JustPaste.it

দেশে দেশে ইসলাম

মুসলিম উম্মাহর গর্ব মালয়েশিয়ার শ্লোগানঃ কুরআন ও সুন্নাহ আমাদের একমাত্র আদর্শ ও প্রেরণার আধার

নাসীম আরাফাত

=====================================================================

 

        ডাঃ ইকবালের একটি দার্শনিক তত্ত্ব মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, মুসলিম জাতি মধ্য গগণের প্রতােজ্জ্বল সূর্যের ন্যায়। পৃথিবীর এক প্রান্তে তা অস্তমিত হলে অপর প্রান্তে আপন মহিমায় উদিত হয়। ক্ষণিকের তরে ও তা পৃথিবীর বুক থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় না। হয় না অস্তমিত। কারণ ইসলামই আল্লাহর মনােনীত একমাত্র জীবন বিধান। যার পর আর কোন জীবন বিধান আসবে। আসবে না আল্লাহর কোন মনােনীত ধর্ম। আর মুসলমানরাই হলাে সর্বশ্রেষ্ট ও সর্বশেষ প্রিয়জাতি। তাই কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর এই মনােনীত জীবন বিধান ও তার অনুসারীরা অবশ্যই থাকবে। তবে যে প্রান্তের মানুষ তাকে আকড়ে ধরবে, একে নিজেদের উন্নতির পথ ও পন্থা মনে করবে তারা পৃথিবীতে শীর উচু করে দাড়াবে। অন্যথায় হারিয়ে যাবে ইতিহাসের অতল গহ্বরে।

 

        বিগত ১৪ শত বৎসরের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে এ চির সত্যটিই স্পষ্ট হয়ে উঠে। দেখা গেছে, যখনই পৃথিবীর কোন প্রান্তের মুসলমানরা ইসলামী জীবন বিধান ত্যাগ করেছে তখনই তারা বিজাতির হাতে পরাজিত, লাঞ্ছিত, পদদলিত হয়েছে। ঠিক তখনই অন্য কোন প্রান্তের মুসলমানরা ইসলামকে জীবন বিধান রুপে প্ৰহণ করার কারণে পৃথিবীর বুকে শীর উঁচু করে দাড়িয়েছে। বীরদর্পে দূর্বার গতিতে অমুসলিমের সকল দর্প চূর্ণ করে এগিয়ে গেছে হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে। দেশ, অঞ্চল ও এলাকা ভেদে এ ঘটনারই পূণরাবৃত্তি ঘটেছে বার বার। এভাবেই ইসলাম চির অজেয়, অমর ধর্ম।

 

        স্পেনের মুসলমানরা যখন ইসলামের আদর্শ ত্যাগ করলাে, ভুলে গেলাে আল্লাহর দেয়া জীবন বিধ্যনের কথা, তখন খৃষ্ঠান নৃপতি রডারিক আর ইসাবেলার বাহিনীর সামনে তারা টিকে থাকতে পারলো না। পরাজিত লাঞ্চিত ও নির্মম হত্যাজজ্ঞের শিকার হলাে। নিস্পাপ মুসলিম শিশুর রক্তে খৃষ্টানরা হােলি খেললাে। মা-বােনদের ইজ্জত আব্রু করলাে রক্তাক্ত, ছিন্ন ভিন্ন। প্রাণে বাঁচা মুসলমানরা হলাে রিক্ত হস্ত, ভবঘুরে পথিক ঠিক তখনই ইউরােপের পূর্ব প্রান্তে তুরস্কে মুসলমানেরা ইসলামী জীবন বিধানকে আঁকড়ে ধরার কারণে বিশাল ইসলামী রাষ্ট্রের গােড়া পত্তন করে।

 

        একদিকে গ্রানাডার পতন অপর দিকে সুলতান সুলায়মান কানুনীর আমলে অসম শক্তি সহ উসমানী খিলাফতের উথান সেই একই কারণে এবং গ্রানাডার ইসলাম রবি এসে ওসমানী খিলাফতের মধ্য গগনে আলাে বিকিরণ করতে থাকে।

 

