JustPaste.it

ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ মুসলিম বিশ্বঃ ইসলামের বিজয় কোন পথে?

আব্দুল্লাহ আল ফারুক

          ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী এই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ইসলাম পৃথিবীময় তার গৌরবোজ্জল পদচারণা অব্যাহত রেখেছিল। পৃথিবীর শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার সুমহান দায়িত্ব মিলিত বিশাল বিশাল বাহিনীকে বার বার নাস্তানাবুদ করে দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ইসলামের সেবা করে আসছিল।হাত্তিন, মানজিকার্ট, নিকোপলিশ, জালাকা, কনস্টান্টিনোপল, কসোভো প্রভৃতি যুদ্ধে পাশ্চাত্য তুর্কীদের নিকট সম্মুখ সমরে পরাজিত হয়ে অবশেষে তুর্কী সাম্রাজ্যকে টুকরো টুকরো করার নীল নকশা গ্রহণ করে।এই সময় তুর্কী সাম্রাজ্য পুরো আরব উপদ্বীপ,  জর্দান,  সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, ইরাক, কুর্দিস্তান, এশিয়া মাইনর ও পূর্ব ইউরোপের একাংশ নিয়ে গঠিত ছিল। ধূর্তবাজ সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপের কূটনীতির ফলে পূর্বেই তুর্কী সাম্রাজ্য থেকে হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া ও৷ সার্বীয়া  বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ এলাকায় পাশ্চাত্য শক্তি সর্বদা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উস্কানী দিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা জিইয়ে রাখতো  এবং বিচ্ছিন্নতা আন্দোলন একটু জোরদার হলেই ফ্রান্স, বৃটেন ও রাশিয়া মিলিতভাবে তুরস্কের ওপর কুটনৈতিক ও সামরিক চাপ প্রয়োগ করে তাদের পুরো পুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে মদদ যোগাত।প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময়,  বৃটেন কূটকৌশলে তুরস্ককে যুদ্ধ ক্ষেত্রে টেনে আনে।জার্মানি থেকে তুরস্কের ক্রয় করা দুইখানা জাহাজ ডুবিয়ে দেয় এবং দার্দানোলিজ প্রণালীর মুখে উস্কানীমূলক রণপোত বসিয়ে রাখে।এ সকল উস্কানীর কারণে তুরস্ক বিশ্ব যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য হয়।গুরুত্বপূর্ণ দার্দানোলিজ প্রণালী দখলের জন্য ৩ লক্ষ ইংরেজ সৈন্য মোতায়েন করা হয়।ফলে তুরস্কেরও বাছা বাছা ৫ লক্ষ সৈন্য এর প্রতিরক্ষায় মোতায়েন করতে হয়।এই সুযোগে ফ্রান্স,বৃটেন ও রাশিয়ার মিলিত বাহিনী সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশে প্রবল চাপ প্রয়োগ করে। তা সত্ত্বেও বাগদাদ রণাঙ্গনে কামাল পাশার নেতৃত্বে তুর্কী বাহিনীর হাতে ইংরেজদের চরম পরাজয় ঘটে।সম্মুখ রণে পরাজিত হয়ে বৃটেন এবার কূটনীতির খেলায় অবতীর্ণ হয়।বৃটেন ধাড়িবাজ লরেন্সকে আরব এলাকায় পাঠালো জাতীয়তাবাদ নামক বটিকা দিয়ে।লরেন্স আরবের মীর জাফর শরীফ হুসাইনকে হাত করল এবং আরব, প্যালেস্টাইন,  ইরাক ও সিরিয়ায় জাতীয়তাবাদের ধোঁয়া তুলে তাদেরকে তুর্কীদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুললো। ইংরেজরা তুর্কী সেনাবাহিনীতে কর্মরত আরবদের বোঝালো যে, তারা যদি মিত্র বাহিনীর সাথে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তবে যুদ্ধ শেষে তাদের স্বাধীনতা দেয়া হবে। ব্যাস,তুর্কী বাহিনী যখন ফ্রান্স, বৃটেন, রাশিয়ার মিলিত সৈন্যদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত ঠিক সেই সময় ৪ লক্ষ সৈন্য অস্ত্র-শস্ত্র সহ মিত্র বাহিনীর সাথে যোগ দেয়।রণাঙ্গনের চেহারা মূহুর্তের মধ্যে পাল্টে যায়।শরীফ হুসাইনের বিশ্বাস ঘাতকতার জন্য হেজাজ ও অন্যান্য আরব এলাকায়ও লক্ষাধিক তুর্কী সৈন্য বন্দী হয়।মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক তুরস্ক ভেঙ্গে সৃষ্টি হয় সিরিয়া, ইরাক, জর্দান, প্যালেস্টাইন, ইয়ামেন, কাতার, আরব আমিরাত, কুয়েত, সৌদি আরব সহ বহু আলাদা ভূখণ্ড। ভারত বর্ষের আজাদী আন্দোলনও এর প্রতিক্রিয়ায় চরমভাবে ব্যর্থ হয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিষ ফোঁড়া ইসরায়েলেরও জন্ম হয় এ সময়। আর মিশর, তিউনিসিয়া, সুদান, আলজেরিয়া, মরক্কো, ইরিত্রিয়া, ফ্রান্স ও বৃটেনের দখলে চলে যায়।তুরস্কের আওতাধীন বিশাল কুর্দিস্তান রাশিয়ার দখলে চলে যায়। পূর্ব ইউরোপে অভ্যুদয় ঘটে গ্রীক ও আলবেনিয়ার।তুরস্কের খেলাফত কাঠামো ভেঙ্গে যাওয়ায় ও মুসলিম বিশ্ব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে পরিণত হওয়ায় বিশ্বে মুসলিম শক্তি মুমূর্ষু সিংহে পরিণত হয়।যার জের আজও অব্যাহত রয়েছে।মুসলিম শক্তির এ নাটকীয় পতনের পর বহুস্থানে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় নিজেদের গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন পন্থায় আন্দোলন ঘটেছে। কিন্তু কোন কোন আন্দোলনের পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ ও তারা ইসলামী দর্শন  কাটছাট করে অনুকরণ করায় তা মুসলিম উম্মাহর নিকট সমানভাবে অনুকরণীয় আদর্শরূপে গ্রহণযোগ্য হয় নি। তা থেকে মুসলিম বিশ্বের উল্লেখযোগ্য কোন উপকার হয় নি।ইসলাম বিদ্বেষী দাম্ভিক শক্তির মোকাবিলায় সমগ্র মুসলিম বিশ্বের খেলাফত কাঠামো বা তার নিকটবর্তী কোন ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হওয়ারও কোন সুযোগ এর দ্বারা সৃষ্টি হয় নি।

