JustPaste.it

ভারত ভাঙ্গতে আর কতদেরি?

-ফারুক আব্দুল্লাহ

==============================================================

          আধুনিক সমাজ বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বিশ্ব বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে খালদুনের মতে প্রতি পঞ্চাশ বছর পর যে কোন রাষ্ট্রের কাঠামো ও চরিত্র পরিবর্তিত রূপ গ্রহণ করে। স্বাভাবিক রাষ্ট্র সাধারণত তিন পুরুষ বা ১২০ বছরের অধিক স্থায়ী হয় না। সমাজ সংহতি বা মানবের ঐক্যবোধই রাষ্ট্রশক্তির মূলভিত্তি। এই ঐক্যবোধ যত শিথিল হয় রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হবে।

          বিশ্ব অঙ্গনে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও সাম্প্রতিক ভাঙ্গা-গড়ার অতি সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে তার এই মতের যথার্থতা উপলব্ধি করা যায়। বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন ৭০ বছরের মাথায় ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়েছে। মর্শাল টিটোর সুযোস্লাভিয়া আজ খণ্ড-বিখণ্ড, চেকোস্লাভিয়া দুই ভাগ হয়ে যাচ্ছে, দুই জার্মানি ও দুই ইয়ামেন এক হয়েছে, দুই কোরিয়া এক হওয়ার পথে।

ইরান, আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, আলবেনিয়া, রোমানিয়ার পুরানো শাসন কাঠামোই পরিবর্তন ঘটেছে। বলতে গেলে চলতি দশকের শুরুতেই  বিশ্ব ব্যাপি ভাঙ্গন ও পরিবর্তনের হাওয়া এত জোরালো ভাবে প্রভাবিত হচ্ছে যে মানচিত্রকাররা দিশেহারা হয়ে পড়ছে। তারা চিন্তায় হিমশিম খাচ্ছে এই ভেবে যে আজ তারা যে মানচিত্র আঁকছে! আগামী দিন সে মানচিত্র বহাল থাকবে কিনা!

          সোভিয়েত ইউনিয়নের এককালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ভারতের নেতা ও নীতিনির্ধারক বুদ্ধিজীবী সকল মহল সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাপী ভাঙ্গনে ও পরিবর্তনের স্রোতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব হতাশা ও সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। ২৫ টি রাজ্য ২৫০টির বেশী ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ও ৪০ টি ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে গড়া বিশাল ভারতের অসংখ্য সমস্যা তাদের বুকে বারবার ভারত টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার গ্রীন সিগনাল বাজাচ্ছেন। ভারতমাতার সেবক পুত্রদের এখন ত্রাহি মধুসূদন দশা।

          সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ভারতের এককালের বৈদেশিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সিংহভাগ যোগানদাতা। কিন্তু সোভিয়েতের অকালে শ্মাশান যাত্রায় ভারতের সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে। সোভিয়েতের অর্থনীতি এখন দুর্ভিক্ষ ও দেহ ব্যবসায় পরিণত হওয়ায় ভারতকে তড়িঘড়ি করে তার পণ্যের নতুন বাজার খুঁজতে হচ্ছে। ফলে ভারতের রুপি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালের জার্মানির মার্কের ন্যায় কেবল ঊর্ধ্বগতিতে পেয়ে বসেছে। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। বিশ্ব শিশু শ্রমিকদের এক চতুর্থাংশ ভারতে বিশাল জনসংখ্যার মাত্র ১৯% শিক্ষিত। সর্বোপরি ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এত নাজুক যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও বলেছেন যে কংগ্রেসের সদস্যরা আমার হাত পা রেখেছে অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। পন্ডিত জওহার লাল নেহেরু একসময় ভারতের সমস্যার পাহাড় দেখে ভীত হয়ে বলেছিলেন। এ দেশে যত মানুষ ততটা সমস্যা রয়েছে। ভারতের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে সাম্প্রতিক শেয়ার কেলেঙ্কারি এছাড়া ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হলো পর্যটন অধিকাংশ পর্যটন স্পটগুলো বর্তমানে সংঘাত বিক্ষুব্ধ কাশ্মীর অবস্থিত। সংঘাতের কারণে পর্যটকরা সে দিকে ভুলেও ফা বাড়ায় না। কাশ্মীরের ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানে ৮০ লক্ষের মত পর্যটকের আগমন ঘটত। কিন্তু জঙ্গি হিন্দুদের কর্তৃক বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা এই সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কারণে চলতি পর্যটন মৌসুমে বিদেশি পর্যটকরা ভারতকে এড়িয়ে যাচ্ছে। এটা বর্তমানে ধ্বসেপড়া ভারতের অর্থনীতির উপর "মড়ার উপর খাড়ার ঘা" এর চেয়েও বড় আঘাত।

