নীচের লিখাটি জামাতে ইসলামীর মানহাজের দূর্বলতা বুঝার পর, সেটি ছেড়ে দেয়ার প্রাক্কালে কিংবা কিছু পরে হয়তো, সেখানকার ভাইদের কাছে সত্য তুলে ধরার জন্য এক ভাই এর লিখা। এই লিখাটি থেকে আমরা অনেকেই জামাতে ইসলামীর মানহাজ এর ব্যাপারে ভাল ধারনা পাবো ইনশাআল্লাহ। এছাড়া জামাতে ইসলামী কিংবা ইসলামী ছাত্র-শিবিরের কিংবা অন্য যে কোন 'গণতান্ত্রিক ইসলামী' দলের সদস্যকে দাওয়াহ দেয়ার সময় এগুলো কাজে লাগতে পারে ইনশাআল্লাহ।

নোট - মাওলানা মাওদুদী (রঃ) চিন্তাধারা পরবর্তীতে কিছু পরিবর্তন হয়েছে হয়তো কিংবা তাওহীদের উপর ভিত্তি করে দাওয়াতী কার্যক্রম না করায় - দিনে দিনে সেখানে এমনিতেই জঞ্জাল ঢুকে যাবার কথা। সেটিই স্বাভাবিক। তবে প্রতিটি আন্দোলনের শুরুতে কিছু হক্ব কথা থাকে - যা আশেপাশের মানুষকে কাছে টেনে নেয়। নীচের কোট করা কথাগুলো এমনই হয়তো। আল্লাহু আলাম।


এই প্রশ্নগুলো আসলে শুধু জামায়াতে ইসলামীকে নয় বরং প্রতিটি 'গণতান্ত্রিক ইসলামী' দলের জন্য প্রযোজ্য।



=================

মওলানা মওদুদী (রঃ) এর প্রাথমিক চিন্তাধারা বনাম বর্তমান “বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী”

নিশ্চই সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য,আমরা তাঁরই প্রশংসা করি,আমরা তাঁর কাছে সাহায্য চাই,আমরা তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি,আমরা তাঁরই কাছে আমাদের অন্তরের অনিষ্ট থেকে এবং আমাদের কর্মসমূহরে খারাপ প্রভাব থেকে আশ্রয় চাই। নিশ্চয় আল্লাহ যাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন,কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না,আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট হতে দেন,কেউ তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে না। আমরা এই সাক্ষ্য দেই যে,আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমরা আরও সাক্ষ্য দেই যে,মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দাহ ও রসুল।
অতঃপর সবচেয়ে সত্য কথা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব (আল কুরআন), উত্তম পথনির্দেশক হচ্ছেন মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ইসলামে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ হচ্ছে এর মধ্যে নতুন আবিস্কার। প্রত্যেক নতুন আবিস্কৃত বিষয়ই (ইবাদাতই) বিদয়াত, প্রতিটি বিদয়াতই হচ্ছে পথভ্রষ্টতা, আর প্রতিটি পথভ্রষ্টতার পরিণাম হচ্ছে জাহান্নাম।

জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিলো মূলতঃ ইসলামকে বিজয়ী করা, সমাজে, রাস্ট্রের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়াত প্রতিষ্ঠা করা। একথা অনস্বীকার্য।
সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর রোকন, কর্মী, সাথী, সমর্থক ভাইরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন, অনেক কষ্ট করেছেন। ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে, নাস্তিক-মুর্তাদদের পক্ষ থেকে অনেক গালি, অনেক কটূ-কথা সহ্য করেছেন। নিজে না খেয়ে, না পরে নিয়মিত ইয়ানত (ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার জন্য আল্লাহর রাস্তায় অর্থ প্রদান করা) দিয়েছেন। এমনকি অনেক ভাই আল্লাহর রাস্তায় তাদের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ প্রত্যেক নিষ্টাবান ভাইদের ইখলাসপূর্ণ আমাল সমূহ কবুল করুন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এদেশে ইসলামকে প্রতিষ্ঠার জন্য, এদেশের মানুষের সামনে ইসলামের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরার জন্য বাংলায় তাফসীর, হাদিস গ্রন্থসমূহ, ফিকাহর কিতাব ছাড়াও ইসলামী সাহিত্যের এক বিরাট ভান্ডার গড়ে তুলেছে। এবং এই বই সমূহ তথা ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন করে এদেশের অনেকে জাহিলিয়াতের অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামের আলোয় নিজ জীবন উদ্ভাসিত করেছেন। অন্ততঃ আমি ব্যক্তিগতভাবে আমি এই বই সমূহ হতে অনেক উপকৃত হয়েছি। নিশ্চয়ই পাঠকদের অনেকেই এরকম লাভবান হয়েছেন। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর প্রাপ্য। একমাত্র ইসলামের শত্রু অথবা হিংসুটে ছাড়া কেউ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের এই অবদান অস্বীকার করবে না।

কিন্তু কালের পরিক্রমায় এই সংগঠনের অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম দিকে মাছিঘোটের সম্মেলনের পর আলিমদের এক বিরাট অংশ এই আন্দোলন হতে বের হয়ে যান, পরবর্তীতে মাওলানা আব্দুর রহীম সহ আরো অনেক আলিম এই সংগঠন হতে আলাদা হয়ে যান অথবা আলাদা হতে বাধ্য হন। সে সকল আলিমদের কি কি অভিমত ছিলো যা জামায়াত একমত হতে পারে নি, সেই অভিমত গুলো আল-কোরয়ান ও সুন্নাহর আলোকে সঠিক ছিলো কি না, তা জানা কষ্টকর। কারণ ক্যাডার ভিত্তিক সংগঠন হওয়ায় সেই মত বিরোধগুলির ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সাধারণ কর্মী, সদস্য হতে গোপন রাখা হয়েছে।
http://sonarbangladesh.com/blog/nazmul86/ এমএনহাসান ভাই এর “ইতিহাসের আলোকে জামায়াতে ইসলামী অধ্যয়ন” যারা পড়েছেন, তারা এ ব্যাপারে কিছুটা ধারনা পেয়েছেন। সেই সিরিজটা পড়ার সময় আমার মনে বার বার ইচ্ছা জেগেছিলো, “আল-কোরআন এ সুন্নাহর আলোকে জামায়াতে ইসলামী অধ্যয়ন” নামে একটা পোষ্ট দিতে। কিন্তু তা এখনো সম্ভব হয় নি। আল্লাহ চাইলে ভবিষয়তে সেটা লিখার ইচ্ছা আছে। কারণ মুসলমান হিসেবে আমরা আমাদের প্রত্যেকটি কাজকে আল-কোরআন ও সুন্নাহর মানদন্ডে পরখ করতে বাধ্য।

আপাততঃ আমি মাওলানা মওদুদী (রঃ) এর চিন্তাধারার আলোকে বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর কর্মকান্ড নিয়ে কিছু আত্ম-জিজ্ঞাসা পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে চাই। আত্ম-জিজ্ঞাসা কথা থেকেই বুঝতে পারছেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে এই আন্দোলনের সাথে জড়িত। আমার এই আত্ম-জিজ্ঞাসাগুলি জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতা, অনেক রোকন, অনেক ভাইদের সাথে শেয়ার করেছি, কিন্তু কারো কাছ থেকে এর কোন সদুত্তর পাই নি।

এই প্রশ্নগুলি সবার সাথে শেয়ার করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, যদি আমার এই আত্ম-জিজ্ঞাসা গুলি আল-কোরআন কিংবা সুন্নাহর আলোকে অসমীচিন হয়, তবে তা সহজে অপনোদন হবে। যদি সেগুলি যথার্থ হয়, তবে সেগুলি ইসলামী আন্দোলনের অনেক ভাই-বোনদের কাছে পৌঁছে যাওয়ার ফলে সেগুলি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে জামায়াতের বর্তমান নেতৃবৃন্দ বাধ্য হবেন। সেগুলি সঠিক হলে তাঁরা সেটা গ্রহন করবেন, সেগুলি তাদের দৃষ্টিতে ভুল হলে তারা আল-কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সেই জিজ্ঞাসাগুলির সদুত্তর দিবেন।

‘ইহতিসাব’ পদ্ধতি থাকার পরও কেন, আমি ব্লগ বেছে নিলাম। কারণ এই পদ্ধতি সঠিকভাবে কাজ করছে না। তাছাড়া যে সব বিষয় In Public হয়, সে সব বিষয়ে আলোচনা In Public না হলে বাকীরা অন্ধকাতে থেকে যান। হজরত উমার (রাঃ) যেদিন গনীমাতের মাল থেকে ২ টুকরো কাপড় পড়ে খুতবা দিতে উঠেছিলেন, সেদিন প্রশ্নকারী সাহাবীতো সবার সামনেই তাঁকে প্রশ্ন করেছেন, উমার (রাঃ) ও সবার সামনে উত্তর দিতে লজ্জা বোধ করেন নি। যেদিন উমার (রাঃ) মহিলাদের সর্বোচ্চ মোহরানা নির্দিষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন, সেদিন মহিলা সাহাবী তো ব্যক্তিগত সময় নিয়ে সবার অগোচরে ইহতিসাব করেন নি। বরং সবার সামনেই তার বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। উমার (রাঃ) তাঁর সিদ্ধান্ত ফিরত নিয়েছিলেন।

তাছাড়া আমাদের ইসলামী আন্দোলন নিয়ে এখন এত কথা জমে গেছে যে, তা কোন একটি সীরাত মাহফিলের পর, কর্মী সভার পর প্রশ্ন-উত্তর পর্বে আলোচনা করে শেষ করা সম্ভব হবে না। দায়িত্বশীলদের থেকে আলাদা সময় নিয়ে সমস্ত কথা বুঝিয়ে দিয়ে, তা উপরুস্ত দায়িত্বশীল হয়ে আবার উত্তর আসার প্রক্রিয়ায় প্রশ্নের মূল সুর ও অর্থ হারিয়ে যায়, বিস্তারিত দলিল ভিত্তিক উত্তর আসে না। তাছাড়া আমাদের আন্দোলন এখন রোর্ড-মার্চ, ১২ মার্চের ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ ইত্যাদি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ইস্যুতে এত ব্যস্ত যে, একজন সাধারণ কর্মীর এর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় ও সুযোগ কারোই হচ্ছে না। তাই আমি বাধ্য হয়ে এই ব্লগ বেছে নিয়েছি। আশা করি আমার বিভিন্ন প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের নেতৃ-বৃন্দের কাছে পৌঁছে যাবে। আর তারা এ ব্যাপারগুলি নিয়ে বিস্তারিত চিন্তা-ভাবনা করবেন।
এই সিরিজে আমি যে আত্ম-জিজ্ঞাসাগুলি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো, সেগুলি মূলতঃ অনেক দিন পর মাওলানা মওদুদী (রঃ) এর “ইসলামী বিপ্লবের পথ” বইটি পড়তে গিয়ে আমার মনে জেগেছে। যারা ইসলামী আন্দোলনের সাথে জড়িত নন, তাদের জন্য এই বই (আসলে যা একটি বক্তৃতা তিনি ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়েছিলেন) এর একটি লিঙ্ক দিলাম।

http://www.islam.net.bd/content/view/62/27/
আমার আত্ম-জিজ্ঞাসাগুলিকে এক কথায় প্রকাশ করার জন্য এমএনহাসান ভাই এর নিম্নোক্ত উক্তি খুবই সহায়কঃ

