মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধান কোথায়?
ইবনে বতুতা
==============================================================
(পূর্ব প্রকাশের পর)
ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাস এবং ঐতিহ্য জড়ানো একটি ভূ-খণ্ডের নাম সিরিয়া। সিরিয়াকে বাদে যদি কেউ ইসলামের ইতিহাস রচনা করতে চান তবে তার ইতিহাস অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই সিরিয়ায় পত্তন ঘটেছিল বিখ্যাত উমাইয়া বংশের। মুসলমানরা সর্বপ্রথম যে দুটি পরাশক্তির মুখোমুখি হয়েছিল তার প্রথমটি ছিল রোম সম্রাজ্য। ৬৩৬ খৃষ্টাব্দে সিরিয়ার ইয়ারমুক প্রান্তরে মহাবীর খালিদের নেতৃত্বে মুসলমানরা রোমকদের নাস্তানাবুদ করে এই সিরিয়া দখল করে। ১১৮৭ খৃষ্টাব্দে বিশ্বখ্যাত বিজয়ী বীর সুলতান সালাউদ্দিন এই সিরিয়ার হাত্তিন নামক স্থানে পাশ্চাত্যের ক্রুসেডার বাহিনীকে বিপর্যস্থ করে প্রথমবারের মত ক্রুসেডার বাহিনীর হাত থেকে পবিত্রভূমি জেরুজালেম উদ্ধার করেন। এই সিরিয়ার আইনে জালুতের প্রান্তরে ১২৬০ সালে। বিশ্বাস ও অপরাজিত মোঙ্গল বাহিনীকে মিশরের মামলুক শাসক কুতুজ ও দুর্ধর্ষ বেবারস আল বন্দুকধারী ধ্বংস করে দিয়ে রুদ্ধ করেন মোঙ্গলদের ধ্বংসের তাণ্ডব, রক্ষা করেন ইসলামের পবিত্র স্থানগুলো ও মুসলমানদের অস্তিত্ব।
শুধু পরাজিত করেই বেবারস ক্ষান্ত হননি। বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে নজীরবিহীন ৩০০ মাইল পর্যন্ত মোঙ্গলবাহিনীকে তাড়িয়ে নিয়ে যান তিনি। সিরিয়া কৃষি, খনিজ ও পশু সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ। প্রাক ইসলামী যুগ থেকেই এই দেশটি এশিয়ার একটি সমৃদ্ধ এলাকা শষ্য-ভাণ্ডার বলে পরিগণিত হত। বলতে গেলে এই ভূ-খণ্ডটি যুগ যুগ ধরে মুসলিম সাম্রাজ্যর প্রাণ স্বরূপ ছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, মুসলিম বিশ্বের এই সমৃদ্ধ ভূ-খণ্ডটি এখন আর সত্যিকার মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে নেই এবং এর দ্বারা মুসলিম বিশ্বের অনিষ্ট বৈ কানাকড়ি উপকার হচ্ছে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত সিরিয়া তুর্কী উসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে শাসিত হত। এই বিশ্ব যুদ্ধের সময় মিত্র শক্তি সিরিয়াবাসীদের এই বলে প্ররোচিত করে যে, তারা যদি তুরস্কের বিরুদ্ধে মিত্র শক্তির পক্ষে যুদ্ধ করে তবে যুদ্ধ শেষে তাদের স্বাধীনতা দেয়া হবে। সিরিয়ার ক্ষমতাসীনরা পাশ্চাত্যের এই হীন জাতীয়তাবাদের ফাঁদে পা দেয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তুরস্কের পরাজয় ঘটলেও ফ্রান্স ও বৃটেনের গোপন চুক্তি অনুযায়ী বৃটেন ইরাক, জর্ডান ও ফিলিস্তিন এবং ফ্রান্স সিরিয়া ও লেবানন কুক্ষিগত করে। উল্লেখ্য, '১৯১৮ সালের পূর্ব সময় পর্যন্ত বর্তমান জর্ডান, লেবানন, ফিলিস্তিন ও ইসরাইল সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে এই বৃহত্তর সিরিয়া অর্থনৈতিক ভূমিকা ছাড়াও মুসলিম বিশ্বের ব্যাপক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভূমিকাও পালন করত। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিম ঐক্যকে ধ্বংস করা ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত করার স্বার্থে সিরিয়াকে খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করে ফেলে।
