JustPaste.it

দেশে দেশে ইসলাম

 

চীনে মুসলমানদের উপর কি চলছে?

মুহাম্মদ খায়রুল বাসার

 

            আজ চীনে স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের ওপর হত্যাসহ ব্যাপক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ জিনজিয়াং-এর মুসলমানরা সম্প্রতি তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠলে চীন সরকার তাদের ওপর সেনাবাহিনী ও পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে ব্যাপক হত্যাকান্ড চালায়। স্বর্ণ, তেল ও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ চীনের বৃহত্তম মুসলিম আবাসভূমি জিনজিয়াং-এ চীন সরকার মারাত্মকভাবে মানবাধিকার লংঘন করে চলেছে। মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলন দমনের জন্যে গত ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারী কমিউনিষ্টরা মুসলমানদের ওপর চড়াও হলে দু'পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। এতে কমপক্ষে এক হাজার মুসলমান নিহত হয় বলে একটি মুসলিম সূত্রে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সরকারী সূত্রে মাত্র ১০ জন নিহত ও ১৪৪ জন আহত হবার কথা স্বীকার করা হয়। কয়েকটি পশ্চিমা সংবাদ সংস্থা ও হংকং এর একটি পত্রিকা জানায়, স্বাধীনতাকামী প্রায় এক হাজার মুসলমান এবং পুলিশের মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ চলাকালে বহু দোকান-পাট ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অনেকগুলো গাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। রিপোর্টে বলা হয়, সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র কাজাখিস্তানের সীমান্ত থেকে মাত্র ৫০ কি, মি, দূরে অবস্থিত ইনিং শহরে নিরাপত্তাবাহিনী দাঙ্গা দমনের সময় ৫শ লোককে গ্রেফতার করে। খবরে বলা হয়, চীনা কর্তৃপক্ষ বিক্ষোভের সময় নিহত বহু মুসলমানের লাশ পুড়িয়ে ফেলেছে। এদিকে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংঘর্ষের জন্যে মুসলমানদের দায়ী করেছে। এরপর ৩০ জন মুসলমানকে পবিত্র রমযান মাসের শেষ দিন ৮ ফেব্রুয়ারী ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। জিনজিয়াং এর মুসলমানদের স্বাধীনতাকামী প্রবাসী নেতা ইউসুফ বেক মুখলেসী কাজাখিস্তানের রাজধানী আলমাআতায় এ তথ্য জানান বলে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