 

“বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন আজ পলিটিকাল ড্রেনে আটকা পড়ে আছে।যার ফলে ইসলাম ইটসেলফ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে,হচ্ছে বিশাল কর্মি বাহীনি।বুদ্ধিবৃত্তিক গ্রোথ নিন্মগামী,কেকের ভাগ নিয়ে চলছে কাড়াকাড়ি.....এই অবস্থায় পলিটিকাল ড্রেনের জন্য তার গতিপথ পরিষ্কার করে দেয়াই আমার দৃষ্টিতে শর্টকাট সমাধান।“
যা হোক, আমি হাসান ভাই এর সাথে সমস্যার বিষয়ে একমত, কিন্তু তার দেয়া সমাধানের ব্যাপারে এখনই কথা বলতে চাচ্ছি না। পরে সে ব্যাপারে কথা বলার ইচ্ছা আছে।

মাওলানা মওদুদী “ইসলামী বিপ্লবের পথ” বই এ “আদর্শিক রাস্ট্র” অধ্যায়ে বলেছেনঃ

 

আদর্শবাদী রাষ্ট্র যে ধারণা (IDEA) পেশ করে, তার মূল কথাই হচ্ছে, আমাদের সামনে ‘জাতি’ বা ‘জাতীয়তাবাদের’ কোনো অস্তিত্ব নেই। আমাদের সামনে রয়েছে শুধু মানুষ বা মানব জাতি। তাদের কাছে আমরা এক মহান আদর্শ এ উদ্দেশ্যে পেশ ও প্রচার করবো যে,এ আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠিত ও প্রতিষ্ঠিত হবার মধ্যেই তাদের সকলের কল্যাণ ও সাফল্য নিহিত রয়েছে। এই আদর্শ গ্রহণকারী সকল মানুষ ঐ আদর্শিক রাষ্ট্রটি পরিচালনায় সমান অংশীদার।

আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• তবে কেন আমরা নিজেদেরকে প্রতিনিয়ত “জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী” শক্তির অংশ হিসেবে প্রচার করছি?
• বাঙ্গালী কিংবা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ কোনটাই যেহেতু ইসলামে স্বীকৃত নয়, তবে কেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের পক্ষে আমাদের অবস্থান?
• ‘ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ’ বই এ কি মাওলানা মওদুদী (রঃ) প্রমাণ করেননি যে, জাতীয়তাবাদ জাহেলিয়াতের একটি ধারনা? এটা হারাম?
• কেন আমরা বলিষ্ট কন্ঠে ঘোষণা করতে পারছি না যে, যারা এই দ্বীন, এই আদর্শ গ্রহন করেনি অর্থাৎ অমুসলিম, কাফিরদের জন্য এই ইসলামী রাস্ট্রের পরিচালনায় কোন ভাগ নেই? গয়েস্বর বাবু কিংবা সুরঞ্জিতদের জন্য ইসলামী রাস্ট্র পরিচালনায় কোন অংশ থাকবে না। একথা পরিস্কার ভাবে উল্লেখ করতে, ইসলামের শিক্ষাকে যথাযথভাবে উল্লেখ করতে আমাদের এত লজ্জা কিসের?

মাওলানা মওদুদী বলেনঃ

 

এবার একটু চিন্তা করে দেখুন, যে ব্যক্তির মন মগজ, ভাষা বক্তব্য, কাজ কর্ম, তৎপরতা প্রভৃতি প্রতিটি জিনিসের উপর সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও জাতিপূজার মোহরাংকিত হয়ে আছে, সে কী করে এই মহান বিশ্বজনীন আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চলতে সক্ষম হবে? সংকীর্ণ জাতি পূজায় অন্ধ বিভোর হয়ে সে নিজের হাতেই তো বিশ্বমানবতাকে আহ্বান জানাবার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রথম কদমেই তো সে নিজের পজিশনকে ভ্রান্তির বেড়াজালে নিমজ্জিত করেছে। বিশ্বের যেসব জাতি জাতীয়তাবাদী বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে আছে, জাতিপূজা এবং জাতীয় রাষ্ট্রই যাদের সমস্ত ঝগড়া লড়াইর মূল কারণ, তাদের পক্ষে বিশ্ব মানবতাকে কল্যাণের আদর্শের প্রতি আহ্বান করা সম্ভব নয়। যারা নিজেদের জাতীয় রাষ্ট্র এবং নিজ জাতির অধিকারের জন্যে ঝগড়ায় নিমজ্জিত, তারা কি বিশ্ব মানবতার কল্যাণের কথা চিন্তা করতে পারে? লোকদেরকে মামলাবাজী থেকে ফিরানোর আন্দোলন আদালতে মামলা দায়ের করার মাধ্যমে আরম্ভ করা কি যুক্তি সংগত কাজ হতে পারে?

আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• তাহলে মানুষকে সংসদ ভবনে আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা থেকে ফিরানোর জন্য নিজেরাই সংসদ সদস্য হয়ে যাওয়া কি যুক্তি সংগত কাজ হতে পারে?
• মদের দোকান উচ্ছেদ করতে গিয়ে নিজেরাই আবার মদের দোকানের কর্মচারী, ম্যানেজার হওয়া কি যুক্তি সংগত?
• সুদ ভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা উচ্ছেদ করতে গিয়ে কি নিজেরাই কোন সুদ ভিত্তিক ব্যাংক এ চাকুরী নেয়া কি যুক্তিসংগত হতে পারে? নাকি ইসলাম সেটার অনুমতি দেয়?

আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক রাষ্ট্রঃ

 

ইসলামী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, তার গোটা অট্টালিকা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। এ ধারণার মূল কথা হলো, বিশ্ব সাম্রাজ্য আল্লাহর। তিনিই এ বিশ্বের সার্বভৌম শাসক। কোনো ব্যক্তি, বংশ, শ্রেণী, জাতি, এমনকি গোটা মানবজাতিরও সার্বভৌমত্বের (Sovereignty) বিন্দুমাত্র অধিকার নেই। আইন প্রণয়ন এবং নির্দেশ দানের অধিকার কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট।
আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• তাহলে যারা জনগণকে সার্বভৌমত্বের অধিকারী বলে দাবী করে, যারা ইসলাম ছাড়া অন্য জীবন-বিধানকে এদেশের জন্য উত্তম বিবেচনা করে, সে ব্যবস্থার জন্য জীবন-পণ সংগ্রাম করে, তাদের সাথে কিভাবে আমরা সন্ধি করতে পারি?
• যদি মানুষের কোন সার্বভৌমত্ব না থাকে তবে আমাদের সংবিধানের বিভিন্ন ধারা-উপধারায় যেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব লংঘিত হয়, সে সবের বিরোধিতা আমরা করছি না কেন?
• আমাদের সংবিধানে বলা আছে, ‘যে আইনের যতটুকু এই সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হবে, সে আইনের ততটুকু বাতিল হবে’। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বিরোধী এরকম অনেকগুলো অনুচ্ছেদ থাকার পরও কিভাবে আমাদের নেতৃবৃন্দ সেই সংবিধানকে সম্মান করার, সেই সংবিধানকে রক্ষা করার অংগীকার নিতে পারেন?
• কিভাবে আমরা এই সংবিধানের ধারক-বাহক হিসেবে নিজেদেরকে পরিচয় দিতে পারি?


অবাস্তব ধারণা- কল্পণাঃ

 

আল্লাহর কালেমা বিজয় যে জিনিসের নাম, তার জন্যে তো এমন সব কর্মী বাহিনীরই প্রয়োজন, যারা হবে আল্লাহর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত। কোনো প্রকার লাভ ক্ষতির পরোয়া না করেই আল্লাহর আইন ও বিধানের উপর যারা থাকবে অটল অবিচল। মূলতঃ আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে এরকম একদল লোকেরই প্রয়োজন। চাই তারা বংশগত মুসলমানের মধ্য থেকেই এগিয়ে আসুক, কিংবা আসুক অপর কোনো জাতি থেকে, তাতে কিছুই যায় আসেনা। আমাদের জাতির উপরে বর্ণিত ধরণের পঁচিশ পঞ্চাশ লাখ লোকের মেলা অপেক্ষা এরকম দশজন মর্দে মুমিন আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজে অধিকতর মূল্যবান। সেরকম বিপুল তাম্রমুদ্রার ভাণ্ডার ইসলামের কোন কাজে আসবে না, যেগুলোর উপর স্বর্ণমুদ্রার মোহরাংকিত করা হয়েছে। মুদ্রার এইসব বহিরাংকন দেখার আগে ইসলাম জানতে চায়, এগুলোর অভ্যন্তরেও সত্যিই সোনা আছে কি? জাল স্বর্ণমুদ্রার বিরাট স্তুপ অপেক্ষা আল্লাহর দ্বীনের কাজে একটি খাঁটি স্বর্ণমুদ্রাও অধিকতর মুল্যবান।
আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• ইসলামী আন্দোলন এখন যে ধারায় অগ্রসর হচ্ছে, তাতে কি শুধু বেশী লোকের সমাগম করার কাজকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না? অধিক ভোট লাভ করার জন্যই কি আমাদের বেশীর ভাগ কার্যক্রম আবর্তিত হচ্ছে না?
• আল্লাহর আইন ও বিধানের বিরোধিতাকারী, মানব রচিত আইন দিয়ে দেশ পরিচালনাকারী বিএনপি এর পক্ষে কি আমরা মিছিল-মিটিং করছি না?
• আমাদের অনেক রোকন, কর্মী, সমর্থক থাকার পরও কেন আমরা এখন বিএনপি এর ছত্রছায়া ব্যতীত রাস্তায় বের হয়ে মিছিল করতে পারছিনা?
• তাহলে লক্ষ লক্ষ লোকের ভোট লাভ করার চেয়ে নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের মানোন্নয়নকে কি বেশী গুরুত্ব দেয়া উচিত হবে না?


