মুজাহিদের আযান
জিহাদের বায়’আত
মাওলানা মাসউদ আযহার
لَّقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا ﴿١٨﴾
‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা বৃক্ষের নীচে আপনার কাছে শপথ করল। আল্লাহ অবগত ছিলেন, যা তাদের অন্তরে ছিল । অতঃপর তিনি তাদের প্রতি প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরষ্কার দিলেন।'
এ আয়াতে একটি বিশেষ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে, যাকে বায়আতে রিদওয়ানা বলা হয়ে থাকে। ইসলামী ইতিহাসের এ বৈশিষ্টমণ্ডিত ঘটনাটি ষষ্ঠ হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল।
তখন হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক স্বপ্ন দেখে সে অনুযায়ী চৌদ্দশত সাহাবীকে সাথে নিয়ে কুরবানীর পশুসহ ওমরা। পালনের উদ্দেশ্যে মক্কার পথে রওয়ানা হয়েছিলেন-
মক্কার মুশরিকরা ছিল মুসলিম শত্রুতায় অন্ধত্বের শিকার। তারা পথিমধ্যে এই হজ্ব কাফেলার রাস্তা আগলে দাঁড়াল। অথচ হজ্ব যাত্রীদের হয়রানী করা ও পথ আলগে রাখা ছিল চরম অন্যায় ও অনিয়ম।
তাদেরকে এ সফরের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বলার জন্য প্রিয়নবী (সাঃ) হযরত ওসমান (রাঃ) কে মক্কা পাঠালেন। তিনি মক্কার মুশরিকদের বুঝবেন যে, তারা কেবল ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় এসেছে-কোন যুদ্ধ সংঘটন ও মক্কা দখলের ইচ্ছা তাদের নেই, তারা ওমরা পালন শেষে চলে যাবে।
আর যে সকল মুসলমান এখনো মক্কায় বসবাস করছেন, তিনি তাদেরকে এ সুসংবাদ জানাবেন যে, অতিসত্বর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য অসম্মানজনক জীবনের অবসান ঘটিয়ে নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে।
অতপর হযরত ওসমান (রাঃ) মক্কায় পৌছলে মক্কায় মুশরিকরা তাঁকে আগলে রাখে। এদিকে লোকের মুখে ব্যাপকভাবে শুনা যাচ্ছিল যে, হযরত ওসমানকে শহীদ করে ফেলা হয়েছে।
একজন মুসলমানের রক্তের মূল্য
এবার বিষয়টি একজন মুসলমানের রক্তের মূল্য আদায়ের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
আপনারা জানেন, একজন মুসলমানের রক্ত, জীবন ও মর্যাদার মূল্য আল্লাহর নিকট অত্যন্ত বেশী। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যদি কাবার সকল ইটগুলোও বিক্রি করা হয় (অথচ কাবার একখানা ইটের মূল্য আদায়ের সামর্থ পৃথিবীর কারো নেই।) তবুও একজন মুসলমানের ইযযাতের সমান তার মূল্য হবে না। আল্লাহর নিকট মুসলমানের মর্যাদা কল্পনাতীত বেশী।
আমাদের সমাজে এ সব বিষয় অতি মামুলী হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে-কোথাও একজন প্রতিনিধি পাঠান হলো এবং সে নিহত হলো, সামান্য প্রতিক্রিয়া অতঃপর সব নীরব। আমাদের দেশে হাজার হাজার মানুষ মরে গেলেও সামান্য অনুসোচনা পরিলক্ষিত হয় না অধিকাংশের মনে। লাখো মানুষের ইজ্জাত লুষ্ঠিত হলেও হৃদয়ে বিন্দু পরিমাণ ব্যাথা অনুভূত হয়না।
কিন্তু তিনি ছিলেন আল্লাহর নবী, তাঁর সাথে ছিলেন সাহাবা কিরাম। তারা গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন, আমাদের কাউকে যদি কেউ অন্যায়ভাবে হত্যা করে, আর যদি তার প্রতিশোধ গ্রহণ করা না হয়, তবে এ জীবনের মূল্য থাকে কি! কি মর্যাদা অবশিষ্ট থাকে মুসলিম হয়ে বেঁচে থাকার?
