JustPaste.it

সম্পাদকীয়

 

বিশ্ব মুসলিমের চিরন্তন জাতীয়তা


ভূ-প্রকৃতি, ভাষা, অঞ্চল, রক্ত, বর্ন ও রাষ্ট্রের  পরিচয়ে যে জাতীয়তা গঠিত হয়, তা নিতান্তই পার্থিব। এর কিছুটা প্রাকৃতিকভাবে নির্ধারিত হয়, আবার কৃত্রিম উপায়েও এর নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। যেমন ইংল্যান্ডের বাসিন্দারা ইংলিশ। ইংরেজী  বললেও ইংলিশ। তবে আমেরিকার ইংরেজীভাষীরা ইংলিশ নয়, ওরা ইংরেজী ভাষী মার্কিন। ভারতের বাংলাভাষীরা বাঙালী, কিন্তু জাতীয়তা তাদের ইন্ডিয়ান। ওরা বাংলাদেশী নয়। আর বাংলদেশের নাগরিকেরা বাংলাদেশী; এরা বাংলাভাষী। পাকিস্তানের সব নাগরিক পাকিস্তানী, এরা যেমন সবাই আবার সিন্ধী, বিহারি, পাঞ্জাবীও, তবে ভারতীয় নয়। আর ভারতের বিহারী ও পাঞ্জাবীরা যেমন পাকিস্তানী নয়। বাংলাদেশের পাহাড়ী, হাজং, মুরং, চাকমা, সাঁওতাল, গারোরা যেমন বাঙালী নয়, কিন্তু বাংলাদেশী। ইরাক, কুয়েত, আমিরাত, বাহরাইনের লোকেরা আরব, তবে সৌদী নয়। সউদীরাও তেমন কুয়েতী, ইরাকী, বাহরাইনী নয়। অথচ এদের সবাই আরব। এই হলো জাতীয়তার হিসাব।
পাঠক! নিশ্চয়ই জাতীয়তা নির্ধারণের এ বৈচিত্রপূর্ণ নীতিমালার উল্টা-সিধা ব্যাখ্যায় ইতিমধ্যেই হাঁপিয়ে উঠেছেন। হাঁপিয়ে ওঠারই কথা। আঞ্চলিকতা, ভাষা, বর্ণ ও গোত্রনির্ভর জাতীয়তা আজকের শতধাবিভক্ত বিশ্ব মানচিত্রে আর ধরে রাখা সম্ভব নয়। এখানে এখন রাষ্ট্রীয় সীমানা ও নাগরিকত্ব ভিত্তিক জাতীয়তা চালু হয়ে হয়ে গেছে। কেননা, একই ভাষাভাষীদের বহু দেশ হয়েছে, একই জাতি-গোষ্ঠীর বহু আবাস হয়েছে, অভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অসংখ্য স্বদেশ হয়েছে। সুতরাং '৪৬-এ যে ইন্ডিয়ান-বৃটিশ, '৪৭-এ সে-ই পাকিস্তানী। '৭১-এ আবার সে-ই বাংলাদেশী। যতদিন বাংলাদেশ টিকে থাকবে, ততদিন ইনশা আল্লাহ্ সে এ পরিচয়েই থাকবে। আর এ যুগ পরম্পরায় প্রতিটি লগ্নেই সে হয়ত বাঙালী, পাহাড়ী বা গারো, হাজং, সাওতাল বা মুরং। বাংলাদেশী কিংবা অহমিয়া উর্দু, হিন্দী, রোহিঙ্গা ইত্যাদি ভাষার অপভ্রংশ সমৃদ্ধ কোন মিশ্র ভাষাভাষী। আর এসব যুগ ও শাসন ধারাক্রমের প্রতিটি দিনক্ষণ ও মুহূর্তেই এ লোকটি আবার হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা নাস্তিক।
এখন জাতীয়তা নির্ধারণ খুবই মুশকিল। যেমন, এক ব্যক্তি একই সাথে মানুষ এবং পুরুষ। একই সাথে পুত্র এবং পিতা। এই সাথে আবার সে স্বামী, ভ্রাতা, বন্ধু। এ ক্ষেত্রে এ লোকটির উপস্থিত পরিচয়টিই মুখ্য। এখানে এর পরিচিতি নিয়ে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও বিতর্ক কাম্য হতে পারে না।
কিন্তু মুসলমানদের একটি চূড়ান্ত ও মহাজরুরী চিন্তা-ভাবনার বিষয় আছে। অতিশয় অপরিহার্য সিদ্ধান্ত আছে। আর সেটি হলো, তাদের ঈমানী পরিচিতি। আকীদা-বিশ্বাস ও ইহ-পারলৌকিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট আত্ম-পরিচিতি। সেটি হলো মুসলমানদের দ্বীনী জাতীয়তা। মুসলমান একথায় 'একজন মুসলমান'। প্রথমেও সে মুসলমান,  মাঝেও সে মুসলমান, শেষেও সে মুসলমান। আদিতেও সে মুসলমান,মা ঝেও সে মুসলমান, অন্তেও সে মুসলমান। কারণ, মৃত্যুর পর কবরে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে