---জীবন পাথেয় ---
========================================
দাওয়াত প্রদানের পদ্ধতি ও কৌশল
মাওঃ ক্বারী মুহাম্মাদ তাইয়্যেব (রহ.)
-------------------------------------------------
মুসলিম জাতি কারো থেকে নিতে নয়, উপহার দিতে এসেছেন, মুসলিম জাতি পৃথিবীতে কারও নিকট হাত পাততে আসেনি,তারা এসেছে উপহার দিতে। পৃথিবীর মানুষকে তারা সত্যের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে। অন্যায় থেকে বাঁধা দিবে। আল্লাহর প্রতি ঈমানে বলিষ্ঠ থাকবে। মানুষের নিকট নবী পর্যন্ত অবিচ্ছেদ্য সনদযুক্ত দ্বীনের আহ্বান জানাবে।অথচ তাঁরা আপন দায়িত্ব ভুলে গিয়ে পৃথিবীর অন্যসব জাতির দুয়ারে আদর্শ ভিক্ষা করে ফিরছে। এটাকেই মনে করছে আসল কাজ। তারা কোন জাতির নিকট সংস্কৃতি আর কোন জাতির নিকট সামাজিক নীতির ভিক মাঙ্গছে।এক্ষেত্রে মাওলানা রুমীর একটি পংক্তি আমার মনে পড়ছেঃ
অর্থঃ "মাথায় রুটি ভরা টুকরী নিয়ে মানুষের দুয়ারে রুটির জন্য ভিক্ষা চাইছে।"
এ হীনমন্যতার শেষ কোথায়? ঘরে রুটি, মাথায় টুকরী ভরা রুটি। কিছু সামান্য কষ্ট করে হাত বাড়িয়ে সে রুটি তুলে নিয়ে খাচ্ছে না, হাত পাতছে অন্যের দুয়ারে আত্নসম্মান ভুলে গিয়ে।
মুসলিম জাতি পৃথিবীতে ভিক্ষা করতে আসেনি। বরং পৃথিবীকে কিছু দিতে এসেছে। পৃথিবীর কাছে যে রত্ন নেই সে পৃথিবীকে তা দিবে। পার্থিব সম্পদ মুসলমানদের চেয়ে ভিন্ন জাতির নিকট বহু পরিমাণে বেশি আছে। সোনা-চাঁদী আর অট্টালিকা আপনাদের চেয়ে তাদেরই বেশি। আপনি তাদেরকে উপহার দিবেন ঐ সম্পদ যা তাদের ঝুলিতে নেই। সে উপহার হল এই সনদযুক্ত দ্বীন। এই দ্বীন ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার পথ নির্দেশনা। যা বিশ্বের আর কারও হাতে নেই।
অমুসলিমদের নিকট ইসলামের আহ্বান দেয়া প্রতিটি মুসলমানদের কর্তব্যঃ
বর্তমানে সবাই অন্যকে স্ব স্ব মতাদর্শের প্রতি আহ্বান করছে। কমিউনিস্টরা কমিউনিজমের প্রতি, পুঁজিবাদীরা পুঁজিবাদের প্রতি, ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষবাদের প্রতি। আপনাদের দায়িত্ব হলো, ইসলামের প্রতি আহ্বান করা।আজ ভ্রান্ত মতবাদের প্রচারাভিযান চলছে। প্রানপণে স্বীয় মতবাদের প্রচার করা মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পৃথিবীর মানুষ শুধু ইসলামী মতাদর্শেই শান্তির দিশা পাবে। কমিউনিজম, পুঁজিবাদ আর জাতীয়তাবাদে নয়। এসব মতবাদ মুখরোচক ও ভিত্তিহীন।
ভিত্তিহীন বস্তুর কোন স্থায়ীত্ব নেই। যা সপরিমিত তাই আদী থেকে স্থায়ী এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য সে পৃথিবীর যে প্রান্তে অবস্থান করুক, যে কোন বংশের হোক সে স্বীয় মতবাদ প্রচারে যত্নবান হবে।
