প্রদান করে। অনেকে চাঁদা বাবদ তা মাদ্রাসায় দিয়ে দেয়। কিন্তু এই টাকা মাদ্রাসায় দেয়ার সময় মুহতামিম সাহেবকে সে এ ব্যাপারে অবহিত করে না যে, এটা যাকাতের টাকা। ফলে যাকাতের অর্থ মাদ্রাসার গৃহনির্মাণ, কিতাব ক্রয় বা শিক্ষকদের বেতন আদায় কল্পে ব্যয়িত হয়। অনেকে আবার যাকাতের অর্থ মুর্দারের কাফন-দাফনে ব্যয় করে। এর কোন অবস্থাতেই যাকাত আদায় হয় না। বরং পূর্বের ন্যায় তার যিম্মায় থেকে যায়। অনুরূপভাবে অনেকে এমন লােকদেরকে যাকাত দান করে যারা যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত নয়।
এরূপ অনুপযুক্ত কাউকে যাকাত দিয়ে ফেলে। তখন যে নিয়েছে তার দায়িত্ব হলাে যাকাত দাতাকে তার সম্পর্কে এই বলে অবহিত করা যে, সে যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত পাত্র নয়। যাকাতের টাকা জেনেও তা এরূপ কারাে জন্য গ্রহণ করা আল্লামা শামীর মতে সম্পূর্ণ হারাম। আর যদি যাকাত গ্রহনকারী ভাবে বুঝতে পারে যে, যাকাত দাতা জানে না যে সে যাকাতের উপযুক্ত নয়, তাহলে যাকাতদাতাকে তখন তার সম্বন্ধে অবহিত করা ওয়াজিব। এ পর্যায়ে প্রকৃত অবস্থা গােপন রাখা বা চুপ করে থাকা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। এমন কারাে যাকাত গ্রহণ করার কথা যাকাত দাতা জানতে পারলে পুনরায় তাকে ওই পরিমাণ যাকাত অবশ্যই আদায় করতে হবে। তবে মাইয়্যেতের নিকটবর্তী তার কোন গরীব আত্মীয়কে যাকাতের অর্থ প্রদান করা হলে যদি সে বাধ্য হয়ে বা চাপে পড়ে নয় বরং সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় খুশী মনে তদ্বারা কাফনের কাপড় খরীদ করে এনে দেয় তাহলে তা জায়েয হবে। অনুরূপভাবে ইমাম মুয়াযযিন গরীব হলে নির্ধারিত বেতনের বাইরে তাদেরকে যাকাতের অর্থ দেয়া যেতে পারে। অবশ্য দু'টি শর্তে যাকাতের অর্থ মাদ্রাসায়ও প্রদান করা যায়। প্রথমতঃ দেয়ার সময় মুহতামীম সাহেবকে বলে দিতে হবে যে, এগুলাে যাকাতের অর্থ। দ্বিতীয়তঃ দাতাকে এব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে যে, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তার দেয়া যাকাতের অর্থ
উপযুক্ত খাতেই ব্যয় করবে। কিন্তু যদি দেয়ার সময় মুহতামিমকে অবহিত না করা হয় কিংবা সঠিক মাসআলা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অথবা অন্য কোন কারণে যদি উপযুক্ত খাতে ব্যয় করবে বলে মুহতামিমের প্রতি আস্থা না থাকে তাহলে এমন ব্যক্তির হাতে তা দেয়া জায়েয হবে না।