        ঐতিহাসিকদের নিকট বাগদাদ ধ্বংসের প্রেক্ষাপট ও ঠিক এরূপ এক ও অভিন্ন ! ইসলামী জীবন বিধান যখন বাগদাদাসী ত্যাগ করে তখনই বাগদাদের আকাশে বিপদের ঘনঘটা দেখা দেয়। হালাকু খান কতৃক বাগদাদ আক্রান্ত হয়, বর্বর তাতারীরা পরাজিত মুসলমানদের ছিন্ন মস্তকদিয়ে বিজয় স্মৃতি সৌধ নির্মান করে। বাগদাদের মিনার গুলাে ধ্বসে পরে মাটির কোলে ! বন্ধ হয়ে যায় আল্লাহু আকবর ধ্বনি প্রতিধ্বনি। তিলে তিলে হাজার বছরে গড়ে উঠা ইসলাম সভ্যতা উৎকর্ষতার নির্দশনগুলাে বাগদাদের বুক থেকে চির তরে মিটে যায়।

 

        ঠিক তখনই ভারতের মুসলিম শাসকরা ইসলামকে জীবন বিধান রুপে গ্রহণ করার কারণে অসম শক্তি ও সাহসে ইসলামী সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ন্যায় নীতি ও সম্প্রীতিতে ভারতবর্ষ তখন এক স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হয়।

 

        উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে শুরু হয় প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ। মুসলিম জাহান আক্রান্ত হয় ইউরােপিয়ানদের নখর থাবায়। পরাজিত উসমান খিলাফত-শাসিত অঞ্চল সমূহকে লুষ্ঠিত সম্পদের ন্যায় ভাগ বাটোয়ারা করে নেয় ইউরােপিয়ানরা। ছিনিয়ে নেয় আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলাে। সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও ইরাককে ভাগা ভাগি করে নেয়।

 

        আরাে কিছু কাল পরের কথা। মুসলিম জাহানে তখন ঘাের দুর্দিন। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের হিংস্র থাবায় মুসলিম জাহান তখন দিশেহারা। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ষাড়শী আক্রমণে পরাজিত মুসলমানদের প্রাণ উষ্ঠাগত। ইঙ্গ-মার্কিন মদদ পুষ্ট ইহুদীরা নির্মম ভাবে ফিলিস্তিনের নিরীহ জনগণকে হত্যা করছিলাে। ভারত বর্ষে চলছিলাে ইংরেজদের নির্যাতনের ষ্টীম রোলার !

 

        ঠিক এমনই মুহর্তে গভীর অন্ধকারের বুক চিড়ে নব জাগরণের ডংকা বেজে উঠে ইসলামী জাহানের প্রান্তে প্রান্তে। স্বাধীনতা সংগ্রামের জিহাদী জযবায় জীবন মৃত্যু বাজি রেখে মুসলিম বীর সেনানীরা জেগে উঠে দেশে দেশে । আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল থেকে চীন সাগরের উপকুল পর্যন্ত গােটা মুসলিম জাহান প্রচন্ড গণ-বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে উঠে।যালিমদের অন্তরাত্মা থর থর করে কেঁপে উঠে। গুটাতে শুরু করে তাদের আখেরী তল্পিতল্পা। একে একে মুসলিম দেশ গুলাে স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে। তখন ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পৃথিবীর বুকে দু'টি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া । আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি যখন অত্যন্ত ঘােলাটে, কুয়াশাচ্ছন্ন। জাতিসংঘ নামক শয়তানী আড্ডা খানার ছত্রছায়ায় কুফুরী শক্তি বসনিয়া। হার্জে গােভিনায় চালাচ্ছে শতাব্দির ন্যক্কার জনক পৈশাচিক অত্যাচার আর হত্যা কান্ড। কাশীরের আকাশ বাতাস কাঁদছে নির্যাতিতা নারীর আর্ত চিৎকারে। মায়ানমার, মিন্দানাও ও আলজেরিয়া সহ বিভিন্ন মুসলিম বসতি শয়তানের দোসরদের পৈশাচিক অট্টহাসিতে মুখর। প্রকম্পিত। মুসলিম জনতা নির্যাতিত। ঠিক তখনই ইসলামী বিশুদ্ধ চিন্তা চেতনা নিয়ে শীর উচু করে দাড়িয়েছে আফগানের সেই চির অপরাজেয় জাতি। যারা কখনাে মাথা নত করেনি কোন বাতিলের সামনে। যারা চির দূর্ধর্ষ শার্দুল জাতি। জেগেছে দক্ষিন চীন সাগর উপকূলে অবস্থিত এশিয়ার টাইগার মালেশিয়ার মুসলিম বীর সন্তানেরা। তাই বাতিল আর কুফরী শক্তির রক্তচক্ষু আজ রক্তশূন্য। ফ্যাকাশে আর কুৎসিত তার চেহারা ।