ছাত্রদেরকে আমি বলে থাকি, ভাই, মাদ্রাসায় এসে অথবা যে কোনভাবে দ্বীনী জ্ঞানার্জন করা ফরজ। কিন্তু শিক্ষা সমাপনীর শুধু এ কিতাবগুলিই অন্যকে পড়ানো লক্ষ্য হওয়া যথেষ্ট নয়। মাদ্রাসা শিক্ষার পরিসর সীমিত। আপনি শিক্ষার পর অপরকে শিক্ষা দিলেন। এটা একমাত্র উত্তম কাজ নয়। হ্যাঁ, তবে তালীম বুনিয়াদি বিষয়। তালীম ব্যাতীত উপায় নেই। কিন্তু শুধু এতটুকুতে পরিতুষ্ট হওয়া উচিত নয়। বরং হৃদয়ে দাওয়াত ইলাল্লাহ (আল্লাহর দিকে আহ্বান করা) এর আবেগ থাকা চাই। দাওয়াতের পন্থা এই নয় যে, সবাই একই বলবেন যে, ভাই! মুসলমান হয়ে যাও! বরং এর বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে।
দাওয়াত ইলাল্লাহর বিভিন্ন পদ্ধতিঃ
যে লোক যে পদ্ধতিতে প্রভাবিত হয় তাকে ঐ পদ্ধতিতে আল্লাহর দিকে ডাকতে হবে। কখনও কৌশলের মাধ্যমে আর কখনও উত্তম ব্যবহার দ্বারা। এতে মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করবে। সাহাবায়ে কেরাম কিতাব পড়ে দাওয়াত দেননি। কিতাব পাঠ ও পাঠদানের জন্য এক বিশেষ মহল ছিল। আর দাওয়াত দানের ক্ষেত্রে কেবল কিতাবী ইলম নয় প্রয়োজন হিকমাতেরও। কেউ চিকিৎসা করে তার ফাঁকে ফাঁকে দাওয়াত দিয়েছেন। কারণ রোগী ডাক্তারকে তার মঙ্গলকামী মনে করে। তার কথায় প্রভাবিত হয়। ডাক্তারগণ এ সুযোগে তাকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে পারেন।এ ভাবে চিকিৎসাদানের মাধ্যমে লাখো মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে।
ব্যবসার মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত ও চীনে ইসলামের শুভাগমনঃ
আবার কেউ ব্যবসার মাধ্যমে দাওয়াত দিয়েছেন। মানুষের সাথে তারা ইসলামের সুন্দরতম পদ্ধতিতে লেন-দেন করছেন। আর মানুষ স্বভাবত সুন্দর লেন-দেনে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়। এ কারনে দেখা যায়, সৎ ও সুন্দর ব্যবসা দেখে লক্ষ মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে। ইসলামকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সাহাবাগণ রাসূলুল্লাহর ওফাতের পর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন।
ইতিহাস পাওয়া যায়, আটজন সাহাবী দাওয়াতের নিয়তে ব্যবসা করতে এক এলাকায় যান। সেখানে তাঁরা ব্যবসা শুরু করেন। সততা ও সত্যবাদিতার কারণে তাঁদের দোকানে খুব বেশি বেচা-কেনা হতে থাকে।এতে অন্যদের দোকানের বেচা কেনা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ঐ ব্যবসায়ীরা তাদের উপর ক্ষেপে উঠে। তারা পরামর্শ করে এই বহিরাগত ব্যবসায়ীদের দেশ থেকে বের করতে হবে। এ মর্মে তারা সরকারের নিকট আবেদন জানাল, ভিন দেশীয় কিছু লোক আমাদের ব্যবসা ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাদের দেশ থেকে বের করে দিন। সরকার ঐ আটজন সাহাবাকে ডেকে বললো, তোমরা কি আমাদের দেশের অর্থ ব্যবস্থা