JustPaste.it


রণাঙ্গন থেকে বলছি


ঈমান পরীক্ষার সর্বোত্তম স্থান
জিহাদের ময়দান
দ্বীন মোহাম্মদ


(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নির্ভিকতাঃ নির্ভীকতা মুজাহিদ চরিত্রের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ। এক আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো কাছে মুসলমান মাথা নত করবে না-এ চেতনা থেকে উৎসারিত ও বিকশিত হয় এ গুণটি। বাস্তবিক, মুজাহিদ যে পরিবেশেই হোক না কেন, তার সামনে যত প্রবল প্রতাপান্বিত শত্রুই দন্ডায়মান থাকুক, মুজাহিদ কখনো ভীত বিহ্বল হবে না। কেননা, সে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহয় অংশ নেয়। একটি হলো শাহাদাত- রক্ত রঞ্জিত পোষাকে আল্লাহ্র দরবারে পৌঁছে বিনে হিসেবে জান্নাতে পৌছার টিকেট সংগ্রহ করা, অন্যটি হলো গাজী অর্থ্যাৎ বিজয়ীর বেশে মর্যাদার সাথে দুনিয়ার অবস্থান। মুজাহিদ জনবল, অস্ত্রবলে দুর্বলতা সত্ত্বেও যুগে যুগে অজেয় দুর্ধর্ষ শক্তিতে পরিণত হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল তাদের নির্ভীক চরিত্র, অটল মানসিকতা। এ নৈতিক ও চারিত্রিক বিজয় মুজাহিদদের সরঞ্জামের ঘাটতি পুষিয়ে দিতো। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, যুগে যুগে মুষ্টিমেয় মুজাহিদ কয়েকগুণ শক্তিশালী শত্রু বাহিনীর ওপর নির্দ্বিধায় আক্রমণ চালিয়েছে এবং বিজয় পৌরবে ধন্য হয়েছে। এ ব্যাপারে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর সিরিয়া বিজয় প্রণিধানযোগ্য। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) তখন ইরানের বিরুদ্ধে অভিযানে লিপ্ত। সিরিয়া সীমান্ত থেকে খবর এসেছে, রোমান বাহিনী মুসলিম বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পুর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। খলিফার দিকে রওয়ানা হলেন। সামনে দুটি পথ, একটি বিশাল দুর্গম মরু পথ, অপরটি শত শত শত্রুর ছাউনির পাশে ঘেষে সাধারন পথ। যে পথে অগ্রসর হলে সহজে শত্রুর চোখে ধরা পড়ার আশংকায় রয়েছে। অসম সাহসী খালিদ (রাঃ) দীর্ঘ ৫শত মেইল জনশূন্য মরু পথকেই বেছে নিলেন। ৮ হাজার সাথী-যোদ্ধার সবাইকে নিজ নিজ উটকে অতিরিক্ত পানি খাইয়ে মুখ বন্ধ করে নিতে বললেন। পথে ক্লান্ত ও বৃদ্ধ উটকে জবাই করে তার গোস্ত ও পেটে জমানো অতিরিক্ত পানি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা করেন। এভাবে ৮০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে খালিদ (রাঃ) সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের রোমান সৈন্যদের প্রধান ঘাটির পেছন ভাগে অতর্কিত আক্রমণ চালান। রোমান সৈন্যরা এ দিক থেকে যে আক্রমণ হতে পারে তা কখনো কল্পনাও করেনি, বরং তারা আরও অগ্রসর হয়ে মুসলিম বাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অসম সাহসিকতার কারণে সামরিক ইতিহাসে এক বিরল নজির স্থাপন করে খালিদ (রাঃ) মুষ্টিমেয় মুজাহিদ নিয়ে হাজার হাজার রোমান সৈন্যকে আতঙ্কিত করে তুলেন এবং দামেস্কে তাদের আত্মরক্ষার অবস্থানে ফিরে যেতে বাধ্য করেন।
