JustPaste.it

দেশে দেশে ইসলাম

 

রাসূল (সাঃ) এর যুগে ইসলাম যেভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে

নাসীম আরাফাত

=====================================================================

 

        ঈসা (আঃ) এর উর্ধ্বগমনের পরে ৫০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে । এরই মধ্যে পুরো পৃথিবী বাতিল ও কুফরের আঁধারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে । হানাহানি, কাটাকাটি, অনাচার, অবিচার মানুষের মজ্জাগত স্বভাবে পরিণত হয় । এক আল্লাহর ইবাদাত ছেড়ে হাজারো দেবতার পূঁজায় মানুষ অভ্যস্থ হয়ে পড়ে । এক কথায় এ যুগকেই আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকারের যুগ বলা হয় । এই অন্ধকারকে দূর করে পৃথিবীকে মানবতার আলোক শিখায় আলোকিত করার জন্য আগমন করলেন বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) । তাঁর আগমনে পৃথিবী হয় প্রাণোজ্জল,আনন্দের জোয়ারে আপ্লুত । এই মহামানবের আগমনের প্রতিক্রিয়ায় বাতিল ও কুফুরীর ধ্বজাধারী,মিথ্যা ও দম্ভ অংকারের প্রতীক কিসরার প্রাসাদের ১৪ টি গম্বুজ ভেঙে পড়ে,পারস্যে পূজারীদের হাজার বছর ধরে জ্বালিয়ে রাখা আগুন নিমিশে নিভে যায়, শাতিল নদী শুকিয়ে যায় । শুধু কায়সার ও কিসরার দম্ভ অহংকারই নয় আজমীদের শান, রুমীয়দের শওকত, চীনের প্রাচীন ও গগণচুম্বী মহলরাজী ভেঙে পড়ে । অবিশ্বাসের গভীর ঘন-অন্ধকার এবং পথভ্রষ্টতার বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় । পূঁজার মন্ডপে ধূলিঝড় বইতে থাকে,পৌত্তলিকদের গলার পূঁতির মালা ছিড়ে যায় । খৃষ্টান ইহুদীদের ভ্রান্ত মতের বিপ্লব ছিন্ন ভিন্ন হয়ে তাওহীদের আলোয় মানব মন উদ্ভাসিত হয়ে উঠে । মানবতার মুক্তি,সত্যের পথের সন্ধান পেয়ে মানুষ হয়ে ওঠে আর্দশ মানুষ ।

 

        মানুষকে অন্ধকার ভেদ করে মানবতার মহা সড়কে পথ চলতে উদ্বুদ্ধ করতে আমাদের প্রিয় নবী (সঃ) কে অনেক চড়াই উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে । অনেক কণ্টকাকীর্ণ পথ উপেক্ষা করে,অনেক লাঞ্ছনা হজম করতে হয়েছে । তিনি জীবনের শুরুতে অন্ধকারে নিমজ্জিত নিজ বংশধর ও পাড়া প্রতিবেশীদের মানবিক দুরাবস্থা দেখে মনোপীড়ায় আক্রান্ত হলেন বটে,কিন্তু থামলেন না । নিজে সমস্ত অনাচার, অবিচার,কুসংস্কার  আর জাহিলিয়াত থেকে পবিত্র থেকে জন্মস্থান পবিত্র মক্কাবাসীদের জানালেন তাওহীদের দাওয়াত । কুসংস্কার, অন্ধ আচরণ থেকে ফিরে এসে তাওহীদ ও একত্ববাদের আলোয় এসে নয়া মানব সভ্যতা নির্মাণের জন্য জানালেন উদ্ধাত্ত আহবান । মক্কাবাসীরা তাঁর কথা শুনলো; পাগল, যাদুকর প্রভৃতি আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখান করলো । বাপ-দাদার অনুসৃত ধর্মমতের বিরুদ্ধে কথা বলায় তারা রাসূলের (সাঃ) ওপর চালালো অমানুষিক অত্যাচার ।

 

        তাঁকে নতুন ধর্মমত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারিবারিক, সামাজিক চাপ প্রয়োগ করল । এই নতুন ধর্মমত তথা তাওহীদের বাণী গ্রহণ করে যারা নিজেদের জীবন ধন্য করেছিলেন সেই রাসূল (সাঃ) এর কলিজা তুল্য সাথী সঙ্গীগণের ওপর চালানো হলো অমানুষিক অত্যাচার । তবুও রাসূল (সাঃ) দমলেন না,তাঁর ইসলাম প্রচার বন্ধ রাখলেন না । এদিকে তাঁরই চাচা আবু জাহেল,আবু লাহাব, আবু সুফিয়ান,অলিদ প্রমুখরাও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল । তারা তাওহীদের অনুসারীদের বয়কট করল,নির্বাসন দিল । কিন্তু ইসলামের অগ্রযাত্রা, প্রাণোচ্ছলকে দমিয়ে রাখতে পারল না । অবশেষে এই তাওহীদ বাণী তথা ইসলামের প্রাণ রাসূল (সাঃ) কে হত্যার ঘৃণ্য ষড়ষন্ত্র আঁটল । কিন্তু মহাপরিকল্পনাকারী আল্লাহ দুর্বল মানব পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দিলেন । রাসূল (সাঃ)- তাঁর নবুয়ত জীবনের ১৩টি বছর  ইসলামের বাণী মক্কার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার  পর মদীনা অভিমুখে যাত্রা করলেন । এই মদীনাই হল ইসলামের প্রাণকেন্দ্র । এই মদীনা নগরী রাসূল (সাঃ) এবং তাঁর সাথীদের আশ্রয় দিয়ে ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করে । এই মদীনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে,পায় স্থায়িত্ব ।

 

