আল কায়েদা কিভাবে ইসলামিক স্টেটের হুমকি মোকাবিলা করছে !!
How al-Qaeda Survived the Islamic State Challenge!!
গবেষণায়-Daveed Gartenstein-Ross & Nathaniel Barr
আশা করি যে কেউ ধৈর্য্য নিয়ে পড়বেন ইনশাআল্লাহ আল-কায়েদার *বৈশ্বিক মানহাজ নিয়ে বুঝতে পারবেন।
————————–
বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ, সোশ্যাল মিডিয়ায় দক্ষতা এবং সমর্থকদের অভুতপূর্বভাবে নিজের দিকে সমবেত করার সাথে সাথে ইসলামিক স্টেটের যে উত্থান তা গ্লোবাল জিহাদিস্ট আন্দোলনে আল কায়েদার যে কর্তৃত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল তাকে হুমকির সম্মুখিন করে দেয়। এক সময় বিশ্লেষকদের বড় একটা অংশ বিশ্বাস করা শুরু করেছিলেন যে, আইএস হয়তো আল কায়েদার ঔজ্জল্যকে ম্লান করে দেবে, যদিও তারা এর মধ্যে না করে দেয় এবং এটা হয়তো আল কায়েদার অস্তিত্বকেই অপ্রাসঙ্গিক করে দেবে এবং তাদেরকে বিলুপ্তির সম্মুখিন করে দেবে। সাধারনভাবে অনেকে মনে করেছিল, এঅবস্থায় আল কায়েদা শুধুমাত্র তখনই প্রাসঙ্গিক থাকতে পারবে যদি তারা পাশ্চাত্যে কিছু সন্ত্রাসী হামলা করতে পারে অথবা আইএসের মত নিষ্ঠুরতা দেখায় এবং আইএসের এই জাঁকজমকপূর্ণ মডেলের অনুসরণ করে। কিন্তু আল কায়েদা এই প্রচলিত ধারনাকে তুচ্ছ প্রমাণিত করলো। তারা শুধুমাত্র আইএসের হুমকি থেকেই টিকে থাকলো না, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে এমন একটা কৌশল নিল, যাতে তাদের দিকে মনোযোগ না থাকে এবং এতে তারা আরও শক্তিশালী হয়ে আবির্ভূত হলো। আল কায়েদা নিজের সুনাম কে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলো। যেখানে আইএস অনেক বেশি নিষ্ঠুরতা দেখাচ্ছিল, সেখানে আইএসের বিপরীতে আল কায়েদা তাদের সাথে নিজেদের পার্থক্য তৈরির মাধ্যমে আরও বেশি করে এই অঞ্চলে কাজ করার সুযোগ করে নিল। এই প্রবন্ধে আল কায়েদার এই মডেলের গত এক দশকে কি বিবর্তন হয়েছে তা দেখানো হয়েছে। এবং দেখানো হয়েছে কিভাবে তারা এই চ্যালেঞ্জ গুলো বিচক্ষণ পরিকল্পনা এবং কৌশলগত ধৈর্যের সংমিশ্রণে বারবার মোকাবিলা করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন পানেট্টা ২০১১ সালের জুলাই মাসে দাবি করেন যে, আল কায়েদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কৌশলগত পরাজয়ের সম্মুখীন। পানেট্টাই প্রথম নয় যে, আল কায়েদার আসন্ন পতনকে লক্ষ্য করছিল এবং সেই শেষ নয়। মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিম উভয় জায়গার পর্যবেক্ষকরাই ২০১১ সালের গোড়ার দিকের আরব বসন্তকে আল কায়েদার জন্য আরবদের পক্ষ থেকে একটা অস্বীকৃতি হিসেবে দেখছিলেন। কারন এ সময় যে নাটকীয় রাজনৈতিক পরিবর্তন হয় তা মূলত তেমন কোন সহিংসতা ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছিল। তারা তাই আগে থেকেই ধারণা করছিলেন যে, আল কায়েদার গুরুত্ব এবং জনপ্রিয়তা রুঢ ভাবে কমে যাবে।
কিন্তু আল কায়েদা এবং এই জিহাদি মুভমেন্ট তাদের ভবিষ্যৎবাণীকে হার মানিয়েছে। এই সংগঠন এবং মুভমেন্ট গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এই অস্থিতিশীল অঞ্চল থেকেই উপকৃত হয়েছে। এবং আল কায়েদা এটাকেও নিজেদের জন্য সহনীয় করে নিয়েছিল। ২০১৪ সালে বেশীরভাগ বিশ্লেষক এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আল কায়েদা জিহাদি মুভমেন্টের উপর তাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলেছে তখনই, যখন তাদের এক সাবেক সহযোগী সংগঠন আইএস ২০১৪ সালে উত্তর ইরাকে একটি অতিশয় সফল আক্রমণ পরিচালনা করল এবং আল কায়েদার বিভিন্ন শাখা থেকে কে আনুগত্য আদায় করতে পারে এব্যাপারে তারা একে অপরকে টেক্কা দেয়া শুরু করলো। এই তর্কের সবচেয়ে চরম সংস্করন ছিল যে, “আল কায়েদা এখন জিহাদি সংগঠন গুলোর মধ্যে দুই নম্বরে রয়েছে।” এবং এসময় বলা হচ্ছিল যে, এই গ্রুপটি ২০১৬ সালের আগেই ভেঙ্গে যাবে। আরব বিশ্বের বিভিন্ন প্রেস কভারেজ এবং বিশ্লেষণ মোটামুটি তাই বলছে, যা পশ্চিমা বিশ্লেষক এবং কর্মকর্তারা বলছেন। যেমন একজন আলজেরিয়ান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, “আল কায়েদা উধাও হয়ে যাবে, তাদের চেয়ে আরও চরমপন্থি ইসলামিক স্টেটের জন্য পথ করে দিয়ে।” আইএসের অনলাইন ভক্তদের অনেকেই এই সুযোগে বারবার আল কায়েদার বিভিন্ন সংগঠনের সামান্য অনৈক্য অথবা কোন আইএস পন্থি সংগঠন আল কায়েদা নেটওয়ার্কের মধ্যে কাজ করলে তা বারবার অতিরঞ্জিত করে প্রচার করতে থাকলো।
কিন্তু ধ্বংস না হয়ে, উলটো আল কায়েদা আইএসের এই উত্থান এবং তাদের নিষ্ঠুরতাকে একটা কৌশলগত সুযোগ হিসেবে নিল। টিকে থাকার জন্য তারা একটা টেকসই পদ্ধতি বেছে নিল এতে তাদের কাজ অনেক কমিয়ে দিতে হয় ফলে তাদের উপর মনোযোগ একেবারেই কম থাকে। এভাবে আল কায়েদা শান্তভাবে এবং এখনো অপেক্ষাকৃত দ্রুততার সাথে নিজেদের সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠা করছে। এছাড়াও সিরিয়া এবং ইয়েমেন যেখানে তারা বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে, সেখানে নিজেদের স্থানীয় মানুষদের মাঝে প্রোথিত করেছে।
আইএসের জাঁকজমকের সাথে সাফল্যের প্রতিক্রিয়ায় আল কায়েদার সিদ্ধান্ত ছিল আরও গোপন এবং বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে থাকা, যা অনেকের কাছে প্রথমে অপ্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু এটা ছিল ফলপ্রসূ এবং এভাবে আল কায়েদা সাফল্যের সাথেই আইএস ঝড়ের মোকাবিলা করল। এই প্রবন্ধে কিভাবে আল কায়েদা আইএস এর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টিকে ছিল এবং আরও বিস্তার লাভ করছিল সেই গল্পই বলা হয়েছে। এই প্রবন্ধে গত এক দশকে তিনটি প্রধান ঘটনায় আল কায়েদার কি প্রতিক্রিয়া ছিল সেই ব্যাপারেই মূলতঃ নজর দেয়া হয়েছে। এগুলো হলঃ ২০০৭-০৯ সালে আল কায়েদা ইন ইরাকের পরাজয়, ২০১১ সালের আরব বসন্ত এবং আইএসের উত্থান। এই তিনটি ঘটনাতে আল কায়েদার প্রতিক্রিয়া ছিল পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। যেপথ আল কায়েদা নির্ধারণ করেছে তাতে এ সকল চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ, যেগুলো তাদের সামনে এসেছে, সেগুলোই ব্যাখ্যা করে যে আল কায়েদা ২০১৪ সালের চেয়ে এখন কেন এত বেশি শক্তিশালী। আর কেন এরা আইএসের চেয়ে ভাল অবস্থানে আছে, যাতে ভবিষ্যতে টিকে থাকা যায়।
আল কায়েদার সুনামে কাল দাগঃ
আল কায়েদা ইন ইরাক (একিউআই), যা পরে আইএসে পরিণত হবে, ২০০৭-০৯ সালে ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ চলাকালীন, মীমাংসিত ভাবে পরাজিত হয়। এই পরাজয়ে বিশ্বব্যাপী আল কায়েদার সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতঃপর আল কায়েদা তার কৌশলকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে থাকে, যাতে তারা নিজেদের ঐ ক্ষতির ক্ষতিপূরণ করতে পারে, যেটা তারা মানুষকে অতিরিক্ত নির্যাতনের মাধ্যমে করেছিল এবং এতে তাদের ইরাকি শাখার চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। ইরাক যুদ্ধের সময় ঘটা এই ব্যর্থতাপূর্ণ পরিস্থিতির বিশ্লেষণ থেকে যে পাঠ তারা নিয়েছিল, তা পরবর্তীতে এই গ্রুপের কৌশলগত চিন্তার রুপায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে, যা আইএসের জন্যও সহায়ক ছিল।
