হাকীমুল উম্মত মাওলানা থানুভী রহ. এর মনোনীত কাহিনী
এক ডেপুটি কালেক্টর ও দরবেশের কাহিনী
==============================================================
জনৈক ডেপুটি কালেক্টর এক দরবেশের দরবারে গিয়ে বলেন, আল্লাহ প্রাপ্তির অতি সহজ পথ কি? এই জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে দরবেশ সাহেব সরাসরি এর জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করেন। তিনি তাঁকে বলেন, বাড়ীর সকলে ভালো ? ছেলে মেয়ে ভালো আছে? বর্তমানে কতটাকা বেতন পাচ্ছেন? দিন-কাল কেমন চলছে? কেসমোকাদ্দমা কোন পর্যায়ে আছে? আলাপ চারিতার এক পর্যায়ে দরবেশ সাহেব তাঁর নিকট জানতে চাইলেন, প্রথমে স্বল্প বেতন থেকে বর্তমানে বড় অংকের বেতন প্রাপ্তি এবং চাকুরীর নিম্নস্তর থেকে বর্তমান উচুস্তর পর্যন্ত পৌঁছতে তাকে কত সাধনা ও মেহনত করতে হয়েছে? একথা জিজ্ঞাসা করলে ডেপুটি সাহেব অত্যন্ত আগ্রহের সাথে দরবেশ সাহেবকে তাঁর চাকুরী জীবনের ক্রম উন্নতির সব কথা বিস্তারিত বলে শুনান। তিনি বলেন, প্রথমে আমি খুব অল্প বেতনের চাকুরীতে যোগদান করি, আমি ছিলাম তৃতীয় শ্রেণীর একজন কর্মচারী। এই সময় আমার বেশ কিছু কাজে যথেষ্ট সুনাম হয়। ক্রমে আমি উন্নতি করতে থাকি। বর্তমানে আমি প্রথম শ্রেণীর পদে চাকুরীর করছি। বহু সময় ও কঠিন সাধনার পর নিচ থেকে উপরে উঠেছি। বর্তমানে পঞ্চান্ন বছর বয়সে আমি পেনশন ভোগ করছি। অতঃপর দরবেশ সাহেব তাকে বলেন, সব কাজে উন্নতির নিয়ম হলো, নিচ থেকে উঠা। আপনার মনে খোদা প্রাপ্তির যে আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়েছে তা খুবই ভালো কথা এবং আপনি অবশ্যই মনে করেন যে, ডেপুটি কালেক্টরের পদের চেয়ে খোদা প্রাপ্তির কাজ শ্রেষ্ঠ ও উত্তম। ডেপুটি সাহেব বল্লেন, জি হ্যা। অবশ্যই।খোদা তলবীর চেয়ে উত্তম কাজ আর কি হতে পারে!
এবার দরবেশ সাহেব তাঁকে বললেন, ডেপুটি সাহেব! আল্লাহ প্রাপ্তির পথকে ডেপুটি কালেক্টরের পদ ও কাজের চেয়ে আপনি উত্তম মনে করেন ঠিকই কিন্তু এই সামান্য ডেপুটি কালেক্টরের পদে উন্নীত হতে কত দীর্ঘ সময় আপনার প্রয়োজন হয়েছে। আমার দুঃখ হয় এবং আপনার লজ্জা করা উচিত, সেই আপনিই আল্লাহ প্রাপ্তির সন্ধানে কত ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন এবং অল্প সময়ে সর্বোচ্চ পদে উন্নীত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছেন!! উল্লেখ্য যে, যে কাজ যে পর্যায়ের তা সাধন করার পথও তত কঠিন ও কষ্টসাধ্য হয়ে থাকে। একটি সাধারণ চাকুরী পাওয়ার জন্য জীবনে যতটুকু কষ্ট করতে হয় একটি বড় পদের চাকুরীর জন্য তার চেয়ে বহু বেশী কষ্ট করতে হয় এবং শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। এটাই উন্নতির ধারা ও নিয়ম।
অযাচিত মেহমান হওয়ায় অভ্যস্ত এক কবির কাহিনী
-------------------------------------------------------------------------------------
খাওয়ায় খুব রুচী ও পটু এক কবিকে কেউ জিজ্ঞাসা করে যে, পবিত্র কুরআনের কোন আয়াত এবং দুয়াটি তোমার সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে? কবি বলেন, 'কুলু ওয়াশরবু (খাও ও পান কর)। আর দুআর মধ্যে, 'রব্বানা আনযিল আলাইনা মায়ি দাতাম মিনাসসামায়ি’ (হে আমাদের প্রতি পালক! আকাশ থেকে আমাদের জন্য খাদ্যের খাঞ্চা অবতীর্ণ কর।)
উল্লেখ্য যে, আমাদের অবস্থাও এমন যে সমগ্র কুরআনের যেখানের যে অংশ পছন্দ হয় সেটুকু গ্রহণ করি। অথচ স্বেচ্ছাচারিতার জন্য আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হই। এতে আল্লাহর কালামের এতটুকু পরিবর্তন ঘটে না এবং যা সম্ভবও নয়। যখন এর তত্ত্ব ও গুরুত্ব উপলব্ধিতে আসবে তখন বুঝবে, কত ভুল ও ভ্রান্তির মধ্যে পূর্বের জীবন অতিবাহিত হয়েছে। যেদিন একটি সামান্য পাপের জন্য কৈফিয়ত তলব করা হবে সেদিন লা-জওয়াব হয়ে এ কথা বলা ছাড়া কি উপায় থাকবে যে, আপনার করুণাই পার হওয়ার একমাত্র ভরসা!