বাস্তবিক, কোন ঈমানদার মুসলমানের চরিত্রে একমাত্র আল্লাহ্ ভীতি ছাড়া আর কোন ভীতি, ভীরুতার অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এ প্রসঙ্গে, রাসূল (ﷺ) বলেন, “মানুষের নিকৃষ্টতম অভ্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ভিরুতা (যার ফলে জিহাদের ময়দানে তার শরীর কাঁপতে থাকে)। [-সুনানে কুবরা বায়হাকী-৯ম খন্ড, ১৭০ পৃঃ]
জালিম ও দাম্ভিক শক্তির প্রতিরোধে নির্ভীক চরিত্রের যথার্থ ধারণা পেতে হলে আমাদের ইসলামের ইতিহাসের প্রথমভাগ মন্থন করতে হবে। কাদেসিয়ার যুদ্ধ। ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানরা এই প্রথম একটি প্রবল প্রতাবান্বিত পরাশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছেন। পারস্যের বিশাল বাহিনীর সেনা নায়ক বিশ্বখ্যাত মহাবীর রুস্তম। তার জনবল, অস্ত্রবল, সৈন্যদের সাজ সরঞ্জাম, ট্রেনিংয়ের কাছে মুসলমানরা তৃণসম। কিন্তু নৈতিক ও চারিত্রিক বিষয়ে মুসলমানরা তাদের কাছে কখনো দুর্বলতা প্রকাশ করেনি। জিহাদের নীতি অনুযায়ী মুসলমান পক্ষ থেকে ১৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ইরানীদের ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য দূত হিসেবে নিয়োগ করা হয়। দুতগণ দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে পারস্যের রাজধানী মাদায়েনে পৌঁছলেন, তাদের বেশভুষা অত্যন্ত সাধারণ, ঘোড়ার পীঠে গদি এবং হাতে সামান্য হাতিয়ার। দূতের আগমন সংবাদ শুনে সম্রাট ইয়াজদগীরদ অত্যন্ত শান শওকতের সাথে দরবার সাজালেন। দূতগন সম্রাটকে কোন প্রকার কুর্নিশ না করে নির্ভীকচিত্তে উন্নত মস্তকে দরবারে প্রবেশ করলেন। দাম্ভিক দরবারীগণ সম্রাটের প্রতি এ অবমাননায় অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন। সম্রাট সর্ব প্রথম দূতগণকে প্রশ্ন করলেন, “তোমরা কেন এ দেশে এসেছো?” দলনেতা নমান ইবনে মাকারবিন অতি সংক্ষেপে ইসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্যের বর্ণমা দিলে বললেন, “আমরা আপাতত দুনিয়ার সামনে দু’টি বিষয় পেশ করে থাকিঃ প্রথমটি ইসলাম এবং দ্বীতিয়টি জিজিয়া, অন্যথায় শাণিত তরবারী।” এ নির্ভীক উত্তরে সম্রাট ক্রুদ্ধস্বরে আবার প্রশ্ন করলেন, “তোমরা কি ভুলে গিয়েছ তোমরাই কিছু দিন আগে দুনিয়ার সবচেয়ে হতভাগ্য জাতি ছিলে?  সামান্য একটু অবাধ্য হলে সীমান্তের জমিদারদের দ্বারা তোমাদের শায়েস্তা করে ছাড়তাম।” সম্রাটের এ শ্লেষবাক্যে আরবের অমিততেজা বীর পুরুষ মুগীরা ইবনে যাররা দাঁড়িয়ে বললেন, “সম্রাট আমার সাথে যাদের দেখছেন তারা আরবের সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তি। অতিরিক্ত কথা বলতে তাদের ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগা স্বাভাবিক। এতদ্বসত্ত্বেও তারা যতটুকু বলেছে তাই হয়ত যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আপনার প্রশ্ন শুনে মনে হচ্ছে, বলার মতো আরো কথা বাকী রয়ে গিয়েছে। এ কথা সত্য যে, আমরা দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট জাতি ছিলাম। মারামারি, কাটাকাটি, মূর্তিপূজা, পরধন অপহরণ , ব্যভিচার নরহত্যা, এমন কোন অপরাধ ছিল না যা আমরা করতাম না। কিন্তু আল্লাহ্ অনুগ্রহ করে আমাদের জন্য একজন নাবী পাঠালেন, তিনি আমাদের আলোর পথে নিয়ে যেতে চাইতেন, আমরা পিছনে ছুটতে চাইতাম। কিন্তু ধিরে ধীরে তার কথা আমাদের অন্তরকে আকৃষ্ট করল এবং আমরা আলোক প্রাপ্ত হলাম। তিনি আমাদের আদেশ করলেন, এ দ্বীনকে সমস্ত দুনিয়ার সামনে তুলে ধরো, যারা তা গ্রহণ করবে তারা তোমাদের সম মর্যাদা সম্পন্ন বলে গণ্য হবে। আর যারা সরাসরি তা গ্রহণ না করে জিজিয়া দিয়ে বশ্যতা গ্রহণ করবে তারাও তোমাদের দায়িত্বে থাকবে। আর যারা এর একটিও গ্রহণ করবে না, তাদের জন্য রয়েছে শাণিত তরবারী।”