 

এছাড়া আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার আন্দোলনের জন্যে প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব, যারা সেইসব নীতিমালা থেকে এক ইঞ্চিও বিচ্যুত হতে প্রস্তুত নয়, যেগুলো প্রতিষ্ঠার জন্যে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে। এই আদর্শিক দৃঢ়তার ফলে সকল মুসলমানকে যদি না খেয়েও মরতে হয়, এমনকি তাদেরকে যদি হত্যাও করা হয়, তবু তাদের নেতৃবৃন্দ বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি বরদাশত করতে প্রস্তুত হবেনা।

আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• বর্তমানে আমাদের নেতৃত্ব কি আমাদের মনগড়া কোন কোন ‘হিকমাহ’র জন্য, পরিস্থিতির চাপের কথা বলে, ‘বাস্তবতার নিরিখের’ কথা বলে ইসলামের অনেক নীতিমালা থেকে দূরে সরে আসেন নি?
• আমাদেরকে কেন প্রতি ৫ বছর পর পর অনৈসলামিক রীতি-নীতি অনুযায়ী নতুন আমীর নির্বাচন করতে হবে? কেন আমরা ঘোষণা করতে পারবো না যে, এটা ইসলামী নীতি নয়, তাই তা আমরা মানি না।
• কেন আমরা নারী-নেতৃত্ব ইসলামে হারাম জেনেও চার-দলীয় জোট-নেতৃ, কুফরী মতবাদের ধারক-বাহক খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন করবো?
• কেন ইসলামী আন্দোলনের নেতাদেরকে এ দেশের জনগণের সামনে সভায়, বক্তৃতায় খালেদা জিয়ার প্রশংসা করতে হবে? কেন তাকে দেশ-নেতৃ উপাধী দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের নেতাদেরকে কথা বলতে হয়?
• আসলেই কি আমরা এই মহিলাকে দেশ-নেতৃ মানি?
• ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচার, ইফতার মাহফিলে বক্তৃতা, সভা-সেমিনারে বক্তব্য এর মাধ্যমে দেশবাসী বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার ব্যাপারে কি এটাই শিখছে না যে, বিএনপি এবং খালেদা জিয়া ঠিকই আছেন, তিনিই এদেশের মুসলিমদের দেশ-নেতৃ।
• আমাদের এই আচরণের ফলে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদলকে কি ইসলামের দাওয়াত দেয়া হচ্ছে, নাকি তাদেরকে তাদের জাহিলী যুগের ধ্যান-ধারনায় টিকে থাকার পথকে সুগম করা হচ্ছে?
• কেন ইফতার মাহফিলে বেপর্দাভাবে উপস্থিত খালেদা জিয়াকে মাঝখানে বসিয়ে রেখে দুয়া করা হয়, এটা কি ভুল পথে পরিচালিত, শিরক-কুফরে নিমজ্জিত কারো কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌছানোর নীতি? এটা কি ইসলামী পর্দার বিধানের বিচ্যুতি নয়?
• আমরা কি বিএনপির সাথে রাজনৈতিক সন্ধি করেই তাদেরকে জান্নাতে নেয়ার চেষ্টা করছি? আমরা কি প্রকাশ্যে কখনো বলি যে, বিএনপি, ছাত্রদল, ছাত্রলীগকে অবশ্যই তাদের বর্তমান মতাদর্শ ত্যাগ করতে হবে? জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে হলে তাদেরকে সকল ক্ষেত্রে একমাত্র ইসলামী আদর্শ মেনে চলতে হবে?
• কেন খালেদা জিয়ার সাথে রুদ্ধ দ্বার বৈঠকে আমাদের নেতারা মিলিত হবেন? এগুলো কি ইসলামের নীতিমালার খেলাফ নয়?
• কেন বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের কাফির মহিলারা বেপর্দা ভাবে আমাদের নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত করার অনুমতি পায়? কেন তাদেরকে জানানো হয় না, যদি কোন মহিলা রাষ্ট্রদূত আমাদের নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা করতে চায়, তবে তাকে পর্দার বিধান মানতে হবে?
• আমরা ইসলামের এসব নীতিমালায় ছাড় দিলে অন্যান্যরা ইসলাম সম্পর্কে কি শিখবে?


ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মনীতিঃ

 

ইসলাম হলো সেই মহান আন্দোলনের নাম, যা মানব জীবনের গোটা ইমারত নির্মাণ করতে চায় এক আল্লাহর সার্বভৌমত্বের দৃষ্টিভঙ্গির উপর। সেই অতি প্রাচীন কাল থেকেই এই আন্দোলন এই একই ভিত্তি ও পন্থায় চলে আসছে। আল্লাহর রাসূলগণই (প্রতিনিধিগণ) ছিলেন এ আন্দোলনের নেতা। তাই আমাদেরকেও যদি এ আন্দোলন করতে হয়, তবে তা অবশ্যি এই সকল নেতৃবৃন্দের পদ্ধতিতেই করতে হবে। কারণ, এছাড়া এ বিশেষ ধরণের আন্দোলনের জন্যে অন্য কেনো কর্মনীতি নেই এবং হতে পারেনা।
............
এ ব্যাপারে আমরা কেবল এক জায়গা থেকেই পূর্ণাঙ্গ ও সুস্পষ্ট পথ নির্দেশনা পাই। তাহলো, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের যিন্দেগী। নিছক ভক্তি ও ভালবাসার কারণেই আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করছিনে, বরঞ্চ প্রকৃতপক্ষেই এ আন্দোলনের যাবতীয় চড়াই উৎরাই ও বাঁধা বিপত্তির জগদ্দলে ভরা দীর্ঘ পথ কিভাবে পাড়ি দিতে হবে, তা জানার জন্যে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে আমরা বাধ্য।

আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• আমরা কি এখন রাসুলগণের পদ্ধতি অনুসরণ করে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করছি?
• দেশের অধিকাংশ আসনে ধানের শীষ তথা বিএনপি এর জন্য ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাওয়া কি কোনভাবে রাসুলের পদ্ধতির সাথে মিলানো যায়?
• কোন রাসুল কি কখনো হিকমাতের জন্য, কৌশলের জন্য জাহিলিয়াতকে সমর্থন দেয়ার জন্য মানুষকে আহবান করেছেন?
• কোন রাসুল কি আমাদের মতো ইসলামের অনেক বিধানকে পায়ের নীচে মাড়িয়ে দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন?



 

ক. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ার আহ্বানঃ তাঁর গোটা দেশ ও জাতি ছিলো অজ্ঞতা, নৈতিক অধঃপতন, দারিদ্র ও দীনতা এবং ব্যভিচার ও পারস্পারিক কলহ বিবাদে চরমভাবে নিমজ্জিত। কুয়েত থেকে ইয়ামেন পর্যন্ত পূর্ব ও দক্ষিণের গোটা উপসাগরীয় এলাকা এবং উর্বর শস্য শ্যামল ইরাক প্রদেশ পারস্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি রেখেছিলো জবর দখল করে। উত্তর দিকে রোম শাসকরা হিজাযের সীমানা পর্যন্ত বিস্তার করে রেখেছিলো তাদের সাম্রাজ্যবাদী থাবা। ইহুদী পূঁজিপতিরা স্বয়ং হিজাযের অর্থনীতিকেই করছিল নিয়ন্ত্রন। গোটা আরবের লোকদের তারা আবদ্ধ করে রেখেছিলো চক্রবৃদ্ধি সুদের অক্টোপাসে। তাদের শোষণ নিপীড়ন পৌঁছে গিয়েছিল চরম সীমানায়। পশ্চিম উপকূলের সোজা অপর পাড়ে হাবশায় প্রতিষ্ঠিত ছিল খ্রীস্টান রাষ্ট্র। মাত্র কয়েক বছর পূর্বে এরাই আক্রমণ চালিয়েছিলো মক্কায়। হিজায এবং ইয়ামেনের মধ্যবর্তী প্রদেশ নাজরানে বাস করতো এই খ্রীস্টানদেরই স্বজাতির লোকেরা। তাছাড়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে তারা ছিলো জোটবদ্ধ। এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশেই অবস্থান করছিল তখনকার আরবদেশ, নবীর স্বদেশ।
কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্যে যে মহান নেতাকে নিযুক্ত করেন, তিনি গোটা বিশ্বের, এমনকি স্বদেশের এতোসব জটিল সমস্যার মধ্যে একটি সমস্যার প্রতিও মনোনিবেশ করেননি। সকল সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি কেবল একটি কথার দিকেই মানুষকে আহ্বান জানালেনঃ اَنِ اعْبُدُوا اَلله وَاجْتَنبوا الطَّاغُوتِ
“হে মানুষ, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর সকল প্রভুত্ব শক্তিকে অস্বীকার করো, পরিত্যাগ করো এবং কেবলমাত্র আলাহর দাসত্ব ও আনুগত্য মেনে নাও।”

আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• তার মানে নবী (সাঃ) আমাদের মতো তিস্তার পানি বন্টন, সীমান্তে হত্যা, দারিদ্র সমস্যা, তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে ময়দান গরম না করে শুধুমাত্র একটি কথার দিকেই মানুষকে আহবান করেছেন?
• তাহলে আমরা কেন এসব হাজারো সমস্যা নিয়ে মিছিল-মিটিং করে সময় নষ্ট করছি, ইস্যু ভিত্তিক রাজনীতি করে মাঠ গরম রাখার চেষ্টা করছি?
• তাফসীর ফি যিলালিল কোরয়ানে দেখলাম, সাইয়েদ কুতুব (রঃ) সকল প্রকার মানব রচিত বিধানের দিকে আহবানকারীদেরকেও তাগুত বলেছেন। তবে আমরা কেন বিএনপি এর মতো একটি তাগুতের সান্নিধ্যে থেকে, তাদের ছত্র ছায়ায় কাজ করার চেষ্টা করছি?
• আমরা কেন ইসলামী অর্থনীতি, সমাজ নীতি ইত্যাদির সুবিধা সমূহ নিয়ে বই লিখা ও প্রচার করতে ব্যস্ত?
• আমরা কি সবাইকে اَنِ اعْبُدُوا اَلله وَاجْتَنبوا الطَّاغُوتِ এর দাওয়াত দিচ্ছি?
• তাগুত কাকে বলে? আমাদের সমাজে কোন কোন জিনিস তাগুত, কিভাবে তাগুতকে পরিত্যাগ করতে হয়, এসব বিষয় কি আমরা নিজেরা বিস্তারিতভাবে জানি? কই আমাদের সিলেবাসেতো এ বিষয়ে তেমন কোন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।
• আমরা কি সভা, সেমিনারে, সিম্পোজিয়ামে, পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে, দাওয়াতী কার্যক্রমে, নির্বাচনী প্রচারে তাগুতকে বর্জন করার আহবান জানাচ্ছি? মানুষের সামনে তাগুতের স্বরুপ তুলে ধরছি? যে বিষয়ে আমাদের নিজেদেরই বিস্তারিত জ্ঞান নেই, সে বিষয়ের দিকে আমরা কিভাবে মানুষকে আহবান জানাবো?
• তাগুতের বিষয়ে আমাদের কয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে? কয়টি লিফলেট বিলি হয়েছে? কয়টি ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে? যদি আসলেই রাসুল (সাঃ) এর দাওয়াতের প্রথম বিষয় এটা হয়ে থাকে, তবে কেন তা আমাদের দাওয়াতে অনুপস্থিত?