আজ যদি এক মুসলিমের রক্ত ও জীবন এভাবে এত সস্তায় বিকিয়ে যায়, তবে কাল যেখানে সেখানে মুসলমানকে হত্যা করতে কেউ এতটুকু ইতস্তত করবেনা। যে কেউ যখন তখন মুসলমানের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে। তামাশাচ্ছলেও তারা মুসলমানের গর্দান উড়িয়ে দিতে থাকবে- তরবারীর তেজ পরীক্ষা করে দেখার সখ হলো, ব্যস, মুসলমানের ঘাড়ে মেরে দিল। এমনি এক অমর্যাদাকর পরিস্থিতির শিকার হবে সকল এলাকার মুসলমানরা। অতএব এখনি এর প্রতিবিধান দরকার। এমন অবস্থায় আমরা নীরব থাকতে পারি না, এমন যুলুমকে আমরা বরদাস্ত করতে পারি না। আমরা থেকে এমন অপরাধকে নির্মূল করেই ক্ষ্যান্ত হব না, যদি এ অপরাধকে নির্মূল করতে আমাদের মরতেও হয় তবে আমরা সে মরণকেই বরণ করে নিব। কিন্তু যালিমকে রেহাই দেয়া যাবে না।
প্রিয় নবী (সাঃ) ওসমান (রাঃ)-এর হত্যার সংবাদ শুনেই একটি গাছের তলায় বসে গেলেন। তিনি সাহাবীদের থেকে এক চরম অঙ্গীকার নিতে থাকলেন-
কী সে চরম অঙ্গীকার?
মরণের অঙ্গীকার
প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত সালামা ইবনে আকওয়া (রাঃ)-এর নিকট ইয়াযিদ ইবনে আবু আব্দুল্লাহ জিজ্ঞেস করেছিলেন, কোন বিষয়ের উপর আপনারা (সেদিন) শপথ গ্রহণ করেছিলেন?
তিনি বল্লেন, ‘মৃত্যুর অঙ্গীকার।' (সহীহ বুখারী ও পৃঃ ১৫, খঃ ১)।
-রাসূলের নিকট তারা শপথ গ্রহণ করেছিলেন, ‘মরে যাব তবুও ওসমান (রাঃ)-র রক্ত বৃথা যেতে দেব না। তার রক্তের বদলা নিয়েই ছাড়ব।' হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন বিষয়ের উপর আপনারা সেদিন বায়আত গ্রহণ করেছিলেন? তিনি বলেন, “আমরা সবরের উপর বায়আত গ্রহণ করেছিলাম। আমরা শপথগ্রহণ করেছিলাম যে, শত্রু পক্ষ যতই শক্তিশালী হোক আমরা ময়দান ত্যাগ করে চলে যাব না। (সহীহ বুখারী পৃঃ ৪১৫, খঃ ১)
সে যাত্রায় সাহাবীগণের যুদ্ধ করার কোনই ইচ্ছা ছিল না। পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্রও তাদের নিকট ছিল না। তাঁদের প্রত্যেকের সাথে ছিল একখানা করে তরবারী মাত্র, যা তাদের প্রত্যেকের সাথে সব সময়ই থাকে। তারা এখন ঘর-বাড়ী থেকে বহু দূরে, উপরন্তু শক্রর কবলে অবস্থান করছে, শত্রুর ঘর-বাড়ী একেবারে কাছে। তাছাড়া এখানে যুদ্ধ হলে তা কাবার হেরেমের সীমানার মধ্যেই সংঘটিত হবে। প্রিয় নবী (সাঃ) ও তাঁর সাথীগণ অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতির শিকার হলেন।
তাই আল্লাহর নবী বাধ্য হলেন তাদের মুকাবিলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে। একজন মুসলমানের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠায় কাবার সীমানার মধ্যেই তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে মনস্ত করলেন। এর দ্বারা অনুমান করা যায়, একজন মুসলমানের জীবন ও ইজ্জত কত মূল্যবান বিষয়।
আল্লাহর নবী বৃক্ষের নীচে বসে আছেন। সাহাবীগণ বলছেন, তখন ক্ষোভে তাঁর শরীর বার বার ঝাকিয়ে উঠছে, এক একজন করে সাহাবী এসে সুদৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রিয় নবীর হাতে শপথ করছেন যে, কোনো অবস্থায়ই আমরা ময়দান ত্যাগ করব না। শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত শত্রুর মুকাবিলায় লড়ে যাব। ওসমান (রাঃ)-এর হত্যাকারীদের চরমভাবে বুঝিয়ে দিব, মুসলমানের জীবন ও ইজ্জত কোনো সস্তা জিনিস নয়।