১৯১৯ সালে সিরিয়ায় ফ্রান্সের শাসন ব্যবস্থা কায়েম হলে একের পর এক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। ফরাসীরাও ততোধিক নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে এ আন্দোলন দমন করে। ১৯২৫-২৬ সালে ফরাসীরা বিমান ও গোলন্দাজ আক্রমণ চালিয়ে দামেস্ক শহরকে ধ্বংস্তুপে পরিণত করে। বহু নগরবাসী এ ঘটনায় নিহত হয়। ফরাসীদের এ বর্বরতায় বিশ্ববাসী শিহরিত হয়ে উঠে। মুসলমানরা ব্যাপক দমন, নির্যাতনের মুখেও ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠে। ফরাসীরা তখন অন্য পথ ধরল। তারা বেশী দিন সিরিয়াকে পদানত করে রাখতে পারবে না বুঝতে পেরেই ভবিষ্যতে যাতে সিরিয়া একটি শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে না পারে সেই সেই ষড়যন্ত্র করে। তারা শিয়া, সুন্নী ও খৃষ্টানদের মধ্যে সূক্ষ্ম প্রচারণা চালিয়ে এককে অপরের শত্রুতে পরিণত করে। জাতীয় ঐক্যকে ধ্বংস করার জন্য ধর্মীয় মত পার্থক্যকে বিরোধে পরিণত করে এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে অসম্প্রীতির বুনিয়াদ রাখে।
দেশটির মোট জনসংখ্যার ৮০+% সুন্নী, ৫% নুসাইরী শিয়া, ৮% খৃষ্টান ও বাকীরা দ্রুজ, উলুবী শিয়া। নুসাইরী ও উলুবী শিয়ারা কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী এবং খৃষ্টানদের ধর্ম চর্চার সাথে তাদের ধর্ম চর্চার ব্যাপক মিল ছিল বলে তারা খৃষ্টানদের ভালো বন্ধু ছিল। ক্রুসেড যুদ্ধের সময় এই নুসাইরী, দ্রুজ ও উলুবী সম্প্রদায় খৃষ্টান বাহিনীকে মুসলমানদের বিপক্ষে ব্যাপক সাহায্য করে। এরাই খৃস্টান ক্রুসেডারদের সিরিয়ার সমুদ্র উপকূলে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয় এবং পথ-প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। মানব জাতির কলংক তাতারী বাহিনীও এদের সহযোগিতায় মুসলিম দেশ সমূহে আক্রমণ করার সুযোগ পায়। এ সম্প্রদায়গুলি সকল যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রু পক্ষের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৬৭ সালে আরব ইসরাইল যুদ্ধের সময় যখন গোলান উপত্যকায় সিরিয়ান বাহিনী ইসরাইলী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচণ্ডতম লড়াইয়ে লিপ্ত, ইসরাইলী বাহিনী যখন পরাজয়ের মুখে ঠিক তখনী সীমান্তের দ্রুজ সম্প্রদায় বিশ্বাসঘাতকতা করে ইসরাইলের সমর্থন ঘোষণা করে এবং তাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। ফলে সিরিয়ান বাহিনী পশ্চাদপসারণে বাধ্য হয়।