 

ইসলামী আন্দোলনের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের নৈতিক ও সামাজিক জীবনে যতো অধঃপতনই সৃষ্টি হোক না কেন, সেগুলোর আসল কারণ হলো, মানুষের নিজেকে স্বাধীন স্বোচ্ছাচারী (Independent) এবং দায়িত্বহীন (Irresponsible) মনে করা। অন্য কথায়, নিজেকেই নিজের ইলাহ বানিয়ে নেয়া। কিংবা এর কারণ হলো, মানুষ কর্তৃক বিশ্ব জাহানের একমাত্র ইলাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকেও হুকুমকর্তা ও সার্বভৌম সত্তা হিসাবে মেনে নেয়া। চাই সে মানুষ হোক কিংবা অন্য কিছু। ইসলামের দৃষ্টিতে এই বুনিয়াদী ভুলকে তার অবস্থানের উপর বহাল রেখে কোনো প্রকার বাহ্যিক সংশোধন দ্বারা ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক অধঃপতন ও বিপর্যয় দূর করার ব্যাপারে কিছুতেই সফলতা লাভ করা যেতে পারেনা। এমতাবস্থায় এক স্থানে কোনো একটি অপরাধ করা হলেও অন্য জায়গা দিয়ে তা মাথা গজিয়ে উঠবে।

আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• আমরা শেষ কবে আল্লাহ ছাড়া আর কোন আইন-বিধান দাতা নেই – এই কথা বলে মিছিল করেছি, এই কথা আমাদের নির্বাচনী ইস্তিহারে উল্লেখ করেছি?
• আমরা শেষ কবে সভায়, সেমিনারে উল্লেখ করেছি যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে হুকুম দাতা হিসেবে মানি না?
• আমরা শেষ কবে ইফতার মাহফিলে কিংবা চারদলীয় ঐক্যজোটের সভায়, যৌথ মিছিলে কিংবা একক মিছিলে ইসলামের এই শ্বাশত দাবীর দিকে এদেশের মানুষকে আহবান করেছি?
• আর তা না করে থাকলে, আমরা কিসের পিছনে সময় নষ্ট করছি? কোন পদ্ধতিতে আমরা ইসলাম কায়েম করতে চাইছি?
• রাসুল (সাঃ) থেকে বেশী হিকমত ওয়ালা কিংবা জ্ঞানী তো আমরা কখনো হতে পারবো না। তবে কেন আমাদের কথায়, বক্তৃতায়, সংবাদ সম্মেলনে, বিদেশী দূতদের কাছে আমরা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর’ এই ঘোষণা উল্লেখ করছিনা?
• রাসুল (সাঃ) এর কাছে কোন অপরিচিত, বিদেশী লোক আসলে কি তিনি ‘লা ইলাহা’ এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা গোপন করতেন? আল্লাহ ছাড়া যে আর কোন আইন-বিধানদাতা, হুকুমকর্তা নেই – এই ইমান বা বিশ্বাস গোপণ করতেন ?


 

তছাড়া এই বাস্তব জিনিসটিও ভালোভাবে পরিষ্কার হওয়া দরকার। তাহলো, এই গোটা বিশ্বজগতের কেবলমাত্র একজনই সম্রাট, একজনই মালিক এবং একজনই স্বাধীন সার্বভৌম কর্তা রয়েছেন। এখানে অপর কারো কর্তৃত্ব করার কোনো অধিকার নেই। আর বাস্তবেও এখানে অপর কারো কর্তৃত্ব চলেনা। সুতরাং তুমি তাঁর ছাড়া কারো দাস হয়ো না। অপর কারো কর্তৃত্ব স্বীকার করো না। অপর কারো সামনে মাথা নত করো না। এখানে “হিজ হাইনেস” কেউ নেই। সকল ‘হাইনেস’ শুধুমাত্র সেই সত্তার জন্যেই নির্দিষ্ট। এখানে “হিজ হোলিনেস” কেউ নেই। সমস্ত ‘হোলিনেস’ কেবলমাত্র সেই একমাত্র শক্তির জন্যেই নির্ধারিত। এখানে “হিজ লর্ডশীপ” কেউ নেই। পূর্ণাঙ্গ ‘লর্ডশীপ’ কেবল সেই একমাত্র সত্তার। এখানে বিধানকর্তা কেউ নেই। অাইন ও বিধানকর্তা কেবলমাত্র তিনি এবং কেবলমাত্র তাঁরই হওয়া উচিৎ। এখানে অন্য কোনো সরকার নেই। অন্নদাতা নেই। অলী ও কর্মকর্তা নেই। নেই কেউ ফরিয়াদ শুনার যোগ্য। ক্ষমতার চাবিকাঠি কারো কাছে নেই। কারো কোনো প্রকার শ্রেষ্ঠত্ব এবং মর্যাদা নেই। জমীন থেকে আসমান পর্যন্ত সবাই এবং সবকিছু কেবল তাঁরই দাসানুদাস।
সমস্ত মালিকানা, প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব কেবলমাত্র আলাহ রাব্বুল আলামীনের। তিনিই একমাত্র ‘রব’ এবং ‘মাওলা’। সুতরাং, তুমি সকল প্রকার গোলামী, আনুগত্য ও শৃংখলকে অস্বীকার করো। কেবলমাত্র তাঁরই গোলাম, অনুগত এবং হুকুমের অধীন হয়ে যাও। এটাই হচ্ছে সকল প্রকার সংস্কার সংশোধনের মূল ভিত্তি। এই ভিত্তির উপরই ব্যক্তিগত চরিত্র এবং সমাজ ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ অট্টালিকা সম্পূর্ণ নতুনভাবে গড়ে উঠে। হযরত আদম (আঃ) থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যতো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত সৃষ্টি হবে, তা সবই একমাত্র এই বুনিয়াদী পন্থায়ই সমাধান হওয়া সম্ভব।

আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• আমাদের দাওয়াতী কাজে কবে থেকে এই কথাগুলি হারিয়ে গেছে, তা কি আমাদের মনে আছে? কেন এই শ্বাশত কথা গুলি আমরা এদেশের মানুষকে শুনাচ্ছিনা?
• আমাদের কথায়, লিখনীতে, বক্তৃতায় শেষ কবে এই সুরে, এই মূল মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়েছে?
• নাকি আমরা সমসাময়িক বিষয় নিয়ে এত ব্যস্ত হয়েছি যে, মূল দাওয়াত দেয়ার সময় আমাদের হচ্ছে না?



 

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো প্রকার পূর্ব প্রস্তুতি,ভূমিকা এবং প্রারম্ভিক কার্যক্রম ছাড়াই সরাসরি এই মৌলিক সংশোধনের আহ্বান জানান। এই আহ্বানের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছা পর্যন্ত তিনি কোনো প্রকার বাঁকাচোরা পথ অবলম্বন করেননি। এ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাজ করে মানুষের উপর কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেননি, যে প্রভাব দ্বারা লোকদের পরিচালনা করে ধীরে ধীরে স্বীয় লক্ষ্যে উপনীত হতে পারতেন। এ সবের কিছুই তিনি করেননি। বরঞ্চ আমরা দেখি, হঠাৎ আরবের বুকে এক ব্যক্তি মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্- আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নাই।’ তাঁর দৃষ্টি মুহূর্তের জন্যেও এই মৌলিক ঘোষণার চাইতে নিম্নতর কোনো কিছুর প্রতি নিবদ্ধ হয়নি।

আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• দূরদর্শী মাওলানা মওদুদী (রঃ) অনেক আগেই আমাদের সম্ভাব্য বিকৃতি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, তাইতো আমাদের তৈরী বিভিন্ন খোঁড়া অযুহাত তিনি আগেই উল্লেখ করেছেন।
• আমরা যে হিকমাতের নামে, আরো কিছু শক্তি সঞ্চয়ের নামে, সবাই এসব গভীরের কথা বুঝবে না- এই অযুহাতে, ব্যাংক, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজের মাধ্যমে কিছু সামাজিক-অর্থনৈতিক সেবা করে মানুষের মন যুগিয়ে তারপর ইসলামের এই দাওয়াত দিতে চাচ্ছি, তার কোন গ্রহনযোগ্য কারণ কি আমরা দেখাতে পারবো?
• আমরা মূল দাওয়াতের ক্ষেত্রে যে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছি, তার কোন যথাযথ কারণ কি দেখাতে পারবো?
• আমরা যে, এই মৌলিক ঘোষণার থেকে নিম্নতর অসংখ্য বিষয়ে বছরের পর বছর ধরে দৃষ্ট নিবদ্ধ রেখেছি, তার কৈফিয়ত কি আমাদের কাছে আছে?


 

কেবল নবীসুলভ সাহসিকতা আর আবেগ উদ্যমই এর কারণ নয়। বস্তুত এটাই ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃত কর্মনীতি। এছাড়া অন্যান্য উপায়ে যে প্রভাব, কার্যকরিতা ও কর্তৃত্ব সৃষ্টি হয়, এই মহান সংস্কার কাজের জন্যে তা কিছুমাত্র সহায়ক নয়। যারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুর মৌলিক আদর্শ ছাড়া অন্য কোনো কারণে আপনার সহযোগী হয়, এই মহান পুনর্গঠনের কাজে তারা আপনার কোনো উপকারে আসতে পারেনা।


আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• বিগত ১৫/২০ বছর থেকে সামাজিক-অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করার যে প্রোগ্রাম আমাদের রয়েছে, তা মুখ থুবড়ে পড়ার পরও কি আমরা একই ভুল করতে থাকবো?
• আমাদের এসব অন্যান্য কার্যক্রম আমাদের ইসলামী আন্দোলনে কি কি লাভ ঘরে এনে দিয়েছে? আর কি কি ক্ষতি আমাদের হয়েছে? তার হিসাব মিলানোর সময় আমাদের এখনই।


 

এই মহান কাজে সেসব লোকই আপনার সহায়ক ও সহযোগী হতে পারে, যারা শুধুমাত্র ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর’ আওয়াজ শুনে আপনার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এ মহাসত্যকেই জীবনের বুনিয়াদ ও জীবনোদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে নেয় এবং এরই ভিত্তিতে কাজ করতে প্রস্তুত হয়। সুতরাং, ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার জন্যে যে বিশেষ ধরণের চিন্তা ও কর্মকৌশল প্রয়োজন, তার দাবীই হচ্ছে, কোনো ভূমিকা ও উপক্রমণিকা ছাড়াই সরাসরি তাওহীদের এই মৌলিক দাওয়াতের মাধ্যমে কাজ আরম্ভ করতে হবে।

আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• আমরা কেন তাওহীদের মৌলিক দাবীর প্রতি মানুষকে দাওয়াত দিচ্ছি না যে, আমরা এসব রাস্ট্র ব্যব্স্থা মানি না, আমরা কেবল ইসলামী শারীয়াত চাই, এর চেয়ে এক চুল কম কোন কিছুও আমরা গ্রহণ করবো না, আমরা এদেশের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর আইন এর শতভাগ বাস্তবায়ন চাই?
• শুধু এদেশেই ইসলামের বিজয়ে আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে না, বরং সারা বিশ্বের প্রতিটি শহরে, বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে ইসলাম বিজয়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হবো না।
• কেন আমরা ঘোষণা করছি না, এই সংবিধানের প্রতিটি অনুচ্ছেদ, প্রতিটি ছত্রে যেখানে যেখানে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কোন কিছু আছে, তা আমরা মুছে ফেলতে চাই?
• কেন আমরা বর্তমান সংবিধানে যে ইসলাম বিরোধী ধারা আছে, তা মানুষের সামনে তুলে ধরছি না? তাহলে সাধারণ জনগণ আমাদের সাথে বিএনপি-আওয়ামীলীগ ইত্যাদি মানব রচিত দলের কি পার্থক্য দেখতে পাচ্ছে?
• নির্বাচনী ইস্তেহারে কেন আমরা ঘোষণা করছি না যে, আমরা সরকার গঠন করলে, আল-কোরয়ান ও সুন্নাহ হবে এদেশের আইন, এদেশের সংবিধান?
• আমরা কেন ঘোষণা করছি না যে, সকল সুদ ভিত্তিক ব্যাংক এদেশে বাতিল করা হবে, সবার জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হবে, ছেলে মেয়েদের স্কুল আলাদা করা হবে, পতিতা-বৃত্তি নিষিদ্ধ হবে, কাফির-মুশরিকরা নিয়মিত জিযিয়া কর দিবে, কেন আমরা ইসলামের সার্বজনীন এই বিষয় গুলো আমাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে উল্লেখ করছিনা? কিসের ভয়ে?
• যদি ইসলামের সঠিক পরিচয় মানুষের সামনে তুলে ধরতে আমরা ভ্য় পাই, তবে আমরা কিভাবে এদেশে, সারা বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবো?
• কেন আমরা ঘোষণা করছি না, আমরা বিজয়ী হলে ইসলামী শরীয়া আইন হবে এদেশের একমাত্র আইন। অন্য সকল মানব-রচিত কুফর-জাহিলিয়াতের আইন বাতিল করা হবে। কেন আমরা সৎ সাহস নিয়ে ইসলামী রাস্ট্রের মূলনীতিগুলি সবার কাছে তুলে ধরতে পারছি না?
• যদি জণগণ বুঝবে না কিংবা বিরোধিতা করবে মনে করে থাকি, কিংবা পাশ্চাত্যের দেশ গুলি আমাদের উপর নারাজ হবে মনে করে থাকি, তবে আমরা কি সঠিক ভাবে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি? তাহলে এখনি নির্বাচনে যাওয়ার কি প্রয়োজন রয়েছে আমাদের? আমরা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংসদ ভবনে কিছু অনৈসলামিক আইন প্রণয়ন এবং সুরা মায়েদার ৪৪ নং আয়াত ভুলে গিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় মন্ত্রী হওয়া ছাড়া আর কি হাসিল করতে পেরেছি?

 

তাওহীদের এই ধারণা নিছক কোনো ধর্মীয় ধ্যান ধারণা নয়। বরঞ্চ এ হচ্ছে এক পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন। এ দর্শন স্বেচ্ছাচারিতা এবং গাইরুল্লাহর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বের উপর সমাজ জীবনে যে কাঠামো বিনির্মিত হয়েছে, এ দর্শন তাকে সম্পূর্ণ মুলোৎপাটিত করে দেয়। বিলকুল এক ভিন্ন ভিত্তি ও বুনিয়াদের উপর গড়ে তোলে নতুন অট্টালিকা। আজ পৃথিবীর লোকেরা আপনাদের মুয়াযযিনের ‘আশ্হাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর’ বিপ্লবী আওয়াজকে নীরবে শুনে যায়। কারণ, ঘোষণাকারীও জানেনা সে কি ঘোষণা করছে? আর শ্রোতাদেরও নজরে পড়েনা এর কোনো অর্থ আর উদ্দেশ্য। কিন্তু ঘোষণাকারী যদি জেনে বুঝে ঘোষণা দেয় আর দুনিয়বাসীও যদি বুঝতে পারে যে, এই ঘোষণাকারী বলছেঃ আমি কাউকেও সম্রাট মানিনা, শাসক মানিনা। কোনো সরকারকে আমি স্বীকার করিনা। কোনো আইন আমি মানিনা। কোনো আদালতের আওতাভূক্ত (Jurisdiction) আমি নই। কারো নির্দেশ আমার কাছে নির্দেশ নয়। কারো প্রথা আমি স্বীকার করিনা। কারো বৈষম্যমূলক উচ্চ অধিকার, কারো রাজশক্তি, কারো অতিপবিত্রতা এবং কারো স্বেচ্ছাচারী উচ্চক্ষমতা আমি মোটেও স্বীকার করিনা। এক আল্লাহ ছাড়া আমি সকলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী। সকলের থেকে আমি বিমুখ।

আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• সত্যিই, মানুষ এই ঘোষণা ঠিকমতো বুঝে না। আমরাও কি এই ঘোষনার ব্যাখ্যা ভুলে যেতে বসেছি?
• আমরা কি মানুষের সামনে ঘোষণা করছি, যে ইসলাম ছাড়া কোন আইন আমরা মানি না, আমরা শুধুমাত্র আল্লাহকেই আইন প্রণেতা হিসেবে মানি?
• মুসলিম হতে হলে, মুসলিম থাকতে হলে হে বাংলাদেশের জনগণ আপনাদেরকেও এ কথা মেনে নিতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। এর কোন শর্ট-কাট নেই।
• আমরা কেন ইসলামী জাতীয়বাদ ছেড়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হলাম?
• আমরা কেন খিলাফাত ব্যবস্থার প্রচারক হিসেবে গর্ব করার পরিবর্তে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যব্স্থার প্রবর্তক হিসেবে সম্মান বোধ করার চেষ্টা করছি?
• কেন আমরা বিলাত-আমেরিকা তথা পশ্চিমা দেশের ভয়ে ইসলামের মূল কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহকে’ এদেশের মানুষের সামনে সঠিক ভাবে তুলে ধরতে পারছি না? কেন আমরা এদেশের মানুষকে পরিস্কার ভাবে সত্য জানাতে পারছি না?
• কেন আমরা বিএনপি, আওয়ামীলীগকে বলতে পারছি নাঃ দেখো, তোমাদের সাথে আমাদের কোন ধন-সম্পদ নিয়ে শত্রুতা নেই, জায়গা নিয়ে বিরোধ নেই। তোমরা ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাস্ট্রীয় জীবনে সর্বক্ষত্রে একমাত্র ইসলামী বিধান না মানলে, রাসুলের আদর্শকে উত্তম স্বীকার না করে সে অনুযায়ী না চললে, মুসলিম থাকতে পারবে না। তোমরা পরিণামে নিজেদেরকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছো। তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো। তাদের কাছ থেকে এই সত্য কথা গোপন করা কি হিকমাহ? কোন নবী কি এই হিকমাহ করেছেন? নাকি সকল নবী অকপটে এই সত্য কথা মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন?
• কেন আমরা তাদেরকে বলতে পারছি না, তোমরা যদি আমাদের পূর্বোক্ত কথা গুলি মেনে নাও, শতভাগ ইসলামী নিয়ম-নীতি এদেশে প্রতিষ্ঠিত করো, তবে আমাদের আর কোন চাওয়া-পাওয়া থাকবে না। বরং আমরাই হবো তোমাদের প্রতিষ্ঠিত সেই ইসলামী সরকারের রক্ষক। আর যদি তোমরা তোমাদের ইসলাম বিরোধিতা পরিত্যাগ না করো, তবে মৃত্যু পর্যন্ত তোমাদের সাথে আমাদের শত্রুতা চলতে থাকবে?
• আমরা বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদলকে ইসলামের এই সহজ সরল কথা কি কখনো বলেছি? তারা যদি কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে এই ফরিয়াদ করে যে, আমরা সহজ সরলভাবে তাদেরকে ইসলাম এর মূল আহবান পৌছিয়ে দেই নি, তবে আমরা আল্লাহর কাছে কি জবাব দেবো?
• এই দুনিয়ায় ইসলামী রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও বিএনপি আওয়ামীলীগ সহ এদেশের সকল মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করার দায়িত্ব কি আমরা ভুলে গেছি?
• আমরা কেন প্রকাশ্যে বলতে পারছি না যে, হে আমাদের জাতি, আপনারা শতভাগ ইসলাম অনুসরণ করুন, জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের বাস্তবায়ন করুন। আপনারা আমাদের দলে শরীক হতে হবে, এটাই একমাত্র পথ নয়। আপনারাও এদেশে ইসলাম রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করুন। যেই আগে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবে, আমরা সবাই মিলে তাকে সহযোগিতা করবো।

 

ঘোষক আর শ্রোতারা যদি ঘোষণার এই প্রকৃত মর্ম বুঝতে পারে, তবে কি আপনি মনে করছেন বিশ্ববাসী এই ঘোষণাকে সহজভাবে হজম করে নেবে? বরদাশত করবে নীরবে? বিশ্বাস করুন, সে অবস্থায় আপনি কারো সাথে লড়তে যান বা না যান, বিশ্ববাসী কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে। এই ঘোষণা উচ্চারণ করার সাথে সাথেই আপনি অনুভব করবেন, গোটা বিশ্ব আপনার দুশমন হয়ে গেছে। চতুর্দিক থেকে সাপ, বিচ্ছু আর হিংস্র পশুরা আপনাকে নির্মমভাবে আক্রমণ করছে।

আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• কই বিগত কয়েক দশক লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর দাওয়াত দেয়ার পরও তো আমাদের উপর এরকম কোন আক্রমণ আসে নি। হ্যাঁ, হল দখল করা, সিট দখল করা কিংবা ৭১ এ আমাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে আমাদেরকে কেউ কেউ আক্রমণ করছে, জেলে দিচ্ছে, নির্যাতন করছে।
• কিন্তু কেউ তো এই বলে আমাদেরকে বলছে না যে, তোমরা এদেশে আল্লাহর আইন ছাড়া আর কোন আইন চাও না, তোমরা এদেশে শুধুমাত্র ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাও। তোমরা অন্য কোন সরকার ব্যব্স্থা, জাতিসংঘ কিংবা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কোন কর্তৃত্ব মানছো না।
• আওয়ামী-লীগ এর সাথে আমাদের বেশ বৈরীতা থাকলেও অন্যান্য মানব-রচিত দলের সাথে আমাদের তেমন বৈরীতা নেই কেন? কেন বিএনপি এর মতো মানবরচিত বিধানের ধারক-বাহক দলগুলো আমাদেরকে সহ্য করছে? কেন তারা আমাদেরকে সাথে নিয়ে একসাথে আন্দোলন করছে? তারা কি ইসলামী খিলাফতের পক্ষ শক্তি? যদি আমাদের বর্তমান কষ্ট, নির্যাতন ইসলামের জন্য, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর দিকে মানুষকে ডাকার জন্য হয়ে থাকে, তাহলে তো সকল মানব রচিত মতবাদের ধারক-বাহক দলই আমাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার কথা।
• তারাও কি এদেশে ইসলামী রাস্ট্র চায়? কেন চার দলীয় ঐক্যজোটে আমাদের এমপি, মন্ত্রীকে তারা সহ্য করলো? তার মানে কি আমাদের লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর দাওয়াতে কোন ত্রুটি আছে?
• তাহলে কি ‘আমাদের লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের দাওয়াতে এমন কোন বিল্পবী ঘোষণা নেই, যা দেশে বিএনপি এর মতো জাহেলিয়াতের দলগুলো ভয় পেতে পারে?
• তাছাড়াও আসল কাফির জাতি সমূহ যেমন আমেরিকা, ব্রীটেন, ফ্রান্স, ইইউ প্রভৃতির সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক আছে কিভাবে? রাসুল (সাঃ) এর সাথে কি আবু জেহেল, আবু লাহাবদের এরকম সুসম্পর্ক ছিলো?


 

খ. অগ্নি পরীক্ষায় নিখাদ প্রমাণিত হওয়াঃ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন এই আওয়াজ উচ্চারণ করেছিলেন, তখনো ঠিক এই একই অবস্থা ও পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিলো। ঘোষক জেনে বুঝেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। শ্রোতারাও বুঝতে পারছিলো কি কথার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে! তাই এই ঘোষণার যে দিকটি যাকে আঘাত করেছে, সেই উদ্যত হয়ে উঠেছে একে নিভিয়ে দেয়ার জন্যে। পোপ ও ঠাকুররা দেখলো এ আওয়াজ তাদের পৌরহিত্যের জন্য বিপজ্জনক। জমিদার মহাজনরা তাদের অর্থ সম্পদের, অবৈধ উপার্জনকারীরা তাদের অবৈধ উপার্জনের, গোষ্ঠী পূজারীরা গোষ্ঠীগত শ্রেষ্ঠত্বের (racial supererioty), জাতি পূজারীরা জাতীয়তাবাদের পূর্বপুরুষদের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পথ ও মতের। মোটকথা এ আওয়াজ শুনে সব ধরণের মূর্তি পূজারীরা নিজ নিজ মূর্তি বিচূর্ণ হবার ভয়ে আতংকিত হয়ে উঠলো। তাই এতোদিন পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধোমত্ত থাকা সত্ত্বেও এখন সকল কুফুরী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেলো। ‘আল কুফরু মিল্লাতুন ওয়াহিদাহ’ এই নীতি কথাটি তারা বাস্তবে রূপ দিলো। এক নতুন আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে তারা সমবেত হয়ে গেলো এক প্লাটফরমে। গঠন করলো ঐক্যজোট।
আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে তো সকল মূর্তির মূজারীরা ঐক্যবদ্ধ হয়নি বরং কোন কোন ধরনের মূর্তি পূজারীরা আমাদের সাথে ঐক্য করছে?
• তার মানে কি আমাদের লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ঘোষণা সঠিকভাবে হয় নি? আমারা কি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর কোন কোন দাবীকে লুকিয়ে রাখছি? কোন কোন দাবী চেপে যাচ্ছি?
• আমাদের ঘোষণায়, আমাদের দাওয়াতে সব ধরনের অত্যাচারীরা প্রকম্পিত হচ্ছে না কেন?


 

এই অগ্নিপরীক্ষা ও চরম সংঘাতের তৃতীয় সুফল এই ছিলো যে, এর ফলে একদিকে এই বিপ্লবী কাফেলায় যারা শরীক হচ্ছিল, বাস্তব ময়দানে তাদের হতে থাকে যথার্থ প্রশিক্ষণ। অপরদিকে দিনের পর দিন প্রসারিত সম্প্রসারিত হতে থাকে ইসলামী আন্দোলন। মানুষ যখন দেখতে থাকলো, কিছু লোক দিনের পর দিন মার খাচ্ছে। নির্যাতিত হচ্ছে। তখন স্বাভাবিকভাবেই এর আসল কারণ জানবার প্রবল আগ্রহ পয়দা হতে থাকে তাদের মনে। এই লোকগুলোকে নিয়ে কেন এতো হৈ হট্টগোল? -এই প্রশ্নের জবাব পেতে উৎসুক হয়ে উঠে তাদের মন। অতঃপর তাদের অনুসন্ধানী দৃষ্টি যখন জানতে পারতো, আল্লাহর এই বান্দাগুলো কোনো নারী, সম্পদ, প্রতিপত্তি বা কোনো প্রকার ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, বরং এক মহাসত্য তাদের কাছে উন্মুক্ত হয়েছে এবং তারা তা একনিষ্ঠভাবে আঁকড়ে ধরে আছে বিধায় এভাবে তাদের অত্যাচার করা হচ্ছে, তখন স্বঃতই সেই মহাসত্যকে জানার জন্যে তাদের মন হয়ে উঠতো ব্যাকুল।
অতঃপর যখন লোকেরা জানতে পারতো, সেই মহাসত্য হচ্ছে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, আর এ জিনিসই মানব জীবনে এমন ধরনের বিপ্লব সৃষ্টি করে, এরই দাওয়াত নিয়ে এমনসব লোকেরা উত্থিত হয়েছে, যারা কেবল এই সত্যেরই জন্যে দুনিয়ার সমস্ত ফায়দা ও স্বার্থকে ভূলুন্ঠিত করছে। নিজেদের জমি, মাল, সন্তান সন্ততিসহ প্রতিটি জিনিস অকাতরে কুরবানী করছে, তখন তারা বিস্ময়ে অবিভূত হয়ে যেতো।

আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• আমরা কি সেই মহা সত্যের দাওয়াত যথাযথ ভাবে দিতে পেরেছি? লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা, এর পূর্বশর্ত, একে বিনস্টকারী বিষয়সমূহ আমরা কি জানি?
• আমরা কি মানুষকে জানিয়েছি যে, লা ইলাহা সঠিক অর্থ? ইল্লাল্লাহ এর সঠিক অর্থ?
• সেই মহা সত্যের দাওয়াত আমাদের কথায়, আমাদের লিখনীতে আমাদের আচরণে কি প্রকাশ পাচ্ছে?


 

গ. নেতা ছিলেন আদর্শের মডেলঃ
কুরাইশের লোকেরা তাঁকে হিজাযের রাজতখ্ত গ্রহণ করার প্রস্তাব দেয়। তারা বলে, আমরা আপনাকে আমাদের বাদশাহ বানিয়ে নেবো। আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীকে আপনার কাছে বিয়ে দেবো। সম্পদের স্তূপ আপনার পদতলে ঢেলে দেবো। এসব কিছু আমরা আপনার জন্যে করবো। করবো একটি শর্তে। তাহলো, এই আন্দোলন থেকে আপনাকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু মানবতার মুক্তিদূত তাদের এইসব লোভনীয় প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এইসবের পরিবর্তে তিনি তাদের উপহাস, তিরস্কার আর প্রস্তরাঘাতকেই সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেন।
আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• কই আমাদেরকে তো কেউ নিজে থেকে তাদের শিরকের বিরোধিতা বন্ধ করার শর্তে রাজতখত গ্রহণ করার প্রস্তাব দেয় নি বরং আমরা নিজেরাই হিকমাহ এর নাম করে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক শিরকের বিরোধিতা করা বন্ধ করে দিয়েছি।
• অথচ রাজতখতের বিনিময়েও প্রিয় নবী (সাঃ) সমকালীন বাতিল মতবাদের, শিরকের, কুফরের, জাহিলিয়াতের বিরোধিতা করা বন্ধ করেন নি।
• আমরা কেন গুটা বিশেক সংসদ সদস্য পদের জন্য বিএনপি এর রাজনৈতিক শিরক ও আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরোধী আদর্শের বিরোধিতা করা ছেড়ে দিলাম ?
• একই কারণে সংসদ ভবনে আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে আইন রচনা করার মতো শিরকে এখন আমরা টুঁ শব্দটিও করতে পারছি না। অথচ আমরা সবাই জানি যে, এটা শিরক।


 

এই বিপ্লবী আন্দোলনের মহান নেতা মুহাম্মদ (সা.) তাঁর আন্দোলনের ব্যাপারে নিজের দেশ, জাতি, গোত্র ও বংশের কারো স্বার্থেরই কোনো পরোয়া করেননি। আন্দোলনের ব্যাপারে কোনো স্বার্থের সাথেই তিনি আপোষ করেননি। তাঁর এই নৈতিক দৃঢ়তাই মানুষের মনে এক চরম আস্থার জন্ম দিলো যে, নিঃসন্দেহে মানুষের কল্যাণের জন্যে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে। আর এ আস্থার ফলেই প্রত্যেকটি কওমের লোক এসে তাঁর আন্দোলনের পতাকাতলে সমবেত হয়েছে। তিনি যদি কেবল নিজ খান্দানের কল্যাণ চিন্তা করতেন, তবে হাশেমী গোত্রের লোক ছাড়া আর কারোই এ আন্দোলনের প্রতি কোনো আগ্রহ থাকতো না। তিনি যদি কুরাইশদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে ব্যস্ত হতেন, তবে অকুরাইশ আরবরা তাঁর আন্দোলনে শরীক হবার কল্পনাই করতো না। কিংবা আরব জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা যদি হতো তাঁর উদ্দেশ্য, তবে হাবশী বেলাল, রোমদেশীয় সুহাইব আর পারস্যের সালমানের (রা.) কি স্বার্থ ছিলো তাঁর সহযোগিতা করার?
আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• তাহলে আমরা কোন স্বার্থে কালিমার মূল দাওয়াতকে বাদ দিয়েছি?
• আমরা কার কাছে ভালো থাকার জন্য তাগুতকে পরিত্যাগ করার দাওয়াত দিতে পারছি না?
• কার কৃপা দৃষ্টি লাভের জন্য আমরা শুধুমাত্র আল্লাহকে এক ইলাহ, একমাত্র আইন দাতা, একমাত্র বিধান দাতা হিসেবে মেনে নেয়ার জন্য মানুষকে দাওয়াত দিতে পারছি না?
• কি কারণে আমরা এদেশের মানুষকে আল্লাহ ছাড়া অন্য সকল আইনদাতা, বিধান দাতা, বিচার ব্যবস্থা পরিত্যাগ করার, অস্বীকার করার দাওয়াত দিতে পারছি না?

