JustPaste.it

কাছে খেকে দেখা

 

লাহোর থেকে কান্দাহার

সৈয়দ মবনু

             পাকিস্তানের জন্মের সময় এ গ্রহে আমার অস্তিত্ব-ই ছিল না। পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ হওয়ার সময় আমার বয়স মাত্র এক বছর। দেখিনি ইতিহাসের এই পর্ব। আমাদের প্রজন্মের ছেলেরা আজ বিভ্রান্ত ইতিহাসের এই পর্ব নিয়ে ভারত কেন্দ্রিকতার স্পর্শে ১৯৭১ সালের পর আমাদের ইতিহাস অস্পষ্ট। আমরা জানি পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল কালেমার স্লোগানে। বলা হতো, “পাকিস্তান কা মতলব কেয়া-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্”। আবার আমরা জানলাম, পাকিস্তানী মুসলমানেরা ইসলামের নাম নিয়ে বাংলার মুসলমানদের উপর নির্যাতনের সর্বপ্রকার স্টীমরোলার চালালো, মা-বোনদের ইজ্জত হরণ করলো। লুটে-পুটে নিয়ে গেলো ধন-জন-ইজ্জত। কেন? তারা এমন করলো কেন? আমরা কি অপরাধ করেছি তাদের কাছে? তবে তারা কি আমাদেরকে মুসলমান মন করে না? না এটা ছিল নেতৃত্বের লড়াই? হতে পারে। আওয়ামী লীগ ও পিপল্স পার্টি দু'টি-ই কিন্তু সেক্যুলার সংগঠন। ওদের মাধ্যমে ইসলাম আসতে পারে না। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ কি জানে, ১৯৭১ সালে বাংলার মুসলমানদের উপর তারা কি নির্যাতন করেছিল?

             পাকিস্তানের সাথে, পাকিস্তানের জন্মের সাথে বাংগালী মুসলমানদের একটা ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দুদের বড় অংশই ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে। বিশেষ একটি অংশ ছিল বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত। ওদের সাথে মুসলমানদের হৃদয়ের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বিশ শতকের শুরুতে তাও ভেঙ্গে গেল। ইংরেজরা যেহেতু মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে ভারতবর্ষের ক্ষমতা অবৈধভাবে দখল করেছে, তাই তাদের সংঘাতটা মুসলমানদের সাথেই বেশি ছিল। হিন্দুরা এটাকে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছে। তাদের মধ্যে যারা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে, তারা খুব সচেতন ছিল, যাতে মুসলমানরা ক্ষমতা ফিরে না পায়। হিন্দুদের এই ষড়যন্ত্রের নীল নকসা মুসলমানরা প্রত্যক্ষ করল বিশ শতকের শুরুতে। ভারতের বড় লর্ড কারজনের সময় প্রশাসনিক সুবিধার্থে ১৯০৫ সালে উত্তর ও পূর্ব বাংলাকে আসামের সাথে যুক্ত করে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' নামে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। এই প্রদেশের রাজধানী ঢাকায় করে এখানে একটি আইনসভাও প্রতিষ্ঠিত হয়। কংগ্রেসের হিন্দু মহোদয়গণ তা মেনে নিতে পারলেন না। তারা জানতেন, যদি ঢাকা একটি প্রদেশের রাজধানী হয়ে যায়, তবে মুসলমানরা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে যাবে। তাই তারা বঙ্গ ভঙ্গ রদ আন্দোলন শুরু করলেন। এই আন্দোলনের ফলে শেষ পর্যন্ত ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ বঙ্গ বিভাগ রদের সুপারিশ করেন। ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে আহুত দিল্লীর দরবারে বঙ্গ ভঙ্গ রদের ঘোষণা করা হয়। এরপর মুসলমানরা স্পষ্ট বুঝে ফেলেন যে, এ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম নামক ইংরেজের হাতে ১৮৮৫ সালে জন্ম নেওয়া কংগ্রেসও মুসলমানদের শত্রু। ইংরেজরা চাচ্ছে তাদের পর ভারতবর্ষে হিন্দুদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে। এই উদ্দেশ্যেই তারা কংগ্রেসের জন্ম দিয়েছে। কংগ্রেসের সাথে মুসলমানদের সহাবস্থান চলবে না। কংগ্রেসের মাধ্যমে মুসলমানদের কোন অধিকার আদায় হবে না। তাই ১৯০৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ঢাকায় উপমহাদেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে নবাব সলিমুল্লাহর প্রস্তাব অনুসারে সর্বসম্মতিক্রমে ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত এই মুসলিম লীগের আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসেবে পাকিস্তানের জন্ম।

                  মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির স্বপ্নদ্রষ্টা বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক কবিসম্রাট ডঃ আল্লামা ইকবাল। ১৯৩০ সালে তিনি এক বক্তব্যে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির প্রস্তাব করেন। পরে ১৯৩৩ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকাগুলোর জন্য ‘পাকিস্তান' নামের উদ্ভাবন করেন। এরপর আন্দোলন, নির্বাচন, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের জন্ম। এই পাকিস্তান কিংবা পাকিস্তানের চিন্তাই আসতো না, যদি বাংলার কৃতিসন্তান নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম লীগ গঠনের প্রস্তাব না করতেন। যদি শেরে বাংলা ফজলুল হক ১৯৪০-এর লাহোর অধিবেশনে ঐতিহাসিক প্রস্তাব না করতেন, তবে ভারতবর্ষে পাকিস্তান আন্দোলন গর্জে উঠতো না। যদি ১৯৪৬ সালে বাংলার মুসলমানরা মুসলিম লীগকে নির্বাচনে ভোট দিয়ে বিজয়ী না করতো, তবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র বাস্তবে রূপ নিতো না। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের বিজয়ের জন্য যদি বাংলার মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরায়ার্দী চেষ্টা না করতেন, তবে কি জিন্নাহ- লিয়াকত আলীরা বিজয়ের মালা গলায় দিয়ে মুচকি হাসি হাসতে পারতেন? এখন প্রশ্ন হলো যে, বাংগালী মুসলমানেরা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম দিলো তারাই আবার কেন ভাংতে গেল?

              এইসব প্রশ্ন আমার কিংবা আমাদের প্রজন্মের অনেকের। এই প্রশ্নগুলোকে সামনে নিয়েই দীর্ঘদিন থেকে ভাবছি পাকিস্তান সফরে যাবো। শেষ পর্যন্ত আমি, আমার বন্ধু আবু উমর মোহাম্মদ মোস্তফা এবং আবুল কাসেম সিদ্ধান্ত নিলাম পাকিস্তান সফরের।

              ২৭শে ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯ ইংরেজী সকাল ৯টায় আমরা বার্মিংহ্যাম এয়ারপোর্ট থেকে কে.এল.এম বিমানে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। হুল্যান্ডের আমস্টারডাম বিমানবন্দর থেকে কে.এল.এম-০৪৪৯ ফ্লাইট আমাদেরকে নিয়ে এই দিন দুপুর ১টায় করাচীর পথে যাত্রা শুরু করে।

           

