আমরা যাদের উত্তরসূরী
ইসলাম প্রতিষ্ঠার ও আযাদী আন্দোলনের সিপাহসালারঃ
সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরেলভী রাহঃ
আবদুল মতিন
অবিভক্ত ভারতে শাসক জাতি মুসলমানরা ইংরেজদের হাতে কেবল মাত্র তাদের রাজ্য ও স্বাধীনতাই হারায়নি এর সাথে হারিয়েছিল তাঁদের শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শৌর্য-বীর্য, অর্থ-সম্পদ, ধর্মীয় রীতি-নীতি। এমনিভাবে সবকিছু হারিয়ে এই বাদশাহর জাতি যখন সমাজ ও ধর্মীয় জীবনে বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কার ও অনৈসলামিক কার্যকলাপ গ্রহণ পূর্বক নৈতিক শক্তিকে দুর্বল করে কাঠ-ফাটা, পানি-টান, পাইক-পেয়াদা, পিয়ন-দারোয়ানের জাতিতে পরিণত হয়ে কাতরিয়ে মরছিলো ঠিক তখন এ জাতির পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে এগিয়ে এলেন সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভী। তিনি অধঃপতিত মুসলিম জাতিকে একত্ববাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এদেশের মাটি থেকে বিদেশী-বিধর্মী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ইসলামী আদর্শভিত্তিক এক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমগ্র ভারত উপমহাদেশব্যাপী এক অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
অনেকের ধারণায় এই আন্দোলন ছিল অষ্টাদশ শতাব্দী কালব্যাপী (১৭০৩-১৭৮৬) মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব কর্তৃক আরবে পরিচালিত ওহাবী আন্দোলন আদর্শিক। কিন্তু সৈয়দ আহমদ বেরলভী কোন ওহাবী নেতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে তার প্রেরণার উৎস ছিল ভারতের বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, সংস্কারক ও স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম নকীব শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভীর শিক্ষা ও জীবন দর্শন। ওহাবী এবং বেরলভী পরিচালিত উভয় আন্দোলনেরই মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় ও সমাজ জীবনে অনুপ্রবেশকারী, সকল প্রকার অনৈসলামিক রীতি-নীতি, কার্যকলাপ ও কুসংস্কার-সন্দেহ দূরকরণপূর্বক মুসলিম সমাজের পূনর্জাগরণ। এতদসত্ত্বেও উভয় আন্দোলনে সুফী মতবাদ বা শিয়া ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের জীবনাদর্শ সংস্কারের আওতায় ছিল। এদিক থেকে ইহা ছিল অনেকাংশে অনুদার ও সংকীর্ণ। অপর দিকে শাহ ওয়ালী উল্লাহ পরিচালিত ভারত উপমহাদেশের সংস্কার আন্দোলন কেবল মাত্র কুসংস্কার ও অনৈসলামিক রীতি-নীতির সংস্কারের মধ্যেই সীমিত ছিল না বরং ইহা ছিল শিয়া-সুন্নীসহ সকল প্রকার সম্প্রদায় ও মতবাদের সংস্কার ও সমন্বয় এবং ইসলাম।সমাজ ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থার পুনর্গঠন পর্যন্ত সম্প্রসারিত।
সৈয়দ আহমদ শহীদের আন্দোলনের প্রকৃতি ও তাৎপর্য উপলদ্ধির জন্য শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভীর আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতির প্রয়োজন। শাহ ওয়ালী উল্লাহ দিল্লীর বিখ্যাত সুফী পরিবারে ১৭০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। দিল্লীর বাদশাহ আওরঙ্গজেবের মৃত্যুকালে (১৭০৭) তিনি ছিলেন ৪ বছরের শিশু। মোগল সাম্রাজ্য তখন দ্রুত পতনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মোগলদের এই পতন তিনি প্রত্যক্ষ করেন। তিনি আরো প্রত্যক্ষ করেন-উত্তর ভারতে শিখ ও দক্ষিণ ভারতে মারাঠা শক্তির ক্রমবর্ধমান দাপট কি চরমভাবে মুসলিম জাতিকে লাঞ্ছিত করছিল। কোরআনিক দর্শন, ইসলামী মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক পদস্খলন এবং আধ্যাত্মিক অধঃপতনই মুসলিম জাতির এই বিপর্যয়ের মূল কারণ বলে তিনি নিশ্চিত হন। তাই জাতিকে পুনর্জাগরণ ও মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তিনি কুরআনের অনুবাদসহ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ের বহু মূল্যবান পুস্তক রচনা ও প্রচার করেন। ভারতে বিভিন্ন স্থানে বহু মাদ্রাসা ও ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে মুসলিম জাতির মধ্যে রাজনৈতিক অধিকার সচেতন ও ধর্মীয় মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক ব্যাপক গণ আন্দোলনের সূচনা করেন।
শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভীর মৃত্যুর পর (১৭৬২) তার এই ধর্ম সংস্কার ও স্বাধিকারের আন্দোলনের ভার ন্যস্ত হয় তার সুযোগ্য পুত্র ও তদানিন্তন যুগের শ্রেষ্ঠ আলিম শাহ আবদুল আজীজের উপর। তিনি পিতার নীতি ও আদর্শ ভাইদের সহায়তায় এবং শিষ্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উপমহাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে দেন এবং দক্ষতার সাথে পিতা ওয়ালী উল্লাহ সূচিত আন্দোলন এগিয়ে নেন। সৈয়দ আহমদ বেরলভী ছিলেন শাহ আবদুল আজীজের শিষ্যদের অন্যতম। তিনি তাঁরই দীক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশকারী অনৈসলামিক রীতি-নীতির সংস্কার ও পরাধীনতার জিঞ্জির ছিন্ন করে স্বাধীনতা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা লাভ করেন।
সৈয়দ আহমদ বেরলভী উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলী জেলায় ১৭৮৬ সালের নভেম্বর মাসে জন্মগ্রহণ করেন। ১৩ বছর বয়সের সময় পিতা সৈয়দ মোহাম্মাদ ইরফান পরলোক গমন করেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃদ্বয় সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহীম ও সৈয়দ মোঃ ইসহাক তাঁকে দিল্লীতে শাহ আবদুল আজীজের নিকট প্রেরণ করেন। সেখানেই তিনি কুরআন-হাদীস ও ইসলামের প্রতিটি শাখায় জ্ঞানার্জন করে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৮০৭ সালে শাহ আবদুল আজীজের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এ সময়েই সৈয়দ আহমদ তার মুক্তি সংগ্রামের খ্যাতনামা সহচর শাহ আবদুল আজিজের জামাতা মাওলানা আবদুল হাই ও ভ্রাতুষ্পুত্র মাওলানা ইসমাঈল শহীদ এর সাক্ষাত লাভ করেন।
শাহ আবদুল আজীজের শিষ্যত্ব ও দীক্ষা গ্রহণ করার পর ১৮০৭ সালের শেষার্ধে অথবা ১৮০৮ সালের প্রথমার্ধে তিনি রায়বেরেলীতে ফিরে যান এবং সে বছরই সৈয়দ মোহাম্মদ রওশনের কন্যা জাহরার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ১৮০৯ সালে তাঁর জেষ্ঠ্যা কন্যা সৈয়দা সারার জন্ম হয়।
তখন ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জাতি চরম দুরাবস্থার মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করছিল। পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের কতিপয় হিন্দু ও মুসলমান চক্রান্তকারী বিশ্বাসঘাতকের সহযোগিতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ বণিকেরা শেষ মুসলিম নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বাংলার সিংহাসন কেড়ে নেয়। এ জাতির শিক্ষা-সংস্কৃতি ও নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দেয়। অনৈসলামিক রীতি-নীতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ইসলামের মূল দর্শন ভিন্নখাতে পরিচালিত করে। অপর দিকে, পশ্চিমাঞ্জলের পাঞ্জাব ও সীমান্ত এলাকায় শিখ সম্প্রদায় মুসলমানদেরকে পরাস্ত