আমরা যাদের উত্তরসূরী:
নবী প্রেমিক তালহা ইবনে বারাহ্ (রাদিঃ)
শহীদুল ইসলাম
=================================================================
নবুওয়্যাতের ত্রয়োদশ বছর। মদিনার ৭০ জন গোত্র প্রতিনিধি দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবায় ইসলাম গ্রহণ করার পর হিজরত করে মদীনায় চলে আসার জন্য তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম কে আবেদন জানালেন। সেদিন হতেই তারা মদীনায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞবদ্ব হন অনতি বিলম্বে তার মদীনা আগমনের সম্ভাবনার কথা জানিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনী বার্তা নিয়ে মহানন্দে প্রতিনিধিগণ ফিরে এলেন মদীনায়। ক্রমান্বয়ে মক্কার কাফেরদের অত্যাচার প্রচণ্ডতর হলো। কিন্তু রাসূলকে তাতেও দমাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ইহধাম থেকে চির বিদায় করার ষড়যন্ত্রে কাফেরদের দল ঐক্যবদ্ধ হলো। আর তখনই আল্লাহ তাআলা জিব্রাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইসি ওয়াসালালাকে মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ দেন।
আল্লাহর নির্দেশে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবী আবু বকর (রাঃ) কে সাথে করে রাতের আধারে লোক চক্ষুর অন্তরালে, অচেনা-অজানা বিজন মরুপথ দিয়ে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। মদীনা পৌছুতে তাদের কয়েকদিন লেগে গেল। ইতোমধ্যে মদীনাবাসী খবর পেলেন, নবীকুল শিরোমনি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার পথে রওয়ানা হয়েছেন। দু-একদিনের মধ্যেই হয়তো তিনি পৌঁছে যাবেন। এ সংবাদ পৌছাবার পর বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে স্বাগত জানানোর জন্য একদল অনুরাগী প্রতিদিন মদীনার উপকণ্ঠে এসে তার জন্য অপেক্ষা করতেন। সরা দিন প্রতীক্ষার পথ চেয়ে তাদের কেটে গেল বেশ ক'টি দিন। অতঃপর একদিন সাঁঝের বেলা গোধূলি রাঙ্গা মরু প্রান্তর পেরিয়ে ধূলি মলীন বেসে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পা রাখলেন মদিনার সবুজ শ্যামল খেজুর বীথি ঘেরা পল্লীতে। দিবাকর শেষ আভা ছড়িয়ে ডুবে গেল। বিশ্বনবীর পদস্পর্শে ধন্য হলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল ইয়াসরিবের মাটির পথ ঘাট।
মদীনার রাজপথে হুমড়ি খেয়ে পড়লো মানুষ। বহু কাঙ্খিত রহমতের নবী কে এক পলক দেখার জন্য কার মনে না চায়। এক আনসারী টগবগে যুবক। নাম তার তালহা ইবনে বারাহ। হাজার মানুষের ভীড় ঠেলে পা-পা করে ধীরপদে এগিয়ে এসে নবীজিকে জড়িয়ে ধরে তাঁর হস্ত মোবারক অবিরাম চুমুতে থাকেন। যেন অমৃত সুধা পেয়ে গেছেন তিনি। হৃদয়টা তার পরম তৃপ্তিতে কানায় কানায় ভরে ওঠল। নিমিলী নেত্রে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাকে যে কোন কাজের নির্দেশ দিন, কখনো আমি আপনার হুকুম পালনে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করব না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিসসালাম যুবকের সৎসাহস ও দৃডঢ়তা দেখে মুচকি হাসলেন। পরীক্ষামূলক তালহাকে বললেন, "যাও, তোমার পিতাকে হত্যা করে এসো তবে!" তালহার প্রতিজ্ঞা ছিল নিখাদ। নবীজীর আদেশে সে প্রস্তুত হয়ে গেল তার পিতাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে। নবীয়ে রহমত অমিত তেজী যুবকদের উদ্যোগ দেখে বারণ করে বললেন, 'আমি তোমাকে পরীক্ষা করে দেখলাম যে, তুমি তোমার অঙ্গীকারে আন্তরিক কিনা এবং আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা নিখাত কিনা। মনে রাখা দরকার, "দুনিয়ায় আমি পরস্পরে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এসেছি। মানব বন্ধন ছিন্ন করতে আসেনি।"