করাচী এয়ারপোর্ট

             আট ঘণ্টা চলার পর বিমান আকাশের কালো মেঘ ঠেলে নিচের দিকে যেতে লাগলো। যেতে যেতে একসময় সে তর্জনী দিয়ে দু'পা মাটিতে রাখলো। এরপরই এলিয়ে দিলো সমস্ত শরীর। সবার মধ্যে চঞ্চল ভাব। অদৃশ্য থেকে কণ্ঠ ভেসে এলো, “সম্মানিত যাত্রীবৃন্দ! আমরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, আমাদের প্লেন এইমাত্র করাচী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে। আগামীতে আবারও দেখা হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে জানাচ্ছি যে, আপনাদের ভ্রমণ শুভ হোক।” কর্তৃপক্ষের এই আশির্বাদ বাণীটি ডাচ্‌, ইংরেজী ও উর্দুতে প্রচার করা হলো। উর্দু ভাষায় আনাড়ী একটা লোক এখানে উর্দু বলেছে। বিদেশী বিমানে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও এই অসহ্য জিনিষটা মাঝে মধ্যে সহ্য করতে হয়। আমরা এতো টাকা দিয়ে তাদের সাথে ভ্রমণ করি তারা কি আমাদের স্বার্থে এজন প্রকৃত বাংলাদেশীকে চাকুরী দিতে পারে না? কে.এল.এম-০৪৪৯ তার নির্ধারিত গেইটে থামলো। করাচী বিমানবন্দর (যাকে উর্দু ভাষায় হাওয়াই আড্ডাখানা বলে) এর আন্তর্জাতিক কাস্টম লাউঞ্জেও পা দিতেই স্মরণ হলো আমার সোনার বাংলার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কালচার। না, কোন ব্যবধান নেই। দালালরা এখানেও আছে। আমাদেরকে দালালদের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে। ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় তারা জানতে চাইলেন, “স্যার! মাল তো জিয়াদা নেহি, আগার চাহে তো হাম মদদ কর ছেকতে?” একজন নয়, এক এক করে পাঁচজন একই কথা বললেন। অবশেষে একজনকে আমার অসহ্যের কথা জানিয়েই দিলাম। এর পর আর কেউ আসেনি। পানির মত পরিষ্কার আমাদের সব কিছু। দালালের কি প্রয়োজন? ইমিগ্রেশন শেষে বেরিয়ে দেখি খলিল দাঁড়িয়ে। বার্মিংহামের লোক। লেখাপড়া করে করাচিতে। তার সাথে টেলিফোনে আগে যোগাযোগ হয়েছে। একশত রুপি দিয়ে গাড়ি ভাড়া করা হলো। মালপত্রসহ আমরা গাড়িতে উঠলাম। ড্রাইভার পুলিশকে সেলামি দিয়ে যাত্রা শুরু করলো।

 

খলিলের ফ্লাট

             গাড়ি এসে থামলো গুরু মন্দির কলোনিতে। দেখতে প্রায় আজিমপুর কলোনির মতো। ভাড়া পরিশোধ করে আমরা হাঁটতে শুরু করি। সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে উঠতে প্রায় ক্লান্ত হয়ে গেলাম। পাঁচ তালার উপর খলিলের ফ্লাট। উঠতে একটু কষ্ট হলেও ফ্লাটের পরিবেশ খুব আরামদায়ক। খলিলের সাথী মাওলানা শামীম আমাদের জন্য খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। আমরা সবাই খুব মজা করে খেলাম। এখন ঘুমানোর পালা। রুমে ফ্যান থাকলেও আমরা ব্যবহার করিনি। শত গরম হলেও ফ্যান চালিয়ে ঘুমাতে আমার অসহ্য লাগে। জানালা খোলা। তাই খুব আরামদায়ক কুদরতি বাতাস আসছিলো। একটু আয়েশ করেই ঘুমালাম।

ফজরে ঘুম ভাংলো চারিদিকে আজানের ধ্বনি শোনে। শয়তান এসে বিছানা গরম করছে যাতে না উঠি। ইস্তেগফার করতে করতে উঠে গেলাম। অজু করে নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াতে বসলাম। দীর্ঘদিন পর সকালের কোরআন তেলাওয়াতের সাথে কাকের কা-কা, কাক-চড়ুই-এর কিচির মিচির শুনতে খুব মধুর লাগছে। বৃটেনে সাধারণত এমন পরিবেশ পাওয়া খুব দুষ্কর। তেলাওয়াত শেষে খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়ালাম।

এক রাশ মুক্ত বাতাস এসে শরীরে লাগলো। এই ফ্লাট শহর থেকে অনেক উঁচুতে হওয়ায় বাতাসে শহরের কোলাহলের স্পর্শ নেই। করাচী আরব সাগরের তীরে অবস্থিত। এক সময় এটি পাকিস্তানের রাজধানী ছিল। পরে তা পরিবর্তন করে ইসলামাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তানের বিশিষ্ট রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ডঃ ইসরার আহমদের মতে পাকিস্তান ভাঙ্গার কারণগ একটি হচ্ছে রাজধানী পরিবর্তন।

(নেদায়ে খিলাফত, ডিসেম্বর ১৯৯৬ সংখ্যা)

করাচী শহরের ভেতরে প্রবেশ করলে বুঝাই যায় না যে, এটা সাগর-তীরের শহর। তবে খলিলের ফ্লাট থেকে কিছুটা অনুভব করা যায়। বাতাসে একটু একটু ঠান্ডা লাগছে। খলিলের ফ্লাটে সবচাইতে আকর্ষণীয় হলো কলিং বেল। টিপ দিলেই বলে উঠে-“আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ”।

 

মুফতি জাকির তার সাথীদের সাথে পরিচয়

জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এক সময় ভুলে গেলাম নিজের অবস্থান। এর মধ্যে কে কলিং বেলে টিপ দিলো। দু'তিনজন এক সাথে প্রবেশ করলেন। বাংলায় কথা বলছেন, বুঝলাম, তারা বাঙালী। পরে বুঝলাম, তারা এসেছেন আমাদের সাথে দেখা করতে। তিনজনের একজন হলেন মুফতি জাকির। তিনি করাচীর সুপরিচিত একজন বাঙালী আলেম। নাজিমাবাদের মাদ্রাসায়ে ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। তাঁর সাথে রয়েছেন মাওলানা আব্দুর রহমান ও মাওলানা সিদ্দিকে আকবর। তারাও বর্তমানে করাচীর অধিবাসী। তাদের কারো সাথেই আমার পূর্ব পরিচয় নেই। আলোচনার মাধ্যমে জানতে পারলাম, তারা ইতিপূর্বে আমার লেখার সাথে পরিচিত। দীর্ঘ সময় তাদের সাথে আলোচনা হলো। বিদায়ের বেলা মুফতি জাকির ভাই তার মাদ্রাসায় দাওয়াত করে গেলেন।

 

জাকির ভাইয়ের মাদ্রাসা রশিদ ট্রাস্টের মসজিদ

পাকিস্তানের এক এক কলোনী বিরাট বিরাট এলাকা নিয়ে। মুজাহিদ কলোনী নাম শুনে কেউ ভয় পেয়ে যেতে পারেন তবে ভয়ের কিছু নেই। নামে মুজাহিদ কলোনী হলেও এটি একটি সাধারণ মহল্লা। আসরের নামাজের সময় আমরা মুজাহিদ কলোনীতে পৌঁছি। চার নম্বর মুজাহিদ কলোনী, নাজিমাবাদ হলো জাকির ভাইয়ের ইসলামিয়া মাদ্রাসা। মাদ্রাসার পাশেই রশিদ ট্রাস্ট। এটা মুফতি রশিদ আহমদ সাহের নামানুসারে। এই ট্রাস্টে রয়েছে মাদ্রাসা, মসজিদ, দারুল ইফতা। ‘জরবে মুমিন’ নামক একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হয় এখান থেকে। মুফতি রশিদ আহমদ বর্তমান পাকিস্তানের একজন বয়োবৃদ্ধ বিজ্ঞ আলেম। মাওলানা সিদ্দিকে আকবর আমাকে রশিদ ট্রাস্টের মসজিদে আসরের নামাজ পড়তে নিয়ে গেলেন।

