JustPaste.it

প্রচ্ছদ নিবন্ধ

 

রক্তে রাঙ্গা চেচনিয়া

ইতিহাসের চলমান ট্রাজেডি বনাম বন্ধকী বিবেক

মাসুদ মজুমদার

             চেচনিয়া। উত্তর ককেসাশের একটি ছোট্ট দেশ। ককেসাশ মানে অনেকগুলো পর্বতমালা। রাশিয়া-ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যবর্তী কৃষ্ণসাগর থেকে দক্ষিণ পূর্ব কাম্পিয়ান সাগর পর্যন্ত এর বিস্তৃতি প্রায় সাড়ে সাতশত মাইল। প্রধান পর্বতমালা বৃহত্তর ককেসাশ কয়েকটি তুষারাবৃত শৃঙ্গ সমষ্টি। কুরা নদীর দক্ষিণে ক্ষুদ্র ককেসাশ ইরানী মালভূমির সম্প্রসারিত অংশ।

            এখানে গড়ে উঠে একটি মিশ্র জাতি-গোষ্ঠী। খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারখ্যাত বাকু, গ্রেজনী মাইকপ, চিয়াতুরায় রয়েছে অনেক খনিজ সম্পদ। গ্রীকরা এই জনপদের সন্ধান জানতো অনেক আগ থেকেই। সারকেসিয়া, উঃ ককেসিয়া রুশ ফেডারেশনের অংশ হিসেবে চিহ্নিত হলেও আদি ইতিহাস রুশ-কেন্দ্রিক ছিলো না। রুশ ফেডারেশনের অংশ হিসেবে এর বিভাগ ছিলো জর্জিয়া, আজারবাইজান, আরমেনিয়া।

             উনিশ শতকের একেবারে গোড়াতে মুসলমানরা প্রথমবারের মত রুশ অনুপ্রবেশ ও আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য প্রবল বাধার সৃষ্টি করে। ১৮৫৯ সালে ইমাম শামিলের নেতৃত্বে মুসলমানরা প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। রুশ ইতিহাস যেটিকে ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। দুর্ভাগ্য, এই ‘বিদ্রোহ’ সফলতা পায়নি। এই জনপদের মানুষ রুশ ভাষায় আদৌও অভ্যস্ত নয়। এখানে ভিন্ন আদলে আরবির প্রচলন রয়েছে। তলস্তয় ও লারমনতক এর উপন্যাসে এবং পুশকিনের কবিতায় ককেসাশের যে জীবন চিত্রের প্রমাণ মিলে, এখানকার স্বাস্থ্য নিবাসের যে বর্ণনা, তা দিয়ে প্রমাণিত হয়- সমৃদ্ধ ও উন্নত সভ্যতার ছোয়াপ্রাপ্ত সভ্য মানুষদের আদি বসতি এই চেচনিয়া।

             অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া চেচনিয়ার অধিবাসী প্রায় সবাই মুসলমান। মূল ভূখণ্ডটি ১ লাখ ৯৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে ১২ লাখ। কাসপিয়ান সাগর হতে বলকান সাগর পর্যন্ত প্রায় সোয়া তিনশ মাইল বিস্তৃত এলাকা জুড়ে চেচেনদের আবাসস্থল, বাসস্থান। রাজধানী গ্রোজনী (গ্রজনি) নামকরা শিল্পনগরী। আজকের গ্রোজনী রক্তাক্ত জনপদ, বিধ্বস্ত নগরী। হানাদার রুশদের বর্বরোচিত হানায় চেচনিয়ার বরফকুচির সাথে বনি আদমের রক্ত আর রক্ত। রক্তাক্ত এই জনপদ শুধু চেচনিয়া নয়, পুরো ককেসাসের পর্বত কন্দরে রুশ শ্বেত ভল্লুক ও হায়নারূপী রুশ সৈন্যদের হিংস্র নখরের আঘাতে দগদগে ক্ষত আর খুনে রাঙ্গা প্রতিটি অঞ্চল এখন স্বাধীনতার প্রহর গুণছে।

              চেচেনদের প্রচন্ড প্রতিরোধ সাম্প্রতিক বিশ্বকে কিছুটা নাড়া দিয়েছে। রাশিয়ার ক্ষমতার ভিতে কাঁপন ধরিয়েছে। স্বাধীনতার এ লড়াই, মুক্তির এই জিহাদ এখন বিশ্ব বিবেককে স্পর্শ করতে শুরু করেছে। অনুসন্ধিৎসু করে তুলেছে এই জাতির ইতিহাস সম্পর্কে।

             চেচেনরা মোঙ্গল ও তাতার জাতির একটি অভিন্ন রক্তধারা। তাদের সংগ্রামের ইতিহাসও অভিন্ন। বারো শতকের শেষ দিকে তাতাররা এশিয়ার বৃহৎ অংশ, ইউরোপের কিয়দংশ অধিকার করে। তাদের অগ্রাভিযান ছিলো কিং বদন্তির মত। কথায় আছে, তাতার-মোঙ্গলরা সামনে বাড়লে পিছু তাকায় না। সেই দুর্ধর্ষ জাতির রক্তধারা ও উত্তরাধিকার চেচেন মুজাহিদরা। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা এই জাতির ইতিহাসের আদিপর্ব, সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহসহ কিছু বিশ্লেষণ ও দুনিয়ার সংবাদ মাধ্যমগুলোর খণ্ডচিত্র তুলে ধরার প্রয়াস পাবো। ইতিহাস মাত্রই বহুমাত্রিক বর্ণনা ধারণ করতে পারে। কিছু প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তি ঘটলেও পূর্বাপর মিল ও সাযুজ্য রাখার স্বার্থে আমরা সীমিত পরিসরে হলেও একটু ইতিহাস চর্চার গোড়ায় যেতে চাই।

             

ইতিহাসের আদিপর্ব

            যুগ যুগ ধরে চেচেনরা আজাদীর স্বপ্নকে সযত্নে বুকের গভীরে লালন করে পরাধীনতার শৃংখল ভাঙ্গার সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। জাতি হিসেবে চেচেনদের রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, সর্বস্ব ত্যাগ করার সুমহান ঐতিহ্য। এই চেতনাকে জার এবং কমিউনিস্ট সরকার কেউ ধ্বংস করতে পারেনি। গোটা ককেসাশ অঞ্চলের জনগণের রয়েছে রুশ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরে ঐতিহ্য। চেচনিয়া, ইংগুশতিয়া, দাগেস্তান এবং তাতারিস্তান একই ঐতিহ্যের সূত্রে গাঁথা। চেচনিয়ায় ইসলামের আগমন একটু বিলম্বে ঘটলেও ইসলামের জন্যে চেচেন মুসলমানদের জিহাদের কথা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। সোভিয়েত মুসলমানদের মধ্যে চেচনীয়রা সর্বাধিক ধর্মপরায়ণ। দৃঢ় ঈমান তাদের পুরো জীবনাচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারা নিজেদের ইসলামী চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখার জন্যে ঔপনিবেশিক রুশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের কমিউনিস্ট উত্তরসূরীদের গণহত্যার বিরুদ্ধে দুইশ’ বছরেরও অধিক সময় পর্যন্ত জিহাদে লিপ্ত থাকে। ১৭৮৩ সালে ইমাম মনসুরের সময় এই প্রত্যক্ষ জিহাদ শুরু হয়। ১৯৪১-৪৩ সালে সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভ্যুত্থান ঘটে। ১৯৯২ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে চেচেন মুসলমানরা বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

             চেচনিয়ার একটি স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্রের ইতিহাস রয়েছে। এই রাষ্ট্রে ইসলামী সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। রুশ সাম্রাজ্যবাদের থাবা এই রাষ্ট্রের ওপর বিস্তার লাভ করা সত্ত্বেও চেচেনদের মধ্যে একটি অভিন্ন ঐক্য বজায় ছিল। স্টেট অব মনসুর (১৭৮০-৯১), স্টেট অব শামিল (১৮৩৪-৬৪), রিপাবলিক অব নর্থ ককেশিয়ান মাউন্ডেনিয়ার্স (১৯১৮-১৯), দ্য নর্থ ককেশিয়ান আমিরাত (১৯১৯-২০) এবং সোভিয়েত মাউন্টেন রিপাবলিক (১৯২০-২৪)। রাষ্ট্রগুলোই চেচেন মুসলমানদের গৌরবময় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে।

            সোভিয়েত কমিউনিস্টদের আগ্রাসন সত্ত্বেও বিভিন্ন ভাষাভাষী ককেশিয়ার উত্তরাঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে একতা বজায় আছে এবং বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও তারা অভিন্ন ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধিকারী। তারা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দিনে দিনে আরো সমৃদ্ধ করেছে। চেচেন, ইংগুশ এবং দাগেস্তানীরা হচ্ছেন ককেসিয়ার উত্তরাঞ্চলের সুন্নী মুসলমান। প্রত্যেক চেচেন ও ইংগুশ নিজেকে একজন মুক্ত, স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাশীল নাগরিক বলে মনে করে। আরবী সাহিত্যের ওপর নির্ভর করে তাদের সাহিত্য বিকাশ ও সমৃদ্ধি লাভ করে। সেখানকার স্কুল, মাদ্রাসা এবং ইসলামী শিক্ষার বিকাশে আরবীকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের ভিত্তিতে তাদের ঐক্য ও সংহতি জোরদার হয়েছে। ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে তারা সাম্রাজ্যবাদী জার ও সোভিয়েত কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে ব্যাপক নির্যাতনের সম্মুখীন হয়। রাশিয়ার জারেরা মুসলমানদেরকে খ্রীস্টান বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল।

