JustPaste.it

সত্যের সন্ধানে

 

ঈসাবেলা

মূলঃ মাওঃ আঃ হালীম শরর লখনবী

অনুবাদঃ মাওঃ আবদুর রাযযাক

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

চিঠি পাওয়া মাত্রই ঈসাবেলা পিতৃ গৃহ হতে বের হয়ে পরিচারিকার সাথে কছরুশ শুহাদা হতে রবাত রুম্মানী (রুম্মানী মুছাফিরখানা) গামী সড়কটি ধরে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগল। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর পরিচারিকা সড়ক পরিত্যাগ করে একটি গলিপথে যাত্রা করল!আরও কয়েকটি গলি পার হয়ে একটি বিরাট প্রাসাদাভ্যান্তরে প্রবেশ করল।প্রাসাদের দ্বার অর্গলাবদ্ধ করে দেওয়ার পর কয়েকটি কামরা অতিক্রম করে একটি বিরাট কামরার অভ্যন্তরে ঈসাবেলাকে বসিয়ে রেখে পরিচারিকা মীরাতোকে সংবাদ দিতে চলল। কিছুক্ষণ পর দ্বার উন্মুক্ত করে কামরায় প্রবেশ করল মীরাতো নহে বরং কতিপয় আপাদ লম্বিত শুভ্র আলখেল্লা পরিহিত খৃষ্টীয় দরবেশ বা রাহেব। তারা ঈসাবেলাকে ঘাড় ধাক্কার সাহায্যে প্রাসাদের অভ্যন্তরে অবস্থিত ভূতল কক্ষের সিঁড়ির দিকে নিয়ে চলল। ঈসাবেলা বুঝতে পারল যে, সে এখন ইনকুইজিশন ডিপার্টমেন্টের হস্তে বন্দিনী। তার জ্ঞান লোপ পাবার উপক্রম হল। সিঁড়িতে পা পড়া মাত্র জনৈক রাহেব - অবলা ঈসাবেলার কোমল দেহে সজোরে ঘুষি মেরে কর্কশ স্বরে বলে উঠল “হে অভিশপ্ত বালিকা! সম্মুখে চল, দেখ, খোদাওন্দ যীশুর গযবের অগ্নি তোকে ভস্ম করবার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। অভাগিনী তুই খৃষ্ট ধর্মের দুর্নাম করেছিস এবং তার সর্বজনমান্য পিতার মান-সম্ভ্রমকে ধূলায় লুন্ঠিত করেছিস।" বেচারী ঈসাবেলা খামোশ কিন্তু ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। মুষ্টাঘাত খেতে খেতে সে অন্ধকার ভূতল কক্ষের অভ্যন্তরে অবতরণ করল। জনৈক রাহেব বাতি প্রজ্বলিত করল। এতে সেই পাতালপুরীর সুচিভেদ্য অন্ধকার অবশ্য বিদূরিত হল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তথাকার যে ভীষণ দৃশ্যাবলী ঈসাবেলার দৃষ্টিগোচর হল, তাতে ভয়ে তার প্রাণ বহির্গত হওয়ার উপক্রম হল। সে দেখতে পেল, তথায় নরকঙ্কালসমূহ চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে এবং দেয়াল গাত্রে অগণিত নরমুণ্ড গ্রথিত থেকে ভীষণ বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে। রাহেব ঈসাবেলাকে বলল, “অভাগিনী! এখন তোকে এখানেই অবস্থান করতে হবে, যেন তোর বোধগম্য হয় যে, খোদাওন্দ যীশু হতে বিমুখ হওয়ার পরিণতি কি হয়ে থাকে। (নর কঙ্কালসমূহের প্রতি ইঙ্গিত করে) তোকে সাজা দেওয়ার জন্যই এদেরকে নিযুক্ত করা হয়েছে।"

ঈসাবেলা সম্পূর্ণ নীরব, সে নিজেকে যেন ঘুমন্ত এবং এ সকল ব্যাপারকে স্বপ্ন বলে মনে করছিল। রাহেবগণ ভূতল কক্ষ হতে বহির্গত হয়ে দ্বার অর্গলাবদ্ধ করে দিল এবং নিজ নিজ নির্ধারিত স্থানে গমন করতঃ খৃষ্টীয় সাধনা এবং উপাসনায় লিপ্ত হল। অল্পক্ষণ পরেই ঈসাবেলার উপলব্ধি হল যে, সে ঘুমন্ত নহে, বরং জাগ্রত এবং তাকে এই প্রেতপুরীতে আবদ্ধ করা হয়েছে একমাত্র সত্যাবলম্বনের অপরাধে। আর এই প্রাসাদটি হল খৃষ্টীয়দের একটি উপাসনালয় বা খানকা।

