JustPaste.it

নির্বাচিত নিবন্ধ

 

দ্বীনের দুর্দিনঃ আবু লাহাবের নসীব ও আরাফাতের স্মৃতি
কামরুজ্জামান লস্কর


সেদিন এক সতীর্থের মৃত্যু হলো। জানাজার পর লাশ দেখানো হচ্ছিলো। চেহারাটি দেখে মনে বড় আফসোস হলো। আহা, মুখমন্ডলটি একেবারে খালি রয়ে গেলো। অথচ বন্ধুটি দীর্ঘদিন থেকে মুত্যুর অপেক্ষায় ছিলেন। কঠিন রোগের শেষ চিকিৎসা চলছিলো। আফসোস হলো এই জন্য যে, নবীজির সুন্নতি দাড়ি, যা রাখা আমাদের জন্য ওয়াজিব, তা নিয়ে তিনি দুনিয়া থেকে যেতে পারলেন না। 
আমরা ঈমান নিয়ে মরতে চাই, কিন্তু দুনিয়ার হায়াতে মুসলমানি জীবন যাপন পছন্দ করিনা। নামাজ কালাম করবো, বাবুগিরিও করবো। দাড়ি আর লম্বা কোর্তা এসব হুজুরদের মানায়। টুপী শুধু নামাজের জন্য কয়েকমিনিট পরা যাবে। প্যান্টের দৈর্ঘ্য খাটো করা সম্ভব নয়, নামাজের সময় দরকার হলে দু'চার ভাঁজ দিয়ে খাটো করে নেয়া যাবে; অথচ টাখনুর উপর কাপড় পরা সব সময়ের আমল, নীচে ঝুলানো সর্বাবস্থায় হারাম। 
এইভাবে নিজেই নিজের জীবনকে আলাদা আলাদা খাতে ভাগ করে নিয়েছি। একভাগে দ্বীন আর অন্যভাগে দুনিয়া। দ্বীনের খাতে যা কিছু দিয়েছি, তা আবার নিজেই ছিনতাই করে দুনিয়ার খাতে পাচার করে দিই। দ্বীনের জন্য সামান্য যা বরাদ্দ করেছি, তাকেই আবার যখন তখন কাট ছাট করে দুনিয়ার খাতে জোগান দিচ্ছি। 
কেউ খাল খাটে পানির জন্য। কেউ কাটে কুমীর আনার জন্য। ঘরে যখন সাপের ভয়, নদীতে তখন হাংগর কুমীর। বাঘ তো ওপারে বসেই আছে। সবেমাত্র জোয়ার এসেছে। বসত বাটি টালমাটাল। দ্বীনের এখন সমূহ বিপদ। ইসলামী চাল-চলন, বেশ ভূষা, জীবন ব্যবস্থা এসবের ধারে কাছে যেতে অনেকের সাহস হয়না। কঠিন এক হীনমন্যতায় মাথা হেঁট করে আছে সবাই। এদেশের হাজার হাজার আলেম-উলামা লক্ষ লক্ষ তালেৰে ইলম সবাই প্রায় এই অবস্থার শিকার। আল্লাহর দ্বীন হতে দূরে থেকে দূরে অবস্থানকারীরা তাদের কটাক্ষ করে তাচ্ছিল্য করে। নিজেদের কুভাষায় মন্তব্য করে তারপরও মাথা তুলে জবাব দেন না আল্লাহর নিরীহ বান্দারা। তবে এক বান্দাকে দেখেছি, যিনি তথাকথিত শিক্ষিত নামধারীদের ও সাহেবী চালওয়ালাদের মোকাবিলা করতেন। হঠকারী কথা ও কাজের সমুচিত জবাব দিতেন। অত্যন্ত নির্ভীক ও স্পষ্টবাদী ছিলেন তিনি। 
ইনি মাওলানা সাইফী। প্রথমে ছিলেন মসজিদের ইমাম। মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন সিনেমার ব্যবসার সাথে জড়িত। একলোক সংগত কারণেই ইমামের সাথে তার মতবিরোধ হলো। সভাপতি সাহেবের বুজুর্গী কিছু লোককে চোখ ধাধিয়ে দিলো। ঢাকা শহরে খড়ম পায়ে চলাফিরা করেন। ইমাম পরাজিত হলেন। তবে বিনাযুদ্ধে নয়; রীতিমতো লড়াই করে। এরপর হলেন মাদ্রাসার মুহতামিম।

