ইসলামী সমাজতন্ত্রের পর এবারই ইসলামী গণতন্ত্র (?)
আবদুর রশীদ তারাপাশী
===================================================================
সমাজতন্ত্র যখন তার যৌবনে দেশ ভ্রমণে বেড়িয়েছিল তখন তৃতীয় বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রপুঞ্জের সাথে সখ্যতা গড়ার জন্যে নিজেকে যে পরিচয়ে পরিচিত করেছিল তা ছিল ‘আমি হলাম ইসলামী সমাজতন্ত্র।’ অর্থাৎ আমার আর আপনাদের মূল কথা একই। আপনারা যেমন আমীর-গােলাম, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ ও সাদা-কালাের মধ্যেকার বৈষম্যের পাহাড় ভেঙ্গে সকলকে একই সমতল মাঠে দেখতে চান আমারও স্বপ্ন সাধ এবং আজন্ম কামনা এটাই। আর বিস্ময়কর ব্যাপার হলেও দেখা গেল রাষ্ট্রযন্ত্রের চাবি লাভের যুদ্ধে লিপ্ত তৃতীয় বিশ্বের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী যারা এতদিন ইসলামী শাসন ব্যবস্থাকে অমানবিকতা, হিংস্রতা বলে গালাগাল করতেন, যারা ইসলামের নাম শােনা মাত্রই থর থর করে কাঁপতেন, ভয়ে শিউরে উঠতেন হঠাৎ তারা আমূল বদলে গেছেন। তারা ইসলামের জন্যে নিবেদিত প্রাণ মুজাহিদ সেজে যত্র তত্র ইসলামী জয়গানের খই ফুটিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের কারণে মঞ্চে ঠাই পাওয়াও ছিল কষ্টকর ব্যাপার। কিন্তু আসলে তারা ছিলাে ছদ্মবেশী সাম্রাজ্যবাদ তথা “ইসলামী সমাজতন্ত্রের” দালাল। ছদ্মবেশী সাম্রাজ্যবাদ বলার কারণ এই যে, ইসলামে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার কোন অবকাশ নেই। সমাজতন্ত্রের সাথে ইসলামকে যােগ করে নেয়াটা দালালী এবং স্বার্থপরতা ছাড়া কিছুই নয়। এ দালালরা তখন মক্কেলদের পক্ষ সমর্থনে ইসলামের নতুন নতুন ব্যাখ্যা দানে ব্যস্ত ছিলেন। ইসলামের সাথে এহেন অমার্জনীয় অপরাধের দরুনই বােধ হয় সমাজতন্ত্র শতাব্দী কালের আগেই আপন অবাধ্য পুত্রদের হাতে কাস্ত ঘর্ষণ এবং হাতুড়ী পেটা খেয়ে বিলীন হয়ে গেছে।
সমাজতন্ত্রের এই অকাল মৃত্যুর মধ্যে যদিও শিক্ষার অনেক উপাদান ছিল কিন্তু ভাড়া খাটা ঐ সব বুদ্ধিজীবীরা শিক্ষা গ্রহণ না করে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ভােল পাল্টিয়ে নিয়েছেন। এরও একটা কারণ আছে। কারণটি হল এরা স্বার্থের পুজারী। যেখানে স্বার্থ দেখে সেখানেই দৌড়ে যাবে, যার দালালী করলে স্বার্থ হাসিল হবে এরা লাজ শরমের মাথা খেয়ে সেখানেই ধর্ণা দেবে। এদের চিন্তা চেতনার কোন কেন্দ্র নেই। তাদের কাছে কড় কড়ে নােটগুলােই হচ্ছে আসল ব্যাপার। কিন্তু এটা আমেরিকার না রাশিয়ার না অন্য কোন ছদ্মবেশী সাম্রাজ্যবাদের তা তাদের ভাববার বিষয় নয়। টাকা পেলে এরা আত্মসম্মানের সওদা করতে রাজি। আর এজন্যেই এদেরকে সব সময় একটু তাজা তাজা দেখা যায়। কারণ, তাদের রুজির দরজা সব সময়ই খোলা। সমাজতন্ত্রের অকাল মৃত্যুর ফলেও কিন্তু তাদের রুজি কমেনি। তারা এখন পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ইসলামী গণতন্ত্র নামক আরেক ছদ্মবেশী সাম্রাজ্যবাদের দালালী শুরু করেছে। কিন্তু হায়! এ আহম্মকের গােষ্ঠীটি একবারও কেন একথাটা ভেবে দেখল না যে, আমরা গণতন্ত্রের সাথে ইসলামকে মিলিয়ে যতই আকর্ষণীয় খিচুড়ী পাক করি না কেন তা ইসলামপন্থীরা গ্রহণ করবে কিনা। ইসলামের মধ্যে তারা যে স্বাদ পেয়েছে এবং যে স্বাদ পেয়ে তারা ইসলামী সমাজতন্ত্রের খিছুড়ীটা চেখেও দেখেনি তারা কি এবারেরটা গ্রহণ করবে?
