আশুরা আনন্দ না শোকের স্মৃতি?
আমিনুল ইসলাম ইসমতি
==================================================
মহানবীর সাল্লাহু সাল্লাম এর আহলে বায়িত এর প্রতি ভালোবাসা রাখা ও সম্মান প্রদর্শন করা ঈমানের অঙ্গ। তাদের উপর কৃত পৈশাচিক নির্দয় অত্যাচারের কাহিনী ভুলে যাওয়ার মতো নয়। নির্যাতিত হযরত হাসান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ও তাঁর সাথীদের মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক শাহাদাতের ঘটনা, যার অন্তরে দুঃখ বেদনা ও সহানুভূতির উদ্রেক করে না তাকে পাষান ছাড়া আর কিছু বলা যায়? তবে তাদের প্রতি সত্যিকার প্রীতি ও পূর্ণমাত্রায় সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া বিপদে দরদ প্রদর্শনের অর্থ এই নয় যে, সারা বছর আমোদ-প্রমোদে কাটিয়ে দেবে একটি বারের মতো কখনো তাদের কথা বলবে না, আর শুধুমাত্র আশুরার দিনে শাহাদাতের ঘটনা স্মরণ করে অশ্রু ঝরাবে ও শোক প্রকাশ করবে, আর তাযিয়া প্রদর্শন ও খেল তামাশা করবে। বরং সত্যিকারের সহানুভূতি ও ভালোবাসা হচ্ছে এটাই যে, যে মহান লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে তাঁরা এ কোরবানি দিয়েছেন সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ত্যাগ ও কুরবানী দেয়া, তাদের চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন ও আমলের অনুসরণকে দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য সৌভাগ্য মনে করা।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে শিয়া সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রে কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার স্মৃতিবহ অবিমিশ্র শোকের দিবস বলে পরিচিত তাজিয়া প্রদর্শনী, মর্সিয়া ও কন্দনরতা একশ্রেণীর লোকের হাবভাব দর্শনে এ কথাই মনে হয় যে কারবালায় হযরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর শাহাদাতই যেন এই দিবসের একমাত্র ঘটনা। কেউ কেউ আবার হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর শাহাদাতের ঘটনার জন্য আশুরার রোযা দিবসে রোজা রাখা ও পরিবার-পরিজনের জন্য মুক্ত হস্তে ব্যয় করা সংক্রান্ত বর্ণনার সমালোচনা করে বলেন যে, নবী দৌহিত্রের শাহাদাতে এই দিবসটি অবিমিশ্র শোক পালনে অতিবাহিত করা উচিত।
রোজা রাখা, পরিবার-পরিজনের জন্য মুক্তহস্তে খরচ করা, দান খায়রাত করা, প্রভৃতির মাধ্যমে উৎফুল্ল মনেরই অভিব্যক্তি ঘটে। এই শোক ও বিষাদ স্মদিবসে এরূপ করা অনুচিত। কিন্তু তাদের এ ধারণা সম্পূর্ণ অলীক ভ্রান্ত। বরং সত্য ও প্রকৃত কথা হল, আল্লাহ তা'আলা তাঁর নবী দৌহিত্রের শাহাদাতের জন্য এমনই একটি মহিমান্বিত দিনকেই নির্বাচন করে নিয়েছেন, যা মাহাত্মের দিক হতে আবহমানকাল হতে শ্রেষ্ঠ, যেন তার মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পায় এবং তিনিও শাহাদাত প্রাপ্ত সাহাবীগণের মর্যাদায় অভিষিক্ত হন। কেননা, প্রথমতঃ আশুরা বিশ্ব ইতিহাসের চিরন্তন মাইলফলক। মানব ইতিহাসে যুগান্তকারী অনেক ঘটনার সাক্ষী এই আশুরা।
এই দিনে আল্লাহ তাআলা স্বীয় অনুগ্রহে বহু নবী-রাসূলকেই বিপদমুক্ত ও জয়যুক্ত করেছেন এবং চির দুশমনকে ধ্বংস করে তাদেরকে সমাসীন করেছেন উচ্চমর্যাদায়।
মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম কে আল্লাহ পাক আশুরার দিনেই তার প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করেছেন এবং দিনেই তার তাওবা কবুল করেছেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় আদম বলে পরিচিত হযরত নূহ আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম সাড়ে নয় শত বছর যাবত দ্বীন ইসলামের তাবলীগ করার পরেও তখনকার মানুষ আল্লাহ তাআলার বিধি-নিষেধ পালনে অস্বীকৃতি জানায়, তখন নেমে আসে আল্লাহর গজব। হযরত নূহ আঃ এর সম্প্রদায় হয় কোপগ্রস্থ। এক মহাপ্লাবনে তদানীন্তন পৃথিবীর মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়, রক্ষা পায় শুধু তারা যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে হযরত নূহ আঃ এর তরীতে আরোহন করেন। এই তরী জুদি পাহাড়ের পাদদেশে এসে থামে এই ঐতিহাসিক আশুরার দিনে।
আর এই দিনেই হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম ভূমিষ্ঠ হন এবং এই দিনেই তিনি আল্লাহর খলিল তথা বন্ধুর মর্যাদা লাভ করেন। এই দিনেই তিনি নমরুদের অগ্নিকুণ্ড হতে মুক্তি লাভ করেন।
হযরত ঈদ্রিস আঃ কে যখন তার ধূর্ত সম্প্রদায় মেরে ফেলার ফন্দি আটে তখন আল্লাহ পাক হযরত ঈদ্রিস আঃ কে তাদের কোপানল থেকে এই আশুরার দিনে ঊর্ধ্বজগতে তুলে নেন এবং তাকে উচ্চ মর্যাদা দান।
করেন হযরত সুলাইমান আঃ কে এই দিনে জ্বীন ও ইনসান তথা মানব দানব জগতের রাজত্ব প্রদান করেন। ঘটনাক্রমে একবার হযরত সুলাইমান আঃ তাঁর হাতের আংটি হারিয়ে ফেলেছিলেন। ফলে তিনি সাময়িকভাবে রাজ্য হারা হন। এই ঐতিহাসিক আশুরার দিনে আল্লাহ পাক তার হৃত রাজত্ব পুনরায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
এই দিনে হযরত ইউসুফ আঃ এর সঙ্গে সুদীর্ঘ 40 বছর পর তার পিতা হযরত ইয়াকুব আঃ এর সাক্ষাৎ ঘটে।
আর এ দিনেই সর্বপ্রথম হযরত মুসা আঃ এর সাথে আল্লাহতালার কথোপকথন হয় এবং তার প্রতি তাওরাত অবতীর্ণ করেন মিথ্যা খোদায়ির দাবিদার অত্যাচারী ফেরাউনের কবল থেকে আল্লাহ তাআলা অসীম কুদরতে হযরত মূসা আঃ বনী ইসরাঈলকে মুক্ত করেন। আর ফেরাউন সদলবলে নীল নদে ডুবে মারা যায়।
হযরত ইউনুস আঃ ইরাকের দজলা নদীতে নিমজ্জিত হলে এক বিরাট মৎস্য তাকে উদরে পুরে নেয়। আল্লাহ পাকের বিশেষ কুদরতে এই আশুরার দিনেই তিনি মৎস্যের উদর থেকে নাজাত লাভ করেন।
এমনি আরও বহু ঐতিহাসিক ঘটনা এই আশুরার দিনে ঘটেছে যেমন এই দিনে হযরত দাউদ আঃ এর তাওবা কবুল হয় এবং তিনি নিষ্পাপ বলে চিন্তা মুক্ত হন।
হযরত ঈসা আঃ ভূমিষ্ঠ হয়েছেন এ আশুরার দিনে এবং তাকে আল্লাহপাক আসমানে তুলে নিয়েছিলেন এই দিনেই।
দ্বিতীয়তঃ এই দিনের করণীয় কাজে আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য প্রভুত কল্যাণ ও সীমাহীন সাওয়াব নির্ধারিত করে রেখেছেন। আল্লাহর বাণীঃ "আল্লাহর নিকট মাসের হিসাব হলো মাস ১২ টি। তন্মধ্যে চারটি মাস অতি মর্যাদাপূর্ণ।" (সূরা তাওবা ৩৬ নম্বর আয়াত)
মুহাররম মাস উক্ত সম্মানিত মাস গুলোর অন্যতম এবং আশুরার দিন তারই অন্তর্ভুক্ত। হাদিসে এসেছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সাঃ এরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি মুহাররম মাসে আশুরার রোজা (চাঁদের দশম তারিখে) থাকবে সে ব্যক্তি কে ১০ হাজার ফেরেশতা ১০ হাজার শহীদ এবং ১০ হাছার হজ ও ওমরা কারীর সাওয়াব প্রদান করা হবে। সে ব্যক্তি ঐ দিনে কোন ইয়াতিমের মাথায় হাত বুলালে আল্লাহতায়ালা তাঁর মাথায় প্রতিটি চুলের পরিবর্তে জান্নাতে তাকে একটি করে মর্যাদা দান করবেন।
যে ব্যক্তি আশুরার দিন সন্ধ্যায় কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে সে যেন সমস্ত উম্মতে মোহাম্মদীয়াকে ইফতার করাল এবং সকলেই তৃপ্তির সহিত ভোজন করালো। তখন সাহাবাগণ রাঃ আরয করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ কি আশুরার দিনকে সর্বাধিক ফযিলত দান করেছেন? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে ইতিবাচক উত্তর প্রদান করেন।
হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ এর অপর বর্ণনায় আছে যে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি আশুরার রোযা রাখবে আল্লাহ তাকে ৬০ বছর দিবসভর বোযা ও রজনীভর ইবাদতের সওয়াব দান করবেন। (তিবরানী)
হযরত আনাস ইবনে মালিক রাঃ একদা অসুস্থতা বশতঃ আশুরার রোজা রাখতে না পারায় রোদন করতে করতে বলেন যে আমি আজ অসুস্থতার জন্য রোজা রাখতে পারলাম না অথচ আমি নিজ কানে শ্রবণ করেছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি আশুরার দিন রোযা রাখবে দোযখের আগুন তাকে কখনও স্পর্শ করবেনা। (মাজালিসুল আবরার)
জা-লীসুন নাসিহীন কিতাবে বর্ণিত হয়েছে হযরত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি নিজের জন্য দোযখের আগুন হারাম করতে চায় সে যেন মহররম মাসের নফল রোজা রাখে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি আশুরার দিন গোসল করবে একমাত্র মৃত্যুকালীন রোগ ছাড়া সকল রোগ হতে সে বেঁচে থাকবে।
যে ব্যক্তি আশুরার দিন আসমত (সুরমা তৈরীর পাথর বিশেষ) এর সুরমা ব্যবহার করবে পূর্ণ বছর ব্যাপি সে চক্ষু রোগ হতে মুক্ত থাকবে। যে ব্যক্তি আশুরার দিন কোন রূগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে গেল সে যেন সমস্ত আদম সন্তানের রোগ শুশ্রূষা করল।
উপরোক্ত আলোচনা দারা এ দিবসের প্রভুত কল্যাণ ও সীমাহীন তাৎপর্য সম্পর্কে অবগতির পর এই কথা ভালোভাবে প্রতিভাত হয় যে, শিয়া সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভান্বিত হয়ে "হায় হুসাইন! হায় হুসাইন! বলে বুক চাপড়ানো মর্সিয়া ক্রন্দন ও তাজিয়া প্রদর্শনের জন্য আশুরার দিবস নয়।
তৃতীয়তঃ সাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম ও তাবেয়ীনগন নিঃসন্দেহে আমাদের তুলনায় হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর ঘনিষ্ঠতর ছিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা অনুসারে তারাই যখন দিবসটিতে রোজা রেখেছেন এবং পরিবার-পরিজনের জন্য মুক্ত হস্তে ব্যয় করেন আনন্দ প্রকাশ করেছেন, সেখানে ঐসব হর্ষের দিককে পরিত্যাগ করে হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর চোখে এত বড় একটি মহিমান্বিত দিবসকে নিছক বিষাদ দিবসে পরিণত করার যৌক্তিকতা কোথায়? আমরা কি সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ও তাবেয়ীগণের তুলনায় হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর অধিকতর ঘনিষ্ঠ? তাঁদের চেয়ে তার প্রতি কি আমাদের দরদ বেশি?
চতুর্থতঃ যদিও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর শাহাদাত এর কারনে এ দিবসটিকে শোক দিবস রূপে পালন করা হয়, তবে সোমবারকেও শোক দিবস রুপে পালন করতে হবে। কেননা এই দিন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এবং আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর ইন্তেকাল হয়। কিন্তু তারা তা কি কেউ করে? বরং সোমবার দিনের মুসলিম জাতি আনন্দচিত্তে রোজা রাখে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নানাবিধ পুণ্যের কাজ বেশি বেশি পালন করে। কেননা এই দিনে রোজা রাখার ফজিলত এবং সোমবার বান্দার আমল আল্লাহর সমীপে উত্থাপিত হওয়ার কথা হাদিছে রয়েছে। তাই আশুরা শোকের স্মারক নয়, নয় বিষাদের স্মৃতি। আশুরা হল হর্ষ স্মারক আমোদ-প্রমোদের স্মৃতি। আশুরাকে শোক দিবস রূপে পালন করা অযৌক্তিক হর্ষ দিবস রূপে পালন করায় অধিক যুক্তিযুক্ত। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নিজেদের মনগড়া আচার-আচরণ ও প্রথা পদ্দতি পরিত্যাগ করে তাঁর রাসূলের সুন্নতকে পুরোপুরি অনুসরণ করে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন।
*****