JustPaste.it

সত্যের সন্ধানে

ইসাবেলা
মূলঃ মাওলানা আব্দুল হালীম শরর লখনভী
অনুবাদঃ মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক
===========================================

 

(পূর্ব প্রকাশের পর)
       ইসাবেলার এই কথায় উপস্থিত খৃস্টানগণের উপর যেন বজ্রাঘাত পতিত হল। সকলে একে অন্যের মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে লাগল। কিছুক্ষণ হতভম্ব অবস্থায় থাকার পর অধ্যাপক মীখাইল দন্ডায়মান হলেন এবং সভাকে উদ্দেশ্য করে বক্তৃতা শুরু করলেনঃ
     ভাইসব! আমরা এখানে নিজ নিজ ঈমান যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছি। আর নিঃসন্দেহে এতা একটি পবিত্র কাজ। কিন্তু এ কাজে সাফল্য লাভের জন্য প্রয়োজন সত্যকে গ্রহণ করার আগ্রহ এবং নিষ্ঠা পরিপূর্ণ হৃদয়। ঈমান এমনই একটি বিষয় শুধু যা খোদাওয়ান্দের কৃপাদৃষ্টি ব্যতীত মানুষ শুধু তাঁর নিজ চেষ্টায় অর্জন করতে পারে না। অতএব আসুন, আপনারা এবং আমরা সকলে মিলে খোদাওন্দের দরবারে মিনতি সহকারে প্রার্থনা করি, তিনি তাঁর পবিত্র আত্মার সহায়তায় আমাদের উপর আজকের আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধে প্রকৃত তত্ব উদঘটিত করে দিন এবং খৃষ্ট ধর্মের গুপ্তভেদ আমাদের বুঝিয়ে দিন। (সমবেত খৃষ্টানদের তরফ থেকে উচ্চঃস্বরে আওয়াজ উত্থিত হল, আমীন!) মহোদয়গণ! শরয়ীত অভিশাপ কিনা তা একটি বেহুদা প্রশ্ন। আসল কথা হলো, খৃষ্টধর্মের মূলতত্ত্ব ও মূল বিশ্বাসের জ্ঞান আমাদের মুসলিম ভাইগণের নেই। কাজেই তারা অমূলক প্রশ্ন করে থাকেন। আমাদের ধর্মের সারাংশ শুধু দুইটি কথার দ্বারাই প্রকাশ হয়। খোদাওন্দ যীশুর খোদায়ীত্ব ও প্রায়শ্চিত্ত। এই দুইটি কথা যে ব্যক্তি বুঝতে সক্ষম হয়েছে, গোটা খৃষ্ট ধর্মের সম্পূর্ণ গুপ্তভেদই সে বুঝতে সক্ষম হয়েছে। পিতাজী খোদাওন্দের এটা কতবড় অনুগ্রহ যে, তিনি আমাদের মুক্তির উদ্দেশ্যে তাঁর একমাত্র পুত্র যীশুকে প্রেরণ করেছেন, যিনি জগতে আগমন করে কেবল আমাদেরই জন্য কত যাতনা সহ্য করেছেন। এমনকি ক্রুশ মৃত্যু বরণ করে আমাদের পাপসমূহের প্রাশ্চিত্ত করে গেছেন। কাজেই আমি আমার বন্ধু ওমর লাহমী এবং তার সঙ্গীদের পাপসমূহের প্রায়শ্চিত্ত করে গেছেন, কাজেই আমি আমার বন্ধু ওমর লাহমী এবং তাঁর সঙ্গীদের নিকট এই দরখাস্তই করব যে, আপনারা শরীয়ত এবং অভিশাপের নিরর্থক আলোচনা পরিত্যাগ করে খোদাওন্দ যীশুর পবিত্র অস্তিত্ব এবং এর অভুতপূর্ব প্রায়শ্চিত্তের গভীরে চিন্তা করুন এবং খৃষ্টধর্মের উপর ঈমান স্থাপন করুন।
     ওমরঃ আমরা এখানে খোশ-আলাপের উদ্দেশ্য আগমন করিনি। আমরা একটি নীতিমালার অধীনে নিয়মতান্ত্রিক আলোচনা করতে ইচ্ছুক। আমরা আমাদের আলোচ্য বিষয় চিঠির মাধ্যমে পূর্বেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, যার সাক্ষ্য আমাদের বোন ইসাবেলা স্বয়ং। এখন আপনারা চাচ্ছেন যে, আমি নির্দিষ্ট আলোচ্য বিষয় পরিত্যাগ করে যীশুর খোদায়িত্ব ও প্রায়শ্চিত্ত সম্পর্কে আলোচনা করি। বেশ, আমি এর জন্যও প্রস্তুত আছি, তবে এই শর্তের উপর যে, আপনাকে লিখে দিতে হবে, “শরীয়তের আলোচনা পরিত্যাগ করে শুধু যীশুর খোদায়িত্ব ও প্রায়শ্চিত্ত সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।”