              জার ফিওদরের আমলে মুসলমান ও ইসলামকে ধ্বংস করার জন্যে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। ১৯২৪ সালে উত্তর ককেসাশে ইসলাম-বিরোধী ব্যাপক প্রচারণা, ১৯২৮ সালে সেখানে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হামলা চালানো হয়। রুশ কমিউনিস্টরাও জারদের মত চেচেন মুসলমানদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। চেচেন মুসলমানরা তাদের স্বাতন্ত্র্যবোধ অক্ষুণ্ন রাখার জন্যে ১৮ শতকের পর থেকে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। শেখ মনসুর ও শেখ ইসমাইলের নেতৃত্বে রুশ উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে চেচনিয়া ও ইংগুশতিয়ার মুসলমানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নতুনভাবে সংগঠিত হবার প্রয়াস শুরু করেন। বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্যাতনে প্রায় অর্ধেক চেচেন মৃত্যুবরণ করে। স্তালিনের মৃত্যুর পর মুসলমানরা আবার তাদের বাড়িঘরে ফিরে আসে এবং নতুনভাবে সংগঠিত হয়। বর্তমানে রাশিয়া তাদের পুরনো সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় চেচনিয়ার মুসলমানদের চিরদিন গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ  রাখার লক্ষ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

            ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তাতারদের একটি সম্পূর্ণ ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। ককেসাশ তাতার ও চেচেনদের মিলে সমন্বিত ইতিহাসের যে চিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করি সেটি আরো চমকপ্রদ।

             নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি পেলেও আমরা অজানা সেই ভুলে যাওয়া ইতিহাসের দিকে খানিকটা আলোকপাত করতে পারি।

            একসময় প্রায় সমগ্র রাশিয়া ও সাইবেরিয়ায় তাতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ অঞ্চলে তাতারদের এক বিশাল সাম্রাজ্য পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত অটুট ছিল। পরে এই সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে খানদের শাসনাধীন হয়ে পড়ে। খানদের এই রাজ্যগুলো কালক্রমে কিছু উসমানীয় তুর্কী সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে যায়। কিছু দখল করে নেয় রাশিয়ার চতুর্থ জার ‘ইভার্ন’। তাতারদের দুর্ভাগ্যের সুচনা এখান থেকেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কী সাম্রাজ্যের বিরাট অংশ মিত্র শক্তির মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যায়। রুশদের হাতে তাতাররা আটকা পড়ে যায়। পরে ১৯২০ সালে তাতার স্বায়ত্ত্বশাসিত সোভিয়েত সমাজতন্ত্রী প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। নির্ভরযোগ্য ইতিহাস হচ্ছে-

            ত্রয়োদশ শতকে তাতার অভিযানের সময় ককেসাশের ঐ অঞ্চলে চেচেন-তাতারদের আগমন ঘটে এবং সেখানে তারা স্থায়ী বসতি স্থাপন করে। কাম্পিয়ান সাগর থেকে বলকান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার মধ্যে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলো হচ্ছেঃ  ইঙ্গুশতিয়া, আবখাজিয়া, কারাচায়েভা, চেরকিস, কাবার, দিদিয়ান, বলকার, দাগেস্তান। একই সময় এসব এলাকাতেও মুসলমান বসতি গড়ে উঠে। ঐ সব এলাকায় বসবাসকারী মুসলমানরাও তাতার জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত। শাফী মাজহাবের অনুসারী।

            তাতারের যেমন সংগ্রাম ও লড়াইয়ের ঐতিহ্য রয়েছে, তেমনি চেচেন, ইঙ্গুশ প্রভৃতিরও পৃথক এতিহ্য ও ইতিহাস রয়েছে। রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চেচেনরা শুরু থেকেই লড়াই চালিয়ে আসছে। অষ্টাদশ শতকে ইমাম মনসুরের নেতৃত্বে চেচনিয়ায় গণজাগরণ ঘটে। ইমামের দেশপ্রেম ও বীরত্বের কথা চেচেনরা এখনও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। ইমাম মনসুর ১৭৮৩ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত চেচেনদের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। এরপর তিনি কারারদ্ধ হন এবং ১৭৯১ খ্রীষ্টাব্দে রুশ কারাগারে ইন্তেকাল করেন। স্বাধীনতার যে মশাল ইমাম মনসুর চেচেনদের মধ্যে জ্বালিয়ে দেন, পরবর্তীকালে সে মশাল বহন করেন তার অনুসারীরা। ইমাম মনসুরের ৩০ বছর পর চেচেনদের নেতৃত্বে আসেন ইমাম শামিল। তিনি একটানা ৩৫ বছর নেতৃত্ব দেন। এই সময় চেচেনদের কেউ পরাস্ত করতে পারেনি। ককেসাসের এই প্রবাদ-পুরুষ গোটা ককেসাস অঞ্চলে ঈমান ও স্বাধীনতার বাণী ছড়িয়ে দেন। তার নেতৃত্বাধীন বাহিনী জার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমরণ লড়াই চালিয়ে গেছে। ১৮৩৪ সালের লড়াইয়ে চেচেনদের অর্ধেকের বেশি পুরুষ শাহাদাতবরণ করেন।

             ইমাম শামিলের নেতৃত্বে চেচনিয়া, ইঙ্গশতিয়া, দাগেস্তানসহ বিরাট এলাকা জুড়ে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দু’দশক এই খেলাফত টিকে থাকে। ১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দে জার বাহিনীর সঙ্গে ইমামের বাহিনীর এক মারাত্মক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী পরাজয় বরণ করে এবং ইমাম শামিলের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা রুশ সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। এরপর ১৯৭৭ ও ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে ককেশীয় মুসলমানরা বিদ্রোহের জান্ডা উত্তোলন করে। রুশ গৃহযুদ্ধের সময় তারা তাদের নেতা ওজুন হাজীর নেতৃত্বে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

             রুশ বিপ্লবের পর ককেশীয় মুসলমানরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে। এ সময় তারা ‘উত্তর ককেশাস স্বাধীন প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করে। ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে দাগেস্তানে যে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটে, তাতে চেচেনরাও শামিল হয়। ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে স্ট্যালিন যখন জাতি হত্যার অভিযান শুরু করে তখনও চেচেনরা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়। ১৯৪৪ সালে স্ট্যালিন চেচেন ও ইঙ্গুশদের কাজাকিস্তান ও সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেয়। এই সময় তাদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতন চলে। তাদের বাড়িঘর ও সহায় সম্পদ দখল করা হয়। টেনে-হেঁচড়ে গাড়িতে তুলে কাজাকিস্তানের মরু এবং সাইবেরিয়ার তুষার প্রান্তরে নিক্ষেপ করা হয়। এই বিতাড়ন অভিযানের সময় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ক্ষুধা, তৃষ্ণা, পথশ্রম ও বৈরী পরিবেশে মৃত্যুবরণ করে। ক্রুশ্চেভের আমলে ১৯৫৬ খ্রীষ্টাব্দে চেচেনদের স্বদেশে ফেরার অনুমতি দেয়া হয়। দেশে ফিরে এসে তারা দেখতে পায় তাদের সহায়-সম্পত্তি ভোগ দখল করেছে রুশরা। এভাবে একটি জাতিকে নির্মূল ও পরাধীন করার জন্যে রুশ জারতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীরা শত শত বছর ধরে এত কিছু করার পরও চেচেনরা বেঁচে আছে এবং এখন তারা আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে।

              ১৯৯১ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতনের পর জবর দখলকৃত প্রায় প্রত্যেকটি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। মধ্য এশিয়ার পাঁচটি মুসলিম প্রধান দেশ যথাক্রমে আজারবাইজান, কাজাকিস্তান, তাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানসহ অন্যান্য দেশ যেমন- আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন এবং বালটিক অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেকটি দেশই মস্কোর নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একই প্রক্রিয়ায় চেচনিয়ার কৃতী সন্তান সোভিয়েট বিমান বাহিনীর জাদরেল জেনারেল জোহার মোহাম্মদ দুদায়েভ ১৯৯১ সালের ১ নভেম্বর চেচনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর আগে ১৯৯১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর দুদায়েভ রাশিয়ান বিমান বাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে চেচনিয়া গিয়ে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন।

             ১৯৯১ সালের ২৭ অক্টোবর দুদায়েভ চেচনিয়ার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নির্বাচনের আগেই তিনি চেচনিয়ার জনগণকে প্রতিশ্রুতি দেন, তিনি নির্বাচিত হলে চেচনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কায়েম করবেন। মস্কোর শাসকগোষ্ঠী সম্পদে ভরপুর স্বাধীন চেচনিয়ার অস্তিত্ব মেনে নিতে চায়নি। স্বাধীনতা ঘোষণা করার মাত্র এক সপ্তার মধ্যেই বরিস ইয়েলৎসিন ৭ নভেম্বর মস্কো থেকে চেচনিয়ার উপর জরুরী আইন জারি করে। মাত্র দু’দিন পর মস্কোর সাবেক কেজিবি সমন্বয়ে গঠিত বর্তমানে রাশিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক ও নিন্দনীয় বাহিনী হিসেবে খ্যাত ইনটিরিয়র মিনিস্ট্রি বাহিনীর প্রায় সহস্রাধিক সৈন্য চেচনিয়ার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে। কিন্তু রাশিয়ান পার্লামেন্টের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ইয়েলৎসিন ১০ নভেম্বর এই বিশেষ সৈন্যদল ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। এরপরের তিন বছর বরিস ইয়েলৎসিন বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছে চেচনিয়ার স্বাধীন জাতিসত্তাকে ধ্বংস করতে। মস্কো কখনো বলেছে দুদায়েভ বেআইনী রাষ্ট্রপ্রধান, কখনও আবার পশ্চিমা দুনিয়াকে বুঝাতে চেষ্টা করেছে, চেচনিয়া হলো ক্রিমিনালদের স্বর্গরাজ্য।

              মস্কো মিথ্যাচার দিয়ে একটা বিশেষ ক্ষেত্র তৈরী করতে চেয়েছিল তিনটি বছর। অথচ ভুলেও একথা স্বীকার করেনি যে, দুদায়েভ চেচনিয়ার নির্বাচিত নেতা এবং নির্বাচনের পূর্বে তিনি জনগণকে রাশিয়া থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হবার প্রতিশ্রুতি দেন। চেচনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণায় উৎসাহিত হয়ে পার্শ্ববর্তী ককেশীয় রাজ্য যথাক্রমে- ইংগুশতিয়া, দাগেস্তান ওশেনতিয়া ও আবখাজিয়া স্বাধীনতা লাভের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

             উক্ত চারটি রাজ্যই মুসলিম প্রধান এবং খনিজ সম্পদে ভরপুর। রাশিয়ার নব্য সম্প্রসারণবাদীরা চেচনিয়ার স্বাধীনতা ধ্বংস করার চক্রান্তে লিপ্ত হয় বিভিন্নভাবে। বিশেষ করে ১৯৯৪ সালের ১৩ জুন চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনীতে রাশিয়ার আভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত বিশেষ বাহিনী নগণ্য সংখ্যক সাবেক কমিউনিস্ট কর্মী দ্বারা ব্যাপক হাঙ্গামার চেষ্টা চালায়। ১৯৯৪ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে রাশিয়ার প্যারা-মিলিটারী কমিউনিস্ট ও উগ্রপন্থীরা চেচনিয়ায় প্রত্যক্ষ আক্রমণ শুরু করে। রাশিয়ান হেলিকপ্টার চেচনিয়ার বিভিন্ন তেল শোধনাগার ও পাওয়ার প্ল্যান্টে বোমাবর্ষণ করে। চেচনিয়ার কর্তৃপক্ষ রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলে মস্কো তার জড়িত থাকার ব্যাপারটা অস্বীকার করে। নভেম্বর মাসের ২০ তারিখে প্রেসিডেন্ট দুদায়েভ চেচনিয়ার সকল ধর্মীয় নেতা ও স্থানীয় নেতাদের একটা বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করেন। উক্ত অধিবেশনে দুদায়েভ ঘোষণা করেন যে, আজ থেকে চেচেনিয়া সম্পূর্ণ ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী চলবে, অর্থাৎ তিনি চেচনিয়াকে ইসলামিক রাষ্ট্র বলে ঘোষণা দেন। এই ঘোষণায় বরিস ইয়েলৎসিন ক্ষেপে যান। এই ঘোষণা পশ্চিমা বিশ্বকেও হতবাক করে দেয়।

              চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট জোহার দুদায়েত এই মর্মে অভিযোগ করেছেন যে, হানাদার রুশ বাহিনী ১ লাখ চেচেনকে খুন করেছে এবং এই ভাগ্যাহত নিরপরাধ চেচেনদের অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। চেচেন প্রেসিডেন্ট রুশ হামলার সুদূরপ্রসারী দূরভিসন্ধি সম্পর্কে ইঙ্গিত করে বলেন, রুশদের এই গণ হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্যে হচ্ছে, চেচেন জনগণকে পুরোপুরি নির্মূল বা উচ্ছেদ করা। রাশিয়ার স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন বলেছে, রুশ বাহিনীর এই নির্মমতা প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের জন্য অশুভ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। রুশ মানবাধিকার কমিশনের এক সাম্প্রতিক রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়, চেচনিয়ায় রুশ অভিযানের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অত্যন্ত ব্যাপক, যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে পোল্যান্ডে নাজী অভিযানের সাথে তুলনীয়।

           

ঘটনার পুনারাবৃত্তি

             ৯৪ সালে চেচনিয়ার সাথে সংঘটিত প্রচন্ড যুদ্ধে রাশিয়া অত্যন্ত অপমানজনকভাবে পরাজয় বরণ করে। তারপরও তারা চেচনিয়ার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি না দিয়ে চেচেন প্রেসিডেন্ট মাসখদভের সাথে ৫ বছর মেয়াদী একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু চুক্তির ৩ বছরের মাথায় রাশিয়া আকস্মিকভাবে চেচনিয়ায় সর্বাত্মক হামলার মাধ্যমে সেখানে গণহত্যা চালাচ্ছে। চেচনিয়ার ওপর আবারো আগ্রাসী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে রাশিয়া ১৯৯৬ সালের চুক্তিই কেবল লংঘন করেনি বরং অতি কাপুরুষোচিত, অমানবিক ও অসাংবিধানিক কর্মের পুনরাবৃত্তি করেছে।

             ১৯৯৪-৯৬ সালের যুদ্ধের সময় চেচনিয়ায় হামলা চালানোর অমানবিক ও অসাংবিধানিক আদেশের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে খোদ রাশিয়ারই ৬ জন সেনানায়ক পদত্যাগ করেছিলেন। পার্লামেন্টেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠেছিল।

             চেচনিয়া হচ্ছে রুশ ফেডারেশনের ২১টি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজাতন্ত্র। ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত এক গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ের ভিত্তিতে চেচনিয়াও স্বাধীনতা ঘোষণা করে। রুশ বিমান বাহিনীর সাবেক জেনারেল জওহর দুদায়েভ প্রজাতন্ত্রটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী সাম্রাজ্যবাদী রুশ প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই মুসলিম প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেননি। রুশ শাসক চেচনিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাকে বিচ্ছিন্নতা বলে আখ্যায়িত করে এই উদ্যোগ কঠোর হস্তে দমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। চেচনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার তিন বছর পর্যন্ত চুপচাপ থেকে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ করে ইয়েলৎসিন চেচনিয়ায় সামরিক বাহিনী প্রেরণ করে। তিনি সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ৪০ হাজার সৈন্য পাঠান। রুশ বাহিনীর অগ্রাভিযান চেচেন সীমান্তে এসে বাঁধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। চেচেন মহিলারা রাস্তার সামনে ব্যারিকেড রচনা করে। এভাবে পুরো এক সপ্তাহ রুশ ট্যাংক বহরকে ঠেকিয়ে রাখা হয়। ৫ মাস একটানা যুদ্ধে রাশিয়ার শত শত সৈন্য নিহত হয়। চেচেনদের গেরিলা রণকৌশলের কাছে রুশ বাহিনী হার মানতে বাধ্য হয়। চেচনিয়ার কয়েক হাজার রুশ সৈন্য নিহত হওয়ায় নিহত সৈন্যদের পরিবারবর্গ রাশিয়ায় প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের জন্যে চেচনিয়া সংকট এক বিরাট রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আলেকজান্ডার লেবেদকে সংকট সমাধানের দায়িত্ব দেন। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে ক্রেমলিনে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইয়েলৎসিন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর যুদ্ধবিরতির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে চেচনিয়ায় পুনরায় হামলা করার জন্যে রুশ বাহিনীকে নির্দেশ দেন। রাশিয়ার বিশ্বাসঘাতকতায় মুজাহিদরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয় নিয়ন্ত্রিত বিশেষ বাহিনী নগণ্য সংখ্যক সাবেক দিয়ে রাশিয়া ১৯৯৬ সালের চুক্তিই কেবল বিশ্বাসঘাতকতায় মুজাহিদরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয় এবং রুশ বাহিনীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। মুজাহিদদের আচমকা হামলায় রুশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। যুদ্ধে রাশিয়া প্রচণ্ড মার খায়। রাশিয়া আবার শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করার জন্যে উদগ্রীব হয়ে ওঠে এবং ১৯৯৬ সালের ৩১ আগস্ট চেচেন চীফ অব স্টাফ ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট আসলান মাসখাদভ এবং জেনারেল লেবেদের মধ্যে আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সালের ৩১ আগস্ট উভয় পক্ষ শাস্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে। কিন্তু রাশিয়া শান্তি চুক্তি লংঘন করে একতরফা চেচনিয়ার ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ৫ বছর মেয়াদী চুক্তি অনুযায়ী ২ হাজার সালের ৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত চেচনিয়ায় স্থিতাবস্থা বজায় থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিন বছর যেতে না যেতেই চুক্তি লংঘন করে রাশিয়া চেচনিয়ার ওপর এক অসম যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে।