মােটকথা, যে ক্ষেত্রে যাকাত দিলে ব্যক্তি বিশেষ তার মালিক হয় না, যেমনঃ মসজিদ বা মাদ্রাসার ঘর নির্মাণ বা চাটাই খরিদ করার কাজে ব্যয় করা বা কাফন খরীদ করে মুর্দাকে পরিয়ে দেয়া কিংবা ব্যক্তি বিশেষ মালিক হয় ঠিকই কিন্তু সে যাকাত গ্রহনের উপযুক্ত পাত্র নয়, যেমন মালেকে নেসাব বা বণী হাশেম অথবা কাজের পারিশ্রমিক রূপে দান করা ইত্যাদি এর কোনটিই যাকাতের খাত নয় বিধায় যাকাত আদায় হবে না। দিয়ে ফেললে পুনরায় তা আদায় করতে হবে।
অনেক লােক যাকাতের অর্থ মসজিদ কিংবা মাদ্রাসার সাধারণ কাজে ব্যয় করার ক্ষেত্রে এরূপ হীলা করে থাকে তারা প্রথমে যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত কোন মিসকীনকে এই চুক্তিতে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে বুঝিয়ে দেয় যে, আমি তােমাকে একশত টাকা দিব আর তুমি তা মসজিদ কিংবা মাদ্রাসায় দিয়ে দিবে। অতঃপর যাকাতের সেই অর্থ তাকে প্রদান করা হয় আর সে তা মসজিদ বা মাদ্রাসায় দিয়ে দেয়। একে পরিভাষায় ‘হীলায়ে তামলীক’ বা 'মালিক বানানাের কৌশল' বলা হয়। এ ক্ষেত্রে যেহেতু একথা নিশ্চিত যে, সেই মিসকীনকে প্রকৃত মালিক বানানাে দাতার উদ্দেশ্যে নয় বরং তাকে মালিক বানানাের একটা বাহানা করা হয় মাত্র। তাই এই পদ্ধতিতে যাকাত আদায় হবে কিনা তা বলা মুশকিল।
তাছাড়া এ পদ্ধতিতে আরেকটি অসুবিধা হলাে, এভাবে যাকাতের অর্থ যাকে দেয়া হয় সে একরকম বাধ্য হয়ে তা ফেরত দেয়। অথচ অন্যের সম্পদ ভােগ করা হালাল হওয়ার জন্য যে দানের বেলায় মালিকের প্রসন্ন হৃদয়ে দান করা শর্ত-এখানে তা উপস্থিত নয়। তাই এভাবে দেয়া-নেয়া দু’টোতেই অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায় এবং তা গ্রহণ প্রদানের বিশুদ্ধ রীতিতে অনুকূলে নয়। অনেকের মনে আবার এই সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে, শরীয়াতের বিধানতাে বাহ্যিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে কার্যকরী হয়। সুতরাং এ পদ্ধতিতে আপত্তির কি আছে? এ প্রসঙ্গে আমি বলব, বাহ্যিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে শরীয়তের বিধান কার্যকরী হওয়ার অর্থ হলাে- মনের গােপনীয় কথা অনুসন্ধানের নিষ্প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু অনুসন্ধান ছাড়াই যদি কারাে মনের খবর জানা যায় তখন তাে এরূপ প্রশ্নের কোন অবকাশই থাকে না। তাই এরূপ ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় যে, গ্রহণ-প্রদানের বেলায় আন্তরিক প্রসন্নতা মােটেই থাকে না। এইরূপ অপ্রসন্ন হৃদয়ের দানও যে গ্রহণযােগ্য হবে তা শরীয়াতের কোন কিতাবে লিখিত হয়েছে? যদি তাই হয় তাে অন্যের সম্পদ গ্রহণ ও ব্যবহার করা হালাল হওয়ার জন্য শরীয়াত দাতার আন্তরিক প্রসন্নতার শর্ত আরােপ করল কেন?
