JustPaste.it

পদে পদে আল্লাহর নুসরাত

জম্মু-কাশ্মির ফ্রন্টে কমান্ডার শামশীর খানের ইমান-দীপ্ত দস্তান

(পূর্ব প্রকাশের পর)

========================================================================

 

        শামসুল হক ভাই আমাকে জানালেন, কয়েক দিন হলাে একজন পাকিস্তানী মুজাহিদ এসেছেন এবং তিনি শ্রী নগরে অবস্থান করছেন। লােকটি অত্যন্ত দুর্ধর্ষ ও উন্নত সামরিক প্রশিক্ষন প্রাপ্ত। আমি তার নাম জিজ্ঞেস করলে বললেন, “বাশারত আব্বাসী"। বাশারত আব্বাসী সম্পর্কে ইতিপূর্বে অনেক কথাই আমি শুনেছি। তাই তাঁর সাথে সাক্ষাত করার জন্য আমার মন উদগ্রীব হয়ে উঠল।

 

        এসময় কাশ্মিরী মুজাহিদ ফ্রন্ট পাকিস্তানী মুজাহিদদের আগমন প্রত্যাশী ছিলেন। আমি সাইয়্যেদ সালাউদ্দীন ও রশীদ তারাবীকে ব্যক্তিগত ভাবে অনেক বার চিঠি লিখেছি পাকিস্তান থেকে কাশ্মীর ফ্রন্টে লােক পাঠানাের জন্য। আমার চিঠি লিখবার উদ্দেশ্য এ নয় যে, কাশ্মীরে আমরা মুজাহিদ সংখ্যা কম। বরং আমার উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানীদের আগমনে কাশ্মিরী মুজাহিদদের মধ্যে সাহস বৃদ্ধি পাবে, তারা বুঝতে পারবে, ঘর দখলদার ভারতীয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শুধু আমরাই লড়াই করছি না, বহির্বিশ্বের মুসলিম ভাইয়েরাও আমাদের সাথে আছে। বাস্তবেও দেখা গেছে, কাশ্মীরীদের সাথে কোন পকিস্তানী মুজাহিদ থাকলে তারা দ্বিগুণ উৎসাহ ও শক্তিতে বলীয়ান হয়ে দুর্দমনীয় হামলা চালিয়েছে।

 

        বাশারাত ভাইকে দেখার জন্য আমি শ্রীনগর এলাম । শামসুল হক ভাই-এর সাথে পূর্বেই আমি শ্রীনগর আসার প্রােগ্রাম করে নিয়েছিলাম। সারা দিন গায়ের মেঠো পথে পায়ে হেটে সন্ধায় শ্রীনগর উপকণ্ঠে পৌছলাম। একটি গােপন আস্তানায় শামসূল হক ভাই-এর সাথে আমার সাক্ষাত করার কথা ছিল। সেখানে গিয়ে আমি তাকে পেলামনা। তখন তিনি অন্য এক কাজে বাইরে গিয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি হাজির হলেন । তিনি আমাকে বললেন-বাশারত ভাই এর সাথে সাক্ষাত করতে হলে আপনাকে পােশাক বদল করে অস্ত্র রেখে যেতে হবে।

 

        ভাের বেলায়, আমরা গােপন স্থানে পৌছার জন্য এভাবে রওয়ানা হলাম যে, কুয়াশায় আমাদের শরীর ভিজে চপচপে হয়ে গেল। আমি আগে থেকেই প্যান্ট-শার্ট পরেই ছিলাম, আর শামসুল হক ভাইয়ের পরনে ছিল সাফারী স্যুট। আমাদের পােশাক দেখে কেউ মুজাহিদ মনে করার সুযােগ ছিল না। ইস্পিত স্থানে পৌছে দেখি, আমাদের হাতিয়ার আগেই সেখানে পৌছে গেছে।

 