করে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অমানবিক অত্যাচার আরম্ভ করে। আযান দেয়া বন্ধ করে দেয়। এমতাবস্থায় সৈয়দ আহমদ বেরলভী অনুভব করেন যে, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে নির্যাতিত মুসলিম জাতির মুক্তির লক্ষ্যে তাদেরকে অনৈসলামিক চিন্তা-চেতনা ও ক্রিয়া-কর্ম থেকে মুক্ত করে ইসলামী দর্শন ও জীবনাদর্শ মোতাবেক পবিত্র ও নিষ্কলুষ জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তিনি আরো উপলব্ধি করেন যে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভিন্ন এ জাতির আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সফলতা অসম্ভব। তাই তিনি তারই ওস্তাদ আবদুল আজীজের নির্দেশ মোতাবেক ইসলামী আদর্শে রাষ্ট্র কায়েমের জন্য আযাদী আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন সামরিক কলা- কৌশলের জ্ঞানসহ শক্তিশালী এক মুজাহিদ বাহিনীর। আর তাই তিনি বাস্তব জ্ঞান লাভের আশায় ১৮১০ সালে টংকের নবাব আমীর খানের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি সেনাদলে দক্ষতার ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেন। তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও গুণপনায় নবাব আমীর খান মুগ্ধ হন।
সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভী ও শাহ আবদুল আজীজ মুসলিম বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে আমরণ জিহাদ ঘোষণার জন্য নবাব আমীর খানকে অনুরোধ করেন। কিন্তু আমীর খান শক্তিধর শিখ ও বৃটিশের বিরুদ্ধে জিহাদ করা অসম্ভব মনে করে ইংরেজদের সঙ্গে এক অধীনতামূলক সন্ধি করে ফেলেন। ফলে, সৈয়দ আহমদ বেরলভী টংকে থাকার আর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই বলে দিল্লীতে শাহ আব্দুল আজীজের নিকট ফিরে আসেন এবং ১৮১৮ সালে উভয় নেতা একত্র হয়ে মুসলিম জনতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রত্যক্ষ জিহাদের সিদ্ধান্ত নেন। এতদুপলক্ষ্যে ১. ইংরেজ ও শিখ শাসনের নির্মম প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে সমগ্র ভারত উপ-মহাদেশকে “দারুল হারব” বা “শত্রুদেশ” বলে ঘোষণা করেন এবং সকল মুসলমানকে মাতৃভূমি উদ্ধারের জন্য জিহাদের আহ্বান জানান, ২. জিহাদের প্রয়োজনীয়তা, শাহ ওয়ালি উল্লাহর নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, জিহাদের গুরুত্ব মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচারের জন্য। মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ইসহাক ও মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুবকে নিয়ে একটি শক্তিশালী প্রচার সংসদ গঠন করেন। সামরিক সংগঠন পরিচালনার লক্ষ্যে সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে সভাপতি এবং মাওলানা আবদুল হাই ও মাওলানা ইসমাঈল শহীদকে সদস্য করে একটি শক্তিশালী সামরিক পরিষদ গঠন করেন। শাহ আবদুল আজীজ তাঁর সকল শিষ্যবর্গ ও আত্মীয়- স্বজনকে সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে সার্বিক সাহায্য ও সহযোগিতাসহ ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দান করেন।