হযরত ওমর (রাঃ) এ দৃশ্য দেখে দৌড়ে এসে রাসূল (সাঃ)-এর হাতে বায়'আত গ্রহণ করলেন। সকল সাহাবীর শপথ গ্রহণ শেষ। তখন আল্লাহর নবী (সাঃ) তার এক হাতের উপর অপর হাত রেখে বল্লেন, ‘আমি ওসমানের পক্ষ থেকে শপথ গ্রহণ করছি।'
সন্তুষ্টির পয়গাম
একদিকে শপথ অনুষ্ঠান চলছিল, অপরদিকে তাদের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছিল। আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ হলো, হে জিবরীল! এখনি যেয়ে আমার হাবীবকে সুসংবাদ জানিয়ে দাওঃ
‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা বৃক্ষের নীচে আপনার কাছে জিহাদের বায়আত করল। আমরণ যুদ্ধ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করল। জিহাদের ময়দান ত্যাগ না করার শপথ করল।'
আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশের সাথে সাথে ওয়াদা করলেনঃ
‘বিজয় লাভের সকল দ্বার তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।'
বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত হলোঃ
হুদায়বিয়ার সন্ধির পরে তাঁরা মদীনায় ফিরে গেলেন। অতঃপর ৭ম হিজরীতে খায়বার বিজয় হলো। ৮ম হিজরীতে বিজয় হলো সম্পূর্ণ মক্কা।
এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ
إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِينًا ﴿١﴾
“নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়।
তাদের বিজয়ের গতি অব্যাহত রইল। পরক্ষণেই হুনাইন বিজয় হলো, তায়িফ দখলে আসল। মুতার ময়দানে সাহাবা কিরাম যুদ্ধে লিপ্ত, তাবুকে যুদ্ধ চলছে, ইসলামদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে, যাকাত অস্বীকারকারীদের চরমভাবে দমন করা হয়েছে, মিথ্যা নবী দাবীদারদের পরাজিত করে দুনিয়া থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় করে দেয়া হয়েছে।
হুদায়বিয়ার সন্ধিতে প্রকাশ্যতঃ মুসলমানদের পরাজিত মনে হয় বটে, কিন্তু চৌদ্দশত সাহাবীর প্রিয় নবীর (সাঃ) হাতে বায়'আত গ্রহণ এবং তাদের জিহাদের অঙ্গীকার ও জীবনবাজি রেখে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার জযবা দেখে আল্লাহ তাআলা ভবিষ্যৎ বিজয়ের সকল পথ তাদের জন্য খুলে দিলেন।
কাফের ভয় পেয়ে গেলঃ
সাহাবা কিরামের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান ছিল স্বতস্ফূর্ত ও ঐতিহাসিক। একের থেকে অপরের শপথ ছিল আরো মজবুত।
প্রত্যেকের মুখেই তখন এ পংক্তি দু’টি উচ্চারিত হচ্ছিলঃ
نحن الذين بايعوا محمدا على الجهاد ما بقينا ابدا
‘আমরা তো তারা, যারা মুহাম্মাদ (সাঃ) এর হাতে শপথ গ্রহণ করেছি যে, যতদিন বেঁচে থাকব জিহাদ করব, জিহাদ ত্যাগ করব না মরণ না আসা পর্যন্ত।
এদিকে মক্কার মুশরিকদের নিকট সংবাদ পৌছে গেলো যে, মুসলমানরা আমরণ জিহাদের শপথ গ্রহণ করেছে এবং তাদের সাথে একটি চুক্তিও হয়েছে। আর কাফিরেরা বিশ্বাস করে, মুসলমান কখনো চুক্তি ভংগ করে না।
এরপর তারা প্রকাশ করে যে, ওসমান জীবিত আছে এবং তাদের যুদ্ধ করার কোন ইচ্ছা নেই।
অথচ এর পূর্বক্ষণেও তারা যুদ্ধের প্রস্তুতিসহ তরবারী নিয়ে টহল দিচ্ছিল, তীর ও নেজায় ধার দিচ্ছিল; এই দুর্বলতার সুযোগে মুসলমানদের হত্যা করার ইচ্ছা ছিল তাদের অত্যন্ত সুদৃঢ়।
কিন্তু জিহাদের বায়'আতের সংবাদ শুনে তাদের সকল বদ মতলব ধুলায় মিলিয়ে যায়।