 

        মালেশিয়া পূর্ব এশিয়ার একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট। রাজধানী কুয়ালালামপুর। আয়তন ১,২৮৭০৩ বর্গমাইল। লােক সংখ্যা ১৫২,৬৪০০। পূর্ব ও পশ্চিম মালেশিয়ার মাঝে বয়ে গেছে তরঙ্গায়িত দক্ষিন চীন সাগর। সাগরের উভয় পার্শ্বে ঘন সবুজের টিপ পড়া দেশ। মালেশিয়া উপকূল ঘেষে তাল, নারিকেল আর রাবারের বাগান চলে গেছে মাইলের পর মাইল। পনেরটি অঙ্গরাজ্যের দেশ মালেশিয়ার ভূপৃষ্টের ন্যায় ভুগর্ভও অঢেল সম্পদে সমৃদ্ধ। স্থানে স্থানে রয়েছে টিন, লােহা, তামা, বক্সাইট, পেট্টোল, এন এন জির অফুরন্ত খনিজ ভান্ডার। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ উপকুলীয় ও সামদ্রিক মৎস সম্পদও বিরাট আয়ের উৎস। রাবার সহ পাম ওয়েল, তালেরশাষ, নারিকেলের শাষ, নারিকেল তেল, মরিচ ইত্যাদি অর্থকরী সামগ্রী কোটি কোটি টন উৎপন্ন হয় এই দেশটিতে।

 

        শিল্প সামগ্রী উৎপাদনেও মালেশিয়া বহুদুর অগ্রসর হয়েছে । ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি, আসবার পত্র, মেশিনারী কেমিকেল দ্রব্য, বস্ত্র, স্থানীয় কাঁচামাল প্রসেসিং সহ বহু শিল্প সামগ্রী উৎপাদিত হচ্ছে। প্রােটন সাগা মােটর গাড়ী এখন মালেশিয়ার সমৃদ্ধির প্রতীক। এ কোম্পানী প্রতিদিন পাঁচশত নূতন ঝকঝকে গাড়ী তৈরী করছে বিরামহীন গতিতে।

 

মালেশিয়ার ইসলাম পূর্ব ইতিহাস

        নীল নদের তীরে মিশরীয় সভ্যতা, টাইগ্রীস-ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকায় মােসােপটেমিয়ার সভ্যতা, সিন্ধু নদের তীরে সিন্ধু সভ্যতা এব্ং হােয়াংহাে ও সিয়াংকো নদীর তীরে চৈনিক সভ্যতার ন্যায় মালেশিয় সভ্যতাও অতি প্রাচীন। সারাওযাক অঙ্গ রাজ্যের নিয়াহ গুহায় মালেশিয় সভ্যতার বহু প্রাচীন নিদর্শন রয়েছে।

 

        ইসলাম আগমণের পূর্বে মালেশিয়ার বৌদ্ধ রাজত্ব লাংকাসকা ও পরে শ্রী বিজয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিলাে। ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে শ্রী বিজয়ার রাজ্য খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠে ছিলাে। চর্তুদশ শতাব্দীতে যাভার হিন্দু রাজা মাজাপাহিতও মালেশিয়ায়। প্রভাব বিস্তার করেছিলে।

 