সৈয়দ আহমদ বেরলভী এতদুপলক্ষ্যে ব্যাপকভাবে গণসংযোগ শুরু করেন। ৭ মাস ব্যাপী তিনি দিল্লীর পার্শ্ববর্তী জেলা সমূহের মুরাদনগর, গাজিয়াবাদ, দেওবন্দ, গাংগো, নানোতা, মীরাট, কান্দলা, মুজাফফর নগর প্রভৃতি স্থানসমূহ ভ্রমণ করে বিপুল সংবর্ধনা লাভ করেন এবং দলে দলে লোক তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। ১৮১৯ সালে তিনি তার জন্মস্থান বায়বেরেলীতে গমন করেন। দু'বছরকাল ব্যাপী সেখানকার মুসলিম জনসাধারণকে যুদ্ধবিদ্যা, মল্লযুদ্ধ, তীর নিক্ষেপ, অসি চালনা প্রভৃতি সমর কৌশলসমূহ শিক্ষা দেন। এ সময় ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে তার আমন্ত্রণ আসতে থাকে। তিনি প্রথমে এলাহাবাদ ও বেনারসে গমন করেন। উভয় স্থানে প্রায় পনের হাজার নর-নারী তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরে তিনি অযোধ্যার নবাবের সহকারী আগ মীরের আমন্ত্রণে লক্ষ্ণেী গমন করেন। সেখানে তিনি বিপুল সাড়া পান এবং অসংখ্য প্রভাবশালী শিক্ষিত মুসলামন তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তন্মধ্যে মাওলানা মোঃ আশরাফ, মৌলভী, ইমামুদ্দীন বাংগাল, মৌলভী ইমামুদ্দীন লাক্ষ্ণৌড়ী, মৌ. আবুল হাসান নাসিরাবাদী, মৌঃ নাজিবুল্লা বাংগালী, শাহ ইয়াকিমুল্লাহ, মাওঃ হাফেজ আবদুল ওহাব এবং মাওঃ বেলায়েত আলীর নাম উল্লেখযোগ্য শেষাক্ত এই বেলায়েত আলীই সৈয়দ আহমদ বেরলভীর শহীদ হওয়ার পর কৃতিত্ব ও সুনামের সাথে এই আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন।
সৈয়দ আহমদ বেরলভী হজ্জ যাত্রার পথে বাংলা ও বিহার ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের ক্ষেত্রে জনমত গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর ১৮২৯ সালের ৩ আগস্ট প্রায় চারশত শিষ্য ও হজ্জ যাত্রীসহ তিনি নৌকাযোগে কলকাতা রওয়ানা হন। পথিমধ্যে থেমে থেমে মুসলমানদেরকে ইসলামের মূল দর্শনভিত্তিক সংস্কার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। যাত্রীদল এলাহাবাদ পৌঁছলে চারদিকে এক বিপুল সাড়া পড়ে যায়। হাজারে হাজারে মুসলমান সৈয়দ আহমদকে একনজর দেখার জন্য ছুটে আসেন। এবং প্রায় ২০,০০০ (বিশ হাজার) টাকা হজ্জযাত্রীদিগকে দান করেন। তিনি কলকাতায় পেীছে স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের যোগদানের আহবান ও প্রচারণার জন্য মৌঃ ইমামুদ্দীনকে দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করেন। দেশের চারদিক থেকে সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে নেয়ার জন্য আমন্ত্রণ আসতে থাকে কিন্তু সময়ের অভাবে তিনি সর্বত্র যেতে পারেন নি। সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও অন্যান্য জেলা থেকে বহু মুসলমান তাঁর সাথে হজ্জে যাওয়ার জন্য কলকাতায় এসে হাজির হন। ফলে হজ্জযাত্রীদের সংখ্যা এখন চারশ' থেকে সাতশত তেপ্পান্নতে বৃদ্ধি পায়। মৌঃ ইমামুদ্দীনকে বেরলভীর বাণী ও সংগ্রামের উদ্দেশ্য প্রচারের জন্য বাংলাদেশে রেখে বাকী সকলকে নিয়ে তিনি মক্কা শরীফ রওয়ানা হন এবং দশমাস পর ১৮২২ সালের ২১ মে মক্কা শরীফ পৌঁছেন। মক্কা ও মদীনায় তারা প্রায় তিন বছরকাল বসবাস করেন। এ সময় মাওলানা ইসমাঈল শহীদ হজ্জযাত্রীদের নিকট শাহ ওয়ালি উল্লাহর বিখ্যাত “হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা” এবং সৈয়দ আহমদ লিখিত “সিরাতুল মুস্তাকিম”-এর মর্মবাণী ব্যাখ্যা করে সকলকে জিহাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলেন।
১৮২৪ সালের ২৯ এপ্রিল বেরলভী মক্কা হতে রায়বেরেলীতে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু ইতিপূর্বে ১৮২৩ সালে তাঁর পীর শাহ আবদুল আজীজ ইন্তেকাল করেন। অতএব, এখন থেকে সংগ্রামের সমস্ত দায়িত্ব তার উপর ন্যাস্ত হয়। তিনি পরবর্তী বিশ মাস ‘দারুল হারব’ বা ‘শত্রুদেশ’ ভারতকে “দারুল ইসলাম” বা ‘শান্তির দেশ’ এ পরিণত করার লক্ষ্যে সংগ্রামের বিরামহীন প্রস্তুতি চালান। সকল মুসলমানকে জেহাদে শরীক হওয়ার পবিত্র কর্তব্য সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন।