          ভারতের জন্মলগ্ন থেকে বিভিন্ন রাজ্যের বিচ্ছিন্নতা আন্দোলন অস্তিত্বের উপর মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করেছে। এই মুহূর্তে ভূস্বর্গ কাশ্মীরে স্বাধীনতা আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভারত রাজ্যটি নিজের ভূখণ্ডের অংশ বলে দাবি করলেও ৬ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করেও রাজ্যটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। ভারতের বুদ্ধিজীবী মহল থেকেও রাজ্যটির ভবিষ্যৎ রাজ্যের জনমতের উপর ছেড়ে দেওয়ার দাবি উঠেছে। স্বাধীনতাকামীদের দমন করার জন্য সরকার প্রতিদিন কোটি কোটি রুপি ব্যয় করছে। সৈন্যরা সামরিক ঘাঁটিতে করে প্রতিদিন স্বতন্ত্র উপত্যকায় যাচ্ছে। আর আসার সময় লাশ বুঝাই করে নিয়ে আসছে। সম্প্রতি আফগানিস্তানের মুজাহিদদের বিজয়লাভ কাশ্মীরে মুজাহিদদের বাড়তি মনোযোগ দিয়েছে আকাশ মিনি মুজাহিদরা আফগানিদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে এবং তাদের ঝুলিতে রয়েছে পরাশক্তি রাশিয়ার ফৌজদের পরাজিত করার অভিজ্ঞতা। সুতরাং ভারতের মানচিত্র অঙ্কনের সূচনা এই কাশ্মীরি থেকে যেকোনো দিন উদ্বোধন করা হতে পারে।

          বিচ্ছিন্নতা আন্দোলনে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য পাঞ্জাবও। এই আন্দোলনের কারণে এ পর্যন্ত যত পরিমাণ রক্ত ঝরেছে তা দুবার সংঘটিত পাক-ভারত লড়াইয়েও ঝরেনি। এক মাত্র ১৯৯১ সালেই এখানে ১৭ হাজার লোক নিহত হয়েছে। অত্যন্ত তীব্র গতিতে এখানে স্বাধীন খালিস্তান গঠনের আন্দোলন চলছে। এককালের রাজভক্ত নামে খ্যাত শিখরা আজ জীবনের বাজি রেখে রাজশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে।

          কাশ্মীরি ও পাঞ্জাবের দেখাদেখি আসামের উলফা ও বোডো স্বাধীনতাকামীদের গেরিলা তৎপরতাও ভারতের প্রশাসনের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছে। ভারতের অধিকাংশ কয়লা চা আরো বহু মূল্যবান খনিজ সম্পদে এই রাজ্যটি থেকে আহরিত হয়। কিন্তু আসামে উন্নয়নের কোন চাপ না থাকায় গেরিলারা আসামের স্বাধীনতার দাবি করেছে। তারা রাজ্যটিতে হাজার হাজার কেন্দ্রীয় পুলিশ ও লক্ষ লক্ষ সেনা মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও বন্ধ ধর্মঘট ডেকে রাজ্যের জাতীয় উৎপাদনের চাকা সচল করে দিচ্ছে। আর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে কেন্দ্রীয় অর্থ ব্যবস্থার উপর।