যদি কখনাে যাকাতের অর্থ দ্বারা এভাবে কারাে সাহায্য করতেই হয় তাহলে অন্য একটি গ্রহণযােগ্য পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে। যা সম্পূর্ণরূপে শরীয়াতের বিধিসম্মত। তাহলাে- কোন মিসকীনকে এই পরামর্শ দেয়া যে, তুমি কারাে থেকে ঋণ করে অমুক ব্যক্তিকে বা অমুক মাদ্রাসায় দশটি টাকা দান কর। ওই ঋণ আদায়ের ব্যাপারে আমি তােমাকে সহযোগিতা করব। এ পরামর্শে সম্মত হয়ে যদি সে ঋন করে তাহলে যাকাতের অর্থ থেকে তাকে দশ টাকা প্রদান করলে পাওনাদার তার থেকে নিজের পাওনা উসুল করে নিবে। এ পদ্ধতিতে মিসকীনকে দেয়ার ব্যাপারে কোন ঘাপলা থাকে না এবং সদকা দেয়ার জন্যও তাকে বাধ্য করার প্রশ্নেরও কোন অবকাশ থাকে না। কারণ এ প্রস্তাব গ্রহণ করা ও না করার ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। পক্ষান্তরে হীলায়ে তামলীকের মিসকীন যদি পূর্বের কথা অনুযায়ী টাকা হাতে পেয়ে আর না দেয় তা হলে পরস্পরে মনমালিন্য এমনকি বিবাদ-বিসম্বাদের সম্ভাবনাও থেকে যায়।
আলােচ্য পদ্ধতিতে পাওনাদার মিসকীন থেকে জোর করেও তার পাওনা আদায় করে নিতে পারে। আর যেহেতু যাকাতের অর্থ প্রদানের পর এক্ষেত্রে মিসকীন সত্যিকার অর্থে তার মালিক হয়ে যায়। তাই জোর করেও তার থেকে টাকা আদায় করায় কোন দোষ নেই। তার থেকে সে টাকা জোর করে আদায় করাও সহজ। কেননা সে ঋণী এবং ঋণদাতার অধিকার আছে ঋণ আদায়ে চাপ সৃষ্টি করার।
যাকাত দ্বারা দুনিয়াবী স্বার্থ উদ্ধার করা
৬। একটি ক্রটি এই যে, অনেক লােক যাকাত দ্বারা দুনিয়াবী স্বার্থ উদ্ধার করে থাকে যা সম্পূর্ণরূপে এখলাস পরিপন্থী। যেমনঃ নিজের অধীনস্থ কর্মচারীদেরকে এই খেয়ালে যাকাত দেয়া যে, এতে সে তার বেশী অনুগত হবে এবং কাজও বেশী করবে। এমতাবস্থায় কাজে অমনযােগী হলে অনেকে বলে ফেলে যে, নিমকহারাম! তােকে মাস গেলে বেতন দেই, যাকাত দেয়ার সময়ও তাের কথা ভুলি | না- এসবই তুই ভুলে গেছস! ইত্যাদি। এক্ষেত্রে বিধান অনুযায়ী যাকাত আদায় হয়ে যায় বটে কিন্তু আল্লাহর দরবারে তা কবুল হয় না।
যাকাত না দেয়ার বাহানা
এ যাবত যে ক'টি ত্রুটির কথা বলা হলাে তন্মধ্যে যাদের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ত্রুটি রয়েছে তারা যাকাত না দেয়ার ব্যাপারে কিংবা কম দেয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। যেমনঃ