মালেশিয়ায় ইসলামের আগমন

        ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে আরব বনিকদের মাধ্যমে মালেশিয়ায় ইসলামের আগমন ঘটে। আরব বনিকদের সুমধুর ব্যবহার, আচার-আচরণ, ধার্মীকতা ও নিস্কম্প বিশ্বাসে মুগ্ধ হয়ে মালেশিয়ার স্থানীয় লােকেরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মুসলমান হতে থাকে। ধীরে ধীরে স্থানীয় মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে চলে। মালেশিয়ার বুকে ইসলাম আপন মহিমায় স্থান করে নেয়। ঘটনাক্রমে সিংগাপুরের রাজা পরমেশ্বর (১৩৯৬-১৪১৫) প্রথমে রাজা মাজাহিত তারপর থাই সেনা বাহিনী কতৃক বিতাড়িত হয়ে মালাক্কায়, পালিয়ে আসে। তিনি মালাক্কার মুসলমানদের আদর্শ ও ব্যবহার মাধুর্যে দারুন মুগ্ধ হন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ইস্কান্দার শাহ নাম ধারণ করেন। এর পর তিনি এক নূতন রাজবংশের সূচনা করেন। ইস্কানদার শাহেব উত্তর পূরুষরা, ইসলামী জীবন বিধানুসারেই রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন।

 

        এদিকে ইউরােপের শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরােপিয়ান বনিকরা বিশ্বের আনাচে কানাচে ব্যবসা ও বানিজ্যের নামে ছড়িয়ে পড়ে। তারা ব্যবসা-বানিজ্যের আড়ালে প্রভূত শক্তিশালী হয়ে ক্ষমতা ও ছিনিয়ে নিতে থাকে একের পর এক দেশের। ঠিক এই ঘটনাই ঘটে মালেশিয়ায়ও। ১৫১১ খৃষ্টাব্দে পর্তুগীজ বনিকরা বিশাল অস্ত্রের বহর সহ প্রভূত শক্তি নিয়ে মালেশিয়ার রাজ ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়।

 

        অপরদিকে ওলন্দাজ বনিকরা মালেশিয়ার সীমাহীন ধন সম্পদের লােভ সংবরণ করতে না পেরে পূর্তগীজদের উপর আক্রমণ করে মালাক্কা ছিনিয়ে নেয়। তারপর ১৮২৬ খৃষ্টাব্দে আসে বৃটিশরা। এরা ওলান্দাজদের পরাভূত করে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। দীর্ঘ এ পারাধীনতার সময়ে মালেশিয়া মুসলমানরা নিরব থাকেনি। থাকেনি নিস্পৃহ নির্জীব, তারা ঢেলেছে অজস্র রক্ত। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। অবশেষে ১৯৫৭ সালের ৩১ শে আগষ্ট মালেশিয়ার আকাশে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য উদিত হয়, গােলামীর জিন্দেগীর হয় চির অবসান ।

 

        স্বাধীনতা লাভের পর থেকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশটি পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৯৫৫ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে 'বারিসান ন্যাশনাল' নামে যে রাজনৈতিক মাের্চা গঠন করা হয় সে মাের্চা আজো ক্ষমতাসীন। প্রতি পাঁচ বৎসর পর পর নুতন নির্বাচনের মাধ্যমে এ মাের্চা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। দেশ প্রেমিক এই দলটিকে সচেতন জনগণও প্রত্যেক বার স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে ভােট দিয়ে থাকে।

 

ধর্মীয় ভাবমূর্তি

        মালেশিয়ায় ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ সকলে একথা বিশ্বাস করে যে, ইসলামই মুসলমানদের ইহ ও পরকালে চির উন্নতি ও মুক্তির একমাত্র পথ। যে দিন তারা ইসলাম ত্যাগ করবে সেদিন থেকেই তাদের উপর নেমে আসবে লাঞ্ছনা, অবমাননা আর দাসত্বের নির্মম শৃঙখল। তাই ধর্মীয় অনুভূতি মালেশিয়ার সর্বত্র বিরাজমান।

 

        রাষ্ট্রীয় সংবিধানের তৃতীয় ধারায় ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে এবং মুসলমানদের নিকট অমুসলিমদের ধর্মের প্রচারকে চরম দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে বলা হয়েছে। সংবিধানের তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছেঃ

        Islam is the oppicial Religion of the Education, the other religon may be practiced in peace and harmony...... and state law may control or restrict non-Muslim from propagating their religion to Muslim.