ফিলিস্তিনীরা মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে সিরিয়ান সীমান্তে আশ্রয় নিলে এই দ্রুজ ও নুসাইরী সম্প্রদায় তাদের ওপর ইহুদীদের চেয়েও মারাত্মক অত্যাচার চালায়। ইসরাইলের ষড়যন্ত্রে ফিলিস্তিনী গেরিলাদের বিরুদ্ধে তারা গেরিলা ও মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে। সুতরাং ফ্রান্স সিরিয়ান সুন্নি মুসলমানদের ভবিষ্যতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র কায়েমকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য এই কট্টর ইসলাম বিদেশী শিয়াদের রাষ্ট্রীয় সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে পূর্ণবাসিত করে। সুন্নিদেরকে সরকারী গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। সেনাবাহিনী, কল কারখানা, প্রশাসন, অফিস-আদালতে 'নুসাইরী’ শিয়ারা প্রাধান্য লাভ করে। ফ্রান্স এত সর্বনাশ করেও ক্ষান্ত হয়নি। প্রাচ্যের শস্যভাণ্ডার’ বলে খ্যাত লেবাননকে সিরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে- যা ছিল দীর্ঘ ৬০০ বছর যাবৎ সিরিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এই লেবাননে ভবিষ্যতে খৃষ্টানদের ক্ষমতায় আসার পথ সুগম লাভের জন্য সেখানেও প্রশাসন ও সেনাবাহিনীকে খৃষ্টানীকরণ করা হয়। দেশটির ভবিষ্যত স্থিতিশিলতা নস্যাৎ করার জন্য এক বিদঘুটে সংবিধানের আওতায় ম্যারেনাইট খৃষ্টান প্রেসিডেন্ট, সুন্নি মুসলমান প্রধান মন্ত্রী, স্পিকার শিয়া, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী- দ্রুজ, সেনাপতি খৃষ্টান এরূপ খিচুরী ব্যবস্থা কায়েম করে। সেনাবাহিনীও বিভিন্ন সম্প্রদায় অনুযায়ী পৃথক পৃথক গঠিত হয়। ফলে, দেশটিতে পঞ্চাশের দশক থেকে ৪০ বছর যাবৎ গৃহযুদ্ধ চলে এবং কমপক্ষে ১০টি সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনী গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের রাজনৈতিক ভাবে ধোকা দেয়ার জন্য ফ্রান্স সিরিয়ার মাইকেল আলাক নামক জনৈক প্রফেসরের দ্বারা ইসলামী মূল্যবোধে ও আদর্শ বিরোধী বাথ পার্টি নামক একটি রাজনৈতিক দলের পত্তন ঘটায়। এই লোক ফ্রান্সে লেখা-পড়া করে। সে সিরিয়ার বিখ্যাত মাদ্রাসায় প্রথমে ইতিহাসের ওপরে ফ্রান্সী ভাষা শিক্ষার শিক্ষক থাকাকালে মাদ্রাসার মেধাবী ও সন্ত্রান্ত পরিবারের সন্তানদের ফ্রান্সে পাঠাত উচ্চ শিক্ষার লোভ দেখিয়ে। এভাবে এই চতুর লোকটি সিরিয়ার ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধর্মহীন করার প্রচেষ্টা চালায়।
উল্লেখ্য, উক্ত মাদ্রাসায় তখন সিরিয়ার উচ্চ পদস্থ ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানেরা লেখাপড়া করত। মাইকেল অফলাক যাদের ফ্রান্সে পাঠাতেন তাদের মাথায় ইসলাম বিদ্বেষী চেতনা ঢুকিয়ে দেয়া হত। ১৯৪৯ সালে হুসনে জয়ীম নামক একজন শিয়া জেনারেল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলে মাইকেল আফলাক শিক্ষা মন্ত্রী নিযুক্ত হয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাথ পার্টির আদর্শ প্রচার করার ব্যবস্থা করে ধর্মীয় শিক্ষাকে ধীরে ধীরে তুলে দিতে সমর্থ হয়। সিরিয়ার কলেজ অফ এডুকেশন এবং টিচার ট্রেনিং সেন্টার তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং ইসলামী জীবনাদর্শের অনুসারী সকল ছাত্রের জন্য এ প্রতিষ্ঠান দুটির পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। নুসাইরী ও দ্রুজ শিয়ারা বাথ পার্টির মূল চালিকা শক্তি হওয়ায় এই দুই সম্প্রদায়ের সন্তানেরাই মূলত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার সুযোগ পায় এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বাথ পার্টির ঘাঁটিতে পরিণত হয়। এসমস্ত ছাত্ররা বাথ পার্টির বিষ ক্রিয়ায় এত অধিক পরিমাণ আক্রান্ত হয় যে, এক সময় তারা আল্লাহর জানাজা পরে তাঁকে বিদায় করে দিয়ে আবু লাহাব ও আবু জাহেলের নামে দুটি প্রমোদ ক্লাব খুলে বসে। সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে শিয়াদের প্রাধান্য থাকায় সেখানেও বার্থ পার্টির সমর্থক গড়ে উঠে। ফ্রান্সের এই ত্রি-মুখী ষড়যন্ত্রের ফলে ও ১৯৬৩ সালে সিরিয়ায় এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বার্থ পার্টি ক্ষমতায় আসে। লেঃ জেনারেল আমিন আল হাফিজ নামক একজন নুসাইরী শিয়া ক্ষমতালাভ করে। ১৯৭০ সালে আরেক অভ্যুথানে বর্তমান নুসাইরী শিয়া শাসক হাফিজ আল আসাদ ক্ষমতা দখল করে। তার আমলেই বার্থ পার্টির অনুসারী শিয়ারা সিরিয়ার ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। অথচ এরা দেশের লোক সংখ্যার মাত্র ৫%।
১৯৪৪ সালে ইসলাম পন্থী জাতীয়তাবাদীদের প্রচণ্ড চাপের মুখে ফ্রান্স সিরিয়ার স্বাধীনতা মেনে নেয়! মূলত ১৯৪৭ সালের ১লা জানুয়ারী ফ্রান্সের সৈন্য অপসারণের পরই সিরিয়া প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৪৫ সালে দেশের প্রধান কয়েকটি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইখওয়ানুল মুসলিমীন’ নাম ধারণ করে একটি সংগঠন কায়েম করে। ইখওয়ান কর্মীরা ১৯৪৫ সালে ফ্রান্সের বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং ১৯৪৫ সালে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু ১৯৪৯ সালে হুসনে জায়ীমের ক্ষমতা দখলের পর ইখওয়ানের ওপর দমন নির্যাতন শুরু হয়। ১৯৬৪ সালে ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ করা হয়। একনায়ক হাফেজ আল আসাদের সময় ইখওয়ানের ওপর দমন নির্যাতন বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ১৯৮২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী আসাদের বাহিনী সুন্নী মুসলমান ও ইখওয়ানের শক্ত ঘাঁটি 'হামা’ অবরোধ করে। গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের গোলা ও আকাশ থেকে বিমান বাহিনী বোমা বর্ষণ করে শহরটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে।
এই আক্রমণে শহরের ৫ লক্ষ লোকের ৩০ হাজার লোক তাৎক্ষণিক নিহত হয়, ৩৮ টি মসজিদ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়। ইসলাম পন্থী রাজনৈতিক দল ও সুন্নী আলেম ও সাধারণ মুসলমানদের ওপর আসাদ সরকারের দমন অভিযান এখনও অব্যাহত আছে। সিরিয়ার ক্ষমতাসীন বাথ পার্টির অর্থনৈতিক দর্শনের সাথে মার্ক্সবাদ, লেনিন বাদের সমাজতন্ত্রের সাথে অধিকাংশ স্থলে মিল রয়েছে। সিরিয়ার বৈদেশিক নীতিও প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ঘেষা। ১৯৮০ সালে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সিরিয়া ২০ বছর মেয়াদী এক মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করে সোভিয়েত বলয়ে নিজের নাম লেখায় আসাদ সরকার। ফিলিস্তিনীদের অধিকার পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে মোটেও আন্তরিক নয় বরং আসাদ সরকার শুরু থেকেই প্যালেস্টাইনী উদ্বাস্তুদের সাথে অমানবিক ব্যবহার করে আসছে।