        কিন্তু মদীনায়ও রাসূল (সাঃ)-এর শান্তিপ্রিয় অবস্থানকে,ইসলামের আলো দ্রুতবেগে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়াকে মক্কার রক্তপিপাসু, হিংস্র ও প্রতিশোধ পরায়ণ কুরাইশরা মেনে নিতে পারল না । একই ঈর্ষার আগুনে পুড়ে মরল মদীনার ইহুদীরাও । গড়ে ওঠল এই দুই অশুভ শক্তির আঁতাত । ফলে দ্বন্ধ সংঘাত থেকে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও রাসূল (সাঃ) শান্তিতে থাকতে পারলেন না । আল্লাহর তরফ থেকে নির্দেশ এল জিহাদে ঝাপিয়ে পড়ার । দয়ার নবী,শান্তির নবী হাতে তুলে নিলেন হাতিয়ার । সিপাহ সালার বেশে তাকে রণাঙ্গণে যাত্রা করতে হলো । কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনায় পরিস্থিতি ক্রমে জটিল ও উত্তপ্ত হয়ে উঠল । রাসূল (সাঃ) কুরাইশদের ভয় প্রদর্শনের জন্য তিন প্লাটুন মুজাহিদ বিভিন্ন অভিযানে প্রেরণ করলেন । কোন সংঘাত ছাড়াই তারা ফিরে এলো । মক্কার কুরাইশরা মদীনা আক্রমণের জন্য বিশাল বাহিনী গঠন করে এগিয়ে এলো । মুসলিম বাহিনী বিক্ষিপ্ত কতগুলি ঘটনায় কুরাইশদের বাণিজ্য পথ অবরুদ্ধ করে রাখে,এক সংঘাতে একজন কুরাইশ নিহত হয় এবং দু'জন বন্দী হয় । ফলে কুরাইশরা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে প্রতিশোধে উন্মাদ হয়ে ওঠে । বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা । রক্তপাতের মাধ্যমে উদ্ভোধন হয় ইসলামের নতুন পথযাত্রা,নতুন ইতিহাস ।

 

        বদরের যুদ্ধে (প্রত্যক্ষ জিহাদ শুরু) কুরাইশ বাহিনী চূড়ান্ত আঘাত হানতে  ঐক্যবদ্ধ হল । স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তারা চাঁদা প্রদান করল । আবু সুফিয়ান প্রেরিত হল অস্ত্র কেনার জন্য শাম দেশে (সিরিয়া) ।

 

        এসব কিছুই ছিলো রাসূলের নখদর্পনে । সংবাদ পেলেন আবু সুফিয়ানের । এক হাজার উটের বিশাল কাফেলা মদীনা পতনের জন্য কেনা অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে মদীনার পাশ দিয়েই মক্কা যাচ্ছে । এ অবস্থায় নীরব থাকার অর্থই আত্মহনন । তাই রাসূল ৩১৩ জন সাহাবীকে নিয়ে তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে আনতে অগ্রসর হলেন । আবু সুফিয়ান তা আঁচ করলে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে দ্রুত অশ্বারোহী মক্কায় পাঠিয়ে দিলো এবং নিজে প্রধান পথ ছেড়ে সমুদ্রোপকুল ধরে মক্কার দিকে অগ্রসর হতে ছিলো ।

 

        মক্কায় যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে । আবু জাহেল সশস্ত্র ১০০০ সৈন্য নিয়ে কাফেলা রক্ষার জন্য তেড়ে এলো । কিন্তু নিরাপদে কাফেলা গেলেও আবু জাহেল বিনা যুদ্ধে ফিরতে নারাজ । তাই মাত্র ৩১৩ জন সহচর নিয়ে রাসূল (সাঃ) ৯০০০ সশস্ত্র সৈন্যের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন । যুদ্ধের জন্য অপ্রস্তুত এই ৩১৩ জনের নিকট তেমন অস্ত্র শস্ত্র না থাকলেও তারা ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় ও পর্বতসম মনোবলের অধিকারী । আল্লাহর সাহায্যের বিশ্বাসে তাদের অন্তর ছিলো শান্ত-সুস্থির । আল্লাহর অনুগ্রহে তাঁরাই বিজয়মালা ছিনিয়ে আনলেন । রণে ভঙ্গ দিয়ে পালালো কোরাইশদের যোদ্ধারা । পিছনে পড়ে রইলো তাদের ৭০ জন নিহত যোদ্ধা । বন্দী হলো ৭০ জন । মুসলমান শহীদ হলেন মাত্র ১৪ জন । বদরের যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর মাত্র সাত দিনের মধ্যে আবু লাহাবের মৃত্যু মক্কাবাসীদের করুণ শোকের ছায়াকে আরো ঘনিভূত করে তুলে । অপরদিকে, এ বিজয়ের ফলে রাসূল (সাঃ)- এর প্রতি মদীনার পার্শ্ববর্তী  লোকদের বিশ্বাস ও আস্থা বেড়ে যায় । তারা বুঝলো যে, তিনি সত্যই আল্লাহর রাসূল । তদুপরি তিনি একজন সুবিজ্ঞ ও বিচক্ষণ শাসক । তাই অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল । অনেকে এসে শান্তিচুক্তি করলো ।

 

কায়নুকার যুদ্ধ

 

        বিশ্বাস ঘাতক ইহুদী জাতি । তারা কোন কালেই তাদের জাতীয় স্বভাবের পারাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেনি । বদরে যুদ্ধকালীন সময়ে রাসূল মদীনায় অনুপস্থিত ছিলেন । তারা ভেবে ছিলো, এবার মক্কার কাফেরদের বিজয় নিশ্চিত । তাই মদীনার মাঠে- ময়দানে কিংবা বাজারে নিঃসঙ্গ মুসলিম নারীদের পেলেই উত্যক্ত করতো । ইহুদীরা কিছু কিছু ধ্বংসাত্নক কাজেও হাত বাড়ায় । অবশেষে এক ইহুদী এক মুসলিম রমনীর সাথে অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করলে মুসলমানদের মাঝে তা দারুন উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং মুসলমানরা তাকে হত্যা করে । ইহুদী ও মুসলমানদের মাঝে প্রচণ্ড উত্তেজনা ও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করতে থাকে ।