ধ্বংস করতে এসেছো? সাহাবীগণ (রাঃ) বললেন, আমরা তোমাদের দেশ ধ্বংস করতে আসিনি, গড়তে এসেছি। চুরি আর আত্মসাৎ করে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করেছে তোমাদের দেশীয় ব্যবসায়ীরা। পক্ষান্তরে, আমরা লোকদেরকে সততা ও সত্যবাদিতা শিক্ষা দিয়েছি, যার প্রভাব পড়েছে দেশময়। আমরা দেশ গড়তেই এসেছি। সরকার বললো, অত কথা বুঝি না, আপনারা দেশ ত্যাগ করুন। সাহাবায়ে কেরাম প্রতিবাদ করে বললেন, আমাদের অন্যায় প্রমাণ করুন, নির্ধিদ্বায় তা স্বীকার করব। অযথা আমাদের হয়রানী করলে আমরা আপনাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে বলছি, দেশ ছাড়বো না। সরকার বললো, আপনাদেরকে দেশ ত্যাগ করতে হবে অবশ্যই। সাহাবীগণ বললেন, এই বেআইনি নির্দেশ আমরা মেনে নিতে পারি না। যুক্তির নিরিখে আমাদের ত্রুটি প্রমাণ করুন।তাহলে আমরা আপনাদের কথা মানবো, দেশ ত্যাগ করবো। পৃথিবীর সকল ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহ, কেউ বের করতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট তার পরও চাপ প্রয়োগ করলে এ সংবাদ দেশময় রটে যায়। এর প্রতিক্রিয়া স্বরুপ জনগণ সরকারকে হুমকি দেয়,
যদি এ লোকগুলোকে বের করে দেয়া হয় তবে তাদের সাথে আমরাও দেশ ছেড়ে চলে যাব। আমরা কেউ এদেশে থাকবো না। দেশের সাধারণ সব লোক সাহাবীদের পক্ষ নেয়।
মন্ত্রী পরিষদ অবস্থা দৃষ্টে প্রেসিডেন্টকে বললো, আপনি এই ভিন দেশী লোকগুলোকে বের করে দিলে আপনার রাজত্বই চলে যাবে, গোটা দেশবাসী চলে যাবে তাদের সাথে। বাদশাহ এবার নমনীয় হয়ে সাহাবীদের বললেন, তোমরা এখানে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করো। ঐ মহান সাহাবীদের বরকতে এ অঞ্চলে আজও হাজার হাজার মুসলমান বিদ্যমান।ঐতিহাসিকদের মতে, এই ঘটনাটি ঘটেছিলো চীন দেশে। এর দ্বারা বুঝা যায়, দাওয়াত প্রদানের সদিচ্ছা ও দ্বীনের দরদ থাকলে দোকানে বসেও দাওয়াত দেয়া যায়। চিকিৎসা করে আর সরকারি দফতরে বসেও দাওয়াত কার্যক্রম চালানো যায়। এমনি পন্থায় হিকমআতের সাথে দাওয়াত দিতে হয়।
মঙ্গলকামিতা ও সেবার মাধ্যমে ইসলাম প্রচারঃ কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ক্লাশে চৌদ্দ পনের জন ছাত্রের মধ্যে একজন ছিলো মুসলমান। বেচারা ছিলো খুবই নম্র, স্বল্পভাষী এবং সাধাসিধে। বাকি সবাই তাকে নিয়ে খুব উপহাস ও ঠাট্টা করত।সবাই দিন-রাত তাকে অস্থির করে রাখত। বেচারা সব কিছু সহ্য করত নীরবে। কিছুই বলত না। আল্লাহর অপার মহিমা, একবার ঐ ছাত্রগ্রুপের নেতাজী ভীষণ কঠিন এক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। সবাই তার বাঁচার আশা ছেড়ে দেয়।তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।কাছাকাছি রুম হওয়াতে মুসলমান ছাত্রটি যত্নের সাথে তার খুব সেবা শুশ্রুষা করত।