JustPaste.it

মায়ের মত মা

– আরশাদ ইকবাল

================================================

 

        ধূসর মরু প্রান্তর। যেদিকে চোখ যায় শুধু বালিয়াড়ি আর বালিয়াড়ি। মাঝে মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে উপল খণ্ড। দুপুরের অগ্নিতাপে বালু কণাগুলাে অগ্নি ফুলিংগের মত দুরন্ত বাতাসের সাথে দাপাদাপি, ছুটাছুটি করে, আবার বিকেলের স্নীগ্ধ শিতলতায় অপূর্ব হিমেল বায়ু প্রবাহ ছুটে বেড়ায়।

 

        এই তাপদগ্ধতা ও স্নগ্ধ শীতলতার কোলে ছোট একটি ময়দান মদীনা নগরী। খজুর বৃক্ষের সবুজ প্রান্তরের মাথায় বহু কষ্টে, বহু চড়াই উৎরাইয়ের মাঝে এখনো দাড়িয়ে আছে।

 

        শুক্লাপক্ষ, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। মুখে তার নিটোল হাসি। নিঝুম নিস্তব্ধ রজনী। উর্ধ্বলােকের বাতায়ন খুলে তারারা পিট্ পিট্ করে তাকিয়ে আছে। শুধু মেঘমালা ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে অজানা লােকে। এ স্নিগ্ধ স্বর্গীয় সুষমায় শিক্ত মদীনা নগরী ঘুমে অচেতন। ক্রমে রাত গড়িয়ে সোবহে সাদেক হলাে। পূর্বাকাশ আলােচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠলাে।

 

        অপসৃয়মান অন্ধকারের বুক চিরে একটি দরাজ কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়লাে মদীনার অলিতে গলিতে, “হে মুজাহিদরা, হে রাসূলের সাহাবারা, ইসলাম আজ উষ্ণরক্তে ধন্য হতে চাইছে। ইসলামের শত্রুরা ইসলামকে স্তব্ধ করতে সমবেত হয়েছে। জিহাদে চলো। জি-হা-দে চ-লাে!” বিলাল (রাঃ) -এর ডাকে অচেতন মদীনা নগরী শিউরে ওঠলাে। চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়লাে চারি দিকে। বিলাল (রাঃ)-এর কণ্ঠস্বর এঁকে বেঁকে ক্রমে দূরে মিলিয়ে যায়। পথের বাঁকে একজীর্ণ কুটিরে এক বিধবা মহিলা তার পুত্র সন্তানকে বুকে জড়িয় বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলাে। বিলাল (রাঃ) -এর কণ্ঠস্বরে তার ঘুম ভেঙে যায়। জিহাদের ডাক! হৃদয়টা ছাৎ করে ওঠলাে। অশ্রু ভারে চক্ষুদ্বয় ঝাপসা হয়ে এলাে, মানস পটে ভেসে ওঠলাে প্রাণপ্রিয় স্বামীর অন্তিম বিদায় লগ্নের স্মৃতি বিজড়িত মুহূর্তগুলাে ; যখন শাণিত তরবারি তুলে দিচ্ছিলেন স্বামীর হাতে, তাকে বর্ম পড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজ হাতে। তারপর অশ্বের পদাঘাতে ধুলিঝড় উড়িয়ে তিনি চির বিদায় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন বদর অভিমুখে। কিন্তু তারপর? তারপর ফিরে এসেছিলেন শহীদের খুনরাঙা আভরণে। অধরে লেগেছিলাে অপূর্ব জান্নাতী হাসির রেখা। রক্তে জান্নাতের খোশবু। তিনি আজ বহু দূরে-জান্নাতে। কিন্তু আমি? আমি বুঝি চির বিরহিনী, চির দুঃখীনী।

 

        কল্পনার অসহ্য যাতনায় দু’চোখ চেপে অশ্রু ঝড়তে লাগলাে। ডুকরে কেঁদে ওঠলাে বিধবা মহিলা! অশ্রুর উষ্ণ পরশে কান্নার আওয়াজে এতিম বালকটির ঘুম ভেঙে যায়। হতবিহবল হয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলাে। নিষ্পলক নেত্রে মায়ের মুখপানে চেয়ে থেকে কতক্ষণ, তার পর কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললাে, “মা! কাদছো কেন? কি হয়েছে তোমার?” আবেগে তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলাে। ওষ্ঠাধর কাঁপতে লাগলাে। শত চেষ্টা করেও আর কিছুই বলতে পারলাে না এতিম বালকটি।

 

