JustPaste.it

জীবন পাথেয়

 

স্বামী-স্ত্রীর সামাজিক অধিকার

আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী

 

                বিবাহ একটা সুসংবদ্ধ বন্ধন, একটা সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতি। পুরুষ ও নারীর মাঝে সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে তোলার জন্যেই আল্লাহ তা'য়ালা এ ব্যবস্থা কার্যকর করেছেন৷ বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর উভয়ই উভয়ের জুড়ি। ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে স্বতন্ত্র হলেও বাস্তবতার দৃষ্টিতে তারা একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজন অপরজনের প্রতিভূ। প্রত্যেকেই নিজস্ব কামনা-বাসনা ও আশা-আকাঙক্ষা পরস্পর সম্পৃক্ত, সংযোজিত। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার এ সম্পর্কের চূড়ান্ত দৃঢ়তা ও অবিচ্ছিন্নতার কথা বোঝাবার উদ্দেশ্যেই কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

             'স্ত্রীরা তোমাদের পোশাক, তোমরা তাদের জন্যে পোশাক।’ (আল-বাকারা ৪ ১৮৭)

              আয়াতের আসল বক্তব্য হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রী পরস্পর সুসংবদ্ধ, পরস্পরের গোপনীয়তা আচ্ছাদনকারী, পরস্পরের সমর্থক ও সাহায্যকারী এবং একজনের অপরজনের জন্যে সৌন্দর্য বিধায়ক হতে হবে। অন্য কথায় প্রত্যেকেরই অপরজনের উপর অধিকার রয়েছে। সে অধিকার পুরা মাত্রায় অবশ্যই আদায় করতে হবে। এ অধিকার সম্পূর্ণ সমান, পুরুষদের প্রকৃতি অনুযায়ী তাদের দেওয়া বিশেষ অধিকার ছাড়া আল্লাহ্‌র কথা থেকেই তা স্পষ্ট। তিনি বলেনঃ

             ‘স্ত্রীদের জন্যে রয়েছে সে সব, যা আছে তাদের উপর সুস্পষ্ট ও প্রচলিত বা সাধারণ নিয়মে। তবে পুরুষদের জন্যে তাদের উপর একটা অগ্রাধিকার রয়েছে।' (আল-বাকারাঃ ২১৮)

              সে অগ্রাধিকারের পর্যায় হচ্ছে পরিচালক নিয়ন্ত্রক দায়িত্বশীল ও জওয়াবদিহি করতে বাধ্য হওয়ার। নবী করীম (সঃ) কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেসা করলেনঃ আমাদের উপর আমাদের স্ত্রীদের কি অধিকার রয়েছে? জওয়াবে তিনি বললেনঃ

               ‘তা হচ্ছে, তাদের নিজেদের সঙ্গে খাওয়াবে, নিজেদের মতই পরাবে। তার মুখমন্ডলের উপর মারবে না, তাকে খারাপ অশ্লীল গালাগালি করবে না এবং তাকে তার ঘর ছাড়া অন্য কোথাও ছাড়বে না।’ (আবু-দাউদ, ইবনে হাব্বান)

             কাজেই নিজ স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ব্যাপারে ঔদাসিন্য বা উপেক্ষা দেখানো কোন মুসলমানের পক্ষেই জায়েয নয়। হাদীসে বলা হয়েছেঃ

             'একজন লোকের গুনাহগার হওয়ার জন্যে এতটুকুই যথেষ্ট যে, যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার উপর অর্পিত, তাদের প্রতি সে ব্যাপারে চরম উপেক্ষা দেখাবে।' (-আবু দাউদ, নাসায়ী, হাকেম)