 

        ধর্মমন্ত্রণালয় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আওতায়, ধর্মের জ্ঞান অর্জন এবং বিভিন্ন ভাবে অনুধাবন করানাের জন্য কোটি কোটি ডলার বাজেট করা হচ্ছে। সরকারী অফিস আদালতগুলােয় ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ধর্মীয় ক্ষেত্রে আরও উৎসাহিত করার জন্য প্রতি বছর হিজরী সালের মহররমের প্রথম দিকে একজনকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেয়া হয়। Towards understanding Islam নামে নতুন একটা গবেষণা পরিষদ করা হয়েছে। সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অপরাপর বিষয়ের সাথে ধর্মীয় প্রশ্নও যােগ করা হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে ইসলামী কলেজ আছে এবং এইসব কলেজ Compatative production TCU BICI সবচেয়ে এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে আন্তর্জঅতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৮৩ সালে মাত্র আইন ও অর্থনীতি এ দুটি বিষয় চালু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ারিংসহ প্রায় ২০টি বিষয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানীর একবারে প্রায় মধ্যমনিতে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে থেকে এ প্রতিষ্ঠানটি অনেক পূর্বেই ঐদেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদায় অতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এখানে প্রায় দ্বিগুণ বেশী পড়াশুনা করতে হয়। তারপরও বিশ্বের প্রায় ৫০/৬০টি দেশের ছাত্র/ছাত্রীসহ দেশীয় শ্রেষ্ঠ মেধাবী ছাত্ররা এখানে আসছে। স্থানীয় যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এর ব্যয়ভার অনেক বেশী। মালয়েশিয়ান সরকার ব্যয়ের প্রায় ৯৫% যােগান দিচ্ছে। এটিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে ব্যাপক পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সাড়ে ছয়শত একর জায়গার উপর প্রায় ৭শ মিলিয়ন রিংগীট। (১x১৬) ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে শহরতলীতে স্থায়ী ক্যাম্পাস, যাতে ৪০ হাজার লােকের একোমােডেশন হবে। সরকারী ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে বিশাল বিশাল মসজিদ। সালেরগর প্রদেশের রাজধানী শাহ আলমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৩৫০ মিলিয়ন রিংগীট ব্যয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ মিনারল যুক্ত মসজিদ । ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ইলুরেন্স সরকারী উদ্যোগে থাকায় আদায় ও বন্টন ব্যবস্থা আর একটা সরকারী সাফল্য।

 

        প্রতিবছর প্রায় দেড় মিলিয়ন রিংগীট জাকাত আদায় হয় এবং তা গরীবদের মাঝে বিতরণ করা হয়। মালয়েশিয়ার দরিদ্রতা দূরীকরণে জাকাতের ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ৩০ বছর মেয়াদী পরিকল্পনার মধ্যে এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যে, ঐ সময়ের মধ্যে দেশের প্রতিটি মুসলিম নাগরিক বৈষয়িক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি এ পরিমাণ ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করতে পারে যেন যে কোন ব্যক্তিকে উপস্থিত ক্ষেত্রে দাঁড় করায়ে দিলে তিনি জুমার নামাজের খতিবের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। উল্লেখ্য, মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা এবং অমুসলিমদের জন্য নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। তবে ইতিমধ্যে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সমিতি থেকে অমুসলিমদের জন্য ও ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবী জানানাে হয়েছে। ইদানীং সরকার দারুল আরকাম নামে একটি ধর্মীয় সংগঠনের ব্যাপারে কথা বলছেন এবং একে বেআইনী ঘােষণা করেছেন-তা সরকারী ভাষায়ঃ এরা ধর্মের অনুসরণ করছে না বলেই আলেমদের ফতুয়া (Legal ruling) অনুসারে ধর্মের সঠিকত্বকে বজায় রাখার জন্যই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মালয়েশিয়ান ইসলাসীক দল নামের একটি দল ইতিমধ্যেই একটি প্রদেশে absolute majority নিয়ে (সরকারী দল ওখানে ১টা আসনও পায়নি) জাতীয় নির্বাচনে কেবিনেট ফরম করেছে। মদ-জুয়া, পতিতালয়সহ যাবতীয় করেছে। ইতিমধ্যেই ইমলামী ফৌজদারী আইন (La of Hudud) প্রয়ােগের ব্যবস্থা পাকাপােক্ত করা হয়েছে।

 