অতঃপর, ১৮২৬ সালের জানুয়ারীতে সৈয়দ আহমদ দু'হাজার স্বেচ্ছাসেবকসহ উত্তর পশ্চিম সীমান্তের দিকে অগ্রসর হন ফতেহপুর, জালালপুর ও গোয়ালিয়র হয়ে তিনি টংকে পৌছেন টংকের নবাব আমীর খান ও তদীয় পুত্র ওয়াজিউদ্দৌলা সৈয়দ আহমদের জিহাদ আন্দোলন সমর্থন করেন এবং সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। পরে মুজাহিদ দল আজমীর হয়ে হায়দ্রাবাদের দিকে এগুতে থাকেন এবং ভাওয়ালপুরের নবাব ও সিন্ধুর আমীরদিগকে জেহাদে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু কেউ এ আহ্বানে সাড়া দেননি। কারণ,
১. তারা সৈয়দ আহমদের জিহাদের উদ্দেশ্য ও নীতি সম্পর্কে ভালভাবে অবগত ছিলেন না।
২. তারা প্রতাপশালী শিখ নেতা রণজিৎ সিংহের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে সাহস পাননি। ৩. রণজিৎ সিংহের অনুগামীরা গুজব রটিয়ে দিল যে, সৈয়দ আহমদ ও তাঁর অনুগামীগণ আসলে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির গুপ্তচর। রণজিৎ সিংহের সাথে সিন্ধুর নবাবদের যুদ্ধ বাধিয়ে এতদাঞ্চলে ইংরেজ রাজত্ব কায়েমের চেষ্টায় তারা নিয়োজিত। অনুরূপভাবে গজনী ও কাবুলের আমীরগণও গৃহবিবাদের কারণে সৈয়দ আহমদের সঙ্গে যোগদান করতে পারেন নি। পরে তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের পাঠানদিগকে জেহাদে শরীক করার লক্ষ্যে পেশোয়ার গমন করেন। চরসেদা এলাকায় হাসত নগরের শাসক মোহাম্মদ খান সৈয়দ আহমদের শিয়াত্ব গ্রহণ করেন। ফলে পাঠানগণ দলে দলে মুজাহিদ বাহিনীতে যোগদান করেন।
ইত্যবসরে সৈয়দ আহমদ জানতে পারলেন যে, রণজিৎ সিংহের সৈন্যেরা বুদ্ধ সিংহের নেতৃত্বে মুসলমানদেরকে মুকাবিলা করার জন্য সিন্ধু নদ অতিক্রম করে খাইবারের নিকট উপস্থিত হয়েছে। বেরলভীও তাই অনুরূপ প্রস্তুতি নিলেন। যুদ্ধের পূর্বে সৈয়দ আহমদ রণজিৎ সিংহের নিকট তিনটি শর্ত আরোপ করে নিম্নরূপ একটি পত্র লিখেন-
১. “আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন, তাহলে আমরা আপনাকে আমাদের বন্ধু ও ভ্রাতা হিসেবে গ্রহণ করব,
২. অন্যথায় আপনি আমাদের আনুগত্য স্বীকার করুন তাহলে আপনার নিরাপত্তা ও রক্ষার দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করব।
৩. যদি এ দুয়ের কোনটাই আপনার নিকট গ্রহণযাগ্য না হয় তাহলে আপনি আমরণ আমাদের সহিত যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হোন। মনে রাখবেন, আপনি সুরাপান করতে যত আনন্দ উপভোগ করেন, তার চেয়েও অধিক আনন্দের সহিত মুসলমানগণ আপনার সহিত জিহাদে শহীদ হতে প্রস্তুত।” কিন্তু শক্তির দাপটে মত্ত রণজিৎ সিংহ এ পত্রের কোন জবাব দেননি।
বুদ্ধ সিংহের সৈন্য সংখ্যা সাত হাজারেরও বেশী তদুপরি, তারা ছিল প্রচুর অস্ত্র সম্ভারে সমৃদ্ধ। অপরদিকে মুসলিম সেনাদলে ছিল মাত্র দু'হাজারের মত স্বেচ্ছাসেবী মুজাহিদ। কিন্তু হলে কি হবে, তারা ছিলেন ঈমানী বিক্রমে বলিয়ান। ১৮২৬ সালের ২০ ডিসেম্বর রাত সোয়া চার ঘটিকার সময় মুসলিম বাহিনী 'আল্লাহু আকবার' ধ্বনির সাথে অতর্কিতে শিখ সেনাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েন। সূর্যোদয়ের পূর্বপর্যন্ত তুমুল আক্রমণ চালানোর পর মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করেন। নওশেরার এ যুদ্ধে ৭০০ শিখ সৈন্য নিহত ও ৮২ জন মুজাহিদ শহীদ হন।