একিউআই এবং তার প্রতিষ্ঠাতা আমির আবু মুসাব আল যারকাউয়ীর জন্য যুদ্ধে বর্বরতার ব্যবহার ছিল একটি অত্যাবশ্যকীয় হাতিয়ার। একিউআই মার্কিন বিরোধী বিদ্রোহের সামনের সারিতে উত্তরণের জন্য চরম সহিংসতাকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করেছিল। গ্রুপটি মুলতঃ কুখ্যাত হয়ে উঠে তখন, যখন তারা বিভিন্ন জনাকীর্ণ বাজার এবং মসজিদে শিয়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আত্নঘাতি বোমা হামলা শুরু করে এবং তাদের কর্মকাণ্ডের চিহ্ন হিসেবে তারা যেসব শিরশ্ছেদ করত তার ভিডিও প্রকাশ করার মাধ্যমে যা পরবর্তীতে আইএসের Signature এ পরিণত হয়। তারা আসলে যাদের উপরই ক্ষমতা লাভ করতো তাদের উপরই নিষ্ঠুর আচরন করা শুরু করত, এক্ষেত্রে তাদের কাছে সকলেই সমান। ইউ.এস মেরিন করপসের অফিসিয়াল “আনবার গণজাগরণের ইতিহাস” এ বেশকিছু প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনার মৌখিক সাক্ষ্য উঠে এসেছে। যেমন মহিলাদের জন্য ইরাকের এক এনজিওর প্রধান মিরিয়াম(ছদ্মনাম) বলছেনঃ “সবচেয়ে নোংরা নির্যাতন করত আল কায়েদা। যদি নিয়মের বাইরে কিছু ঘটত, তাহলে লোকদের অপমানিত করা হত এবং তাদের জবাই করে ফেলা হত। এরপর মাথাটা একটা কন্টেইনারে রেখে ছুড়ে ফেলে দেয়া হত। অথবা ঘাড় কেটে মাথাটা উলটো করে বসিয়ে দেয়া হত।” এভাবে একিউআই তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার জনগণের সাথে বিজাতীয়দের মত আচরন করত, তাদের উপর শরিয়ার একটা কঠোর ভার্শন চাপিয়ে দিয়ে।
একিউআই এর এই নির্মমতায় দুটো কাজ হয়। এটা তাদেরকে ইরাকি সুন্নিদের উপর আধিপত্য বিস্তারে সাহায্য করে, যারা ছিল একিউআই এর মুল সমর্থক। এছাড়া শিয়া-বিরোধী সংঘর্ষের কারণে শিয়ারাও উৎসাহিত প্রতিহিংসামূলক আক্রমণ পরিচালনা করতে, যা একিউআই এর একটা সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ শুরু করার লক্ষ্যকে পূর্ণ করে। একিউআই এই সুন্নি-শিয়া উত্তেজনায় একারণে আগুন জ্বালায় যাতে, এই জিহাদি গ্রুপটি সুন্নি জনগণের রক্ষাকারী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
এই কৌশল সামান্য সময়ের জন্য একিউআই এর খুব কাজে দেয়, কিন্তু পরবর্তীতে এই পরিকল্পনা ব্যাকফায়ার করে। ২০০৬ সালের অগাস্ট মাসের এক ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টে কর্নেল পিটার ডেভলিন একিউআই কে সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ আনবার প্রদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করেন। কিন্তু একিউআই এর এই অতিরিক্ত সহিংসতা পরিণামে উলটো ফল বয়ে আনে। ২০০৬ সালে আনবার প্রদেশের স্থানীয় গোত্রপতিরা, একিউআই এর এই কৌশল এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে তাদের হস্তক্ষেপে ক্ষুদ্ধ হয়ে একটি বিদ্রোহের সুচনা করে।
যদিও বেশ কয়েকবার সেখানে গোত্রীয় বিদ্রোহের সুচনা হয়, কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় বিদ্রোহটা সংগঠিত হয় ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে। যখন বড়সংখ্যক স্থানীয় শেইখেরা জনসমক্ষে আল কায়েদার বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এই আন্দোলনকে তারা ‘সাহওয়া’ বা ‘গণজাগরণ’ নামে অভিহিত করে। এই আন্দোলনে একটি এগারো দফার ‘ইশতেহার’ ছিল। কর্নেল সীন ম্যাকফারল্যান্ড ফার্স্ট আরমার্ড ডিভিশনের ফার্স্ট ব্রিগেডের কমান্ডার বলেন, “তাদের দশ জনের জন্য আমি প্রায় একই ভাবে লিখেছিলাম এবং তারাও আমাকে লিখেছিলেন।” এই গণজাগরণের অন্যতম উদ্দেশ্য আনবারের গভর্নরকে হত্যা করা ছিল একটা কঠিন কাজ।
সাহওয়া শেখেরা আমেরিকানদের সাথে কথা বলতে চাইছিল এবং তাদের সাথে কাজ করতে আগ্রহী ছিল। ইউএস এই সুযোগটা গ্রহণ করে নিল, কারন তারা প্রধানত নিজের সৈন্যদের বিভিন্ন জনপদ থেকে দূরে দেয়াল দিয়ে ঘেরা বিশাল সব ঘাটিতে রেখে, অন্যদের দ্বারা প্রতিবিদ্রোহ চালাতে চেষ্টা করছিল। এভাবে আমেরিকানরাই গোত্রীয় বিদ্রোহে পিছন থেকে ভুমিকা রাখে, যা আল কায়েদাকে আনবার থেকে বের করে দেয়। আনবার গণজাগরণের সাফল্যের পর, পুরো দেশ জুড়ে যেখানেই আল কায়েদার উপস্থিতি ছিল সেখানেই তাদের বিরুদ্ধে এই মডেলের প্রতিরোধ সংগঠিত হতে থাকে। ফলে এক সময় যে নির্মমতা তাদের শক্তি হিসেবে গন্য হত এখন তা তাদের দুর্বলতায় পরিণত হয় এবং জনগন তাদের সাথে শত্রুভাবাপন্ন আচরন শুরু করে। ২০১০ সালের মধ্যে আল কায়েদা এখানে একেবারে কৌশলগতভাবেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
একিউআই এর এই প্রশ্নাতীত পরাজয় আল কায়েদার বিশ্বব্যাপী সুনামের জন্য একটা বড় আঘাত ছিল। একিউআই হচ্ছে প্রথম আল কায়েদার অঙ্গসংগঠন যা ৯/১১ এর পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছিল এবং এর ভেঙ্গে পড়া এটাই নির্দেশ করছিল যে আল কায়দা কোথাও শাসন করতে সক্ষম নয়। আরও উদ্বেগের বিষয় ছিল যেভাবে একিউআই এর পতন হল তা। এটা এই ধারনায় যথার্থতা দেয় যে, আল কায়েদা, যারা একসময় মুসলিমদের বিদেশী শক্তির হাত থেকে প্রতিরক্ষার শপথ নিয়েছিল তারাই এখন বিজাতীয় দখলদারদের মত আচরন করছে।
এমনকি যখন একিউআই তার শীর্ষচূড়ায় তখনই আল কায়েদার সিনিয়র নেতারা এই জিনিসটা বুঝতে পেরেছিলেন। ২০০৫ সালের জুলাইতে আইমান আল যাওয়াহিরি (সেসময় বিন লাদেনের সহকারী) যারকাউই কে একটা চিঠি লিখেছিলেন, এতে তিনি এই আবেগপ্রবন জঙ্গি নেতাকে নিজের উগ্র মেজাজ সামলে রাখতে বলেন। যাওয়াহিরিও কোন শান্তিবাদি লোক ছিলেন না। তিনি যারকাউইকে বন্দীদের শিরশ্ছেদ করার পরিবর্তে গুলি করে মেরে ফেলার উপদেশ দেন। কিন্তু তার ভয় ছিলো যে, যারকাউইর এই নির্মমতার প্রদর্শনী জনগণকে শত্রুভাবাপন্ন করে তুলবে। যেমন একজায়গায় যাওয়াহিরি লিখেছেন “সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র যেটা মুজাহিদিনরা উপভোগ করে তা হল মুসলিম জনগণের সমর্থন।” তাই জিহাদিদের “এমন যেকোনো কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা উচিত যা জনগণ বুঝবে না অথবা সমর্থন করবে না।” ঐ বছরের শেষ দিকে আতিয়াহ আব্দুল রহমান, আরেকজন সিনিয়র আল কায়েদা কর্মকর্তা আরো কঠোর একটা চিঠি প্রেরন করেন যা যাওয়াহিরির উপদেশেরই প্রতিধ্বনি ছিল। আতিয়াহ যারকাউইকে বলেন যে, সামরিক কৌশলগুলো অবশ্যই এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও পুরন করে। তিনি এই জর্ডানি বংশোদ্ভূত নেতাকে তার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সহিংসতাকে আরও নিয়ন্ত্রণ করতে বললেন, অন্যথায় এটা আল কায়েদার জন্য যে সাধারণ সহানুভূতি আছে তার ক্ষতি করতে পারে। আতিয়াহ যারকাউইকে জনগণের ভুল ত্রুটির উপর অত বেশি মনোযোগ না দেয়ার উপদেশ দেন। এবং তাদেরকে এজন্য সহ্য করতে বলেন যাতে পরবর্তীতে তারা উলটো যেন কোন ধরনের শত্রুতে পরিণত না হয়। কিন্তু একিউআই এর প্রতি সেন্ট্রাল আল কায়েদার এসব আহবান উপেক্ষিত থেকে যায়।