দূতের মুখে এ নির্ভীক উক্তি শুনে সম্রাট ক্রোধে অধির হয়ে বললেন, “যদি দূত হত্যার নিয়িম থাকতো তবে তোমরা একজনও জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারতে না।”
আর একটি ঘটনা। কাদেসিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বাহ্নের ঘটনা। মুসলমানরা শান্তি স্থাপনের শেষ চেষ্টা হিসেবে পাঠালেন রবী ইবনে আমেরকে। রবি ইবনে আমের কম্বলের বিরাট পাগড়ী অ জামা পড়ে এক আজব বেশে সজ্জিত হলেন। কোমরে খেজুর পাতার মোটা রজ্জুর কোমরবন্ধ, কটিদেশে তলোয়ার ঝুলিয়ে এক বিরাট আকারের আরবী অশ্ব নিয়ে ছুটলেন রুস্তমের দরবারে। ওদিকে ইরানীরা বিশ্বখ্যাত ইরানী গলিচা বিছিয়েজাক জমকের সাথে দরবার সাজালেন। রবি বিছানার নিকটে গিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে তার লাগাম বাধলেন রুস্তমের হাত ওয়ালা সিংহাসনের হাতলের সাথে। তারপর বেপরোয়াভাবে বর্শা হাতে রুস্তমের দিকে অগ্রসর হতে থাকলেন। বর্শার আঘাতে দামী গালিচা ছিদ্র হয়ে যাচ্ছিল। দরবারীগণ এ বেপরোয়া আচরণের প্রতিবাদ করতে না পারলেও নিয়ম অনুযায়ী রবির অস্ত্র খুলে রাখতে চাইল। রবি তাতে অসম্মতি জানিয়ে বলেন, এ প্রকারে আসা তোমাদের পছন্দ না হলে আমি ফিরে যাচ্ছি। অবশেষে রুস্তম তাকে এ অবস্থায়ই আসার অনুমতি দিলেন। এরপর শুরু হলো প্রশ্নপর্ব। রুস্তম ক্রোধভরে প্রশ্ন করলেন, “তোমরা এ দেশে কেন এসেছো?” রবী বললেন, “এ জন্য যে মানুষ সৃষ্টির পূজা না করে যেন শ্রষ্টার পুজা করে”।
দরবারের লোকেরা বার বার রবীর হাতিয়ার পর্যবেক্ষণ করে উপহাস করে বলছিল, “এর দ্বারা তোমার ইরান জয় করতে চাও?” রবীর বীরত্বে এ উপহাস আঘাত হানলো। তিনি তৎক্ষণাৎ বিদ্যুৎ বেগে তরবারী কোষমুক্ত করেন এবং তীক্ষ্ণতা পরীক্ষা করার জন্য ঢাল আনতে বললেন। ঢাল আনা হলে তিনি এক আঘাতে তা দ্বিখণ্ডিত করে ফেললেন। দরবারীরা তার এ আচরণে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। 
পরদিন আবার দৈত্যকাজে গেলেন মুগীরা। এদিনও রুস্তম মুসলমানদের প্রলুদ্ধ করার জন্য জাক জমকের সাথে দরবার সাজিয়েছিল। মুগীরা এবার সরাসরি রুস্তমের সিংহাসনের  কাছে গিয়ে রুস্তমের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে বসে গেল। তার এ আচরণে দরবারের আমীর-আমলারা ক্ষেপে গেল এবং মুগীরাকে জোর করে আসন থেকে নামিয়ে দিল। মুগীরা জবাবে বললেন, “আমি তো সাধ করে তোমাদের এখানে আসিনি, তোমরাই ডাকিয়ে আনিয়েছো। সুতরাং অতিথির সাথে এরূপ আচরণ সমীচিন নয়। তোমাদের মতো আমাদের এমন কোন রীতি নেই যে, এক ব্যক্তি খোদা হয়ে বসবে আর বাকী লোক তার সামনে বান্দার মতো নতশীরে থাকবে। তার মন্তব্যের তর্জমা শুনার পর সভাসদগণ বলে উঠল “আমাদের ভুল যে, আমরা একটি আদর্শবাদী জাতিকে অত্যন্ত নিকৃষ্ট বলে মনে করেছিলাম।” রুস্তমও মুগীরার এ জবাবে লজ্জিত হয়ে বল, এতা চাকরদের কর্ম এতে আমার কোন হুকুম নেই।” আন্তরিকতা দেখাতে রুস্তম মুগীরার তুনির হতে একটি তীর বের করে বললেন, “এ সামান্য কাঠির দ্বারা কি হবে?” উত্তরে মুগীরা বললেন, “আগুনের শিখা ছোট হলেও আগুনই বটে।” এবার রুস্তম মুগীরার তরবারী বের করে উপহাস করে বললো, “এতো কতো পুরন তরবারী, কিন্তু ভুলে যাবেন না, এর মধ্যেই তীক্ষ্ম ধার রয়েছে।” রুস্তম এবার মুগীরাকে কিছু ধন সম্পদ দান করার প্রলোভন দেখিয়ে মুসলমানদের এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। মুগীরা এবার স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে তরবারীর অগ্রভাগে হস্ত স্থাপন করে বললেন, “যদি ইসলাম বা জিজিয়ার শর্ত গ্রহণ না কর তবে এর দ্বারাই মীমাংসা করা হবে।” 
উল্লেখ্য মহাবীর খালিদ (রাঃ)ও একবার রোম সাম্রাজ্যের সেনাপতির দরাবারে দূত হিসেবে গিয়ে সেনাপতির এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “তোমাদের রক্তপান করতে এসেছি। ইসলাম অথবা জিজিয়ার শর্ত গ্রহণ না করলে এ তরবারি দ্বারা তোমাদের গর্দান কেটে রক্তপান করে তবে ক্ষ্যান্ত হবো।” 
আমরা এসব বির মুজাহিদদেরই উত্তরসূরী। জিহাদের ময়দানে শত্রুর ওপর চারিত্রিক প্রাধান্য অর্জন করতে হলে এসব মহাপুরুষদের আদর্শকে অবশ্যই আকড়ে ধরতে হবে। জিহাদের ময়দানে ভীরুতা, দুর্বলতা যদি মনে বাসা বাধার সুযোগ পায় তবে কাংখিত সাফল্য কখনও আশা করা যায় না। কেননা ভীরুতা মোনাফেকীরও অন্যতম লক্ষণ। জালিমের শক্তির ভয় বা মৃতুর ভয়ে ভীত হয়ে পড়লে তা জিহাদ থেকে পলায়ন করার রাস্তা খুঁজতে উৎসাহিত করবে। ইসলামী পরিভাষায় যাকে জঘন্য অপরাধ, আল্লাহ্র অভিসম্পাত মাথা পেতে নেয়া এবং দুনিয়া অ আখিরাতের বরবাদীর কারণ বলে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং ঈমানের পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে অবশ্যই ভীরুতাকে পরিত্যাগ করতে হবে। 
বিপদে ধৈর্যধারণঃ জিহাদের ময়দানে আর এক অন্যতম পরীক্ষা হলো ধৈর্য ধারণের পরীক্ষা। যুদ্ধের ময়দানে মুজাহিদদের বিজয়ের পূর্ব শর্ত হলো ধৈর্য ধারণ করা। বিপদ যত কঠিন হবে মুজাহিদরা ঈমানী দায়িত্ব পালনে তত ধৈর্যশীলতার পরিচয় দেবে। আল-কুরআনে ঈমানদারদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্টের বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, তারা বিপদে ধৈর্যধারণকারী। জিহাদের ময়দানে আল্লাহ্র মদদ (সাহায্য) লাভেরও পূর্ব শর্ত হলো ধৈর্যধারণ করা।  কঠিন বিপদ অ বিপর্যয়ের মুখেও ধৈর্যের সাথে সুষ্ঠভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করে গেলে তখনই আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রত্যাশিত সাহায্য মিলবে। ইসলামী জিহাদের ইতিহাসে যুগে যুগে তা প্রমাণিত হয়েছে। প্রথমেই বলা যায় বদরের জিহাদের কথা। ৩১৩ কন মুজাহিদ কয়েকগুণ বেশী শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অনমনীয় দৃঢ়তা এবং অটল ধৈর্য ধারন করে জিহাদে অবতীর্ণ হন। শত্রু যে সংখ্যায়, অস্ত্র বলে অনেক বেশী শক্তিশালী এ চিন্তা তাদের মনে ক্ষণিকের তরেও আচর কাটতে পারে নি। বরং তারা এমন দৃঢ়তার সাথে ময়দানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন যেন বিজয়ের ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। বদরের মুজাহিদরা ধৈর্যের সাথে জিহাদ অটল থাকার ফলে এক পর্যায়ে মুজাহিদের সাহায্যে আল্লাহ্র নির্দেশ অনুযায়ী ফেরেশতারা অবতীর্ণ হন।
