JustPaste.it


ধারাবাহিক উপন্যাস

মরণজয়ী-মুজাহিদ
মল্লিক আহমদ সরওয়ার
 =================================


       চীফ কমান্ডারের নিকট পৌঁছে আলী ও মেজর ফাইয়্যাজ সমস্ত বিবরণ পেশ করল। তাদের পাহাড়সম হিম্মত ও সাহসিকতার দাস্তান শুনে কমান্ডার মুচকী হেসে বললেন, ইসলামের সোনালী যুগের নমুনা পেশ করেছ তোমরা, তোমাদের ব্যাপারে আমি অত্যন্ত চিন্তিত ছিলাম, আল্লাহ্র শোকর, তোনরা সবাই সুস্থ এসেছ।
      আঃ করীমের আম্মা এবং ইয়াসীনের বিবি বাচ্চাকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়া হয়। কয়েকদিন পর মেজর ফাইয়্যাজ হায়দার মারকাজে ফিরে আসেন-যাতে শহরের নিকটে থেকে গুপ্ত হামলার তদারকী করা যায়।
     শীতের মওসুম শেষ হয়ে বসন্তের আগমনী শুরু হয়েছে। পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করেছে। এমন সময়ে মুজাহিদদের কাছে সংবাদ পৌছল যে, কাবুল উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, বৈঠকে মুজাহিদদের গুরুত্বপূর্ণ বড় মারকাজ গুলোর উপর প্রচণ্ড আক্রমণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আলী যে মারকাজে এখন অবস্থান করছিল সেটাও এ আক্রমণের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ক্যাম্পটি তিন দিক দিয়ে পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। শুধু উত্তর দিকে একটি রাস্তা আছে, এ রাস্তাটি দিয়ে বড় বড় প্রাদেশিক শহর ও কাবুলের সাথে মিশেছে। তা মুজাহিদরা এর নাম রেখেছে ট্রাঙ্ক রোড। বেশ কিছুদিন যাবত এ সড়ক মুজাহিদদের দখলে, সরকারী ফৌজ সড়কটি দখল করার জন্য বার বার হামলা করেও ব্যর্থ হয়েছে। 
     মুজাহিদদের এ ক্যাম্পটি আধুনিক পদ্ধতিতে নির্মিত। ক্যাম্পের মাঝে পাহাড় খুড়ে বড় বড় গুহা তৈরী করা হয়েছে। আহতদের জন্য আন্ডার গ্রাউন্ড হাসপাতালও রয়েছে এখানে। পাহাড় কেটে তৈরী করা হয়েছে একটি সুদৃশ্য মসজিদ। গুহার মধ্যে রেডিও ষ্টেশনও আছে। সমস্ত আফগানিস্তানে এ ষ্টেশন থেকে অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। রুশী মুসলমানদের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় রুশ ভাষায়। পাহাড়ের উপর বিমান বিধ্বংসী তোপ তাক করে রাখা হয়েছে। ক্যাম্পের এক পার্শ্বে অতিথি মুজাহিদদের জন্যে হোটেলের ব্যবস্থাও রয়েছে নবাগত যুবকদেরকে এখানে ট্রেনিং দেয়া হয়। আবার অন্যান্য প্রদেশ ও ক্যাম্পে এখান থেকে অস্ত্র সরবরাহও করা হয়ে থাকে। এ সব কারএ ক্যাম্পটি অত্যাধিক গুরুত্ব রাখে। এ ক্যাম্পের যুদ্ধবাজ মুজাহিদরা শত্রুর কাছে যমদূত রুপে পরিচিত। এ মারকাজের ব্যাপারে শত্রু পক্ষ অত্যন্ত চিন্তিত। তাই এর উপর আক্রমণের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ওরা।