 

ঘ. আদর্শের কার্যকর স্বাভাবিক বিপ্লবঃ তের বছরের প্রাণান্তকর সংগ্রামের পর মদীনায় একটি ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ আসে।


আত্মজিজ্ঞাসাঃ
- এর বিস্তারিত বিবরণ মাওলানা মওদুদী এই ভাষণে দেন নি। কিন্তু এর বিস্তারিত বিবরণ কি এরকম নয়?
- আকাবার শপথ অনুষ্ঠিত হয়। মদীনার ১২ টি গোত্রের নেতারা একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের মাধ্যমে রাসুল(সাঃ) কে মদীনায় আসার আমন্ত্রণ জানায়। তারা রাসুল (সাঃ) কে নিরাপত্তা দানের প্রতিশ্রুতি দেন।
- ইবনে ইসহাক বর্ণিত, “লোকেরা বায়াতের জন্য সমবেত হওয়ার পর হজরত আব্বাস ইবনে ওবাদা ইবনে নাযলা (রাঃ) বললেন, তোমারা জানো, তোমরা কিসের উপর বায়াত করছো? সবাই বললো, হ্যা জানি। তোমরা তাঁর হাতে কালো ও লাল লোকদের সাথে যুদ্ধ করার বায়াত করছো। যদি তোমরা মনে করে থাকো, যখন তোমাদের ধন-সম্পদ বিনষ্ট করা হবে, তোমাদের অভিজাত নেতৃস্থানীয় লোকদের হত্যা করা হবে, তখন তোমরা তাঁকে পরিত্যাগ করবে, তবে এখনই তাঁকে পরিত্যাগ করো। …”- [আর রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্টাঃ ১৭৪,প্রকাশকঃ হাফিজ মুনির উদ্দিন আহমেদ]
- দেখা যাচ্ছে, এ শপথ ইসলাম গ্রহন করার শপথ ছাড়াও যুদ্ধের সম্ভাবনা মাথায় নিয়েও রাসুল(সাঃ) কে মদীনা নিয়ে যাওয়ার শপথ ছিলো। দেখুন নীচের হাদিসটিঃ
হজরত জাবের (রাঃ) বর্ণিত, “সমবেত ৭০ জন লোক বায়াতের জন্য উঠলে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী আসয়াদ ইবনে যুরারা (রাঃ) রাসুল (সাঃ) এর হাত ধরে বললেন, ইয়াসরিববাসী একটু থামো। আমরা তাঁর কাছে উটের বুক শুকানো দূরত্ব অতিক্রম করে এই বিশ্বাস নিয়ে এসেছি যে, তিনি আল্লাহর রাসুল। আজ তাকে মক্কা থেকে নিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, সমগ্র আরবের সাথে শত্রুতা, তোমাদের বিশিষ্ট নেতাদের নিহত হওয়া ও তলোয়ারের ঝনঝনানি। কাজেই এসব যদি সহ্য করতে পারো তবেই তাঁকে নিয়ে যাও। তোমাদের এ কাজের বিনিময় আল্লাহর কাছে রয়েছে। আর যদি নিজের প্রাণ তোমাদের কাছে প্রিয় হয়ে থাকে, তবে তাঁকে এখানেই ছেড়ে যাও। এটা হবে আল্লাহর কাছে তোমাদের অধিক গ্রহণযোগ্য ওযর”। [ মুসনাদে আহমদ।]
- এই আমন্ত্রণে মুসলিমরা মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় চলে যায়। সবশেষে মুহাম্মাদ স. ও আবু বকর রযি. ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনায় হিজরত করেন। বর্ণিত আছেঃ “৫ম, ১২তম, ২৬ তম দিনের জুময়া বার তিনি আল্লাহর নির্দেশে সওয়ারীতে আরোহন করেন। তখন আবু বকর (রাঃ) তাঁর পিছনে ছিলেন। কোবা থেকে রওয়ানা হওয়ার আগে তিনি তাঁর মাতুল গোত্র বনু নাযযারকে খবর পাঠান। তারা তলোয়ার সহ হাজির হয়। তাদের সাথে নিয়ে তিনি মদীনা অভিমূখে রওয়ানা হন।” -[সহীহ বুখারী, ১ম খন্ড, পৃঃ ৫৫৫-৫৬০, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃঃ ৫৫, ইবনে হিসাম, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪৯৪;রাহীকুল মাখতুম,পৃষ্টাঃ ১৯৬,প্রকাশকঃ হাফিজ মুনির উদ্দিন আহমেদ]
- তাই দেখা যাচ্ছে, রাসুল (সাঃ) এর মদীনায় গমন শুধুমাত্র এক বিশাল জন-নেতার (যাকে অধিকাংশ জনগণ পছন্দ করে) নিজ জণগনের কাছে গমন ছিলোনা, সেখানে Show of Power / Force ও ছিলো। যারা মনে করেন, দাওয়াত দানের পর অধিকাংশ জণগণকে মুসলিম বানিয়েই কেবল ইসলাম ক্ষমতায় যায়/ গিয়েছিলো, তারা এই জায়গায় একটু আবার চিন্তা করবেন, please. সব যুগেই ইসলাম দুইটি জিনিসের সাহায্যে বিজয় লাভ করেছে। তা হচ্ছে, আল-কোরআন ও তলোয়ার।
- রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “আমি আদৃষ্ট হয়েছি মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে যতক্ষণ না তারা এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন প্রকৃত ইলাহ নেই ও মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয়। তারা যদি এটা করে তবে ইসলামী আইনের ব্যাপার ছাড়া তাদের জীবন ও ধন-সমপদ আমার কাছে নিরাপদ, আর তাদের হিসাব আল্লাহর কাছে”। – সহীহ বুখারী, হাদিস নং ২৪, সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ৩৩।
- “And We brought forth iron wherein is mighty power (in matters of war), as well as many benefits for mankind, that Allaah may test who it is that will help Him (His religion) and His Messengers in the unseen” [al-Hadeed 27:25] এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেনঃ So whoever deviates from the Book is to be brought back with iron, i.e. by force. Hence the soundness of the religion is based on the Qur’aan and the Sword. It was narrated that Jaabir ibn ‘Abd-Allaah (may Allaah be pleased with him) said: The Messenger of Allaah (peace and blessings of Allaah be upon him) commanded us to strike with this, meaning the sword, whoever turns away from this, meaning the Qur’aan. [Majmoo’ al-Fataawa, 28/263]
- ইবনুল কায়্যিম (রঃ) বলেন, “আল্লাহ কিয়ামতের পূর্বে, রাসুল (সাঃ) কে পাঠিয়েছেন – পথপ্রদর্শক কিতাব (আল-কুরআন) ও বিজয়ী তলোয়ার দিয়ে, যাতে কোন শরীক ছাড়া এক আল্লাহর ইবাদত হয় এবং তাঁর রিযক তলোয়ার ও ঢালের ছায়াতলে অবস্থিত। আল্লাহ দ্বীন ইসলামকে প্রতিষ্টিত / বিজয়ী করছেন দলীল-প্রমাণ এবং ঢাল-তলোয়ারের মাধ্যমে, দুটোই একত্রিত এবং পরস্পরের পরিপূরক- আল ফুরুসিয়া (পৃঃ ১৮)
- হযরত স. এর আগমনের পর মুসলমানেরা ক্রমান্বয়ে চারদিক থেকে এসে মদীনায় জমায়েত হচ্ছিল। পূর্বের মতোই দাওয়াত বা গণসংযোগের কাজ জোরদার গতিতে চলতে থাকে।
- নবী (সাঃ) মুসলিমদের মধ্যে বিশেষ ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেন। অতঃপর শুধু মুসলিমদের মধ্যে আলাদা সহযোগিতার অংগীকার করান, এবং তাদেরকে “অন্য সকল মানুষ থেকে এক ভিন্ন উম্মতে” আবদ্ধ করেন। [আর রাহীকুল মাখতুম, ১ম সংস্করণ, পৃষ্টাঃ ২১১, প্রকাশকঃ হাফিজ মুনির উদ্দিন আহমেদ]
- তাছাড়াও তিনি ইহুদীদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। যাতে এটাও উল্লেখ ছিলো যে, (এক) বনু আওফের ইহুদীরা মুসলিমদের সাথে মিলিত হয়ে একই উম্মত হিসেবে বিবেচিত হবে। ইহুদী ও মুসলিম নিজ নিজ দ্বীনের উপর আমল করবে। … বনু আওফ ছাড়াও তাই অন্য ইহুদীরাও একই অধিকার ভোগ করবে। ......... (নয়) এ চুক্তির অন্তর্ভূক্তদের মধ্যে কোন সমস্যা দেখা দিলে বা ঝগড়া-বিবাদ হলে আল্লাহর আইন অনুযায়ী রাসুল (সাঃ) তার মীমাংসা করবেন। [ইবনে হিসাম, ১ম খন্ড, পৃঃ ৫০৩-৫০৪; আর রাহীকুল মাখতুম, ১ম সংস্করণ, পৃষ্টাঃ ২১৬-২১৭, প্রকাশকঃ হাফিজ মুনির উদ্দিন আহমেদ]
অর্থাৎ মদীনা মুসলিমদের আয়ত্বে আসার পর রাসুল (সাঃ) সেটাকে ইসলাম অনুযায়ী পরিচালনা করেন। জনগণের কোন প্রাণের দাবীর জন্য তিনি অপেক্ষা করেন নি । আর ইহুদীদের সাথে রাসুল (সাঃ) এর চুক্তিতে বিএনপি এর সাথে আমাদের জোট গঠনের সমর্থন পাওয়া যায়না। কারণ রাসুল (সাঃ) এর চুক্তি অনুযায়ী তিনি ছিলেন সর্বে সর্বা, ইসলাম ছিলো বিজয়ী, যে কোন ব্যাপারে মতভেদ-বিবাদ হলে আল্লাহর আইন অনুযায়ী তা মীমাংসা হতো আর আমাদের জোটে ইসলামের / আল্লাহর আইনের কোন অংশ নাই বরং খালেদা জিয়ার দয়ার উপর আমরা টিকে আছি। এবং অধিকাংশ সিদ্ধান্ত হয় দ্বীন ইসলামের দিকে ভ্রুক্ষেপও না করে তথাকথিত গণতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী, অথবা নিজেদের খেয়াল-খুশী অনুযায়ী, যার কোন বৈধতা ইসলামে নেই।
- রাসুল স. মদীনায় আসা এটাই প্রমাণ করে যে, মুসলিমরা মদীনার নেতৃত্ব নিয়ে নিয়েছেন। এতে শুধুমাত্র জণগণের প্রাণের দাবী থাকলে রাসুল (সাঃ) তলোয়ারসহ বনু নাযযার কে মদীনায় প্রবেশ করার সময় সাথে রাখতেন না। তাঁর এ ধরনের প্রবেশ এটাই প্রমাণ করে যে, জণগণের সাপোর্টের পাশাপাশি (অধিকাংশ জণগণ বলতে চাইলে যে কাউকে দলীল-প্রমাণ হাজির করতে হবে) শক্তি-সামর্থের মাধ্যমে মুসলিমরা মদীনার কর্তৃত্বে আসেন। স্বভাবতই রাসুল (সাঃ) হন, তাদের নেতা / আমীর / খলিফা।


