JustPaste.it

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

 

হজ্ব ও কোরবানী আল্লাহ প্রেমের এক নির্মল নিদর্শন

মুফতী মুহাম্মাদ শফী (রাহঃ)

========================================================================

 

        মহা বিশ্বের স্রষ্টা - পরওয়ার দিগারের সাথে মানুষের সম্পর্ক বিভিন্ন রকমের। যেমন তিনি স্রষ্টা আর আমরা সবে সৃষ্ট, তিনি শাসক আর আমরা শাসিত। এমনিভাবে ইশক বা প্রেমের সম্পর্কও রয়েছে। তিনি আমাদের প্রেমাস্পদ আর আমরা প্রেমিক। মহা বিশ্বের সকল কিছুতে দৃষ্টি বুলালে আমাদের নিকট এ কথাটি প্রতিভাত হয় যে, আল্লাহ মাহবুব আর আমরা হাবীব। প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে প্রেমের আগুণ দৃষ্টি গোচর হয়। মূর্তিপুজারীরা যদিও পাথর প্রতীমার সামনে নত মস্তকে পুজা পালন করে। কিন্তু তবুও তাদের দাবী, আমরা তো মূর্তি পূজা একারণে করি যে, মূর্তিগুলো আমাদেরকে আল্লাহর নিকট পৌছে দিবে। অগ্নিপূজারী অগ্নিপূজা করছে। সূর্যপূজারী সূর্য পূজা করছে। হিন্দু পূজার উদ্দেশ্যে মন্দিরে ছুটছে। খৃস্টান গির্জায় যাচ্ছো, ইহুদী উপাসনালয়ে যাচ্ছো। যদি তাদের প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করা হয়, তোমরা কার তালাশে যাচ্ছো? কার স্বরণে এতো ব্যস্ত? এক বাক্যে সবাই একই কথা বলবে। একজন একেশ্বরবাদী মুসলমান যে পবিত্র সত্ত্বার ইবাদতের লক্ষ্যে মসজিদে যায় ঠিক সেই সত্ত্বার স্মরণে, সেই সত্ত্বার তালাশে ও তার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই তারা নিজ নিজ ইবাদতখানায় উপস্থিত হয়।

 

        দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মুসলমান ছাড়া অন্যরা সঠিক সরল পথ গ্রহণ করেনি। যার কারণে তাদের সকল প্রচেষ্টা শুধু নিরর্থকই নয় বরং তা তাদের জন্য কঠিন শাস্তির কারণ হবে। তারা যতই ভুল পথে চলতে থাকবে ততই উদ্দিষ্ট লক্ষ্য থেকে দূরে ছিটকে পরবে। কবির ভাষায়ঃ

 

        “হে মূর্খ, নির্বোধ! তুমি তো কখনো কাবায় পৌঁছতে পারবে না, কেননা তুমি যে পথে যাচ্ছো তা হলো তুর্কিস্তানের পথ। ”

 

        পক্ষান্তরে মুসলমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা সঠিক সরল পথ প্রদর্শন করেছেন, তারা যতই এ পথে অগ্রসর হবে ততই প্রেমাস্পদ আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হবে। মোট কথা, হৃদয়ে আল্লাহর ভালবাসা জাগরিত থাকা মানুষের সৃষ্টিগত বিষয়। যে বিষয়ে মহা দার্শনিক থেকে আরম্ভ করে একেবারে নিরেট মূর্খ পর্যন্ত সকলে সমান। যে অন্তরে জীবনের হীন স্পন্দন এখনও বাকী আছে সেও তার অন্তরে আল্লাহর ভালবাসা অনুধাবন করে। তবে এ ধরনের অন্তরের কথা বলছি না। যেগুলোকে বস্তুমোহে দুষিত করেছে। মরহুম আকবর ইলাহাবাদী যাদের সম্পর্কে বলেছেনঃ

 