      মার্চের প্রথম সপ্তায় সংবাদ পাওয়া গেল যে, দুশমনের সশস্র ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ী সহ বিরাট এক কনভয় মারকাজের নিকটবর্তী এক ছাউনীর দিকে এগিয়ে আসছে। শত্রপক্ষের প্রোগ্রাম হল, প্রথমে পোষ্টি দখল করে সেখানে সামরিক সরঞ্জাম জমা করা, পরে সেখান থেকে সরাসরি মারকাজে হামলা করা। বোমারু বীমানগুলো কনভয়ের ওপর দিয়ে উড়তে থাকে। কণভয়ের অগ্রযাত্রা রোধ করতে মুজাহিদরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কনভয়ের পদে পদে বিছানো হয় ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন, গর্ত খনন করা হয় স্থানে স্থানে এবং ওঁৎ পেতে কয়েক জায়গায় কনভয়ের উপর হামলাও করা হয়। এসব পদক্ষেপের কারণে শত্রু পক্ষকে পদে পদে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়েছে। কনভয় এক সপ্তাহের জায়গায় ছয় সপ্তাহ পর তাদের লক্ষে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। মুজাহিদদের এসব অতর্কিত হামলার প্রত্যকটিতে আলী অংশ গ্রহণ করে। মুজাহিদরা ধারণা করে যে, শত্রুপক্ষের সৈন্য ও সরঞ্জামের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং তারা ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। তাই তারা এখনই আমাদের মারকাজের উপর আক্রমণ করতে সাহসী হবে না। কিন্তু একদিন অতর্কিতভাবে তারা হামলা করে বসল।
     দিনটি ছিল এপ্রিল মাসের জুমাবার। এ সময়ে ক্যাম্পের বেশী সংখ্যক মুজাহিদ পরিবার পরিজনের সাথে সাক্ষাত করতে পাকিস্তান চলে গিয়েছে। মার্কাকাজে উপস্থিত মুজাহিদদের সংখ্যা বেশী হলে একশ হবে। সকাল বেলা শত্রু পক্ষের বিশটি বোমারু বীমান দেখা গেল, সাথে এক ডজন হেলিকপ্টার। শুরু হল মারকাজের উপর বোমা বর্ষণ এবং মারকাজের তিন দিক থেকে হেলিকপ্টার হতে নেমে আসে কমান্ডো বাহিনী, যাতে কোনদিক হতে মুজাহিদরা সাহায্য না পায়। চতুর্দিক দিয়ে শত্রুপক্ষ বিরাট শক্তি ও বিশাল বাহিনি নিয়ে প্রচন্ড আক্রমণ করে। অল্পক্ষণের মধ্যে তারা মুজাহিদ ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড় দখল করে নেয়।
     ক্যাম্পে উপস্থিত সব মুজাহিদ একত্র হন। তারা সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নেন, শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়ে যাবেন। তখনই মুজাহিদদের এন্ট্রি এয়ার ক্রাপট গুলো সরব হয়ে উঠে। শত্রু বিমানের উপর শুরু হয় একের পর এক ফায়ার। 
     কিন্তু শত্রু বিমান তোপের রেঞ্জের বাইরে থাকায় কাজ হচ্ছে না। ওপর থেকে তারা হাজার পাউন্ড ওজনের বোমা ছুড়ছিলো। তা দেখে মনে হয়, বিমানের পেট ফুঁড়ে বুঝি আরেক বিমান বের হয়ে আসছে। বোমায় মুজাহিদদের এয়ার ক্রাপ্ট গান একটা একটা করে ধ্বংস হয়ে যায়। ক্যাম্পের কয়েক স্থানে নাপাম বোমার বিষ্ফোরণের আগুন ধরে যায়।
     বোমাবর্ষণে থেকে বাচার জন্যে মুজাহিদরা পাহাড় খোদিত এক গুহায় আশ্রয় নেয়। মুজাহিদ সংখ্যা এখন মোট ৭০জন। হঠাৎ গুহার উপর বিরাট এক বোমা আঘাত হানে, তাতে ৪৫ জন মুজাহিদ চাপা পড়ে শাহাদাত বরণ করেন। গুহার মুখ বুন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাকীরা গুহার ভিতরে আটকা পড়ে যান।