          ভারতের প্রশাসন উচু বর্ণের হিন্দুদের দখলে। তারা রাষ্ট্রের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা একতরফা নিচু জাতের হিন্দুদের বঞ্চিত করে ভোগ করছে। নিচু জাতের হিন্দুরা সেদেশে নির্যাতিত অবহেলিত। অধিকারহারা আজও একজন ব্রাহ্মণ যে রাস্তায় যাতায়াত করে সে মন্দিরে পুজো দেয়। তার সন্তান যে স্কুলে লেখাপড়া করে সেখানে একজন শূদ্র বা তার ছেলের প্রবেশের অধিকার নেই। সভ্যযুগে সেই আদিম বর্ণবাদীর প্রথার জ্বলন্ত প্রমাণ ভারতের বিহার রাজ্যে। সর্বত্র এই প্রথা থাকলেও বিহারে হরিজন ও বর্ণহিন্দু সংকট প্রকট ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রে বর্ণহিন্দুদের কর্তৃক হরিজন হত্যা ও নির্যাতনের ১৭ হাজার ঘটনা ঘটেছে। এখানে সাম্প্রদায়িক অবস্থা নাজুক যে হরিজনদের সংগঠন এম সি সি ও বর্ণহিন্দুদের সংগঠন সুরন মুক্তি ফৌজের কর্মীদের মধ্যে প্রতিদিনই দাঙ্গা খুন গুমের ঘটনা ঘটছে। ইবনে খালদুনের মতে রাষ্ট্র শক্তির মূল সমাজ সংহতির ছিটেফোঁটাও এখানে অবশিষ্ট নেই। যেমনি নেই ভারতের কোথাও।

          এসমস্ত আন্দোলনের পাশাপাশি উত্তর ভারতের বিহার পশ্চিমবাংলা ও উড়িষ্যা প্রদেশের ১৫ টি জেলা নিয়ে ঝাড়খন্ড রাজ্যের দাবিতে চলছে ঝাড়খন্ড আন্দোলন। বন্ধ হরতাল ও সন্ত্রাসী ঘটনায় রেল লাইনে, ব্রিজ, রাস্তা ও কয়লাখনি বন্ধ হচ্ছে অহরহ। একই প্রক্রিয়ায় গুর্খা নেতা সুভাষ ঘিসিং এর নেতৃত্বে গুর্খারা পৃথিবীর বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র ও স্বাস্থ্যকর স্থান দার্জিলিং জেলায় চালাচ্ছে পৃথক গুর্খা রাজ্য গঠনের আন্দোলন। ত্রিপুরায় এ,টি,টি,এফ গেরিলারা ত্রিপুরাকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে আন্দোলনের অংশ হিসেবে পুলিশের উপর হামলা চালাচ্ছে। স্বাধীনতাকামীদের গেরিলা আক্রমণ এর জন্য মনিপুর ও নাগাল্যান্ড পার্বত্য রাজ্য দুটির পরিস্থিতিও বেশ উত্তপ্ত। তামিলনাড়ুতে তামিল স্বশস্ত্র গেরিলাদের তৎপরতার জন্য সেখানের জনজীবনও প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।