রাসূল (ﷺ)-এর ওফাতের পর মদীনা রাষ্ট্র মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ভন্ড নবী, যাকাত অস্বীকারকারী, বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উৎপাত, বহিঃশত্রুর তৎপরতা প্রভৃতির ফলে মদীনা রাষ্ট্র অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত হয়। ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা তখন আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)। তিনি মুসলিম বাহিনীকে কয়েকটি দলে বিভক্ত করে ইসলামী রাষ্ট্রের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদে প্রেরণ করেন। সেই কঠিন পরিস্থিতে কোমল চরিত্রের খলিফা আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) যে কঠিন ধৈর্যের পরীক্ষা দেন তা আমাদের জন্য শিক্ষার বিষয় হয়ে রয়েছে। যে অবস্থায় মদীনা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা করতেই হিমসিম খেতে হচ্ছিল সে অবস্থায় খলিফা পর্যায়ক্রমে মুসলিম বাহিনীকে অভিযানে পাঠিয়ে সকল বিদ্রোহ বিশৃংখলা উৎখাত করেন। ইসলামের ইতিহাসের পরতে পরতে এরূপ বহু ঘটনার নজীর রয়েছে। ১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে ভারতের একমাত্র স্বাধীন সালতানাত মহিশুর রাজ্যের অন্তিম সময়। ইংরেজ ও নিজাম দু’দিক থেকে মহিশুর রাজ্যের রাজধানী শ্রীরঙ্গপট্টম অবরোধ করে রেখেছে। মহিশুরের বাহিনীও প্রাণপণে যৌথ বাহিনীকে প্রতিহত করে চলছে। সুলতান টিপু ধৈর্যের সাথে স্ময়ক্ষেপন করে চলছিলেন প্রত্যাশিত আল্লাহ্র সাহায্য প্রাপ্তির জন্য। যদিও যুদ্ধের পরিস্থিতি তার বাহিনীর প্রতিকুলে যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি নিশ্চিত ছিলেন আসন্ন বর্ষা মওশুমে কাবেরী-কৃষ্ণা নদীতে একবার বান ডাকলে যৌথ বাহিনী মহা বিপর্যয়ের সম্মুখিন হবে এবং তিনি আল্লাহ্র এ সাহায্যকে কাজে লাগিয়ে বিজয়ী হবেন। কিন্তু প্রতিকুল অবস্থা দেখে একশ্রেণির দুর্বল মানসিকতার ওমরাহ শত্রুর সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় নিজেদের ভবিষ্যৎ বিপদমুক্ত করার জন্য। এ ষড়যন্ত্রকারীরাই নগরীর গোপন পথ শত্রুর জন্য খুলে দিয়ে দেশের স্বাধীনতাকে বিক্রি করে দেয়। সুলতান টিপু বিরের মতো লড়াই করতে করতে শাহাদাত বরণ করে। এ ঘটনার পরদিন শহীদ সুলতানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে যখন তার লাশ নিয়ে গোরস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয় ঠিক তখন সমগ্র আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়। শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টিসহ মুষল্ধারে বৃষ্টি । যে বৃষ্টির ভরসায় টিপু সুলতান যুদ্ধকে বিলম্বিত করছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, মহিশুরের ইতিহাসে এত প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি খুব কমই হয়েছে। কাবেরী-কৃষ্ণ নদীতে সেবার  যে বন্যা দেখা দিয়েছিল তাতে আর একদিন মহিশুর বাহিনী টিকে থাকলে ইংরেজ মৈত্রি জোটের ধ্বংস নিশ্চিত ছিল। কিন্তু কিছু সংখ্যক লোকের আল্লাহ্র সাহায্য সম্পর্কে নিরাশ ও ধৈর্যহারা হয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার জন্য মহিশুরের নিশ্চিত বিজয় রূপান্তরিত হলো একদিনের ব্যবধানে চরম বিপর্যয়ে।