ঈসাবেলা খোদাকে স্মরণ করতে লাগল। এক সময় ঝিঁঝিঁ পোকা ও অন্যান্য কীট-পতঙ্গের একটানা আওয়ায শ্রবণে সে বুঝতে পারল, দিবা অবসানান্তে নিশার আগমন হয়েছে। হঠাৎ দ্বারোন্মুক্ত করে রাহেবগণ সেই প্রেতপুরীতে প্রবিষ্ট হল এবং ঈসাবেলাকে তা হতে বের করে এক গ্লাস ছাতুর শরবত পান করালো। ঐ সময়ও রাহেবগণ বিড় বিড় করে ঈসাবেলাকে তিরস্কার করছিল। অতঃপর তারা তাকে খানকার বিভিন্ন স্থান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাতে লাগল, যেখানে রাহেবগণ নানা প্রকার সাধনা ও ইন্দ্রিয় দমনার্থে বিভিন্নরূপ অমানসিক দৈহিক যাতনা ভোগে মশগুল ছিল। এ সকল দেখাবার উদ্দেশ্য সম্ভবতঃ এটাই ছিল যে, হয়ত ঈসাবেলা খৃষ্টীয় ধর্মানুগামীদের সাধনা ও উপাসনা দর্শনে প্রভাবান্বিত ও ভাববিহ্বল হয়ে পড়বে এবং রাহেবগণের দৈহিক-যাতনা ভোগ তাহার অন্তরে আঘাত হেনে তাকে দুর্বল করতে সক্ষম হবে। ঈসাবেলা গভীর দৃষ্টিতে রাহেবগণের উপাসনার প্রক্রিয়াসমূহ দর্শন করতে লাগল। একস্থানে দেখতে পেল, এক ব্যক্তি লৌহ শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় এক কোণে পড়ে ছটফট করছে, আর অপর এক ব্যক্তি তার উপর শপাশপ চাবুক বর্ষণ করে চলছে। এ দৃশ্য দর্শনে ঈসাবেলা অত্যন্ত মুষড়ে পড়ল, সে ধারণা করতে লাগল, “এ ব্যক্তি আমারই মত জনৈক অপরাধী। কিন্তু শীঘ্রই সে জানতে পারল যে, ইন্দ্রিয় দমন ও শয়তানী শক্তিকে পরাস্ত করার এ একটি প্রক্রিয়া মাত্র, যা রাহেবগণ আপন স্বার্থে, স্বেচ্ছায় অবলম্বন করছে। এক বৃহৎ কক্ষে কুমারী মরিয়মের এক প্রস্তর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তার চতুর্পাশে রাহেব এবং রাহেবাগণ ধ্যান ও তপস্যায় নিমগ্ন। কয়েকজন দেয়াল আশ্রয় করে মস্তক জমীনে স্থাপন পূর্বক বাকী সর্বাঙ্গসহ পদযুগল আকাশের দিকে উত্থিত করে রয়েছে। আরও কয়েকজন , রাহেব এক কোণে পড়ে কাতরাচ্ছে। কারণ তারা ইন্দ্রিয় দমনার্থে বিশ দিন যাবত অনাহারে কাটিয়ে মরণাপন্ন হয়ে পড়েছে। রাহেগণের এ সব অমানসিক ক্রিয়াকান্ড সম্বন্ধে যদিও ঈসাবেলার অজানা ছিল না, কিন্তু এ দৃশ্যাবলী স্বচক্ষে দর্শন করবার সুযোগ তার ইতিপূর্বে হয়নি।

জনৈক উচ্চপদস্থ রাহেব ঈসাবেলাকে বলল, “রে মরদুদ বালিকা! যদি তুই মুক্তি পেতে ইচ্ছা করিস, তবে এ প্রকার সাধনা দ্বারা খোদাওন্দ যীশুকে তুষ্ট কর। এর দ্বারাই কেবল তোর জঘন্য পাপের প্রায়শ্চিত্ত হওয়া সম্ভব।" রাহেবের বাক্য শ্রবণ করে ঈসাবেলা সহাস্যে বলে উঠল, এ সকল সাধনায় খোদার কি প্রয়োজন? ধর্মের উদ্দেশ্য তো, বান্দার উপর খোদার যা আদেশ, তা পালন করে খোদার মখলুকের খেদমত করে যাওয়া; চামচিকার ন্যায় অদোমুখী হয়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকা নয় ।