 

          তুরস্কের উসমানীয়া খেলাফতের পতনের পর পাশ্চাত্যের সমর্থনে বাকী তুরস্কে কামাল পাশা ক্ষমতাসীন হন।পাশ্চাত্যের ইঙ্গিত ও ইসলাম বিদ্বেষী ভাবধারায় আক্রান্ত কামাল পাশা ভগ্ন তুরস্কের অবশিষ্ট মুসলমানদের ধর্ম পালনের ওপর কাঁচি চালান এবং তিনিই সর্বপ্রথম কোন মুসলিম দেশে পাশ্চাত্য থেকে ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদকে ধার করে আনেন।পর্দা প্রথা, আরবী পঠন ও পাঠনের ওপ্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।সুদীর্ঘ সময় ধরে তুরস্কে ইসলামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যে সংস্কৃতি ও শিল্প-কলা গড়ে ওঠে সেগুলো বিদায় করে পাশ্চাত্যের ফ্যাশন দুরস্ত নগ্ন পোশাক ও সংস্কৃতি চালু করা সহ শরীয়তের বহু আইন বাতিল করেন।মোটকথা, তার উদ্দেশ্য ছিল খেলাফত কাঠামো বাতিল করার সাথে সাথে দেশের সকল ক্ষেত্র থেকে ইসলামকে উচ্ছেদ করে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ কায়েম করা।