শ্রদ্ধেয় পাঠক! আজকাল ইসলামী গণতন্ত্রের নামে যে অপপ্রচার চালিয়ে মানুষের মেধা ও মনকে আচ্ছন্ন করা হচ্ছে আসলে তা ইসলামকে সমূলে ধ্বংস করার একটা সূক্ষ্ম চাতুরী বৈ কিছুই নয়। ইসলাম এমন কোন কাঙ্গাল ধর্মমত নয় যে তাকে সচল রাখার এবং তার দ্বারা সমাজ ও রাষ্ট্রের শান্তি নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিফলিত করার জন্যে বাহির থেকে কিছু মূলনীতি আমদানী ঘটাতে হবে। বরং ইসলাম এমন একটি মুক্ত জীবন বিধান যা মানব জীবনের সব ক্ষেত্রে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির ফল্গুধারা বইয়ে দিয়ে আদর্শ রপ্তানী করতে সক্ষম। আজ সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে যে বিচিত্র সমস্যাবলী দেখা দিয়েছে এর কোনটির জন্যে ইসলাম একটুও দায়ী নয়। গণতন্ত্রকে ইসলামী লেবাসে সাজিয়ে আদৃত করায় যতই নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস চালানাে হােক না কেন, ইসলামকে যারা জানে ও চিনে তারা গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান বৈ গ্রহণ করবে না। কেননা সচেতন মুসলমনিরা অবশ্যই দেখতে পাচ্ছেন যে, গণতন্ত্র প্রতিনিয়ত একটি সমস্যার সমাধান করতে যে নতুন নতুন আইন-কানুন আবিষ্কার করছে। তা সমস্যার সমাধান করাতাে দূরের কথা বরং সমস্যাকে আরাে বহুমুখী ও প্রকট করে তুলছে। অথচ ইসলাম চৌদ্দশত বৎসর আগে থেকেই এসব সমস্যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সমাধান দিয়ে আসছে। সুতরাং গণতন্ত্র গ্রহণ যােগ্য হয় কি করে? তাছাড়া, সচেতন ব্যক্তি মাত্রই জানেন যে, গণতন্ত্র মানেই হলাে মানব রচিত জীবন বিধান।
আর ইসলাম হলাে আল্লাহর প্রদত্ত জীবন বিধান। মানুষের জ্ঞান যে নিতান্তই সীমিত এবং অপরিনামদর্শি তা মানুষ যতই অস্বীকার করুক প্রত্যেকেই কিন্তু অপনাআপন বােধের অলক্ষ্যে কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বীকার করে চলছেন। কোন মানুষই আজ যা করছে এর প্রতিক্রিয়া বা ফলাফল আগামী কাল কোন রূপ ধরে আত্মপ্রকাশ করবে তা বলতে পারে না। যা বলে থাকে তাও নিছক অনুমান ভিত্তিক। তাই দেখা যায়, অনেক সময় কাজের ফলাফল ধারণার বিপরীতে চলে যায়। এতদ্ব্যতীত ফলাফলটা তাৎক্ষণিক ভাবে বাঞ্চিতরূপে প্রকাশ পেলেও কিছু দিন পর তাকে এটা তার ভুল স্বীকার করতে শুনা যায়। এমনকি অল্প দিনের ব্যবধানে বাঞ্চিত ফলাফলটা সংশ্লিষ্ট লােকটির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতেও দেখা যায়। সুতরাং অনুমান নির্ভর ফলাফল লাভের নিমিত্তে মানব রচিত জীবন বিধান গণতন্ত্রকে সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষের জন্যে গ্রহণ করা কি সমুচিত হবে? কিংবা এর সাথে পবিত্র ইসলামকে গুলিয়ে ফেলার কোন অবকাশ আছে? আপনিই বলুন, দু'জন লােক আপনাকে দুটি কাজের নির্দেশ দিলেন। একজন বললেন, কাজের পরিণাম নিশ্চয়ই শুভ হবে, অপর জন বললেন, শুভ হতে পারে। এমতাবস্থায় আপনি কোনটি গ্রহণ করবেন? নিশ্চয় শুভ ফলের কাজটাই গ্রহণ করবেন।