     গুহায় আটকা পড়া মুজাহিদদের মধ্যে আলীও একজন। বদ্ধ গুহায় অতিরিক্ত ক’ঘন্টা তারা জীবিত থাকবে তা বলা মুস্কিল ছিলো। আর এমন প্রচণ্ড বোমা বর্ষনের মাঝে বাইরের কোন সাহায্যেরও আশা করা যায় না। বাহির থেকে সাহায্য আসলেও গুহা মুখে জমা কয়েক হাজার টন মাটি সরাতে প্রচুর সময়ের প্রয়োজন। ততক্ষণে অক্সিজেনের অভাবে গুহাবস্থিত মুজাহিদরা কেউ বেঁচে থাকবে না। আলী এসব ভাবছিলো। অন্যরাও বসে বসে এ ভাবনায় ছিলো। বদ্ধ গুহার গাড় অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না।
     এভাবে দু’ঘন্টা কেটে যায়। মুজাহিদদের শ্বাস কষ্ট অনুভব হচ্ছে। চীফ কমান্ডারও বোমার আঘাতে আহত। তিনি সব মুজাহিদদের উদ্দেশ্য করে বল্লেন, ‘মুজাহিদ ভায়েরা আমার! আমাদের আগে যারা শাহাদাত বরণ করলেন, আমরাও ক্ষণিক পর হয়ত একে একে সবাই তাদের সাথে গিয়ে মিলিত হব। তবে ভয়ের কিছু নেই। কারণ তারা যেমন আল্লাহ্র জন্যে জীবন বিলিয়েছেন, ঠিক তেমনি আমরাও তাদের পথে জীবন দিব। রব্বে যুলজালাল ঘোষণা দিয়েছেন, “এবং যারা খোদার পথে জিহাদ করে এবং নিহত (শহীদ) হয় অথবা মৃত্যু বরণ করে আল্লাহ্ পাক তাদের উত্তম রিযিক দান করবেন এবং নিশ্চিয়ই আল্লাহ্ পাক একমাত্র উত্তম রিযিকদাতা। তাদের তিনি এমন স্থানে প্রবেশ করাবেন যার উপর তারা সন্তুষ্ট। (সূরা হজ্জ)
      তারপর কমান্ডার সাহেব বল্লেন, আল্লাহ্র দরবারে আমাদের প্রতিদান জয়-পরাজয়ের উপর নির্ভরশীল নয়। আল্লাহপাক অবগত যে, আমাদের নিয়ত বিশুদ্ধ-নিখাদ। আমাদের কারো মনে পার্থিব সম্পদের লালসা নেই। দ্বীন ইসলাম এর জন্যই শুধু আমরা জিহাদে ঝাপিয়ে পড়েছি, জালিমের বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছি। আমাদের সাথীদের মৃত্যু আল্লাহ্র নিকট সম্ভবত এইভাবে কাম্য ছিল এবং আমরাও হয়ত তাদেরই মত শাহাদত বরণ করতে যাচ্ছি। আমাদের সবার হৃদয়ে একই আকাঙ্ক্ষা, একই আশা, স্বদেশকে আমরা মুক্ত-স্বাধীন করব। আবার আফগানিস্তানের আকাশে উড্ডীন হবে ইসলামী ঝান্ডা। আর যে সব শহীদ আমাদের পূর্ব আল্লাহ্র দরবারে পৌঁছেছেন তাদেরও কামনা ছিল এটাই। বন্ধুরা! এসো সবাই মিলে আল্লাহ্র দরবারে একবার দুআ’ করি, যেন তিনি আমাদের গুনাহ মাফ করেন। কবুল করেন আমাদের এই শাহাদাত। আমাদের দেশ যেন আবার হয় মুক্ত-স্বাধীন। সব মুজাহিদ বল্লেন, ‘আমীন’
      কিছুক্ষণ পর্যন্ত মজলিস নবীর। এরপর একদিক হতে আলীর কণ্ঠ শুনা যায়ঃ ‘শ্রদ্ধেয় কমান্ডার সাহেব! শাহাদাত আমাদের একান্ত কাম্য, শাহাদাত লাভ গৌরবের বিষয়, মৃত্যুকে ভয় করি না আমরা। কিন্তু দুঃখ হচ্ছে এ কারণে যে, আমরা অসহায়ের মত মৃত্যু বরণ করতে যাচ্ছি। আমরা আল্লাহ্র নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি নে কেন। যিনি সর্বময় ক্ষমতাবান। তিনি আমাদের সাহয্য ফেরেস্তাও পাঠাতে পারেন। বদর ময়দানে আল্লাহ্ পাক কি ফেরেস্তা দিয়ে মুজাহিদদের সাহায্য করেন নি। আর আবরাহার হস্তী বাজিনীকে আবাবীল পাখী দ্বারা ধ্বংস করেননি? তবে কেন আমরা সেই রাব্বে জুলজালালের দয়া থেকে নিরাশ হচ্ছি?