              জিনজিয়াং হচ্ছে চীনের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশ। জিনজিয়াং এর আগের নাম ছিল পূর্ব তুর্কিস্তান মুসলিম প্রজাতন্ত্র। জিনজিংয়াং মঙ্গোলিয়া, কাজাখিস্তান, কিরগিজিস্তান ও পাকিস্তান এবং চীনের তিব্বত, কিংগহাই এবং কানসু প্রদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত। এর আয়তন ১৬ লক্ষ ৪৬ হাজার ৮০০ বর্গ কিলোমিটার। চীনের ৬ ভাগের এক ভাগ হচ্ছে জিনজিয়াং। বর্তমানে যার জনসংখ্যা হচ্ছে এক কোটি ৬৬ লক্ষ । এদের বেশীর ভাগই হচ্ছে তুর্কী মুসলমান। তারা উইঘুর, কাজাক ও উজবেক হিসেবে পরিচিত। জনসংখ্যার ৩৮ শতাংশ হচ্ছে চীনা হান। হেরাল্ড ট্রিবিউন সূত্র এ তথ্য জানায়। কোন কোন সূত্র আবার সেখানকার ৯০ শতাংশ জনসংখ্যাই মুসলমান বলে জানিয়েছে। এই অঞ্চলের উপর বেইজিং তার নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার লক্ষ্যে এবং মুসলমানদের প্রভাবকে খাটো করার জন্যে বহিরাগতদের জিনজিয়াং-এ এনে স্থায়ীভাবে বসবাস করানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। মুসলমানরা চীন সরকারের এই অন্যায় উদ্যোগ মেনে নিতে পারেনি বলেই দাঙ্গার সূত্রপাত হয়েছে। জিনজিয়াং-এর মূল্যবান খনিজ সম্পদ নিজেদের করায়ত্তে রাখার জন্যে এই অঞ্চলকে ছলে-বলে-কৌশলে চীনের আয়ত্তাধীন রাখতে চীন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জিনজিয়াং-এর উপর বিদেশী শক্তির শ্যেন দৃষ্টির ইতিহাস বহু পুরাতন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে জিনজিয়াং ছিল ‘সিক্রেট এশিয়া’, চীনাদের কাছে ‘দ্যা ফার ওয়েস্ট’ রাশিয়ানদের কাছে ‘দ্যা ব্যাংক বিয়ন্ড’ এবং পারস্য, তুর্কী ও আরব সাহিত্যে জিনজিয়াং 'তুর্কিস্তান' হিসেবে পরিচিত। জিনজিয়াং-কে বলা হয় বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ জনপথ। এছাড়া জিনজিয়াং-কে এশিয়ার একক বৃহত্তম ইউরেনিয়াম রিজার্ভার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পারস্য সাহিত্যে জিনজিয়াং বিপুল সোনা ও মূল্যবান পাথরের গুদাম হিসেবে স্বীকৃত। জিনজিয়াং-কে নিয়ে চীনের এত চিন্তার কারণ হচ্ছে, জিনজিয়াং-যে তারা একদিন দখল করে নিয়েছিল সেটা তাদের মনে আছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর থেকে তাদের যেন উদ্বেগের শেষ নেই। জিনজিয়াং এর মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে তারা বিদেশী শক্তির মদদ হিসেবে সন্দেহ করে। চীনের সরকারী কাগজ পত্রে জিনজিয়াংকে ঐতিহাসিকভাবে চীনের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। উইঘুর মুসলমানদের শতকরা ১৯ জনই এই প্রদেশে বসবাস করে। উইঘুররা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন তুর্কী জনগোষ্ঠী। উইঘুররা জিনজিয়াং ছাড়াও কাজাখিস্তান ও কিরগিজিস্তানের মত চীনের প্রতিবেশী দেশসমূহেও বসবাস করে। ১৯৮০ এর দশকের শেষ দিকে উইঘুর জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন করে স্বাধীনতার স্পৃহা জেগে ওঠে। বহু শতাব্দী ধরে উইঘুরদের একটি পৃথক দেশের প্রয়োজনীয়তা ছিল অসামান্য। কিং ডাইন্যাস্টির আমলে জিনজিয়াং একটি প্রদেশে রূপান্তরিত হয়। প্রত্যন্ত এই মরু এলাকার ওপর বেইজিং-এর তেমন একটা প্রভাব ছিলনা বললেই চলে। উইঘুরদের স্বাধীনতার স্পৃহা কোন অলীক স্বপ্ন বা বাসনা নয়। ১৯৪৪ সালে পূর্বাঞ্চলীয় জিনজিয়াং এর উইঘুররা চীন-জাপান যুদ্ধের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে পূর্ব তুর্কিস্তান প্রজাতন্ত্র নাম দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তারা জাতীয় সঙ্গীত এবং জাতীয় পতাকাও তৈরী করে। তখন মুসলিম চিন্তাবিদ ও পন্ডিত ব্যক্তিরাই প্রজাতন্ত্রটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তারা প্রজাতন্ত্রে ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু ১৯৫০ সালে চীনের গণমুক্তি ফৌজ জিনজিয়াং-এ প্রবেশ করে উইঘুরদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিল। সম্প্রতি চীন জিনজিয়াং-এ যে হত্যা, নির্যাতন, দমন অভিযান চালাচ্ছে, সেটা কোন নতুন বা আকস্মিক ঘটনা নয়। বাইরের দুনিয়া না জানলেও দীর্ঘ কাল থেকে সেখানে মুক্তিসংগ্রাম চলছে এবং সাথে সাথে চীন সরকারের হত্যা নির্যাতন তথা দমন অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯৫ সালে স্বাধীনতাকামী মুসলমানরা চীন-বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তখনও সেখানে সংঘর্ষ হয়। ১৯৯৩ সালের ১৭ জুন জিনজিয়াং এর কামাগড়ে একটি হোটেলের সামনে বোমা বিস্ফোরণে তিন ব্যক্তি নিহত হয়। এর আগে ১৯৯৩ সালে চীন সরকার একটি স্বাধীনতাকামী মুসলিম গ্রুপকে চরমভাবে দমন করে। মক্কাভিত্তিক ইসলামী সংস্থা 'রাবেতা আলমে ইসলামী'র সাময়িকী মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ জার্নালের সাম্প্রতিক সংখ্যায় জিনজিয়াং-এর স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তার