JustPaste.it

|| আরব্য রজনীর নতুন অধ্যায় ||

|| নির্বাসনের চিরকুট ||

( সূচনা -২ )

 

আল-কায়েদার আবির্ভাব ঘটে আরেকটি সংগঠন থেকে। এই সংগঠনের নাম ছিল ছিল মাকতাব আল-খিদমাত। ১৯৮০র দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আসা আরব যুবকেদের জন্য একটি সার্ভিস ব্যুরো হিসেবে ড. আব্দুল্লাহ ইউসুফ আয্‌যাম একে গড়ে তোলেন। আয্‌যামকে ১৯৮৯ সালে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যুর পর নেতৃত্বে আসেন তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ শিষ্য ওসামা বিন লাদেন। বিন লাদেন এই সংস্থাটিকে রূপান্তরিত করেন আল-কায়েদায়। এ পরিবর্তন ছিল কাঠামোগত। তবে যাওয়াহিরী এবং মিশরীয় ক্যাম্পের আদর্শ এবং সংগ্রামী কৌশলের প্রভাব ছাড়া আল-কায়েদা কখনই আজকের মতো এমন প্রভাব বিস্তার করতে পারতো না। সংগঠন হিসেবে আল-কায়েদাকে আজ বিশ্ব যেভাবে চেনে, যাওয়াহিরীই হলেন তার রূপকার।

 

1 ow_ikCD9oeV4HiqxHn7BLw.jpeg

বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতির চাহিদা পূরণের জন্য ইসলামি বিশ্বাসের প্রয়োজনীয় পুণঃ-সংজ্ঞায়নের মাধ্যমে আল-কায়েদা পশ্চিমা বিরোধী সংগ্রামের আদর্শিক ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করে। তৈরী করে এ আন্দোলনের যৌক্তিক কারণ ও ভাষাসমূহ। আল-কায়েদার মতে, ইসলামী বিশ্বাসের ভিত্তি হল একত্ববাদ বা তাওহিদ, যা দাবী করে, “আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ হচ্ছেন তারা সর্বশেষ রাসূল (বার্তাবাহক)”। আল-কায়েদার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এই একত্ববাদের ধারনাই ব্যাক্তিগত ও সামগ্রিক দুইভাবেই ইসলামিক ঐতিহ্যকে সংজ্ঞায়িত করে।

“আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন উপাস্য নেই” — এ বিশ্বাস কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। বরং আল-কায়েদা মনে করে, সৃষ্টিকর্তার ধারনা কর্তৃত্বের সমার্থক। অর্থাৎ, আল্লাহর একত্ববাদের দাবী হল কর্তৃত্ব কেবল ইসলামেরই হতে হবে। কোন রাজনৈতিক ব্যাবস্থা বা কর্তৃপক্ষ যদি আল্লাহ্‌র ইচ্ছা তথা ইসলামী শরীয়তের দাসত্ব করতে অস্বীকার করে তবে তা কার্যত শিরক বা আল্লাহর সাথে অপরকে বা অন্যকিছুকে শরীক করার শামিল। “আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন উপাস্য নেই” এই সাক্ষ্য যেকোন ধরনের মানব সৃষ্ট ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার প্রতীক।

মুসলিমদের মধ্যে যারা এই বিশ্বাস ধারণ করে তারা স্বভাবতই সেই সকল শাসন ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে যার ভিত্তি হচ্ছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র অথবা অন্য কোন মানবসৃষ্ট মতবাদ। তাদের মতে এ ধরণের সকল ব্যবস্থা আল্লাহর প্রণীত আইনের (ইসলামী শরীয়ত) পরিবর্তে মানবরচিত আইনের ওপর নির্ভর করার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে মানুষকে অংশীদার বানিয়ে ফেলে। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এমন সকল শাসন ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে মুসলিমরা বাধ্য।

এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে যেকোন ধরণের ধর্মনিরপেক্ষ সরকার বা শাসন ব্যবস্থা ধর্মদ্রোহী হিসেবে বিবেচিত হবে, এমনকি যদি সেই রাস্ট্রে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠও হয় তবুও। আর এর ফলে “তাকফীর”– এর ধারণা সামনে আসে। তাকফীর হল একজন মুসলিমের মধ্যে ঈমান ভঙ্গকারী কোন বিষয় পাওয়া যাওয়ার কারণে তাকে ধর্মত্যাগী কাফির ঘোষনা করা। মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাথে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাস্ট্রেগুলোর কৌশলগত মিত্রতাও তাকফীরের আওতাধীন। অর্থাৎ মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফিরের সাথে মিত্রতা হল এমন কিছু যা একজন মুসলিমকে কাফিরে পরিণত করে। এ নীতিই হল আল-কায়দার সামগ্রিক কৌশলের ভিত্তি।