            স্ত্রীর মুখের উপর মারার কোন অনুমতি ইসলাম দেয়নি। কেননা, এ কাজ মানবীয় সম্মান ও মর্যাদার পরিপন্থী। তাতে দেহের সর্বাধিক সম্মানার্হ ও মর্যাদাসম্পন্ন অংগ-দেহের সমস্ত সৌন্দর্য যেখানে কেন্দ্রীভূত-আহত ও ক্ষুন্ন হয়। নাফরমান ও সেচ্ছাচারী স্ত্রীকে প্রয়োজন মত সুশিক্ষা দান ও গড়ে তোলার প্রশ্নে কখনও কখনও স্ত্রীকে হালকাভাবে মারাও যেতে পারে। কিন্তু তাকে কষ্ট দেওয়া ও মুখমন্ডলকে ক্ষতবিক্ষত করার মত মার মারা কিছুতেই জায়েয হতে পারেনা। স্ত্রীকে গালাগালি করাও জায়েয নয়। তার মনে কষ্ট দেওয়া, তার জন্যে অসহনীয় কথাবার্তা বলা, তার জন্যে বদদোয়া করা প্রভৃতিও সম্পূর্ণ না-জায়েয।

              স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার পর্যায়ে নিম্নোদ্ধৃত হাদীসটি উল্লেখ্য। নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ

            ‘যে স্ত্রীলোক আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমানদার, তার পক্ষে তার স্বামীর ঘরে এমন ব্যক্তিকে আসবার অনুমতি দেওয়া বৈধ নয়, যাকে তার স্বামী পছন্দ করেনা। স্বামীর অনুমতি ব্যতীত ঘরের বাইরে যাওয়াও তার জন্যে জায়েয নয়। এ ব্যাপারে অপর কারুর কথা মান্য করাও তার উচিত নয়, স্বামীর শয্যা থেকে দূরে থাকাও বাঞ্ছনীয় নয়। স্বামী যদি অত্যাচারী হয়, তা হলে তাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্যে স্বীয় সাধ্যমত চেষ্টা চালাবে। তার এই খিদমত স্বামী গ্রহণ করলে তো ভালই। আল্লাহ তার ওযর কবুল করে নেবেন এবং তার সত্যপন্থী হওয়াটাও প্রকাশ করে দেবেন। আর স্বামী যদি রাযী না হয়, তা হলে আল্লাহর কাছে তার অক্ষমতার ওযর পৌঁছে যাবে।’ (-হাকেম)

 

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ধৈর্য ধারণ

              মুসলিম স্বামী মাত্রেরই কর্তব্য তার স্ত্রীর ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করা। বিশেষ করে তার মধ্যে যদি এমন কিছু লক্ষ্য করে যা তার পছন্দ নয়। মানুষের মধ্যে মানুষ হওয়ার কারণে যে সব দোষক্রটি স্বাভাবিকভাবেই থাকে, আর স্ত্রীলোকদের মধ্যে নারীত্বজনিত যে সব দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়, তা সহ্য করে নিতে অভ্যস্ত হওয়া স্বামীর একান্তই কর্তব্য। অনুরুপভাবে স্ত্রীর দোষগুলোর তুলনায় তার গুণগুলো এবং ক্রটি-বিচ্যুতি অপেক্ষা ভাল ভাল দিকগুলোর প্রতিই নযর প্রকট করে রাখা বাঞ্চনীয়। হাদীসে বলা হয়েছেঃ

             ‘কোন ঈমানদার পুরুষ যেন কোন ঈমানদার নারীকে ঘৃণা না করে। কেননা তার মধ্যে একটি ব্যাপার যদি অপছন্দনীয় থাকে, তা হলে অপরাপর গুণাবলী নিশ্চয়ই পছন্দনীয় পাওয়া যাবে।’

           আর আল্লাহ্‌ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেনঃ

           ‘তোমরা স্ত্রীদের সাথে ভালভাবে বসবাস ও জীবন যাপন কর (ভাল আচরণ গ্রহণ কর) তোমরা যদি তাদের অপছন্দ কর, তা হলে অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ তাদের মধ্যে অনেক কিছুই ভাল ও কল্যাণ জমা করে রেখেছেন।’

            ইসলাম যেভাবে স্বামীকে স্ত্রীদের অপছন্দনীয় ব্যাপারাদিতে ধৈর্য ধারণ করতে ও পরম সহিষ্ণুতা দেখাতে বলেছে, তেমনি স্ত্রীদেরও নির্দেশ দিয়েছে নিজ নিজ স্বামীকে যথাসাধ্য সন্তুষ্ট রাখার জন্যে চেষ্টা চালিয়ে যেতে এবং স্বামীকে অসন্তুষ্ট রেখে রাত যাপন না করতে। হাদীসে বলা হয়েছেঃ