বিরুদ্ধে সরকারী দমন অভিযানের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জিনজিয়াং-এ মানবাধিকারের মারাত্মক লংঘন ঘটছে। মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলন দমনের জন্যে চীনা সেনাবাহিনী সেখানে নির্যাতন বাড়িয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেখানকার সীমান্ত এলাকার সেনা উপস্থিতি কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত গ্রীষ্মকাল থেকে চীন সেখানে সন্ত্রাস দমনের নামে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লংঘন করে চলেছে। তথাকথিত সন্ত্রাস দমন অভিযান শুরুর তিন সপ্তাহের মধ্যে ছয়'শ পবিত্র কুরআন শিক্ষার মক্তব এবং প্রায় দু'শ মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পুলিশ মুসলমানদের কাছ থেকে ইসলামী সাহিত্য, ভিডিও এবং অডিও ক্যাসেট কেড়ে নিয়েছে। জিনজিয়াং প্রশাসন ৪ হাজারেরও বেশী সন্দেহভাজন কর্মচারীকে ভয়ংকর প্রকৃতির বিবেচনা করে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করছে। রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৫ হাজার লোককে গ্রেফতার করেছে। জিনজিয়াং-এর মুসলমানরা মনে করে, চীন একটি ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে তাদের মাতৃভূমিকে জবর দখল করে রেখেছে। চীন কর্তৃপক্ষ বিশ্ববাসীকে জিনজিয়াং সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখেছে। গত ৫০ বছর ধরে চীন ঐ অঞ্চলে কোন বিদেশীকে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। সাম্প্রতিককালে সেখানে আরো কঠোর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। বেইজিং প্রশাসন জিনজিয়াং-এ বিদেশী সাংবাদিকদের গমন নিষিদ্ধ করায় সেখানে সর্বশেষ নিষ্ঠুরতার অনেক খবর-ই অজানা রয়ে গেছে। মুসলিম গণঅভ্যুত্থান শুরুর পরপরই জিনজিয়াংমুখী রাস্তা এবং অধিকাংশ টেলিফোন লাইন বন্ধ করে দেয়া হয়। বেইজিং-এ একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, উইঘুররা মুসলমান হবার কারণেই আন্তর্জাতিকভাবে এ সমস্যা তেমন কোন গুরুত্ব পাচ্ছে না। জিনজিয়াং-এ কোন সাংবাদিক বা কোন বিদেশীকে প্রবেশ করতে দেয়া না হলেও সম্প্রতি সেখানে উৰ্দ্ধতন চীনা নেতৃবৃন্দ সফরে গিয়েছিলেন। সম্প্রতি জিনজিয়াং-এর প্রধান শহর ইউরুমচি ও কাশঘরে চীনা প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন, প্রধানমন্ত্রী লী পেং এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মার্শাল ফু কুরান-উ সফর করেন। উল্লেখ্য, গত বছরের গোড়ার দিকে চীন রাশিয়া, কাজাখিস্তান, কিরগিজিস্তান ও তাজিকিস্তানের সাথে সশস্ত্র মুসলিম স্বাধীনতাকামীদের দমনের জন্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই চীন জিনজিয়াং-এ সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধিসহ দমন অভিযান জোরদার করে। আলমাআতায় বসবাসরত মাদান মুখলিসি এবং তার পিতা ‘রেভ্যুলেশনারী ফ্রন্ট অব ইন্টার্ন তুর্কিস্তান’ নামে একটি সংগ্রাম পরিচালনা করেন বলে জানান। তারা তাদের সংগঠনের ২৩ টি ইউনিট আছে বলে দাবী করেন। জনাব মুখলিসি বলেন, আমরা মনে করি, স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে লড়াই করতে হয়। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আমরা গণতন্ত্র ও শান্তিপূর্ণ উপায় অবলম্বন করেছি। কিন্তু আমরা এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, চরমপন্থাই একমাত্র পথ। চীনা সশস্ত্র বাহিনীর দমন অভিযানের পর বাখাদী, কোজাম্বেরী ও মুখলিসির ৩টি উইঘুর সংগঠন এক সাংবাদিক সম্মেলনে জিনজিয়াং-এর স্বাধীনতার জন্যে এক সাথে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে।

    চীনে মুসলমানের উপর দমন অভিযান চালানোর বিষয়টি ইতোমধ্যেই মুসলিম বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তুর্কী পররাষ্ট মন্ত্রণালয় পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছে বলে জানিয়েছে। সৌদী সংবাদপত্র আল বিলাদ বলেছে, জিনজিয়াং-এর সংঘর্ষের খবরে মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান জিনজিয়াং পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে বলে জানিয়েছে। বিশ্ব পরিস্থিতিতে এখন ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। দেশে দেশে পরাধীনতার শৃংখল ভেঙ্গে জনগণ স্বাধীনতার দাবীতে ক্রমশঃ সোচ্চার হচ্ছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়ে সেখানে ১৫টি স্বাধীন রাষ্টের জন্ম হয়েছে। বিশ্বের কোন স্বাধীনতাকামী জাতিকেই জোর করে দাবিয়ে রাখা যায় না। জিনজিয়াং-এর মুসলমানরাও তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবার লক্ষ্যে তাদের জন্মভূমির স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। একদিন হয়তো তারাও স্বাধীনতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছে যেতে সক্ষম হবে।