সেই সময়ের কথাঃ একদিন আমি ও মাওলানা সাইফী গুলিস্তান থেকে ফিরছিলাম। টেম্পুষ্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে টেম্পু ধরার চেষ্টা করছিলাম। টেম্পু ষ্ট্যান্ড তো নয় যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র। একের পর এক টেম্পু বিভিন্ন জায়গা থেকে গুলিস্তান আসছে, যাত্রী নামার সাথে সাথে প্রচন্ড হৈ হুল্লুড় করে মুহর্তে আবার যাত্রী বোঝাই করে তীরবেগে ছুটে চলে যাচ্ছে। রাস্তার একপাশে যাত্রী নামার আগেই শুরু হয়ে যাচ্ছে আরোহনের লড়াই। সাইফীর মাথায় পাগড়ী, মুখমন্ডল জুড়ে দাড়ি, গায়ে দীর্ঘ কোর্তা এবং সুঠাম দেহ। প্রতিযোগিতায় তিনি পিছিয়ে নেই। আমি প্রৌঢ় ও দুর্বল। অতএব তাঁর পিছনে থেকে ভাগ্য পরীক্ষা করছি। একটির পর একটি করে টেম্পু যাত্রীতে পূর্ণ হয়ে চলে যাচ্ছে অথচ সাইফী উঠতে পারছেন না। অথচ তারই আগে উঠার কথা। কেননা তিনি বয়সে যুবক এবং অনেকের চেয়ে বেশী শক্তিশালী। আসলে তিনি খুব একটা জোর করছিলেননা এবং অন্যদেরকে ছাড় দিচ্ছিলেন। আমি ইশারায় বুঝলাম, এভাবে। যাবার আশা বৃথা। জোর করেই উঠতে হবে। এবার সাইফী যেন কিছুটা কঠোর হলেন পরের টেম্পুটি আসা মাত্রই তিনি ঝাপিয়ে পড়লেন সবার আগে। আমিও যথারীতি পিছন থেকে ঝাপটে ধরলাম তার দেহকে। 
কিন্তু মুসকিল হলো টেম্পুর হেলপারকে নিয়ে। সেও যুবক এবং শক্তিশালী। সাইফীর ঠিক সামনে হাত বাড়িয়ে টেম্পুর রড ধরে। তাঁর পথ রুদ্ধ করে দিলো। আর তখনই অপর পাশ দিয়ে দু'একজন উঠে পড়লো। সাইফী তাড়াতাড়ি অপর পাশে গিয়ে উঠতে চেষ্টা করতে যুবকটি আবার অন্যপাশের রড ধরে পথ আটকে দিলো। এবার পূর্ববর্তী দিক খোলা পেয়ে দু'একজন টপ্ করে ভিতরে ঢুকে পড়লো। সাইফী এ পাশে তো ছেলের হাতও এ পাশে। এ যেন এক অদ্ভুত খেলা । তবে ব্যাপারটা অন্য কিছু নয়। সাইফীর দেহটি আকতিতে একটু বড়। মোটা মানুষ। এটাই হয়েছে কাল। তিনি টেম্পুতে উঠলে জায়গা বেশী দখল হবে, এখানেই হেলপারের আপত্তি। এদিকে টেম্পুর সিট শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছে। সাইফী মরিয়া হয়ে যুবকটির রডে আঁকড়ে ধরা হাত ধরে এমন টান দিলেন যে, হাত না ছাড়লে হয়তো হাতের চামড়া অক্ষত থাকতোনা। চেহারার অবস্থা দেখে আমার বুঝতে কষ্ট হলোনা যে, বাবাজীর হাত এবং রড উভয়ের ঘর্ষণে বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেছে । যাই হোক সাইফী ভিতরে শেষমুহুর্তে প্রবেশ করলেন, আমার শেষ রক্ষা হলো । 