জিহাদের ময়দানে ধৈর্য ধারণ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে আফগানিস্তান, চেচনিয়ার কথা বলা যায়। ১৯৮৯ সাল। আফগান জিহাদের এক সংকটময় সময়। রাশিয়ান সৈন্যরা দেশে ফিরে গেছে। মুসজাহিদদের নিশ্চিত বিজয়কে রোখার জন্য এবার রাশিয়ার সাথে এককালের মুজাহিদদের মিত্র আমেরিকা, ফ্রান্সও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এ ষড়যন্ত্রের ফলে ডঃ আবদুল্লাহ আযযাম , শেখ তামিম আদনান সহ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় মুজাহিদ নেতা শহীদ হন। রণাঙ্গনের চৌকষ কমান্ডারদের মধ্যে আব্দুর রহমান ফারুকীসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কমান্ডারও শহীদ হয়ে যান। এছাড়া মুজাহিদদের অন্যতম বন্ধু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকও চক্রান্তের শিকার হয়ে শহীদ হয়ে যান। এ অবস্থায় চুতুর্মুখী ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। একটি যুদ্ধ বিরতির মাধ্যমে নাজিবুল্লাহকে টিকিয়ে রাখার ধান্ধা নিয়ে আফগান সংকট জিইয়ে রাখার জোর চেষ্টা চলতে থাকে। পাশাপাশি গণ প্রত্যাখ্যাত জহির শাহকে পুনর্বাসিত করে একটি জগাখিচুরি মার্কা পাশ্চাত্য স্টাইলের সরকার প্রতিষ্ঠার কূটনৈতিক চেষ্টাও চলতে থাকে। এ উদ্দেশ্যে মুজাহিদদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব ছড়ানোর জন্য তথাকথিত একটি মুজাহিদ গোষ্ঠী দাড় করানো হয় জহির শাহের সমর্থক রূপে। মুজাহিদরা এ সংকট ষড়যন্ত্র অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করে। তারা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জিহাদের মাধ্যমে আফগান সংকট সমাধানের মত ব্যক্ত করেন এবং সকল মতলবী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ফলশ্রুতিতে ১৯৯২ সালের শুরুতে তাসের ঘরের মতো নজিবুল্লাহর পতন ঘটে। বর্তমানে বিশ্বের বিস্ময় তালেবানদের ক্ষেত্রেও দেখা যায় একই ঘটনা। ১৯৯৫ সালের শুরুতে তারা একবার কাবুলের দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির হয়। কিন্তু ,মাসুদ বাহিনীর প্রতি আক্রমণে তাদের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। এমন একটা পর্যায় অতিক্রান্ত হয় যে তালেবানরা কাবুলের উপকন্ঠ থেকে উৎখাত হয়ে যাবে। কিন্তু তারা ধৈর্যের সাথে সে সংকট মোকাবিলা করে এবং বছর শেষ হওয়ার আগেই তারা কাবুলে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়। বর্তমানে অচল অবস্থা কাটিয়ে উঠে তালিবানরা মাসুদ-দোস্তাম বাহিনীর বিরুদ্ধে যে সাফল্য লাভ করছে তার পেছনেও রয়েছে সীমাহীন ধৈর্যধারণ ও অদম্য মানসিকতা।
জিহাদের ময়দানে এ ধৈর্যের পরীক্ষা জীবন মৃত্যুর পরীক্ষা সম। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি, সেনাবাহিনীর বিপর্যয়কর অবস্থা-এ পরিস্থিতিতে আরো অপেক্ষা করলে হয়তো ফলাফল আরো নাজুক হতে পারে। এর চেয়ে পশ্চাদপসরণ করলে হয়তো প্রাণ রক্ষা হতে পারে, এ ধরনের দুর্বল চিন্তা মন-মানসিকতার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। এসব মানসিক দুর্বলতাকে পাত্তা না দিয়ে ধৈর্যধারণ করে আল্লাহ্র সাহায্যের প্রত্যাশা করা কম ঈমানী শক্তির ব্যাপার নয়। 
(চলবে)