     পিটার্সঃ আমার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, এইসব প্রশ্ন সম্পর্কে আপনি আলোচনা না করুন; বরং আমার বলার উদ্দেশ্য হল, অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন পরিত্যাগ পুর্বক মৌলিক বিষয়ের উপর চিন্তা করুন।
     ওমরঃ তা হলে আপনারা আমাদেরকে এখানে কেন ডেকেছেন? চিন্তা করার জন্য তো গীর্জা অথবা মসজিদের কোন প্রয়োজন নেই। যদি আপনারা আলোচনা করতে অসম্মত হন, তবে পরিষ্কারভাবে তা জ্ঞাপন করুন, যেন সময়ের অপব্যয় থেকে আমরা রক্ষা পাই।
      মীখাইলঃ মহামান্য পিটার্সের কথায় আপনার অন্তরে একটি ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর উদ্দেশ্য এটা নয় যে, এই সম্পর্কীয় আলোচনা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া হোক, বরং উদ্দেশ্য হল, আপনি মৌলিক বিষয়ের উপর চিন্তা করে প্রশ্ন করতে পারেন। যা হোক, এখন বেলা দ্বিপ্রহর হয়ে গিয়েছে আপনাদের আহার করতে হবে। অতএব বলুন, পুনরায় কোনদিন আপনাদের শুভাগমণ হবে?
     ওমরঃ এখনই ত সর্বোত্তম সময়। কে বলএ পারে ভবিষ্যতে এমন শুভযোগ আর ঘটবে কিনা?
     মিখাইলঃ আপনাদের ত নামাযও পড়তে হবে?
     ওমরঃ নামায আমরা এই গীর্জায়ই পড়ে নিব। ইসলামে নামযের জন্য মসজিদ হওয়া শর্ত নয়।
    পিটার্সঃ আমার মতে আগামী রবিবার পুনরায় সভা অনুষ্ঠিত হোক।
    ওমরঃ কিন্তু আমার অভিমত হলো, আলোচনা মুলতবী করা না হোক। হয়ত খোদা আমাদের সবাইকে সত্য সরল পথে পরিচালিত করবেন।
 মীখাইলঃ আচ্ছা, তবে অদ্যকার ন্যায় আগামী কল্যও আলোচনা হোক এবং দ্বিপ্রহরের মধ্যেই সমাপ্ত করা হোক।
      ইসাবেলাঃ  যদি আগামী কল্যই পুনরায় আলচনা করতে হয়-তবে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত নয় বরং সন্ধ্যা পর্যন্ত তা চলতে দেয়া হোক, যেন একটি সুফল লাভে আমরা সমর্থ হই।
     মীখাইলঃ কখনই নয়, আমাদের কি অন্য কোন কাজ নাই?
     ইসাবেলাঃ আমার ধারণায় এই কাজের চেয়ে বেশী জরুরী অন্য কোন কাজ হতে পারে না।
      মোট কথা, পরদিন সোমবার সকাল হতে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত পুনরায় আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়া সাব্যস্ত হল। প্রথম অধিবেশন এই পর্যন্তই সমাপ্ত হল। ওমর লাহমী সমবেত খৃষ্টানগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে সঙ্গিগণসহ গৃহ রওয়ানা হলেন। পাদ্রীগণ এবং ইসাবেলা গীর্জার অভ্যন্তরেই উপবিষ্ট রইলেন।