পনের বিশদিন পর নেতাজী সুস্থ হয়ে মুসলিম ছাত্রটির নিকট হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে বললো, ভাই! তুমি সত্যিই ভগবান। কোন অদৃশ্য শক্তি তোমার মাঝে সুপ্ত আছে নিশ্চয়ই। আমরা তোমার সাথে এত ঠাট্টা করার পরও তুমি আমার সেবা করেছো! ইশ্বরের দোহাই, আমাদের ক্ষমা করে দাও। বাকি ছাত্ররাও তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বললো, অত্যন্ত নিকৃষ্ট ও জঘন্য ব্যবহার করা সত্বেও মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছো তুমি।
তোমার সাথে বিদ্রুপ করার পরও তুমি সেবা করেছো তার। এটা মহৎ লোকের পরিচয় বটে। এরপর সবাই তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এ মহান শিক্ষা পেয়েছ কোত্থেকে? মুসলমান ছাত্রটি বললো, আমার ধর্মই আমাকে এ শিক্ষা দিয়েছে। সব ছাত্র আবদার করল, আমাদেরকেও সে ধর্মে দীক্ষিত কর।মুসলিম ছাত্রটি তাদের নিকট ইসলামের মাহাত্ম্য তুলে ধরলে তাদের অনেকেই ইসলামে দীক্ষিত হয়।এতে বুঝা যায়, মানব সেবাও ইসলাম প্রচারের একটি প্রক্রিয়া। এমনিভাবে দাওয়াতের আরও প্রক্রিয়া রয়েছে। কেবল হৃদয়ে প্রেরণা থাকলে দাওয়াতের কাজ জোরদার হবে, স্বার্থক হতে পারে।
দাওয়াতের কাজে হিকমাত অবলম্বনঃ
হযরত মাওঃ ইলিয়াস এর বড় ভাই মাওঃ নূর মুহাম্মদ সাহেবের শাগরিদদের মধ্যে হাজী আঃ রহমান মেওয়াতী নামক একজন লোক ছিলেন। লেখাপড়া বেশি জানতেন না তিনি।তবে বুযুর্গদের সাথে তার সুসম্পর্ক ছিলো, দ্বীনি কাজে ছিলো প্রচন্ড আগ্রহ। হৃদয়ে ছিল ঈমানী জযবা। সর্বদা যিকিরে মশগুল থাকতেন। তাঁর হাতে প্রায় এক হাজার অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি শুধু কুরআনের হাফেজ ছিলেন।
তাঁর কথা বলার ভঙ্গি এতে আকর্ষণীয় ছিল যে, লোকজন তার কথা শুনে মোহমুগ্ধ হয়ে যেত।
তাঁর জীবদ্দশায় মেওয়াতে এক সাধু ব্যক্তি আসেন। লোকটি ছিলেন হিন্দু সাধক।তিনি বিস্ময়কর ও অসাধারণ সব কান্ড ঘটাতেন। এলাকায় তাঁর বেশ সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। একদিন হাজী সাহেব সাধুকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর নিকট গমন করেন। সাধু হাজী সাহেবকে খুব সম্মান ও আদর করেন এবং তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করেন।হাজী সাহেব উত্তরে বললেন, আপনাকে দেখতে এসেছি। এরপর সাধুর সাথে কথা শুরু করে বললেন, সাধু জী! আপনি একজন সাধক ব্যক্তি। অনেক বিস্ময়কর বিষয় আপনি লোকদেরকে দেখিয়ে থাকেন। সাধু বললেন, আমি ঈশ্বরের নগণ্য এক সেবক মাত্র। হাজী সাহেব বললেন, না জনাব! আপনি অত্যন্ত মহৎ লোক।
সবাই আপনার মতো মহৎ হতে পারে না। সাধুর খুব প্রশংসা করে বললেন, এ সম্মান আপনি কিভাবে অর্জন করলেন। আমাদেরকে বলবেন?