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মাঝামাঝি সময়ে আল কায়েদার সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে একিউআই এর এই মতানৈক্যই মুলত আল কায়েদার ভবিষ্যৎ কৌশল এবং আইএসের উত্থানের ফলে এর প্রতিক্রিয়া কি হবে তা নির্ধারণ করে দেয়। ২০১০ সালের মধ্যেই একিউআই এর এভাবে ভেঙ্গে পড়ায় আল কায়েদার সিনিয়র নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল সংগঠনের ভাবমূর্তির পুনরুদ্ধার করা। বিন লাদেনের অ্যাবোটাবাদ কম্পাউন্ড থেকে উদ্ধার করা কিছু কাগজপত্রে এসময় আল কায়দা নেতাদের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়।
আল কায়েদার প্রাথমিক সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই গ্রুপের কৌশলের পরিবর্তন। ২০১০ সালের মে মাসে আতিয়াহকে লেখা বিন লাদেনের চিঠিতে তিনি আল কায়েদার অভিযানে নতুন ধারার প্রস্তাব করে লিখেন যে, যেসব ভুল আমরা করেছি তার সংশোধন করতে হবে এবং সেসকল মানুষের আস্থা আবার অর্জন করতে হবে যারা জিহাদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। এই নতুন ধারার লক্ষ্য ছিল একটি জনগনকেন্দ্রিক কৌশল যে কৌশল ব্যবহার করে এর আগে ইউএস একিউআই কে পরাজিত করে। বিন লাদেন সতর্ক করে দেন যে, “যদি আল কায়েদা জনগণকে আবার শত্রুভাবাপন্ন করে তোলে , তাহলে তারা হয়তো কিছু ছোটখাটো যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত মূল সমরে পরাজিত হবে।” অন্য আরেকটি চিঠিতে আতিয়াহ, আল কায়েদা ইন দা আরাবিয়ান পেনিন্সুলার আমির নাসির আল বুহাইশিকে মুজাহিদিনদের জন্য মুসলিম জনগণকে জয় করে নেয়ার কারন সম্পর্কে ব্যাখ্যায় বলেন যে, “মাছের জন্য যেমন পানি প্রয়োজন তেমনি মুজাহিদিনের জন্য জনগণের সমর্থন প্রয়োজন” (বিদ্রোহীদের জন্য জনগণের সমর্থন সম্পর্কে মাওয়ের বিখ্যাত প্রবচন)। জনগণকেন্দ্রিক এই কৌশল নেয়ার মানে হল এই সংগঠন একিউআই এর ঐ কৌশলকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে, যেখানে তারা ভয় দেখিয়ে জোর করে জনগণকে নিজেদের অধিনে রাখতে চাইছিল, তার পরিবর্তে আল কায়েদা স্থানীয় জনগণের মন জয় করে নেয়ার চেষ্টা শুরু করল। প্রকৃতপক্ষে আতিয়াহ জনগণের কাছে শত্রুভাবাপন্ন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে একিউআই কে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
আল কায়েদা এমনকি নিজের নামও পরিবর্তন করে ফেলতে চেয়েছিল, এটা দেখানোর জন্য যে, একিউআই এর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই । নাম না জানা এক আল কায়েদার কর্মকর্তা বলছিলেন যে, আল কায়েদা নামটা এমন যেন এটা শুধুমাত্র একটা “যোদ্ধাদের সামরিক ঘাটি” এবং এই নামটা আসলে এই গ্রুপের যে আসল উদেশ্য “মুসলিম জাতির (উম্মাহ) ঐক্য সাধনের বৃহত্তর মিশন” তার সাথে কোন সম্পর্ক রাখে না। ঐ লেখক আরও লেখেন যে, এই গ্রুপের নাম ইসলাম থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন এবং এতে “মুসলিমদের মধ্যে এই ধারণাটা হ্রাস পাচ্ছে যে আমরা আসলে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত এবং এতে শত্রুরা চাতুরীর সাথে এটা দাবী করতে পারবে যে তারা আসলে ইসলাম এবং মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত নয়। তারা আসলে আল কায়েদা সংগঠনের সাথে যুদ্ধ করছে।” ঐ কর্মকর্তা বেশ কয়েকটি নতুন নাম প্রস্তাব করেন, তার মধ্যে ছিল ‘মুসলিম ইউনিটি গ্রুপ’(জামাআত ওয়াহদাত আল মুসলিমিন) এবং ‘ইসলামিক নেশন ইউনিফিকেশন পার্টি’ (হিযব তাওহিদ আল উম্মা আল ইসলামিয়্যাহ)। যদিও আল কায়েদা কখনো তাদের মূল সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে নি, তবে গ্রুপটি তাদের এই কর্মকর্তার উপদেশ তাদের পরবর্তী শাখা সংগঠনগুলোর নাম রাখার ক্ষেত্রে মেনে নেয়। বেশ কয়েকটি আল কায়েদা গ্রুপের নাম হল আনসার আল শরিয়া, আবার আল কায়দার সিরিয়ান অঙ্গসংগঠনের নামের সাথে আল কায়েদার নামের কোন সম্পর্কই নেই যা হল জাবহাত আল নুসরা লি আহলি আল শাম , যা আল নুসরা ফ্রন্ট নামেও পরিচিত। (এই প্রবন্ধের উপসংহারে নুসরার সাথে আল কায়েদার সাম্প্রতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যা ব্যাপকভাবে একটি পৃথকীকরণ হিসেবে চিত্রিত হয়েছে)
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যাওয়াহিরি, যিনি উসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর আল কায়েদার বর্তমান আমির হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন তিনি “জিহাদের সাধারণ দিকনির্দেশনা” প্রকাশ করেন। যা একিউআইয়ের পরাজয়ের পর এই গ্রুপের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের একটা প্রচেষ্টা। এই নথিতে আল কায়েদার আরও সংযত এবং জনগণকেন্দ্রিক পদক্ষেপের প্রকাশ দেখা যায়। এখানে যাওয়াহিরি নির্দেশ দিচ্ছেন যে ধর্মীয় সঙ্খ্যালঘু এবং “পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়”(নন-সুন্নি) গুলোর সাথে সহিংসতায় আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের এড়িয়ে চলতে। এবং এমন সকল আচরণ পরিহার করতে যা “জনগণকে বিদ্রোহে” প্ররোচনা দেয়। যাওয়াহিরি একই সাথে আল কায়দার অঙ্গসংগঠনগুলোকে নারী এবং শিশুহত্যা, বাজার ও মসজিদে হামলা চালানো এমন যেকোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন যার পরিণতিতে মুসলিমদের মৃত্যু হয় এছাড়া এতে তিনি অন্যান্য ইসলামিক গ্রুপ গুলোকে সহ্য করা এবং তাদের সাথে একসাথে কাজ করার নির্দেশ দেন, যদিও তাদের সাথে আল কায়েদার গভীর আদর্শগত পার্থক্য থাকে। একারণে জিহাদিদের দ্বারা সংঘটিত কোন সহিংসতা বা অন্য কোন কারণে যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে যাওয়াহিরি তাদেরকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান এবং ক্ষতিগ্রস্তদের যথাসাধ্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে বলেন।
এই সাধারণ নির্দেশিকার প্রকাশনা তাদের পাঁচ বছরের অভ্যন্তরীণ আলোচনা এবং বিতর্কের প্রতিনিধিত্ব করে যা একিউআইয়ের রেখে যাওয়া কালো দাগ মুছে ফেলার জন্য প্রণীত হয়েছে। এবং এটা আইএসের সঙ্গে আল কায়েদার মোকাবেলার কৌশলগত প্রতিচিত্র হিসেবে কাজে লাগানো হয়।
আরব গনজাগরনঃ আল কায়েদার “ঐতিহাসিক সুযোগ”
২০১১ সালের গোঁড়ার দিকের আরব গণজাগরণ ছিল আল কায়েদার টিকে থাকার সক্ষমতার জন্য আরেকটি পরীক্ষা। যেমনটা আগে আলোচিত হয়েছে, পাশ্চাত্যের বিশ্লেষকদের সেসময়কার সাধারণ ধারণা ছিল যে বিপ্লবের ফলে যে পরিবর্তিত পরিস্থিতি তাতে আল কায়েদার গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। কিন্তু যা ধারণা করা হয়েছিলো তার কোন কিছুই ঘটে নি।