        তবে বাশারত ভাই এখনাে এখানে পৌঁছেননি। আগ্রহের আতিশয্যে আমি বার বার শামসুল হক ভাইকে জিজ্ঞেস করছিলাম, কি-ভাই! বাশারত ভাই কখন আসবেন? তিনি আমার কথার কোন জবাব দিচ্ছিলেন না। সময় গড়িয়ে জোহরের নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেল। শামসুল হক ভাই আমাকে বললেন, আপনি নামায পড়ান। আমি বললাম, ফ্রন্টের আমীরের উপস্থিতিতে ইমামতি করার ধৃষ্টতা আমার নেই। তিনি বললেন, শমশির ভাই! এটা আমার নির্দেশ। অগত্যা আমি নামায পড়ালাম। নামাযান্তে দু'আয় আমি মুজাহিদদের অতি প্রিয় ও সর্ব পরিচিত। একটি বাক্য আবৃত্তি করলাম-“হে আল্লাহ! আমাদের ভাগ্যে মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও শাহাদতের মৃত্যু নসীব করুন।”

 

        মােনাজাতের পর শামসূল হক ভাই আমার উদ্দেশ্যে বললেন, আপনার কোন সাথীকে যদি আল্লাহ শাহাদাতের সৌভাগ্য দান করেন, তাহলে আপনার খুশী হওয়া উচিৎ। তাই না? বললাম, হ্যা, কেন খুশী হবােনা। আমরা সবাই তাে এপথেরই যাত্রী। আমি তার কথা না বুঝেই জবাব দিয়ে বসলাম। গভীর ভাবে তলিয়ে দেখিনি, শামসুল হক ভাই এ কথায় আমাকে কি বুঝাতে চাচ্ছিলেন। জিজ্ঞাসু নেত্রে তার দিকে চাইলাম । বললেন, শমশির ভাই! আমরা যার সাথে সাক্ষাত করতে ঝুকিপূর্ণ দীর্ঘ পথ পেড়িয়ে এলাম, তিনি, আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। বাশারত আব্বাসী শাহীদ হয়েছেন।

 

        একথা শুনে আমি দুঃখে শোঁকে হত বিহ্বল হয়ে পড়লাম। আমার ধমনিতে প্রতিশােধের আগুন জ্বলে উঠলাে। মনের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলাে, বাশারত ভাই! তুমি আমাদের আগে চলেগেলে। অথচ আমরাতাে বহু দিন থেকে কাশ্মীর উপত্যকার পাহাড় জঙ্গল নদী নালা মাঠ ঘাট চষে বেড়াচ্ছি। কিন্তু এ সুবর্ণ সুযােগআমাদের হাতের মুঠোয় আসলনা। আপনি এতাে সৌভাগ্যের অধিকারী যে, কাশ্মীর ফ্রন্টে পা রাখার সাথে সাথেই পরিতৃপ্ত হয়ে স্বর্ণ শিখরে পৌছে গেলেন। সফর শুরু করলেন, আর সৌভাগ্যের স্বর্ণ সিড়ি আপনার পা চুম্বন করল ।

 

        শামসুল হক ভাই ভেবেছিলেন, বাশারত আব্বাসীর শাহাদতে আমি ভেঙ্গে পড়ব। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই আমি নিজেকে সামলে নিয়ে শাহাদাতের অমিয় সূধা পানে উজ্জীবিত হলাম। বললাম- এ মহান মর্যাদা যাদের পাওয়ার তারা পেয়ে গেছে, তাে ভাগ্যন্বেষণ কারীদের বসে থাকার অবসর কোথায়? শামসুল হক ভাইকে উৎসাহিত করার জন্য তার মনােভাবের বিপরীতে বললাম -

 