 

        বদর জিহাদ শেষে রাসূক (সাঃ) মদীনায় এসে কৈফিয়ত তলব করলে তারা চুক্তিপত্র ছিড়ে ফেলে দেয় এবং প্রকাশ্যে যুদ্ধের আহবান জানায় । এ কারনে মুসলমানরা তাদের পনের দিন অবরোধ করে রাখে,তারপর মদীনা ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয় ।

 

আবু সুফিয়ানের পলায়নঃ

        বদরের নিহতদের শোকে মক্কার ঘরে ঘরে মাতম উঠলো । প্রতিশোধের স্পৃহায় আবার তারা উঠে দাঁড়ালো । আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে তারা শাণিত তরবারি তুলে নিলো । সাথে তার ২০০ শত যোদ্ধা । মদীনার তিন মাইল দূরে পৌঁছে তারা দুজন মুসলমান কৃষককে হত্যা করলো এবং খেজুর বাগানে আগুন লাগিয়ে দিলো ।

 

        রাসূল সংবাদ পেয়েই তাদের দ্রুত পশ্চাদ্ধাবন করলেন । তড়িঘড়ি করে পালাতে গিয়ে তারা রসদ পত্র সহ ছাতুর বস্তা ফেলে পালিয়ে গেলো ।

 

নজদের রাস্তা অবরোধ

        নজদের পার্শ্ববর্তী কবিলা বুনী ছালাবা মদীনা আক্রমণের দুঃসাহস করে এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় । সংবাদ পেয়ে রাসূলের চার শত সাহাবী নিয়ে তাদের আকস্মিক আক্রমণ করে । বনু ছালাবা স্তম্ভিত হয়ে যায় । ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে এলাকা ছেড়ে পালায় । বনু গাতফানও বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করেছিলো । কিন্তু রাসূলের পদাপর্নে ভীত হয়ে সন্ধিচুক্তি করে নীরব হয়ে যায় । এ অভিযানে রাসূল নজদের এলাকাসমূহ ঘুরে ঘুরে দেখেন । রাসূল ধারণা করেছিলেন, মক্কার কুরাইশ উপকূল ও বদরের পথ পরিহার করে নজদ ও ইরাক হয়ে সিরিয়ার বাণিজ্য পথ অবলম্বন করবে । তাই হলো । ফলে এ পথেও অবরোধ সৃষ্টির ব্যবস্থা করলেন । যায়েদ ইবনে হারেসার নেতৃত্বে একটি অভিযান প্রেরণ করে আবু সুফিয়ানের কাফেলা লুণ্ঠনের নির্দেশ দেন । কারওয়াহ নামক স্থানে তারা কাফেলা ঘিরে ফেললে আবু সুফিয়ান পালিয়ে যায় ।

 

উহুদ যুদ্ধ

        কুরাইশদের মর্যাদাবোধের অহমিকা ধুলায় লুণ্ঠিত । অর্থনৈতিক সংকট,বাণিজ্যিক মন্দাভাব,তদুপরি বাণিজ্যপথ বিপজ্জনক । বদরের নিহতদের করুণ স্মৃতি তখনো তাদের হৃদয় থেকে মুছে যায়নি । তাই প্রতিশোধ স্পৃহা আরো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো । ৩০০০ সুসজ্জিত সৈন্য বাহিনী নিয়ে আবু সুফিয়ান মদীনার দিকে অগ্রসর হয় । রাসূল মাত্র ৭০০যোদ্ধা নিয়ে মোকাবেলার জন্য উহুদ পাহাড়ের পাদতলে উপস্থিত হন । ভয়ঙ্কর যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিম বাহিনীর বিজয় নিশ্চিত হলে গিরিপথে নিযুক্ত বাহিনী ওখান থেকে সরে যায় । ফলে মুসলমানদের উপর আংশিক পরাজয়ের গ্লানি নেমে আসে । ৭০ জন সাহাবী এবং রাসূলের চারটি দাঁত শহীদ হয় ।

 

উহুদের পরবর্তী কতিপয় ঘটনাঃ

        উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের বাহ্যিক পরাজয়ে কাফেরদের মনোবল বেড়ে যায় । তারা রাসূলের বিরুদ্ধে দানা বাঁধতে শুরু করে । ইহুদীরাও সুযোগ লুফে নেয় । তারা কাফেরদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে । এ পরিপ্রেক্ষিতে আযল ও কাযা গোত্র দুটি ওয়াদা ভঙ্গ করে দশজন সাহাবীকে বনু লেহইয়ানের দুশ সশস্ত্র যোদ্ধার মাঝে ছেড়ে দেয় । ফলে তারা শহীদ হন ।

 

        উহুদের চার মাস পর বিরে মাউনায় মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে । নজদের শাসক ৪০জন মুবাল্লিগ সাহাবাকে নিরস্ত্র অবস্থায় শহীদ করে ।

 

        ভুল বশত দুই ব্যক্তিকে হত্যার রক্তপণ দেয়ার উদ্দেশ্যে রাসূল মদীনায় ইহুদী গোত্র বনু নাযীরে গেলে তারা রাসুলকে  উপর থেকে পাথর ফেলে হত্যার ষড়যন্ত্র করে । তাই তাদের পরাজিত অবস্থায় নির্বাসন  দেয়া হয় ।

 