অস্ত্রসজ্জিত কাফিরেরা ভয় পেয়ে গেল, মুসলমানদের জিহাদে অবতরণের সুদৃঢ় অঙ্গীকারের কথা শুনে তারা যুদ্ধের পরিকল্পনা শিকেয় তুলে রাখল।
বিশ্বাসে সুদৃঢ় এই সকল সাহাবীর সম্পর্কে আল্লাহ রব্বুল ইযযাত ইরশাদ করেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ
‘এ সকল লোক, যারা আপনার (সাঃ) হাতে বায়'আত গ্রহণ করেছে এবং চুক্তি সম্পাদনে আপনার সঙ্গী হয়েছে-‘মূলত তারা আল্লাহরই সাথে বায়’আত ও চুক্তি করেছে।
يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ ۚ
‘আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর। (সূরা ফাতাহঃ আয়াতঃ ১০)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি প্রিয় নবী (সাঃ)-এর নিকট বায়আত গ্রহণ করেছে, সে আল্লাহরই নিকট বায়আত করেছে। আর যে আল্লাহর নিকট বায়আত করেছে, পৃথিবীতে কেউ তাকে পরাজিত করতে পারবে না।
জিহাদের বায়'আত এবং মুনাফিক চক্র
আপনি কুরআন শরীফ খুলে দেখুন, যেখানে জিহাদের আলোচনা এসেছে সেখানে মুনাফিকদের সম্পর্কে দু'চার কথা অবশ্যই উল্লেখিত হয়েছে যে, তারা জিহাদ থেকে পিছনে থাকতে পারার ফলে আনন্দিত হত এবং যখন মুসলমানের বিজয় দেখত, তখন তাদের সাথী হওয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠত। মুনাফিকদের চরিত্রই হলো, ‘সময়ে সরব অসময়ে নীরব' বিপদের সময় পিছনে থাকা এবং বুদ্ধি করে পিছনে থাকতে পাবার কারণে বিকৃত আনন্দ উপভোগ করা।
প্রিয় নবী (সাঃ) জিহাদের উদ্দেশ্যে তাবুক রওয়ানা হয়ে গেলে মুনাফিকরা এ চিন্তা করে আনন্দিত হয়েছিল যে, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এ যুদ্ধে মুসলমানদেন পরাজয় সুনিশ্চিত। ফলে আর মুহাম্মাদের (সাঃ) মদীনায় ফিরে আসার ভাগ্য হবে না। সেই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত হয়েছেঃ
فَرِحَ الْمُخَلَّفُونَ بِمَقْعَدِهِمْ خِلَافَ رَسُولِ اللَّهِ وَكَرِهُوا أَن يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ
‘পেছনে থেকে যাওয়া লোকেরা আল্লাহর রাসূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসে থাকতে পেরে আনন্দ লাভ করেছে, আর জান ও মালের দ্বারা আল্লাহর রাহে জিহাদ করতে অপছন্দ করেছে।'
উপরন্তু এই মুনাফিকের চক্র কেবল নিজেরাই বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে জিহাদ থেকে পিছনে থাকত না বরং অন্যান্য লোকদেরও তারা বিভিন্ন কৌশলে জিহাদ থেকে বিরত রাখত। এ আয়াতাংশে সে কথাই বলা হয়েছে
وَقَالُوا لَا تَنفِرُوا فِي الْحَرِّ ۗ
এবং বলেছে, এই গরমের মধ্যে অভিযানে বের হয়ো না।'
অতঃপর আল্লাহ বলছেন, হে নবী! আপনি এই সব হতভাগাদের বলে দিন
قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّا ۚ
‘উত্তাপে জাহান্নামের আগুন প্রচণ্ডতম।' (তাওবাঃ আয়াতঃ ৮১)
অযৌক্তিক কারণে জিহাদে যোগদান না করার ফলে যে প্রচণ্ড উত্তপ্ত আগুনে তোমাদেরকে নিক্ষেপ করা হবে, সে আগুন পৃথিবীর এই সামান্য গরমের চেয়ে বহু পরিমাণে বেশী ভয়াভহ ।
বায়'আতের হুকুম কে দিয়েছেনঃ
উপরোক্ত আয়াতের পরে আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের বৈশিষ্ট ও চরিত্র বর্ণনা করে বলেছেন, তারা আল্লাহর নিকট বায়আত গ্রহণ করেছেন। তবে কথা থাকে যে, তাদেরকে এই ঐতিহাসিক বায়'আতের দাওয়াত ও হুকুম কে দিয়েছেন?