না যে, তুমি কি বাঙালী না বাংলাদেশী? তুমি কি ঢাকা ভিত্তিক বাঙলা বলতে না কোলকাতাকেন্দ্রিক বাঙলা বলতে? তুমি কি উর্দুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ভারতের সাথে মিত্রতা গড়েছিলে? এসব কথা জিজ্ঞাস করা হবে না। প্রশ্ন করা হবে, তুমি কি মুসলমান ছিলে? তোমার মালিক পালনকর্তা কে? তোমার দ্বীন কি ছিল? তোমাদের নিকট খোদায়ী বার্তা বহনকারী এ মহান ব্যাক্তিটি কে? তাকে কি তুমি চেন? কি ধরনের সম্পর্ক তোমার এই মহান রসূলের সাথে? এ ধরনের জিজ্ঞাসাই করা হবে।
অতএব, দু'দিনের জিন্দেগীতে, ক্ষণিকের দ্বন্দ্ব আর নশ্বর বিতর্কে মেতে ওঠার চেয়ে বেশী যৌক্তিক হবে মূল পরিচয়, চূড়ান্ত জাতীয়তা আর সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা। আরব-আজম, পূর্ব-পশ্চিম, প্রাচ্য-প্রতীচ্য, ইরান-তুরান, ভারত-চীন, জাপান-জার্মান যেখানেই জন্ম হোক, বসবাস হোক, স্বদেশ হোক, বিদেশ হোক 'ইসলাম' আমার পয়লা পরিচয়। আমি বাংলাদেশেও মুসলমান, ভারতেও মুসলমান, আরবেও মুসলমান, আজমেও মুসলমান। হিন্দী, উর্দু, আরবী, ইংলিশ, ফারসী, তুর্কী যে ভাষাই বলি না কেন আমি মুসলমান। বাঙলা বললেও আমি মুসলমান। জীবনে আমি মুসলমান, মরণেও আমি মুসলমান। সুখের দিনেও মুসলমান, দুঃখ, দুর্দশা, লাঞ্ছনা আর গঞ্জনার দিনেও মুসলমান। পৃথিবীর যে কোন অঞ্চলে, ভূখন্ডে, পরিবেশে-প্রতিবেশে, জনপদে-অরণ্যে লোকালয়ে-বিজনে, সর্বত্র আমার পরিচয় আমি মুসলমান। বিশ হাত পানির নীচেও আমি মুসলমান, আকাশের নীলিমায়ও আমি মুসলমান। ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল, গোত্র ইত্যাদি আমার দেহের ভূষণ; রাষ্ট্র, দেশ ও মানচিত্র আমার জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেকের ভূষণ। জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, জীবন, আয়ু ও পরিচয় যখন মৃত্যুর স্পর্শে শেষ হয়ে যাবে, যখন আমার মাটির দেহ মাটিতে লীন হয়ে যাবে, তখন কি আমার দেশ থাকবে? আমার বর্ণ, বংশ, ভাষা, বর্ণমালা, অঞ্চল,ভূপ্রকৃতি আর জাতীয়তা থাকবে? কিন্তু আমার আত্মা অমর অক্ষয়। সে পরলোকে থাকবে। ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য ও ন্যায়-অন্যায়ের প্রতিফল ভোগের জন্য সে আলেমে বরযাখে প্রতীক্ষায় থাকবে। আর তার মুক্তি, শান্তি ও নিস্কৃতির জন্যে যে পরিচয়টুকুর ভীষণ প্রয়োজন। অপার্থিব জীবনের অনিঃশেষ সময়ে আমার সত্ত্বর যে জাতীয়তা, স্বাতন্ত্র্য আর শ্রেণী বৈশিষ্ট্যটুকু বিকল্পহীনভাবে অপরিহার্য। আজ এবং প্রতিদিন আমি যেন সে পরিচয়টুকুকেই আকড়ে ধরে রাখি। দু'দিনের জিন্দেগীতে আমি যত যা-ই হই, আমি যেন মুসলমান হই। যেন ইসলামই হয় আমার শাশ্বত জাতিসত্ত্বা। আমার চিরন্তন জাতীয়তার পরিচয়।
এ দূরদর্শী, লক্ষ্যভেদী, চূড়ান্ত ও অব্যর্থ  চিন্তাটুকু অন্তরে গেঁথে নিলে ইহজীবনের ভাষা, বৈচিত্র, রং, বর্ণ, গোত্র, বংশ, দল, মত, রাষ্ট্র, দেশ, ভুগোল, মানচিত্র আর পার্থিবতার সংকীর্ণতারা আত্মাকে কলুষিত করতে পারে না। আত্মার পবিত্রতা নিশ্চিত হলে পরে বুদ্ধি, চিন্তা, বিবেক, বিশ্লেষণ, আচার, আচরণ ইত্যাদি সবই সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতার সপক্ষেই থাকবে।