দ্বিতীয়তঃ আপনাদের দাবী অনুসারে হযরত ঈসা নিজেই তো খৃষ্টানদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে গিয়েছেন। অতএব আপনাদের এসব ক্রিয়াকাণ্ড নিষ্ফল। ঈসাবেলার কথা শোনা মাত্রই রাহেবের নীল চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ ধারণ করে, যেন অগ্নিশিখা উদগিরণ করতে লাগল এবং সে ঈসাবেলার বক্ষোপরি সজোরে এক ঘুষি মেরে বলে উঠল, 'জাহান্নামী বালিকা। তোর সংশোধন কিছুতেই হবার নয়। চল, আপন স্থানে গিয়া বস। তোর পূর্ণ চিকিৎসা সে স্থানেই হবে।' রাহেব ভূতল কক্ষের দ্বারোদ্ঘাটন করে ঈসাবেলাকে পুনরায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তার অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দিল।

ঈসাবেলা ভূতল কক্ষের এক কোণে গিয়ে বসে পড়ল। ঐ বিভীষিকাপূর্ণ কক্ষে প্রথম প্রবেশের পর তার মস্তিকে কিছু অচৈতন্য ভাব দেখা দিয়েছিল। কিন্তু পরে তার হৃদয় ও মস্তিষ্কের পূর্ণ শক্তি ফিরে আসল এবং সে তার অগ্র পশ্চাৎ সকল অবস্থার উপর চিন্তা করার যোগ্যতা পুনরায় ফিরে পেল। সে সারা রাত্র কুরআন মজিদের তার জানা দোয়াসমূহ পাঠের ভিতর দিয়ে কাটাল। এ নীরব নিঝুম মুরদা খানায় ইদুর বা আরশোলার সামান্য নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেলেও বেচারী ঈসাবেলা ঐ অন্ধ কোঠার চারিদিকে নিস্ফল ভয়াতুর দৃষ্টিপাত করতে থাকে, পরক্ষণেই নিজেকে প্রকৃতিস্থ করে দোয়া পাঠে মশগুল হয়। খোদাকে স্মরণ করতে করতে কোন প্রকারে এই বিভীষিকাময় নিশির অবসান হল। কক্ষের ছাদ সংলগ্ন দেয়ালের সংকীর্ণ ছিদ্রপথে সূর্যের সামান্য কিরণ প্রবেশ করে নিশার বিদায়বার্তা অবহিত করল। কিছুক্ষণ পর দ্বার উন্মুক্ত হল এবং জনৈক রাহেব তাকে তা হতে বের করে আনল। খানকার এক বিরাট কক্ষে প্রতিষ্ঠিত যীশু ও তার বারজন হাওয়ারীর কাল্পনিক প্রস্তর মূর্তির সম্মুখে তাকে উপবেশন করল। শহরের দুজন প্রখ্যাত পাদ্রী পূর্ব হতেই তথায় মৌজুদ ছিল। তারা প্রথমতঃ ঈসাবেলার উপর চূড়ান্ত ক্রোধাগ্নি বর্ষণ করল। অতঃপর তাকে উপদেশ প্রদান করতে আরম্ভ করল।

পাদ্রীঃ তুই কি মুসলমান হয়ে গিয়েছিস?

ঈসাবেলাঃ আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ পাক আমাকে ইসলাম স্বরূপ সম্পদের অধিকারিণী করেছেন।

পাদ্রীঃ ইসলামের প্রশংসাবাদ পরিত্যাগ কর, এখন বল্, তুই কি অশুভ মৃত্যুই পছন্দ করিস না পুনরায় নতুন করে খোদাওন্দের অনুগ্রহের অংশীদার হওয়ার বাসনা রাখিস।

ঈসাবেলাঃ ইসলামের আনুগত্য স্বীকার করে নেয়ার পর প্রত্যকেই খোদার অনুগ্রহের অংশীদার হয়ে থাকে। আর ঐ ব্যক্তির চেয়ে সৌভাগ্যবান অপর কেউই নেই, যাকে খোদা ইসলাম গ্রহণের তৌফীক প্রদান করেছেন। কেননা এ ধর্মই খোদার সন্তুষ্টি ও মহব্বত লাভের একমাত্র উপায়।