        আমীরে মুহতারাম! আপনাকে মােবারকবাদ জানাচ্ছি। আমাদের এক বন্ধু আল্লাহর প্রিয় মনযিলে আমাদের আগে পৌছেছেন, আর আমরা তার পিছনে যাব। কোন অগ্রগামী অশ্বারােহী যদি দ্রুত লক্ষ স্থলে পৌছে যায় তবে তাতে দুঃখ করার কি আছে, এতাে খুশীর ব্যাপার।”

 

        আমার এই অভিব্যক্তিতে শামসুল হক ভাই বললেন- বাশারত আব্বাসী শ্ৰীগরের শহীদ কবরস্থানে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন। আমাদের তার কবরের গিয়ে তাকে সালাম জানানাে উচিত। এজন্য আমি শহীদ কবরস্তানে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেললাম। শামসুল হক ভাই আমাকে সেখানে যেতে নিষেধ করে বললেন, সেখানে যাওয়া খুব ঝুঁকি পূর্ণ ব্যাপার। ভারতীয় সেনা বাহিনী সব সময় শহীদ কবরস্তান ঘিরে রাখে। তােমার সেখানে গ্রেফতার হওয়ার আশংকা আছে। এমন ঝুঁকি না নেয়া ভাল। আমি বার বার তাকে অনুরােধ করলে শেষ পর্যন্ত তিনি যেতে অনুমতি দিলেন।

 

শহীদ কবরস্থানে

        জম্মু কাশ্মীরের শহর গঞ্জ পল্লীতে শহীদদের হাজারাে কবর ছড়িয়ে রয়েছে। এমন কোন পল্লী নেই যার মাটি কোন না কোন মুজাহিদের দাফনে ধন্য হয়নি। শ্ৰী নগরের বিশাল মাঠ শহীদ মুজাহিদদের কোলে নিয়ে শুয়ে আছে শান্ত নিরবে । শহীদী কাফেলায় নিত্য দিন যােগ হচ্ছে নতুন নতুন বাসিন্দা।

 

        শহীদ কবরস্তানে যাওয়ার আগে একটি নিরাপদ জায়গায় আমি পরিধেয় পােশাক বদলিয়ে নিলাম। গায়ে গেয়াে জামা আর পায়ে চপ্পল পরে আমি অতি সাধাসিধে কাশ্মীরী যুবকের বেশ ধরলাম। জামার ভিতরে লুকিয়ে নিলাম ক্লাশিনকভ। চারজন বৃদ্ধ ও দু’জন বালক নিয়ে নিরাপদে পৌছে গেলাম শহীদ কবরস্তানে। পথে ইন্ডিয়ান আর্মি আমাদের কোন জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। কবর স্থানে পৌছে ভাগ্যবান মুজাহিদদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম পেশ করলাম। বিস্তৃত মাঠে সারি সারি শহীদদের কবর। এরই মধ্যে আরাে নতুন নতুন কবরের চিহ্ন দেখা যায়। এখানে দাফনকৃত প্রাথমিক শহীদদের অনেকের সাথেই আমার পরিচয় ছিল, ছিল গভীর সম্পর্ক। অনেকেরই নাম পরিচয় আমি জানিনা। কিন্তু এরা সবাই ছিল কাশ্মীরের মুক্তিপাগল বীর সন্তান। আযাদীর অগ্নি মশাল প্রজ্জ্বলিত করে ওরা ঠাই নিয়েছে আল্লাহর প্রিয় সান্নিধ্যে। নিযুত শহীদের কবরের পাশে আরাে পাঁচ হাজার শহীদের দাফনের জন্য যমিন উপযােগী করে রাখা হয়েছে । কবরস্থানের অদূরে একটি নাম ফলকে দৃষ্টি গােচর হলাে একটি বাক্য। “এই জায়গা শহীদ মকবুল বাটের জন্য অপেক্ষমান।” শহীদ মকবুল বাটকে বিহার জেলখানায় গুলিবিদ্ধ করে শহীদ করার পর তাকে সেখানেই ওরা দাফন করে দিয়েছে।

 