এক আজিব অবস্থা। মসজিদের গেইটের দু'পাশে দুটি সামরিক চৌকি। পাকিস্তানে অবস্থানকালে আমি যে দিনই যে মুহূর্তে সে দিকে এই চৌকির ছিদ্রগুলোর দিকে দৃষ্টি দিয়েছি, তখনই দেখেছি দু'একটা মানুষের চোখ। অর্থাৎ প্রতি মুহূর্ত সতর্ক পাহারা চলছে। এছাড়া মসজিদের গেইটের বাইরে একজন এবং ভেতরে একজন ক্লাশিনকভ নিয়ে দাঁড়িয়ে। অপর একজন প্রবেশরত মুসল্লীদেরকে তন্ন তন্ন করে তল্লাসী করছেন। আমরা সকল ঝামেলা শেষে ভেতরে গেলাম। জামাত শুরু হওয়ার দু'এক মিনিট পূর্বে আরেকজন ক্লাশিনকভ নিয়ে মসজিদের আঙ্গিনার দিকে প্রবেশ করলেন। খুব সতর্ক দৃষ্টিতে চারিদিকে দেখলেন। চলে গেলেন। কিছু সময় পর ইমাম সাহেবকে সাথে নিয়ে আবার ফিরে এলেন। এই ইমাম সাহেবই হচ্ছেন মুফতি রশিদ আহমদ। জামাত শুরু হলো। মসজিদের মিম্বরের উপর ক্লাসিনকভ হাতে একজন দাঁড়িয়ে রইলেন। হয়তো তিনি আগে নামাজ পড়ে নিয়েছেন। অথবা পরে পড়বেন। যদি সাথী আগে আমায় এসব দৃশ্যের কথা না বলতেন, তবে হয়তো কিছুটা ভয়ই পেতাম। তবে দৃশ্যটা খুবই অসহ্যকর। যুদ্ধের ময়দান কিংবা ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ভারত হলে তা মেনে নেওয়া যেত। পাকিস্তানের মতো একটি মুসলিম দেশ, যার জন্ম ইসলামের ভিত্তিতে সেখানে এই দৃশ্য কষ্টদায়ক। এটা হয়েছে শিয়া-সুন্নী সংঘাতের কারণে। বছর দু'য়েক আগে শিয়ারা এই মসজিদে ব্রাশ ফায়ার করে সেজদারত পাঁচ-ছয়জন মুসল্লীকে শহীদ করে দিয়েছিল। তাই মসজিদ কর্তৃপক্ষ এই ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছেন। শিয়াদের ভয়ে শুধু এই মসজিদ-মাদ্রাসাই নয় বরং গোটা পাকিস্তানের সকল মসজিদ-মাদ্রাসায় কমবেশি এমন অবস্থা। আসরের নামাজ পড়ে আমরা ইসলামিয়া মাদ্রাসায় চলে আসি। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মুফতি জাকির। শিক্ষকের মধ্যে বাঙালী, পাকিস্তানী, পাঠান রয়েছেন। ছাত্রদের অনেকেই বাঙালী। প্রায় তিন-সাড়ে তিনশ' ছাত্র এই মাদরাসায়। সবার জন্য ফ্রি লেখাপড়া এবং থাকা-খাওয়া। মুফতি জকির সাহেব আমাদের জন্য খুব সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা করেন।

 

করাচীর বাঙালী

করাচীতে যে এত বাঙালীর বসবাস তা আমার আগে জানা ছিল না। ইংল্যান্ডের বাঙালীদের মত করাচীর বাঙালীরা প্রায় স্থায়ী হয়ে গেছেন। সেখানে বয়স্করা ভালোভাবে বাংলায় কথা বলতে পারলেও নতুন প্রজন্ম উর্দু মিশিয়ে বাংলাকে খিচুড়ি করে ফেলে। নতুন প্রজন্মের বাঙালীকে পাকিস্তানে ঠাট্টা করে ‘ফটোস্ট্যাট বাঙালী’ বলা হয়। বিশেষনটা আমার কাছে এক প্রকারের গালি মনে হয়েছে। যাদেরকে সম্ভব হয়েছে নিষেধ করেছি এমন শব্দ ব্যবহার করতে। ওদের পরিচিতি হতে পারে ‘পাকিস্তানী বাঙালী’।

জাকির ভাইয়ের মাদ্রাসায় খাওয়া-দাওয়া করে বিদায় নিলাম। মাওলানা শামীমকে নিয়ে তিন হাট্টি বাঙালী কলোনীতে গেলাম। টেক্সি থেকে নেমে বস্তির ভেতরে যাওয়ার পথেই দেখা হলো মাওলানা ইউনুসের সাথে। তিনি স্থানীয় বাঙালী মসজিদের ইমাম। মাওলানা শামীমের পূর্ব পরিচিত। আমাদের পরিচয় দেয়া হলো। হুজরাখানায় (ইমাম সাহেবের ঘর) আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো। কিছু সময়ের মধ্যে বেশ কিছু বাঙালী সমবেত হয়ে গেল।

তাদের কাছে জানতে চাইলাম, করাচীতে আপনারা কিভাবে অবস্থান করছেন?

তাদের মধ্যে সবচাইতে যিনি বয়ঙ্ক তিনি উত্তর দিলেন, আমাদের অনেকই এসেছে ত্রিশ-চল্লিশ বছর পূর্বে। তখন বাংলাদেশ পাকিস্তান এক ছিল। আর অনেকে এসেছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে। এখানে সরকারীভাবে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত অনেকে দেশ থেকে পরিবার নিয়ে এসেছে। এরপর আস্তে আস্তে সরকারী খাস জমির উপর বাড়ী ঘর তৈরী করে বস্তির পর বস্তি গড়ে উঠেছে। করাচীতে প্রচুর বাঙালী বস্তি রয়েছে। সরকারী হিসাব অনুযায়ী গোটা পাকিস্তানে কয়েক লাখ বাঙালী রয়েছে। মুসলিম লীগ সরকার ওদের কতিপয়কে সনাক্তি কার্ড অর্থাৎ নাগরিকত্ব এবং কতিপয়কে কাজের অনুমতিক্রমে সেটেল করার চিন্তা করছিল। অবশ্য আমাদের পুরাতন অনেকেরই সনাক্তি কার্ড আছে। তা ছাড়া এখানে ছাত্র ভিসায় প্রচুর বাঙালী আছেন।

-সরকারের এই উদ্যোগে আপনারা কতটুকু খুশি?

-হ্যাঁ! আমরাও চাই এমন একটা কিছু হোক।

জানতে চাইলাম, পাকিস্তানের সরকার ও সাধারণ মানুষ বাঙালীদের সাথে কি ধরনের ব্যবহার করে?

তাদের মধ্য থেকে একজন উত্তর দিলেন, বর্তমান সরকারের ব্যবহার ভালো। বেনজির ভুট্টোর দল ক্ষমতায় গেলে বাঙালীদের খুব নির্যাতন করে। বর্তমানে আমাদেরকে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে। বেনজির ভূট্টোর সময় বাঙালীদেরকে পিপলস্‌ পার্টি ও আলতাফ হোসেনের কওমী মুহাজির দলের কর্মীরদের সাথে পুলিশও নির্যাতন করতো। ১৯৭১-এর হিংসায় ভুট্টোর দল বাঙালীদেরকে সহ্যই করতে পারে না। নওয়াজ শরীফ ক্ষমতায় আসার পর অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মুসলিম লীগ সর্বদাই বাঙালীদেরকে সমিহ করে। মাঝে- মধ্যে দু’ একজন ছাড়া এবং পিপলস্‌ পার্টির কর্মী ও নেতারা ছাড়া বাকি মানুষদের স্পষ্ট বক্তব্য যে, দুই নেতায় ক্ষমতা নিয়ে যুদ্ধ করে পাকিস্তান ভেঙ্গেছে। সাধারণ মানুষের কোন দোষ নেই। সৈন্যরা যে নির্যাতন করেছে, তা অন্যায়। তাছাড়া যাদের মধ্যে ইসলামী অনুভূতি আছে, তারা মনে করে, বাঙালী পাকিস্তানী বড় কথা নয়। আমরা সবাই মুসলমান। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের উভয় অংশে যারা নেতৃত্বে ছিল তাদের বেশির ভাগ ছিল ধর্মীয় অনুভূতিহীন।

- আলতাফ হোসেন মোহাজিরদের নেতা।আর আপনারা মুহাজির। সমস্যাটা কোথায়?

- আলতাফ হোসেন চাপাবাজ ও সন্ত্রাসী। মোহাজিরদের নাম ভাঙ্গিয়ে সে ও তার দলের লোকেরা মাস্তানী এবং আয়েশ-বিলাস করে। সে চেয়েছিল আমরা তাকে সমর্থন করি। আমরা করিনি। বাস্তবে কোন ভাল লোক তাকে সমর্থন করতে পারে না। তাই সে নারাজ। আপনাদের ইমেগ্রেশন অবস্থা কি?

- আমাদের অনেকের সনাক্তি কার্ড আছে। আবার অনেকের নেই। মুহাজির কওমী দলও বিহারীদের সংগঠন। তারা চায় আমরা বাংলাদেশে চলে যাই। আর বাংলাদেশ থেকে বিহারীরা ফিরে আসুক। এ নিয়ে আগে হাঙ্গামা হতো প্রায়। বর্তমানে দেশে ফৌজী শাসন (সামরিক শাসন) চলছে, তাই অবস্থা এখন শান্ত।

- শুনলাম এখানে পাকিস্তানীরা বাঙালীদেরকে কাজ করিয়ে পয়সা দেয় না। তা কি সত্য?

-এমন ঘটনা আমাদের জানা নেই। তাছাড়া বর্তমান জামানা সিয়াসতের (অর্থাৎ রাজনীতি)। সিয়াসতের কারণে মানুষ তিলকে তাল করে। বাংলাদেশে কি এমন ঘটনা নেই যে, কাজ করিয়ে পয়সা দেয় না, হাইজ্যাক করে সব নিয়ে যায়?

-বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ হলো করাচীর বাঙালী মহিলারা বেশির ভাগ দেহ ব্যবসার সাথে জড়িত। এখানে নাকি প্রকাশ্যে বাঙালী নারী ক্রয়-বিক্রয় হয়। এসব কি সত্য?

-এসব ডাহা মিথ্যা কথা।

বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ কিংবা ইংলিশ রোড গিয়ে যদি কেউ বলে, বাংলাদেশে বেশির ভাগ মহিলা পতিতা, তবে কি সত্য হবে?

শয়তানী সব স্থানেই কমবেশি আছে। তবে নারায়ণগঞ্জ বা ইংলিশ রোডের মতো প্রকাশ্য নয়। তাছাড়া ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারটা প্রকাশ্য হাট-বাজারের কোন বিষয় নয়। আমাদের দেশে যেভাবে বিয়ের সময় বরকে কনে পক্ষের যৌতুক দিতে হয়, তেমনি এখানের কিছু কিছু গোত্রে কনে পক্ষকে বর পক্ষের টাকা দিতে হয়। কখনো এই টাকার পরিমাণ খুব বেশি হয়ে থাকে। তাই অনেকে নিজের গোত্রে বিয়ে করতে না পেরে অন্য গোত্রে বিয়ে করে। এই সুযোগে আমাদের বাঙালী কিছু কাগুজ্ঞানহীন বদমাশ দেশ থেকে মহিলা নিয়ে আসে। এবং নিজে গার্জিয়ান হয়ে টাকার বিনিময় তাদের বিয়ে দেয়। তবে এই সব চলে অতি গোপনে।

-আপনারা বর্তমানে এখানে খুব সুখে আছেন?

-আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ্‌ সুখে রেখেছেন। আল্লাহ্‌ ছাড়া কে সুখী করতে পারে?

-এই মসজিদ কি বাঙালীদের দ্বারা পরিচালিত?

-হ্যাঁ! এই মসজিদ বাঙালীদের দ্বারা পরিচালিত। এছাড়া এই বস্তিতে আরো সাতটি মসজিদ আছে বাঙালীদের। তবে এটা প্রথম মসজিদ। প্রত্যেক মসজিদে মক্তব, মাদ্রাসা ও হিফজখানা আছে। এই যে বিরাট বস্তি দেখছেন, তা এক সময় জঙ্গল ছিল।

-এখানে বাঙালীরা সাধারণত কি কাজ করে?

-বেশির ভাগই গার্মেন্টেসে।

-বেতন কেমন?

-পিস ওয়ার্ক। কেউ দশ বিশ হাজার রূপীও রোজগার করছে। আর সর্বনিন্ম দু'তিন হাজার।

-ছেলে মেয়েদের লেখা-পড়ার কি ব্যবস্থা?

-স্কুলে যায়। প্রতিটি মহল্লায় মাদ্রাসা আছে। যাদের উৎসাহ নেই তারা এদিক ওদিক কোথাও নেই। দীর্ঘ আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে চা, বিস্কুট, পানের ব্যবস্থাও ছিল। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হওয়ার পথে দেখলাম, এক দোকানের সাইনবোর্ডে বাংলায় লেখা ‘হাসেম রেকর্ডিং হাউস। এখানে বাংলা পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ক্যাসেট, বই ইত্যাদি পাওয়া যায়।’ এছাড়া সাথে একটা পানের দোকানও আছে। পান খাওয়ার বাহানা করে দোকানের মালিকের সাথে কথা বললাম। শেষ পর্যন্ত আর পানের দাম নিলো না। বরং চা বিস্কুটের ব্যবস্থা করা হলো। দেখতে দেখতে প্রচুর লোকের সমাগম হয়ে গেল। সবাই বাঙালী। বেশির ভাগ নোয়াখালী ও ফরিদপুরের লোক। তাদের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করে বিদায় হলাম। টেক্সি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাসে উঠলাম। পাকিস্তানের বাস এমনভাবে সাজানো, যেন ময়ুরপঙ্খি। রাত তখন প্রায় বারোটা।

 

পাকিস্তানের যানবাহন

এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার জন্য প্লেইন, ট্রেন, সাধারণ বাস ও উন্নতমানের কোচ রয়েছে। ট্রেনে আবার বিভিন্ন শ্রেণীর আসন রয়েছে। লোকাল বাস সার্ভিস আছে। টেক্সি ও রিক্সা আছে। টেক্সি হলো কার। আর রিক্সা হলো বেবি টেক্সি। সেখানে টেক্সি কার বেশির ভাগ চলে গ্যাস দিয়ে। অর্থাৎ পেট্রোল প্রয়োজন হয় না। বেশির ভাগ গাড়ী দেশীয় কারখানায় তৈরী। আমাদের দেশে যাকে রিক্সা বলা হয়, পাকিস্তানে তা নেই। সেখানে টেক্সি ও রিক্সায় মিটার লাগানো আছে। তবে বেশির ভাগ মিটার খারাপ। ভাড়া প্রতি মিটার বর্তমানে তিন রূপী। ড্রাইভাররা চায় না মিটার হিসাবে যেতে। তারা চুক্তিভিত্তিক যেতে চায়। ড্রাইভার যদি পাঞ্জাবী হয় তবে সাবধান। ওরা ঝামেলায় উস্তাদ। অন্যরা কেউ ভালো কেউ খারাপ। আর যদি ড্রাইভার পাঠান হয়, তবে নিরানব্বই ভাগ ভরসা করা যায়। ওরা হলো একদাম এক কথার লোক।

 