জাহেল আবেদের ঘটনা
-------------------------------------------------------------------------------------
আমাদের এলাকার ‘খাইল’ নামক বস্তিতে এক জাহেল লোক বাস করত। লোকটি ছিলো জাহেল ও এবাদত গুজার। নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামায আদায় করত। লোকেরা তাকে ভক্তি করত, ভালোবাসত এবং বুজুর্গ হিসাবে শ্রদ্ধা করত। এই মহল্লায়ই নেজামুদ্দীন নামক ভাঁড় প্রকৃতির এক লোক থাকত। এই বুজুর্গের প্রতি তার সুধারণা ছিলো না মেটেই। লোক যখনই এই আবেদকে তার সামনে বুজুর্গ বলে অবহিত করত তখনই সে এর প্রতিবাদ করে বলত, জাহেল আবার বুজুর্গ হয় কিভাবে! এ কারণে নেজামুদ্দীনকে প্রায়ই মানুষের গাল-মন্দ শুনতে হত। একদিন বুজুর্গ ব্যক্তি তাহাজ্জুদের নামায আদায়ের জন্য উঠলে ভাঁড় লোকটি তার বাড়ীর ছাদের ওপর উঠে দুষ্টামি করে অত্যন্ত চিকন ও নরম সুরে বুজুর্গকে ডাকতে থাকে। বুজুর্গ উত্তরে বলে, কে? ভাঁড় বলে, আমি জিবরাঈল! আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার জন্য পয়গাম নিয়ে এসেছি। তুমি বেশ বৃদ্ধ হয়ে গেছে এবং এখন শীত মওসুম-রাতে ওঠে ওযু করতে তোমার যথেষ্ট কষ্ট হয়। এতে আল্লাহর লজ্জা হয়। যাও এখন থেকে তোমার জন্য সব নামায মাফ করে দেয়া হলো। এ কথা শুনে জাহেল আবেদ ভীষণ খুশী হয় এবং উঠে গিয়ে আরামের সাথে বিছানায় শুনে পড়ে ও যায়। আনন্দের গভীর নিদ্ৰায় তার ফজরের নামায চলে যায়।
ফজরের নামাযে তার অনুপস্থিতির কারণে অন্যান্য মুসল্লিরা মনে করে যে, হয়তো তার স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে। যে কারণে ফজরের জামাতে হাজির হয়নি। কিন্তু এর পরের ওয়াক্তেও সে আসল না। এভাবে কয়েক ওয়াক্ত তাকে মসজিদে অনুপস্থিত দেখে মহল্লার লোকরা চিন্তিত হয়ে তাকে দেখতে আসে। তারা যেয়ে দেখে, বুজুর্গের চেহারা হাসি খুশীতে উজ্জ্বল এবং আরামে চকির ওপর শুয়ে বিশ্রাম করছে। দর্শনার্থীরা জিজ্ঞাসা করল, মিয়াজি স্বাস্থ্য কেমন? বল্লো, খুব ভালো। তারা বল্লো, নামাযে আসছেন না যে? এবার দরবেশ আয়েশ করে জবাব দেন, ভাই জীবনে বহু নামায পড়েছি, খোদা আমার সবকিছু কবুল করে নিয়েছেন। নামায পড়া দ্বারা আমার যা উদ্দেশ্য ছিলো তা আমি পেয়ে গেছি। এখন আমার নিকট ফেরেশতা আসে, তারা সরাসরি আমার সাথে চেতন অবস্থায় কথা বলে। গত পরশু এক ফেরেশতা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে পয়গাম দিয়ে যান যে, আল্লাহ আমার জন্য সকল নামায মাফ করে দিয়েছেন।”