             

সাম্প্রতিক চিত্র

            আমরা জানি প্রলম্বিত এই জিহাদ একদিন চেচনিয়াকে স্বাধীনতা এনে দিবে। সেদিন আর দূরে নয় ইনশাআল্লাহ। কালেমাখচিত চেচনিয়ার স্বাধীন পতাকা আকাশ স্পর্শ করবে। সাম্প্রতিক কিছু সংবাদ চিত্র চেচনিয়ার মুক্তিযুদ্ধকে কিভাবে দেখছে তার বিবরণ হচ্ছে-

           

মস্কো থেকে রয়টারঃ

          চেচনিয়া হানাদার রুশ বাহিনীর জন্য মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। মস্কো স্বীকার করেছে যে, গত এক সপ্তাহে মুজাহিদদের আক্রমণে ১৫৬ জন রুশ সৈন্য নিহত হয়েছে। চেচনিয়ার যুদ্ধ এখন রুশদের জন্য এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর্যায়ে পদার্পণ করেছে। চেচেন মুজাহিদরা সমগ্র চেচনিয়ায় সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং রুশ বাহিনীর উপর অতর্কিতে আঘাত হানছে।

            গত সপ্তাহে গ্রোজনীর কাছে মুজাহিদদের এক আক্রমণে ২০ জন আধাসামরিক পুলিশসহ বহু সৈন্য নিহত হয় এবং সলেমান তাউমেনে রাশিয়ার দুর্ধর্ষ ছত্রী সৈন্যের ৮৪ সদস্যের একটি কোম্পানীর সকলেই নিহত হয়। এতে চেচনিয়ায় মুজাহিদদের বিরুদ্ধে প্রায় ছয় মাসব্যাপী যুদ্ধে রুশ বাহিনী জয়ী হয়েছে বলে মস্কোর দাবী মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

             চেচেন মুজাহিদদের ইন্টারনেট ওয়েবসাইট-কাভকাজ ডট অর্গ জানিয়েছে, শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন মুজাহিদ কমান্ডার নিহত হবার রুশ খরব মিথ্যে। আবর বংশোদ্ভূত চেচেন মুজাহিদ মোহাম্মদ খাত্তাবের বরাত দিয়ে কাভকাজ ডট বার্তা জানায়, নিহত মুজাহিদরা কিভাবে যুদ্ধ করেন রাশিয়া শিগগিরই তা উপলব্ধি করতে পারবে।

             চেচনিয়ার উচ্চ পার্বত্য গ্রাম উলুস-কার্ট ও সালমান উসেন গ্রামের কাছে এক সপ্তাহ ধরে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। পার্বত্যাঞ্চলের পাদদেশে অবস্থিত কমসোল স্কায়ারেও সপ্তাহ ধরে তীব্র যুদ্ধ চলছে। এনটিভি টেলিভিশনের একজন সাংবাদিক কমসোলস্কায়ার রণাঙ্গণ থেকে জানান, এই গ্রামটিতে দেড় হাজার মুজাহিদ অবস্থান নিয়েছে। এর আগে রুশরা তাদের সংখ্যা মাত্র ২৫/৩০ জন বলে জানিয়েছিলো। পরে তারা তাদের ধারণা ভুল ছিলো বলে জানায়।

             মুজাহিদরা পুনরায় বড় আকারে সংগঠিত হয়ে আক্রমণ চালাতে পারবে না বলে রুশরা যে ঘোষণা দিয়েছিলো এতে তাও মিথ্যা প্রমাণিত হয়। রাশিয়া চেচনিয়ার মুজাহিদদের সংগঠিত প্রতিরোধ ধ্বংস করে দিয়েছে বলে দাবী করার পরপরই মুজাহিদদের বড় ধরনের কয়েকটি সফল আক্রমণ ও রুশদের বিপুল প্রাণহানিতে ককেশাস অঞ্চলে রুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মস্কোর সামর্থ্যের ব্যাপারে আবারও সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।

             রাশিয়া সফররত বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বলেছেন, তার আলোচ্যসূচীতে চেচনিয়ার বিষয়টি থাকলেও তা গৌণ বিষয়। তিনি দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি ও সম্পর্ক জোরদারের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

             

মস্কো থেকে এএফপিঃ

        স্বাধীনতাকামী চেচেন মুজাহিদরা একটি কার্যকর পাল্টা হামলার দাবীর সমর্থনে নিজেদের মরণপণ অতর্কিত গেরিলা হামলার একটি লোমহর্ষক ভিডিও প্রকাশ করার মাধ্যমে চেচনিয়ায় রুশবাহিনীর বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিরোধ যুদ্ধ জোরদার করেছে।

             মুজাহিদরা গত শুক্রবার জানায় যে, তারা মাত্র একদিন আগে রুশ নিয়ন্ত্রণ রেখার অভ্যন্তরে একটি সফল গেরিলা হামলা চালিয়ে ২৪ জন ফেডারেল সৈন্যকে হত্যা করেছে। তাছাড়াও তারা নিজেদের প্রতিরোধ যুদ্ধ জোরদার করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।

             শীর্ষ পর্যায়ের একজন চেচেন মুখপাত্র জানান মুজাহিদরা গত শুক্রবার গ্রোজনীর ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত আলখান কালা উপকণ্ঠ দখল করে নিয়েছে। গত একমাস এই এলাকাটি রুশদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

             মুখপাত্র মোভলাদি উদুগভ জানান, মুজাহিদরা একই সময়ে চেচনিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় পার্বত্য এলাকার পাদদেশে অবস্থিত দু’টি গ্রামে আকস্মিক হামলা পরিচালনা করে দখল করে নেয়। এর ফলে গ্রোজনীর পতনের এক মাস পর এই গ্রাম দু’টি মুজাহিদদের প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয়।

              উদুগভ একটি অজ্ঞাত স্থান থেকে টেলিফোনে বলেন, এটা আমাদের হামলার সূচনা মাত্র। তিনি বলেন, এটা আমাদের প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

             বৃটিশ বিবিসি টেলিভিশনে গতকাল শনিবার সম্প্রচারিত এক ভিডিওতে রুশদের ওপর চেচেন মুজাহিদদের গত বৃহস্পতিবারের সফল হামলার দৃশ্য দেখানো হয়েছে।

             চেচেন মুজাহিদরা নিজেরাই বিবিসির কাছে এই ভিডিও টেপটি হস্তান্তর করেছে। এর মাধ্যমে মুজাহিদরা রুশ বাহিনীর বিরদ্ধে তাদের কার্যকর পাল্টা হামলার দাবীর সমর্থন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে।

             রুশ কর্মকর্তারাও চেচেন মুজাহিদ হামলায় গত বৃহস্পতিবার তাদের ২৪ জন সৈন্য নিহত ও ২৯ জন আহত হবার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে।

             চেচনিয়ায় রুশ সেনা দলের ওপর স্বাধীনতাকামী চেচেন মুজাহিদরা আরো হামলা চালিয়েছে। মুজাহিদরা রাজধানী গ্রোজনীর দক্ষিণে পাহাড়ী এলাকায় তাদের ঘাঁটি থেকে রুশ সেনা বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে।

            রুশ অধিনায়করা বলছেন, মুজাহিদরা যাতে তাদের ঘাঁটি ছেড়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়, সেজন্য এলাকার গ্রামণ্ডলোর ওপর কামানের গোলা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। রাশিয়ার নিরাপত্তাবাহিনী জানায়, তাদের এই তৎপরতা সত্ত্বেও কিছু পুলিশে ঐ আক্রমণে আহত হয়েছে। কিন্তু অতর্কিত অপর এক আক্রমণে ৭৫ জন রুশ সৈন্য নিহত হওয়ার খবর মস্কো অস্বীকার করেছে। গত শুক্রবার অর্জুন খাদে রুশ সৈন্যদের ওপর অতর্কিত মুজাহিদ হামলায় উক্ত ৭৫ জন সৈন্য নিহত হয়।

            এদিকে দু’দিন আগে ৩৭ জন রুশ সৈন্য মুজাহিদদের অতর্কিত আক্রমণে নিহত হওয়ার পর রুশ সৈন্যরা এখন গ্রোজনীর ঘরে ঘরে তল্লাশী চালাচ্ছে।

             রুশ সামরিক কর্তৃপক্ষ বলছে, চেচনিয়ায় রুশ বাহিনীর ওপর চেচেন মুজাহিদদের এক অতর্কিত হামলার পর তারা ৩০ জনকে গ্রেফতার করেছে।