নওশেরার এই অসম যুদ্ধে বিজয়ের ফলে চারিদিক থেকে খান ও সর্দারগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদানের জন্য সৈয়দ আহমদ-এর পতাকাতলে সমবেত হতে থাকেন। খান ও সর্দারগণ সৈয়দ আহমদের বশ্যতা স্বীকার করলেও তারা একে অন্যের প্রতি বৈরী ছিল। যার ফলে মুজাহিদদের মাঝে একতা ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ল। পরে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্থির হয় যে, খান ও সর্দারগণ নিজ নিজ এলাকার শাসনভার গ্রহণ করবেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্য ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করবেন। উপরোক্ত শর্তাধীনে তারা সৈয়দ আহমদকে তাদের খলীফা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান সেনাপতি ঘোষণা করেন। অধিকৃত পেশোয়ারে তিনি ইসলামী শাসন কায়েম করেন।
খলীফা হওয়ার পর তিনি সকল মুসলমান বিশেষ করে সকল আমীর, নবাব ও ওমরাহগণকে জিহাদে যোগদানের আহ্বান জানান। কিন্তু টংকের নবাব আমীর খানের পুত্র ওয়াজিরুদ্দীন ভিন্ন আর কেউ বেরলভীর ডাকে সাড়া দেয়নি। তিনি টংকের ওয়াজিরুদ্দীনকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পরিবর্তে স্বেচ্ছাসেবক ও অর্থ সাহায্য প্রেরণের জন্য অনুরোধ জানান। সীমান্তের নবাব ও আমীর ওমরাহগণ জিহাদের আন্দোলনে সাড়া না দিলেও ভারতের মুসলিম জনতা ধর্মীয় ও স্বাধিকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছাসেবক কিংবা ধন-রত্ন দিয়ে এই সংগ্রামকে বিপুলভাবে সাহায্য করেছিলেন। সৈয়দ আহমদের অনুচর ও শিষ্যগণ যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ভারতের প্রতিটি জেলা ও গ্রাম থেকে বিশেষ করে ইংরেজ শাসনাধীন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা হতে স্বেচ্ছাসেবক ও অর্থ সংগ্রহ করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে সৈয়দ আহমদের মুজাহিদ বাহিনীতে প্রেরণ করেছিলেন তা বর্ণনা করতে হান্টারদের মত ইংরেজ লেখকগণও বিস্ময় প্রকাশ করেছে।
সীমান্ত অঞ্চলের যে সকল খান ও সর্দার বেরলভীর দলে যোগদান করেছিলেন তাদের মধ্যে কোহাটের ইয়ার আহমদ খান, বানুর সুলতান মোহাম্মদ খান, হাসত নগরের সৈয়দ মোহম্মদ খান, হান্দ-এর খাদে খান ও অন্যান্য অঞ্চলের আশরাফ খান ও ফতেহখান উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তারা সকলে মুসলিম বাহিনীর জন্য বিশ্বস্ত ছিলেন না। সৈয়দ আহমদের জনপ্রিয়তা ও ক্রমবর্ধমান শক্তি প্রত্যক্ষ করে তার সাথে তারা যোগ দিয়েছিলেন। সুলতান মোঃ খান ও ইয়ার মোঃ খান উভয়েরই ভয় ছিল যে, সৈয়দ আহমদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তাদের আধিপত্য ও স্বাধীনতা খর্ব হবে। তাই তাঁরা মুজাহিদ বাহিনীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই তার দলে যোগ দিয়েছিলেন। এদিকে রণজিৎ সিংহও তাদেরকে টাকার বিনিময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য প্রেরণা যোগিয়েছিলেন।
ইতিপূর্বে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক খান ও সরদারগণ মুজাহিদ বাহিনীর সাথে সম্মিলিতভাবে শিখদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা। তদনুসারে, ১৮২৭ সালের মার্চ মাসে মুসলিম বাহিনী সম্মিলিতভাবে ‘সাঈদু’ নামক স্থানে শিখদের মুখোমুখি হন। তুমুল যুদ্ধের পর বিজয় যখন মুসলমানদের সুনিশ্চিত, ঠিক তখনই ইয়ার মোহাম্মদ খান বিশ্বাসঘাতকতা করে তার সেনাদলসহ যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে। ফলে মুজাহিদ বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে।