এই সময় ওই জাঁদরেল ভাঁড় দূরে বসে সব দেখতে ও শুনতে ছিলো এবং বুজুর্গ এ কথা বলায় সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে চিৎকার করে বলতে থাকে, এবার জাহিলের বুজুর্গি ঠাওর করতে পেরেছ সবাই! সবাই ধমকের সুরে ভাঁড়কে বল্লো, বে ওকুফ, চিৎকার করে বেচারার সব বুজুর্গি পণ্ড করে দিলে? উল্লেখ্য যে, এতো মাত্র একজন জাহেলের ঘটনা। যার ঘটনা শুনে তাকে মূর্খ ও খারাপ মনে হয়। কিন্তু আশ্চর্য্য হয়, আমরা একে নিয়ে হাসছি—নিজেদের অবস্থা অবলোকন করছি না। আমাদের অনেকেরই অবস্থা এ লোকটির চেয়ে মোটেও ভালো, নয়। এমন লোকের সংবাদও আমাদের জানা আছে, যে আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখার জন্য চারদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। এর চেয়ে অজ্ঞাতা আর কি হতে পারে?
এক ছাত্রের অবাস্তব আকাঙ্ক্ষা
-------------------------------------------------------------------------------------
একজন ছাত্র দারিদ্রে্যর কারণে লাগাতার উপবাস করত এবং এক শাহজাদীকে বিবাহ করার ব্যাপারে তার মনে বদ্ধমূল প্রতিজ্ঞা ছিল। তার কল্পনায় সার্বক্ষণিকভাবে এই একটি বিষয়ই ঘুরপাক খেতে থাকে। এছাড়া অন্য কিছু সে ভাবতেও পারে না। ধীরে ধীরে তার চাল-চলন ও কথা বার্তায় প্রেম-ভাবুকতার বিষয় প্রকাশিত হতে থাকলে জনৈক কবি তাকে জিজ্ঞাসা করে যে, তুমি যেন কার মিলন আকাঙ্ক্ষায় অধীর অপেক্ষা করছ। ছাত্র বল্লো, হ্যা যাকে ভাবছি তাকে পাওয়ার জন্য অর্ধেক কাজ সমাপ্ত করেছি, অর্ধেক বাকী আছে মাত্র। লোকটি জিজ্ঞাসা করলো, সে বাকী অর্ধেক কি? ছাত্র বল্লো, শাহজাদীকে বিবাহ করতে আমি সম্পূর্ণ রাজী কিন্তু শাহজাদী মোটেই রাজী নয়। অর্থাৎ বিবাহে দুটি জিনিস প্রয়োজন হয়, এক, মেয়ে পক্ষের সম্মতি, দুই, ছেলে পক্ষের তাকে বরণ করে নেয়া। যাকে বলা হয় ইজাব ও কবুল। আমি তাকে বরণ করে নিতে আগ্রহী কিন্তু আমার ঘরে বউ হয়ে উঠতে তার মোটেই সম্মতি নেই। সমস্যা মাত্র এতটুকু।
উল্লেখ্য যে, আখেরাতে মুক্তির ব্যাপারে আমাদের অবস্থাও অথৈবচ। জান্নাতে প্রবেশের আকাংখা বুক ভরা, কিন্তু প্রবেশাধিকার প্রাপ্তির প্রস্তুতি মোটেই নেই। আমাদের আছে আকাঙ্ক্ষা,বাকী থাকে আল্লাহর অনুমতির অপেক্ষা। এই হলো আমাদের অবস্থা। মনে রাখতে হবে, শুধু কথার ফুলঝুরি ও বাস্তবতা শূন্য ।আকাংখা দ্বারা উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয় না।
সংকলনঃ আবুল হাসান আজমী
অনুবাদঃ ম, আ, মাহদী