      আলী কথা শেষ করতেই মুজাহিদ কমাণ্ডারের কণ্ঠ শুনা যায়। ‘বন্ধুগণ! আলী ঠিকই বলেছে। সত্যিই আমাদের বাঁচার জন্যে বাহ্যিক কোন উপকরণ দেখছিনা। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, আল্লাহ্ পাক সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। হযরত ইউনুস (আঃ) সমুদ্রে নিক্ষেপিত হয়ে মাছের উদরে গেলে তিনি আল্লাহ্র নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। তখন কি মাছ তাকে তীরে রেখে দেয়নি? আর হ্যাঁ, আমার আরও স্মরণ আসছে, নবীজি (ﷺ) বনী ইসরাইলের তিনজন ঈমানদার লোকের ব্যাপারেও এরূপ ঘটনা বর্ননা করেছেন। তারা পাহাড়ের গুহায় আটকা পড়েছিলেন। ঘটনার বিবরণ অনেকটা এরূপঃ
      বনী ইসরাইলের তিন ব্যক্তি ভ্রমণে বের হয়। তারা কোন এক জায়গায় পৌছলে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। এমন সময় প্রবল বর্ষা শুরু হয়। প্রচণ্ড ঝড় বইতেছে। ঝড় থেকে বাঁচার জন্যে তাঁরা তিনজন এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়। প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টির ফলে পাহাড়ের উপর থেকে একটা পাথর গড়িয়ে পড়লে গুহা মুখ বন্ধ হয়ে পড়ে। ভাবতে থাকে, কিভাবে এ গুহা থেকে বের হওয়া যাবে। তিনজন মিলে সমস্ত শক্তি দিয়ে পাথরটিকে ধাক্কা দেয়। কিন্তু পাথরটা এত বড় যে, এক ইঞ্চিও সরলনা। এবার তাঁরা ভাবলো যে, আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত। একজন বল্লো, ‘আমরা স্ব স্ব নেক আমলের ওছিলা দিয়ে আল্লাহ্র নিকট সাহায্য চাইলে হয়ত আল্লাহ্ পাক আমাদের বাঁচার উপায় করে দিবেন। বাকী দু’জনও তার কথায় সমর্থন জানায়।
     এরপর তাদের একজন মিনতিভরে দু’আ করলো, হে আল্লাহ্! আমি আমার বৃদ্ধ মাতা পিতার সেবা করতাম একান্ত ভাবে নিষ্ঠার সাথে। তাদের না খাইয়ে আমি আমার বাচ্চাদের কখনও খাওয়াতাম না। আমিও খেতাম না। একদিন আমি জীবিকা উপার্জনের উদ্দেশ্যে বহু দূর চলে যাই। ফিরে এসে দেখি, মা-বাবা না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি তাদের জন্যে দুধ জ্বালালাম। এ সময় তাদেরকে জাগানো ঠিক হবে না এবং তাদের পূর্বে অন্য কাউকে দুধ খাওয়ানোও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এ অবস্থায় দুধ নিয়ে তাদের শিয়রে সারারাত দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার সন্তানেরা ক্ষুধার জ্বলায় আমার পায়ে পড়ে কাদঁতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর হল। মা-বাবা জেগে উঠে দুধ পান করলেন। হে আমার মালিক! এসব কিছু যদি তোমার সন্তুষ্টির জন্যে করে থাকি তবে এগুহার মুখ থেকে পাথরটা সরিয়ে দাও। দু’আ শেষ হতেই পাথরটা গুহা মুখ থেকে অল্প একটু সরে যায়।