সে কথাই পবিত্র কুরআনের এ আয়াতে বলা হয়েছে যে,
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ۚ
‘আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মুসলমানদের থেকে তাদের জান ও মাল এই মূল্যে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।' (তাওবাহঃ আয়াতঃ ১১১)।
আপনারা জানেন, ক্রয়-বিক্রয়ের বেলায় দুটি জিনিসের দরকার হয়, এক, টাকা-পয়সা, দুই. মাল-সওদায়।
এ দু’টি জিনিসের মধ্যে কোনটির গুরুত্ব বেশী? টাকা-পয়সার, না সওদার? মনে রাখতে হবে, এ ক্ষেত্রে সওদার মূল্য বেশী! পকেটে পয়সা আছে কিন্তু হোটেলে ভাত নেই, এ অবস্থায় পয়সা দ্বারা কি উপকার হয়? পয়সা পকেটে থাকলে ক্ষুদা লাগবে না এমন কথা কেউ বলবেনা।
টাকা আছে কিন্তু বাজারে খাট পালংক ও বিছানা-কাপড় পাওয়া যাচ্ছে না। তখন কেউ কি টাকা বিছিয়ে ঘুমাবে? এক্ষেত্রে টাকা উপকারে আসল না বলাই ঠিক হবে।
তাই ক্রয় করতে হয় সর্বক্ষেত্রে যা আসল উদ্দেশ্য হয়। যে কারণে আল্লাহ তা'আলা জান্নাতকে 'মূল্য' হিসাবে উল্লেখ করেছেন যা দামী ও অতিমূল্যবান। পক্ষান্তরে আমাদের জীবন ও সম্পদকে ‘বিক্রয়ের জিনিস' হিসাবে উল্লেখ করেছেন,-যা হল আসল ও উদ্দেশ্য। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, আমাদের জীবন ও সম্পদকে জান্নাতের চেয়ে মূল্যবান প্রতিপন্ন করেছন আল্লাহ তাআলা নিজেই।
কথাটি এভাবে বলা হয়েছে যে, তোমরা নিজ জীবন ও সম্পদের বিনিময়ে জান্নাত ক্রয় করেছে। না, এমন বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে, আল্লাহ তা'আলা মুমিনের জীবন ও সম্পদকে জান্নাতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন।
খরিদদার হলেন স্বয়ং আল্লাহ, বিক্রেতা আমরা, বিনিময় হলো জান্নাত এবং বিক্রিত দ্রব্য হলো, আমার জীবন ও সম্পদ।
আমাদের ক্ষুদ্র জীবন ও ধ্বংসশীল সম্পদকে আল্লাহ তা'আলা জান্নাতের চেয়ে বহু দামী প্রতিপন্ন করে নিজেই তার ক্রেতা হয়ে গেলেন। চিন্তা করে দেখুন, আমাদের জীবন কি কোন অদামী ও খেলনার জিনিস?
এই ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্র কোথায়?
এই ক্রয়-বিক্রয় কি ঘরে বা কোন দোকানে বসে হবে? আলোচ্য আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ তা'আলা সে কথাই বলেছেন, নাঃ
يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ ۖ
‘তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহে, অতঃপর মারে ও মরে। তাই তোমাদের জীবন বিক্রয়ের মূল্য পেতে হলে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হতে হবে। কখনো তোমরা হত্যা করবে, আবার কখনো তোমাদেরকেও তারা হত্যা করবে।
জীবন দেয়ার ক্ষেত্র ও সময়ঃ
দুনিয়ার নিয়ম হলো, খরিদদার যখন টাকা দোকানীর হাতে তুলে দেয়, তখন বিলম্ব না করে খরিদদারের হাতে মাল তুলে দিতে হয়। কিন্তু আল্লাহর নিয়ম এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। আজ তুমি তোমার জীবন আল্লাহর হাতে জিহাদের উদ্দেশ্যে সোপর্দ কর, এখন থেকে জীবন দানকারী হয়ে যাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার জীবন গ্রহণ করবেন, আশি বা নব্বই বছর বয়সে হলেও-সরাসরি জিহাদের ময়দানে তা গ্রহণ করতে পারেন, জিহাদের ময়দানে যাবার পথেও গ্রহণ করতে পারেন, শত্রু হত্যা করার বদলায় অথবা আপন পক্ষের কারো ভুল নিশানার শিকার হয়েও। অসতর্কভাবে নিজেদের তরবারীর আঘাতে নিহত হলেও, অথবা ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যেয়ে নিহত হলেও, জিহাদের ময়দানে বা চলা চলে সাপ, বিচ্ছু বা জীব-জন্তুর আঘাত ও আক্রমণের শিকার হলেও, অথবা পাহারাদারী করার সময় প্রচন্ড গরম বা চরম শীতের প্রকোপে মরে গেলেও ক্রয়-বিক্রয় সম্পূর্ণ হয়ে যাবে। (অসমাপ্ত)
অনুবাদঃ মনযূর আহমাদ