অনেকে বলে, এভাবে যদি যাকাত দিতেই থাকি তাে কিছু সম্পদতাে এমন আছে যা শেষ হয়ে যাবে। যেমনঃ জমা করা টাকা-যদ্বারা ব্যবসা করা হয় না এবং তা অনর্থক জমা করে রাখা হয়েছে। কিংবা এমন অলংকার যা কোন কাজে খাটান হচ্ছে না। এ ধরনের জমা টাকা বা গুঁজে রাখা অলংকার থেকে যদি প্রতি বছর কিছু কিছু করে যাকাত দিতে থাকি তাে একদিন তা শেষই হয়ে যাবে। এর উত্তর হলাে, টাকা গুলাে কেন অনর্থক জমা করে রাখা হয়েছে? এই টাকা দ্বারা ব্যবসা করতে কেউ তাকে নিষেধ করেছে কি? কেউ যদি জমা টাকা দ্বারা ব্যবসা না করে বা অলংকার দ্বারা আর্থিকভাবে উপকৃত নাহয়ে সিন্দুকে বন্দী করে রাখে সে জন্য কি শরীয়াত দায়ী হবে? মূলত সােনা-চাদীর সৃষ্টি একমাত্র অলংকার তৈরীর জন্য নয় বরং মানব সভ্যতার আদি এ থেকে মৌলিকভাবে এগুলােই লেন-দেন ও ব্যবসার নিয়ামক শক্তি। আর অলংকার আপনি নিজের ইচ্ছায়-মনের খুশীতে তৈরী করিয়েছেন-এ জন্য শরীয়ত দায়ী নয়। অলংকারের যাকাত দিতে যদি কারও আপত্তি থাকে তাে তার তা ভাঙিয়ে ব্যবসা করা উচিত। ফলে তার লভ্যাংশ থেকেই যাকাত আদায় করতে পারবে এবং এটাই সহজ বুদ্ধি।
আরেকটি বাহানা এই দেখানাে হয়, দোকানে বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন মূল্যের মাল থাকে। এমতাবস্থায় হিসাব করা একটা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফলে হিসাব আর করাই হয় না। এর সমাধান হলাে, প্রত্যেক দোকানে ক্রয় বিক্রয়ের হিসাব রাখা উচিত। এতে বছরের শেষে পাকাপাকি হিসাব করে যাকাত দেয়া সহজ হয়। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে অনুমানিক হিসাব করতে হবে যে, দোকানে কত টাকার মাল আছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা অনুমান করে যা সিদ্ধান্ত দিবে সাবধানতার খাতিরে তার চেয়ে আরেকটু বেশী ধরে নিলেই হয়। যেমন, যদি আনুমানিকভাবে যাকাত আটশত টাকা স্থির করা হয় তাহলে সাবধানতা বশত এক হাজার টাকা ধরে নিতে হবে। এতে অনুমানে ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও তিরােহিত হয়ে যায়।
আর অতিরিক্ত দুইশত টাকার যাকাত আসে মাত্র পাঁচ টাকা-যা কোন ব্যবসায়ীর পক্ষে আদায় করা মােটেই কষ্টকর নয়। অনুরূপভাবে সোনা-চাদীতে যদি ভেজাল থাকে তখনও অনুমানই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে। আরেকটি বাঁহানা হলাে-অনেকে বলে; জনাব! আমাদের সম্পদই তাে হালাল নয়, হারাম সম্পদে তাে যাকাত হয় না। এর উত্তর হলাে, হারাম মালে যাকাত হয়না একথা ঠিক নয়। বস্তুতঃ হারাম মাল যদি হালাল মালের সাথে মিশে যায় তবে তাও মালিকানায় এসে যায়। যদিও তা অবৈধ। উপরন্তু যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য মালিকানা শর্ত হালাল হওয়া শর্ত নয়। তবে আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্য হালাল হওয়া শর্ত। অতএব হারাম মালে যাকাত ওয়াজিব হবে কিন্তু তা কবুল হবে না।
এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, কবুলই যখন হবে না তাে দিয়ে লাভ কি? জবাব হলাে, এর যাকাত না দিলে ওয়াজিব আদায় না করার যে গুনাহ হতাে আদায় করে দিলে অন্তত এই পাপের শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আর কবুল না হওয়ার অর্থ সওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকা। এবার বলুন, আযাব হওয়া আর সওয়াব না হওয়া কি এক কথা? তবে হারাম উপার্জনের জন্য যে শাস্তি হবে সে কথা আলাদা। কিন্তু যাকাত না দিলে দু'টি শাস্তি ভােগ করতে হবে।
প্রথমতঃ হারাম পন্থায় উপার্জনের জন্য,
দ্বিতীয়তঃ যাকাত না দেয়ার জন্য। আর যাকাত দিলে প্রথমটির শাস্তি হবে দ্বিতীয়টির নয়।
খারাপ মাল দ্বারা যাকাত দেয়া
৭। যাকাত প্রদানের ব্যাপারে আরেকটি ত্রুটি হলাে, অনেকে যাকাত স্বরূপ তার ব্যবসার খারাপ ও অচল মালগুলাে প্রদান করে। যেমন কোন পুস্তক ব্যবসায়ী ভালাে পুস্তকের দামে এমন একটি খারাপ পুস্তক প্রদান করে যার মূল্য যাকাতের পরিমাণের তুলনায় কম হয়। কিংবা কাপড়ের ব্যবসায়ী ভালাে কাপড়ের দামে পুরাতন থান থেকে যাকাত দেয় এবং খাদ্য শস্য ব্যবসায়ী ভালাে শস্যের দামে এমন শস্য দিলে যার দাম ভালাে শস্যের সমান নয় ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে যে মাল দেয়া হলাে, যদি তা বাজার মূল্য অনুযায়ী যাকাতের পরিমাপের চেয়ে কম হয়। তাহলে তার সম্পূর্ণ যাকাত আদায় হবে না। বরং যতটুকু কম হবে ততটুকু তার যিম্মায় থেকে যাবে। আর যদি খারাপ মালের মূল্য যাকাতের অংকের পরিমাণ হয় ও, তবুও এখলাসের ঘাটতির কারণে তা কবুল হওয়ার ব্যাপারে ত্রুটি থাকার আশংকা মােটেই অবান্তর নয়।
দাওয়াত করে খাওয়ানাের মাধ্যমে যাকাত আদায় করার হুকুম
যাকাত আদায় করার ব্যাপারে একটি ত্রুটি হলাে এই যে, অনেকে যাকাতের অর্থ বা শস্য দ্বারা খাদ্য রান্না করে তা গরীব-মিসকীনদেরকে দাওয়াত করে খাওয়ায়। এক্ষেত্রে যদি খাদ্য রান্না করে তা তাদের হাতে তুলে দিয়ে এই অধিকার দিয়ে দেয়া হয় যে, তােমরা ইচ্ছা হলে তা নিয়েও যেতে পার এবং ইচ্ছা হলে বসে পেট ভরে খেয়েও যেতে পার-উপস্থিত সকল আমন্ত্রিত মিসকীনকে এই অধিকারের কথা জানিয়ে দেয়া হয়। আর যদি সেই রান্না করা খাদ্যের মূল্য যাকাতের পরিমাণ হয় তাহলে নিশ্চিত ভাবে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে যদি তাদেরকে তা নিয়ে যাওয়ার অধিকার দেয়া না হয় বরং বসে খেয়ে যেতে বাধ্য করা হয়, তাহলে যাকাত আদায় হবে না।