             বিভিন্ন সূত্রের ভিত্তিতে প্রণীত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, সর্বশেষ ঘটনায় রুশরা অত্যন্ত বিব্রত। রুশরা রাজধানী গ্রোজনীসহ যেসব এলাকা তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে বলে ধরে নিয়েছিল, সেসব জায়গা তাদের জন্যে ততোটা নিরাপদ নয়। দু’দিন আগে স্বরাষ্ট্র দফতরের একটি ইউনিটের ওপর গ্রোজনীর উপকষ্ঠে মুজাহিদরা হামলা চালায়। মুজাহিদরা শহরটিতে ইচ্ছামত ঘুরে বেড়াতে পারছে। রুশ সৈন্যরা এখন হামলাকারীদের খুঁজে বের করার জন্যে ঘরে ঘরে তল্লাশী চালাচ্ছে। রুশরা দাবী করছে যে, প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে।

            রাশিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন এই হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্যে আমরা কি করতে পারি, আমাদের অসাবধান হওয়া উচিত নয়। এ সম্পর্কে এখন কোন কিছু বলা মুশকিল। আমার মনে হয়, যারা সামরিক তৎপরতায় এবং সামরিক বাহিনী মোতায়েনে নিয়োজিত তাদের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করা যায়।

            এতে কোন সন্দেহ নেই। চেচনিয়ার গ্রামগুলোতে মুজাহিদদের আশ্রয় দেয়া হচ্ছে। চেচনিয়ার মানুষ রুশদের পছন্দ করে না। আর সম্ভবত তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে মুজাহিদদেরকে রুশদের হাতে তুলে দেবেন না। মুজাহিদরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। মুজাহিদরা আগামী মাসগুলোতে তৎপরতা চালিয়ে রুশদের মনোবল ভাঙ্গতে পারবে এবং এ কৌশল খুব কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

আরো কিছু সাম্প্রতিক সংবাদ একটি রণক্ষেত্রঃ ভিন্নধর্মী বর্ণনা

            মস্কো থেকে এএফপি॥ রাশিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন বলেছেন, চেচনিয়ায় তাদের অভিযান চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এদিকে রুশ জেনারেলরা পাহাড়ী দক্ষিণাঞ্চলে স্বাধীনতাকামী মুজাহিদদের দমনের জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।

            রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ২৬ মার্চ প্রথম দফা ভোট গ্রহণের আর মাত্র ১৬ দিন বাকি। এ মুহূর্তে ক্রেমলিন প্রধান কৌশলগত স্থান কমসোমোল স্কয়ার দৃঢ় প্রতিরোধ নিয়ে বিরত রয়েছেন। এনটিভিতে প্রদর্শিত যুদ্ধের দৃশ্যে দেখা গেছে, রাশিয়ার সৈন্যরা কামানের গোলা নিক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও সুরক্ষিত গ্রামের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় অগ্রবর্তী ট্যাঙ্কের পিছনে গুটি গুটি মেরে এগুচ্ছে।

            পুটিন বলেন, তিনি চেচনিয়া পুনর্দখল করার পর সেটিকে সরাসরি ক্রেমলিনের নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু এক সপ্তাহের প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর দেখা যাচ্ছে মুজাহিদদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

             সামরিক কর্মকর্তারা জানান, গত সপ্তাহে ১শ’ ৫৬ জন সৈন্য নিহত হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইগর সের্গেইয়েভ স্বীকার করেছেন যে, ২৯ ফেব্রুয়ারী রাতের যুদ্ধে ৮৫ জন প্যারাট্রপার নিহত হয়েছে।

               সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান ভালেরী মানিলভ বলেছেন, রাশিয়ার সৈন্যরা ১ অক্টোবর থেকে চেচনিয়ার মুজাহিদদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান শুরুর পর থেকে সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ১ হাজার ৫শ’ ৫৬ জন সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে।

             বাণিজ্যিক দৈনিক কমার্সেন্ট পত্রিকার সঙ্গে দেয়া সাক্ষাৎকারে পুটিন প্রথমবারের মত ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, চেচনিয়ার অবিলম্বে রুশপন্থী সরকার বসানোর কোন পরিকল্পনা নেই।

              ‘লৌহ মানব’ শিরোনামে কমার্সেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে পুটিন বলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরে আমরা সম্ভবত কয়েক বছরের জন্য চেচনিয়ায় সরাসরি প্রেসিডেন্টের শাসন চালু রাখবো।

             

মস্কো থেকে রয়টার

     চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনীর দক্ষিণে আরগুন গিরিসংকটে চেচেন মুজাহিদদের এক আক্রমণে ৩১জন রুশ সৈন্য নিহত হয়েছে। দু’পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধের সময় আরো বহু রুশ সৈন্য আহত হয়।

              একজন শীর্ষস্থানীয় রুশ জেনারেল গতকাল সোমবার রুশ সেলভিশনকে একথা জানান।

              জেনারেল গেনাডি ট্রশেড বলেন, সম্প্রতি উলুসকাট ও সেলেমানতাউসেন গ্রামে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। চেচেন মুজাহিদরা আরগুন গিরিসংকট থেকে সমতলের দিকে রুশ ব্যূহ ভঙ্গ করার চেষ্টার সময় এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

            উত্তর ককেশাসে রুশ বাহিনীর প্রথম ডেপুটি কমান্ডার জেনারেল ট্রশেড বলেন, “আমরা রুশ বাহিনীর হতাহতের ঘটনা রোধ করতে পারছি না। কিন্তু হতাহতের বিষয়ে কথা বলাও কঠিন।” তিনি বলেন, চেচেনরা ছত্রীসেনার ষষ্ঠ কোম্পানীর ওপর হামলা চালায়। এতে ৩১জন সৈন্য নিহত হয় এবং বহু আহত হয়।

            সরকারী আরটিআর টেলিভিশনের একজন রিপোর্টার বলেন, ছত্রীসেনারা শুক্রবার দু’টি গ্রামের কাছে অবস্থান গ্রহণ করার পর পরই একহাজার চেচেন মুজাহিদের একটি দল তাদের উপর হামলা চালায়।

            গত বৃহস্পতিবার চেচেন মুজাহিদদের আক্রমণে রুশ ক্রাক ওমেল পুলিশের ২০ জন সদস্য নিহত হবার ঘটনা রুশ সামরিক কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন। রুশবাহিনী গত মাসে গ্রোজনী দখল করে নেয় এবং আশা করছে যে, চেচনিয়ায় তাদের অর্ধ বছরের হামলার শিগগিরই অবসান ঘটবে। তবে চেচেন মুজাহিদরা বলেছেন, তারা রুশদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।

             গ্রোজনী এখনও চেচেন মুজাহিদদের হাতে। অবিশ্বাস্য হলেও কথাটি সত্য। রুশ জেনারেলরা গর্ব করে বলেছিলেন, তারা বড়দিনের (২৫ ডিসেম্বর) আগেই গ্রোজনী দখল করবেন। নতুন খ্রীষ্টীয় শতকের ১ জানুয়ারি রুশ সৈন্যরা বিজয় উৎসব পালন করবেন গ্রোজনীতে পতাকা উড়িয়ে আর ভৎকা খেয়ে। কিন্তু তাদের সে আশা পূর্ণ হয়নি। জানুয়ারি মাস শেষ হয়ে গেল এখনও কিন্তু গ্রোজনী অকুতোভয়, আল্লাহ্‌র রাস্তায় জেহাদকারী চেচেন মুজাহিদদের হাতে। সামরিক বিবেচনার দিক থেকে বিষয়টি অবিশ্বাস্য। রাশিয়া এখনও দুনিয়ার দু-নম্বর পরাশক্তি। দূরপাল্লার কামান, আধুনিক বোমারু বিমান, র‌্যাডার নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র, ফৌজের সংখ্যা__ সব কিছুতেই রাশিয়া দুনিয়ার সেরা দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় ক্ষুদ্র দেশ চেচেনিয়ার মুসলিমদের পদানত করার জন্য তারা প্রয়োগ করেছে সমস্ত শক্তি। সামরিক বিশেষজ্ঞরা তো বলেই ফেলেছেন, সংখ্যাল্পতা নয়, ববং অস্ত্র ও ফৌজের আধিক্যই রুশদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাশিয়ানরা চেচেনিয়ায় এত বেশি সৈন্য সমাবেশ ও যান্ত্রিক ইউনিট নিয়োগ করেছে যে, তাদের ঠিকমত ‘কাজ’ দেওয়া যাচ্ছে না।

            সর্বশেষ খবর হচ্ছে, রুশ সেনারা রাজধানী গ্রোজনীর বড় বড় বিল্ডিংগুলোতে বোমা ও রকেট দ্বারা লাগাতার আক্রমণ করে যাচ্ছে। আর স্থলপথে রুশ সেনারা গ্রোজনীর বরফঢাকা রাজপথ ও অলিগলি দিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে গ্রোজনীর কেন্দ্রের দিকে এগুতে চাইছেন। কিন্তু এ পথ বড় ভঙ্গুর। রাশিয়ানরা গত দেড় সপ্তাহ ধরে গ্রোজনীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ‘মিনটকা স্কোয়ারটি’ দখলের জন্য রুশ ফৌজ প্রণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছে। কারণ এই স্থানটি কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

              রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মি. ইগর সাজারইভ- এর মতে, রাশিয়ানরা শীঘ্রই এই লড়াইতে তুমুল সাফল্য লাভ করবে। কিন্তু তিনি স্বীকার করেন, হানাদার রুশ সেনাদের গ্রোজনীতে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অবশ্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী সারজাইভ দাবি করেছেন, আমাদের ক্ষতি থেকেও মুজাহিদদের লোকসান অনেক বেশি।

              নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের মতে, বড় বড় দাবি সত্ত্বেও রুশ সৈন্যরা খুব অল্পই অগ্রসর হতে পারছে। ও.আর.টি টেলিভিশনের খবর হচ্ছে, মুজাহিদ নিশানাবাজরা বহুতল বিল্ডিংগুলো থেকে অগ্রসরমান রুশ সেনাদের ওপর তীব্র গুলিবর্ষণ করে চলেছে।

              শেখানভা এবং মুসারভা স্ট্রিটের রুশ সৈন্যরা ভীষণ গোলাগোলির সম্মুখীন হয়। শেষ পর্যন্ত রুশরা ট্যাঙ্ক, কামান ব্যবহার করে। বহুতল অট্টালিকাগুলোর উপরের তলাগুলো প্রায় গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু মুজাহিদবাহিনী তার আগেই রাস্তা দু’টি থেকে সরে পড়ে। গ্রোজনীর কাছাকাছি মিচুরিনিষ্কি শহর থেকেও তীব্র লড়াই- এর খবর পাওয়া গেছে। অথচ রুশ ফৌজরা দাবি করেছিল তারা শহরটি দখল করে নিয়েছে। মুজাহিদ সূত্র থেকে বলা হয়েছে, শহরটির অধিকাংশই এখনও তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গ্রোজনীর মুজাহিদ কমান্ডার আসলান বেগ ইসমাইলিয়ভ সাংবাদিকদের বলেন, গ্রোজনীতে অনেক অঞ্চল থেকে রাশিয়ান সেনাদের পিছু হটিয়ে আগের জায়গায় ফেরত পাঠানো হয়েছে, যেখান থেকে তারা জানুয়ারির শুরুতে হামলা শুরু করেছিল।

              যুদ্ধ কভার করতে আসা সাংবাদিকরা বলছেন, মুজাহিদদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল নির্দ্বিধায় রাজধানী শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তারা খুব নিকট থেকে চারদিক দিয়ে রাশিয়ান সৈন্যদের উপর হামলা চালাচ্ছে। রুশ সেনারা এন.টি.ভিকে বলেছেন, গ্রোজনীতে মুজাহিদদের প্রিয় কৌশল হল, তারা শহরের আন্ডারগ্রাউন্ড পথ দিয়ে তিন জনের দলে বিভক্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের কারও হাতে থাকে স্নাইপার রাইফেল, কারও হাতে মেশিনগান এবং কারও হাতে গ্রেনেড লাঞ্চার। এ ধরনের দু-তিনটি গ্রুপ অগ্রসরমান রুশ ইউনিটের উপর অতর্কিতে বিভিন্ন দিক থেকে হামলা চালায়। রাশিয়ানরা কামান ও ট্যাঙ্ক বাহিনী ডেকে আনার আগেই মুজাহিদরা ঐ এলাকা থেকে সরে পড়ে। সম্প্রতি যে রুশ সেনাপতি মিখাইল মালোফিয়েভ চেচেন গেরিলাদের হাতে মারা পড়েছেন, তিনি এই ধরনের একটি দলের হাতেই ধরা পড়েন। রাশিয়ার ইটারতাস নিউজ এজেন্সী জানাচ্ছে, চেচেনদের প্রতিরোধ এত তীব্র যে, সারাদিন কয়েক শ’ হাত এগুতে পারলেই তাকে রুশরা বড় সাফল্য মনে করছে।

             .পি. জানাচ্ছে, ইদানিং রাশিয়ান সৈন্যরা দিনের বেলায় বিল্ডিংগুলোর দখল নেয় এবং রাতের বেলা তা পরিত্যাগ করে পালিয়ে আসে। চেচেন মুজাহিদদের আক্রমণের ভয়ে রাশিয়ানরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে রয়েছে।

              দুঃখের কথা হচ্ছে, ক্ষুদ্র দেশ চেচেনিয়ার ধ্বংসযজ্ঞ সমগ্র পৃথিবী নীরব হয়ে অবলোকন করছে। একমাত্র চেচেন মুজাহিদরা শীত ও বরফপাতকে উপেক্ষা করে সামান্য অস্ত্র নিয়ে অসীম বীরত্বের নজির রাখছেন। আল্লাহ্‌ ছাড়া তাদের সহায়তা করার জন্য কেউ নেই। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার বডি এ সম্পর্কে ভোটাভুটি করেছে। রুশ বিদেশমন্ত্রী তাতে উপস্থিত ছিলেন। তারা কিন্তু রাশিয়ার ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি বা কোন কড়া বিবৃতিও দেয়নি। বরং বলেছে, চেচেন সংঘাত শেষ করার জন্য রাশিয়াকে তিনমাস সময় দেওয়া উচিত। এ হচ্ছে পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের নমুনা।

              

অভিজ্ঞ বিশ্লেষকরা কি ভাবছেন

            চেচেনদের দেশ রুশরা জয় করে। চেচেনরা চাচ্ছে রুশ পরাধীনতার এই বন্ধন ছিন্ন করতে। চেচেনদের এই স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যদি সাহায্য করি, তবে তাতে দোষটা ঘটছে কোথায়! এই সব পত্র-পত্রিকা, মৌলবাদের নামে চেচনিয়াতে রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের সাফাই গাচ্ছে মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। আগেরকার দিন হলে এসব পত্র-পত্রিকা হয়ত লিখতো, চেচেনরা প্রতিবিপ্লবী। খতম কর চেচেন প্রতিবিপ্লবীদের। কিন্তু রাশিয়া এখন আর বিপ্লবের ধ্বজাবাহী কোন দেশ নয়। চেচনিয়ায় রুশ অভিযান এখন একটি নিছক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন মাত্র। সে হিসাবেই তার ব্যাখ্যা দিতে হয়। মুসলিম মৌলবাদের ভয়ে, এই নির্মম সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে সমর্থন করা যায় না। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে রুশরা এই অঞ্চলকে প্রথম দখলে আনতে পারে। কিন্তু চেচেনরা সুযোগ পেলেই করেছে বিদ্রোহ। ১৮৬৭, ১৮৭৭, ১৯০৫-এর চেচেন বিদ্রোহ ইতিহাসে খ্যাত হয়ে আছে। এই সব বিদ্রোহ কোন ‘মৌলবাদী’ বিদ্রোহ ছিল না। ছিল রুশ নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হবার অভ্যুত্থান মাত্র। ১৯৪১-১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রুশ অধীনতা থেকে মুক্ত হবার মানসেই চেচেনরা গ্রহণ করতে চায় জার্মান সাহায্য। প্রতিবিপ্লবের নামে যাকে নির্মমভাবে দমন করা হয়। এ সময় নাৎসি (Nazi) বাদের প্রতি চেচেনদের কোন আদর্শিক টান ছিল না। কিন্তু ককেশাস অঞ্চলের কিছুটা জার্মানরা দখল করে নেবার পর তারা হয়ে উঠেছিল বিদ্রোহী, স্বাধীন হতে পারবে, এই আশা নিয়ে।

            ককেশাস অঞ্চল রুশ দেশ নয়। রুশরা এই অঞ্চল জয় করেছে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে। এই অঞ্চলকে তাই রাশিয়া হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে না। যদিও বর্তমানে একে দাবী করা হচ্ছে রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে।

             বর্তমানে যুদ্ধ চলেছে সরাসরি রুশ আর চেচেনদের মধ্যে। উনবিংশ শতাব্দীতে ঠিক এই পরিস্থিতি ছিল না।

চেচেনদের দেশের সঙ্গে লাগোয়া হলো জর্জিয়া। তারাও চেচেনদের সঙ্গে যুদ্ধের কথা ভাবছে না। কয়েক বছর আগে তারা স্বাধীন হয়েছে রুশ নিয়ন্ত্রণ থেকে। আজ চেচেনদের বলা হচ্ছে মৌলবাদী। কিন্তু কোনো দেশ মৌলবাদী হবে কি হবে না, সেটা তাদের ব্যাপার, অন্য দেশের ব্যাপার নয়। ১৯৩২ সালের দিকে রুশ কমিউনিস্টরা অভিযোগ করতো চেচেনরা ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদী’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্তালিন-এর হুকুমে, ৫,০০০০০ চেচেন নর-নারী ও শিশুকে বন্দী করে নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল মধ্য এশিয়ায়। সেখানে শীতে, অনাহারে মৃত্যু ঘটেছিল বহু চেচেন-এর। যারা এত বিপদের মধ্যেও বেঁচে ছিল, ১৯৫৮ সালে তাদের ফিরতে দেয়া হয় চেচনিয়ায়। বিরাট এক ঘৃণা ও প্রতিহিংসা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে চেচেনদের মনে।