টেম্পু ছেড়ে দিলো। হেলপারের কঠিন একটি তিরস্কার সকলের কানে পৌছুলোঃ ‘মাইষের ঘরে মাগনা খাইতে খাইতে হুজুরগো গায়ে চর্বি জমছে, গায়ের জোর দেখায়।' যাত্রীরা অলক্ষ্যে সাইফীর দিকে এক ঝলক তাকালেন। তবে সাইফী একেবারে চুপচাপ। অর্ধেক পথ চলার পর হেলপার। ভাড়া নেয়া শুরু করলো, যাত্রীরা একে একে ভাড়া দিচ্ছেন। সাইফী ভাড়ার টাকা হাতে নিয়ে বসে আছেন। হেলপার সবশেষে ভাড়ার জন্য সাইফীর দিকে হাত বাড়ালো। এবার তিনি মুখ খুললেন। অত্যন্ত শান্তভাবে বলতে লাগলেনঃ “হ্যা বেটা, ঠিকই বলেছো, হুজুররা কোনো কোনো সময় মানুষের ঘরে মাগনাই খান। তোমার মতো গরীবের ঘরে কী-ইবা থাকে দেবার মতো? যেমন ধরো, তোমার বাবা যখন তোমার মাকে বিয়ে করেছিলেন, তখন ঐ গরীব বাবাকে কোনো হুজুর মাগনাই বিয়ে পড়িয়েছিলেন। এসব মাগনা কাজে মাঝে মাঝে মাগনা খাওয়া হয় বৈকি? তবে এ কথাটাও মনে রেখো, এ রকম মাগনা খাওয়া আর মাগনা কাজে হুজুররা রাজী না হলে তোমার মতো বহু সন্তান হারাম হয়ে পয়দা হতো। হুজুরদের অসম্মান করোনা, তাতে নিমকহারামি হবে। আপন-পর চিনতে ভুল করোনা, নিজেই ক্ষতিগ্রন্থ হবে।' সাইফী আরো কিছু বলতে চাইছিলেন; যাত্রীদের কেউ কেউ জোড়হাতে অনুরোধ করতে লাগলেনঃ ‘হুজুর, খুব হয়েছে। বেওকুফ সমুচিত জবাব পেয়েছে।' একজন তো এই বলে হেলপারকে মারতেই উদ্ধৃত হলেনঃ ‘তোর কত বড় সাহস যে, হুজুরকে টেম্পুতে উঠতে বাধা দিচ্ছিলি?' ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।
দ্বীনের এখন দুর্দিন। দ্বীনদারের দুর্দিন। দ্বীনের ইলম এখন সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। তালেবে ইলিমকে 'তালেবান' বলে। পত্র-পত্রিকা কটাক্ষ করে। আল্লাহর মনোনীত দ্বীনের হেফাজতে জীবনদানকারী মুজাহিদ এখন আইনের শত্রু। আল্লাহর আইনকে প্রতিষ্ঠাকারী এখন মানুষের আইন প্রতিষ্ঠাকারীর আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দন্ডায়মান। কলেমাকে গালিব করার অপরাধে জিহাদের ময়দানে শৃঙ্খলিত হয় মরণজয়ী সৈনিক। তাগুতের জিন্দানখানায় বিনা বিচারে বন্দী হয় জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর একনিষ্ঠ মুমিন। মানুষের বেতনভুক কর্মচারী কলেমার পতাকাবাহীকে ধমক দেয় এবং তারপরও আল্লাহর বান্দাহ বলে নিজেকে দাবী করে। কুফরী সান্নিধ্য দুনিয়ার হুকমবরদারকে এমন নিষ্ঠুর করে দিয়েছে যে, কোথাও পালাবার পরামর্শ দেয়। এইসব পথচ্যুৎ দ্বীনহীন বেতনভূক দুর্ভাগারা দুনিয়াতে মুসলমানের মতোই জীবনযাপন করে, মৃত্যুবরণ করে এমনভাবে, যেন মুসলমান হয়েই মরেছে, যদিও দ্বীনের দুষমন কখনো দ্বীনের উপর মৃত্যুবরণ করে না। দ্বীনের দুষমনের কাছে দ্বীনকে জিম্মি রেখে যারা নিজেরাও আল্লাহর দুষমনে পরিণত হয়েছে, তাদের জিল্লতি আল্লাহপাক দুনিয়াতেই তাদের বংশধরদেরকে দেখিয়ে থাকেন তার চিরন্তন কৌশলে।
