জীবন পাথেয়ঃ
ইলম অর্জনের গুরুত্ব ও আবশ্যকীয়তা
বশীর আহমাদ হানাফী
==================================================
ইলমের ফজীলত সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ পাক তাঁর কালামে মাজিদে ইরশাদ করেছেন যে, যারা ঈমান এনেছে বিশেষত যারা ইলম হাছীল করেছে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে উচ্চাসনের অধিকারী করবেন।
ইলম অর্থ জ্ঞান হলেও সবধরনের জ্ঞানকে ইলম বলা যাবে না। ইলম আল্লাহ পাকের ভয় ও ভক্তির বাহক ও উছিলা হয় এবং যা দ্বারা মানুষের মনে আল্লাহ্ পাকের ভয় ও ভক্তির উদ্রেক হয় তাকেই প্রকৃত ইলম বা জ্ঞান বলা হয়। যে জ্ঞান দ্বারা আল্লাহ পাককে চিনা যায় না সে জ্ঞান অর্জনকারীরা যখন পরকালে দোজখবাসী হবে তখন দুঃখ ও অনুতাপ করে বলবে, “হায় যদি আমরা অন্যের থেকে দ্বীনের ইলম অর্জন করতাম তা হলে আজ আমরা দোজখ বাসী হতাম না।” (আল কুরআনঃ সূরা মূলক)
ইলমে দ্বীন শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলে করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন যে, “প্রত্যেক নর-নারীর জন্য দ্বীন ইলম অর্জন করা ফরজ-অবশ্য কর্তব্য।” যেমন নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাতের ফরয ওয়াজিব বিষয়গুলো প্রত্যেকের জানা ফরয। এমনিভাবে পর্দা একটি ফরজে দায়েম। এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান বালেগ পুরুষ ও নারীর ওপর ফরজ। ব্যবসায়ী ব্যক্তি কিরূপে ব্যবসা করবে সে জ্ঞান বা ইলম তার জানা থাকা দরকার। কেননা কোন মাল বেচাকেনা করার অনুমতি শরিয়তে আছে, কোনটার নেই সে জ্ঞান অর্জন করার পরই ব্যবসায় অবতীর্ণ হতে হয় ইত্যাদি।
তাই রাসূল (সাঃ) আলেমগণের ফজীলত সম্পর্কে ইরশাদ করেন, “আলেমগণ নবীগণের ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী। এই দুনিয়ায় নবীগণের ত্যাজ্য সম্পত্তি একমাত্র ইলম। যে ব্যক্তি ইলম শিক্ষা করেছেন সে . অতি মূল্যবান সম্পদ লাভ করেছেন।
দ্বীনী ইলম অর্জন করার গুরুত্ব সাহাবা ও তাবেয়ীদের মধ্যে কি পরিমাণ ছিল তা হাদীসের একটি ঘটনা দ্বারা বুঝা যায়- এক ব্যক্তি মদীনা শরীফ থেকে ছয়শত মাইল পথ অতিক্রম করে দামেস্ক শহরের সফর করেছিলেন মাত্র একখানা হাদীস শ্রবণ করার জন্য। ওই ব্যক্তি দামেস্ক পৌঁছে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু দারদা (রাঃ) -এর নিকট গিয়ে বলেছিলেন, হে আবু দারদা (রাঃ) আমি আপনার নিকট একটি হাদীস শ্রবণ করার জন্য এসেছি যে হাদীস খানা আপনি হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করে থাকেন। আর আমার এই সফর শুধু এ জন্যই তাঁর কথার প্রতি উত্তরে হযরত আবু দরদা (রাঃ) বলেছিলেন, “যে ব্যক্তি ইলম শিক্ষা করার জন্য সফর করবে আল্লাহ পাক তার জন্য বেহেস্তের পথ সহজ ও সুগম করে দিবেন।” তিনি আরও বলেছিলেন, “নিশ্চয় জেনে নাও যে, দ্বীনের জ্ঞান আহরণকারী তালীবে ইলমের জন্য স্বীয় পালক সমূহ বিছিয়ে দিয়ে তাদের সম্মান করে থাকেন, ফেরেস্তারা সার্বক্ষণিকভাবে তাীলবে ইলমের খিদমতে রত থাকনে।”
তিনি আরও বলেন যে, “সাত আসমান ও জমীনের ওপর যা কিছু বাস করে এমন কি পানির মধ্যে বসবাসকারী মৎস্য জাতীয় জীবেরাও তালীবে ইলম বা আলেমের মুক্তির জন্য দুআ মাগফেরাত করতে থাকে।”
বোখারী শরীফের এক খানা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, “মানুষের জন্যে প্রতিযোগিতা করে হাসীল করার বিষয় মাত্র দু’টি, একটি হল সাখাওয়াত বা দানশীলতা, দ্বিতীয়টি হল হিকমত বা সত্যিকারের ধর্ম জ্ঞান।”