        বনু নাযীরের নির্বাসনের সংবাদে ইহুদীরা ক্ষিপ্ত হয়ে মদীনার খাদ্য সংকট সৃষ্টির লক্ষ্যে দাওমাতুল জান্দালের আশেপাশে মদীনাগামী কাফেলাগুলো লুট করতে থাকে । এদের নজদের কয়েকটি গোত্রকে প্রলুব্ধ করে । বাধ্য হয়ে রাসূল তখন সশস্ত্র সাহাবাদের নিয়ে গাতফান কবিলগুলোকে ভীতিপ্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নাখলা নামক স্থানে তিনদিন অবস্থান করেন এবং  আবু সুফিয়ানের রণপ্রস্তুতির সংবাদে মদীনায় ফিরে আসেন ।

 

দ্বিতীয় বদরঃ

        উহুদ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় আবু সুফিয়ান উচ্চ কন্ঠে ঘোষণা করে গিয়েছিলো যে, আগামী বছর বদর প্রান্তে আবার । যুদ্ধ হবে । তাই সে বিশাল বাহিনী নিয়ে বদর মুখী অগ্রসর হলো কিন্তু মুসলমানদের রণ প্রস্তুতি তাকে ঘাবড়ে দেয় । রাসূল ৮ দিন তার অপেক্ষায় বদরে থেকে ফিরে আসেন । এর ফলে মুসলমানদের মনোবল বহুগুণ বেড়ে যায় । আর কাফেরদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় ।

 

খন্দকের যুদ্ধ:

        উহুদে মুসলমানদের বাহ্যিক পরাজয়ে ইহুদীরা ছিলো দারুণ খুশি । তাই দ্বিতীয় বদরের ঘটনা । তাদের মর্মমূলে আঘাত হানে । তা ছাড়া মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান শক্তিতে মুশরিকরা ক্ষোভ ও প্রতিশোধ স্পৃহায় ধিকি ধিকি জ্বলছিলো । ইহুদীরা এ সুযোগটি হাতিয়ে নিলো । আরবের প্রায় সকল মুশরিক কবিলাগুলোকে মক্কায় একত্রিত করে ঐক্যবদ্ধ ভাবে মদীনায় আক্রমণের পরিকল্পনা পেশ করে এবং তারা মক্কায় কাফিরদেরও উদার সাহায্যের অঙ্গিকার ব্যক্ত করে । তাই আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ১০,০০০ যোদ্ধা নিয়ে কুরাইশরা মদীনার দিকে ধেয়ে আসে । পথে পথে বেদুঈনরাও তাদের সাহায্যার্থে যোগ দেয় ।

 

        মদীনার আকাশে ভীষণ ঘনঘটা । ছোট শহর মদীনা একে রক্ষার উপায় কি!এ বিশাল বাহিনীর সামনে তো খড়কুটোর ন্যায় ভেসে যাবে মুসলমানরা । শেষতক ভেবে চিন্তে সালমান ফারসী (রাঃ)- এর পরামর্শে শহরের অরক্ষিত  উত্তরাংশে একটি গভীর পরিখা খনন করে ব্যরিকেট সৃষ্টি করা হয় এবং ২৫০০ সাহাবা নিয়ে রাসূল তাদের বাধা দেন । কাফেররা দীর্ঘ একমাস  পর্যন্ত চেষ্টা করে পরিখা অতিক্রম করতে না পেরে ঝড় বৃষ্টিতে দারুন কষ্ট পেয়ে একদিন নৈশ অন্ধকারে পালিয়ে বাঁচে ।

 

বনু কুরায়জার যুদ্ধঃ

        মদীনা সনদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ইহুদী গোত্র বনু কুরায়জা খন্দকের যুদ্ধে সম্মিলিত মুশরিক বাহিনীর সাথে গোপন আঁতাত করে । তাই রাসূল এবার মদীনাকে শত্রুমুক্ত করতে সংকল্পবদ্ধ হন । ২৫ দিন অবরোধ চলার পর সাদ ইবনে মুয়াজ (রাঃ)- এর ফয়সালা উভয় পক্ষ নির্বিঘ্নে মেনে নেয়ার অঙ্গীকার করে । ফয়সালা মতে এ অপরাধের জন্য তাদের যুদ্ধ সামর্থ্য সকল পুরুষকে হত্যা করা হয় এবং নারী ও শিশুদের গণিমতের মাল হিসেবে গণ্য হয় । রাসূল দেখলেন, তাঁর ফৌজী শক্তি খুব দুর্বল । বদরে ছিলো মাত্র দুটি ঘোড়া,ওহুদে মাত্র ৩০ টি আর খন্দকের যুদ্ধে ৩৬টি ঘোড় সাওয়ারের ছোট একটি প্লাটুন । তাই ফৌজী শক্তিকে আর শক্তিশালী করার লক্ষ্যে মুজাহিদদের উৎসাহিত করলেন । এবং গণিমতের মাল বন্টনের সময় প্রত্যেক অশ্বারোহীকে তিন ভাগ দিলেন । নিজের এক ভাগ ঘোড়ার দু'ভাগ যেন আগামী অভিযানগুলোতে সবাই ঘোড়ার ব্যবস্থা করে ।

 

বনু লেহয়ান ও বনু মুস্তালিকের যুদ্ধঃ

        রাসুল কখনো বিশ্বাসঘাতকদের সহ্য করতে পারতেন না । বনু লেহয়ান, আযল ও কায়ার লোকদের যদিও তৎক্ষণাৎ শাস্তি বিধান করা সম্ভব হয়নি । তাই রাসূল এবার তাদের বিশ্বাসঘাতকতার শিক্ষা দিতে বের হলেন । অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে অগ্রসর  হলেন । কিন্তু রাসূলের আগমণ সংবাদে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তারা পালিয়ে যায় । একই সময়ে বনু মুস্তালিকের যুদ্ধ প্রস্তুতি সংবাদ পৌঁছলে  রাসূল বাঁকাচোরা পথে অগ্রসর হয়ে আচানক আক্রমণ করে তাদের পরাভূত করেন ।