              রুশ রাজনীতিতে বর্তমানে চেচেন যুদ্ধ হয়ে উঠেছে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আগে যা ছিল না। ১৯১৭ সালে ঘটে রুশ বিপ্লব। এ সময় থেকে রাশিয়া হয়ে ওঠে বিশ্ব রাজনীতির বিশেষ বিবেচ্য। অনেকে ভাবতে আরম্ভ করে, বিশ্ব রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেবে রাশিয়া। সারাবিশ্বে সে অবসান ঘটাবে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানের৷ জাতিসত্তার সমস্যা চাপা পড়ে কিছুদিনের জন্য। কিন্তু এক পর্যায়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে শুরু হয় রুশিকরণ। রুশ ভাষা শিক্ষা সবার জন্য করা হয় বাধ্যতামূলক। রাশিয়ানরা সর্বত্রই পেতে থাকে ভাল চাকরি। এর ফলে একটা রুশ বিদ্বেষ দানা বাঁধতে থাকে। অন্যান্য ধর্মের চাইতে সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম সম্পর্কে করা হতে থাকে সবচেয়ে বেশী অপপ্রচার। এর পশ্চাতে কাজ করে চলে কেবল মার্কসবাদ নয়, প্রাচীন রুশ খ্রীষ্টীয় ধর্মবিশ্বাসও। এই ইতিহাস আমাদের দেশের অনেকেরই জানা নেই।

             রাশিয়ার অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট পুতিন, এক সময় চাকরি করতেন গোয়েন্দা বিভাগে। তিনি একজন কুচক্রী, অনেক আগে থেকেই। বর্তমানে তিনি রাজনীতিতে সফল হতে চাচ্ছেন, রুশ জাতীয়তাবাদ এবং বহু আগে থেকে সঞ্চিত ইসলাম বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে।

 

ইম্প্যাক্ট ইন্টারন্যাশনাল একটি নতুন ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিচ্ছে

            সাংহাই পাঁচ নামে পরিচিত চীন, কাজাঘিস্তান, কিরঘিজিন্তান, রাশিয়া এবং তাজিকিস্তান সম্প্রতি সন্ত্রাসবাদ, আন্ত সীমান্ত অপরাধ দমন এবং নিজ নিজ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। রাশিয়ার ইন্টার ফ্যাক্স বার্তা সংস্থা এই তথ্য জানিয়েছে। চীনের সাথে ১৯৯৬ সালে তার সাবেক প্রতিবেশী সোভিয়েত ইউনিয়নের ৪টি দেশের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবার পর সাংহাই পাঁচ কথাটির উদ্ভব ঘটে।

              এই পাঁচটি দেশ ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তাদের নিরাপত্তা প্রধানদের দু’দিনব্যাপী বৈঠকের পর একটি স্মারক সাক্ষর করে। কিরঘিজিস্তানের রাজধানী বিশকেকে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তারা তথাকথিত বিশকেক গ্রুপ গঠন করতেও সম্মত হয়। এই বিশকেক গঠনের মাধ্যমে নিরাপত্তা প্রধান জরুরী বিষয়ে অন্তত বছরে একবার বৈঠকে বসার ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। ১৯৯৯ সালের পহেলা ডিসেম্বর  কিরঘিজ প্রেসিডেন্ট আসকার আকাইয়েভ তাদের মধ্যকার বৈঠকের শুরুতে রাশিয়া, চীন, কাজাঘিস্তান তাকিকিস্তান এবং উজবেকিস্তানের প্রতি অভিনন্দন জানান। কিরঘিজ প্রেসিডেন্ট তার ভাষায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় তাদের অভিনন্দন জানান। কিরঘিজ প্রেসিডেন্ট চেচনিয়ার বিরদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং উত্তর ককেশাস অঞ্চলের আঞ্চলিক সংহতি রক্ষা এবং সাংবিধানিক শৃঙ্খলা রক্ষায় তার সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি চীন কর্তৃক সংখ্যালঘু মুসলমানদের দমন করার লক্ষ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে চীনের অভিযানের প্রতিও তার সমর্থন ব্যক্ত করেন। কিরঘিজ প্রেসিডেন্ট জিনজিয়াং- এর মুসলমান এবং তিব্বতের বৌদ্ধদের লক্ষ্য করে এই কথা বলেন।

               কিরঘিজ প্রেসিডেন্ট আসকার আকাইয়েভ আফগানিস্তানকে অস্থিতিশীলতার উৎস বলে বর্ণনা করে। তিনি মধ্য এশিয়ায় গত ২০ বছর ধরে রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনার জন্যে আফগানিস্তানকে দায়ী করেন।

              রাশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্লাদিমির রুশাইলো ঐ বৈঠকে চেচনিয়ার স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার জঘন্য পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন। কাজাধিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিরবেক সুলেমিনোভ বলেন, সন্ত্রাসবাদ আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনের ব্যাপারে স্বাধীন দেশসমূহের কমনওয়েল থেকে (সিআইএস) মধ্যে চুক্তি থাকা সত্ত্বেও আঞ্চলিক সহযোগিতার ব্যাপারেও আমাদের মধ্যে একটা ভূমিকা থাকা উচিত। রুশ এবং কিরঘিজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা ২০০০ সালে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্যে একটি পৃথক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। রাশিয়ার টেলিভিশনের খবরে একথা বলা হয়। রুশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অবৈধ চোরাচালান, মাদক ব্যবসা এবং অপহরণ বন্ধ করার লক্ষ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে।

               ‘সাংহাই পাঁচ’ নামে পরিচিত পাঁচটি দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। তারা সোভিয়েত মধ্য এশিয়ার স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী পুনর্জাগরণ প্রতিহত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সোভিয়েত মধ্য এশিয়ার ইসলামী পুনর্জাগরণ রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়ার স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের প্রতিরোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। চেচনিয়ায় অব্যাহতভাবে গণহত্যা চালিয়েও রাশিয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছে না। চেচেন মুজাহিদরা শাহাদাতের পেয়ালা পান করে মৃত্যুকে জয় করে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে গেরিলা কায়দায় রুশ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আতংকের সৃষ্টি করেছে। রাশিয়াকে চেচনিয়ায় কঠিন মূল্য দিতে হচ্ছে। মুসলমানদের বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিলেও চীন জিনঝিয়াং-এ স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া ও চীনের এই আগ্রাসী থাবা থেকে মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মুসলমানদের পরস্পর অনৈক্য বিভাজনের কারণে চেচনিয়া ও মধ্যএশিয়ার মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে। তাই নির্যাতিত মুসলমানদের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য বিশ্ব মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ইসলাম বিরোধী খোদাদ্রোহী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নির্যাতন ও নিষ্পেষণ থেকে রক্ষা করার জন্য নির্যাতিত মুসলমানদের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করার জন্য মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ সহায়তা পেলে চেচনিয়া একটি স্বাধীন মুসলিম দেশ হিসেবে অচিরেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের তাহজীব তমদ্দুনকে ভিত্তি করে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকবে।

 

               শেষ কথা

             চেচনিয়ার মুজাহিদরা মুক্তিযুদ্ধের চিরায়ত সংগ্রামকে তাদের জীবনের মিশন বানিয়েছে। কুরা ও তেরেক নদীর বরফগলা পানি আজ আর পানি নয়। মুজাহিদের খুন হয়ে জান্নাতের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এটি অসম যুদ্ধ। মানবাধিকারের বিরুদ্ধে-মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্যতম যুদ্ধ। সত্য-মিথ্যা তথা হক-বাতিলের এই যুদ্ধে দুনিয়ার কোন জাতিসংঘ, রাজা-বাদশা, শাসক সমর্থন দেবে না। এমন যুদ্ধের মদদদাতা একমাত্র আল্লাহ্‌।

               বিশ্ববিবেকের টনক নড়ুক আর নাইবা নড়ুক শহীদী নজরানা কবুল করার একমাত্র মালিক আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন। তিনি আরশের প্রভূ। তিনি প্রত্যক্ষ করছেন চেচেন যোদ্ধারা শেষ রক্তবিন্দু কিভাবে বিলিয়ে দিচ্ছে। প্রতিজন মা কিভাবে সন্তাকে, স্ত্রী স্বামীকে, বোন ভাইকে জিহাদের ময়দানে নওসার সাজে সাজিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

              চেচনিয়ায় আজকের ঘটনাপ্রবাহ, বদর, ওহুদ, খন্দক, খায়বর, তাবুক কারবালার পুনরাবৃত্তি মাত্র। যে জাতি___যে মুজাহিদ লড়ে যায় একমাত্র আল্লাহ্‌র জন্য, কালেমার ঝাণ্ডাকে সমুন্নত রাখার জন্য, সেই জাতিকে দাবিয়ে রাখে, রুখে দিতে পারে এমন শক্তি পৃথিবীর বুকে থাকতে পারে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে কাচের মত টুকরো টুকরো হয়ে গেল আমাদের চোখের সামনে, পাশ্চাত্য সভ্যতা নামক শয়তানী সভ্যতার ধ্বংসস্তূপ আমরা প্রত্যক্ষ করবো বিধ্বস্ত চেচনিয়ার মুজাহিদদের রক্তভেজা মাটি থেকে উত্থিত বিপ্লবের প্রাণশক্তির ভেতর।