 

তাদের মধ্যে এমন সব শাসনকর্তার আবির্ভাব ঘটে, যাদের কোনো প্রাসাদ ছিলনা। বরঞ্চ তারা জনগণের সাথে বসবাস করতেন এবং তাদের মতো সাধারণ কুটীরেই বাস করতেন। পায়ে হেঁটে হাটবাজারে যেতেন। দরজায় দ্বাররক্ষী রাখতেন না। রাত দিন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে যে কেউ যখন ইচ্ছা তাদের সাথে সাক্ষাত করতে পারতো। তাদের মধ্যে এমন সব ন্যায়পরায়ণ বিচারপতির আবির্ভাব ঘটে, যাদেরই একজন জনৈক ইহুদীর বিরুদ্ধে স্বয়ং খলীফার দাবী একারণে খারিজ করে দেন যে, খলীফা স্বীয় গোলাম এবং পুত্র ব্যতিত আর কাউকেও সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করাতে পারেননি।
আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• আমাদের মধ্যে কি সেই গুনগুলি আছে? এহতেসাব করার সুযোগ কাগজে –পত্রে থাকলেও বাস্তবে সংগঠনের কোন পলিসির বিরোধিতা করে কি কোন রোকন / কর্মী টিকে থাকতে পারে?
• হজরত উমার (রাঃ) জুমুয়ার নামাযে গনীমাতের ২টি কাপড় ব্যব্যহার করতে দেখে, সাহাবী সবার সামনে প্রশ্ন করে বসেন। এবং উমর (রাঃ) আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে সেই সাহাবীর অভিযোগের জবাব দেন। আমাদের ইসলামী আন্দোলনের কোন পলিসিকে কি অপেনলি আলোচনা করা যায়? এর বিপক্ষে কি সবার সামনে আলোচনা করার সুযোগ পাওয়া যায়?


 

সংযোজন
ঈসা (আঃ) বলেছেনঃ
“আমি দুনিয়াতে শান্তি দিতে আসিয়াছি, এই কথা মনে করিওনা; আমি শান্তি দিতে আসি নাই। বরং মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করাইতে আসিয়াছি; ছেলেকে পিতার বিরুদ্ধে, মেয়েকে মায়ের বিরুদ্ধে, বউকে শ্বাশুড়ির বিরুদ্ধে দাঁড় করাইতে আসিয়াছি। নিজের পরিবারের লোকেরাই মানুষের শত্রু হইবে।”

আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• আমাদের বর্তমান দাওয়াতে কি মানুষের বিরুদ্ধে মানুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে? ছেলে-পিতার বিরুদ্ধে, ভাই ভাই এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে? আমাদের দাওয়াত ও কর্মপদ্ধতি অনুসরণের কারণে কি সমাজ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে?
• যদি আমাদের কর্মপন্থা তাই হয়, তবে কেন আমরা আমাদের কর্মপন্থাকে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি নাম দিতে চাচ্ছি?
প্রকৃতপক্ষে সমকালীন প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অর্থই হলো, সমস্ত বিপদ মুসীবতকে নিজেদের উপর ডেকে আনা। এ মহান কাজের জন্যে যারা উত্থিত হবে, তাদেরকে এক থাপ্পড় খেয়ে আরেক থাপ্পড়ের জন্যে অবশ্যি প্রস্তুত থাকতে পবে। জামা হাতছাড়া হলে চোগা হারাবার জন্যেও প্রস্তুত থাকতে হবে। সমকালীন জীবিকার ভান্ডার যাদের মুষ্টিবদ্ধে, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আবার তাদের থেকে অন্ন বস্ত্র লাভ করার আশা করা যেতে পারে না। তাই কেবল সেই ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম, যে এসব উপায় উপকরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে, কেবল এক আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়ে যাবে।
আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• আমরা কি সমকালীন সমাজ ও রাস্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছি? নাকি সমকালীন সমাজ ও রাস্ট্র ব্যবস্থার রক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করছি?
• আমরা কেন প্রতিনিয়ত বলে বেড়াচ্ছি আমরা একটি গণতান্ত্রিক দল? কেন আমরা নিজেদেরকে শুধুমাত্র একটি কল্যাণ রাস্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় বলে দাবী করছি?
• কেন আমরা পরিস্কারভাবে বলতে চাই না, বলতে পারছিনা যে, আমরা শুধুমাত্র একটি ইসলামী রাস্ট্র, খিলাফাত ব্যবস্থা চাই?


 

এভাবে কোনো একটি দিক থেকেও কোনো প্রকার প্রস্তুতি ছাড়াই যারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে, তাদের মন মস্তিষ্কে যে ইসলামী রাষ্ট্রের কোনো ধারণাই বর্তমান নেই, তাতে কোনো প্রকার সন্দেহ থাকতে পারেনা।
কেউ কেউ এমন অসার পরিকল্পনাও পোষণ করেন যে,অনৈসলামী ধাঁচে হলেও একবার মুসলমানদের একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাক। পরে ধীরে ধীরে শিক্ষা ব্যবস্থা ও নৈতিক চরিত্র সংশোধনের মাধ্যমে সেটাকে ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা যাবে। কিন্তু ইতিহাস, রাষ্ট্র বিজ্ঞান এবং সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কে সামান্য যা কিছু অধ্যয়ন করেছি, তার ভিত্তিতে আমি বলতে চাই, এ অসার কল্পনার কখনো বাস্তব রূপ লাভ করা সম্ভব নয়। এ অবাস্তব কল্পসা যদি বাস্তব রূপ লাভ করে, তবে আমি মনে করবো সেটা এক অলৌকিক কাজ। একথা আমি আগেও বলেছি, রাষ্ট্র ব্যবস্থা সমাজ জীবনের গভীর তলদেশ পর্যন্ত শিকড় গেড়ে থাকে।
তাই যতক্ষণ না সমাজ জীবনে বিপ্লব সাধিত হবে, ততোক্ষণ পর্যস্ত কোনো কৃত্রিম পদ্ধতিতে রাষ্ট্র বিপ্লব সাধন করা সম্ভব নয়। হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীযের মতো বিরাট যোগ্যতা সম্পন্ন শাসক পর্যন্ত এ পন্থায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর পক্ষে একটি বিরাট সংখ্যক তাবেয়ী এবং তাবে তাবেয়ীর সমর্থক থাকা সত্ত্বেও তিনি যে এ উদ্যোগে ব্যর্থ হলেন, তার কারণ হলো, সামগ্রিকভাবে তখনকার সমাজ এ পরিবর্তন ও বিপ্লবের জন্যে প্রস্তুত ছিলোনা। মুহাম্মাদ তুঘলক এবং আলমগীরের মতো শক্তিশালী বাদশাহগণ নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে উন্নত দ্বীনদারীর অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো প্রকার পরিবর্তন ও বিপ্লব সাধন করতে পারেননি। খলীফা মামুনুর রশীদের মতো পরাক্রমশালী শাসক পর্যন্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন করা তো দূরের কথা, তার বাহ্যিক রূপটিতে সামান্য পরিবর্তন করতে চেয়েও ব্যর্থকাম হন। এ হচ্ছে সে সময়কার অবস্থা, যখন এক ব্যক্তির শক্তি ও ক্ষমতা অনেক কিছুই করতে পারতো। এমতাবস্থায় গণতান্ত্রিক নীতির উপর যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হবে, এই বুনিয়াদী পরিবর্তন সংশোধনের কাজে তা কি করে সাহায্যকারী হতে পারে? একথা কিছুতেই আমার বুঝে আসে না।
আত্মজিজ্ঞাসাঃ
• তাহলে আমাদের বর্তমান সরকার ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির হওয়ার পরও কেন আমরা ঐ পদ্ধতিতেই ইসলাম কায়েম করার চেষ্টা করছি? এভাবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে কি এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে কোন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠীত হয়েছে? ইসলামের ইতিহাসে কি এরকম কোন উদাহরণ আছে? আমরা তাহলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম কায়েমের স্বপ্ন দেখছি কেন, শ্রদ্ধেয় মাওলানা মওদুদী (রঃ) এর মতো আমারও ‘তা আমার বুঝে আসে না’।]

 

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা তো সেইসব লোকদের হাতেই আসবে, যারা ভোটারদের সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হবে। ভোটারদের মধ্যে যদি ইসলামী চিন্তা ও মানসিকতাই সৃষ্টি না হয়, যথার্থ ইসলামী নৈতিক চরিত্র গঠনের আগ্রহই যদি তাদের না থাকে এবং ইসলামের সেই সুবিচারপূর্ণ অলংঘনীয় মূলনীতিসমূহ তারা মেনে চলতে প্রস্তুত না হয়, যেগুলোর ভিত্তিতে ইসলামী হুকুমাত পরিচালিত হবে, তবে তাদের ভোটে কখনো খাঁটি মুসলমান নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে আসতে পারবে না। এ পন্থায়তো কেবলমাত্র ঐসব লোকেরাই নেতৃত্ব হাসিল করবে, যারা আদমশুমারী অনুযায়ী মুসলমান বটে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মনীতি এবং কর্মপন্থার দিক থেকে তাদের গায়ে ইসলামের বাতাসও লাগেনি।
[বাস্তব অবস্থা যদি এই হয় এবং বাস্তব অবস্থা যে তাই বরং আরো খারাপ, ডিজিটাল ভাবে চুরি করেও সরকার গঠন করা যায়, ভোট কিনেও সরকার গঠন করা যায়, তাহলে গনতান্ত্রিক পদ্ধতিকে কোন যুক্তিতে ইসলাম কায়েমের একমাত্র পদ্ধতি বলছি? তবে কি আমরাও প্রয়োজনে টাকা দিয়ে ভোট কিনতে রাজী আছি? ইসলামে কি এভাবে টাকা দিয়ে, সুবিধা দিয়ে ইসলাম কায়েমের সুযোগ আছে?]



=========================