     এরপর দ্বিতীয় ব্যক্তি দু’আ করলো, হে আল্লাহ্! আমার এক অপরূপা চাচাতো বোন ছিল, আমি তাকে সীমাহীন ভালবাসতাম। একবার বদ নিয়তে তার নিকটে গেলাম। কিন্তু সে আমার আহবানে সাড়া দিল না। কারণ সে আমার আহবানে সাড়া দিল না। কারণ সে সতী এবং তোমাকে ভীষণ ভয় করত। একবার আমাদের দেশে ভীষণ দূভিক্ষ দেখা দেয়। ঐ যুবতী অভাবের তাড়োনায় মার নিকট সাহায্য চাইতে আসে। আমার কুমতলব আবার জেগে উঠে। তাকে বল্লাম, ‘আমার কাম তৃষ্ণা নিবারণের শর্তে তোমাকে একশ বিশ দীনার দিতে প্রস্তুত আছি।‘ অভাবের তাড়নায় নিরূপায় হয়ে সে তাতে সম্মত হল। কিন্তু আমি তার দিকে অগ্রসর হতেই সে বল্লো, ‘আল্লাহকে ভয় কর। পাপ থেকে বেঁচে থাকো’। এ কথার পর আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। প্রবল কামনা সত্ত্বেও অপরাধে লিপ্ত হলাম না। আর দীনার গুলোও তাকে দিয়ে দিলাম। আয় আল্লাহ্! এসব কিছু যদি তোমার ভয় ও সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করে থাকি তাহলে আমাদের এ বিপদ হতে উদ্ধার করো। তার দু’আ শেষ হতেই পাথরটা আরেকটু সরে যায়। কিন্তু এখনও বের হওয়া সম্ভব নয়।
     তৃতীয় জন দু’আ করলো, ‘আয় আমার আল্লাহ্! তুমি অবগত আছ যে, একবার আমি ক’জন শ্রমিক নিয়োগ করি। তাদের সবার পাওনা উসুল করে দেই। কিন্তু একজন আর পাওনা না নিয়েই চলে যায়। আমি তার পাওনা টাকা ব্যবসায় খাটিয়ে বহু অর্থ আয় করি এবং সে অর্থ দিয়ে কয়েকটি উট, গরু, ছাগল এবং দাস খরিদ করি। বহু দিন পর সে কর্মচারী আমার নিকট এসে তার পাওনা চায়। আমি ওই সমস্ত উট, গরু, ছাগল এবং দাস গুলি তাকে দিয়ে দিলাম। সে স্তম্ভিত হয়ে বল্লো, ওহে আল্লাহ্র বান্দা! আমার সাথে ঠাট্টা করোনা। তোমার সম্পদ নয়, আমি আমার পাওনা টাকা কয়টা চেয়েছি। তখন আমি তাকে বুঝিয়ে বল্লাম, ঠাট্টা করছি না তোমার সাথে। এসব সম্পদ তোমার সেই পাওনার লভ্যাংশ। অতপর সে খুশী মনে তার সব সম্পদ নিয়ে চলে যায়। হে আল্লাহ্! এসব যদি তোমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করে থাকি তাহলে আমাদের এ বিপদ থেকে উদ্ধার করুন।‘ তার দু’আ শেষ হতেই পাথর পূর্ণ সরে যায়। তাঁরা তিনজন এভাবে গুহা থেকে বের হয় এবং লাভ করে নতুন জীবন।
       এঘটনা বর্ণনার পর মুজাহিদ কমাণ্ডার বল্লেন, ‘বন্ধুরা! এসো আজ আমরাও আল্লাহ্ পাকের নিকট অনুরূপ দু’আ করি। তিনি আমাদের কারো নেক আমলের বদলে এ বিপদ থেকে হয়ত আমাদের উদ্ধার করবেন।