 

হাঙ্গামা বাজদের বিরুদ্ধে কয়েকটি সফল অভিযানঃ

        দীর্ঘকালের অদিক্ষীত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরবে পৌত্তলিকরা রাসূলের শাশ্বত সুন্দর জীবন বিধানকে সহজে মেনে নিতে চাইলো না । তাই বিভিন্ন দিকে তারা হাঙ্গামা শুরু করলো । রাসূল এদের শায়েস্তা করতে কয়েকটি সফল অভিযান প্রেরণ করেন ।

 

আশকারা ইবনে মুহসিনের নেতৃত্বে গামর নামক স্থানে একটি অভিযান প্রেরণ করেন । হাঙ্গামাবাজরা টের পেয়ে পালিয়ে জান বাচায় ।

 

        যিল কিসসার বেদুইনদের উৎপাতের কারনে  উবায়দা ইবনে জাররাহর নেতৃত্বে ৪০ জন সাহাবায়ে কেরামকে প্রেরণ করা হয় । বেদুইনরা তাদের আগমনের সংবাদে পালিয়ে  পাহাড়ে আশ্রয় নেয় । একই কারণে বনু মুলায়েমকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্যে  যায়েদ ইবনে হারিছার নেতৃত্বে একটি অভিযান প্রেরণ করেন । তিনি গণিমতের মালসহ বেশ কিছু লোক বন্দী করে নিয়ে আসেন ।

 

        এরপর যায়েদ(রাঃ) কে ঈসের অভিযানে এবং বনু ছালাবাকে শায়েস্তা করতে প্রেরণ করেন । তিনি উভয় অভিযানে সফল হয়ে ফিরে আসেন । দাহিয়াতুল কালবী (রাঃ) রোম সম্রাট কায়সারের পুরস্কার নিয়ে ফিরছিলেন,পথে বনু হিশাম তা ছিনিয়ে নিলে রাসূল তাদের শায়েস্তা করতেও যায়েদ (রাঃ)কে প্রেরণ করেন । এ অভিযানে তিনি বিপুল গণিমতের মাল হস্তাগত করেন ।

 

এ সময়ে রাসূল দুমাতুল জান্দাল ও ওয়াদিউল কুরার অভিযান পরিচালনা করেন এবং প্রত্যকটি অভিযান সুফল বয়ে আনে ।

 

হোদায়বিয়ার সন্ধিঃ

        হিজরতের পর থেকে ঘোড়ার পিঠে পিঠে রাসূলের অনেক দিন কেটে গেছে । শ্বাশত সুন্দর শান্তির বাণী প্রচারে তাকে বারবার বন্ধুর গিরিপথ লঙ্গিতে হয়েছে । এতো দিন পর সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মদীনায় কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে । এবার তাঁর মন বাইতুল্লাহর তাওয়াফে ব্যাকুল হয়ে উঠল । রাসূল (সাঃ) ১৪০০ সাহাবী নিয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় উমরার উদ্দেশ্যে মক্কা যাত্রা করলেন । কিন্তু কুরাইশরা রুখে দাঁড়ালো । কিছুতেই তারা তাঁকে মক্কায় ঢুকতে দিবে না । অবশেষে দশ বছরের অনাক্রমণ চুক্তি করে রাসূল মদীনায় ফিরে আসেন ।

 

সন্ধির ফলাফলঃ

        দৃশ্যতঃ এ সন্ধি মুসলমানদের জন্য বাহ্যত অপমানজনক হলেও মুসলমানদের বিশ্বজয়ের পথকে এ সন্ধিই করেছিলো উজ্জল,দৃঢ় ও সুনিশ্চিত ।

 

        অনাক্রমণ চুক্তির ফলে মুসলিম অমুসলিমদের পরস্পরে মেলামেশা এবং একে অপরকে অতি নিকট থেকে দেখার ও বুঝবার রুদ্ধ দুয়ার খুলে যায় । ফলে মুসলমানদের চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলামের উদাত্ত আহবানে আপ্লুত হয়ে মাত্র দু'বছরে এতো অধিক সংখ্যক লোক মুসলমান হয় যা ইতিপূর্বে সম্ভব হয় নি । দিনে দিনে মুসলমানদের মিত্রের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যায় । বহুদূর পৌঁছে যায় মুসলমানদের প্রভাব বলয় । অনাক্রমণ চুক্তির ফলে কাফির মুশরিকদের মনোবল ভেঙে পড়ে । মহাবীর খালিদ ইবনে অলিদ, আমর ইবনে আস সহ বহু বীর যোদ্ধা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মুসলমান হয় । চুক্তি অনুযায়ী পরের বছর মুসলমানরা হজ্জে এলে পাহাড় চূড়ায় আশ্রয় নেয় । ফলে মক্কা মদীনা সহ সর্বত্র ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব বেড়ে যায় । বনু দাওলা সহ ইয়ামেনের ১৫ টি গোত্র স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ।

 

এবার আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ইসলামের পদচারণাঃ

        মদীনার সুনীল আকাশে শান্তি-কপোতের ছুটাছুটি । আর রক্তপাত নয় । আর যুদ্ধ নয় । রাসূল ও সাহাবারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন । তাই রাসূল আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ইসলামের শ্বাশত সত্যের সওগাত পৌঁছে দেয়ার সংকল্প করেন । এশিয়া সহ আফ্রিকা, ইউরোপের সম্রাট ও রাজন্যবর্গের নিকট তার পত্র সহ দূত পৌঁছে গেল । ইউরোপের রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস,এশিয়ার পারস্য সম্রাট খসরু, আফ্রিকায় আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসী ও মিসরের শাসন কর্তা মুকীওকিসের নিকট পৃথক পৃথক পত্র প্রেরণ করে ইসলামের উদাত্ত  আহবান জানান ।