দারেমীতে একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলে করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তির ইলম হাসিল করা অবস্থায় মৃত্যু হয় আর তার ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্য এক মাত্র (আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য) ইসলামের প্রচার প্রসার এমতাবস্থায় ইলম হাসিলকারী ব্যক্তি এবং নবীগণের মাঝে মাত্র একটি দরজার ব্যবধান থাকে।”
দারেমীর আরও একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, একজন আলেম এবং একজন আবেদের মধ্যে একশত দরজা ব্যবধান থাকবে। আর এক দরজা হতে আরেক দরজার দূরত্ব এত লম্বা হবে যে, দ্রুতগামী ঘোড়া সত্তর বছর বিরামহীন দৌড়ানোর পর সেখানে পৌছতে সক্ষম হবে।”
আরও একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন যে, “কিয়ামতের ময়দানে তিন প্রকারের লোক সুপারিশ করার অধিকার পাবে। নবী, আলিমগণ ও শহীদগণ।”
হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, যে, আল্লাহ্ পাক হযরত সোলায়মান (আঃ) -এর সামনে তিনটি বিষয় উপস্থাপন করে তাঁকে যে কোন একটি গ্রহণ করার এখতিয়ার দিয়েছিলেন। বিষয় তিনটি হল ইলম, রাষ্ট্র ক্ষমতা ও সম্পদ। হযরত সোলায়মান (আঃ) এ থেকে ইলম গ্রহণ করে ছিলেন। এর ফলে আল্লাহ্ পাক খুশি হয়ে তাঁকে তিনটিই দান করেন।
হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, “সাত কারণে ইলম সম্পদ থেকে উত্তম। (১) ইলম নবীগণের ত্যাজ্য সম্পদ আর মাল ফেরাউনি সম্পদ (২) ইলম বিতরণ করার দ্বারা কমে না বরং বৃদ্ধিপায় আর মাল বিতরণের দ্বারা কমে যায় (৩) মাল হেফাজতের জন্য পাহারাদারের প্রয়োজন হয় আর ইলম খোদ হেফাজতকারী হয় যে তাকে অর্জন করে (৪) মানুষ মরে যাওয়ার পর সম্পদ তার সাথে যায় না। বরং জমীনের ওপর থেকে যায়। আর ইলম আলিমের সাথে কবরে প্রবেশ করে (৫) সম্পদ অর্জন করে ইমানদার ও বেঈমানদার উভয়ে কিন্তু ইলম অর্জন করার সৌভাগ্য লাভ করে কেবল ঈমানদার ব্যক্তি (৬) দুনিয়ার মালদারেরা দ্বীনি বিষয়ে আলেমগণের মুখাপেক্ষী থাকে কিন্তু আলেমগণ মালদারদের নিকট মুখাপেক্ষী নন। (৭) ইলম মানুষকে সরল ও সোজা পথে চলার শক্তি যোগায় আর সম্পদ সর্বদা মানুষকে বক্র পথে পরিচালিত করে।”
ইলমে দ্বীনের কি দরকার ও তা অর্জনকারী নায়েবে নবীগণের কি সম্মান ও ক্বদর হযরত আলী (রাঃ) -এর কথা দ্বারা তা বুঝা যায়। দুনিয়াতে সঠিক পথ পেতে হলে ইলমে দ্বীনের কত প্রয়োজন একটু চিন্তা করলে আমরাও বুঝতে পারব। আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দ্বীনের শিক্ষা না থাকায় কি ঘটছে তা সবারই জানা। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইলমে দ্বীনের শিক্ষা ও চর্চা না থাকায় তথাকথিত পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার (যা অসভ্যের চরম) আবহে অধিকাংশ শিক্ষিতরা বিপথগামী হচ্ছেন। যেমন পর্দা করা মুসলিম মহিলাদের জন্য আল্লাহর হুকুম কিন্তু আজ বিশ্ব মুসলিমের অবস্থা কি দাড়িয়েছে। পর্দা পালন তো দূরের কথা বরং একে মধ্যযুগীয় প্রথা বলে উপহাস করছে। আমার দেশের মুসলিম যুবক-যুবতী, ছাত্র-ছাত্রী, ভাই বোনদের নিকট আকুল আবেদন, আসুন আমরা ইলমে দ্বীনের শিক্ষা গ্রহণ করে দেশের প্রতিটি ঘরে দ্বীনের আলো ছড়িয়ে দেই। সাথে সাথে আমরা সকলে নবীগণের যোগ্য ওয়ারিস হওয়ার গৌরব অর্জণ করি এবং পরকালে বেহেশতের সর্ব উচ্চাসন জান্নাতুল ফেরদাউসের অধিকারী হই। আল্লাহ আমাদের সকলকে দ্বীনী ইলম অর্জন করার তওফীক দান করুন।
*****