      এরপর এক মুজাহিদ দু’আ করলো, ‘হে আল্লাহ্! তুমি জান, আমি কলেজে পড়াকালীন সময়ে একদিন আমাদের গ্রামে কমিউনিস্টরা শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রা দেখতে আমিও গিয়েছিলাম। তাঁরা কমিউনিজমের শ্লোগান দিচ্ছিলো। শোভাযাত্রা এক মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁরা ইওলাম বিরোধী শ্লোগান দেয়া শুরু করে। কারণ ওই মসজিদের সম্মানিত ইমাম সাহেব ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পক্ষে নিয়মিত বক্তৃতা দিতেন। রাশিয়ায় মুসলমানদের উপর বর্বর কমিউনিস্টদের নিপীড়নের কাহিনী তিনি মানুষদের শুনাতেন। তখন ইমাম সাহেব মসজিদ থেকে বেরিয়ে ইসলাম বিরোধী শ্লোগানের কঠোর প্রতিবাদ জানান। এতে রুষ্ট হয়ে কমিউনিস্টরা তাকে আঘাতে আঘাতে মেরে ফেলে, মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং কুরআন শরীফ ছিড়ে বাথরুমে নিক্ষেপ করে। উপস্থিত ক’জন লোক এর প্রতিবাদ জানিয়ে বল্লো, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর’। একথা শুনে কমিউনিস্টরা অগ্রসর হয়ে বল্লো, যাও, তোমার আল্লাহকে ডেকে আন’। এই বলে সে বর্বর কমিনিস্টি পবিত্র কুরআনের ছিন্ন পাতায় প্রস্বাব করতে থাকে। এসব দেখে আমার চরম রাগ উঠে। তখনই দৌড় ঘরে যাই এবং বন্দুক এনে ঐ কমিউনিস্ট সহ আরো কয়েকজন নাস্তিককে হত্যা করে মুজাহিদদের সাথে যোগ দেই। হে আল্লাহ্! এসব কিছু যদি তোমাকে ভালবেসে করে থাকি তাহলে আমাদের মদদ কর’।
           সবাই বল্লো, ‘আমীন’ ।
       এরপর আরেক মুজাহিদ দু’আ করলো। ‘হে আমার রব! তুমি জান, আমি ও হামেদ একই সাথে পড়া-লেখা করতাম। সে ছিল আমার বাল্য বন্ধু। আমাদের বন্ধুত্ব ছিল অত্যন্ত গভীর। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সে কমিউনিস্ট হয়ে যায়। আমি তাকে বহুবার বুঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সে তা মানলো না। আমার এসব কথাকে ঠাট্টার মতো উড়িয়ে দেয়। সে কুরআনকে বলতো খৃস্টান রচিত গ্রন্থ। হে আল্লাহ্! তোমার রাসূলের শানে সে অত্যন্ত অশালীন বাক্য উচ্চারণ করত। একদিন সে ক্লাশ্রুমে সবার সামনে কুরআন ও ইসলাম বিরোধী বক্তৃতা দিতে শুরু করে। আমি প্রথমে তাকে এ সব বলা থেকে বিরত থাকতে বল্লাম। কিন্তু সে উল্টো আমার সাথে ঝগড়া বাঁধায়। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে অশালীন বক্তৃতা দানকারী এই মুরতাদকে প্রচণ্ড প্রহার করলাম। যদিও সে এক সময় আমার অতি আপনজন ছিল। এরপর আমি তা নাপাক জিহবাটা কেটে ফেলি। হে আমার মাওলা, এসব কিচু যদি তোমার করুণা পাওয়ার আশায় করে থাকি তবে তুমি আমাদের মদদ কর’।
        সব মুজাহিদ বল্লো, ‘আমীন’!