        আমি বাশারাত আব্বাসী ভাই এর কবরের পাশে দাড়িয়ে ভাবছি, এই পাকিস্তানী জীবনপণ সংগ্রামী নেতা স্বীয় জীবন দিয়ে নিপীড়িত কাশ্মীরী ভাই বােনদের হৃদয়ে গড়ে নিয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। যা কোন স্বার্থের টানাপােড়নে ভেঙ্গে যাবার নয়। নানা রঙের ফুলে বাশারত আব্বাসীর কবরটি - ঢেকে দিয়ে কাশ্মীরের ভাই বােনেরা তাঁর প্রতি ঢেলে দিয়েছে কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসার অর্ঘ। তার বুকের উপর সবুজ জমিনে চাঁদ খচিত পাকিস্তানী পতাকা।

 

        আমি তাঁর শিয়রের পাশে দাড়িয়ে ফাতেহা পড়ে এই মর্দে মুজাহিদ ও সাথীদের প্রতি ইসালে সােয়াব করলাম। আর যারা এ পথের যাত্রী তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সাহায্য চাইলাম। এরাই তো সেই কাফেলা যারা আখেরাতে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অভিসিক্ত হবে এবং আমাদের সােনালী পথের দিশারী। যাদের খুনরাঙা তরবারীর বদৌলতে এখনাে প্রবাহমান রয়েছে ঈমান ও ইজ্জতের আবে হায়াত।

 

        অনেক্ষন আমি ঠায় নীরব দাড়িয়ে রইলাম । সহযাত্রীরা আমাকে বললেন, চলুন এখানে বেশীক্ষন দাড়ানাে নিরাপদ নয়। তাদের সাথে স্থানীয় মুজাহিদ আস্তানায় পৌছালে সেখানে শ্রীনগরের জেলা কমান্ডার মূসার সাথে দেখা হল। যিনি শ্রীনগরে আযাদী আন্দোলন আরাে তীব্রতর করার জন্য একটি মিটিং করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

 

        আমাকেও এই মিটিং এ থাকার জন্য বললেন। আমি রাজি হলাম। এই গােপন মিটিং-এ শ্রীনগরের সকল প্লাটুন কমান্ডার, ব্যাটিলিয়ন কমান্ডার ও কোম্পানী কমান্ডার ও জেলার সহকারী কমান্ডার উপস্থিত হলেন। শ্রীনগরে তখন ইন্ডিয়ান গােয়েন্দাদের জোর তৎপরতা। মুজাহিদদের গতিবিধির খবর তাদের কাছে প্রতি নিয়ত পৌঁছে যাচ্ছিল। সরকারী গােয়েন্দাদের চর আমাদের মধ্যেও অনুপ্রবেশ করে। কতিপয় গাদ্দারের অশুভ তৎপরতা আমাদের সব সময় শংকিত করে রাখে।

 

        নির্ধারিত স্থানে পৌছানাের আগে আমরা শ্রীনগরের একবাড়ীতে খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। আমাদের ধারণা ছিল, ইন্ডিয়ান আর্মিদের কাছে আমাদের উপস্থিতির খবর পৌছালে ওরা ক্রেক ডাউন করবে। খাওয়া সেরেই চার পাঁচ কিলােমিটার হেটে আমরা সামনের একটি গ্রামে হাজির হলাম। এখানেই আগামী রাতে সবার মিলিত হবার কথা। দোতলা বাড়ীর উপরে ছিলাম আমরা আর নীচে বাড়ী ওয়ালা ও তাঁর পরিবার বর্গ। গভীর রাত পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলােচনা করলাম। এক পর্যায়ে সকলেই ঘুমের ঘােরে ডুবে গেলাম।

 

        কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে গেল বিপত্তি। ভারতীয় আর্মি আমাদের চতুর্দিকে ঘিরে ফেলল (চলবে)।

 

অনুবাদঃ আসাদ মাহমুদ

 

 ═──────────────═