পাদ্রীঃ খামোশ! আমার সম্মুখে রক্ত পিপাসু ইসলামের প্রশংসা? রসনা সংযত কর। আমি তো তোর নিকট শুধু দুই কথার জবাব চাই, হয় এ অবস্থায় মৃত্যু নতুবা খৃষ্ট ধর্মে ফিরে এসে মুক্তি। বল্-কোনটি তোর কাম্য? যেন অদ্যই তোর ভাগ্যের মীমাংসার পরিসমাপ্তি ঘটাতো সম্ভব হয়।

ঈসাবেলাঃ কোন এক যুগে খৃষ্টীয় শহীদগণ কতই না নির্যাতন সহ্য করেছেন, কিন্তু কখনই তারা সত্য হতে বিমুখ হন নি। তারা জীবিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, সিংহ ও ব্যাঘ্রের সম্মুখে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন,  করাতে দ্বিখণ্ডিত হয়েছেন, কিন্তু সত্যের অঞ্চল তাদের হস্তচ্যুত হতে পারেনি। তারা প্রমাণ করে গিয়েছেন যে, সত্যই প্রকৃত জিন্দেগী। যদি সত্যের কারণে মৃত্যুও সমাগত হয়, তবে তা বরণ করে নেয়াই খোদার সন্তুষ্টি লাভের উপায় এবং অন্তরের প্রকৃত শান্তির পন্থা। যেহেতু আমি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আছি, কাজেই মৃত্যু কেন দুনিয়ার কোন শক্তিই আমাকে সত্য হতে বিমুখ করতে পারে না। আমাকে তে কুরআন এই শিক্ষাদান করেছেঃ “আমার নামায, কোরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ (আমার যথা সর্বস্ব) সেই আল্লাহর জন্য যিনি সারা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক, যার কোনই দোসর নেই এবং এ বাক্যের উপর স্থির থাকার জন্য আমি আদেশ প্রাপ্ত হয়েছি, আর আমি প্রথম অনুগতগণের অন্তর্ভুক্ত।" (সূরা-আন'আমঃ ৪ রুকু)

পাদ্রীঃ অর্থাৎ তুই ইসলাম পরিত্যাগ করে খোদাওন্দ যীশুর অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত হতে অনিচ্ছুক। বেশ, অদ্যই তোর ফয়সালা সমাপ্ত হবে।

ঈসাবেলাঃ যে ফয়সালা করতে হয় কর। নির্ভয়ে কর, প্রাণ ভরে কর। তোমরা কি করতে পারবে? আমাকে এ জগৎ হতে বিদায় করতে পারবে এর বেশীত নয়? কিন্তু তোমাদের জানা নেই যে, সে সত্বার সাথে আমার সম্পর্ক তিনি 'আল্লাহ' তিনি চিরঞ্জীব।

পাদ্রীঃ যখন মৃত্যু সম্মুখে এসে দণ্ডায়মান হবে, তখন তোর অন্তর হতে এ কুরআনের আয়াত আর খোদা সবই উধাও হয়ে যাবে। কুরআন বা মোহাম্মদ যদি তোকে মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা করতে সক্ষম হয়, তবে বুঝবো তোর কুরআনের বাহাদুরী।

ঈসাবেলাঃ এ প্রশ্নই তাদের ধারণা মতে যীশুকে করেছিল যে, “যদি তুমি সত্য হও, তবে ক্রুশ দণ্ড হতে নীচে অবতরণ করে নিজেকে মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা কর,(মথি ২৭ঃ ৪ ০-৪৩)। যেহেতু খৃষ্টীয় মতবাদ অনুযায়ী যীশু নিজেকে মৃত্যুর হাত হতে রক্ষা করতে অক্ষম হয়েছেন, কাজেই হয়ত যীশু (নাউযুবিল্লাহ) মিথ্যাবাদী, আর যদি তিনি কখনও মিথ্যাবাদী না হন, তবে তোমরা ইহুদীদের পদাঙ্ক অনুসারী।

পাদ্রীঃ রে নারীরূপী শয়তান, জাহান্নামী, বদকার, অকর্মণ্যা, অভাগিনী বালিকা। আমাদেরকে ইহুদী বলছিস্? খামোশ, আপন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা কর।

ঈসাবেলাঃ যদি আমাকে আমার অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে তোমরা খামোশ হয়ে যাও এবং আমার সম্বন্ধে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তা করে ফেলো, তবে তাই হবে সর্বোত্তম।

[চলবে]