          এককালের পাশ্চাত্যের কাছে ভীতিকর শক্তি তুরস্ক আজ মাত্র ন্যাটোর একজন সদস্য। এককালের তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ বসনিয়ায় আজ চলছে মুসলিম নিধনযজ্ঞ। সেখানে তার পশ্চিমা খৃস্টান দেশগুলোর তাবেদার জাতিসংঘের নিকট হস্তক্ষেপ করার আবেদন ছাড়া কিছুই করার নাই। সে আজ এতই অসহায়।

          এককালের পৃথিবীময় আতঙ্ক সৃষ্টিকারী তাতার মোঙ্গল বাহিনীর বর্বর দমন অভিযানের মুখে যখন একের পর এক মুসলিম এলাকার পতন ঘটছিল, মিশরের পতন ঘটলেই যখন বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুসলিম জাতির অস্তিত্ব মুছে যেত, মুসলমানদের পবিত্র স্থান মক্কা-মদিনাও বিধর্মীদের হস্তগত হচ্ছিল,  প্রায় ঠিক তখনই মিশরীয়রা বীরের মতো ঘুরে দাঁড়াল, কুতুজ ও বেবারস আল বান্দুকধারীর নেতৃত্বে তারা মোঙ্গল বাহিনীকে ৩০০০ মাইল তাড়িয়ে নিয়ে যায়।ইসলামের এই বীরপুরুষ বেবারস একই সময়  পাশ্চাত্যের ৫ম ক্রুসেডার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে, বন্দী করে রাজা নবম লুইকে।এই মিশর থেকেই সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ক্রুসেডারদের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়ে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেছিলেন।ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই মিশর থেকেই সমগ্র উত্তর আফ্রিকায় ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ফলশ্রুতিতে উত্তর আফ্রিকার দুর্ধর্ষ  বারবার উপজাতির সন্তান তারিক বিন যিয়াদ মরক্কো থেকে অভিযান চালিয়ে সাগরের ওপারের দেশ স্পেন দখল করেন।এই মিশরকে কেন্দ্র করেই তখন গড়ে উঠেছিল শ্রেষ্ঠ ইসলামী শাসন ও সভ্যতা। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এই মিশর  ফ্রান্সের নেপোলিয়নের বাহিনীর নিকট পরাজিত হলে শুরু হয় অধঃপতনের আধার ইতিহাস।

          মিশরের ভৌগোলিক ভূখণ্ডের মধ্যে সীমিত আকারে উনবিংশ শতকের প্রথমে ও প্রথম বিশ্ব যুদ্ধোত্তর কালে যথাক্রমে মুহাম্মদ আলী পাশা ও জগলুল পাশার নেতৃত্বে দুটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে।  মুহাম্মদ আলী পাশা সাম্রাজ্যবাদী বৃটেনের নিকট থেকে দেশকে স্বল্প সময়ের জন্য মুক্ত রাখতে পারলেও জগলুল পাশার আন্দোলন অতটুকু সাফল্যও অর্জন করতে পারে নি। ১৯৪৮ সালে মিশরের শায়েখ হাসান বান্নার নেতৃত্বে "ইখওয়ানুল মুসলিমীন" নামে একটি খাঁটি ইসলামী গণআন্দোলন

          গড়ে ওঠে।কিন্তু সোভিয়েতের চক্রান্তে জামাল আবদুন নাসের নামক একজন সামরিক অফিসার ইসলামী দর্শন বিরোধী সংকীর্ণ "আরব জাতীয়তাবাদ এবং সুয়েজ খাল ইস্যুকে পূঁজি করে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে  ক্ষমতায় বসে সে পিরামিড ও ফেরাউনী সংস্কৃতি প্রবর্তন করে এবং ইসলামী সংস্কৃতি চর্চা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইখওয়ানের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্মমভাবে দমন অভিযান চালানো হয়, দেশকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অনুসারী বলে ঘোষণা করা হয়। মিশরে এখনো ধর্ম নিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ছ্দ্মাবরণে ইসলাম পন্থীদের কারারুদ্ধ ও ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে নিঃশেষ করে দেয়ার তান্ডব আজও অব্যাহত রয়েছে।