ইসলাম তার অনুসারীকে এমন দৃঢ়চিত্ত করে দেয় যে, মুসলমান দৃশ্যমান কোনো জিনিষকে যেভাবে বিশ্বাস করে অদৃশ্যকেও সেইভাবে বিশ্বাস করতে পারে। আল্লাহপাকের অবশ্যম্ভাবী বিধিলিপি কিছুতেই খন্ডন হতে পারেনা। একথা সে জানে এবং নির্ভুলভাবে জানে। নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আবু লাহাবের মৃত্যুর দশ বছর আগে কুরআনের সেই আয়াতে ঘোষণা করেছিলেন, যেখানে বলা হয়েছেঃ আবু লাহাব জাহান্নামের বাসিন্দা। এতটুকু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলোনা এই অলঙ্ঘণীয় ভবিষ্যত্বাণী প্রচার করতে, কেননা এ যে আল্লাহপাকের কালাম। আবু লাহারের কাছেও তা গোপন ছিলোনা। তবু তার সাধ্য হয় নাই দশ বছরের মধ্যে একটিবার অন্ততঃ মিথ্যা করে হলেও, মুনাফেকী করে হলেও বলতে যে, আমি কলেমা পড়েছি, তোমরা দেখে নাও মুহাম্মদের ঘোষণা এখন তো মিথ্যা হয়ে গেলো। 
আজকের দুনিয়ায় যারা ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় ইসলামের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ইসলামের দুষমনের অংগুলি হেলনে যারা সাপের মতো মাথা দুলাচ্ছে, তারা কি কপালের লিখন পড়তে পারেনা? আপন নসীবকে মসীলিপ্ত করে কোন কামিয়াবীর জন্য দিন গুনছে হতভাগারা? 
দ্বীনের সৈনিক ঠান্ডা মেরে গেলে চলবে কেন? দ্বীনের পথ কোনো চোরাগোপ্তা পথ নয়। এ পথের পথিককে হয়রানি করার দুঃসাহস যে করে, সে এই অপকর্ম চোরাপথেই করে। পথিক একা হলেই পথের বিপদ তাকে পেয়ে বসে। ইসলামের কাফেলা, তাই নিঃসঙ্গ চলেনা। আল্লাহর দ্বীনকে এমনকি ইশারা ইংগিতে কটাক্ষ করবে এমন নষ্ট চিন্তাও যেন কেউ না করে। আল্লাহর পথে কন্টক বিছানো যাবেনা, বিছালে সেই কাঁটার বিষে নিজেকেই মরতে হবে, নিজের পাপে বংশের ধারা বিচ্ছিন্ন হবে। বিলুপ্ত হবে। আল্লাহর নির্ধারিত কাজে গোয়েন্দা পাঠালে প্রবল প্রতাপান্বিত রাজাধিরাজ পরম কুশলী আল্লাহপাকের গোয়েন্দা পিছন ছাড়বেনা। ঈমানের তেজে যারা দৃপ্ত, তারা দুনিয়ার প্রতি বেপরোয়া। পথ আর পথিক, দুইয়ের মালিক যখন আল্লাহ, তখন বেপরোয়া হওয়াই স্বাভাবিক। তবে দ্বীনের পতাকাবাহীর সমান্তরাল যারা চলেন, তাঁরা যেন ঠান্ডা মেরে যান। এটা কোনো ইনসাফের কথা নয়। আল্লাহ বেইনসাফীকেও ছেড়ে দেবেন না। 
দ্বীনের এমন দুর্দিন এই জনপথের অধিবাসী সম্ভবতঃ এর আগে আর কোনোদিন প্রত্যক্ষ করেনি। আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষের চিন্তা-চেতনাকে উপলব্ধি করার জ্ঞানটুকুও বিসর্জন দিয়েছি। যেন আমাদের পূর্বপুরুষ সকলেই মূর্খ ছিলেন, আমরাই কেবল জ্ঞানবান হলাম। অথচ তাদের জ্ঞানের উৎস ছিলো আল্লাহর দ্বীনের আলো। আমাদের জ্ঞানবুদ্ধি তো এমন যে, না আমরা তাদের উত্তরসূরীর যোগ্য আর না তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা উপলব্ধি করার যোগ্য। দ্বীনকে উপেক্ষা করে শিরক আর তাগুতের চিন্তা-চেতনাকে সওদা করেছি আর নিয়তির অমোঘ নিয়মে আল্লাহর পাকড়াওকে অনিবাৰ্য করে তুলেছি। 