ইয়ার মোহাম্মদ খানের বিশ্বাসঘাতকতা এবং সাঈদু-র যুদ্ধে পরাজয় মুসলিম বাহিনীর ঈমানী বিক্রমে ভাটা পড়েনি। সৈয়দ আহমদ ভিন্নপথ ধরলেন। তিনি খান ও সরদারদের চেয়ে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর উপর অধিক নির্ভরশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় মনে করলেন। এ সময়ে বৃটিশশাসিত এলাকা হতে বিপুল সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে জিহাদে যোগদানের জন্য আগমন করেছিলেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তিনি সোয়াত; চিত্রলসহ অন্যান্য এলাকা ব্যাপক সফর করেন। ফলে হাজার হাজার পাঠান তার পতাকাতলে সমবেত হন। বিশেষ করে শিখ নেতা হরিসিং নাওলার ভয়ে হাজার জেলার ঘটক, খলিল, সানওয়ারী, আফ্রিদি, মাহমান্দ প্রভৃতি গোত্রসমূহ সৈয়দ আহমদ শহীদের আশ্রয় গ্রহণপূর্বক শিখদের বিরুদ্ধে আমরণ জিহাদে প্রস্তুত হন। ইত্যবসরে ইয়ার মোহাম্মদ খানের সহিত হান্দের অধিপতি খাদে খানও বিশ্বাসঘাতকতায় যোগ দেয় এবং মুজাহিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ও টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়ে পাঠানদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত স্বেচ্ছাসেবকদিগকে প্রলোভন, আটক, লাঞ্ছনা ও আন্দোলনের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করতে থাকে ফলে বহু স্বেচ্ছাসেবক নিরুৎসাহিত হয়ে আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়।
ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি সাধনই ছিল সৈয়দ আহমদের আন্দোলনের লক্ষ্য। তদনুসারে তিনি তার খিলাফতের আওতাধীন পেশোয়ার ও অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত অনৈসলামিক আচার পদ্ধতি সংস্কার করে ইসলামের আদর্শ-ভিত্তিক শাসন প্রবর্তন করেন। ফলে যুগ-যুগান্তরের শোষক কায়েমী স্বার্থবাদীরা পরিবর্তিত আচার-পদ্ধতি, বিচার-ব্যবস্থা, যাকাত ফিতরা, রীতি-নীতি সহজে মেনে নিতে চায়নি। অতএব, তারা আন্দোলনের বিরোধীতায় মেতে উঠে। হান্দের শাসনকর্তা খাদে খান ও কোহাটের শাসনকর্তা ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রকাশ্যে সৈয়দ আহমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে ১৮২৯ সালের ৮ আগস্ট মুজাহিদ বাহিনীর হাতে খাদে খান ও ইয়ার মুহাম্মদ নিহত হন। ফলে হান্দ ও কোহাট খিলাফতভুক্ত হয়।
কাশ্মীরের মুসলমানগণ শিখ শাসকের কুশাসন থেকে মুক্তির জন্য সৈয়দ আহমদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। তদনুসারে মুসলিম বাহিনী কাশ্মীরের পথে অগ্রসর হয়। পথিমধ্যে সামরিক গুরুত্বপুর্ণ অঞ্চল ‘আম্ব’-এর শাসনকর্তা পাইন্দা খানকে মুসলিম বাহিনীর সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু পাইন্দা খান আধিপত্য ও স্বাধীনতা হারানোর ভয়ে সৈয়দ আহমদের সাথে সহযোগিতা করতে অমত প্রকাশ করায় মুজাহিদ বাহিনী ১৮৩০ সালের এপ্রিল মাসে ‘আম্ব’ দখল করে নেয়। পরে পাইন্দা খান অধীনতা স্বীকার করে সৈয়দ আহমদের সাথে এক সন্ধি করেন। অনুরূপভাবে, চিত্রল ও কাগান-উপত্যকার শাসনকর্তা যথাক্রমে সুলাইমান শাহ ও জামান শাহ সৈয়দ আহমাদের বশ্যতা স্বীকার করে মুজাহিদ বাহিনীকে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য সম্মত হন। অতঃপর সৈয়দ আহমদ-এর ভ্রাতুস্পুত্র আহমদ আলীর নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনীকে কাশ্মীরাভিমুখে প্রেরণ করা হয়। এ সংবাদে ভীত হয়ে রণজিত সিংহ কালবিলম্ব না করে হরি সিং নাওলা এবং জেনারেল এলাডকে মুজাহিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করে। ফোলারা নামক স্থানে তারা মুসলিম বাহিনীর উপর গভীর রাতে অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে বহু সংখ্যক মুজাহিদসহ সেনাপতি আহমদ আলী শহীদ হন।