অনুরূপভাবে রান্না করা খাদ্যের মূল্য যদি যাকাতের সমপরিমাণ না হয়-যত পরিমাণ যাকাত যিম্মায় ওয়াজিব ছিল, তাহলে তার যাকাত সম্পূর্ণ আদায় হবে না। যেমন কারাে যিম্মায় বিশ টাকা যাকাত দেয়া ওয়াজিব। এই বিশ টাকার কিছু ব্যয় হলাে রান্নার সামগ্রী ক্রয় বাবদ। কিছু ব্যয় হলাে, বাবুর্চির মজুরী বাবদ। কিন্তু রান্না করা খাদ্যের মূল্য ইনসাফের দৃষ্টিতে বিশ টাকার অপেক্ষা কম হয়ে গেছে। যেমনঃ দ্রব্য ক্রয়ে ঠকানাে হয়েছে। অথবা বাবুর্চির মজুরী অতিরিক্ত বেশী দেয়া হয়েছে অথবা কিছু খাদ্য নষ্ট হয়ে গেছে। মােট কথা যেভাবেই হােক প্রস্তুতকৃত খাদ্যের মূল্য বিশ টাকা হয়নি। বরং এতে ব্যয় হয়েছে সতের বা আঠার টাকা। এমতাবস্থায় একথা বলা সংগত হবে না যে, সে পুরো বিশ টাকাই ব্যয় করেছে। বরং এ কথাই ঠিক যে, সে মিসকীনদেরকে সতের বা আঠার টাকার খাদ্যই প্রদান করেছে। এক্ষেত্রে তার সতের বা আঠার টাকারই যাকাত আদায় হবে। বাকী দু'-তিন টাকা তাকে আদায় করতে হবে।
অনুরূপভাবে যদি যাকাতের অর্থ, দ্বারা কাপড় কিনে পোষাক বানিয়ে তা প্রদান করে, তবে পােষাক তৈরী করার পর যদি তার মূল্য যাকাতের অর্থের সমপরিমাণ হয় তাহলে
অবশ্যই যাকাত আদায় হয়ে যাবে। আর যদি কারণ বশতঃ পােষাকের মূল্য যাকাতের সমপরিমাণ না হয় তাহলে যত টাকা কম হবে তত পরিমাণ অর্থ পুনরায় তাকে আদায় করতে হবে।
৯। আরেকটি ত্রুটি হলাে এই যে, যাকাত দেয়ার ব্যাপারে অনেকে এভাবে যাকাত প্রদান করে যে, কেউ হয়তাে কোন গরীব ব্যক্তির কাছে পাঁচ টাকা পাওনা আছে, আর তার যাকাতও পাঁচ টাকা হয়েছে। এমতাবস্থায় সে মনে করে যে, গরীব লােকটির নিকট আমার পাওনা পাঁচ টাকা। এবং আমার যাকাতও যেহেতু পাঁচ টাকা সেহেতু গরীব লােকটির নিকট আমার পাওনা- ঋণ মাফ করে দিলেই হলাে। তার থেকে পাঁচ টাকা আদায় করা আবার তা দান করা এত ঝামেলার দরকার কি? তার নিকট পাওনা ঋণ মাফ করে দিলেই তাে যাকাত আদায় হয়ে গেলাে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এভাবে মাফ করলে যাকাত আদায় হবে না। ব্যাপারটা এতাে সহজ নয়। যেমনঃ যাকাত আদায়ের জন্যে শর্ত হলাে নির্দিষ্ট অংকের টাকা বা কোন নির্দিষ্ট জিনিস কাউকে হাতে হাতে দান করা। যেহেতু এখানে তা করা হয়নি, সেহেতু যাকাত আদায় হয়নি।
এ পর্যায়ে এই পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে যে, প্রথমে যাকাতের পাঁচ টাকা যাকাতের নিয়তেই তাকে দিয়ে দিবে। যখন সে সেই টাকা হস্তগত করে পূর্ণ মালিক হয়ে যাবে তখন তার কাছে পাওনা টাকা তলব করবে। যদি সে দিতে না চায় তাে জোরপূর্বক আদায় করলেও তা জায়েয হবে।
সতর্কতা
১। নেসাবের মালিক হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি ইতিপূর্বে যাকাত আদায় করেনি এখন সামর্থ্য থাকলে পূর্বের যাকাত আদায় করা তার ওপর ওয়াজিব। তবে মাঝে যদি কোন কারণে সম্পদ নষ্ট হয়ে নেসাবের চেয়ে কমে গিয়ে থাকে তাহলে সেই সময়ের যাকাত তাকে দিতে হবে না।