ইসলামের এতো হীনমন্য অনুসারীর জীবনী বোধকরি ইতিহাস এই প্রথম লিপিবদ্ধ করবে। আল্লাহর কথা বলতে, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ) আল্লাহর নবী, আমাদের মাথার মনি, তার কথা, তাঁর রীতিনীতি, চালচলন অনুপম জীবন পদ্ধতি মানতে, আল্লাহর মনোনীত দ্বীনের কথা উচ্চারণ করতে মুসলমানদের আওয়াজ ক্ষীন হয়ে আসে; দেহমন সংকুচিত হয়ে যায়, প্রাণের স্পন্দন স্তিমিত হয়ে পড়ে। কলেমাকে বুলন্দ করবে যারা, তারা কলেমা উচ্চারণ করতে এদিক সেদিক তাকায়-পাছে কেউ শুনে ফেলে কিনা।
আমার অফিসে এক পিয়ন ছিলো। বস্ অফিস থেকে চলে গেলে সে বসের চেয়ারে বসে পড়তো। তারপর টেলিফোনের রিসিভার তুলে নানান ভংগিতে পা দুলাতে দুলাতে হাত নেড়ে নেড়ে বসের অনুকরণে কথা বলতো। আমাদের দু'শ বছরের মালিকরা চলে গেলেও আমরা তাদের অনুকরণ এখনো ছাড়িনি। তাদের চলন-বলন বেশ-ভূষা অংগভংগি এমন রপ্ত করেছি যে, ওদের জীবন পদ্ধতি আমাদের রক্তের সাথে মিশে গেছে।
একবার হজ্জের মওসুমে হজ্জযাত্রীদের ফ্লাইট ডিউটি করার সময় সৌদি আরবে একটি ব্যাপার খুব লক্ষ্য করেছি। যথারীতি হজ্জপর্ব সমাধান করে জেদ্দা বিমানবন্দরের কাজে যোগদান করেছি। সকলের মাথা কামানো; মুখে অনেকের বেশ কিছু দাড়ি। দিব্যি কাজ করছি। কোনো চিত্তবৈকল্য নেই।
কয়েকদিন পর দেশে ফিরেই সকলের চেহারা গেলো পাল্টে। কারো মাথায় ফেল্ট হেট, কারো, মাথায় নেহেরু ক্যাপ, কারো মাথায় অন্যন্য দামী টুপী। দাড়ি একেবারে ক্লীন সেভ। অর্থাৎ স্মার্ট হওয়ার নানাবিধ প্রচেষ্টা! এই হলো ইসলামী জীবনের পরিবেশ। আর যা নিবে তা' ছ’আনা জীবনের পরিবেশের ব্যবধান। 
কথায় কথায় হজের কথা এসে গেলো। সামনেই আসছে মোবারক হজ্জ। ফেলে আসা জীবনের কত স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে পবিত্র হজ্জের স্মৃতিও। মাত্র কয়দিনের স্মৃতি। অথচ সারা জীবনের স্মৃতিকে অতিক্রম করে সেই কয়দিনের স্মৃতি অন্তরের নিকটতম মনিকোঠায় যেন ঘুমিয়ে আছে পরম শান্তিতে। যখনি ঘুম ভাংগে, তখনি এই স্মৃতি এক ঝলক আনন্দ দিয়ে সমস্ত হৃদয়মন ভরিয়ে দেয়। 
বাইতুল্লাহর পর সবচেয়ে বেশী স্মৃতিময় হয়ে আছে আরাফাতের স্মৃতি। ৯ই জিলহজ্জ সুবহে সাদেকের সময় অগ্রজপ্রতীম আবদুল মালিকের তাড়া শুরু হয়ে গেলো। আগেই কানে কানে জানিয়ে রেখেছেন, ফজরের নামাজের সাথে সাথে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে। মুয়াল্লিমের গাড়ী, সকালের নাস্তা, সাথীদের কাফেলা এ সবকিছুর জন্য অপেক্ষা করা যাবেনা। আব্দুল মালিকের সংগ আমাকে অনেক আশ্চর্য্য অভিজ্ঞতা ও দুর্লভ সুযোগ এনে দিয়েছিলো হজ্জের দিনগুলিতে। তাই আবারো