 

        এছাড়া বাহরাইন, আম্মান, ইয়ামামা সহ আরবের বহু গোত্রপতি ও শাসকের নিকটও দূত প্রেরণ করেন । ঐতিহাসিকদের ভাষ্য, রাসূল (সাঃ) তাঁর শ্বাশত সওগাত বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেয়ার জন্য যত শান্তি চুক্তি, সন্ধি, দূত ও পত্র প্রেরণ করেছিলেন পৃথিবীর কোন শাসক সম্রাট তা করতে পারেন নি । প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী রাসূল (সাঃ)  বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ও শাসক-সম্রাটের নিকট প্রায় আড়াই শতের মত পত্র ও দূত প্রেরণ করেছিলেন ।

 

খায়বারের যুদ্ধঃ

        ফিতনাবাজ ইহুদী জাতি সর্বদা-সব  কালেই ফিতনার মূল নায়ক । বনু নযীরকে মদীনা থেকে নির্বাসিত করলে খায়বারের ইহুদীরা তাদের আশ্রয় দিয়ে শক্তি সঞ্চয়ে নেমে পড়ে এবং মুসলমানদের উপর অতর্কিত আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে । এসব কিছু ছিলো রাসূলের নখদর্পনে । তিনি এবার তাদের শায়েস্থা করতে চাইলেন এবং অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অতর্কিতভাবে আক্রমণ করে তাদের দূর্গগুলা দখল করে নেন এবং ইহুদীদের চিরতরে আরব ভূমি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পথ সুগম করেন ।

 

মুতার যুদ্ধঃ

        আরবে মুসলমানদের  অজেয় শক্তিরুপে দেখা দিলেও বহিঃশক্তির সাথে অর্থাৎ পরাশক্তির সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কোন দ্রুত পরিকল্পনা তাদের ছিলো না ।

 

        কিন্তু রাসূলের দূত যখন সিরিয়ার গভর্ণরের নিকট ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গেলে সে দূতকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং আন্তর্জাতিক আঈনকে সম্পূর্ণ রুপে অগ্রাহ্য করে । ফলে বাধ্য হয়ে রাসূল তার বিরুদ্ধে ৩০০০ সাহাবীর এক বাহিনী প্রেরণ করেন । মুসলিম বাহিনীর উপস্থিতিতে রোমানরা দেড় লক্ষ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ ময়দানে অবতীর্ণ হয় । কয়েক দিন যুদ্ধের পর মহাবীর খালিদ সেনাপতিত্বের ভার গ্রহণ করলে তিনি এমনভাবে সৈন্যদের বিন্যস্ত করেন যে তা দেখে প্রাণের ভয়ে রোমান বাহিনী পিছু হটে যায় ।

 

মক্কা বিজয়ঃ

        ৮ম হিজরীতে কুরাইশরা রাসূলের মিত্র বনু লুথাকে নির্মমভাবে অত্যাচার করার মাধ্যমে অনাক্রমণ চুক্তি লঙ্ঘন করে । তাই রাসূল ১০০০০ সাহাবা নিয়ে মক্কা বিজয়ের জন্য অগ্রসর হন । কুরাইশদের কোন প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকায় প্রায় নির্বিঘ্নেই মক্কা মুসলমানদের হস্তগত হয় । বাইতুল্লাহ আবার আল্লাহর স্তুতিগানে মুখরিত হয়ে উঠে । মাত্র চারজন পাপিষ্ঠের প্রাণদন্ড ছাড়া সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন । রাসূলের মহৎগুণে বিমুগ্ধ হয়ে প্রায় সকলেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন । আবু সুফিয়ান পর্যন্ত মুসলমান হয়ে যান । বিখ্যাত পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক হোগায়ের ভাষায়,"অতীতের কোন বিজয় কাহিনীতে এরুপ মহত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় না । "

 

হোনায়েনের যুদ্ধঃ

        মক্কা বিজয়ের পর একদল গোড়া মুশরিক স্বধর্ম বিপন্ন হওয়ার অমূলক আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে উঠে । আক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই আক্রমণের জন্য তারা বিশ হাজার বিচক্ষণ যোদ্ধার সমাবেশ করে । রাসূল সংবাদ পেয়েই ১২ হাজার মুজাহিদ নিয়ে প্রতিরোধ আক্রমণে অগ্রসর হন । তাদের অতর্কিত আক্রমণে মুসলমানরা প্রায় পরাজয়ের সম্মুখীন হন । সবশেষে বিজয়ের মাল্য মুসলমানদের ভাগ্যেই জোটে । তারপর আততাস ও তায়েফের যুদ্ধেও তাঁরা বিজয়ের মাল্য ছিনিয়ে আনেন ।

 

রাসূল এবার ক্ষমতার শীর্ষে সমাসীনঃ

        ইতিমধ্যে মুশরিকদের সমস্ত আক্রমণ ও প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে পড়েছে । আরব উপদ্বীপে রাসূল এবার ক্ষমতার সর্বোচ্চ শীর্ষ আসনে । জন বিরল মদীনা এখন জনাকীর্ণ । বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিরা এসে মদীনা ছেয়ে ফেললো । কেউ সন্ধি করলো, কেউ স্বগোত্রে ইসলাম কবুল করলো । কেউ আবার যাকাত দিতে চাইলো না । কেউ আরো কিছুকাল প্রতিমাগুলোকে অক্ষত রাখতে অনুমতি চাইলো ।

 