     জনৈক পাদ্রীঃ বড়ই আফসোস যে, আপনারা এই বিধর্মীদের অভিযোগ করার সুযোগ দিয়েছেন এবং আমাদের পবিত্র ধর্মকে বিদ্রুপের বস্তুতে পরিগণিত করেছেন। এই বিধর্মীদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা শুধু তাদের সম্মুখে কোরআন খুলে ধরা। মহামান্য পিটার্স তো প্রথমে এই ব্যবস্থাই অবলম্বন করেছিলেন, কিন্তু আফসোস যে, এরা চালাকীর সাহায্যে আত্মরক্ষা করল বং শরীয়তের আলোচনা আকড়িয়ে রইল। আগামী দিনের আলোচনাও যদি অদ্যকার নিয়মে চলতে থাকে তবে আমাদের অত্যন্ত অসুবিধা ভোগ করতে হবে। কারণ তারা যে সকল বিষয়ে অবগত হতে চায়, তা খোদাওন্দের নিরেট গুপ্ত ভেদ সম্বন্ধীয় ব্যাপার, যা কেবল পাদ্রীগণই তপস্যাবলে উপলব্ধি করতে সক্ষম, অপর কেউ নয়।
      মীখাইলঃ আসলে আমাদের আলচনার সূচনাই গলদ হয়েছে। নতুবা কেবল কুরআন দ্বারাই ওদের জব্দ করা সম্ভব হত। কোরআনে কিন্তু খোদাওন্দ যীশুকে সৃষ্ট এবং জীবিতকারী উল্লেখ করা হয় নি? ঐ কুরআনেই কি তাঁকে রূহুল্লাহ বলা হয় নি?
      পিটার্সঃ কিন্তু আগামী দিনের আলোচ্য বিষয়ও তো নির্ধারিত হয়েছে যে, কেবল যীশুর খোদায়িত্ব ও প্রায়শ্চিত্ত সম্বন্ধে আলোচনা হবে। দেখ, আমি ই কুরআনের রাস্তায়ই তাদেরকে অতি সহজ ও সুন্দরভাবে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মীখাইল ওদের কথা বলার সুযোগ করে দিলো।
      মীখাইলঃ আপনি অনর্থক আমাকে অপরাধী করবেন না। এই সব আপনারই কৃতকর্ম।
     জনৈক পাদ্রীঃ আপোসে ঝগড়াইয় কি লাভ? যদি আগামী কল্য যীশুর খোদায়িত্ব সম্বন্ধে আলোচনা হয়, তবে তখন দেখা যাবে; আমাদের খৃষ্টধর্ম কোন তাসের ঘর নয় যে, হাত লাগালেই ভেঙ্গে পড়বে?
       এই সমস্ত আলোচনার-পর সমবেত খৃষ্টানগণ গীর্জা হতে বের হয়ে যায়। ইসাবেলা এবং তার সহচর ও সহপাঠীগণও রাস্তায় বের হয় এবং আলোচনা করতে থাকেঃ
      ইসাবেলাঃ দেখলে, মুসলমানদের অগোচরে তো বলা হয় যে, আমাদের সাথে মুকাবেলা করার ক্ষমতা তাদের নেই অথচ আজ পরস্পর মোকাবেলা হোয়ায় সকলেই ভেদ প্রকাশ হয়ে পড়ল। আমার পিতাজী এক বিশেষ প্রয়োজনে উপাসনা সমাপনান্তে গীর্জা হতে বের হয়ে গৃহে চলে গিয়েছেন, কারণ অধ্যাপক মীখাইল ও পীটার্সের শিক্ষাগত যোগ্যতার উপর পিতাজীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। তা না হলে তিনি এই বিধর্মীদের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দিতেন।
      সহচরীঃ আসল কথা হলো, এদের প্রশ্নটি বড় সাংঘাতিক, এমতাবস্থায় তোমার পিতাজী গীর্জায় উপস্থিত থাকলেই বা কি করতে পারতেন?
     ২য় সহচরীঃ আমার মনে হয়, আমাদের ধর্মীয় আকায়েদ-দৃঢ় বিশ্বাস যোগ্য ধর্মীয় বিষয় এবং এর মূলনীতিসমূহই কাঁচা। নতুবা আমাদের পাদ্রীসাহেবগণকে এরূপ অপদস্থ কেন হতে হল?
      ইসাবেলাঃ তওবা, তওবা! তুমিত শুধু একবারের আলোচনায়ই দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েছ! স্মরণ রেখ, আমাদের ধর্মীয় আকায়েদ অত্যন্ত মযবুত। কিন্তু ঐ সকল বিষয় বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সুযোগ্য ব্যক্তির প্রয়োজন। আগামীকল্য খোদাওন্দের খোদায়িত্ব এবং প্রায়শ্চিত্ত সম্বন্ধে আলোচনা হবে, তখন দেখ ঐ সব বিধর্মীর কি দুর্গতি ঘটে।
      আলোচনারত মেয়েরা হাটতে হাটতে এক চৌরাস্তায় গিয়ে পৌছলো এবং সেখান থেকে সকল আপন আপন গৃহাভিমুখে চলে গেল।

 

 

*****************************************