তার অনুসরণ ও নির্দেশ পালনে আমি প্রায় নির্দিধায় রাজী হয়ে গেলাম। অতি সহজেই তার সাথে যখন আরাফাতে পৌছলাম তখন পূর্বদিকের আকাশ সামান্য ফর্সা হয়েছে মাত্র। আব্দুল মালিক দ্রুত এগিয়ে চললেন জাবালে রহমতের দিকে। ইতিমধ্যে প্রচুর লোক সমাবেশ হয়ে গিয়েছে চারিদিকে। এই সেই জাবালে রহমাত, যেখানে আমাদের আদি পিতার দোয়া কবুল হয়েছিলো। যেখানে দাঁড়িয়ে নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জের ভাষণ দিয়েছিলেন। 
কিন্তু আজ একি দৃশ্য দেখছি এখানে! ইহরামের দুইখানি কাপড় পরে জাবালে রহমতের পাদদেশে দাড়িয়ে বিশাল জনতা কার কথা শুনছে, উপরে ঐ পাহাড়ের গায়ে। পাথরের উপর দাঁড়িয়ে দীর্দ শশ্রুমন্ডিত অশিতিপর এই বৃদ্ধই বা কী বলছেন এমন আবেগ মিশ্রিত কষ্ঠে? হায় হায়, এযে সেই অপরূপ পুণ্যময় স্মৃতির পুনরাবৃত্তি, সেই ঐতিহাসিক দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি, যা সংঘটিত হয়েছিলো আজ থেকে চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে এখানে, এইদিনে । 
আল্লাহর নবী (সঃ) শেষবারের মতো উপস্থিত হয়েছেন আরাফাতে সাহাবীদের নিয়ে হজ্জ করতে। স্বয়ং নবীজি এবার হজ্জের আমীর। তাই চারিদিক থেকে ঢল নেমেছে মুসলমানের। হজ্জের যাবতীয় হুকুম-আহকাম বুঝিয়ে দিয়ে প্রিয় নবী (সঃ) জাবাল রাহমাতের উপর দাঁড়িয়ে বিশ্ববিশ্রুত সেই বিদায় ভাষণে বলেছিলেনঃ ‘লোক সকল! আমার কথাগুলি মনোযোগ সহকারে শোন! এমন হতে পারে যে, এই বৎসরের পরে এই স্থানে আমি আর তোমাদের সাথে মিলিত হবনা।' 
এই কথা শুনার পর সাহাবীদের কী অবস্থা হয়েছিলো জানিনা। চারপাশে এমন কিছু লোক নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছিলো, 
যারা তাঁর ভাষণের প্রতিটি বাক্য সালাতের মুকাব্বিরের ন্যায় উচ্চ স্বরে পুনরাবৃত্তি করছিলেন, যাতে উপস্থিত প্রায় দেড় লক্ষ শ্রোতা এই পন্থায় ভাষণটি স্পষ্টভাবেই শুনতে পাচ্ছিলেন। প্রাণপ্রিয় নবীর বিচ্ছেদের পূর্বাভাস সাহাবীদের অন্তরকে খানখান করে দিয়েছিলো কিনা জানিনা; সওর পর্বতের সাথীর বুক চৌচির হয়ে কত অশ্রু প্লাবন বয়েছিলো জানিনা। তবে আজ চৌদ্দশত বৎসর পর ওই একই দৃশ্যের নকসা দেখে আমি যেন পাথর হয়ে গেলাম। সামনে দাড়িয়ে তিনি যখন নবীজির সেই কথাটি উচ্চারণ করলেন, নবীজি বলেছেনঃ “ওহে শোন! আমি কি আল্লাহর পয়গাম পৌছিয়ে দিলাম? উপস্থিত সাহাবারা একসাথে জবাব দিয়েছিলেনঃ হাঁ, অবশ্যই অবশ্যই আপনি তা পৌছিয়েছেন। চৌদ্দশত বৎসর পরে ঠিক সেই কথা উপস্থিত জনতা কেঁদে কেঁদে চিৎকার করে আবারো যখন বললেনঃ “নিশ্চয়, ইয়া রাসুলাল্লাহ নিশ্চয় তা আপনি পৌঁছিয়েছেন। আমি জানিনা, কখন আমার দু’চোখের কুল বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু নেমেছে। জাবালে রহমাত থেকে আবার কণ্ঠ ভেসে এলোঃ নবীজি বললেন, হে মহান আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন। 