সাধু বললেন, আমি সব সময় মনের চাহিদার বিরোধীতা করি। মনের উল্টা কাজ করি। ফলে মনের চাহিদার উপর বিজয়ী হই। এখনও আমার নফস ও মন আমার নিয়ন্ত্রণাধীন। আমি মনের অনুগত নই। মন আমার অনুগত। এ দৌলত আমি বহু সাধনার পরই লাভ করেছি। হাজী সাহেব বললেন, বাস্তবিকই এ সাধনার ফলে চতুর্দিকে আপনার এত সুনাম। ইত্যাদি আরও কথা বলে শেষের দিকে ইসলাম গ্রহণ করতে আপনার মন চায় কি? সাধু উত্তরে বললেন, মোটেই নয়। হাজী সাহেব এ কথায় সাধুকে আটকে দিলেন। হাজী সাহেব বললেন, তাহলে অবশ্যই আপনাকে ইসলাম গ্রহণ করতেই হবে। না হয় আপনি নফসের নিকট পরাজিত হলেন।আপনার সারা জীবনের সাধনা বিফল হয়ে যাবে। এটা হবে আপনার নীতি বিরোধী কাজ। মনে ইসলাম গ্রহণ করার ইচ্ছা না থাকলে আপনার নীতি অক্ষুণ্ণ থাকত। কিন্তু আপনার মন যেহেতু ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী নয় তাই মনের বিরোধিতা করে আপনার ইসলাম গ্রহণ করা উচিত। মোট কথা, তিনি তাঁকে কথার মারপ্যাঁচে আটকে দিলেন। ঐ বৈঠকেই সাধু ইসলাম গ্রহণ করলেন। তার দেখাদেখি আরও অনেকে ইসলাম গ্রহণ করল।
হাজী সাহেব প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না বটে, কিন্তু বুযুর্গদের সাথে ছিলো তার গভীর সম্পর্ক। আল্লাহর যিকিরে তাঁর হৃদয় সর্বদা সজীব থাকত। আল্লাহর পক্ষ হতে সময়োপযোগী ইলহাম প্রদত্ত হতেন। তাঁর হৃদয়ে ছিল দাওয়াত প্রদানের প্রচন্ড আবেগ। হিকমাতের সাথে কথা উপস্থাপন করতেন। তার এই নীতি আজ আদর্শের স্বীকৃতি পেয়েছে। কর্ম পদ্ধতি আপনা হতে তাঁর বুঝে আসত। আপনারা যদি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন আর হৃদয়ে থাকে আল্লাহ প্রদত্ত ঈমানী আবেগ তাহলে দাওয়াত প্রদানের সঠিক পন্থা আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনাদেরও বুঝে আসবে। প্রয়োজন শুধু এজন্য দৃঢ় প্রত্যয়ের।
অমুসলিমরাও দাওয়াতের হকদারঃ
এক হল স্বজাতির মাঝে দাওয়াত প্রদান। এ কাজ সর্বদা অপরিহার্য। যেমনঃ তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম। তারা হাজার হাজার মুসলমানকে সুপথে ফিরিয়ে আনছে।তবে বর্তমানে ভিন জাতির নিকট দাওয়াতের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। আপনাদের উপর অমুসলিমদেরও হক রয়েছে।তবে ইসলাম আমার আপনার বাপ দাদার মিরাসী সম্পত্তি নয়। তা কুক্ষিগত করে রাখার অধিকার নেই কারও।সবার দায়িত্ব তা প্রচার করার। ইসলাম এসেছে সারা দুনিয়ার মানুষের কল্যাণের জন্য। এর দাওয়াত বিশ্বের সকল মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব প্রতিটি মুসলমানের। এ দায়িত্ব পালন না করে মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। স্বজাতির ও ভিন জাতির সবারই দাবী রয়েছে আমাদের উপর। তাদের মঙ্গল হওয়া আমাদের কাম্য।এ দ্বীনকে সকলের নিকট পৌঁছে দিতে হবে। যা তাদের পরকালের মুক্তির সনদ হবে। হাজী আঃ রহমান সাহেবের মত হিকমতের সাথে দাওয়াত দিতে হবে। আর উপস্থাপন পদ্ধতি হওয়া চাই এমন আকর্ষণীয় যাতে মানুষ অভিভূত হয়ে পড়ে। সামর্থ অনুযায়ী সেবা, হিকমাত, সহানুভুতিশীল তথা যে কোন পন্থায় হোক ইসলামের দাওয়াত চালু রাখতে হবে।