        মা ছেলের কপালে গভীর মমত্বের চুমু এঁকে দিলেন। স্বস্নেহে মাথার চুলগুলা নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, “বাবা, আজ ইসলামের বড় দুর্দিন, জিহাদের ডাক এসেছে। তোর আব্বা থাকলে, তাকে জিহাদে পাঠাতাম। তিনিও নেই, আর তুইতো এখনো ছোট, কাকে রাসুলের সাথে জিহাদে পাঠাবো?” বালকটি শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বললাে, “এজন্য কি কাঁদতে হয় মা! আমাকে রাসূলের দরবারে নিয়ে চলুন। যদি আমাকে জিহাদে কবুল করেন তবে তো। মহাসৌভাগ্য। এখনই আমাকে রাসূলের নিকট নিয়ে চলুন।”

 

        ছেলের কথায় মায়ের হৃদয়-কপাট খুলে স্নগ্ধ আলােয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। দারুন আনন্দিত হলেন ছেলের কথা শুনে। বার বার ছেলেকে চুমু খেতে থাকেন। স্বস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।

 

        ফজরের পর মসজিদ চত্বরে এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারনা হয়। সারিবদ্ধ মুজাহিদদের সাথে নবীন মুজাহিদদের দলও এসে হাজির। চোখে মুখে আনন্দের ফাল্গুধারা। বুকে অসীম সাহস। হৃদয়ে উচ্ছসিত উদ্দম আর প্রশান্তি। স্বয়ং রাসূল ﷺ তাদের সেনাপতি। আল্লাহ্ তাদের পরিচালক। সুতরাং বিজয়তো তাদেরই। রাসূল ﷺ এলেন কিশোর মুজাহিদদের আদরে সোহাগে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফিরিয়ে দিতে লাগলেন। এমন সময় বিধবা মহিলাটি তার ছেলেকে নিয়ে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হন। সে আশা-নিরাশার দোলায় দুলছে। আলাে আঁধারের এক অপূর্ব মিলন স্পষ্ট হয়ে ওঠছে তার মুখাবয়বে। আবেগ জড়িত কণ্ঠে বললেন, “ইয়া এ রাসূলাল্লাহ, এছেলেটি আমার জীবনের একমাত্র সম্বল। আমার দ্বিতীয় কোন সন্তান নেই। ওর পিতা বদরের যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাই আমার আন্তরিক নিবেদন, দয়া করে ওকে জিহাদে নিলে আমি কিয়ামত দিবসে মুজাহিদদের মায়েদের সাথে দাঁড়াতে পারতাম।”

 

        ত্যাগের দীপ্ত চেতনায় ফুরিত মহিলার কথায় রাসূল ﷺ অত্যন্ত মুগ্ধ হলেন। মুগ্ধ হলেন সাহাবাগণও। শহীদ পিতার কথা শুনে আবেগাকুল হয়ে রাসুল ﷺ ছেলেটিকে কাছে টেনে নিলেন। আদর করে চুমু খেলেন। পরম স্নেহের সাথে বললেন, “তুমি এখনো ছোট, তাই না? আরেকটু বড় হও, যুবক হও, তখন তোমাকে জিহাদে নেবো, কেমন?” ছেলেটি তখন অস্ফুট অথচ করুণ আবেদনের সুরে বললাে, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আম্মা যখন চুলােয় আগুন ধরায় তখন ছোট ছোট খড়িগুলােই তো আগে দেয়, আমিও কি জিহাদের ময়দানে ছোট খড়ি হতে পারবোনা।” ছেলেটির বুদ্ধিমত্তায় দারুন বিস্মিত হলেন আল্লাহর রাসূল। তিনি তার অনুসন্ধানী দৃষ্টি মেলে ক্ষণকাল তাকিয়ে রইলেন ছেলেটির নিস্পাপ মুখপানে। তারপর এক রাশ প্রশান্তিতে ভরে ওঠলাে রাসূল ﷺ -এর চোখের মনি। আনন্দে বিধবা মহিলাটিকে তিনি বললেন, “যাও হে ভাগ্যবতী মহিলা! আল্লাহ্ তোমার ছেলেকে কবুল করেছেন। তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। তুমি কিয়ামত দিবসে মুজাহিদদের মায়েদের সাথেই থাকবে।”

 

 ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄ ̄

অনিবার্যকারণ বশতঃ মরণজয়ী মুজাহিদ এ সংখ্যায় ছাপা না হওয়ার দুঃখিত। আগামী সংখ্যা হতে পুনরায় প্রকাশিত হবে ইনশাল্লাহ। -নির্বাহী সম্পাদক

*****