অনেক ক্ষেত্রে এ নীতির সাথে মার্ক্সিস্ট বয়ানের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। মার্ক্স তার দর্শন গঠন করেছেন অর্থনৈতিক শ্রেনী সংগ্রামের ওপর ভিত্তি করে। অন্যদিকে নব্য ইসলামপন্থী দর্শন সমাজকে ভাগ করে বিশ্বাস (আক্বীদা) ও তার অনুশীলনের (আমল) ওপর ভিত্তি করে এবং ইসলামের সংগ্রামকেও দুই শ্রেণীতে ভাগ করেঃ –মুসলিম বিশ্বে এ সংগ্রাম হল মুসলিম ও মুশরিকদের (ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী) মধ্যে, আর বৈশ্বিকভাবে এ সংগ্রাম হল ইসলাম ও পশ্চিমা সভ্যতার মধ্যে। তবে এটি মূলত একটি তাত্ত্বিক পার্থক্য, যা তৈরি করা হয়েছে এ সংগ্রামের নির্যাসকে স্পষ্ট করার জন্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের সমর্থন অর্জন করার লক্ষ্যে। বাস্তবে আল-কায়েদা তার যুদ্ধ কৌশল দ্বারা মুসলিম বিশ্বের এবং পশ্চিমা বিশ্বের মুশরিকদের একই সাথে মোকাবেলা করে।

আল-কায়েদা মূলত একটি আরব সংগঠন। কিন্তু সে তার সংগ্রামের জন্য মিশর অথবা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোন দেশকে বেছে নেয়নি। বরং বৈশ্বিক যুদ্ধের সূচনার জন্য আল-কায়েদা বেছে নিয়েছে দক্ষিণ এশিয়াকে। এমন একটি অঞ্চল যেখানকার ঐতিহ্য, ধর্মের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা আল-কায়েদার আরব সদস্যদের নিজস্ব সমাজের প্রায় পুরোপুরি বিপরীত। অনেকের কাছেই যা বিস্ময়কর লাগতে পারে তা হল, এ অঞ্চলকে বেছে নেয়ার পেছনে প্রধান কারণ হল বিশ্বাস। নবী মুহাম্মাদের (সা) ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী, শেষ জমানার যুদ্ধের প্রাথমিক ময়দান হবে খুরাসান, আর আল-কায়েদা এই ভবিষ্যতবাণী বাস্তবায়নের কথা মাথায় রেখে কাজ করে যাচ্ছে।

আবারো মনে করিয়ে দিচ্ছি, ভৌগলিকভাবে আধুনিক ইরান, মধ্য এশিয়ার দেশগুলো, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের অংশ বিশেষ হাদীসে বর্ণীত খুরাসানের যুদ্ধক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত। আবার হাদিসে বর্ণিত গাযওয়াতুল হিন্দ বা হিন্দুস্তানের যুদ্ধের ময়দানও এই অঞ্চলের ভেতরে কিছুটা পড়ে যায়। আর একারণেই সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে বাংলাদেশের মধ্যে প্রাথমিক যুদ্ধের ময়দানকে স্থাপন করাটা আল-কায়েদার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সরাসরি এ যুদ্ধের ময়দান না হলেও ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কৌশলগত নানা চাহিদা পূরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবার কারণে, বাংলাদেশ এ ছকের ভেতরেই পড়ে।

 

এটা ইসলামি বিশ্বাসেরই একটি অংশ যে নবীর (সা) ভবিষ্যৎবাণী সত্য হবে এবং মুসলিম বাহিনী খুরাসান এবং ভারতের যুদ্ধে বিজয়ের পর মধ্য প্রাচ্যের দিকে অগ্রসর হবে আল-মাহদীর সাথে যোগ দেয়ার জন্য। মাহদীর সাথে যোগ দিয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য এ বাহিনী যুদ্ধ করবে দাজ্জাল ও পশ্চিমা জোটের বিরুদ্ধে।

খুরাসানে সক্রিয়ভাবে আল-কায়েদার আবির্ভাব ঘটে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের সময়। এ সময় আল-কায়েদার উদ্দেশ্য ছিল এমন এক পরিবেশ তৈরি করা যাতে মধ্য এশিয়া থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত পুরো অঞ্চল যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হয়। খুরাসানে আল-কায়েদার কার্যক্রমের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের ইসলামি ইমারাত। এ সময় তালেবান শাসিত ইসলামি ইমারাত ছিল উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, চেচনিয়া এবং চীনের জিনজিয়াং (২য় বিশ্বযুদ্ধের আগে স্বাধীন ইসলামি পূর্ব তুর্কিস্তান) প্রদেশের আঞ্চলিক স্বাধীনতাকামী আন্দোলনগুলোর ঘাঁটি।

এ সবগুলো আন্দোলন ইসলামি হলেও, অনেকটা তালেবানদের মতোই তাদের সবার নিজস্ব পরিকল্পনা, চিন্তা ও মনোযোগ ছিল নিজ নিজ অঞ্চলকে নিয়ে। তাদের চিন্তা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থানীয় সীমান্তগুলোর মধ্যে আবদ্ধ ছিল। অন্যদিকে আল-কায়েদার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত সীমান্ত ও সীমারেখা ছাড়িয়ে এক বৈশ্বিক ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন তৈরি করা।

 

(চলবে ইনশাআল্লাহ)