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ' কবর

১৯০৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মুসলিম লীগের নেতৃত্বেই পরবর্তীতে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাস ভূমি হিসাবে পাকিস্তানের জন্ম হয়। মুসলিম লীগ যদিও ভারতের মুসলমানদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের পটভূমিতে সৃষ্টি হয়েছিলো, কিন্তু জিন্নাহর নেতৃত্বের পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম লীগ কোন গণসংগঠন ছিলো না। বরং তা স্যার নবাবদের বৈঠকখানার সংগঠন ছিলো।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ একটি গণসংগঠনের রূপ নেয় এবং পাকিস্তান আন্দোলনকে শক্তিশালী করে। এরপর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে জিন্নাহ একটি অধ্যায়। কেউ চাইলেও তাকে বাদ দিতে পারবে না। ইসলামের দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে জিন্নাহ কতটুকু নেতৃত্বের যোগ্য ছিলেন, তা বিবেচনার বিষয়। তবে জাগতিক দিকে, পাশ্চাত্যের রাজনীতির মানদণ্ডে জিন্নাহ বড় নেতাদের একজন ছিলেন।

করাচীতে জিন্নাহর কবর। তাই ভাবলাম একটু দেখা প্রয়োজন। মাওলানা শামীমকে নিয়ে বাদ ফজর বের হয়ে গেলাম। সাথে আবুল কাসেম। বিরাট এলাকা নিয়ে কবর চত্বর। প্লান করে বিভিন্ন প্রকার গাছ লাগানো। প্রবেশ পথে বিরাট রাস্তার মধ্যখানে পানির ফোয়ারা। এরপর মর্মর পাথরের সিড়ি। অতঃপর গম্বুজের নক্সায় বিরাট ঘর। এই ঘরের ভেতর মরহুম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কবর। সবকিছু মর্মর পাথরের। মূল কবর দু'টি গ্যালারী দিয়ে বেষ্টিত রয়েছে। এর একটি সম্পূর্ণ সোনার এবং একটি  রূপার। (আমি কিন্তু সোনা-রূপা পরীক্ষা করিনি। দেখতে সোনা-রূপার মতো লেগেছে। আমার সাথীরা বলেছে এগুলো সোনার তৈরী)।

কবরের চার দিকে চারজন সশস্ত্র সৈন্য দাঁড়িয়ে। বাইরেও সৈন্য রয়েছে। ওরা কিছুক্ষণ পর পর স্যালুট দিচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম, হায়রে নেতা! মরেও তোমাদের স্বশস্ত্র সৈন্যের বেষ্টনিতে থাকতে হয়। কোথায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শ আর কোথায় তোমাদের অবস্থান। যেমন খলিফা রেখে গেছ তেমনি ব্যবহার পাচ্ছো। কবরের উপরের মতো ভেতর না হলে সবই ব্যর্থ। আল্লাহ্‌ মাফ করুন এই জাতিকে। রক্ষা করুন আমাদের সবাইকে বিদ’আদ, অপচয় ও কবর পুঁজা থেকে।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কবর চত্বরের নিকটেই তার বোন ফাতেমা জিন্নাহ, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, যাকে শহিদে মিল্লাত বলা হয়। কারণ ১৯৫১ সালে তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায়। পূর্ব পাকিস্তানের এক সময়ের গভর্নর নূরুল আমীনের কবর। সবই মর মর পাথরের ঢালাই।

 

আল্লাহ্ ঘরের গরীবত্ব

মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্বের ভাষণে যে সকল উপদেশ বাণী উম্মতের উদ্দেশে বলেছিলে তার মধ্যে একটি হলো; তোমরা অন্যান্য জাতির মতো আমার কবরকে ঢালাই করো না। তোমরা আমার অবর্তমানে কবর পুঁজায় লিপ্ত হয়ো না। কিন্তু আজ আমরা করছি বিপরীত। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো যে, জিন্নাহ সাহেব ও তার খলিফাদের এত সুন্দর সুন্দর কবরের পাশে যে মসজিদখানা রয়েছে, তা দেখতে অসমাপ্ত চার দেওয়াল ছাড়া কিছুই বুঝা অসম্ভব। যদি দেওয়ালের গায়ে “ইয়ে মসজিদ হে” লেখা না থাকতো, তবে আমরা এটাকে মসজিদ বলে বুঝতাম না। একটি মুসলিম দেশে আল্লাহ্‌র ঘর মসজিদের এই গরীব অবস্থা সত্যিই দুঃখজনক। অন্য কোথাও এমন অবস্থা হলে মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু মর্মর পাথরের খোদাইকৃত কবরসমূহের পাশে একটা মসজিদের এই করুণ অবস্থা মেনে নেওয়া যায় না।

 

শায়খুল ইসলামের মাজারে কিছুক্ষণ

জিন্নার কবর জিয়ারত করে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি শায়খুল ইসলাম আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানী (রহঃ)-এর মাজারে। আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানী (রহঃ) দারুল উলুম দেওবন্দের হাদীসের শিক্ষক ছাড়াও একজন বিজ্ঞ রাজনীতিক ছিলেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রহঃ)-এর শিষ্য ছিলেন। শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান (রহঃ) বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক অগ্নি পুরুষ ছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষকে ‘দারুল হরব’ ঘোষণা দিয়ে ‘জিহাদ সকলের জন্য ফরজে আইন’ ফতোয়া দিয়েছিলেন। বৃটিশ সরকার যখন তাকে জেলে বন্দী করেছিলো, তখন তিনি জেলের ভেতর থেকে রেশমের তৈরী রূমালে পরবর্তী কর্মসূচী লিখে পাঠিয়ে ছিলেন। তাই ইতিহাসে এই আন্দোলনকে ‘রেশমী রূমাল আন্দোলন’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে।

শায়খুল হিন্দ (রহঃ)-এর ইচ্ছে ছিলো তার ইন্তেকালের পর এই জিহাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিবেন তারই শিষ্য মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। তাই তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে এক বৈঠকে বলেছিলেন, “ভারতবর্ষে আর শায়খুল হিন্দের প্রয়োজন নেই। এখন প্রয়োজন ইমামুল হিন্দের। আমি মনে করি বয়সে তরুণ হলেও মাওলানা আবুল কালাম সেই যোগ্যতা রাখে।” ইমামুল হিন্দ শব্দ নিয়ে সে দিনের বৈঠকে মতানৈক্য দেখা দিয়েছিলো। তাই সেই বৈঠক অসমাপ্ত থেকে গিয়েছিলো। পরবর্তী বৈঠক পর্যস্ত আর শায়খুল হিন্দ (রহঃ) এই পৃথিবীতে থাকেননি। তাই অসমাপ্ত আলোচনা অসমাপ্তই থেকে গেলো। পরবর্তীতে মাওলানা আজাদ শায়খুল হিন্দ (রহঃ)-এর চিন্তা ধারার রাজনীতি ছেড়ে করম চাঁদ গান্ধীর চিন্তাধারার কংগ্রেসে গিয়েছিলেন। তখন এই নেতৃত্বের শূন্য স্থান পূরণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন আল্লামা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী (১৮৭৯-১৯৫৭) এবং আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী (১৮৮৭-১৯৪৯)।