যদিও আরব গণজাগরণে আল কায়দার ধ্বংস হওয়ার বিশ্লেষকদের ভবিষ্যতবাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছে, তবুও ২০১১ সালের গোঁড়ার দিকের এই আন্দোলন আল কায়দার জন্য ছিল একটা বাস্তব চ্যালেঞ্জ। জিহাদিরা প্রথম দিকের বিক্ষোভে সামান্য ভূমিকা রাখে। আসলে মিসর এবং তিউনিসিয়ার প্রথম দিকের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভগুলো স্বৈরাচারী শাসকদের উৎখাতে যে ভূমিকা রাখে তা আল কায়েদার ঐ দাবীর বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে যেখানে আল কায়েদা দাবী করে যে সহিংস জিহাদ ছাড়া এই অঞ্চলের স্বৈরশাসকদের উৎখাত করা সম্ভব নয়।
কিন্তু আরব গণজাগরণকে নিজেদের প্রতিকূলের কোন কিছু না ভেবে বরং আল কায়েদার কৌশলবিদরা একে নিজেদের জন্য একটা “ঐতিহাসিক সুযোগ” (আতিয়াহর মূল্যায়ন থেকে উদ্ধৃত) হিসেবে গন্য করলেন। আল কায়েদার নীতিনির্ধারকরা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করেন যে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং বিপ্লব পরবর্তী অরাজক পরিবেশ এই গ্রুপের শক্তিকে আরও প্রসারিত করবে। প্রকৃতপক্ষে মিসরের সিনাই উপদ্বীপ, দক্ষিণ লিবিয়া এবং তিউনিসিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় পাহাড়গুলোর মত সরকারি নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত অঞ্চলগুলো দ্রুতই জিহাদিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। বিপ্লবের সময় এবং পরবর্তীতে কয়েক ডজন থেকে কয়েক শতাধিক ঝানু জিহাদিকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয় যারা আল কায়দার জন্য ছিল তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণা এবং অভিজ্ঞ জনশক্তি।
এছাড়া আল কায়েদা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে বিপ্লব পরবর্তী এই দেশগুলোর দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এসব দেশে তাদের সমর্থনের ভিত্তি প্রসারিত করতে এবং এখানকার জনগণকে তাদের মতাদর্শ ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে পরিচিত করার একটা উর্বর ভুমি হতে পারে। বিপ্লব পরবর্তী সরকার গুলোর মধ্যে একটা সাধারণ প্রবণতা ছিল যে তারা নিজেদের স্বৈরাচারী পূর্বসূরিদের থেকে যে তারা আলাদা তা দেখাতে চাইত এবং এজন্য তারা ধর্মীয় কার্যক্রমের উপর থেকে বিধিনিষেধ উঠিয়ে নেয়। এভাবে বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের সুযোগে আল কায়েদা নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা কোন প্রকারের ধরপাকড়ের ভয় ছাড়াই, প্রকাশ্যে জনসাধারণের কাছে নিজেদের সালাফি-জিহাদিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির প্রচারণা শুরু করল। যেমনটা কুয়েত ভিত্তিক জিহাদি ভাষ্যকার হামিদ বিন আব্দুল্লাহ আল আলী মন্তব্য করেছিলেন, “স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ পাওয়ায় ইসলামিক প্রকল্পই সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগ করবে।” আল কায়েদার নীতিনির্ধারকেরা তিউনিসিয়া, মিসর এবং অন্যান্য বিপ্লব পরবর্তী দেশগুলোয় তাদের সমর্থকদের সরাসরি দাওয়াহর(ধর্মপ্রচার) কাজ শুরু করার নির্দেশ প্রদান করেন। এবং বিপ্লব পরবর্তী সময়ের এই স্বাধীনতার সুযোগে বিভিন্ন স্থানে প্রচারণা, শিক্ষা, সংস্কার এবং ইসলামকে পুনরুজ্জীবনের কাজের সূচনা অথবা গতিসঞ্চার করার নির্দেশনা দান করেন।
বিপ্লব পরবর্তী এই দেশগুলো আস্তে আস্তে আল কায়েদার সংস্কার কার্যক্রম এবং নীতির একটা পরীক্ষা ক্ষেত্রে পরিণত হয়। যেগুলো তারা একিউআই এর ব্যর্থতার পর বাস্তবায়ন করে। এধরণের অন্য একটা প্রচেষ্টার মধ্যে ছিল এর সম্মুখ সারির শাখাগুলোকে দাওয়াতি কাজে ব্যবহার এবং এভাবেই জনগণের মাঝে বিস্তার করা। আল কায়েদার হিসাবটা ছিল যে সরাসরি তাদের নিজেদের কর্মীদের এ কাজে ব্যবহার তাদের নিজেদের সমর্থকদেরকেও আরও দূরে ঠেলে দিতে পারে এবং এতে পশ্চিমা শক্তির দৃষ্টিও তাদের দিকে আকৃষ্ট হতে পারে। এভাবে আল কায়েদা ভিন্ন ভিন্ন নামের গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে যার মধ্যে আনসার আল শরিয়া ছিল লিবিয়া এবং তিউনিসিয়ায় যাতে এসকল নতুন জায়গায় আল কায়েদার উপস্থিতি এবং তাদের জনসমাবেশ গুলোর উদ্দেশ্য ঢেকে রাখা যায়।
বিপ্লব পরবর্তী এসব দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার সম্প্রসারণ আল কায়েদাকে একটা দ্বৈত রাজনৈতিক-সামরিক পদ্ধতিতে কাজ করার সুযোগ দেয়। একদিকে দলের সামরিক শাখা বিভিন্ন জায়গায় নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করছিলো এবং তাদের আক্রমনাত্নক অবস্থানে যাওয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি করছিল, অন্যদিকে দলের রাজনৈতিক কর্মীদের লক্ষ্য ছিল দাওয়াহতে নিবদ্ধ। এজন্য তারা প্রচারণা, সামাজিক সেবা প্রদান এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমর্থন অর্জনের চেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছিল। এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছিলো যাতে পরবর্তীতে রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চূড়ান্ত মোকাবেলায় অবতীর্ণ হওয়া যায়।
আল কায়েদার দাওয়ার প্রতি এই জোর প্রদান এবং প্রচারনায় লিবিয়া এবং তিউনিসিয়ায় তারা যথেষ্ট পরিমাণ মানুষের কাছে পৌছতে সক্ষম হয়। আনসার আল শরিয়া ২০১২ সালে তিউনিসিয়ায় এক সম্মেলনের আয়োজন করে সেখানে অন্তত ৩,০০০ থেকে ১০,০০০ মানুষ অংশগ্রহণ করে। এই গ্রুপের বিভিন্ন সহিংস কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তিউনিসিয়ার সরকার তাদের ঐদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং ধরপাকড় শুরু করে, এতে তিউনিসিয়ায় আল কায়েদার প্রচারনা অভিযানের প্রায় সমাপ্তি ঘটে। ফলে এই গ্রুপটি জনসমক্ষে প্রচারণার পরিবর্তে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
যেসব দেশ আরব গণজাগরণের পর গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় এমন প্রায় প্রতিটি দেশে আল কায়েদা তাদের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়। এই গোলমেলে গণজাগরণের ফলে যে অস্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কার শুরু হয় তা গ্রুপটি নতুন নতুন অভিনব কৌশলের ব্যবহারের মাধ্যমে কাজে লাগায়। যারা মনে করত যে আল কায়দার কৌশল অপরিবর্তনীয় এবং তারা নতুন পরিস্থিতিতে অভিযোজন করতে পারে না, এভাবে তাদেরকে আল কায়েদা ভুল প্রমাণিত করল। কিন্তু পরবর্তীতে সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ তাদের সামাল দিতে হয়, তা আসে তাদের নিজের দল থেকেই, এমন একটা দল থেকে এই চ্যালেঞ্জ আসে যারা আল কায়েদার এই নতুন জনগণকেন্দ্রিক কৌশলকে প্রত্যাখ্যান করে।