ইসলামী আইনের বাস্তবায়ন

        সারাদেশে সিভিল ও ফৌজদারী আদালতের পাশাপাশি সম্পূর্ণ পৃথকভাবে শরীয়া আদালত কার্যকরী রয়েছে। ইতিমধ্যে শরীয়া আদালত হাই কোর্টের সমান মর্যাদা লাভ করেছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক (Personal Law) বিষয়ক মামলা এতে দায়ের করা হয়। মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে যে কেউ এই আলদাতের দারস্থ হতে পারে। শরীয়া আদালতের বিচারকগণ কাজী, প্রধান কাজী, মুফতী নামে পরিচিত। কাজীদের প্রশিক্ষণে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন প্রকারের ডিপ্লোমা কোর্সের ব্যবস্থা করেছে। সেদিন হয়তাে দূরে নয় যেদিন সব আদালতই শরীয়া আদালতের (Mahkama Shariah) নিয়ন্ত্ৰাধীনে এসে যাবে।

 

        মালেশিয়ায় কোন মুসলমান মন্ত্রীকে ও কোন লেখক, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীকে ইসলাম বিরােধী ভুমিকায় বা ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রবক্তা বলে সনাক্ত করা মুশকিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডঃ মাহাথীরের তুলনায় উপ-প্রধানমন্ত্রী দাতুক শেরে আনােয়ার ইব্রাহীমকে আরও বেশী ইসলামী মনে করা হয়। ক্ষমতাসীন পার্টি কোন প্রকার বিপর্যয়ে না পড়লে জনাব আনােয়ারই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ১০০ ভাগ সম্ভাবনা রয়েছে। তার সময়ে দেশে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া আরও এগিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। তিনি এক সময় 'আবিম’ নামক একটি প্রভাবশালী ইসলামী যুব আন্দোলনের আলােড়ন সৃষ্টিকারী সভাপতি ছিলেন।

 

        মালয়েশিয়ার উন্নয়নের আর একটি অন্যতম কারণ হলাে সেদেশের লােক পরিশ্রমী, কর্মঠ, সময়ানুবর্তি। সাড়ে সাতটায় সূর্য উঠার সময় অথচ ‘অফিস আওয়ার’ ৮ টায় । ভাের পাঁচটা থেকে রাস্তায় যানবাহন চলাচল শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রী বহনকারী গাড়ী, বাস ইত্যাদি।

 

ইসলামী চিন্তাবিদ ও মনীষী তৈরী মহাপরিকল্পনা

        এখানে কোন ছাত্র রাজনীতি নেই। তবে বিভিন্ন দলের সমর্থনে ছাত্র আছে। ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয় দলীয়ভাবে নয় একক সদস্য হিসেবে। এর নির্দিষ্ট নির্বাচিত সদস্যগণ তাদের মধ্যে থেকে কর্মপরিষদ তৈরী করে নেয়। বর্তমানে প্রায়গুলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ ইসলামী ছাত্র গ্রুপের ছায়ায় নিয়ন্ত্রিত। ছাত্রদের কাজ লেখা-পড়া। কোন ছাত্রকে রাজনীতি বিষয়ে আলােচনা করতে খুব একটা দেখা যায় না! ক্যাম্পাসে কোনপ্রকার সভা-সমাবেশ প্রচেশন শ্লোগান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। লেখা-পড়ার চাপে ছাত্রসংসদের নির্বাচনের সময় কোন কোন ক্ষেত্রে প্রার্থী যােগাড় করাও সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। ছাত্ররাই জাতির বিবেক, স্বৈরাচারের জম-এ জাতীয় উক্তি এখানকার লােকের অজানা।

 

        ২০২০ সাল নাগাদ দেশটি ডেভেলপ নেশন হওয়ার লক্ষ্যে ৩০ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ। করেছে। ঐ লক্ষ্যে পৌছতে হলে কতজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, আইনবিদ, বিচারক, ইমাম ও আলেম দরকার, কতটি মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় দরকার তা নির্ণয় করা হয়েছে। কতটি কলকারখানা তৈরী হবে, কতজন শ্রমিক লাগবে সবই পরিকল্পনার অর্ন্তভূক্ত। ইতিমধ্যেই দেশময় খােড়াখুড়ি পুরােদমে চলছে, ৪২২ ফুট উঁচু কুয়ালালামপুর টাওয়ার প্রায় সমাপ্তির পথে। ৯৫ তলা বিশিষ্ট বিশাল বিশাল ও সুউচ্চ ইমারতের ভূগর্বের ৫ তলার কাজ শেষ হয়ে পৃথিবীর আলােতে উঠে আসছে।