১৯২৮ ইংরেজীতে এই দুই সংগ্রামী আলেমের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিলো সর্ব ভারতীয় সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। কিন্তু ১৯৪০ এর পর দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রশ্নে মাওলানা মাদানী ও মাওলানা উসমানীর মধ্যে তীব্র মতানৈক্য দেখা দেয়। মাওলানা মাদানী ছিলেন অখন্ড ভারতের পক্ষে। মাওলানা উসমানী ছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্বের পক্ষে। মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী (রহঃ) অনেক চেষ্টা করেছেন মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ)-কে এই কথাটি বুঝাতে যে, অতীতে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, হিন্দ মানসিকতা সম্পর্কে। তাই আমাদের উচিত পৃথক হয়ে যাওয়া। কিন্তু মাদানী (রহঃ) তার অখন্ড ভারত দর্শনে দৃঢ় থাকেন। শেষ পর্যন্ত এই দুই চিন্তায় ভারতবর্ষের উলামায়ে কিরাম দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। ১৯৪৫ সালে কোলকাতা মোহাম্মদ আলী পার্কে শায়খুল ইসলাম মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী (রহঃ) কে সভাপতি করে ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ' নাম পরিবর্তন করে 'জমিয়তে উলামা-এ ইসলাম’ নাম রাখা হয়। জমিয়ত হয়ে গেলো দু'ভাগ, একভাগে মাওলানা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী অখন্ড ভারতের পক্ষে, অন্যভাগে শাব্বির আহমদ উসমানী (রহঃ) পাকিস্তানের পক্ষে। পাক, ভারত বাংলার প্রসিদ্ধ আলেমদের মধ্যে শায়খুল ইসলামের নেতৃত্বে জমিয়তে উলামা-এ ইসলামে সে দিন যোগ দিয়েছিলেন হাকিমুল উন্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (১৮৬২-১৯৪৩), মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী (১৮৮৭-১৯৭৪), মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ শফি, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (১৮৯৫-১৯৬৯), মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর, মাওলানা ইহতেশামুল হক থানবী, মাওলানা সৈয়দ সুলায়মান নদভী, ফুরফুরার মাওলানা আব্দুল হাই সিদ্দিকী, মাওলানা আতাহার আলী (১৮৯৪-১৯৭৬), মাওলানা দ্বীন মোহাম্মদ খান (১৯০০-১৯৭৪)। বাংলাদেশের মধ্যে শুধু সিলেট জমিয়তে উলামা এ হিন্দের একটু প্রভাব ছিলো। কারণ মাওলানা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানীর অনেক ভক্ত শিষ্য সিলেটে রয়েছেন এবং রমজানে তিনি সিলেটে প্রায়ই ইতেকাফ করতেন। তবে মাওলানা সৈয়দ সোলায়মান নদভী, মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী ও সিলেটের মাওলানা আতাহার আলী সাহেবের প্রচেষ্টায় সিলেটে পাকিস্তানের পক্ষে বিরাট গণআন্দোলন গড়ে উঠে। শেষ পর্যস্ত গণভোটে সিলেটের জনগণ পাকিস্তানের পক্ষেই রায় দেয়।

মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানীর মাজারের পাশেই মাওলানা সৈয়দ সোলায়মান নদভীর মাজার। মাওলানা নদভী রাজনৈতিক ময়দানের চেয়ে জ্ঞানের ময়দানে বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি ভারতবর্ষর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার ছিলেন। তাঁর জীবনের সবচাইতে বড় কৃতিত্ব আমার মতে ‘সীরাতুন্নবী’ গ্রন্থ। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে এই গ্রন্থের প্রথম লেখা শুরু করেছিলেন বিশ্ব বিখ্যাত জ্ঞানতাপস আল্লামা শিবলী নোমানী (রহঃ)। কিন্তু সমাপ্তির আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। পরে আল্লামা সৈয়দ সোলায়মান নদভী তা সমাপ্ত করেন। কিন্তু পাঠক বইয়ের পটভূমি পাঠ না করলে বুঝবেনই না কার লেখা কোন অংশ। অর্থাৎ জ্ঞানের দিকে সৈয়দ সোলায়মান নদভী এতই অগ্রসর ছিলেন।

 

শায়খুল ইসলামের মাদ্রাসা

আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানী (রহঃ) পাকিস্তান আসার পর করাচীতে একটি দ্বীনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাদ্রাসার পাশে একটি মসজিদও ছিলো। কিন্তু সরকার পরবতীকালে এটাকে ইসলামিয়া কলেজ করে নিয়েছিলো। বর্তমান অবস্থা শায়খুল ইসলামের চিন্তা-ধারা থেকে বহু দূরে। অর্থাৎ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এবং প্রতিষ্ঠানের পরিবেশে ইসলামী তাহাজিব-তামাদ্দুন তেমন নেই। কলেজটি তার মাজারের পাশেই অবস্থিত।

 

শাইখুল ইসলামের বাড়ী

ইসলামিয়া কলেজের পাশেই শাব্বির আহমদ উসমানী (রহঃ)-এর বাড়ীটি আজ জনৈক প্রভাবশালীর অবৈধ দখলে। অথচ এই বাড়ীতে বসে তিনি পাকিস্তানের জন্য অনেক কিছুই করেছেন। পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলনকারী এই নেতার বাড়ীকে সরকারের উচিৎ ছিলো ঐতিহাসিক কারণে সংরক্ষণ করা।

 

আফগান মরিজখানা

আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী (রহঃ)- এর মাজার, কলেজ, বাড়ী, মসজিদ দেখে ফেরার পথে হঠাৎ দেখি এক বাড়ীর গেইটে ছোট একটি সাইনবোর্ড লাগানো, “ইয়ে তালেবান মরিজখানা হে”। ভাবলাম একটু দেখে যাই। পুরাতন একটা বাড়ী, দরজা- জানালা ভাংগা। আহত ও অসুস্থ তালেবান মুজাহিদরা চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার জন্য পাকিস্তানের সরকার এই বাড়ীটি দিয়েছে। সেখানে গিয়ে মাথায় এক নতুন প্লান এলো। যদি আফগানিস্তান সফর করে যাই, তবে কেমন হয়? আমার আবার কোন কিছু মাথায় আসলে অশান্তি শুরু হয়ে যায়। তাই ভাবতে লাগলাম কিভাবে যাওয়া যায়। ভাবতে ভাবতে রুমে ফিরে আসি।

 

মাওলানা মাজহার প্রকৃত একজন ভালো মানুষ

মাওলানা আব্দুর রহমান ও মাওলানা সিদ্দিকে আকবরকে নিয়ে গুলশান-ই ইকবাল গেলাম। উদ্দেশ্য আফগানিস্তানে যাওয়ার ব্যবস্থা করা এবং আমার শ্যালক একরামুল হকের সাথে দেখা করা। গুলশান-ই ইকবালে পাকিস্তানের বিশিষ্ট পীরে কামেল হাকীম মাওলানা আখতার সাহেবের মাদ্রাসা আশরাফুল মাদারিস। একরামুল হক এই মাদ্রাসার ছাত্র। মাদ্রাসা পরিচালনা করেন হাকীম আখতার সাহেবের ছেলে মাওলানা মাজহার সাহেব। আফগানিস্তানের শিক্ষা ও চিকিৎসার উন্নয়নে তিনি ইতিমধ্যে বেশ প্রসংশনীয় কর্মসূচী হাতে নিয়েছেন। কান্দাহারের হাসপাতালটি যুদ্ধকালীন সময় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো, মাওলানা মাজহার তা মেরামত করে দিয়েছেন। বর্তমানে জামেয়া উমর নামে একটি শিক্ষা প্রকল্পে হাত দিয়েছেন। আমীরুল মুমিনীন মোল্লা উমরের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক। আমরা দুপুর বারোটায় তার সাথে দেখা করি। পরিচয় দিলাম। আসার উদ্দেশ্য বললাম। একটু হাসলেন। পাশে বসা লোকটিকে বললেন (হয়তো সেক্রেটারী) কলম কাগজ দিতে। আফগানিস্তানের নায়েবে উজিরে খারেজা (পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) মোল্লা আব্দুল জলিল সাহেবের কাছে পত্র লিখলেন। তা ছাড়া বললেন, করাচীর আফগান সফীর (অর্থাৎ আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত) মোল্লা রহমাতুল্লাহর সাথে দেখা করতে। রহমতুল্লাহর নামে একটি চিরকুট লিখে দিলেন এবং টেলিফোনে বলে দিবেন বললেন। আমরা অবশ্য মোল্লা রহমতুল্লাহকে পাইনি। কারণ যেতে যেতে অফিসের সময় শেষ হয়ে গিয়েছিলো।

 