মাদউর মানসিকতা বুঝে দাওয়াত প্রদানঃ ছাত্রদেরকে আমি বলে থাকি, মাদ্রাসার অনুষ্ঠিত তালিমী (শিক্ষা) কার্যক্রম সমূহ অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, শিক্ষা না থাকলে তাবলীগ ও প্রচারণা সব স্তিমিত হয়ে পড়বে, ভুল পথে পরিচালিত হবে। তালীমের ছায়ায় পরিচালিত হয় এ সব বিভাগ। তাই বলে শিক্ষা সমাপনীর পর শুধু তালীমকে লক্ষ্য বানানো যথেষ্ট নয়।এর সাথে সাথে দাওয়াতের কাজও ব্যাপকভাবে হওয়া চাই। মাদ্রাসায় পড়ানো ভালো কথা।তবে এর সাথে সাথে সাধারণ লোকের সাথে সাক্ষাত হলে তাকে দাওয়াত দিন। সম্মুখে উপস্থিত ব্যক্তির মানসিকতা অনুযায়ী দ্বীনের আলোচনা করুন। জ্ঞানী ব্যক্তির সাথে জ্ঞান-গর্ভ আলোচনা করুন। সরলমনা মানুষকে সহজভাবে ইসলামের দাওয়াত দিন। যুক্তিবাদী লোকের সাথে যুক্তির আলোকে কথা বলুন। মোট কথা প্রতিপক্ষের অবস্থা অনুযায়ী দাওয়াত দেয়ার নাম হলো হেকমত বা কৌশল। ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী লোকের সাথে কথা বলতে হবে। স্বল্প বুদ্ধির মানুষের সাথে দর্শন দাগানো শুরু করলে বেচারা তার কি বুঝবে?
লক্ষ্মৌতে এক জমিদার ছিলেন। তার ক্ষেত -খামার, হাল-চাষ করার জন্য ছিল কয়েকজন মজদুর। জমিদারের ছিল নির্বিচারে ফার্সী বলার বাতিক। তার মন নাকি সর্বদা ফার্সী বলতে চাইত। তাও অশুদ্ধ। একবার ক' জন গ্রামবাসী তার কাছে আসে। জমিদার সাহেব গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেন, এ বছর বৃষ্টি কেমন হয়েছে। সাহেব ফার্সী বলতে গিয়ে দুর্ভেদ্য শব্দগুলো ব্যবহার করলে অশিক্ষিত গ্রামবাসীরা আপোষে বলাবলি করতে লাগল যে, মিয়া সাহেব এখন বুঝি কুরআন তেলাওয়াত করছেন। চলো যাই, পরে আবার আসবো।এ বলে তারা উঠে চলে যায়।এই গ্রাম্য লোকদের সাথে তাঁর ফার্সী কথা বলা ঠিক হয়নি।তারা যা বুঝে না মোটেও। তদ্রুপ কোন দার্শনিকের সাথে সাদামাটা কথা বললে তাও হবে উপহাসযোগ্য। তাই কথা বলতে হবে সম্বোধিত ব্যক্তির যোগ্যতা ও মানসিকতা বুঝে। আল- কুরআন তিন প্রকার মাদউর কথা উল্লেখ করেছেঃ
"হিকমাত ও সুন্দর আলোচনা দ্বারা তোমার রবের পানে আহ্বান করো। লোকদের সাথে সর্বোত্তম পন্থায় যুক্তি ভিত্তিক পর্যালোচনা কর।"
তিন প্রকার মানসিকতার মানুষ রয়েছে।কিন্তু লোক যুক্তিবাদী। তাদের নিকট দ্বীন পেশ করতে হবে যুক্তির আলোকে। কিছু লোক সরলমনা। তারা আল্লাহ ও রাসূলের নাম শুনতেই বিগলিত হয়ে পড়ে। এদের জন্য সাদামাটা উপদেশই যথেষ্ট। আর কিছু লোক গোঁড়া স্বভাবের। দাঁতভাঙা যুক্তি ছাড়া যাদের বশ করা যায় না। তাদেরকে আলোচনা পর্যালোচনা ও তর্ক- বিতর্ক দ্বারা বুঝাতে হবে। এছাড়া তাদের বুঝানো যাবে না। অতএব মানসিকতা বুঝে আলোচনা করতে হবে। এটাই দাওয়াতের মূল কথা।
অনুবাদকঃ আহমদ আল ফিরোজী