        “ইউরোপীয়ানরা আকাশের প্রভুকে ছেড়ে দিয়েছে এবং বিদ্যুৎ ও তাপকে তারা খোদা মনে করছে।”

 

        হৃদয়ে প্রেম ও ভালবাসা সৃষ্টির কারণসমুহের বিষয়ে চিন্তা করলে দেখতে পাই যে, মানুষ তিনটি কারণে একে অপরকে ভালবাসে। তা হলো, সম্পদ, সৌন্দর্য্য ও সুকুমার বৃত্তি। কেউ অন্যকে তার ধন - সম্পদের কারণে ভালবাসে, কেউ সৌন্দর্য্যের কারণে, কেউ অন্যের সুকুমার বৃত্তি বা চরিত্রগুণের কারণে ভালবাসে।

 

        এক্ষেত্রে আমরা মহান রাব্বুল আলামীনের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখতে পাই যে, এ তিনটি কারণ ও বৈশিষ্ট্য তার মাঝে পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান। তিনি তো সকল সম্পদ, সৌন্দৰ্য্য ও সুন্দর গুণাবলীর আধার। দুনিয়ার যেখানেই কিঞ্চিৎ সৌন্দর্য্য ও সুন্দর গুণাবলী দেখা যায় তা তারই সৌন্দয্যের ছায়া বৈ নয়।

 

        যখন প্রেম ও ভালবাসা সৃষ্টির সকল কারণের আধার হলেন মহান রাব্বুল আলামিন তখন তাকে ছেড়ে অন্য দিকে ফিরে যাওয়া বড়ই বদ - কিসমতী ও বঞ্চনা বৈ কি? কবি বলেনঃ

 

        “যারা আপনার দর্শন ছাড়া অন্য কোথাও দৃষ্টি ফেলে তারা একেবারেই অদূরদর্শী, সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন।”

 

        একথা প্রমাণ করে যে, পৃথিবীর সকল সৃষ্টির সাথে আল্লাহ তায়ালার যেমন শাসক - শোষিতের সম্পর্ক রয়েছে তেমনিভাবে তাদের সাথে তার রয়েছে প্রেমের সম্পর্কও। তাই মানুষের ওপর যে বিভিন্ন ইবাদত ফরয করে দেয়া হয়েছে, ওই সব সম্পর্কেরই ফলশ্রুতি মাত্র। কোন ইবাদাত শাসক - শাসিতের সম্পর্কে সম্পৃক্ত, কোন ইবাদত প্রেমাস্পদ ও প্রেমিকের ভাবের সাথে সম্পর্কিত। যেমনঃ নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাতের মধ্য থেকে নামাযের মাঝে প্রভু - ভৃত্ব, শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রভুর দরবারে ভৃত্বের বিনয় ও নম্রভাবে উপস্থিত হওয়ারই এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। আর যাকাতের মাঝে শাসক ও প্রেমাস্পদ উভয় সম্পর্কের সংমিশ্রণ ঘটেছে। কারণ উশর, খিরাজ ইত্যাদি শাসকের প্রাপ্য। অন্যভাবে প্রেমাষ্পদের সন্তুষ্টি অর্জনে ধন সম্পদ ব্যয় করা প্রেমিকেরই বৈশিষ্ট্য। অবশিষ্ট থাকে রোযা ও হজ্ব। এ দু’টির সবটুকুর মাঝে প্রেমিক - প্রেমাস্পদের সম্পর্ক বিদ্যমান। আমার আলোচ্য বিষয় যদিও হজ্ব। কিন্তু রোযার সাথে হজ্বের নিবিড় সম্পর্ক থাকার কারণে এখানে রোযা সম্পর্কেও আলোচনা করতে হচ্ছো।

 

        প্রেম আর প্রণয়ণের প্রথম পর্যায়ে প্রেমিক প্রেমাস্পদের চিন্তায় আহার ত্যাগ করে। রাতে জাগ্রত থাকে। সে দিনরাত শুধু প্রেমাস্পদের চিন্তায় বিমগ্ন থাকে। এক প্রেমিক কবির ভাষায়ঃ