          ভারতের প্রাণ ও সবচেয়ে বেশি লোক অধ্যুষিত (১৮ কোটি) ইউপিতে একটি নতুন প্রজাতন্ত্রের আন্দোলন চলছে। ইউপির আটটি জেলা আলমুডা, নৈনিতাল, পতুরাঘর, চামুলী, দাহরাদুন, উত্তরকাশী ও পুরা গাঢ়ওয়াল নিয়ে এ নতুন প্রজাতন্ত্র গঠনের দাবি উঠছে। মজার ব্যাপার ইউপির বিজেপি সরকার [বর্তমানে বরখাস্তকৃত] কেন্দ্রীয় সরকারকে কোণঠাসা করার জন্য এই আলোক প্রজাতন্ত্রের দাবি মেনে নিয়ে প্রজাতান্ত্রিক এসেম্বিলিতে  একটি বিল পাশ করে নেয়। হিন্দুপ্রধান হরিয়ানা ও শিখ প্রধান  অঞ্জলের মধ্যে কুরুক্ষেত্রের সম্পর্ক, করনাটক ও তামিলনাড়ু রাজ্যের মধ্যে কাবেরী নদীর পানি বন্টন নিয়ে তিক্ত উত্তেজনাকর সম্পর্ক ভারতীয় রাষ্ট্রনায়কদের হিষ্টিরিয়াগ্রস্ত করে তুলেছে। তারা আজ দিশেহারা। সমগ্র ভারত খুঁজেও বিচ্ছিন্নতা নিরাময়ের তারা কোন মহা ঔষদ খুঁজে পাচ্ছেনা। ভারতের এই দুর্দিনে তার সাথে গলাগলি বাঁধতে এসেছে বিশ্ব বেনিয়ার আমেরিকা। সোভিয়েতের পতনের পূর্বেও এই আমেরিকা সোভিয়েতের সাথে গলায় গলায় ভাব গড়ে তুলেছিল। তলে তলে আসল কাজটি সেরে সরে পড়েছে। এখন তার টার্গেট চীন ও ভারত। বিশ্বে সে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার নিজের পছন্দমত ভৌগলিক সীমারেখা নির্ধারণ করার এক খেলায় মেতে উঠেছে। এই চক্রান্তের অংশ হিসেবে সে সোভিয়েতের ন্যায় বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। ভিতর থেকে ভারতকেও ভাঙতে চাচ্ছে, বাবরি মসজিদ সম্পর্কিত পরবর্তী পরিস্থিতির উপর আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে সে ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ইন্ধন জুগিয়ে একে একটা চূড়ান্ত রূপ দেয়ার মাধ্যমে ভারতকে ভাঙতে চায়।

          বর্তমান ভারতীয় কংগ্রেস সরকার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পরিবর্তিতে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরপেক্ষভাবে দেশের স্বার্থ রক্ষার মনোবৃত্তি নিয়ে নিয়ন্ত্রণ না করলে এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে নির্মূল করতে ব্যর্থ হলে ভারতের পরিণতি ত্বরান্বিত হবে। কেননা মুসলমানরা এমন একটা জাতি যাদের আঘাত করলে চুপ করে থাকে না বরং তাদের চেতনা আরো শানিত হয়। চকচকে তকতকে মসজিদের জীর্ণ ও ভাঙ্গা মসজিদই তাদের বেশি শক্তি যোগায়। এজন্য আফগানের মধ্যে এশিয়ার আলবেনিয়ার পূর্ব ইউরোপের বন্ধ ও ভাঙ্গা মসজিদ গুলো বেশি দিন বিরান হয়ে থাকে নি। মুসলমানরা বেশিদিন সমাজগর্ভে মুখ লুকিয়ে থাকে নি। সুতরাং ভারতের মুসলমানদের উপর যে আঘাত হানা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও যদি তা অব্যাহত থাকে তবে তারাও যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জেগে ওঠা মুসলমানদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে ভারতের বুকে আরোও একটি স্বাধীন মুসলিম আবাসভূমির দাবি করবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? জাতিগত সংঘাত ও বিচ্ছিন্নতা নামক রোগ যেভাবে ভারতের গায়ে মহামারীর মত ছড়িয়ে গেছে যে কোন মুহূর্তে সকল অসন্তোষ একত্রিত হয়ে ধৈত্যের মত ঝাপিয়ে পড়ে ভারতের মানচিত্র পাল্টে দিবেনা এমন আশঙ্কা কি তুড়ি মের উড়িয়ে দেয়া যায়?