          মুসলমানদের প্রথম কিবলা ও পবিত্র স্থান বায়তুল মুকাদ্দাস আজও ইহুদীদের দখলে। জায়নবাদী ইসরাইল জেরুজালেম দখল করে সর্বপ্রথম এই মসজিদটির অবমাননা করে, লাখো লাখো আরবকে দেশ থেকে জোর করে বিতাড়িত করে। জবরদস্তি ভাবে আরব ভূখন্ডে প্রতিষ্ঠিত করব ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল। পাশ্চাত্যের মদদে মধ্য প্রাচ্যের মুসলমানদের ওপর বার বার হামলা চালায় এবং বিস্তৃত ভূখণ্ড দখল করে নেয়।আজ গোটা ফিলিস্তনী জাতি দেশ হারিয়ে প্রবাসী জীবনযাপন করছে। বিগত ২৯ বছর ধরে নিজেদের মাতৃভূমি উদ্ধার ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কায়েমের জন্য পি,এল,ও সশস্ত্র, রাজনৈতিক ও গণআন্দোলন উভয়ই  করেছে কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মঞ্জিল থেকে ক্রমশ দূরে সরে পড়ায় তারা যাদের হাতে লাখ লাখ আরব মুসলমানের রক্তে রঞ্জিত সেই ঘাতক ইহুদীদের সাথে হাত মিলিয়ে নিরর্থক আলোচনায় ব্যাপৃত হয়েছে।আশ্চর্যের ব্যাপার,  ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত সকল আরবই মুসলমান অথচ তাদের স্বার্থ আদায়ের আন্দোলনকারী সংগঠনটি ধর্ম নিরপেক্ষ ও সোভিয়েত ঘেষা যা নিশ্চিত একটি দুঃসংবাদ।

          বীরত্ব ও উদারতায় বিশ্বখ্যাত উপমহাদেশের মুসলমানরা বিশ্বের পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে ইসলামের তরবারী ও দর্শনকে যাদুঘরে আবদ্ধ করে রেখেছে। তারা এতখানি পরধর্ম সহিষ্ণু, উদার ও প্রচলিত মিছিল-মিটিং প্রিয় হয়ে পড়েছে যে, এখন তাদের মসজিদ ভাঙ্গছে, স্পেনের স্টাইলে ভারত থেকে মুহাম্মদী উম্মাতদের নিশানা মুছে ফেলার তৎপরতা চলছে, তবুও তারা সিংহের মতো গর্জে উঠছে না।মাত্র অল্প কয়েক বছর পূর্বেও অন্যায়ের প্রতিবাদে উপমহাদেশের রাজপথ যে সকল আলিমদের শহীদী রক্তে রাঙ্গা হতো কোথায় সেই সাহসী আলিম সমাজ?সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সেনাদের চলার পথ যে মুজাহিদদের তপ্ত শোনিতে পিচ্ছিল হতো, যে মুজাহিদদের তাকবীর ধ্বনিতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভিত পর্যন্ত কেঁপে উঠতো তাঁরা আজ কোথায়? পোস্টার, প্রতিবাদ সভা, সিস্পোজিয়াম ও বিবৃতির ভীড়ে সে মুজাহিদদের কাফেলা আজ হারিয়ে গেছে।একদা যারা ভারতকে ৮০০ বছর শাসন করেছে আজ সে দেশের সামরিক বাহিনীতে একজন মুসলমানও খুঁজে পাওয়া যায় না।  বিশ্বকে দেখানোর জন্য ধামাধরা দু'একজন মুসলমান আমলাকে প্রশাসনে 'শো' করা হয়।সবই ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।তবে ভাগ্যকে দোষী করে পরিত্রাণ নেই।যারা দূর্বল, যারা ঐতিহ্যহীন তারাই ভীরুর মতো ভাগ্যকে দোষী করে,পরিস্থিতির মোকাবিলায় নীরব হয়ে যায়।

          উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশ আলজেরিয়া দীর্ঘদিন উসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল।কিন্তু প্রতারণামূলক পদক্ষেপ নিয়ে ফ্রান্স ১৮৩০ সালে এ দেশটি দখল করে নেয়।ফরাসীদের এ অপকর্মের বিরুদ্ধে আমির আব্দুল কাদির জিহাদ ঘোষণা করেন। ইতিহাসখ্যাত দুর্ধর্ষ বারবাকদের জিহাদে অবতীর্ণ হওয়ায় ফরাসীদের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তারা ১৮৩৪ ও ১৮৩৭ সালে দু'দুবার সন্ধি করে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়।কিন্তু বিশ্বাসঘাতকের জাতি ফরাসীরা ১৮৪০ সালে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে আলজেরিয়া দখল করে নেয়। তখন আমির আব্দুল কাদির নির্বাসিত হলে তার অনুসারীরা জিহাদ অব্যাহত রাখে।তার অনুপস্থিতিতে এই ইসলামী আন্দোলনটি ক্রমশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পরিণত হয়।উডমা (UDMA), এম,এল,টি,ডি (MLTD) ও সর্বশেষ FLN নামে জাতীয়তাবাদী সংগঠনের নেতৃত্বে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।অবশেষে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরে আলজেরিয়া ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু FLN ছিল পরিপূর্ণ মার্ক্সবাদী কমিউনিষ্ট দর্শনে বিশ্বাসী।  FLN এর একনায়কতান্ত্রিক শাসন আমলে দেশ থেকে মিশর ও তুরস্কের স্টাইলে ইসলামকে বিতাড়নের চেষ্টা করা হয়।মানুষকে নাস্তিক ও কমিউনিস্ট বানানো সহ ঈমান ধ্বংসের যাবতীয় প্রচেষ্টা চালানো হয় অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। এই গোষ্ঠীর শাসনামলেই আব্বাস মাদানীর নেতৃত্বে একটি পূর্ণ ইসলামী আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামী সালভেশন ফ্রন্টের ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলে ইখওয়ানের ন্যায় এই সংগঠনটি একই পরিণতি বরণ করে।মধ্য প্রাচ্যের অধিকাংশ দেশে পাশ্চাত্যের খুঁটির জোরে কায়েম রয়েছে শেখতন্ত্র, আমলাতন্ত্র, রাজতন্ত্র ও দাম্ভিক একনায়কতন্ত্র। এর কোন দেশেই ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পূর্ণরূপে ইসলাম নেই।একনায়ক, আমির,শেখ, রাজা-বাদশারা শাসনের নামে শোষণ করতে বিভিন্ন দেশ থেকে যখন যেটুকু দরকার সেইটুকু মন্ত্র আমদানি করেন। ইসলামী শরীয়তকে উপেক্ষা বা বিরোধিতা করতে  তারা খুব কমই দ্বিধান্বিত হন। এর পাশাপাশি সমগ্র মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্যের প্রোপাগান্ডার ফলে লু-হাওয়ার মতো বইছে "গণতন্ত্র" নামক একটা ভয়ংকর প্রবাহ।অনেক মুসলিম দেশ এই কুফুরী গণতন্ত্র গ্রহণ করে কি প্রমাণ করছে না যে, আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলামের চেয়ে আল্লাহর সৃষ্ট  মানুষ এরিস্টটল, উইলসনের গণতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ এবং তারা কি পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে আল্লাহ অপেক্ষা এরিস্টটল ও গণতন্ত্রের প্রবক্তাদের বেশি জ্ঞানী ও পন্ডিত মনে করছে না?রাসূল (সাঃ) আমাদের পূর্ণাঙ্গ  জীবন যাপনের সকল পথের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।কুরআনের সর্বশেষ আয়াত যা বিদায় হজ্জের সময় নাযিল হয় তাতে আল্লাহ ঘোষণা করেছেনঃ

"আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম"।

          নিজ হাতে গড়া রাসূল (সাঃ) রাষ্ট্রে,তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বা আল-কুরআনের কোন বক্তব্যের সাথে বর্তমান প্রচলিত  গণতন্ত্রের দূরতম কোন সম্পর্কও আছে কি? অথচ গণতন্ত্রের নামে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব মাতাল হওয়ার দশা।গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও আঞ্চলিকতা কেন্দ্রিক আন্দোলন প্রভৃতির কারণে মুসলিম বিশ্ব এ পর্যন্ত ৫৩ টি খন্ডে বিভক্ত হয়েছে।ফলে সামগ্রিক ও আদর্শিক মুসলিম জাতীয়তাবাদ আজ ভূলন্ঠিত। ইসলামী দর্শন অনুযায়ী কোন মুসলিম ভূখণ্ড কোন শত্রু রাষ্ট্র কর্তৃক আক্রান্ত হলে সকল মুসলিম এক হয়ে সে ভূখণ্ড উদ্ধার করতে হবে।পাশ্চাত্যের প্ররোচনার ফলে মুসলিম রাষ্ট্রগুলি নিজ সীমান্তের বাইরের মাজলুম মুসলমানদের জন্য নৈতিক সমর্থন ছাড়া আর কোন সাহায্য করতে পারছে না। এজন্য অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, ধর্ষণ, গণহত্যার শিকার হচ্ছে রোহিঙ্গা, কাশ্মীরী, মরো, ফিলিস্তিনী, কুর্দি, বসনিয়া ও কসোভোর আলবেনীয় বংশোদ্ভূত মুসলমানরা।

ইসলামের ইতিহাসে উনবিংশ শতাব্দী থেকে এই স্বল্প সময়টুকু চরম অমানিশার সময়। পতন আর বিপর্যয় যেন এ সময় মুসলমানদের তাড়িয়ে ফিরছে। এই দূর্যোগ কাটিয়ে

          ওঠার জন্য বিভিন্ন ভাবে চেষ্টাও হয়েছে।কিন্তু সাফল্য নামক বস্তুটির নাগাল কেউ পেল না।মিশর, আলজেরিয়ায় খাটি ইসলামী আন্দোলন হয়েছে, প্যালেস্টাইন, মিশরে ধর্ম নিরপেক্ষ আন্দোলন হয়েছে।আবার মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ স্থানেই জাতীয়তাবাদী শক্তি ক্ষমতায় এসেছে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে। আর কত লৌহ মানব যে গত হলো এই সময়ের মধ্যে কিন্তু হারানো সুদিন আর ফিরে আসলো না।

          ১৯৪৫ সালের ২২শে মার্চ অধিকাংশ আরব দেশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল আরব লীগ। কিন্তু দীর্ঘ পথ যাত্রায় আরব ভূখন্ডের ওপর বয়ে গেছে অসংখ্য বিধ্বংসী সাইমুম ঝড়।ইসরাইলের জন্ম, আরব-ইসরাইলের যুদ্ধ,ইহুদীদের আরব ভূখণ্ড জবরদখল  ও ফিলিস্তনীদের বহিষ্কার, ইহুদীদের আল-আকসা মসজিদে অগ্নি সংযোগ, লেবাননে গৃহযুদ্ধ ও ইসরাইলের সামরিক হস্তক্ষেপ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, ইরাক-পাশ্চাত্যের যুদ্ধ ও বর্তমান সংকট, লিবিয়ায় মার্কিন হামলা ও বর্তমান জাতিসংঘের অবরোধ, আলজেরিয়ায় জনগণের কন্ঠরোধ সহ কোন সমস্যার সমাধানেই আরব লীগ কোন বাস্তব পদক্ষেপ নিতে পারে নি।মেয়াদ অন্তর সভাপতি নির্বাচন, প্রস্তাব গ্রহণ, সমস্যা নিয়ে নিস্ফল আলোচনা ও ক্ষেত্র বিশেষে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণের মধ্যেই আরব লীগের তৎপরতা সীমাবদ্ধ।