পেশোয়ারের সুলতান মোহাম্মদ খান পরাজয়ের সুযোগে সৈয়দ মোহাম্মদ খান ও মোহাম্মদ খানের সহিত মিলিত হয়ে "মায়ার" নামক স্থানে মুজাহিদ দলের উপর অতর্কিতে আক্রমন চালায়। এতে মুজাহিদ বাহিনীর ২৮ জন এবং মিলিত বাহিনীর ৮০- জন সৈন্য নিহত হয়। সৈয়দ আহমদ স্পষ্টই বুঝতে পারলেন যে, শিখ শক্তিকে পরাজিত করতে হলে সুলতান মোহাম্মদ খানের শক্তি খর্ব করা একান্ত প্রয়োজন। তাই তিনি নিজে ৭ হাজার মুজাহিদ নিয়ে অগ্রসর হন। সুলতান মোহাম্মদ সৈয়দ আহমদের বশ্যতা স্বীকার পূর্বক করদানে সম্মত হয়ে সন্ধি করেন কিন্তু সুযোগমত সুলতান মোহাম্মদ খান সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে পুনরায় দুশমনী আরম্ভ করেন এবং সৈয়দ আহমদের বিরুদ্ধবাদী একদল ধামাধরা মোল্লা এবং যে সকল পাঠান হিন্দুস্তান থেকে আগত স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে পাঠান কন্যাদের বিবাহ পছন্দ করতেন না সে সমস্ত পাঠানদেরকে সৈয়দ আহমদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে লাগলো। রণজিৎ সিংহের অনুচর ও ঐ শ্রেণীর মোল্লাদের সাথে মিলিত হয়ে সুলতান মোঃ আরো অপবাদ রটাতে লাগল যে, সৈয়দ আহমদ আসলে বৃটিশের পক্ষে পাঠানদের পরাস্ত করে অর্থ সংগ্রহ ও নারী হরণ করতে এসেছেন। তিন দলের রটিত এ সমস্ত কুৎসা পাঠানদের মধ্যে সৈয়দ আহমদের বিরুদ্ধে বিষময় প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি করে। পাঠানদের এই অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে সুলতান মোহাম্মদ খান ও তার সহযোগীরা সীমান্তে অবস্থিত মুসলিম সাহিনীর নয়টি সামরিক ঘটির উপর একরাতে একত্রে আক্রমণ চালায় এবং কয়েক দিনের মধ্যে মিলিত বাহিনী মুজাহিদ বাহিনীর এই ঘাটিগুলো দখল করে নেয়।
অবস্থার শোচনীয়তা অনুধান করে সৈয়দ আহমদ কাশ্মীরে যেয়ে ব্যাপক পাল্টা আক্রমণ চালানোর লক্ষ্যে সসৈন্যে ‘চামলা’ উপত্যকার দিকে রওয়ানা হন। কিন্তু ইত্যবসরে রণজিৎ সিংহ শের সিংহের নেতৃত্বে এক বিরাট শিখ বাহিনী মুজাহিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। পার্বত্য অঞ্চলে কয়েকটি খণ্ড যুদ্ধে শিখদের উপর মুজাহিদ বাহিনী জয় লাভ করেন। কিন্তু ১৮৩১ সালের ৬ মে শিখ বাহিনী সীমান্তের “বালাকোট” নামক স্থানে অতর্কিতে পেছন দিক থেকে মুজাহিদ বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। মুজাহিদ বাহিনী রুখে দাঁড়ায়। কিন্তু অতর্কিত এই যুদ্ধে বিপ্লবী বীর মুজাহিদ সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও তাঁর বিশ্বস্ত সহচর মাওলানা ইসমাঈল শহীদ হন। ৬ মে-র রক্তাক্ত বালাকোট শহীদের চেতনায় ভাস্বর হয়ে আছে আজো। এই চেতনা মুসলিম হৃদয়ে জাগ্রত থাকবে চিরদিন।
ভারতব্যাপী এই আন্দোলন ছিল স্বাধীনতাকামী মুসলিম জাতির প্রথম গণ- আন্দোলন। এই স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভীর ইন্তেকালের পর মাওলানা বেলায়েত আলীর নেতৃত্বে তার শিষ্যগণ এই আন্দোলনকে বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে পাকিস্তান হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সিঁড়িতে পেীছিয়েছেন। সৈয়দ আহমদের প্রিয় শিষ্য তিতুমীরসহ হাজী শরিয়াতুল্লাহ ও ফকির মজনু শাহ একই আদর্শ ও উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এই আন্দোলন পরিচালনা করেন। সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভীর এই আন্দোলনের সফলতা ছিল সুদূরপ্রসারী! এই আন্দোলন ভারতের মুসলিম জাতির মধ্যে ধর্মীয় ও জাতীয় চেতনার ক্ষেত্রে যে দিগন্ত উন্মোচিত করে তা-ই পরবর্তীকালে জন্ম দেয় ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলন, দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে অর্জিত হয় পাকিস্তান এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।