ইসলামিক স্টেটের চ্যালেঞ্জ প্রতিরোধ
আইএসের আবির্ভাব আল কায়েদাকে এমন একটা চ্যালেঞ্জের সামনে দাড় করাল যার মোকাবেলা তাদের এর আগে কোন গ্রুপের সাথে করতে হয়নি। আইএসের উত্থানের পূর্বে বিভিন্ন কঠিন পরিক্ষা ও দুর্দশা সত্ত্বেও আল কায়েদা যেকোনো উপায়ে নিজেদেরকে জিহাদি মুভমেন্টের ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাখতে সমর্থ হয়েছিল। এর ফলে, অন্য জিহাদি গ্রুপের সাথে কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিযোগিতার অভাবে আল কায়েদা কৌশলগত ভাবে যেসব বিজয় অর্জন করছিল সেগুলকে ভাল প্রোপাগান্ডা বা প্রচারনা হিসেবে ব্যবহার করতে পারছিল না, বরং এগুলো সামান্য কিছু অর্জন হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছিল। বরং এর বিপরীতে আল কায়েদার একটা সুক্ষ দূরদর্শী পরিকল্পনা ছিল যাতে তারা সাংগঠনিকভাবে আরও বাড়তে পারে এবং অব্যাহতভাবে তার রাষ্ট্রীয় শত্রুদের অস্থিতিশীল করতে পারে। এই পরিকল্পনাকেই কাজে লাগানোর জন্যই আল কায়েদা আরব বসন্তে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং অগ্রবর্তী বিভিন্ন গ্রুপে নিজেদের উপস্থিতির মাধ্যমে এমন একটা কৌশল নিয়েছে যাতে একই সাথে নিজেদের আরও ছড়িয়ে দেয়া যায় এবং নিজেদের কর্মকাণ্ডকে অন্যদের কাছে ঝাপসা করে ফেলা যায়।
আইএসের হঠাৎ আগমন আল কায়েদার ক্রমান্বয়ে বিস্তার পরিকল্পনাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয় এবং আল কায়েদাকে জিহাদি মুভমেন্টে তার আধিপত্যের অবস্থান থেকে নামিয়ে দেয়। আইএসের কৌশল আল কায়েদা কর্তৃক সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, আর এটা (আইএসের কৌশল) এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যাতে আল কায়েদার মুল শক্তিকে দুর্বলতায় পরিণত করা যায়। যেখানে আগে আল কায়েদা আগে বাড়ত চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে, সেখানে আইএস এসে এই সুবিধাগুলোকে চুরি করে নেয়। আইএস ব্যাপকভাবে প্রোপাগান্ডার উপকরণ তৈরি করতে থাকলো যেগুলো এই ডিজিটাল যুগের জন্য উপযোগী, ব্যাপক সংখ্যক এইচডি ভিডিও, ছবি, বিবৃতি প্রকাশিত হচ্ছিল যেগুলোতে আইএসের বিভিন্ন বিজয়ের খবর প্রচারিত হচ্ছিল। আর এগুলো প্রচারিত হত তাদের সোশাল মিডিয়া সৈনিকদের মাধ্যমে। আল কায়েদা অন্যান্য অস্ত্রধারী গ্রুপের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইত, এমনকি জিহাদি চিন্তাধারা পোষণ করে না এমন গ্রুপ গুলোর সাথেও, সেখানে আইএস শুধুমাত্র সকল সুন্নি মুসলিম গ্রুপের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছিল। আল কায়েদা চেয়েছিল জনগনকেন্দ্রিক চেহারা বা রূপ ধরে রাখতে কিন্তু আইএস তার খিলাফতের অধিনস্ত জনগনের উপর তাদের নির্মমতার প্রচার করে যাচ্ছিল।
এরকম বেপরোয়া নীতির মাধ্যমে আইএস প্রকাশ্যে আল কায়েদার শাখাগুলোকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করছিল, যাতে আল কায়েদার গ্লোবাল নেটওয়ার্ক তাদের অংশ হয়ে যায়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেছিলেন যে, এই আন্তঃ জিহাদি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে আইএস ছিল উপরে এবং তারা আল কায়েদার আসল কৌশল বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। অনেক বিশ্লেষক সেসময় মনে করেন যে, আল কায়েদার প্রভাব ধরে রাখার একমাত্র উপায় হল আইএসের কৌশলকে অনুসরন করা, অর্থাৎ আইএসের মত অনুরুপ দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হামলা চালানো। একই ধরনের মত প্রকাশ করেন ক্লিন্ট ওয়াটস ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে Foreign Affairs Article এ, সেখানে বলা হয়েছিল আল কায়েদা আইএসের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের আসল রুপে ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে, যদি তারা আবার শারলি হেবদোর মত নাটকীয় কোন হামলা করতে পারে। কিন্তু আল কায়েদা প্রচলিত সব ধারনাকে তুচ্ছ প্রমাণিত করল। আইএসের অনুসরনের পরিবর্তে তারা বরং বিপরীত নীতি গ্রহণ করল। আল কায়েদা তাদের পাবলিক প্রোফাইল কমিয়ে ফেলল এবং নিজেদের সফলতার খবরগুলোকে ঢালাওভাবে প্রচার করার পরিবর্তে গোপন রাখল এবং নিজেদেরকে সাধারণ জনগনের সাথে মিশিয়ে ফেলল। এভাবে আল কায়েদা তার রক্তপিপাসু প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে নিজেদেরকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরল আরও রুচিশীল বিকল্প হিসেবে।
আইএসের ভয়ঙ্কর উত্থানের ফলে আল কায়েদা কিভাবে লাভবান হতে পারে তা বুঝা যাবে মিডিয়ার সাথে আল কায়েদা নেতাদের দেয়া বিভিন্ন বক্তব্য থেকে। ২০১৫ সালে আল জাজিরার একজন ডকুমেন্টারিয়ানের সাথে আলোচনায় অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা নুসরা ফ্রন্টের একজন ধর্মীয় নেতা আবু সুলাইমান আল মুহাজির সুন্নি মুসলিমদেরকে পথভ্রষ্ট করার জন্য আইএসকে দায়ী করেছেন। তিনি আইএসের সাথে আল নুসরার মতাদর্শের পার্থক্য নিয়ে আলোচনায় বলেন যে, “সিরিয়ার সাধারণ জনগনের এই অধিকার রয়েছে যে তারা নিজেদের নেতাদের বাছাই করে নেবে”। মুহাজির সাহেবের বিবৃতি থেকে এটা লক্ষ্যনীয় যে, আইএসের সাথে প্রোপাগান্ডা যুদ্ধে আল কায়েদা আঞ্চলিক এই কৌশলকে কাজে লাগাচ্ছে যেখানে তারা সাধারন জনগনের কাছে এটা চিত্রিত করেছে যে, আল নুসরা ফ্রন্ট হচ্ছে সিরিয়ান বিদ্রোহ এবং সিরিয়ান জনগনের নিজেদের একটা দল।
২০১৫ সালের জুনে দি গার্ডিয়ান একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে যেখানে আল কায়েদার সবচেয়ে সিনিয়র দুইজন ধর্মীয় নেতা আবু মুহাম্মদ আল মাকদিসি এবং আবু কাতাদা আল ফিলিস্তিনির সাক্ষাতকার ছাপানো হয়। এখানে আল কায়েদার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল প্রকাশিত হয়। এই সাক্ষাতকারে আল কায়েদার শক্তি সম্পর্কে সেরকম কোন ধারণা না দিয়ে তারা পাঠকদের এই ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন যে, আইএস অলরেডি আল কায়েদাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। মাকদিসি দাবি করেন যে, আল কায়েদার সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে আর অন্যদিকে আবু কাতাদা বলতে থাকেন যে যাওয়াহিরি সংগঠনের ভেতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এখানে তারা সম্পূর্ণ ভুল তথ্যের চিত্রায়ন করেছেন। আসলে আল কায়েদার শক্তি এসময় অন্য যেকোনো সময় থেকে বেশি ছিল, এছাড়া তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনগুলোও অবিরতভাবে শক্তি সঞ্চয় করছিল সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায়। যদি সত্যিই মাকদিসি এবং আবু কাতাদা আল কায়েদার ধ্বংসের ভয় করতেন, তাহলে তারা এর শক্তির জায়গাগুলো দেখিয়ে তার সমর্থকদের আশ্বস্ত করতে চাইতেন। বরং তারা এমন ভাবে আল কায়েদার দুর্বলতা গুলোকে তুলে ধরেন যে, এতে সরকারি বাহিনীগুলো তাদের দিক থেকে আর কিছু আশংকা করছিল না এবং এভাবে জঙ্গি গ্রুপটি অবাধে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যায়।