হাবীবের নানা বাড়ী

আলহাজ্ব আব্দুর রহমান করাচীর একজন সফল ব্যবসায়ী। জাতে বাংগালী। কাপড় ও আগরের ব্যবসার সাথে জড়িত। তিনি হলেন হাবীবের নানা। হাবীব হলো আমার মেয়ে মারহামার মামাতো ভাই। সালমার মেঝ ভাই মুফতি ফয়জুল হক করাচীতে লেখা পড়া করেছেন। এরপর বিয়ে করে ভাবীসহ দেশে ফিরেন। আমি আসার আগে জানতে পারি যে, ভাবি বর্তমানে করাচীতে আছেন। তাই সালমা কিছু উপহার সাথে দিলেন। একরামুল হককে নিয়ে হাবীবের নানার গার্ডেন ইষ্টের বাড়ীতে গেলাম। সেখানে দেখা হলো হাবীবের মামা মাওলানা ইসমাইলের সাথে। বড়ই সরল-সহজ মানুষ। কথা প্রসঙ্গে জানালেন তাঁর ইচ্ছে বাংলাদেশে গিয়ে কোন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করার। কিন্তু সরকার যদি সত্যই মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করে দেয়, তবে সেই ইচ্ছা আর পূরণ হবে না। আমি তাকে আশাহত না হতে বললাম। কারণ সরকার এত বড় দুঃসাহস দেখাবে না। তাছাড়া সত্তর বছরের নাস্তিক্যবাদী শাসনের পরও রাশিয়া থেকে ইসলামকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ হয়নি। ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসকগণ অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। শেখ হাসিনা কিংবা তার দল আওয়ামী লীগের পক্ষেও তা সম্ভব হবে না। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের মত নেতাও বার বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।

 

করাচী থেকে কোয়েটা

আজ করাচী থেকে আফগানিস্তানের উদ্দেশ্যে বিদায় হবো। তারিখ ৩রা মার্চ ১৯৯৯ ইংরেজী। এখান থেকে প্রথমে যেতে হবে কোয়েটা। সকালে এয়ারপোর্ট যাওয়ার পূর্বে ভাবলাম মোল্লা রহমতুল্লাহ্‌র সাথে দেখা করবো। এত সকালে অফিসে থাকার প্রশ্নই হয় না। তাঁর বাসায় টেলিফোন করলাম। কেউ রিসিভ করলো না। শেষ পর্যন্ত না পেয়ে এয়ারপোর্ট চলে গেলাম। কোয়েটায় আফগানিস্তানের সপারতখানা (দূতাবাস) আছে। সেখানে চেষ্টা করবো। করাচী এয়ারপোর্টের অবস্থা আগেই বলেছি বাংলাদেশের মতো। আমরা বেশ ক'জন যাচ্ছি। এয়ারপোর্ট গিয়ে দেখি সীট নেই। অথচ টিকেট ওকে। শুধু যে আমাদের এই অবস্থা তা কিন্তু নয়। প্রচুর যাত্রীর একই অবস্থা। শুরু হয়ে গেল হৈ চৈ। শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ একটা উড়োজাহাজের ব্যবস্থা করলেন। সকাল ন'টায় আমরা কোয়েটার উদ্দেশ্যে আকাশে উঠলাম। যেখানে আকাশ পথে করাচী থেকে কোয়েটা এক ঘন্টায় পৌছা যায় সেখানে পাঁচ ঘন্টা লাগলো। পথে অতিরিক্ত দু'টি ষ্টপিজ নিলো। প্রথমটি নিলো টারবাট এয়ারপোর্ট এবং দ্বিতীয়টি নিলো ডালবানডি এয়ারপোর্ট। দু’টাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হয় বাসষ্টপ। একটা পাবলিক টেলিফোন পর্যন্ত নেই। দুপুর দু’টায় আমরা কোয়েটা এয়ারপোর্টে পৌঁছি।

 

কোয়েটায় এক রাত

আমরা যারা ১৯৭১ সালের পূর্বের বাংগালী সেনা বাহিনীর ইতিহাস কিছু কিছু জানি, তাদের কাছে কোয়েটা অপরিচিত থাকার কথা নয়। কারণ পাকিস্তান আমলে বাংগালী সৈন্যদের বেশিরভাগের অবস্থান ছিলো কোয়েটায়। আমরা দুপুর দ’টায় কোয়েটা এয়ারপোর্টে পৌঁছি। একটা গাড়ী নিয়ে সরাসরি আফগান সফারতখানায় চলে যাই। কর্তৃপক্ষ জানালেন যদি তালেবান গাড়ী দিয়ে সীমান্ত শহর চরম পর্যন্ত যেতে হয়, তবে আজ রাত থাকতে হবে। থাকার জন্য কোন অসুবিধা নেই। তাদের নিজস্ব মেহমানখানা রয়েছে। বেশ কিছু কারণে থাকার সিদ্ধান্ত আমরা নিলাম।

প্রথমতঃ পাকিস্তানী পুলিশদের অসৎ ব্যবহার, ঘুষ না দিলে লুট-পাট করে দামী জিনিষপত্র নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

            দ্বিতীয়তঃ আমার সাথে ক্যামেরা। আফগান সীমান্তে যদি তালেবানরা ব্যাগ পরীক্ষা করে, তবে ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে যেতে দেবে না। যদি তালেবান গ্রুপের সাথে যাই, তবে এই ভয় কম। পররাষ্ট্র দফতর পর্যন্ত যেতে পারলেই ক্যামেরার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

তৃতীয়তঃ কোয়েটা শহর দেখার লোভ। কারণ এই শহরের সাথে আমাদের সেনাবাহিনীর একটা ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে মেজর জিয়াউর রহমানের বীরত্বপূর্ণ অনেক ঘটনা আছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১-এর পূর্ব পর্যন্ত ভারতের সাথে যুদ্ধে পাকিস্তানকে বেশি ডিফেন্স করেছে আমাদের বাংগালী সৈন্যরাই।

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসেরা ভাবতে পারেন, আমি বার বার বাংগালী শব্দ ব্যবহার করে বাংগালী জাতীয়তাবাদের পক্ষ নিচ্ছি। বাস্তবে আমি কোন প্রকার জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নয়। আমি মনে করি, ১৯৭১ সালের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের পরিচিতি ছিলো বাংগালী হিসেবে। কারণ আমরা সেই সময় কখনো ভারতের অংশ আবার কখনো পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। কিন্তু ১৯৭১ সালের পর আমাদের একটি স্বাধীন দেশ হয়েছে। তাই আমাদের পরিচিতি এখন বাংলাদেশী। কারণ এখন যদি বাংগালী পরিচয় দেই, তবে প্রশ্ন আসবে কোথাকার বাংগালী? স্মরণ রাখতে হবে ভারত, পাকিস্তান, বৃটেনসহ বিশ্বব্যাপী আজ বাংগালীদের অবস্থান। আমি যে বাংগালী বলছি, তা ১৯৭১-এর পূর্বের বাংগালী।

যাই হোক কোয়েটায় বেশীর ভাগ জনসাধারণ পাঠান। আবহাওয়া প্রচন্ড ঠান্ডা। তালেবান অফিসে জিনিষপত্র রেখে একটা রিক্সা (অর্থাৎ বেবি-টেক্সি) নিয়ে শহরে চলে যাই। শহর আমাদের দেশের শহরগুলোর মতই। আমাদের উদ্দেশ্য পাগড়ী খরিদ করা। কারণ জরুরী বিষয়। আমরা সবাই একটা করে কালো পাগড়ী নিলাম। আমাদের সাথীদের একজনের খুব পানের নেশা। তার ধারণা ছিলো করাচীতে যেমন প্রতিটি মহল্লায় শত শত পানের দোকান তেমনি সমস্ত পাকিস্তানে হবে। কিন্তু কোয়েটায় এসে দেখা গেলো এখানে পানের দোকান নেই। ভদ্রলোক খুব মনঃক্ষুন্ন হলেন। আমরা বললাম, আসুন শেষ চেষ্টা করে দেখি কোথাও পাওয়া যায় কিনা। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ দেখা গেলো একটা পানের দোকান আছে। তবে দাম খুব বেশী। এক খিলির দাম চার রূপী। আমরা সবাই একটি করে খেলাম। বন্ধু মাওলানা এহসান উদ্দিন মোহাম্মদ মুহসিন অনেকগুলো পান, সুপারী, জর্দা খরিদ করলেন। আমরা অবশ্য মনে মনে খুশি হলাম, মাঝে মধ্যে খাওয়া যাবে। এর পর আমরা টেলিফোন একচেঞ্জে এসে করাচী ও বৃটেনে ফোন করি। নসরু, সালমা ও শেফার সাথে আলাপ করলাম। শেফার সাথে আলাপ করে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সে কাঁদছে।