                দূরপ্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্য, নিকটপ্রাচ্য, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দেশে দেশে মুসলমানদের বিপদকে আমরা ভাবি উত্থান ও জাগৃতির নবতর প্রেরণা। প্রতিটি জিহাদ ও মুক্তিযুদ্ধকে ভাবি আগামী ইতিহাস গড়ার সোনালী স্বপ্ন। জানি এ পথে ত্যাগ আর কোরবানীর যে অনুপম দৃষ্টান্ত রেখে যেতে হয় সেক্ষেত্রে আমরা তথা আজকের বিশ্বের হীনবল মুসলমান আত্মপ্রবঞ্চিত। এটি একদিকের চিত্র মাত্র। অন্যদিকে চেচনিয়া, বসনিয়া, কাশ্মীর, লেবানন, ফিলিস্তিন, আকিয়াব, পাঞ্জাব, মরোসহ দুনিয়া জুড়ে হাজারো জিন্দাদিল মুজাহিদ কাফনের কাপড় বেঁধে জিহাদের ময়দানে। আত্মপ্রবঞ্চনার বিপরীতে এ খুনরাঙ্গা ইতিহাস-ই তো আমাদের বাঁচার স্বপ্ন, অস্তিত্বের গৌরব, মুক্তির অভয় বাণী। হেরার রাজতোরণ স্পর্শের একমাত্র ঝিয়নকাঠি। মিথ্যার উপর সত্যের বিজয় অনিবার্য, জালেমের উপর মজলুমের জয় অবশ্যম্ভাবী।

               চেচেনদের মুক্তি আন্দোলন বিশ্ববিবেককে যতটা আহত করার কথা ছিল ততটা করেনি। কারণ চেচেনবাসীরা মুসলমান। ইসলাম তাদের আদর্শ। দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যেই তারা ককেসাশের এই ছোট্ট জনপদটিকে বাছাই করে নিয়েছে। পৃথিবীতে আরেকটি মুসলিম রাষ্ট্র অস্তিত্ব ঘোষণা করুক এটা বর্তমান বিশ্বের মানবাধিকারের ঠিকাদার ইহুদী-খ্রীষ্টানদের পুরোহিত, মুশরিকদের সর্দার কেউ কামনা করে না। এই সত্যের পাশাপাশি আরো একটি মুসলিম দেশ স্বাধীন-সার্বভৌম ঘোষিত হবার সাথে সাথে ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করুক এই বিপ্লবী সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ মুসলিম নামধারী! শাসকচক্রও।

              পৃথিবীর মুসলমানরা কায়মনোবাক্যে কামনা করে ইসলামের বিজয়। কিন্তু তাদের শাসকরা কামনা করে তাগুত, শয়তান এবং তাদের প্রেতাত্মাদের ক্ষমতার দাপট ও বিজয়। মুসলিম জনতাও শাসকগোষ্ঠীর চিন্তা-বিশ্বাস ও প্রেরণাগত এই ফারাক দেশে দেশে মজলুম মুসলমানদের কাছ থেকে প্রকৃত জিহাদী প্রেরণায় উজ্জীবিত মুমিনদেরকে আড়াল করে রেখেছে।

               মুসলিম উম্মাহর উপমা হচ্ছে এক দেহ, এক প্রাণতুল্য। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রায় অর্ধশত মুসলিম দেশ ওআইসিসহ ডজনখানেক বিশ্ব মুসলিম সংস্থা শুধু নির্লিপ্তই নয়__ নিষ্পৃহ এবং প্রকারান্তরে জালেম-শোষক তথা শক্রদের পক্ষে পরোক্ষ ভূমিকাই পালন করছে।

               নবী আলাইহিস সালামদের ইতিহাস প্রমাণ করে, বিভ্রান্ত উম্মত-জাতিকে জান্নাতের পথ থেকে শুধু আড়াল করে না- ভুল পথেও পরিচালিত করে। আজকের প্রেক্ষাপট আমাদেরকে নতুন করে সবক দেয়। প্রতিটি ঈমানদার স্ব-উদ্যোগে স্বেচ্ছায় নিজস্ব বিবেককে জাগ্রত করে যেখানে মজলুম মুসলমান জিহাদের ময়দানে সক্রীয় সেই সব মুজাহিদদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে হবে। সাধ্য থাকলে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে ঈমানের পরীক্ষাকে মানোত্তীর্ণ কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে।

               বাংলা সেই মুসলিমদের জনপদ, যাদের ইতিহাস বালাকোটকে স্পর্শ করেছিলো। তীতুর বাঁশের কেল্লা- মুহাম্মদী আন্দোলন, ফারাইজীদের জেহাদকে সামধিকভাবে অর্থবহ করে তুলেছিল।

             ফিলিস্তিন উদ্ধার, বায়তুল মোকাদ্দাস  দখলমুক্ত করতে বংলার বহু দামাল ছেলে প্রত্যক্ষ জেহাদের ময়দানে শাহাদাতবরণ করেছে। কারণ ঈমান ও ঈমানদারের কোন নির্ধারিত ভূখণ্ড নেই। আল্লাহ্‌ জমিনের যেখানেই দ্বীনের আওয়াজ উঠবে, যেদিক থেকেই জিহাদের ডাক আসবে, মুমিন-মুজাহিদ হাজির হবে। যার যা আছে সবটুকু পূজিকে বিনিয়োগ করবে জেহাদের জন্য।

               রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিন যখন এ যুগের আবরাহার মত দম্ভ করে বলেন, চেচনিয়া থেকে আর সৈন্য সরবে না, সেই সাথে কম্পিত হৃদয়ে এই কথা বলতে বাধ্য হন ১৯৯৫-৯৬ সালে সৈন্য প্রত্যাহার ভুল হয়েছিল। আবার এই কথাও বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে বাধ্য হন, আজ তাদের সামনে খোলা পথ দু’টো। হয় বিপ্লবী চেচেনদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া, স্বাধীনতার স্বপ্ন-সাদ গুড়িয়ে দেয়া, নয়তো চেচনিয়াকে চেচেনদের হাতে রেখে রুশ সৈন্যের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।

             কথিত সেই বিশ্ববিবেক যাই ভাবুক, তাবেদার মুসলিম শাসকরা যাই বলুক, আমরা আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করে দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি, চেচেনদের সামনে এখন আর কোন বিকল্প পথের সন্ধান নেই। আছে মাত্র একটি পথ। জিহাদের পথে আজাদী, মুক্তি, দ্বীনের বিজয় ঘোষণা। ইনশাআল্লাহ্‌ বিশ্ববাসীকে অবাগ করে আল্লাহর সৈনিকরা সেই বিজয়ের ডংকা অচিরেই বাজাবে। আমরা যারা কোন না কোন বাহানায় মুখ ফিরিয়ে রাখবো, তারা প্রতারিত হবো নিজেদের কাছে, প্রবঞ্চিত হবো সময়ের কাছে। কারণ জিহাদের পথে হারাবার কিছুই নেই। বিজয় যেমন আল্লাহ্‌র সেরা দান, তেমনি শাহাদাতও শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। বদর-ওহুদ খন্দক-খায়বরের পথ ধরে মিল্লাতে ইব্রাহীম (আঃ)-এর উত্তরসূরিরা রাসূলে করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উম্মতরা যখন সামনে কদম ফেলে তখন পেছনের কদম মাটি থেকে যেই না আলগা করে নেয়, তখন সে শুধু সামনে বাড়ায়, আর পেছনে তাকায় না, সেই কদম সামনে ছাড়া আর পেছনের মাটি স্পর্শ করে না। চেচেনদের অগ্রাভিযান সাময়িক হয়তো বাঁক ঘুরবে। কিন্তু আল্লাহ্‌র এই সৈনিকদের গতিরোধ করে এই সাধ্য কারো নেই।

              এমনও হতে পারে, বস্তুবাদী সভ্যতা নামক বন্য সংস্কৃতির ধ্বংস্তূপের উপর দাঁড়াবে চিরায়ত সত্য-সুন্দরের অনুপম আদর্শ ইসলাম-চেচনিয়া হবে এর অন্যতম পশ্চাৎভূমি। ইউরোপের ভাঁড় ইয়েলৎসিনের উত্তরাধিকার পুটিনের দম্ভ-অহংকার হয়তো বিধ্বস্ত করে দেবে চেচনিয়াকে, কিন্তু সেই বিধ্বস্ত-বিরাণ জনপদ থেকে বিপ্লবের যে বৃক্ষ গজিয়ে উঠবে, সেটি হবে রুশ সাম্রাজ্যের শেষ ধ্বংস তিলক এবং কমিউনিজমের আত্মাহীন দেহে শেষ পেরেকটির উপর কালেমার হাতুড়ীর শেষ আঘাত।

তথ্যসূত্রঃ জাতীয় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধাম

কৃতজ্ঞঃ বিষয় সংশিষ্ট সকল লেখকের প্রতি