এই মিডিয়া চিত্রগুলো থেকে দেখা যায় আল কায়েদার অঙ্গসংগঠনগুলো কিভাবে কাজ করছিল। অন্যান্য ইসলামিক বিদ্রোহী দলগুলোর সাথে আল নুসরা ফ্রন্টের একটি কোয়ালিশন গঠন করার পর, ২০১৫ সালের এপ্রিলে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমের ইদলিব শহর দখল করা হয়। এরপর নুসরার আমির আবু মুহাম্মদ আল জুলানি এক অডিও বিবৃতিতে বলেন তার গ্রুপ অন্যদের ছাড়া একাই এই শহরটি শাসন করতে চায় না। জুলানির এই ঘোষণা ইদলিবের বাসিন্দা এবং অন্যান্য ইসলামিস্ট বিদ্রোহী উভয়কেই আশ্বস্ত করে যে, নুসরা ফ্রন্টের সাথে তারা কাজ করতে পারবে এবং তারা জনগণের উপর জোর করে তাদের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দেবে না।
ইয়েমেনের বন্দর নগরী মুকাল্লা দখলের পর যখন আল কায়েদা ইন দা আরাবিয়ান পেনিন্সুলা (একিউএপি) শাসন করতে যায় তখন তারাও এই একই রকমের কৌশল গ্রহণ করে। তারা এই শহর শাসন করার জন্য একটি স্থানীয় কাউন্সিলকে নিয়োগ দান করে, যারা হাদরামি ডোমেস্টিক কাউন্সিল নামে পরিচিত ছিল। প্রাথমিকভাবে শরিয়া বাস্তবায়নের জন্য একিউএপি ধীরে ধীরে কিছুটা নমনীয় একটি কৌশল গ্রহণ করে, যদিও তারা পরবর্তীতে শরিয়া ভঙ্গের জন্য কঠোর শাস্তি দেয়া শুরু করে। এভাবে আস্তে আস্তে শরিয়ার সাথে পরিচয় এবং শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম মাসগুলোয় বেশ বড় অপরাধের জন্যও সামান্য সাজা দিয়ে তারা আইএসের সাথে নিজেদের একটা পার্থক্য তৈরির মাধ্যমে স্থানীয় ইয়েমেনিদের মন জয় করে নেয়ার চেষ্টা করে। তার মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পরে, ২০১৫ সালের জুন মাসে প্রকাশিত এক ভিডিও বিবৃতিতে নাসির আল বুহাইশি পরোক্ষভাবে আইএসকে সমালোচনা করে দাবী করেন যে আইএস সাধারণ অপরাধের জন্যও যেভাবে শাস্তি দেয় তা শরিয়া সম্পর্কে তাদের “সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির” প্রতিফলন। বুহাইশির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে, ধীরে ধীরে শরিয়ার বাস্তবায়ন ধর্মতাত্ত্বিক ভাবে গ্রহণযোগ্য এবং কৌশলগতভাবেও বিজ্ঞোচিত কাজ। এতে প্রথম ধাপেই ইয়েমেনি জনসাধারণকে নিজেদের বিরোধী না করে তাদের সহজেই শরিয়া গ্রহণ করে নিতে সক্ষম করে তোলা হয়।
কিন্তু আল কায়েদা যখন বৈশ্বিক ভাবে এসকল পরিবর্তন করছে, তখন স্থানীয়ভাবে আইএসকে মোকাবেলার সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল ছিল তাদের সরাসরি প্রতিহত করা। আল কায়েদা আর আইএসের প্রতিযোগিতার বিশ্লেষণে বেশীরভাগ পর্যবেক্ষকের একটা সাধারণ ভুল ছিল যে তারা আল কায়েদার বিভিন্ন স্থানীয় অঙ্গসংগঠন সমুহের শক্তি, সাধারণ ঐক্য এবং আল কায়দার প্রতি তাদের আনুগত্যের অবমূল্যায়ন করেছিল। আল কায়েদার অঙ্গসংগঠনগুলো এটা প্রমান করেছিল যে তারা তাদের দল থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে এবং নিষ্ঠুরভাবেই প্রো-আইএস মনোভাব উৎখাত করতে চায়।
আল কায়েদার এই আইএস বিরোধী কৌশল খুবই কার্যকরী হয়েছিল সাহেল রিজিওনে। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত আল মুরাবিতুন জিহাদি গ্রুপ (সে সময় একিউআইএমের অংশ) এর মুখপাত্র আদনান আবু ওয়ালিদ আল সাহরাউই, ২০১৫ সালের মে মাসে আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সাহরাউইর এই ঘোষণা পশ্চিম আফ্রিকার মুভমেন্ট ফর ওয়াননেস ইন জিহাদ (এমইউজেএও) (একিউআইএমের অন্য একটি অংশ) এর প্রধান মুখতার বিল মুখতারের পছন্দ হয়নি। সাহরাউইর এই ঘোষণা ছিল মূলত সম্পূর্ণ আল মুরাবিতুন সংগঠনের পক্ষ থেকে। এরপর আল কায়েদার প্রতি অনুগত মুখতার বিল মুখতার দ্রুত এক বিবৃতি প্রদান করেন যেখানে তিনি বারবার আল মুরাবিতুনের আনুগত্য এখনো আল কায়েদার সাথেই আছে এই দাবী করতে থাকেন। তিনি আরও দাবী করেন সাহরাউই সংগঠনের অন্য কোন সদস্যের সাথে আলোচনা ছাড়াই এই ঘোষণা দিয়েছেন। বিল মুখতার এরপর আল মুরাবিতুনের প্রো-আইএস সদস্যদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৫ সালের জুনে এক সংঘর্ষে সাহরাউই আহত হন এবং তার ডজনের মত লোক এতে নিহত হয়। বেশ কয়েকমাস পর আল মুরাবিতুন আবার আনুষ্ঠানিকভাবে একিআইউএমে যোগদান করে এবং মূল আল কায়েদা নেটওয়ার্কে তারা আবার আগের অবস্থানে ফিরে যায়।
সাহরাউইর উপর বেল মুখতারের দমন অভিযানে সাহেল অঞ্চলে আইএসের সম্প্রসারণের সম্ভাবনা টুটে যায়। অবশ্য সাহরাউই ২০১৬ সালের মে মাসে এক অডিও বার্তায় পুনরায় আবির্ভূত হন, যেটা এক বছরের মধ্যে ছিল তার প্রথম প্রকাশ্য বিবৃতি, এতে তিনি বলেন তার নেটওয়ার্ক সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এতে একিউআইএম ই এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী জঙ্গি সংগঠন হিসেবে টিকে থাকলো। আইএসের সাহেলে এই ব্যর্থ প্রচেষ্টা আফ্রিকায় আল কায়েদার অবস্থানের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। কারন আল কায়েদা আফ্রিকায় আইএস কে এমন একটা আঞ্চলিক সংযোগ প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিহত করে যা উত্তর নাইজেরিয়ায় সক্রিয় আইএস অঙ্গসংগঠন বোকো হারাম এবং উত্তর আফ্রিকার লিবিয়াতে প্রতিষ্ঠিত আইএসের কেন্দ্রীয় কমান্ডকে একসাথে সংযুক্ত করতো।
আইএসের প্রচারণা সোমালিয়ায় সামান্য সুপ্রসন্ন হয়েছিল, তবে সেখানকার আল কায়েদা শাখা আল শাবাব তাদের ভেতরকার আইএস সমর্থকদের নির্মূল করার লক্ষ্যে একটি নির্দয় অভিযান চালায়। আইএসের প্রাথমিক প্রচেষ্টা ছিল আল শাবাবকে ঘুষ দিয়ে নিজের দলে আনা, যা প্রত্যাখ্যাত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে আইএস শাবাবের কিছু পদাতিক সৈন্য এবং মধ্যম পর্যায়ের কমান্ডারকে নিয়ে নতুন প্রো-আইএস গ্রুপ তৈরির চেষ্টা চালায়, যা শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ে। শাবাবের ইন্টেলিজেন্স উইং ‘আমনিয়্যাত’ অন্তত কয়েক ডজন প্রো-আইএস জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে। এবং পরবর্তীতে শাবাবের ক্রোধ থেকে বাঁচতে অন্যান্য আইএসের প্রতি সহানুভূতিশীলরা নিজেদের সরকারী নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। যেমনটা এক শাবাব কমান্ডার বলছিলেন, “সোমালিয়ার অনেক আইএস সমর্থকই আমনিয়্যাতের হাতে মৃত্যুর চাইতে নিজেদের শত্রুর হাতে তুলে দিতে পছন্দ করে।”