“যথার্থ দিনরাত সেটাই যেদিন ও রাত তোমার স্মরণে ব্যয়িত হবে।”

 

        রমযান মাসের রাত দিন আল্লাহর সাথে বান্দার সুনিবিড় প্রেমেরই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। সারা দিন ক্ষুধা - পিয়াসায় কাতর থাকে, আর রাতে তার বন্দনায় দাড়িয়ে দাড়িয়ে নামাযে রত থাকে। এ রহস্যের দিকে ইঙ্গিত করেই রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ

 

        “যার হাতে আমার প্রাণ সেই সত্ত্বার শপথ, রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকের খোশবুর চেয়েও বেশী প্রিয়। কেননা রোযাদার একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পানাহার পরিত্যাগ করে, যৌনাচার বন্ধ করে। তাই রোযা একমাত্র আমারই জন্য, আমিই তার প্রতিদান।” প্রেমের আলামত তো এটাই যে, প্রেমিকের মুখের গন্ধও তাঁর কাছে সুগন্ধির চেয়েও বেশী প্রিয় হয়ে উঠে।

 

        তাছাড়া স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নিজেই রোযার প্রতিদান হওয়া প্রেম ও অনুরাগেরই প্রমাণ করে।

 

 

ইতেকাফ 

        রমযান মাসের শেষ দশকে ইতেকাফ করাও সেই প্রেম - প্রণয়েরই বহিঃপ্রকাশ। কবি বলেন, “দিলে তো এই আরজু যে, কবে পদতলে পড়ে থাকবো, প্রিয়জনের পদতলে নিজের শীরকে প্রহরী বানিয়ে।”

 

        ইশক ও প্রেমের দ্বিতীয় ধাপ হলো এটা যখন প্রেমের আগুনে বিদগ্ধ হৃদয় বিচলিত অস্থির হয়ে পড়ে তখন বাড়ীঘর আত্মীয় পরিজন সব কিছু ছেড়ে পাগলের ন্যায় বন বাদাড়ে অজানা মরুপ্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়। শরীরের দিকে কোন খেয়াল থাকে না, পোষাক পরিচ্ছদের কোন খবর থাকে না। শোভা - সৌন্দর্যের পরোয়া থাকে না। সর্বদা প্রেমাস্পদের চিন্তায় মগ্ন থাকে, সিংহাসন ও শাহীমুকুটের চেয়ে নিঃস্ব জীবনই তখন ভালো লাগে। তাই কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ঃ

 

        “আমি দরবেশ আমি ফকীর। কিন্তু আমি আমার পশমী টুপিটিকে শতশাহী তাজের সমান মনে করি না। চাটাই আমার উত্তম বিছানা, দারিদ্র, আমার স্বপ্নের জীবন। শাহী মহলের আয়েসী জীবনে প্রকৃত সুখ কই।”

 

        রমযানের পরই উপস্থিত হয় হজ্বের মাস। প্রেমের প্রথম ধাপের পরই শুরু হলো। দ্বিতীয় ধাপ।

 

 

হজ্ব প্রেমের দ্বিতীয় ধাপ 

        একটু চিন্তা করলে বুঝে আসবে যে, হজ্বের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হলো প্রেমে বিভোর ব্যাকুলতা ভরা এক ইবাদতের নাম। পরিবার পরিজন বাড়িঘর দেশ ছেড়ে প্রেমাস্পদের তালাশে বের হয়ে যাওয়া, গায়ের পোষাক হয় একজন প্রকৃত প্রেমিকেরই ন্যায়। মাথায় নেই কোন তাজ। অবিন্যস্ত চুল। শরীরে সুগন্ধি নেই। প্রতি কদমে কদমে একই প্রতিধ্বনির অর্থাৎ হিযাযের পাথুরে উপত্যকায় বিজন মরু প্রান্তর পাড়ি দিয়ে সকল বাধা মাথায় তুলে প্রেমাস্পদের একটু সান্নিধ্য লাভের আশায় সে ছুটে যায়। শুধুই ছুটে যায় আর বার বার একই কথা বলেঃ 