আসল কথা হল, আমরা ইসলাম থেকে দূরে সরে পরার কারণেই আজ চতুর্মুখী সমস্যার আবর্তে ঘুর পাক খাচ্ছি। আর এই সুযােগে আমাদের চির শত্রু ইহুদি ও খৃষ্টান জগত আমাদেরকে শিকার করার ঘৃন্য প্রচেষ্টায় লিপ্ত। কিন্তু আল্লাহর ফজলে এখনও আমাদের মধ্যে ঈমানের আলােকবিজ্ঞ থাকায় আমাদেরকে তারা সরাসরি আক্রমণের তথা ইসলাম থেকে বিচ্যুত করার সাহস পাচ্ছে। তাই মনস্তাত্মিক চিন্তা চেতনার পথ ধরে আক্রমণ করার সুযােগ খুঁজছে। ইসলামী গণতন্ত্র ঐ ধারারই একটি মারাত্মক আক্রমণ। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হল আমাদের সমাজ থেকে অবশিষ্ট ইসলামী চেতনাটুকুর বিলুপ্তি ঘটিয়ে আমাদেরকে পুরােপুরি গণতন্ত্র তথা পাশ্চাত্য জীবন বিধানের অনুসারী করা। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে ভিনদেশে নিজেদের মতবাদ চিন্তা করা যেমন হুমকির বিষয় তাই তারা কৌশলে কাজ করার জন্যে দালালদের আশ্রয় নিয়েছে। এদেরই কড় কড়ে নােটের লােভে আমাদের বুদ্ধিজীবী নামধারী এক শ্রেণীর কুলাঙ্গার ইসলামী গণতন্ত্রের কোরাস গাচ্ছে।
যদিও এরা মুখে ইসলামকে গালি দিচ্ছে না তবুও এদের কর্মকাণ্ড নিতান্তই ঘৃণিত। এরা ইসলামী গণতন্ত্রের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা ও অন্যায় আনাচারের সুরাহা করতে চায়, ইসলামকে দিয়ে নয়। ইসলামী জীবন বিধানের কোন দিকটি আজ অচল হয়ে গিয়েছে, কোন দিকটি আকড়ে ধরলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না। এসব কিন্তু তাদের বক্তব্যে মােটেও স্পষ্ট নয়। অথচ ইসলামী গণতন্ত্রের দোহাই পেরে ইশারায় তারা সে ধারণাই দিতে চায়। ধরুন ব্যভিচারের শাস্তিকে তারা একটি অমানবিকতা ও হিংস্রতা বলতে চায়। তাহলে বলুন গণতন্ত্রে কি প্রাণদণ্ডের কোন বিধান নেই? যদি থেকে থাকে আর অবশ্যই আছে তাহলে ইসলাম যদি অসংখ্য নারীর সতীত্বের নিরাপত্তার লক্ষ্যে এ আইন জারী করে থাকে, তাহলে কি সেটা খুব হিংস্রতা হয়ে গেল। যারা সতীত্বকে গলাটিপে হত্যা করল যা আর কোনদিন পুণরুদ্ধারের নয় তাকে যদি মামুলী সাজা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে এটাকি কোন ইনসাফ ভিত্তিক ফয়সালা হলাে? কেনা জানে, ব্যভিচার এমন এক ইন্দ্রিয়জাত অপরাধ যাকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি ছাড়া সামাল দেয়া সম্ভব নয়। ব্যাভিচারী কিংবা চোরকে যদি মৃত্যুদণ্ড এবং হাত কাটা শাস্তি না দিয়ে কয়েক দিনের জেল দেয়া হয় তাহলে সে মুক্তি পেয়ে পুণঃরায় ব্যভিচারে লিপ্ত হবে না, চুরি করবেনা এর কোন নিশ্চয়তা দেয়া যাবে? কারাবাসের সামান্য শাস্তি কি তাকে এসব গর্হিত কাজ থেকে নিরুৎসাহিত রাখার জন্যে যথেষ্ট হবে? এই জন্যই দেখা যায় আজকাল চোর-বদমাশরা কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে বিপুল উৎসাহে চুরি ও বদমাশীতে লিপ্ত হয়। শুধু চুরি আর ব্যাভিচারই নয় ইসলামের সবগুলাে বিধানই সম্পূর্ণ মানবিক ও বৈজ্ঞানিক। খৃস্টান ও ইহুদী জগত আসলে আমাদেরকে শিকার করতে চায়।
মানবতাহীন নিয়ম নীতি অবলম্বনের ফলে তারা যে অসুখে আক্রান্ত হয়েছে ঈর্ষাকাতর হয়ে আমাদেরকেও সে অসুখ দিয়ে আত্মকষ্টে ফেলে বিকৃত শাস্তি পেতে চায়। আর আমরা তাদের দালালদের দালালী কথায় ভুলে পাইছি রে, পাইছি বলে নাচতে আগ্রহী। গণতন্ত্রের যে কি সুখ রয়েছে তা গণতন্ত্রের সুতিকাগার ফ্রান্স এবং এর পূর্ণাঙ্গ অনুসারী বৃটেন ও আমেরিকার সামাজিক অবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করলেও আমরা তা সম্যক উপলব্ধি করতে পারি।
═──────────────═