১৯৬৮ সালে সিরিয়া পি, এল,ওর গেরিলাদের ক্যাম্প বন্ধ করে দেয়। ১৯৭১ সালে সিরিয়া থেকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সব ধরণের গেরিলা আক্রমণ চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। ১৯৭৩ সালে সিরিয়া-ইসরাইল যুদ্ধ বিরতি রেখা অতিক্রম করা পি, এল, ওর জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৪ সালে পি, এল, ওর যোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়। ১৯৮২ সালে ইসরাইলীরা লেবাননে বর্বরোচিত হামলা চালানোর সময় ফিলিস্তিনীদের জন্য আসা রসদ-পত্র, যুদ্ধ-সরঞ্জাম সিরীয় বাহিনী কেড়ে নেয়। ১৯৮৩ সালের ১৫ই নভেম্বর সিরীয় গোলান্দাজ বাহিনী পি, এল, ওর বাদাভী ঘাটিতে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে তা ধ্বংস করে দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে লেবানন থেকে পি, এল,ওর উচ্ছেদে সিরিয়া সরকারের হাত রয়েছে। বাথ পার্টির অনুসারী নুসাইরী শিয়ারা দেশের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর অর্থনীতির চরম দেউলিয়াপনা দেখা দিয়েছে। সমাজতন্ত্রের বদৌলতে দেশে ৫ হাজার কোটিপতি পরিবার সৃষ্টি হয়েছে।
তাদের অধিকাংশই শিয়া এবং দেশের শাসক গোষ্ঠী। কালো বাজারী, পতিতা বৃত্তি, আধুনিকতার নামে অশ্লীলতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। দেশের সর্বত্র অসংখ্য মদ্যশালা ও বেশ্যালয় গড়ে উঠেছে। ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য ইসলাম বিরোধী আইন-কানুন চালু করা হয়েছে। এমনকি মুসলিম মেয়েদের অমুসলিমদের বিয়ে করারও অনুমতি রয়েছে। দেশে ভি, সি, আরের সংখ্যা লক্ষ। সেনাবাহিনীর সদস্যরাই চোরাচালান ও অশ্লীলতা ছড়াতে বেশী ভূমিকা রাখছে।
হাফিজ আল-আসাদ সিরিয়ার ক্ষমতাকে নুসাইরীকরণ করেছে। সেনাবাহিনী, প্রশাসন, কয়েক সরকারের সকল ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নুসাইরী শিয়াদের বসানো হয়েছে। আসাদ তার উত্তরসূরী হিসেবে তার ভাই রিফাত আসাদকে গড়ে তুলেছে এবং তাকেই ভাইস প্রেসিডেন্ট পদদেয়া হয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সকল চাবিকাঠি এখন এই নুসাইরীদের দখলে। সুতরাং একথা পরিস্কার যে, এককালের একটি সমৃদ্ধ মুসলিম ভূখণ্ডের আজকের এই রাজনৈতিক ও সামাজিক দৈন্যের জন্য সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সের যেমনি কালো হাত কাজ করেছে তেমনি দায়ী সিরিয়ার তৎকালীন অদূরদর্শী নেতৃবৃন্দ। যারা সাম্রাজ্যবাদীদের প্রলোভনে জাতীয়তাবাদের বটিকা সেবন করে তুকী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে কামানের নল ঘুরিয়ে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের অত্র এলাকায় প্রবেশ করার পথ করে দিয়েছিলো। যারা নিজেদের ভূ-খণ্ডকে স্বাধীন করার জন্য হাজার বছরের গড়া একটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম সমাজকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়ে নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুঠাল মেরেছিলো।
(অসমাপ্ত)