আমনিয়্যাতের এই দমন অভিযানের পরও আইএস সোমালিয়ায় একটা ছোট্ট পা রাখার জায়গা পেয়েছে। ২০১৫ সালের অক্টোবরে আল শাবাবের একজন ধর্মীয় নেতা আব্দুল কাদির মুমিন ১০০ যোদ্ধার একটা ছোট গ্রুপের পক্ষ থেকে আইএসকে বায়াত দেন। আসলে মুমিনের অবস্থান ছিল পুন্টল্যান্ডে, যা দক্ষিণ সোমালিয়ার শাবাবের ঘাটি হতে শত শত মাইল দূরে অবস্থিত। এতে তিনি প্রাথমিকভাবে আমনিয়্যাতকে এড়াতে পারলেও কিছুদিনের মধ্যেই তারা নিজেদের শাবাবের নাগালের মধ্যে আবিষ্কার করে। মুমিনের আইএসের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণার এক মাস পর শাবাব এক রেডিও সম্প্রচারে সতর্ক করে দেয় যে, তারা সকল আইএস সদস্যদের জবাই করে ফেলবে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পুন্টল্যান্ডে মুমিনের গ্রুপ এবং শাবাবের যোদ্ধাদের মধ্যে সংঘর্ষের সুত্রপাত হয়। এছাড়া আরও কিছু ছোট প্রো-আইএস গ্রুপকে দেখা যায় যারা মুমিনের পরপরই আইএসের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা করে, কিন্তু এদের কেউই শাবাবের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে নি।
সাহেল এবং সোমালিয়াই একমাত্র জায়গা নয় যেখানে আইএসের সামান্য জায়গা করে নিতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আফগানিস্তানে আইএসের প্রতিপক্ষ ছিল তাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী তালিবান যারা আইএসের প্রবৃদ্ধি কে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং বিভিন্ন প্রো-আইএস গ্রুপকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে তালিবান ইসলামিক মুভমেন্ট অফ উজবেকিস্তান (আইএমইউ) এর উপর ব্যাপক হামলা চালিয়ে তাদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেয়। আইএমইউ এর কয়েক মাস আগেই আইএসের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দেয়। আইএমইউর এই পরাজয় সম্পর্কে তাদের এক সমর্থকের মন্তব্য ছিল, “যে কাজ আমেরিকা ও তার এজেন্টরা ১৪ বছরে করতে পারে নি তালিবান তা মাত্র ২৪ ঘণ্টায় করেছে।” আফগানিস্তানে আইএসের এই সংগ্রাম আল কায়েদার জোট-গঠন কৌশলের জন্য ছিল পূর্ণ বিজয়। আইএস যেখানে সকল প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির সাথেই সংঘর্ষে যাচ্ছিল এবং তাদের ধ্বংসের চেষ্টা করছিল তখন আল কায়েদা তালিবানের মত এসব স্থানীয় শক্তির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছিলো। এছাড়া ইয়েমেনে আইএসের অভ্যন্তরীণ অনৈক্য তাদের প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ১০০ জনের উপরে আইএস যোদ্ধা, যারা আইএসের ইয়েমেনি শাখার মোট জনশক্তির ১০ শতাংশ, তাদের গভর্নর(ওয়ালি) এর সাথে মতানৈক্যের পর পক্ষত্যাগ করে।
মূলত যেখানে আগে থেকে আল কায়েদার অস্তিত্ব ছিল এমন অধিকাংশ দেশেই আইএসের নিজেদের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে হয়েছে । এমনকি যখন আইএস তাদের শিখরে ছিল তখনও আল কায়দার বেশিরভাগ অঙ্গসংগঠন তাদের প্রত্যাখ্যান করে এবং উলটো আইএসের প্রতি সহানুভূতিশীলদের তারা পশ্চাদ্ধাবন করে এবং তাদের নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এখন যখন আইএস প্রমানিতভাবেই সিরিয়া, ইরাক এবং লিবিয়া সবখানেই তাদের অঞ্চল হারাচ্ছে, তখন আল কায়দার বিভিন্ন শাখা থেকে আইএসের নিজের প্রতি সমর্থন বা আনুগত্য চাওয়ার সম্ভাবনা আরও খর্ব হচ্ছে। এটা হচ্ছে আইএসের নেটওয়ার্ক, যেটা এখন টুকরো টুকরো হওয়ার সম্মুখীন, আল কায়েদার নেটওয়ার্ক নয়।
আন্তঃ জিহাদি প্রতিযোগিতার ভবিষ্যৎ
২০১৬ সালের ২৮ জুলাই নুসরা ফ্রন্টের আমির আবু মুহাম্মদ আল জুলানি একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেন, যা ব্যাপকভাবে আল কায়দার সাথে এই গ্রুপের সম্পর্কচ্ছেদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই ভিডিওতে জুলানি জাবহাত আল নুসরার নামে যেকোনো অপারেশন বাতিলের ঘোষণা করেন এবং একটা নতুন গ্রুপ গঠনের ঘোষণা দেন যার নাম জাবহাত ফাতেহ আল শাম এবং “যেটা বাহ্যিক কোন সংস্থার শাখা নয়”। আল কায়দার বিধ্বংসী ব্র্যান্ড অথবা এই সংস্থার প্রদর্শন না করে বরং নুসরার আল কায়দা থেকে এই কথিত পৃথকীকরণ সিরিয়ায় আল কায়দার প্রাক-আইএস কৌশলে ফিরে যাওয়ার একটি প্রচেষ্টা।
পরিষ্কার করে বললে, জুলানি আসলে তার বিবৃতিতে আল কায়েদা থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। যদিও তার এই বিবৃতিটি এভাবেই সাজানো হয় যে, যাতে তা শ্রোতাদের এমন একটা ধারণা দেয়, আসলেই বুঝি নুসরা আল কায়েদাকে ত্যাগ করেছে। জুলানি কিন্তু কখনোই সরাসরি একথা বলেননি। যেমনটা টমাস জোসেলিন উল্লেখ করেছেন, জুলানির বিবৃতি “জাবহাত ফাতেহ আল শাম কোন বাহ্যিক সংস্থার শাখা নয়”, এ দাবির আসলে তেমন ভিত্তি নেই কারন সিরিয়াতে সিনিয়র আল কায়েদা কর্মকর্তাদের ব্যাপক উপস্থিতি। এতে মনে হচ্ছে যে সিরিয়াতে আল কায়েদার সিনিয়র কর্মকর্তারা জুলানির এই বর্ণনামতে সংগঠনের বাহিরে বলে গন্য হবে না। উপরন্তু জুলানি আইমান আল জাওয়াহিরিকে দেওয়া তার বায়াতের ব্যাপারে এখানে কিছু উল্লেখ না করায়, মনে হচ্ছে যে, তার ঐ বায়াত এখনো বৈধ আছে।
আইএস একটি উল্লেখযোগ্য স্বাধীন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আগে আল কায়েদার সিরিয়ার ব্যাপারে কৌশল ছিল যে তারা নুসরাকে সিরিয়ায় একটি সম্মুখবর্তী গ্রুপ হিসেবে ব্যবহার করবে এবং তারা যে আল কায়েদার অন্তর্ভুক্ত অঙ্গসংগঠন তা স্বীকার করা হবে না। কিন্তু আইএসের সাথে সংঘর্ষের পর এই কৌশলটা ব্যর্থ হয়ে যায় যখন আইএস নেতা আবু বকর আল বাগদাদি প্রকাশ্যে দাবী করেন যে, নুসরা তার অনুগত সংগঠন। এর জবাবে, জুলানি তখন স্বীকার করে নেন যে, নুসরা আল কায়েদা অধিভুক্ত একটি সংগঠন, তখন তিনি যাওয়াহিরির কাছে বাগদাদির সাথে তার সমস্যার সমাধানের অনুরোধ করেন। কিন্তু প্রথমদিকে আল কায়েদা চাইছিল না যে নুসরার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক আছে তা জানাজানি হোক। এর পরিবর্তে আল কায়েদা সিরিয়ায় নুসরাকে সম্মুখবর্তী গ্রুপ হিসেবে ব্যবহারের কৌশলেই অবিচল থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে নুসরা সম্ভবত আল কায়েদা থেকে বের হয়ে নতুনভাবে সংগঠিত হতে যাচ্ছে (যা তারা আসলেই পরবর্তী বছরে করল)। সম্ভবত নুসরা থেকে জাবহাত ফাতেহ আল শামে তাদের এই রুপান্তর এক বছর আগেই দেখা যেতো যদিনা সেসময় আল কায়েদা আইএসকে তাদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের জন্য হুমকি মনে না করত। নুসরা এবং আল কায়েদার এই পৃথকীকরণ থেকে আরেকটা জিনিস বুঝা যায় যে, আল কায়েদা এখন আর বিশ্বাস করে না যে তাদের এই পদক্ষেপে আইএস আর কোন ফায়দা হাসিল করতে পারবে।