          ১৯৬৯ সালে খেলাফত কাঠামো পুনোরুজ্জিবীত করণ, ইসলামী ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বকে জোরদার এবং বিশ্ব মুসলিম স্বার্থকে বহিঃশক্তির কবল থেকে সুরক্ষার জন্য মুসলিম দেশগুলো নিয়ে গঠিত হয় ও,আই,সি।কিন্তু এ সংস্থাও আরব লীগের পথের অনুসারী হয়।আফগানিস্তান, দুর্ভিক্ষ,পীড়িত সোমালিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ইরিত্রিয়া,ভারত, বুলগেরিয়া, বসনিয়া,আরাকান, মিন্দানাও, চীন ও মধ্য এশিয়ার মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে, অধিকার হারা হয়ে দেশ ছেড়েছে কিন্তু ও,আই,সি এ সমস্যার  কোন সুরাহা করতে পারছে না।বসনিয়ায় জাতিগত উৎখাত অভিযানের মুখেও সামরিক হস্তক্ষেপে পাশ্চাত্যের তাবেদার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে অনুরোধ জানিয়ে সে দায়িত্ব শেষ করেছে। এ সংস্থা এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি শীর্ষ সম্মেলন করেছে  কিন্তু মুসলিম বিশ্বের কানাকড়িও লাভ হয় নি তাতে। মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এছাড়াও বহু সংগঠন গঠিত হয়েছে।পোস্টারিং, মিছিল, সিস্পোজিয়াম, মিটিংও কম হয় নি।কাশ্মীর,বসনিয়া, ফিলিস্তিনের ন্যায় সকল অশান্ত মুসলিম দেশের সমস্যার সমাধানের জন্য এবং অপরাধীর বিচার চেয়ে জাতিসংঘেও আমরা অনেক ধর্ণা দিয়েছি।নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ পরিষদ এসব সমস্যা নিয়ে কাগজে কলমে অনেক প্রস্তাবও পাশ করেছে কিন্তু এতে মুসলিম জাতির কোন কল্যাণ তো হয় নি বরং এই কালক্ষেপণের সুযোগে উত্তরোত্তর আমাদের অধঃপতন ঘটেছে। বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, আল-আকসা মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, পবিত্র কাবা শরীফ রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, দু'কোটির বেশী মুসলমান উদ্বাস্তু অবস্থায় আছে, ইসলামের ওপর খৃস্টবাদ প্রাধান্য বিস্তারের পায়তারা করছে।এসব সমস্যার যেন কোন সমাধান নেই। ইসলামের ইতিহাসে পূর্বে কখনো এতো হরেক রকম আন্দোলন হওয়ার নজীর পাওয়া যায় না।বরং গতানুগতিক আন্দোলনের ভিড় কম থাকার ফলে তখন মুসলিম বিশ্ব পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তি বলেই গণ্য হতো। মুসলিম বিশ্বের এই অবনতিশীল পরিস্থিতির দিকে নজর দিলে মনে প্রশ্ন জাগে, বিশ্বময় মুসলিম জাতীয়তাবাদের উত্থান  ও মুসলিম জাতির বিজয় কোন পথে?  এ সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) স্পষ্ট বলে গেছেনঃ

"জিহাদ ইসলামের শিখর চূড়া"।

তিনি আরও বলেছেনঃ

          'তোমরা যখন জিহাদ পরিত্যাগ করে গরুর লেজ ধরে কৃষি কাজ করাকে ভালোবাসবে এবং লিপ্সা, কৃপণতা, অনাস্থা, সুদখোরী ও স্বার্থন্ধতা তোমাদের চরিত্রের অংশ হয়ে দাঁড়াবে তখন তোমরা পরাধীনতা ও পর পদদলনে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হতে থাকবে"।

রাসূল (সাঃ) আরও বলেছেনঃ

          " যে জাতি জিহাদ পরিত্যাগ করবে আল্লাহ তাদের ওপর ব্যাপক আযাব-গজব আপতিত করবেন"।

          অতএব, জিহাদই আমাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার, বিশ্বময় আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা ও ইসলাম বিরোধী শক্তিকে পরাজিত করার একমাত্র বিকল্পহীন পথ।