 

শিক্ষা ব্যবস্থা

        শিক্ষিতের হার ৯০ শতাংশের কাছাকাছি, শিক্ষার মান বেশ উন্নত। জাতীয় বাজেটের বিরাট অংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় হয় শিশু শ্রেণী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীর জন্য। ইসলামী শিক্ষা বাধ্যতামূলক। কারণ মালেশিয়ার বিদগ্ধ মনীষী ও দূরদর্শী জাতীয় নেতৃবন্দ জানে যে, ইসলামী শিক্ষার অবর্তমানই মুসলিম জাহানের অধপতনের মূল কারণ। তাই কোরআন ও সুন্নাহ হবে আজ অধপতিত মুসলিম জাহানের একমাত্র আদর্শ ও প্রেরণার উৎস।

 

        মুসলিম বিশ্ব সহ গােটা বিশ্বের নেতৃত্বের জন্যে যেমন দরকার অর্থ ও শক্তির, তেমনী বরং তার চেয়ে বেশী দরকার ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত আদর্শবান সােনার মানুষ ও বীর শার্দূলদের। তাই এ দুই আভিষ্ঠ ও ইস্পিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য মালেশিয়ার সরকার আজ দৃড় প্রতিজ্ঞ, অত্যন্ত কঠোর ও অনমনীয়। তীব্র গতিতে মালেশিয়া এগিয়ে যাচ্ছে এ মহান অভিষ্ঠ লক্ষ্য পানে।

 

        মুসলিম মালেশিয়ার এ অসম শক্তির উত্থানে আজকের অসহায় বিশ্ব মুসলিমের জন্য রয়েছে শিক্ষার আলােক মিনার। যদি মুসলিম জাহানের নেতৃবৃন্দের শুভ বুদ্ধির উদয় হয় এবং মালেশিয়ার মত ইসলামকেই ইহ ও পরলােকের কামিয়াবী ও সফলতার হাতিয়ার মনে করে এবং সমস্ত তন্ত্র মন্ত্র ফেলে ইসলামকেই আঁকড়ে ধরে, তবে পলকে ইসলামী বিশ্বের রুপ পাল্টে যাবে। রাশিয়া আমেরিকা বা অন্য কোন সুপার পাওয়ারের সামনে নত হয়ে থাকতে হবে না। জাতিসংঘ নামক শয়তানী আড্ডা খানারও পরােয়া করতে হবে না। ফিরে তাকাতে হবে না কোন কুফরী শক্তির রক্ত চক্ষু পানে ।

 

        বরং ধূলির ধরায় আবার ফিরে আসবে স্বর্ণ যুগের স্বর্গীয় শান্তিধারা। সারা দুনিয়া হবে মুসলমানদের সামনে নতজানু, কৃপাপ্রার্থী। অমুসলিম শক্তি থাকবে মুসলিম শক্তির সামনে কম্পমনি !

 

        কিন্তু সেই শুভবুদ্ধির কি উদয় হবে? হতে পারবে কি আজকের মালেশিয়ার মত নির্ভিক, অকপট ও স্পষ্টভাষী। সেদিন কি আবার ফিরে আসবে, হয়ত আসবে। নিশ্চয় আসবে। তাই বুক ভরা আশা নিয়ে কবি নজরুলের কণ্ঠে কণ্ঠমিলিয়ে বলে যাইঃ

        জাগি যদি মােরা দুনিয়া আবার,

        কাঁপিবে চরণে টালমাটাল।

 

তথ্যসূত্রঃ

        (১) রাওয়ায়ে ইকবাল, সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী !

        (২) মুসলিম জাহান, সােহরাব উদ্দীন আহমদ।

        (৩) মালেশিয়ার ধর্মীয় চেতনার জন্যই এই অবস্থান, এ বি এম মাহবুবুল ইসলাম, ইনকেলাব, বৃহস্পতিবার ১৭ ভাদ্র ১৪০১।

        (৪) মুসলিম দুনিয়া, ইদারায়ে মা'রেফে ইসলাম, লাহাের।

 

═──────────────═