        কিন্তু যিনি ইসলাম ও একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে এতো কাল ধরে অবিরাম নিরাপোষ যুদ্ধ করে আসছেন তিনি কিভাবে তা মানতে পারেন? ইসলামই যার মূল ও একমাত্র লক্ষ্য তিনি কিভাবে রাজনৈতিক হীন স্বার্থে আদর্শের প্রশ্নে শীথিল হবেন? মক্কী জীবনের অসহায় করুণ মূহুর্তগুলোতে তিনি তো শুধু রাজনৈতিক স্বার্থে নেতৃত্ব পাওয়া স্বত্বেও তা গ্রহণ করেননি । আদর্শের প্রশ্নে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও আপোষহীন । ফলে এই অদীক্ষিত গোত্রগুলো ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হলো ।

 

তাবুক অভিযানঃ

        মুতার যুদ্ধে সিরিয় বাহিনীর পরাজয় সিরিয়ার গভর্ণরকে দারুন বিচলিত করলো । তাই আরব দিগন্তে উদিত  এই নতুন শক্তিতে নিঃশেষ করতে বিপুল সৈন্য সমাবেশ করালো । রোম সম্রাট ও তাকে চল্লিশ হাজার সৈন্য দিয়ে সহায়তা করলো । এ বিশাল বাহিনী নিয়ে সিরীয় শক্তি মদীনা আক্রমণে অগ্রসর হলো । রাসূল এ সংবাদ শুনে ৩০০০০ সৈন্য নিয়ে সিরিয়া সীমান্ত তাবুকে উপস্থিত হলেন । কিন্তু রাসূলের সশরীরে আগমনে সিরিয়ার শাসকের অন্তরাত্মা চুপসে গেলো ।

 

চির বিদায়ঃ

        রাসূল যখন সাহাবাদেরকে বিশ্ববাসীর আদর্শরুপে গড়ে তুললেন ও বিশ্ব নেতৃত্বদানে যোগ্য উত্তরসূরীরুপে তৈরি করলেন এবং বিশ্বের দরবারে ইসলামের শ্বাশত সওগাত পৌঁছে দেয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক তখনই রাসূল গুরুতর পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন ।

 

পর্যালোচনাঃ

        ইসলাম যখন ফুলকলি মুসলমানরা তখন দারুন অসহায় । মক্কাজীবনে জোর জুলুম অত্যাচার নিপীড়নের স্টীমরোলার নেমে এসেছিলো তাদের উপর । প্রতিনিয়ত অমানবিক অসহনীয় অত্যাচারে জর্জরিত হতো তারা ।

 

        এভাবে দীর্ঘ তের বছর তারা মক্কায় কাটান । তারপর জীবনাশঙ্কা দেখা দিলে মদীনায় হিজরত করেন ও ১০ বছর মদীনায় অতিবাহিত করেন । হিজরতের মাত্র ৫ মাস ১৮ দিন পর থেকেই জিহাদের কার্যক্রম শুরু হয় এবং মাত্র ১০ বছরে রাসূল (সাঃ) ৮০ টি যুদ্ধ পরিচালনা করেন । ২৭ টি যুদ্ধে নিজে সেনাপতি ছিলেন । বাকী ৫৩ টি যুদ্ধে তিনি সাহাবায়ে কেরামদের প্রেরণ করেন । তিনি তার জীবদ্দশায় যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন তা দশ লক্ষ বর্গ মাইল এলাকা বিস্তৃত ছিলো । ১ লক্ষ ৩০ হাজার সাহাবাকে বিশ্ববাসীর নিকট আর্দশ শিক্ষক রুপে রেখে যান । তারাই আমাদের রাসূলের প্রতিচ্ছবি, তারাই আমাদের আদর্শের প্রতীক । তাদের নির্ভীক দুর্দম, সাহসিকতা, অকৃত্রিম নিষ্ঠা,ঐকান্তিকতা ও সীসাঢালা ভ্রাতৃত্ববোধের কারণেই মাত্র অর্ধ শতাব্দীতে পৃথিবীর দিকে দিকে ইসলাম তার বিজয় ঝান্ডা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল । যুগের পর যুগ ধরে পৃথিবী শাসন করেছিল মুসলমানরা ।

 

        কিন্তু অত্যাশ্চর্য বিষয় হলো ইসলামের ঐশী আদর্শিক বিল্পবের লক্ষ্যে রাসূল যে ৮০ টি যুদ্ধ করেছিলেন তাতে রক্তক্ষয় হয়েছিলো অতি সামান্য,একেবারেই নগণ্য । নীচের তালিকা থেকে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়ঃ

 

                                কয়েদী      আহত         নিহত

        মুসলমান        ১১ জন         ১২৭ জন     ৪৫৯জন

        দুশমন           ৬৫৬৪ জন   ০ জন         ৪৫৯ জন

 

        অথচ জনতন্ত্রের লক্ষ্যে সংগঠিত ফরাসী বিপ্লব ৬৬ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে সফল হয়েছিল ।

 

        আর সোভিয়েত রাশিয়াতে সমাজ বিপ্লবের জন্য ১ কোটিরও বেশী মানুষের প্রাণ দিতে হয়েছিলো ।

 

        আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে(১৯১৪-১৮) ৭৩ লক্ষ ৩৮ হাজার লোককে প্রাণ দিতে হয়েছিলো তা একবার দেখে নিনঃ

 

        রাশিয়া         ১৭ লক্ষ

        ইতালি          ৪ লক্ষ ৬০ হাজার

        তুরস্ক           ২ লক্ষ ৫০ হাজার

        রোমান         ১ লক্ষ

        জার্মানি         ১৬ লক্ষ

        অষ্ট্রিয়া          ৮ লক্ষ

        বেলজিয়াম    ১ লক্ষ ২ হাজার

        ফ্রান্স            ১৩ লক্ষ ৭০ হাজার

        বৃটেন           ৭ লক্ষ ৬ হাজার

        বুলগেরিয়া     ১ লক্ষ

        আমেরিকা     ০ লক্ষ ৫০ হাজার

        অন্যান্য        ১ লক্ষ ০ হাজার

        মোট            ৭৩ লক্ষ ৩৮ হাজার

 

        দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও কোটি কোটি ডলার ব্যয় হওয়া ছাড়াও ১ কোটিরও বেশী মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো । নিম্নে তার তালিকা দেয়া হলোঃ

 

        রাশিয়া         ৭ লক্ষ ৫০ হাজার

        আমেরিকা    ৩ লক্ষ

        বৃটেন           ৫ লক্ষ ৫০ হাজার

        ফ্রান্স            ২ লক্ষ

        জার্মান         ২৮ লক্ষ ৫০ হাজার

        ইতালি          ৩ লক্ষ

        চীন             ২২ লক্ষ

        জাপান         ১৫ লক্ষ

        মোট            ১ কোটি ৬ লক্ষ ৫০হাজার

 

         এছাড়াও এক কোটি মানুষ গৃহহারা হয় ।

 

        উল্লেখিত পরিসংখ্যান থেকে আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নেতৃত্ব বিশ্বজুড়ে যে ঐশী মহান বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিলো তা ছিলো সার্বিক কল্যাণ ও শান্তিময় বিপ্লব । আর রাসূল (সাঃ) ছিলেন প্রকৃত রহমাতুল্লিল আলামীন বা সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টির জন্য শান্তি ও মুক্তির দূত । একমাত্র তাঁর আদর্শই চিরন্তন, মহান,অনিন্দসুন্দর, চির অনুকরণীয়, অনুসরনীয় ।

 

        তবে আজকের এই ভয়াবহ মুহূর্তে যখন ইসলাম দারুণ অসহায়, মুসলমানরা দেশে দেশে লাঞ্চিত, পদদলিত বিপন্ন । তাই আজ আমাদের আত্নসচেতন হতে হবে । আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরতে হবে,রাসূলের আদর্শে আদর্শবান হতে হবে,তা হলেই আমরা আবার বিশ্ব নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে পারব । বিশ্বের বুকে শীর উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো ।

 

        আল্লাহ মুসলমানদের হাতে বিশ্ব নেতৃত্বের চাবি কাঠি তুলে দেয়ার জন্য মাত্র একটি শর্তারোপ  করেছেন,তা হলো-"নিষ্কম্প ঈমান" ।

 

        কুরআনের ভাষায়ঃ" হে মুমিনগণ!তোমরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ো না আর চিন্তিতও হয়ো না । তোমরাই হবে বিজয়ী যদি তোমরা প্রকৃত মুমিন হও । "

 

        ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই এ কথা স্পষ্ট বুঝে আসে যে, মুসলমানরা কখনো অস্ত্রবলে বিজয় লাভ করে নি । কোনো দিনই মুসলমানদের সংখ্যা শত্রু সংখ্যা থেকে অধিক ছিল না । কিন্তু ঈমানী জযবায় যখনই মুসলমান রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে তখনই বিজয় মাল্য মুসলমানের কন্ঠেই শোভা পেয়েছে । নিচের পরিসংখ্যান দ্বারা এর সত্যতা বিচার করুনঃ

 

যুদ্ধ      মুসলমানদের সংখ্যা      শত্রু সংখ্যা         বিজয় 

বদর                ৩১৩                         ১০০০                   "      

উহুদ                ৭০০                        ৩০০০                   "

খন্দক              ৩০০০                      ২৪০০০                 "

মুতা                 ৩০০০                      ১০০০০                 "

ইয়ারমুক          ৪০,০০০                   ২,৪০,০০০             "

কাদেসীয়া         ৮০০০                     ৬০,০০০                "

স্পেন                ৭০০০                     ১০০০০০                "

সিন্ধু                  ৬০০০                     ৫০,০০০                "

 

        তাই আজকের বিপন্ন মুসলিম জনপদগুলোকে উদ্ধার করতে বসনিয়া, হার্জেগোভিনার ৫০ হাজার ধর্ষিতা মা-বোন, ৮ লাখ আহত পঙ্গু, ৩০ লাখ উদ্বাস্তু মুসলমানের মুখে নির্মল হাসি ফুটাতে , ৮০০ শত ভাঙ্গা মিনারে আবার আল্লহু আকবার ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে মুখরিত করতে আমাদের ঈমানী বলে বলীয়ান হতে হবে ।

 

        কাশ্মীরে ৫০ হাজার ধর্ষিতা মা-বোনের মনোবাসনা পূরণ করতে, বর্বর ভারতীয় বাহিনীর নিষ্পেষণে দেড় লাখ শহীদ ভাই ও বিভিন্ন হত্যাযজ্ঞে নিহত ৩০ হাজার নিষ্পাপ ভাইয়ের বিদেহী আত্মার শান্তির লক্ষ্যে আমাদের আবার ঈমানী অস্ত্রে সজ্জিত হতে হবে ।

 

        আলজেরিয়া, ফিলিপাইন, ফিলিস্তিন, মায়ানমার তথা বিশ্বের দেড়শত কোটি মুসলমানকে আজ নব চেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে । আলী হায়দার, মহাবীর  খালিদ ইবনে অলীদ, মূসা, তারিকের আঁকা পথেই আমাদেত দূর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে হবে । তাহলেই আমরা ছিনিয়ে নেয়া আমাদের গৌরব আবার ছিনিয়ে আনতে পারবো । ফিরে পাবো মান, মর্যাদা ও বিশ্ব নেতৃত্ব । যেভাবে রাসূল (সাঃ) ২৩ বছর সাধনা করে লাভ করেছেন নেতৃত্বের সর্বোচ্চ আসন ।

 

 

═──────────────═