কিন্তু হায়! রাসুল প্রেমিক সেই যুবকের আয়ু কিছুদিনের মধ্যেই ফুরিয়ে এলো। এমন দুরারোগ্য ব্যধিতে সে আক্রান্ত হল যে, তা আর ভাল হল না। ক্রমান্যয়ে জীবন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। একদিন বিকেলে নবী তাকে দেখতে গেলেন। সে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। যে তরুণ তার জগতের সকল মাল, দৌলত, আত্মীয়-স্বজন পিতা-মাতা সব কিছু থেকে নিজেকে নবীজির জন্য উজাড় করে দিলেন। যার সবটুকু ভালোবাসা রাসূলের জন্য উস্সর্গীত। আজ সেই যুবক মৃত্যু শয্যায় শায়িত। শেষ বারের মতো প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মায়াবী চেহারা দুচোখ ভরে দেখে নিলেন, কিন্তু কিছুই বলতে পারলেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সালাম তারা আদূরে সাহাবীকে দেখার পর ফেরার সময় সেবা-শুশ্রূষাকারীদের বললেন, মৃত্যুর আলামত তালহার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সে হয়তো আর বাঁচবে না। রাতে তার এন্তেকাল হয়ে গেলে তোমরা আমাকে খবর দিও। আমি এসে জানাযা পড়বো। আর দাফন-কাফনে বিলম্ব করো না। কারন মুসলমানদের মৃতদেহ করে ফেলে রাখা উচিত নয়। রোগ আক্রান্ত এ যুবক ছিলেন বনু আমর ইবনে আউপ গোত্রের বাসিন্দা।
মদীনা থেকে তিন মঞ্জিল দূরে মসজিদে কুবার পাশের তল্লাটেই ছিল তার ঘর। পথি মধ্যে ছিল ইয়াহুদীদের পল্লী। তাই রোগাক্রান্ত তালহাকে দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলা থাকতেই মসজিদে নববীতে ফিরে আসেন। দিনের আলো ফুরিয়ে আসার সাথে সাথে তালহার জীবন প্রদীপ শেষবারের মতো দপ করে জ্বলে উঠল। স্বজনদের বিরহ, মৃত্যু যন্ত্রণা কিছুই তার মনে রেখাপাত করল না। তার অন্তরের সবটুকু স্থানজুড়ে বিরাজ করছিল হাবিবে খোদা কল্যাণ কামনা, সফলতা, সমৃদ্বি, নিরাপত্তা ও ভালোবাসা। জীবন সায়াহ্নে তিনি আত্মীয়দের ডেকে বললেন দেখো! রাতে আমার তোমরা তাড়াতাড়ি জানাযা ও দাফন-কাফন সেরে ফেলবে। রাতের বেলা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে খবর দিতে যাবে না। কারণ অনেক দূরের পথ। আবার পথে ইয়াহুদীদের বস্তী। নরপিশাচগুলি সবসময় কুচিন্তায় থাকে। নিশুতিরাতে না জানি আবার দূরাচার পাপিষ্ঠরা কোন দুষ্কর্ম করে বসে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর আক্রমণ করতে পারে।
আমার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম কষ্ট পাবেন তা হতে পারে না। মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে সত্যিকার এক নবী প্রেমিক তরুণ যে কত অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশ ঘটালেন তার কোন তুলনা আছে! আসলে একেই ভালোবাসা বলে। একজন মুমিনের মৃত্যুর পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারা জানাজা পড়াবেন, দাফন-কাফন করবেন, তার গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করবেন, ফলে জান্নাত তার জন্য অবধারিত হয়ে যাবে, তার কবর বেহেস্তের নাজ নিয়ামতে ভরে যাবে