এটা নিছক কোন জনসংযোগ পদক্ষেপ নয়। আল কায়েদা থেকে এই কথিত পৃথকীকরণ জাবহাত ফাতেহ আল শামকে অন্য বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সাথে গভীর সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ দেবে এবং সিরিয়ার বাহিরের পৃষ্ঠপোষকদের থেকে আরও বেশি সমর্থন পাওয়া যাবে। আল কায়েদার তাত্ত্বিকেরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে তারা এই সুনির্দিষ্ট সুবিধাগুলো আশা করছেন। আব্দুল্লাহ আল মুহাইসিনির মতে, নুসরাকে সাহায্য না করার জন্য অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো প্রধান যে অন্তরায়ের কথা বলতেন তা হল- এর সাথে আল কায়েদার সম্পর্ক – যা এখন আর নেই। আবু মুহাম্মদ আল মাকদিসি আরবি ভাষী সংবাদ মাধ্যমগুলোর সাথে এক আলোচনায় একটি ফতওয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন, কয়েক বছর আগে প্রকাশিত ঐ ফতওয়ায় বলা হয়, “যদি কোন নামে তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাড়ায়, তবে তা পরিবর্তন করা অনুমোদন যোগ্য”। অন্য কথায়, আল কায়েদা বিশ্বাস করে যে সিরিয়ায় যদি তারা লাভবান হতে চায় অন্যান্য রণক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা অনুসারে এখানেও সম্মুখবর্তী গ্রুপকেই ব্যবহার করতে হবে।
৯/১১ এরপর থেকে এখনই আল কায়েদাকে সবচেয়ে শক্তিশালী মনে হচ্ছে এবং এই গ্রুপের ইতিহাসে তর্কসাপেক্ষভাবে তারা এই মুহূর্তেই সবচেয়ে ভাল অবস্থানে আছে। যদি নুসরার সাথে আল কায়েদার পৃথকীকরণকে না ধরা হয়, তাহলে দেখা যায় সিরিয়ার উল্লেখযোগ্য অংশেই এই সংগঠনটি (আল কায়েদা) হল সবচেয়ে প্রভাবশালী সামরিক সংগঠন এবং সম্পূর্ণ দক্ষিণ ইয়েমেন জুড়ে রয়েছে তাদের ব্যাপক প্রভাব। আল কায়েদার সবচেয়ে নবীন শাখা আল কায়েদা ইন দা ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট (একিউআইএস) যেটা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে, তারা পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে অনেকটাই সংগঠিত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি। আল শাবাব এবং একিউআইএম আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে, যার মধ্যে আল শাবাব আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং সোমালিয়ার সরকারী বাহিনীর প্রতি আক্রমনের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে অথচ কিছুদিন আগেও মনে হচ্ছিল হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই আল শাবাবের পতন হবে।
আইএসের উত্থান ছাড়াও আরো বেশ কিছু উপাদান আল কায়েদার এসব সাফল্যে ভূমিকা রেখেছে। ভুরাজনৈতিক পরিবর্তন যেমন ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং অন্যান্য সুন্নি রাজ্যগুলোর অপ্রীতিকর লোকদের সাথে কাজ করতে আগ্রহী হওয়া যাতে বাসার আল আসাদের সরকারকে উৎখাত করা যায় তা সিরিয়া এবং ইয়েমেনে আল কায়েদাকে উপকৃত করেছে। এছাড়াও আল কায়েদা অব্যাহত ভাবে আরব গণজাগরণের সময়কার অস্থিতিশীল পরিবেশ থেকে লাভবান হয়েছে। আল কায়েদার আইএসের উত্থানকে সামাল দেয়াটাও আল কায়েদার সাফল্যের একটা উপাদান। যখন আইএস তার নিষ্ঠুরতা দিয়ে পুরো বিশ্বকে আতঙ্কিত করছিল এবং সুন্নি মুসলিমদের তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন করে তুলছিল তখন আল কায়েদা নিজেদের আইএসের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম চরমপন্থি এবং অধিক কার্যকরী বিকল্প হিসেবে স্থানীয় জনসাধারণ এবং অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর মাঝে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়।
আইএস এবং আল কায়েদার ব্যাপারে প্রচলিত ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। আইএস আল কায়েদার নেটওয়ার্ককে গ্রাস করতে পারে নি। এমনকি আল কায়েদা নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আইএসের উপর সেধরনের কোন হামলা চালায়নি যা আইএস চাচ্ছিল। এর পরিবর্তে আল কায়েদা দক্ষতার সাথে এবং সুক্ষভাবে আইএসের উত্থানকে নিজেদের অবস্থানের উন্নতিতে ব্যবহার করেছে। বিশ্লেষকরা আল কায়েদার বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে ধারণা করতে ব্যর্থ হন, এতে এই জিহাদি গোষ্ঠীকে মোকাবেলায় আমাদের বারবার পিছিয়ে পড়তে হয়।
এটা স্পষ্ট যে আল কায়েদা ভবিষ্যতে সাফল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে আইএসের চেয়ে ভাল অবস্থানে আছে। আইএসের তাৎক্ষণিক, ধ্রুব এবং অত্যন্ত প্রকাশ্য সফলতার এই মডেলটা তখনই কার্যকরী ছিল, যখন তারা জিতছিল। প্রকৃতপক্ষে, যখন আইএস ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে উত্তর ইরাকের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল তখন তাদেরকে অপ্রতিরোধ্য বলে মনে হচ্ছিল, একইসাথে তারা প্রত্যেক বিজয়ের পর অপপ্রচার চালাচ্ছিল। কিন্তু এটা স্পষ্ট নয় যে, তারা অসময়ের জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল কিনা। আর এখন চলছে তাদের খিলাফতের দুঃসময়।
অন্যদিকে আল কায়েদার প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার একটা সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। একিউআই এর ব্যর্থতা এবং আরব গণজাগরণ উভয়খানেই আল কায়েদা কৌশলগত ধৈর্য এবং নতুন পরিস্থিতির জন্য কৌশলকে পরিবর্তনের মাধ্যমে এ সব চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করেছে, এবং এসব স্থানের অভাবনীয় সুযোগগুলোকে নিজেদের কাজে লাগিয়েছে। আল কায়েদার এই দীর্ঘ খেলা এখনো চলছে। যখন আন্তর্জাতিক বিশ্ব আইএসকে নিয়েই মত্ত তখন আল কায়েদা রাডারের নিচে দিয়ে তার লক্ষ্যে পৌঁছে যাচ্ছে। এভাবে তারা সিরিয়া এবং ইয়েমেনে সমর্থন তৈরি করছে এবং শত্রু রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। আর তারা নিজেদের পোস্ট-আইএস ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করছে। খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা আল কায়েদারও লক্ষ্য কিন্তু তারা বিশ্বাস করে যে আইএসের মত একটা হঠকারী গ্রুপ এটা পারবে না, আর এজন্যই তারা অপেক্ষা করছে যে যখন জিহাদিদের শত্রুরা আইএসকে ধ্বংসাবশেষে পরিণত করে দেবে তখনই তারা নিজেদের খিলাফতের ঘোষণা দেবে।
এমনকি নিজেদের সম্ভাব্য মিত্রদেরও যেখানে আইএস শত্রু বানিয়ে ফেলতো, সেখানে আল কায়েদা তাদের দাতা এবং বহির্বিশ্বের সমর্থকদের সাথে একটা ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতো। ৯/১১ র হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরো বিশ্বে যে দাতব্য নেটওয়ার্ক আল কায়েদাকে সহায়তা করত তা বন্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু সময় পরিবর্তন হয়েছে। এখন সিরিয়া এবং অন্যান্য স্থানে বেশ কিছু রাষ্ট্র প্রকাশ্যে আল কায়েদাকে সাহায্য করে। বিভিন্ন বেসরকারি এবং আধাসরকারি সংস্থার আল কায়েদাকে সাহায্য করার সুযোগ তৈরি হয়েছে যাতে এই জিহাদি গোষ্ঠী আরও সম্প্রসারিত হতে পারে। যতদিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আল কায়েদার পরিকল্পনা এবং শক্তিকে অবমূল্যায়ন করবে, ততদিনে এই গোষ্ঠী জনগণের আরও গভিরে নিজেদের প্রোথিত করবে এবং তখন তাদের উৎখাত করাটা হবে আরও কঠিন।