২। যাকাতের নিয়তে সম্পদ পৃথক করে রাখার পর যদি তা খুইয়ে যায়, তাহলে যাকাত আদায় হলাে না। পৃথক করে রাখলে কেবল এতটুকু উপকার হয় যে, দেবার সময় আর নিয়ত করতে হয় না যে, আমি আমার সম্পদের যাকাত দিচ্ছি।
সদকায়ে ফিতর ও কুরবানীর চামড়া
যেহেতু সদকা ফিতর আদায় করা এবং বিক্রয় করার পর কুরবানীর চামড়ার মূল্য সদকা করা ওয়াজিব, সেহেতু এই দু'টি বিষয়ও যাকাতের সাথে সম্পর্কিত। অতএব যাকাতের সাথে সাথে এই দুটি বিষয়ের ক্রটি বিচ্যুতি সম্পর্কে আলােচনা করা প্রয়ােজন। বহু পল্লী অঞ্চল এমনও আছে যে সেখানকার মানুষ সদকা ফিতর কি জিনিস তাই জানে না বলে তা আর তাদের আদায় করা হয়না। আলিম ও ওয়ায়েযদের উচিৎ জুমআর খুতবায় কিংবা অন্য কোন উপায়ে এ ব্যাপারে তাদেরকে সচেতন করে তােলা।
আরেকটি ত্রুটি হলাে, সদকা ফিতরের জিনিস অপাত্রে ব্যয় করা। বস্তুত সদকা ফিতর তাদেরকেই দিতে হবে যাদেরকে যাকাত দেয়া যায়। যে সব খাতে ব্যয় করলে যাকাত আদায় হয় না, সেসব খাতে সদকা ফিতর দিলেও তা আদায় হবে না।
হানাফী মাযহাবের উসুল মতে একথা প্রসিদ্ধ যে, গম ব্যতীত অন্য কোন দ্রব্য দ্বারা সদকা ফিতর দিতে হলে গমের দ্বিগুণ দিতে হবে। এতে কিছু ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। কারণ প্রথমতঃ মনে রাখতে হবে যে, অনেক জিনিস এমনও আছে যা দিলে গমের দ্বিগুণ দিতে হয় না। বরং যে সব দ্রব্যের কথা হাদীসে উল্লেখ আছে কেবল সেই সবের বেলায়ই গমের দ্বিগুণ দিতে হয়। যেমনঃ যব ও খেজুর ইত্যাদি। যেগুলাের কথা হাদীসে
উল্লেখ নেই যেমন চনা ও চাউল ইত্যাদি। এগুলাের ব্যাপারে শরীয়তের বিধান হলাে এই যে, হাদীসে উল্লেখিত দ্রব্যের যে মূল্য আসে, চনাবুট, চাউল, ডাল ইত্যাদি দ্বারা সদকা ফিতর দিতে হলে সেই মূল্য দ্বারা যত পরিমাণ খরীদ করা যায় ঠিক তত পরিমাণই দিতে হবে। যেমনঃ গম দিলে সাবধানতা বশতঃ দুই সের দিতে হয়। এখন সেই গমের মূল্য যদি ১৫ টাকা আসে তাহলে চাউল ইত্যাদি দিলে গমের মূল্য হিসেব করে সেই মূল্যের চাউল দিবে। এর কম হলে যতটুকু কম হবে ততটুকু আদায় করা, তার জিম্মায় ওয়াজিব থেকে যাবে। তবে এসব জিনিসেও দ্বিগুণ হিসাব করে দিলে কোন অসুবিধা নেই।
কুরবানীর চামড়ার মূল্যের ব্যাপারে একটি ব্যাপক ভুল পরিলক্ষিত হয় যে, অনেকে তা নির্ধারিত খাত ছাড়া অন্য খাতে ব্যয় করে। সদকা ফিতর ও যাকাতের ন্যায়। এক্ষেত্রেও এমন হলে তা পুনরায় আদায় করা তার যিম্মায় ওয়াজিব থাকবে। যদি কুরবানীর চামড়ার মূল্য পৃথক করে রাখার পর তা বেহাত হয়ে যায় বা কোন উপায়ে নষ্ট হয়ে যায় তবে তখনও পুনরায় তা আদায় করতে হবে। নতুবা অনাদায়ী থেকে যাবে। ওয়াজিব আদায় করা তার জিম্মায় থাকবে।
অনুবাদঃ আবু লাবীবা
═──────────────═