এইতো ছিল সাধারণ একজন মুমিনের একান্ত চাওয়া পাওয়া। কিন্তু তালহা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হেফাজত ও সমূহ বিপদ আশঙ্কা থেকে তাকে রক্ষার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতে সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন। নিজের সুখের চেয়ে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিরাপত্তা ও জীবনকে অত্যন্ত মূল্য দিলেন। সমস্ত পৃথিবীর জন্য যিনি হিদায়াতের আলোকে বর্তিকা, যিনি রাহমাতুল্লিল আলামিন, যারা সম্মানে সকল সৃষ্টি তার প্রতি নিখুঁত ভালোবাসা ও জগতের মানুষের প্রতি কল্যাণ কামনা মৃত্যুর বিভীষিকাও তাকে সেই প্রেম ও দায়িত্ব থেকে বিস্মৃত করতে পারেনি। এরাই তো ছিল সেই আনসার সাহাবী যাদের শানে অবতীর্ণ হয়েছিল কোরআনের শাশ্বত পয়গাম এবং তারা অন্যদের মঙ্গলকে নিজেদের স্বার্থের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের পোহাতে হয় সীমাহীন কষ্ট ও দুঃসহ যাতনা।
সে রাতেই তালহার প্রাণ বায়ু উড়ে গেল। আনসারগণ তার ওসিয়ত মত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে না জানিয়ে রাত্রে তার দাফন কাফন সেরে ফেললেন। সকালবেলা তাদের কোনো একজন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তালহার মৃত্যুও দাফন-কাফন সমাপ্তের সংবাদ দিলো।
তার মৃত্যু সংবাদে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যান্ত ব্যাথিত হলেন। কয়েকজন সাহাবী কে সাথে নিয়ে তিনি উপস্থিত হলেন বনি আমর মহল্লায়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমন সংবাদে বহু লোক এসে জড়ো হলো। নবীয়ে রহমত, হাবীবে খোদা তালহার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার পেছনে সাহাবীগণ সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ানো। একদল নির্মল মনের নিষ্পাপ মানুষ হাত উঠিয়ে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমীন আমীন বলছেন। মৃত তালহার মাগফিরাতের জন্য এর চেয়ে আর বেশী কি প্রয়োজন। প্রেমের নবী, করুনার ছবি রব্বুল আলামিনের কাছে তার প্রিয় সাহাবী তালহার জন্য নিবেদন করলেন। "হে প্রভু! তুমি তালহাকে এমন অবস্থায় তোমার সাক্ষাৎ নসীব কর যেন তোমরা একে অপরকে দেখে হাসছো"
জান্নাতের সবচেয়ে বড় নেয়ামত হলো আল্লাহ তাআলার দিদার। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাকে যেদিন বেহেশতে তার কুদরতি চেহারা দেখার সৌভাগ্য নসীব করাবেন, কোটি কোটি বছর চলে যাবে মানুষ আল্লাহর দিকে অপলক নেত্রে চেয়ে থাকবে, তবুও দেখা শেষ হবে না। প্রেমিকের কাছে প্রিয়ার চেহারা দর্শন ও মিষ্টি মুচকি হাসির চেয়ে বেশী মূল্যবান চাওয়া-পাওয়া কি আছে? তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালহার ভালবাসার প্রতিদান এমন ভাবে দিলেন যাএকজন প্রেমিকের সবচেয়ে প্রিয় পাওয়া, সর্বোচ্চ মঙ্গল কামনা। যা দুনিয়ার আর কোন মানুষের বেলায় তিনি কামনা করেন নি।
আজো মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যারা ভালবাসবে, আল্লাহ তা'আলাও তাদেরকে ভালোবাসবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন "যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে ভালোবাসে স যেন আমাকে ভালোবাসে। আর যে আমাকে ভালবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে অবস্থান করবে।"
*****