এরপর একে একে বিদায় ভাষণের সবগুলি কথা গভীর আবেগের সাথে। আরববাসী আমাদের সবাইকে শুনাতে থাকলেন। আমানতকে তার মালিকের নিকট ফিরিয়ে দেয়া, সুদকে চিরতরের জন্য নিষিদ্ধ ও নিশ্চিহ্ন করা, জাহিলি যুগের সকল শ্রেণী ও গোত্রভেদ বিলীন করা, এমন কাজ থেকে বিরত থাকা, যে কাজকে শয়তান মূর্তিপূজার বিকল্প মনে করে তুষ্ট হতে পারে, স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিকার, স্বামীর উপর স্ত্রীর অধিকার এবং মুমিনরা পরস্পরের ভাই; নবীজির এইসব কথার প্রতিধ্বনি শুনছি আর সেইদিনের সেই পুন্যস্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আরো বললেন, নবীজি (সঃ) বলেছেনঃ “আমি তোমাদের কাছে এমন দুই বস্তু রেখে যাচ্ছি যে, তোমরা তা আঁকড়ে থাকলে কখনো বিভ্রান্ত হবেনা; তা হলো আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নত। এরপর মীরাস, অসিয়ত, ব্যাভিচারীর হত্যা ও পিতা ব্যতীত অন্যের প্রতি পিতৃসূত্র স্থাপনকারীর উপর লানত এবং সবশেষে খতমে নবুওয়তের স্পষ্ট ঘোষণাসহ সালাত ও সিয়ামের কথা বলে শেষ করলেন। বক্তব্যের ধারা অব্যাহত রেখে তিনি আরো বললেন, নিশ্চয় উপস্থিত ব্যক্তি অনুপস্থিত ব্যক্তি পর্যন্ত এই কথাগুলি পৌছিয়ে দিবে। 
জনতার হৃদয় নিংড়ানো কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। শিশুর মতো নিজেও কাঁদছি। সারা অন্তর কেঁদে কেঁদে শুধু বললো, হে আল্লাহর প্রিয়তম নবী, ওগো আরবের শিশুকালে এতীম হয়ে যাওয়া, অত্যচারে জর্জরিত মাতৃভূমি ত্যাগকারী, তায়েফের মার খাওয়া নবী, উহুদের ভাঙ্গা শিরস্ত্রাণে কপাল বিদীর্ণ হয়ে রক্তে রঞ্জিত হওয়া নবী, কুরআনুল করীমের জীবন্ত প্রতীক পৃথিবীর এক অষ্টমাংশ পর্যন্ত ছুটে যাওয়া সাহাবীদের নয়নের মনি, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর ফেরেশতা ? আপনার উপর দরুদ পাঠ করেন, নিঃসন্দেহে আপনার জলীলুল কদর সাহাবীরা ও উম্মতে মোহাম্মদীর নিবেদিতপ্রাণ দয়াময়ের একনিষ্ঠ বান্দারা যুগ যুগ ধরে আল্লাহপাকের মনোনীত ও আপনার প্রচারিত দ্বীনকে আমাদের কাছে পৌছে দিয়েছেন। আর তাইতো আমরা আজ এই আরাফাতে হাজির হতে পেরেছি। চিরকৃতজ্ঞতায় মাথা নত হয়ে এলো। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে হৃদয় বিদীর্ণ করে কণ্ঠে উচ্চারিত হলোঃ

লাব্বায়িক, 
লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক; 
লব্বায়িক, 
লা-শরীকা লাকা লাব্বায়িক; 
ইন্নাল হামদা । 
ওয়ান নি'মাতা । 
লাকা ওয়াল মুল্ক, 
লা-শরীকা লাকা।