 

         ‘বালাদুল আমীন’ অর্থাৎ মক্কায় প্রবেশ করে বাইতুল্লাহ তওয়াফ, হজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা ও চুমু খাওয়া - এ সব কিছু তারই প্রতিচ্ছবি যা কোন প্রেমিক প্রেমাস্পদের বাড়ী যেয়ে করে থাকে। তারপর সাফা মারওয়ার মাঝে ছুটাছুটি, পাহাড়ের চূড়ায় আরহণ, সেখান থেকে মিনায় যাওয়া এসব কিছুই প্রেমে বিভোর প্রেমিকেরই কাজ।

 

        যেভাবে প্রেমাস্পদের মিলনে বাঁধা দানকারীকে প্রেমিকের নিকট শত্রু মনে হয় এবং প্রেমিক তাকে প্রস্তরাঘাতে শেষ করে দিতে উদ্যত হয়, ঠিক হজ্বের সময় “ রমিউল যিমার ” বা প্রস্তর নিক্ষেপ তারই বহিঃপ্রকাশ। কেননা প্রস্তর নিক্ষেপ অনুষ্ঠানটি তো সেই স্মৃতি বহন করছে যা শয়তানের সাথে সেখানে ঘটেছিলো। এভাবে প্রকৃত প্রেমাস্পদের মিলন পথে শয়তানই বাধা দিয়ে থাকে। তারপর হলো তাওয়াকুল বিদা বা বিদায় তাওয়াফ। চূড়ান্ত বিদায় মুহূর্তে বাইতুল্লাহ ও তার গিলাফ ধরে কাদার এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। যা প্রেমিক প্রেমাস্পদের বাড়ী থেকে বিদায় মুহূর্তে ঘটে থাকে।

 

 

প্রেমের শেষ ধাপ কোরবানী 

        প্রেমিক যখন প্রেমাস্পদের নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সকল ধাপ অতিক্রম করে সামনে অগ্রসর হয়ে সঠিক পর্যায়ে উপনীত হয় তখন সে জীবন উৎসর্গ দিতেও কুণ্ঠিত হয় না।

 

        তাই প্রকৃত প্রেমাস্পদ তথা মহান রাব্বুল আলামীনের আশেকদেরও প্রেমের সর্বোচ্চ ধাপে পা রেখে নিজের জীবনকেও উৎসর্গ করে দেয়া চাই। তাই হাজ্বীগণ মিনায় পৌছে নিয়মানুযায়ী নিজের প্রাণকে কোরবাণী করার জন্য পারিপার্শিকতা ও সময়ের কণ্ঠে বলে উঠেঃ “বনের সব হরিণ নিজের হাতে প্রাণ নিয়ে বিচরণ করে। এই আশায় যে, একদিন কোন শিকার পেয়ে যাবে।”

 

        তবে তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু, তিনি নিজেই বলেছেনঃ আমার দয়া মমতা আমার ক্রোধের অগ্রগামী। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বীয় অনুগ্রহ ও অশেষ বলে প্রেমিকের প্রাণের বিনিময়ে এমন এক প্রাণ চেয়ে নিলেন যাকে আল্লাহ সেই প্রেমিকের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আর মজার বিষয় হলো, সেই কোরবানীর বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা বিরাট নেকীর অঙ্গিকারও করেছেন।

 

        পরিশেষে কবি বলেনঃ “ আল্লাহর দেয়া প্রাণ তাঁরই জন্য উৎসর্গ করলাম। তবুও সত্য কথা হলো, তার হক্ব আদায় হলো না।”

 

অনুবাদঃ আহমাদ আল - ফিরোজী

 

═──────────────═