      এমনিভাবে সব মুজাহিদ পালাক্রমে দু’আ করলেন। সবশেষে কমান্ডার সাহেব দু’আ করলেন, হে আল্লাহ্! তুমি জান, এদেশে রুশ আহিনীর জবর দখলের পর থেকে আবাল বৃদ্ধ বনিতার উপর নিপীড়ন চলছে। গ্রামের পর গ্রাম পরিণত হয়েছে বিরাণ ধ্বংস্তুপে। ভেংগে ফেলা হয়েছে অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা। আর তোমার নাম স্মরণ করার অপরাধে শহীদ করা হয়েছে মুমিন বান্দাদেরকে। এসব কিছু আমি সইতে পারলাম না। তাই তোমার পথে অস্ত্র তুলে নিলাম। এগুলি যদি তোমার সন্তুষ্টির আশায় করে থাকি তবে আমাদেরকে মদদ কর’।
      কমান্ডার সাহেবের দু’আয় মুজাহিদরা আমীন বলতেই বাইরে প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ হয়। পাহাড় কেঁপে উঠে। বিকট শব্দে মনে হচ্ছিলো, বাইরে যেন কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে। শব্দ শুনেই মুজাহিদরা চোখ বন্ধকরে ফেলে। এবার সবাই চোখ মেলে দেখল, গুহা আলকিত হয়ে উঠেছে। গুহা মুখ উন্মুক্ত। গুহার মুখে জমানো হাজার টন মাটি বহু দূরে ছিটকে পড়েছে। এত জলদী দু’আ কবুল হওয়াতে মুজাহিদরা বিস্মিত হল।
     অশ্রু ভেজা নয়ন সবাই মহামহীমের দরবারে সেজদাবনত হয়। ব্যাপারটা হলো, এক ডজন শত্রু ফাইটার পুনরায় এসে ক্যাম্পের উপর প্রচণ্ড বোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। ফাইটার থেকে দু’টি বিরাটকায় বোমা গুহা মুখের স্তুপের উপর বিস্ফোরিত হয়। এতে গুহা মুখে জমে থাকা মাটি ও পাথর বহুদূরে ছিটকে পড়ে। এভাবে আল্লাহ্ পাক শত্রু বিমান দিয়ে স্বীয় বান্দাদের মদদ করে আপন সর্বময় ক্ষমতার এক ঝলক তাঁর বান্দাদের অবলোকন করান।
     মুজাহিদরা গুহা থেকে বেরিয়ে হিসেব নিয়ে দেখলেন, তাদের এয়ার ক্রাপ্টগানের সবগুলিই ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধুমাত্র ভুমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য তিনটি কামান ঠিকঠিক আছে। আর তিনজন মুজাহিদ সেগুলো দ্বারা ফায়ার করে দুশমনের অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে রেখেছে। ওদিকে শত্রুর বোমারু বিমান থেকে তাদের উপর অজস্র বোমা নিক্ষেপিত হচ্ছে। কয়েকটা বোমা তাদে একেবারে পাশে এসে বিস্ফোরিত হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্ পাক তাদের হেফাজত করেছেন।মারকাজের মধ্যে এখনও ত্রিশ জন মুজাহিদ বেঁচে আছেন। বিশ জন আহত এবং বাকী সবাই শহীদ হয়েছেন।
     চীফ কমান্ডারের সামনে এখন দি’টি সমস্যা। প্রথম, আহত এবং শহীদদের লাশ নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরিত করা। দ্বিতীয়ত, রেডিও ষ্টেশন ওয়াগনটা কোন নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া। এখন আর মারকাজ হেফাজত করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
     অন্যান্য মুজাহিদদের সাথে পরামর্শ করে কমাণ্ডার সাহেব সিন্ধান্ত দিলেন, কয়েকজন মুজাহিদ কামান দাগাতে থাকবে। পাচজন থাকবে আমার সঙ্গে। বাকীরা এক্ষুণি রেডিও ষ্টেশন-গাড়ী এবং আহত ও শহীদদের নিয়ে মারাকাজ থেকে বেরিয়ে পড়বে। এ মারকাজ থেকে কোন কিছু নিরাপদে স্থানান্তর করা সম্ভব মনে হচ্ছিল না। কারণ শত্রু বিমান মুষলধারে বোমাবর্ষণ করে চলছে। আর সবগুলি পথে রুশ কমান্ডো ওঁৎপেতে আছে। তারপরও দু’জন মুজাহিদ রেডিও-ষ্টেশন নিয়ে গাড়ীতে উঠে বসলেন। বাকীরা আহত ও শহীদদের পিকআপে তুল্লেন। এরপর আল্লাহ্র উপর ভরসা করে ধীরে ধীরে রওয়ানা হলেন। তারা মারকাজ থেকে বেরুতেই শত্রু বিমান এসে তাদের উপর বোমা বর্ষণ শুরু করে। কিন্তু ড্রাইভার অত্যন্ত দক্ষ হাতে গাড়ী পার করে নেন। রাস্তায় তারা রুশ কমান্ডোদের অগণিত মৃত লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। ওরা বিমান থেকে মাটিতে নামতেই অন্য এক গ্রুপ মুজাহিদ ওদের হত্যা করে। ঐ গ্রুপ এখনও 
রাস্তা পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু মারকাজের চীফ কমাণ্ডার সে খবর জানেন না।

 

 

*********************************