             ‘তিন ব্যক্তির নামায তাদের মাথার এক বিঘত উপরেও যায় না, এক সে ব্যক্তি যে লোকদের ইমামতি করে অথচ সেই লোকেরা তাকে পছন্দ করে না। দ্বিতীয় সেই স্ত্রীলোক, যে স্বামীকে অসন্তুষ্ট অবস্থায় রেখে রাত যাপন করে। আর তৃতীয় এমন দু’ভাই, যারা পরস্পরের সাথে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত।’

 

স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ দেখা দিলে

               পুরুষ ঘর ও পরিবারের কর্তা, পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। তাকে এ উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তার মধ্যেই এর যোগ্যতা পাওয়া যায় বিধায় জীবন-সংগ্রাম ক্ষেত্রে তার মর্যাদাও এরূপই বলে এবং মোহরানা ও খরচাদি বহনের দায়িত্ব তারই বলে এ মর্যাদায় তাকে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। অতএব তার আনুগত্য না করা ও আনুগত্য-বহির্ভূত কাজ করা, তার অবাধ্য হওয়া এবং তাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার কোন অধিকার স্ত্রীর থাকতে পারে না। এরূপ যদি করা হয়ই তাহলে পারস্পারিক সম্পর্ক খুবই খারাপ হয়ে যাওয়া অবধারিত। সংসার তরণী হাবুডুবু খাবে এবং কোন প্রকৃত মাঝির অনুপস্থিতির কারণে তার সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়।

                 স্বামী যখন লক্ষ্য করবে যে, স্ত্রীর পক্ষ থেকে তাকে অমান্য করা হচ্ছে, স্ত্রী তার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে চলছে, তখন ভাল ভাল উপদেশ যুক্তিপূর্ণ প্রাণস্পর্শী কথাবার্তা দ্বারা তাকে সংশোধন করার সাধ্যমত চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কিন্তু উপদেশ, কার্যকর না হলে তাকে তার শয্যায় পরিহার ও বর্জন করতে হবে, যেন তার মধ্যে নারীসুলভ ভাবধারা জাগ্রত হয় এবং শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে বাধ্য ও অনুগত হয়ে যায়।

                 ব্যবস্থাপনা কার্যকর না হলে তখন তার উপর হাত তোলা যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে চরম মাত্রার মারধোর, নিপীড়ন ও মুখের উপর আঘাত করা কিছুতেই চলবে না, তা সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবেই। কোন কোন স্ত্রীলোকের জন্যে এ হালকা ধরনের মারধোর অনেকটা কল্যাণকর ও সঞ্জীবক হয়ে দেখা দেয়। মারধোর অর্থ চাবুক বা ডান্ডা বা লাঠি দ্বারা মারা নয়। নবী করীম (সাঃ)-এর একটি উক্তি থেকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়। তাঁর কোন খাদেম কোন ব্যাপারে তাকে রাগিয়েছিল কোন বিশেষ কাজের জন্যে। তখন তিন বলেছিলেনঃ

                ‘কিয়ামতের দিন বদলা নেওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে আমি তোমাকে এ মিসওয়াক দ্বারাই আঘাত দিতাম।’ (তাবাকাতে ইবনে সা'আদ)

               মারধোর করাটা রাসূলে করীম (সাঃ) আদৌ পছন্দ করেননি। তিনি বলেছেনঃ

               ‘তোমাদের এক একজন তার স্ত্রীকে এমনভাবে মারধোর করে কেন, যেমন মনিব তার দাসকে মারছে? অথচ তারপরই সম্ভবত, রাত্রিকালেই সে তার সাথে সংগম করবে।’ (মুসনাদে ইমাম আহমাদ)

                  যারা তাদের স্ত্রীলোকদের মারধোর করে, তাদের সম্পর্কে নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ

                 ‘এ ধরনের লোক তোমাদের মধ্যে কখনও ভাল লোক বলে গণ্য হতে পারে না।’ (আহমাদ, আবূ দাউদ, নাসায়ী)

 

হাফেয ইবনুল হাজার লিখেছেনঃ

               ‘তোমাদের মধ্যে যারা ভাল লোক, তারা কখনও নিজেদের স্ত্রীদের মারধোর করবে না।' রসূলে করীম (সাঃ)-এর এ কথা থেকে বোঝা যায় যে, স্ত্রীদের মারা মোটামুটি জায়েয বটে। তবে তার সঠিক সময় হচ্ছে তখন, যখন স্বামী তার স্ত্রীর মধ্যে যে ব্যাপারে তার আনুগত্য করা কর্তব্য সেই ব্যাপারে অবাধ্যতা দেখতে পায়। এরূপ অবস্থায় সে তাকে বাধ্য ও আনুগত্যের উদ্দেশ্যে মারতে পারে। তবে যদি ধমক ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদির দ্বারা কাজ চলে, তাহলে মারপিট অবশ্যই পরিহার করতে হবে। কেননা তাতে স্ত্রীর মনে স্বামীর প্রতি ঘৃণা তীব্র হয়ে উঠে। আর তা সম্প্রীতিপূর্ণ দাম্পত্য জীবনের পরিপন্থী। অথচ বিবাহিত জীবনের তা-ই হচ্ছে আসল লক্ষ্য। কিন্তু আল্লাহ্‌র নাফরমানী সংক্রান্ত কোন ব্যাপারে যদি তাকে মারতে হয়, তবে তা স্বতন্ত্র কথা।

             নাসায়ী গ্রন্থে হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ননা করেছেনঃ

             ‘রাসূলে করীম (সাঃ) তার কোন বেগমকে কিংবা কোন খাদেমকে কখনোই মারেননি। অপর কাউকেও তিনি কখনও মারবার জন্যে হাত তোলেননি। তবে আল্লাহ্‌র পথে কিংবা আল্লাহ্‌র মর্যাদা নষ্ট করার দরুন আল্লাহরই ওয়াস্তে কাউকে শাস্তি দিয়ে থাকলে সে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাপার।’ (ফতহুল বারীঃ খঃ ৯, পৃঃ ২৯)

            কিন্তু এসব পদক্ষেপও যদি ব্যর্থ হয় ও অফলপ্রসূ হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দেয়, তা’হলে তখনই ইসলামী সমাজের প্রভাবশালী কর্তৃত্বসম্পন্ন ও কল্যাণকামী লোকেরা তাতে হস্তক্ষেপ করে সংশোধনের জন্যে চেষ্টা চালাবে। তার পন্থা হচ্ছে, স্বামীর পক্ষ থেকে একজন সালিশকারী নিয়োগ করতে হবে, যারা বাস্তবিকই উভয়ের কল্যাণকামী হবে। তারা স্বামী-স্ত্রীকে মিলিত করতে ও যে বিরোধ দেখা দিয়েছে তা দূর করতে চেষ্টা করবে, তা’হলে আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে মিলমিশ সৃষ্টি করে দেবেন। এসব ব্যাপারে মহান আল্লাহ্‌র ঘোষণা হচ্ছেঃ

                ‘যেসব স্ত্রী সম্পর্কে তোমরা বিদ্রোহ ও অবাধ্যতার আশংকা বোধ করবে, তাদের বোঝাও ও উপদেশ দাও। তাদের শয্যায় তাদের ত্যাগ কর এবং তাদের মার। পরে যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে, তা হলে বেড়িও না। নিশ্চিত জানবে, আল্লাহ উচ্চতর ও বড়ই মহান। আর তোমাদের পরস্পরে বিচ্ছেদের আশংকা দেখা দিলে স্বামীর আত্মীয়ের মধ্যে থেকে একজন ও স্ত্রীর আত্মীয়দের মধ্যে থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত কর। এরা দু’জন যদি বাস্তবিকই সংশোধনের চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালায়, তা হলে আল্লাহ তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে দেবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সর্ববিষয় অবহিত। (নিসাঃ ৩৪-৩৫)