শেফা যদিও বয়সে আমাদের ছোট, তবে সে আমার চার বোনের মধ্যে বড়। শুনেছি বড় বোন মায়ের স্নেহ নিয়ে জন্মে। আজ হলো বাস্তব হলো অভিজ্ঞতা। আমি কি আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি যে সেখানে গেলেই মরে যাবো? কিন্তু এরপরও বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, আত্মীয়, স্বজন সবাই আফগানিস্তানে যাচ্ছি শোনে আতংকিত। ভয়ে সবার চোখে পানি। বাবা তো শোনার সাথে সাথেই মাকে এক গাল শোনিয়ে দিয়েছেন; দেখছো, তোমার কারবারী ছেলে এখন আফগানিস্তানের পথে যাত্রা শুরু করেছে। অপদার্থ কোথাকার? মানুষ বৃটেনে গিয়ে টাকা উপার্জন করে আর তোমার ছেলেরা পাকিস্তান আফগানিস্তান সফর করে, পত্রিকায় লেখা-লেখি করে সময় নষ্ট করে। আফগানিস্তানে এখন যুদ্ধ চলছে। তার সেখানে যাওয়ার কি প্রয়োজন? দেখবে হঠাৎ সংবাদ পাবে তোমার ছেলের উপর বোম এসে পড়েছে। সে শহীদ হয়ে গেছে। বাহঃ কি খুশি তুমি হবে শহীদের মা। সে পাইছে কি? সে কি আমাদের সবাইকে রেখে বেহেস্তে চলে যাবে? মোটেই পারবে না। আমি কিন্তু বন্দুক নিয়ে তার বেহেস্তের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো, ইত্যাদি। আম্মা বেচারী এমনি চিন্তিত। এরপর বাবার ব্যঙ্গাত্নক কথা। আমরা যখন কিছু করি, তখন বাবা সব রাগ মাকে দেখায়। আর ভালো কিছু করলে নিজে অহংকার করে। দোষের সময় আমরা যেন শুধু মা-এর সন্তান। এটা হয়তো সব বাবাদেরই চরিত্র। আমিও এখন নিজের মধ্যে এই চরিত্র খুঁজে পাই।

যাই হোক। টেলিফোন পর্ব শেষ করে রিক্সা নিয়ে অফিসে ফিরে আসি। শীতল বায়ুর এলাকা হলেও রিক্সা অর্থাৎ বেবি টেক্সিতে ঠান্ডা এত বেশি লাগে না। কারণ দরজা আছে। বেবি টেক্সিতে দরজা জীবনের প্রথম দেখলাম।

আফগানিস্তানের কোয়েটা প্রতিনিধির নাম এই মুহূর্তে স্মরণ হচ্ছে না। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে তার সাথে দেখা করতে গেলাম। এখানে অফিস বলতে আহামারি কিছু নয়। আমাদের দেশে গ্রাম্য মক্তবগুলোতে যেমন দফতর হয় তেমনি। প্রধান অফিসার যিনি, তার উদাহরণও আমাদের দেশের গ্রামের সরল সহজ কওমী মাদ্রাসার একজন শিক্ষকের সাথে দেওয়া যায়। ছিলেনও হয়তো তাই। সালাম করে মুসাফাহা করলাম। তিনি এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগলেন; ‘ছাংগে, জুরে, তাগরে, তবিয়েত খেদে, পা খায়েরদে, শে, উহ, বাচ্চা-মাচ্ছা খেদে, হান্ডি ওয়ালা খেদে।' আমি কিন্তু কিছুই বুঝলাম না। শুধু চেয়ে থাকলাম তাঁর দিকে। পরে বুঝলাম এসব অর্থ কি। ছাংগে-কি অবস্থা? জুরে-ভালো আছেন? তাগরে-শরীর কি ভালো আছে? তবিয়েত খেদে- মেজাজ ভালো তো? পা খেয়ের দে-ভালো। শে-হ্যা ভালো। উহ-হ্যা। বাচ্চা মাচ্চা খেদে-ছেলে-মেয়ে ভালো তো? হান্ডি ওয়াল খেদে-সাথী ভালো আছে তো?

আমাদের যিনি রাহবর তিনিও এই কথাগুলো উচ্চারণ করে উত্তর দিলেন। এরপর বললাম, আমাদের উদ্দেশ্য। ভদ্রলোক মোটামুটি উর্দু জানেন। মাওলানা মাজহার সাহেবের মোল্লা আব্দুল জলিলের নামে যে চিঠি ছিলো তা এগিয়ে দিলাম। তিনি টেলিফোন হাতে নিয়ে কার কাছে জানিনা ফোন করলেন। পশতুতে কি বলে রিসিভার আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। অপর প্রান্ত থেকে শুধু নাম জিজ্ঞেস করা হলো। নাম শোনে বললেন; শোকরিয়া! উস কো দে- দো। আমি রিসিভার ফিরিয়ে দিলাম। তারা দু'জন কি যেনো আলাপ করলেন। রিসিভার রেখে বললেন, “সকালে যে গাড়ী যাবে, তাতে উঠে চলে যাবেন। রাতেই আমি ওদেরকে বলে দেবো।” আমরা ফিরে এলাম মেহমানখানায়।

 

কোয়েটা থেকে চমন

সকালে ফজরের নামাজ শেষে নাস্তা পর্ব সমাপ্ত হলো। আটটায় গাড়ীতে উঠলাম। এই গাড়ী আমাদেরকে নিয়ে যাবে পাকিস্তানের শেষ সীমান্ত চমন শহরে। চার ঘন্টা সময় লাগবে। গাড়ী চলতে লাগলো। পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে গাড়ী যতই অগ্রসর হচ্ছে, ততই নিজের মনে চঞ্চলতা উপলব্ধি করছি। অপেক্ষার চার ঘন্টা প্রায় চার শহরে অতিক্রম হলো। আমরা দুপুর বারোটায় চমন এসে পৌছি। চমন যদিও পাকিস্তানের সীমান্তে, কিন্তু পাকিস্তান সরকারের শাসন সেখানে চলে না। বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী পাঠান। সেখানের এম, পি হচ্ছেন মাওলানা আব্দুল গনি। তাঁর সাথে কিছুদিন পূর্বে বার্মিংহামে দেখা হয়েছে। দেওবন্দী আলেম। দেখেই বুঝা যায় নেক এবং আল্লাহওয়ালা। তিনি পাকিস্তান সরকারের সাথে আলোচনাক্রমে চমন এলাকায় ইসলামী শাসন ব্যবস্থা চালু করেছেন। আফগানিস্তানের মতো পূর্ণ ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত করা যাচ্ছে না, যেহেতু চমন পাকিস্তানের একটি অংশ। কোয়েটার মতো চমনের আবহাওয়াও ঠান্ডা। আমরা চমন শহর থেকে একটি গাড়ী নিয়ে আফগান সীমান্ত এলাকায় পৌঁছলাম।

(চলবে)